Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
আরো বারো – সত্যজিৎ রায়
আরো বারো – সত্যজিৎ রায়
0/88
আরো বারো – সত্যজিৎ রায়

হরিধন অনেক ভেবেচিন্তে উস্কোখুস্কো চুলগুলোয় উকুনের সন্ধান করতে করতে বলে—

—আজ্ঞে ওই যা বল্লাম বারো টাকা, এর কমে কিছুতেই হবে না?

হরিধন-এর মুখে ওই সঠিক দরের হিসাব শুনে লোকটা বলে সে কি হে? হরিধন-এর সংসার ফুটপাথেই।

একটা অযত্নে গড়ে ওঠা ছাতিম গাছ তার মতই বিবর্ণ ধূলিধূসর। পাতাগুলোয় চেকনাই নেই। ওর মধ্যেই আবার দু-তিনটে কাকদম্পতি বাসা বেঁধেছে। তাদের বাসা থেকে খড় কুটো শুকনো বিষ্ঠাও পড়ে হরিধনের আদুড় খড়িওঠা পিঠে। হরিধনের এ-সব নিয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

মাঝে মাঝে শুধু চীৎকার করে—

—হেই-ই

পরক্ষণেই খদ্দেরের কথায় বলে হরিধন—আজ্ঞে খড় কাঠির দাম বেড়েছে, সুতলির দাম তো আকাশছোঁয়া। তায় বড় মানুষের মাল বানাতে হবে। বলেন খটা পড়বে না? তাও কম বলেছি। খদ্দের ভদ্রলোক এদিক ওদিকে চাইল। কলকাতায় জনস্রোত বয়ে চলেছে, বাস ট্রাম চলছে। লোকজনের ভিড়েরও কমতি নেই। একটু পরেই শুরু হবে খেল। তার দল এর মধ্যে দূরে কোন পার্কে জমায়েত করছে লোকজনদের। তারা এর মধ্যে ফেস্টুন লাঠির ডগে ফ্লাগ-টল্যাগ নিয়ে শোভাযাত্রা করে এদিকে আসবে।

বর্তমানে এসপ্লানেডের এই দিগকার রাস্তাটা পরিণত হয়ে ওঠে সভাস্থলে। ওখানে তাদের দল এসে জুটবে রং-বেরং এর পতাকা সাজসজ্জা নিয়ে। পুলিশও রীতিমত সেজেগুজে ঢাল নিয়ে এসে দাঁড়াবে ওদিকে। গুপীনাথের দল অবশ্য ওদের আদৌ ঘাঁটাবে না। তার দলের নির্দেশও সেই রকম, ওরা দাঁড়িয়ে থাকবে, এরা থাকবে এদিকে।

আর শ্লোগান অর্থাৎ বাক্যযুদ্ধ চলবে। অফিস যাত্রীদের ভিড় জমবে, নাকাল হবে তারা। তারপর প্রেসের লোকজন এসে ছবি তুলবে, গলায় মালা দিয়ে ওদিকে গরম গরম লেকচার দিয়ে কারোর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে।

তারপর খেল খতম।

সেদিনের মত যে যার বাড়ির পথ ধরবে।

হরিধনের বাজার এখন বেশ চড়া।

পুজোর আগে বাজার চড়ে। মিটিং, প্রশেসন-এর ভিড় বাড়ে। আর ছুতো-নাতায় দেশ-বিদেশে সব বড় মানুষের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

হরিধন এখন কোন সাহেবের কুশপুত্তলিকা গড়ছে।

স্বদেশে? কোথায় সে কোন নাগরিকদের উপর কি করেছে, এখানে দল হঠাৎ ক্ষেপে উঠে তাদের এমব্যাসির সামনে দাহ করবে সেই সাহেবের কুশপুত্তলিকা।

মরগে তোরা। হরিধন বাঁশের ডগায় তখন খড় আর সুতলি পেঁচিয়ে সাহেব বানাতে ব্যস্ত।

এদিকে গুপী শোনায়—তাহলে পুরো দশই কর হরিপদ, কত কুশপুত্তলিকা নিই বল তোর কাছে?

হরিধন তা জানে।

গুপীনাথ-এর কত দল কে জানে। হপ্তায় দু-তিনটে মাল তো নেয়ই। আর তার দরও আলাদা।

হরিধনের হাতে দশ টাকা দিয়ে বলে গুপী—

—এটাতে মার্জিন থাকবে না রে। করে দে খুব সিম্পল করে বানিয়ে দে। বৈকালে আসছি, নিয়ে যাবো।

হরিধন বলে—দু’দিন আগে অর্ডার না দেলে মাল দেবে কেমনে? দেখছনি কত মাল-এর অর্ডার লাগছে—

গুপী এবার পকেট থেকে মোড়কটা বের করে।

হরিধনের নজরও পড়েছে তাতে। জোঁকের মুখে যেন চুন পড়েছে।

গুপী বলে—নে, খাস নেপালের জিনিস। এক নম্বর?

টেনেটুনে মৌজ করে হাত লাগা।

—তাহলে এসো বৈকালে তবে ডেরেস নি আসবে। কি ডেরেস পরাবে তোমরাই জানো। অর্থাৎ মূর্তি কি করবেন সেটা ওদেরই দিতে হবে।

গুপী চলে যেতে হরিধন এবার হাঁক পাড়ে।

—কচি। এ্যাই কচি—

মেয়েটা ওদিকে বসে সুতলির তাল পাকাচ্ছিল। ওসব সংগৃহীত হয় কলকাতার রাস্তা থেকে। ভোটের সময় হলে তো কথাই নেই। ফেষ্টুন রঙীন কাগজ-এর সাজগোজ করে সুতলিতে বেঁধে রাস্তা গলি ছেয়ে ফেলে।

কাগজ কুড়োনোর দল কাগজ আর সুতলির তাল টেনে-টুনে আনে, এখানেই ঝেড়ে দেয় নামমাত্র মূল্যে।

হরিধন জানে কচির মেজাজ।

মেয়েটাকে দেখছে ক বছর ধরেই। পথেই পেয়েছিল ওকে।

তেজী। ফণা তোলা মেয়ে। হরিধনের চোখে পড়েছিল কচি।

গঙ্গার ধারে থাকতো মেয়েটা ওর বাপ-মায়ের সঙ্গে। গঙ্গামাটি বেচত কুমারটুলি এলাকায়।

হরিধন তখন কুমারটুলিতে কাজ করে পটো পাড়ায়। পুরো নাম হরিধন পাল। তখন হরিধন সবে এসেছে ঘূর্ণি থেকে, জাত ব্যবসার কাজও শিখেছে। পটো পাড়ায় কুমুদ পালের ওখানে কাজ ধরেছে। মাটে ছানা-খড়ে মেড় বাঁধা। মেড়ের জন্য গরাণ ডাল আসে বাদাবন থেকে, সেই সব কাঠ সাইজ মত করে খড় জড়িয়ে সুতলি বেঁধে প্রতিমার কাঠামো তৈরি করতে হয়। বুড়ো কুমুদ পাল বলে মূর্তির আসল হলো এই খরের মেড়, পুত্তলিকা। এর উপরই এই ছাদে মাটি দিয়ে সব হবে। মেড় বাঁধতে শেখ বাপধন। সব হবে!

মেয়েটাও মরসুমের সময় পটোপাড়ায় ফুরোণে গা গতর নেড়ে মাটি ছানতো, খড়-তুষ মিশিয়ে মাটি বানাতো। খড় সাইজ করে দিত মেড় বাঁধার জন্য। আর ওই করতে গিয়েই তাদের দু-জনের পরিচয়টা হয়।

ক্রমশ জমে ওঠে দু জনে।

হরিধন বলে তুই বড় সোন্দর রে। ওস্তাদের হাতে পিতিমের মতন পান পাতা সাইজে মুখখানা তোর। আর মুখে যেন ঘামতেল লাগানো। চকচকে— হাসতো কচি—

বলে—তা সোন্দর হলে তো দেখতে গো?

পথের মেয়েটাও মনে মনে চেয়েছিল ঘরের ঠিকানা।

হরিধন তখন মেড় গড়তে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। দুর্গা-কালী-সরস্বতী মায় অসুর-জগদ্ধাত্রী সব কিছুরই মেড় বাঁধছে। পয়সাও পায় কিছু।

কচির কথায় বলে সে।

—দেখতে তো চাই রে।

হাসে কচি—তাই নাকি। কিন্তু দেখতে গেলে যে খটা লাগে গো। আর বাপু ভেসে বেড়াতে চাই না।

হরিধনও স্বপ্ন দেখে। নোতুন ঘর বাঁধার স্বপ্ন।

—কচির ঘেন্না ধরে গেছে।

তাই নোতুন করে বাঁচার জন্যেই হরিধনকে কাছে পেতে চায়। হরিধন-এর কথাগুলো শুনছে সে স্বপ্নরঙীন মন দিয়ে। সেও স্বপ্ন দেখে।

—সত্যি বলছো কারিগর?

হরিধন বলে—হ্যাঁ রে।

তবু কচির সন্দেহ যায় না। মানুষকে সে বিশ্বাস করে না। করতে পারে না।

বলে কচি—

—শেষমেশ গাং-এ ডোবাবে না তো গো?

হরিধন বলে এবার মরসুমের পরই দেখবি ঘর নিচ্ছি।

কিন্তু ব্যাপারটা ওদের অনেকের চোখে পড়ে যায়।

যায়।

আড়ালে-আবডালে অনেকে অনেক কিছুই করে। তাই বলে ঠাকুরের মূর্তি গড়ার চালাতে পটোপাড়ার আটনে এমনি অনাচার চলতে দিতে চায় না ওরা।

কুমুদ পাল সেদিন গর্জে ওঠে।

—কুমোরের ঘরের ছেলে হয়ে কারিগর হয়ে তুই একটা পথের মেয়ের সঙ্গে কি করিস রে? আর কুমুদ সেদিন ওই মাটিছানা কচির চুলের মুঠি ধরে গর্জায়—নষ্টামির জায়গা পাসনি?

মেয়েটা কাঁদছে।

গর্জে ওঠে হরিধন—ওকে মারবা নাই ওস্তাদ।

কুমুদ পাল বাধা পেয়ে এবার হাতের গরাণ শূলো উঠিয়ে সপাটে মারতে যায় হরিধনকেই।

কুমুদ পাল হরিধনকেই ধরেছে এবার মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে। কিন্তু বলিষ্ঠ হরিধনের হাতের ধাক্কায় বুড়ো কুমুদ ওই ছানা কাদার মধ্যে পড়ে যায়। সর্বাঙ্গে কাদা মাখা, মেয়েটাও ওস্তাদের এই হাল দেখে হাসছে।

পটোপাড়ার আরও দু-চার জন জুটে গেছে। তারাই এবার কুমুদ পালের মত প্রবীণ কারিগরের ওই ছেলেটার হাতে এমনি হেনস্তা দেখে এগিয়ে আসে।

হরিধনকে তারাই বেশি করে শাসায়—বেরো। ফের কোনদিন এ পাড়ায় দেখলে জান খেয়ে নোব।

হরিধনকে ওরা বেশ যুৎ করে পিটিয়েছে। মুখ কপাল ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে তুলেছে। বের হয়ে আসে হরিধন।

এতদিনের তার আশ্রয়, কারিগর হবার স্বপ্ন সব হারিয়ে যায়। কোথায় যাবে জানে না। এতবড় কলকাতা শহরে তার আপনজন, আশ্রয়, কোথাও কিছু নেই। রাতে আহত হরিধন এসে আশ্রয় নেয় পার্কের একটা বেঞ্চে। গা হাতে পায়ে ব্যাথা। কপাল মাথা টনটন করছে।

হঠাৎ কার ডাকে চাইল।

—কচি! তুই!

মেয়েটা তার জন্যে শালপাতায় মোড়া কখানা রুটি আর মাটির ভাড়ে একটু তরকারী এনেছে কোন হোটেল থেকে।

বলে কচি—দিনভোর কিছু খাওনি। এটা খেয়ে নাও!

ওঠো!

কচির কথায় উঠে বসল হরিধন।

কচি বলে—এমনি করে মারলো ওরা কারিগর?

—কারিগর!

—ওসব স্বপ্ন ঘুচে গেছে রে! এখন বাঁচবো কি করে তাই ভাবছি।

কচি বলে—জীব দেছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি!

কচির কথায় যেন এই অন্ধকারেও আশ্বাস খোঁজে হরিধন।

তারপর কয়মাস কষ্টেই কেটেছে। কোন কাজ নেই—ঠিকানা নেই। কচিই সেদিন ঝিগিরি করে দিন চালিয়েছে।

শেষ অবধি হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় এসে যায় হরিধনের। সেদিন কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে কারা যেন। লক্ষ্যভ্রষ্টের মত ঘুরছে হরিধন। এসপ্লানেড এলাকায় এসে ওই কাণ্ড দেখে বলে—খড় কাঠ দ্যান—মেড় বানাই দিচ্ছি।

—পারবি?

—হ্যাঁ।

খড় কাঠ এসে গেলো।

নগদ দু খানা দশটাকার নোট দিয়ে বসে।

তারপর থেকেই হরিধনের ব্যবসা জমতে শুরু করেছে।

পটোপাড়ার মত এখানে খাটতে হয় না। সেখানে মেড় বাঁধা, মাটি ছানা— এক মেটে, দু মেটে করা মূর্তি তৈরীর কত কাজ।

এখানে ওসব নেই। বাঁধা খড়—লাবড়া ও সুতলি দিয়ে আর পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে মাল ডেলিভারী দাও। রোজকার কাজ রোজ রোজ নগদ দাম। কোথায় কোন পণপ্রথা-বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করতে হবে। গরম গরম বক্তৃতার পর কুশপুত্তলিকা দাহ না করলে আন্দোলন জমে না।

তাই দরকার এসবের।

ওরা বলে—তাই দেব! যানা—

—এ্যাডভাস দাও!

অর্থাৎ আগাম চাই! ওরা অবাক হয়।

—সে কি রে আগাম দিতে হবে?

হরিধন বলে—তা দিতে হবে বৈকি।

তারপর একই ডায়ালগ বলে যায়।

— বাঁশ, খড়, সুতলির কত দাম বেড়েছে। মাল-এর খরচাও বেড়ে গেছে। ওদিকে প্রশাসন তখন রাস্তা বন্ধ করে চলেছে। টেম্পো চড়েছে। ওদেরই একজন পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে বলে—জলদি বানা। সভা শুরু হয়ে গেছে।

—হবে গো!

হরিধন, কচি এবার বিদ্যুৎগতিতে হাত চালাচ্ছে। পটোপাড়ার সেই মেড় বাঁধার বিদ্যা দিয়ে একদিন কারিগর হবার স্বপ্ন দেখেছিল সে। তার মূর্তি গড়া সার্থক হবে। দেখিয়ে দেবে সেও বড় কারিগর। কিন্তু সে সব স্বপ্ন আজ মন থেকে নিঃশেষে মুছে গেছে।

আজ হরিধন মূর্তি গড়ার কাছে পৌঁছতে পারেনি। খড়ের বিকৃত মেড় বেঁধে সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে যেন আগুনের জ্বালায় প্রকাশ করার পথই নিয়েছে।

কচি তবু রাতের অন্ধকারে সেই বিবর্ণ ছাতিম গাছের নীচে বসে বলে— মূর্তি গড়বে না কারিগর? শুধু এই আগুন জ্বালা কুশের মেড়ই বাঁধবে? মাটি-রং দে মূর্তি গড়বে না কোনদিন? হাসে হরিধন!

—মানুষ আর দেখেছিস এখানে? সব খ্যাড় গোঁজা ওই কুশপুতুলের দল। তাই আমিও তাই গড়ছি! দিব্যি খাওয়া পরা হচ্ছে। ওরা যত বেশী লম্ভ-ঝম্ভ করবে—ততই আমাদের আমদানী হবে। আবার মূর্তি-ফূর্তি দে কি হবে?

নে! রাত হয়েছে ঘুমো। কাল আবার দু খান বড় মানুষের কুশপুতুল চাই। ভোরবেলা থেকে হাত লাগাতে হবে।