Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
এক ডজন গপ্‌পো – সত্যজিৎ রায়
এক ডজন গপ্‌পো – সত্যজিৎ রায়
0/22
এক ডজন গপ্‌পো – সত্যজিৎ রায়

রাজেনবাবুকে রোজ বিকেলে ম্যাল্‌-এ আসতে দেখি। মাথার চুল সব পাকা, গায়ের রং ফরসা, মুখের ভাব হাসিখুশি। পুরোনো নেপালী আর তিব্বতী জিনিস-টিনিসের যে দোকানটা আছে, সেটায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাইরে এসে বেঞ্চিতে আধঘণ্টার মত বসে সন্ধে হব-হব হলে জলাপাহাড়ে বাড়ি ফিরে যান। আমি আবার একদিন ওঁর পেছন পেছন গিয়ে ওঁর বাড়িটাও দেখে এসেছি। গেটের কাছাকাছি যখন পোঁছেছি, হঠাৎ আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে হে তুমি, পেছু নিয়েছ?’ আমি বললাম, ‘আমার নাম তপেশরঞ্জন বোস।’ ‘তবে এই নাও লঞ্জঞ্চুস’ বলে পকেট থেকে সত্যিই একটা লেমনড্রপ বার করে আমায় দিলেন, আর দিয়ে বললেন, ‘একদিন সকাল সকাল এসো আমার বাড়িতে—অনেক মুখোশ আছে; দেখাবো।’

সেই রাজেনবাবুর যে এমন বিপদ ঘটতে পারে তা কেউ বিশ্বাস করবে?

ফেলুদাকে কথাটা বলতেই সে খ্যাক করে উঠল।

‘পাকামো করিসনে। কার কী করে বিপদ ঘটবে না-ঘটবে সেটা কি মানুষকে দেখলে বোঝা যায়?’

আমি দস্তুরমত রেগে গেলাম।

‘বা রে, রাজেনবাবু যে ভালো লোক সেটা বুঝি দেখলে বোঝা যায় না? তুমি তাো তাকে দেখোইনি। দার্জিলিং-এ এসে অবধি তো তুমি বাড়ি থেকে বেরোওইনি। রাজেনবাবু নেপালী বস্তীতে গিয়ে গরীবদের কত সেবা করেছেন জান?’

‘আচ্ছা বেশ বেশ, এখন বিপদটা কী তাই শুনি। আর তুই কচি খোকা, সে বিপদের কথা তুই জানলি কী করে?’

কচি খোকা অবিশ্যি আমি মোটেই না, কারণ আমার বয়স সাড়ে তেরো বছর। ফেলুদার বয়স আমার ঠিক ডবল।

সত্যি বলতে কি—ব্যাপারটা আমার জানার কথা নয়। ম্যাল-এ বেঞ্চিতে বসেছিলাম—আজ রবিবার, ব্যান্ড বাজাবে, তাই শুনব বলে। আমার পাশে বসেছিলেন তিনকড়িবাবু, যিনি রাজেনবাবুর ঘর ভাড়া নিয়ে দার্জিলিং-এ গরমের ছুটি কাটাতে এসেছেন। তিনকড়িবাবু আনন্দবাজার পড়ছিলেন, আর আমি কোনরকমে উঁকিঝুঁকি মেরে ফুটবলের খবরটা দেখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্যাকাশে মুখ করে রাজেনবাবু এসে ধপ্‌ করে তিনকড়িবাবুর পাশে বসে গায়ের চাদরটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন।

তিনকড়িবাবু কাগজ বন্ধ করে বললেন, ‘কী হল, চড়াই উঠে এলেন নাকি?’

রাজেনবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘আরে না মশাই। এক ইন্‌ক্রেডিব্‌ল ব্যাপার!’

ইন্‌ক্রেডিব্‌ল কথাটা আমার জানা ছিল। ফেলুদা ওটা প্রায়ই ব্যবহার করে। ওর মানে ‘অবিশ্বাস্য’।

তিনকড়িবাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

‘এই দেখুন না।’

রাজেনবাবু পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা নীল কাগজ বার করে তিনকড়িবাবুর হাতে দিলেন। বুঝতে পারলাম সেটা একটা চিঠি।

আমি অবিশ্যি চিঠিটা পড়িনি, বা পড়ার চেষ্টাও করিনি; বরঞ্চ আমি উল্‌টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে গুণগুণ করে গান গেয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছিলাম যেন বুড়োদের ব্যাপারে আমার কোন ইন্টারেস্টই নেই। কিন্তু চিঠিটা না পড়লেও, তিনকড়িবাবুর কথা আমি শুনতে পেয়েছিলাম।

‘সত্যিই ইন্‌ক্রেডিব্‌ল। আপনার ওপর কার এমন আক্রোশ থাকতে পারে যে আপনাকে এ ভাবে শাসিয়ে চিঠি লিখবে?’

রাজেনবাবু বললেন, ‘তাইতো ভাবছি। সত্যি বলতে কি, কোনদিন কারুর অনিষ্ট করেছি বলে তো মনে পড়ে না।’

তিনকড়িবাবু এবার রাজেনবাবুর দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ‘হাটের মাঝখানে এসব ডিসকাস না করাই ভালো। বাড়ি চলুন।’

দুই বুড়ো উঠে পড়লেন।