Accessibility Tools

আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

আর্টের খাতিরে আর্ট

‘আর্টের খাতিরে আর্ট’ বলি যখন, তখন এই কথাটাই বোঝাতে চাই যে আর্ট নয় সামাজিক বা আধ্যাত্মিক বা নৈতিক বা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের উপায়। আর্ট হচ্ছে আপনি আপনার উদ্দেশ্য। আপনি আপনার উপায়।

এখানে সমাজ বা ধর্ম বা নীতি বা রাজনীতি বা অর্থনীতির গুরুত্ব অস্বীকার করা হচ্ছে না। এর কোনো একটিকে বাদ দিলে বা খাটো করলে সভ্যতা হয় না। কোনো একটির অভাব আর একটিকে দিয়ে পূরণ হয় না। মানবিক পরিপূর্ণতার শতদল প্রত্যেকটি দলের উন্মীলন চায়। তা বলে কোনো একটিকে আর-সকলের বা আর একটির উপায় করতে চাইবে কেন? সেও যে একপ্রকার খাটো করা।

আর্ট যদি অপরের বঁাক কাঁধে করে তবে তার নিজের বঁাকটি কাঁধে তুলে নেবে কে? অপরের বঁাক বইতে গিয়ে যদি তার কাঁধ বেঁকে যায় তবে তার গতি হবে কী করে? যাঁরা আর্টের উপর রাজ্যের দায় চাপাতে চান, তারা কি মনে করেন যে রসের দায় বা রূপের দায় বলে আর কোনো দায় নেই, থাকলে তার কোনো গুরুত্ব নেই?

অথচ দু-তিন হাজার বছর পরেও যা বেঁচে থাকে তা ওই আর্ট। তাই নিয়ে সভ্যতার গর্ব। বিংশ শতাব্দীর সমাজব্যবস্থার বা তার ওলটপালটের গুরুত্ব ত্রিংশ শতাব্দীর লোক উপলব্ধি করবে না। কিন্তু চিত্রকলার বা সাহিত্যের গুরুত্ব যদি থাকে তবে তার দিকে দু-দন্ড ফিরে তাকাবে। সভ্যতারও নিরিখ হবে তাই।

এমন যে আর্ট তাকে অন্য কিছুর উপায়ে পরিণত করা হয়তো মহৎ অন্তঃকরণের পরিচয় দেয়, কিন্তু আর্টের নিজস্ব দায়কে খাটো করে। রসের দায় বা রূপের দায়কে লঘু করলে তার যথোচিত অনুশীলন হয় না। ফলে কীর্তি খর্ব হয়। আর্টকে তার রাজকীয় খাজনা দিয়ে হাতে যদি কিছু বঁাচে তবে সমাজকে বা ধর্মকে দিতে পারো, কিন্তু তার রাজমহিমা না মেনে তাকে দিয়ে ধর্মের বা সমাজের কর্ম করিয়ে নিলে তার রাজকোষে পড়বেই। শিল্পীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে দিয়ে একশোরকম কাজ করিয়ে নেওয়া যায়, যা প্রকৃতপক্ষে শিল্পের কাজ নয়। কিন্তু শিল্পী অসহায় হলেও শিল্প অসহায় নয়। শিল্প তার মর্যাদা দাবি করবেই, না পেলে তার অভাববোধ করিয়ে ছাড়বেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুরে যাবে, স্মরণযোগ্য বা সংরক্ষণযোগ্য কিছু সৃষ্টি হবে না।

তা বলে কি আর্ট নি:সম্পর্কীয়? তার তিনকুলে কেউ নেই? না, সেবিচ্ছিন্ন বা নি:সঙ্গ নয়। জীবনের বিভিন্ন ও বিচিত্র বিভাগের সঙ্গে তার নিবিড় ও সানুরাগ সম্বন্ধ। মহাভারত এর মহত্তম দৃষ্টান্ত। যাহা নাই ভারতে তাহা নাই ভারতে। কুরুক্ষেত্রের যুগের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, রণনীতি প্রভৃতি সমস্তই রয়েছে মহাভারতে। যৌননীতিও। মহাভারতকারের দৃষ্টি সর্বব্যাপী ও সর্বত্র প্রবিষ্ট। কিন্তু তিনি মহাকাব্য বা মহান উপন্যাস রচনা করতে বসেছিলেন। দর্শন বা সমাজতত্ত্ব, ধর্মশাস্ত্র বা নীতিশাস্ত্র নয়। যৌনবিজ্ঞান বা যুদ্ধবিদ্যাও নয়। রাজনীতি তো নয়ই। আর্ট সবাইকে ঠাঁই দেয়, তবু সকলের ঊর্ধ্বে থাকে।

এর থেকে যেন এমন ধারণা কারও না জন্মায় যে জীবনের সমস্ত বিভাগ সম্বন্ধে অবহিত ও সংবেদনশীল হওয়া সকল শিল্পকর্মের আদর্শ। না, মহাভারতের আদর্শই একমাত্র আদর্শ নয়। রামায়ণে এতরকম এত কথা কই? আসলে মহাভারতের কোনো জুড়ি নেই। আড়াই হাজার বছর পরেও সেএকাই একশো। আড়াই হাজার বছরে জীবনের বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা বাড়তে বাড়তে এমন বিপুল হয়েছে যে এখন আর মহাভারতের আয়তনেও কুলোবে না। যদি-বা লেখকের আয়ত্তে কুলোয়। যেটা আমাদের আয়ত্তের মধ্যে নয় সেটা আমাদের আদর্শও নয়।

আদর্শ হচ্ছে আর্টের স্বকীয় দায় বহন করে জীবনের আর দশটা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ও জীবনের সমগ্রতার সঙ্গে পা মিলিয়ে নেওয়া। সব কিছু না দেখেও সব কিছু না চেখেও সমগ্রতার একটা মোটামুটি বোধ যদি থাকে তা হলেই হল। যেমন শেক্সপিয়রের বেলা। গ্যেটের বেলা। টলস্টয়ের বেলা।

এটাও কিছু কম কঠিন নয়। সেইজন্যে শিল্পী মাত্রেরই উপর শিল্প-সরস্বতীর তেমন কোনো বরাত নেই। যার পক্ষে যেটা সম্ভব, যতটা সম্ভব, তার পক্ষে সেটাই ও ততটাই যথেষ্ট। তার সৃষ্টি যদি সমগ্রের সঙ্গে না মেলে তবু একাংশের সঙ্গে মিলবে। সিন্ধুর সঙ্গে না মিলুক, শিশিরবিন্দুর সঙ্গেই মিলুক। তার পক্ষে ভান্ডই ব্রহ্মান্ড। চীন দেশের এক বিশিষ্ট শিল্পী শুনেছি শুধু চিংড়ি মাছই আঁকেন। আর তাঁর আঁকা চিংড়ি মাছ রসিকজনের কাছে মহামূল্য। জাপানের এক কবির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, তিনি শুধু ব্যাং নিয়ে কবিতা লেখেন। মানুষও তাঁর চোখে ব্যাং ছাড়া কিছু নয়। এরও কি মূল্য নেই? আপাতদৃষ্টিতে যা তুচ্ছ শিল্পীর দৃষ্টিতে তাই হচ্ছে বৃহত্তর সত্যের প্রতীক। তুচ্ছই হোক আর মহৎই হোক প্রত্যেক শিল্পীকে তার সত্য বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। কার হাতে কোনটা কেমন ওতরায় তাই দিয়েই বিচার হবে। মহৎ বিষয়ে লিখলেই যে লেখা স্মরণীয় বা শাশ্বত হবে তা নয়। উচ্ছে দিয়েও উচ্চাঙ্গের সুক্তো হয়, তুচ্ছ দিয়েও উচ্চাঙ্গের নকশা হয়। দেশে-বিদেশে অসংখ্য ছড়া মুখে মুখে তৈরি হয়েছে, বেঁচে আছেও অনেকগুলি। ব্যালাড বা চারণগাথা না থাকলে সাহিত্যের একটা দিকই থাকে না। সাহিত্য কানা হয়ে যায় যদি হাস্যকৌতুক বা অশ্লীলতাপূর্ণ তামাশা বাদ যায়।

‘আর্টের খাতিরে আর্ট’ যদিও বলি, তবু একথা স্বীকার করি যে আর্টের ফল সুদূরপ্রসারী। তার প্রত্যক্ষ ফল রূপভোগ ও রসভোগ, কিন্তু পরোক্ষ ফল এমন সব পরিবর্তন যা সমাজনায়ক বা রাষ্ট্রনায়কদের স্বপ্ন। কথাটা যতদূর মনে পড়ে শেলির— ‘কবিরা হচ্ছেন মানবজাতির অপরিজ্ঞাত বিধানদাতা।’ হাতের কাছেই বঙ্কিমচন্দ্রের উদাহরণ রয়েছে। তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ গান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে রচিত হয়নি, তা সত্ত্বেও তার দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন উদবুদ্ধ হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা নিকটতর হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। রবীন্দ্রনাথের কাব্য আমাদের অনেকের জীবনধারা বদলে দিয়েছে। শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন পড়ে একটি তরুণীর চৈতন্য হয়, সেইরাত্রেই তার কুলত্যাগের কথা ছিল।

অবশ্য এর বিপরীতটাও সত্য। উপন্যাস পড়ে বহু লোকের মাথা ঘুরে গেছে। তারা কাল্পনিক জগতে বিহার করতে গিয়ে বাস্তব জগতে হোঁচট খেয়েছে। এসব দেখেশুনে সমাজকর্তারা গল্প উপন্যাসের উপর খড়্গহস্ত হয়েছেন। তার মুখে বল্গা পরিয়েছেন। সেযাতে অহিত করতে না পারে তার জন্য তাকে খাসি বানিয়েছেন। সমাজের হিত হয়েছে হয়তো, কিন্তু সৃষ্টি নিষ্ফলা হয়েছে।

লেখক অনেকসময় জানে না সেকীসের জনক। কে তার জাতক। জাতকটি ভালো না মন্দ। মনোহর না ভয়ংকর। আমাদের ছেলেবেলায় প্রায়ই শোনা যেত যে জার্মান যুদ্ধের জন্যে দায়ী নিটশে। তিনিই সেই জাতকটির জনক। বেঁচে থাকলে ও সজ্ঞানে থাকলে তিনি হয়তো তার পিতৃত্ব অস্বীকার করতেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সাহিত্যকে বা দর্শনকে যুদ্ধের দিনে প্রেরণার্থে ব্যবহার করা হয়। যারা প্রচারকার্যের জন্যে লেখেননি তাঁদের রচনাকেও প্রচারের বাহন করে তার থেকে ফল আদায় করা হয়। দীর্ঘকাল যে বই ফলপ্রদ হয়নি, যার পাঠকসংখ্যা মুষ্টিমেয়, হঠাৎ তার উপরে নজর পড়ে। জাতকের জনক ঠাওরানো হয় তাকেই।

‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ যেমন একালের মানুষের অসহ্য তেমনি অসহ্য ‘ফলার্থে ক্রিয়তে কাব্য’। পুত্রার্থের জায়গায় আমরা বসিয়ে দিই প্রেমার্থে। কিন্তু পুত্রকন্যা কি হয় না? না হলেই আশ্চর্য হতে হয়। প্রণয়লীলা যদিও প্রণয়লীলার জন্যেই তবু তার মধ্যে বংশরক্ষার সম্ভাব্যতাও থাকে। তেমনি কাব্যকেলির মধ্যেও থাকে সামাজিক বা ঐতিহাসিক ঘটনার সম্ভাব্যতা। যদিও কাব্যকেলি হচ্ছে কাব্যকেলির জন্যেই। যেখানে তেমন কোনো সম্ভাব্যতা নেই সেখানে বন্ধ্যাত্বের অনুযোগ উঠলে বিস্মিত হবার কী আছে? আর্ট যদিও আর্টের খাতিরেই সৃষ্টি হয় তবু সেই সৃষ্টির ভিতরে হয়তো একটা অরণ্য আত্মগোপন করে থাকে। উপযুক্ত দিনক্ষণ এলে আবির্ভূত হয়। ততদিনে জনকের পঞ্চত্বলাভ হয়েছে। জাতকের আগমনের আভাসও পায়নি সে। কিংবা জীবিত থাকলেও তার পক্ষে কবুল করা শক্ত যে ওরকম কিছু তার কল্পনায় ছিল। যা ঘটে তা সকলের সব কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়।

কখনো কখনো মনে হয় সৃষ্টির প্রেরণা কোন অনাদি উৎস থেকে আসে। কবিরা বা শিল্পীরা নিমিত্তমাত্র। প্রেমের প্রেরণার মতো আর্টের প্রেরণাও ব্যক্তির ভিতর দিয়ে কাজ করলেও নিখিল বিশ্বের আভ্যন্তরিক রহস্য। আমরা যারা লিখি তারা যেন স্বাধীন হয়েও স্বাধীন নই, কোনো এক বৃহত্তর সত্তার অধীন। সেতার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে আমাদের এনেছে, আমাদের দিয়েছে, আমাদের কাছ থেকে নিচ্ছে, আমাদের বিদায় দেবে। যেটা থাকবে সেটার উপর আমাদের নামাঙ্কন থাকলেও সেটা আমাদের নয়, সেটা তার। নামাঙ্কন যে থাকবেই তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। রাজশাহি জেলার পথেঘাটে প্রাচীন শিলামূর্তি ছড়ানো দেখেছি। কেউ বলতে পারে না কার হাতে গড়া। হাজার বছর বয়স।

মহাকালের সোনার তরি ফসল তুলে নিয়ে চলে যায়, যার ফসল তাকে তুলে নেয় না। তার ফসলটাই আসল। সেআসল নয়। কেনই-বা তার নাম থাকবে! যদি থাকে তবে এমন অদৃশ্যভাবে থাকবে যে সহজে কারও চোখে পড়বে না। যেটা সৃষ্টি করা গেল বা আমাদের হাত দিয়ে সৃষ্ট হয়ে উঠল তার পরমায়ু যদি আমাদের পরমায়ুর থেকে বেশি হয় তা হলেই আমরা ধন্য। তাও যে সবসময় হয় না। সাধারণত যে বছরের ফসল সেই বছরই ভোগ হয়ে যায়। ক-খানা বই বিশ-ত্রিশ বছর সমান আনন্দ দেয়?

‘আর্টের খাতিরে আর্ট’ যখন বলি, তখন একথা মনে করেই বলি যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা ক্ষণিক বা তাৎক্ষণিক তার উপরে সামাজিক বা নৈতিক দায়িত্বের গুরুভার চাপিয়ে দিয়ো না। ভারাক্রান্ত হলে সেযেটুকু আনন্দ দিতে পারত সেটুকু দিতে পারবে না। জীবনে অন্তত একটি বার তাকে গলা ছেড়ে গাইতে দাও। হয়তো একখানা গানই সেগাইতে এসেছে, গেয়ে বিদায় নেবে। যাবার সময় অনুরণন রেখে যাবে। হয়তো একটি ছোটো কবিতাই তার দেবার। হয়তো দুটি সার্থক পঙক্তি। মহাভারত বা রামায়ণ রচনা সকলের সাধ্য নয়। অথচ আর্ট যদি লঘুভার হয় তবে তা সকলের সাধ্য। তেমনি করে লোকসাহিত্য হয়েছে, লোকসংগীত হয়েছে। সকলের অন্তরে যে রূপকার ও রসিক রয়েছে তাকে যদি অন্তত একটি বার সৃষ্টির সুযোগ দিতে হয় তবে সেটা হোক সৃষ্টির খাতিরে সৃষ্টি।