অপারেশন জন্নত – ১৫
১৫
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তীব্র শীত।
অপরিসর একটা ছোট ঘরে তাদের তিনজনকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আয়েষার দূর সম্পর্কের চাচার দোকান। বাড়িটা দোকান সংলগ্ন। আয়েষা চাচীর কাছে ভিড়ে গেছে।
তাদের রোয়া ওঠা কম্বল দেওয়া হয়েছে।
আমির বলল, “দেখেছো রজ্জাক মিয়াঁ, ম্যাডাম ঠিক ভাল খাটে শোবে, আর আমাদের এখানে রাখবে”।
রজ্জাক বলল, “ম্যাডাম ঠিকই করেছে। এখানে জেনানা থাকবে কী করে? তাছাড়া আর্মি বার বার রেইড করে। তুমি কি ভেবেছো এতক্ষণে ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে খবর পৌঁছয় নি কিছু?
আমির বলল, “মিরান সাহেব রীতিমত হুমকি দিয়ে আমাকে এই মিশনে পাঠালেন। নইলে কোন দিন আমি আসতাম না। তাও কিনা একজন মেয়ের ভরসায়”।
রজ্জাক বলল, “মেয়েদের ওপর তোমার এত রাগ কেন মিয়াঁ? কোন মেয়ে কি তোমাকে কোন দিন ধোঁকা দিয়েছিল নাকি?”
আমির বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “আমায় ধোঁকা দেবে? মেয়েদের আমি ধোঁকা দেওয়ার উপযুক্ত মনে করি ভেবেছো নাকি? ওদের তো টেনে নিয়ে গিয়ে…”
চুপ করে গেল আমির।
রজ্জাক বলল, “মিয়াঁ, তুমি শাদি কর নি?”
আমির বলল, “না। শাদি করার প্রয়োজন পড়ে নি। কাশ্মীরি মেয়েরা কি কম পড়েছে যে শাদি করতে হবে?”
রজ্জাক আর আমির দুজনেই বাজে ভাবে হেসে উঠল।
রজ্জাক বলল, “অনেক মিশনে গেছি মিয়াঁ, এরকম মিশনে কোন দিন আসি নি। এখনো জানি না কী কাজ, কী করতে হবে। আই এস আইয়ের বাত হি কুছ অলগ হে”।
আমির বলল, “তুমি ঘুমিয়ে পড়। আর এই যে আরিফ, কী ব্যাপার তোমার? তোমার সঙ্গে তো দেখছি আয়েষা ম্যাডাম বেশ ভাল ভাল কথা বলছে। হাতও ধরছে। বিয়ে শাদি করার ইচ্ছা আছে নাকি? কোর না। একে কাশ্মীরি মেয়ে, তার ওপর মিরান সাহেব টিম লিডার করে দিয়েছেন কোন এক্সপেরিয়েন্স ছাড়াই। বুঝতেই পারছো, কীসের বিনিময়ে করেছেন?”
বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল আমির।
আরিফ বলল, “আমার আব্বু আম্মিকে পরশুদিন খুন করা হয়েছে আমির। গোটা গ্রামকে ওরা গুলি করে মেরেছে। তোমার মনে হয়, এই অবস্থায় আমার মনে বিয়ে শাদির কথা আসতে পারে?”
রজ্জাক আরিফের কাঁধ চাপড়ে বলল, “আমাদের সবার জীবনেই এরকম সময় আসে। এই পৃথিবীটা এরকমই নিষ্ঠুর আরিফ। তোমাকে তার জন্য তৈরী হতে হবে”।
আমির বলল, “চার বছর বয়সে আমার আব্বু লাহোর ব্লাস্টে মারা যায়। জুম্মার নামাজ পড়তে গেছিল। কারা এই ব্লাস্টগুলো করায় পাকিস্তানে? যতদিন ইন্ডিয়া নামের দেশটা থাকবে, পাকিস্তান কোন দিন শান্তি পাবে না”।
তিনটে প্লেট নিয়ে আয়েষা আর তার চাচা ঢুকল ঘরে, “খেয়ে নাও। কাবাব আছে। চাচা আনিয়েছে। কাল সকালে আমরা শ্রীনগর যাচ্ছি”।
আমির বলল, “ম্যাডাম, তোমার সঙ্গে মিরান সাহেবের কথা হয়েছে?”
আয়েষা বলল, “না। হবে”।
আমির বলল, “উনি তোমাকে পৌঁছেই ফোন করতে বলেছিল, তাই না?”
আয়েষা বলল, “তোমার কি মনে হয় আমির? উনি আমাদের সম্পর্কে এখনো কিছুই জানেন না? চাচাজান ঠিক জানিয়ে দিয়েছেন। আমার চাচাজান আজ থেকে আই এস আই এর হয়ে কাজ করেন না”।
আরিফের চোখ পড়ল আয়েষার চাচার ওপরে। ভদ্রলোকের গরম পোষাক ভাড়া দেওয়ার দোকান। গুলমার্গে যে সব ট্যুরিস্টরা যায়, তাদের পোষাক সরবরাহ করা হয় এই দোকান থেকে। চাচা বলল, “মিরান সাহেব জেনে গেছেন। আয়েষাকে একটু রাতের দিকে ফোন করতে বলেছেন। কোন কাজে আছেন বললেন”।
আমির কাবাব খেতে শুরু করল, “তাহলে তো আর আমার চিন্তা করে কোন লাভ নেই। সবাই সব কিছু ঠিক করেই রেখেছে”।
চাচা ঘরের একটা আলমারি খুলে চারটে লাইট মেশিনগান বের করে মেঝেতে রেখে বলল, “আপনাদের জন্য মিরান সাহেব কালকেই এগুলো পাঠিয়ে দিয়েছেন। লোডেড মেশিনগান। ম্যাগাজিনের ব্যাগ আমার কাছে আছে। কাল যাওয়ার সময় দিয়ে দেব”।
আমির খেতে খেতে একটা মেশিনগান নিয়ে নলের গন্ধ শুঁকে বলল, “আহ। জন্নত। শুক্রিয়া চাচাজান। আপ গ্রেট হো”।
আয়েষা বলল, “খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি। কাল আবার ভোরবেলা রওনা হতে হবে। এখান থেকে শ্রীনগরের রাস্তায় বার বার চেকিং হয়। নাম জিজ্ঞেস করতে পারে গাড়ি থেকে নামিয়ে। সবাইকে মাথা ঠান্ডা রেখে যেতে হবে। আমাদের দিল্লির চাদনি চকে বাড়ি। কাশ্মীর ঘুরতে এসেছি কলেজ পাস আউট হয়ে। আর জনাব আমির”…
আয়েষা আমিরের দিকে তাকাল।
আমির বলল, “হু”।
আয়েষা বলল, “তোমার শরীরের ভিতর যা গর্মি আছে, মিশনের জন্য বাঁচিয়ে রাখো দয়া করে। আবার বলছি, এমন কোন বোকামো কাল কোর না, যাতে আমরা ধরে পড়ে যাই। আমরা এখানে গ্রেটার কজে এসেছি। ক্লিয়ার”?
আমির কাবাবে মন দিয়ে বলল, “ক্লিয়ার”।
আয়েষা বলল, “আরিফ, আর ইউ ওকে নাও?”
আরিফ বলল, “জি”।
আয়েষা বলল, “তুমি চাইলে চাচাজানের সঙ্গে শুতে পারো। অসুবিধা হচ্ছে?”
আমির বলল, “আপনার সঙ্গে শুতে পারে না?”
আয়েষা আগুনে চোখে আমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনে কাম সে কাম রাখিয়ে”।
আমির ফিক ফিক করে হেসে বলল, “কাবাব খুব ভাল খেতে। আরেকটু পাওয়া যাবে?”
আয়েষা আমিরের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, “পাওয়া যাবে”।
আরিফ চুপ চাপ খেয়ে গেল। হাত মুখ ধোয়ার জন্য একটা বড় পাত্র নিয়ে এসেছিল আয়েষা। জল ঢেলে দিল। হাত মুখ ধুয়ে নিল। রজ্জাক খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
আমির মেশিনগানটা মন দিয়ে দেখতে দেখতে আরিফকে বলল, “ভাল জিনিস। মিরান সাহাব ইজ গ্রেট”।
১৬
দুটো করে কম্বল আর মেঝেয় বিছানা করে দেওয়া হয়েছিল তাদের। রজ্জাক আর আমির আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সারাদিনের পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে গেছিল আরিফ। ঘুমিয়ে পড়ল এপাশ ওপাশ করতে করতে।
ঘুম ভাঙল আয়েষার ঢাকে।
“ওঠো শিগগিরি”।
ধড়মড় করে উঠে বসল আরিফ।
আয়েষা বলল, “ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স খবর পেয়ে গেছে। আমাদের এখনই এই জায়গা ছেড়ে যেতে হবে। গাড়ি এসে গেছে। ওঠো”।
তাড়াহুড়ো করে সবাই তৈরী হয়ে গাড়িতে উঠল। আরিফ দেখল গাড়ির ঘড়িতে সময় রাত তিনটে দশ। সে হিসেব করে দেখল এর মানে পাকিস্তানে এখন দুটো চল্লিশ।
আমির বলল, “কে খবর দিল?”
আয়েষা বলল, “মিরান স্যার। চাচার দোকানে রেড হবে আজ ভোরে”।
আমির বলল, “এখন কোথায় যাচ্ছি?”
আয়েষা বলল, “আরেকটা জায়গায়”।
রজ্জাক বলল, “শ্রীনগর না?”
আয়েষা বলল, “না”।
কিছুক্ষণ পর গাড়িটা একটা গ্রামে প্রবেশ করল। একটা বাড়িতে তাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল।
আয়েষা বলল, “আমার ফুপুর বাড়ি। চাবি আমার কাছে আছে। আজ এখানে থাকি। কাল অল ক্লিয়ার থাকলে শ্রীনগর যাব”।
আমির বলল, “সব আত্মীয়স্বজনের চাবি নিয়ে তুমি ঘুরে বেড়াও বুঝি?”
আয়েষা আমিরের কথার উত্তর না দিয়ে দরজা খুলল।
এ বাড়িটা বড় বাড়ি।
আমির বলল, “যাক, আজকে সোফায় শুতে পারব। আর গাদাগাদি করে শুতে হবে না”।
আয়েষা বলল, “কার্পেট আছে, কম্বল আছে টিভির পাশের আলমারীতে। হেল্প ইওরসেলফ। তবে বাইরের ঘরে না, ভিতরের একটা ঘরে শুতে হবে। আলো আর বেশিক্ষণ জ্বালানো যাবে না। টহলদারি গাড়ি দেখে নিলে সমস্যা হবে”।
রজ্জাক গিয়ে কম্বল আর কার্পেট বের করে মেঝেতে পাতল। আয়েষা বলল, “আমি ভিতরের রুমে ঘুমাব। রিমেম্বার অল, আমাদের সাথে এই মুহূর্তে কোন কমিউনিকেটিং ডিভাইস নেই। গাড়ি আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাদের গাড়িতে উঠে বেরোতে হবে। কখন গাড়ি আসবে তাও জানি না। তাই বি অ্যালার্ট। গাড়ি এলেই আমাকে ডেকে দেবেন। যে কেউ এলে দরজা খুলবেন না। ডোর নক করার একটা প্যাটার্ন দেখিয়ে দিচ্ছি, ঠিক এভাবে নক হলে তবেই দরজা খুলবেন”। আয়েষা টেবিলে শব্দ করে দেখাল। তিনবার পর পর নক হবে। তারপর একটু গ্যাপ দিয়ে আরেকবার।
রজ্জাক বলল, “ওকে। আমি তোমাকে ডেকে দেব”।
আমির বলল, “এর মধ্যে আর্মি যদি এই বাড়িতে অ্যাটাক করে”?
আয়েষা বলল, “মেশিনগান পেয়ে গেছো তো। মরার আগে কয়েকজনকে মেরে যাবে। পারবে না?
আমির আয়েষার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ফিক করে হেসে রজ্জাককে বলল, “লড়কিমে আগ হে”।
আয়েষা রেগে মেগে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
রজ্জাক কার্পেট পেতে আরিফকে বলল, “আরিফ, শুয়ে পড়। ঘুম কম হলে মাথা কাজ করবে না। এর পরে কী হবে তুমি নিজেও জানো না, অকারণ নিজের শক্তি নষ্ট করলে ভাল লাগবে?”
আরিফ বলল, “তোমরা ঘুমিয়ে পড়। আমি জেগে আছি”।
আমির শুয়ে পড়ল।
রজ্জাক বলল, “বি প্রফেশনাল। ফরগেট ইওর পাস্ট। রিভেঞ্জ নিতে হলে এই দুটো সবার আগে মনে রাখা দরকার। পারবে না?”
আরিফ বলল, “জানি না পারব কী না”।
রজ্জাক বলল, “পারতেই হবে। উই আর ইন এ মিশন। মিরান সাহেব যখন তোমাকে চুজ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে বলেই করেছেন। বি ব্রেভ, বি কুল আরিফ। শুয়ে পড়”।
আরিফ হাসার চেষ্টা করল, “শুক্রিয়া রজ্জাক”।
রজ্জাক হাসল। বলল, “শুক্রিয়ার কিছু নেই। আমরা সোলজার। মিশনে এসেছি। একমাত্র আল্লাহপাক জানেন আমরা আমাদের মিশনে সফল হব কী না। কিন্তু এটা জানি, আমাদের সবাইকে সুস্থ থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত। সেটা পারলেই হবে। রাইট?”
আমির ঘুম গলায় বলল, “ভাইসাব ঘুমাও না। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিল”।
আরিফ অনেকক্ষণ পরে হাসল এবার।
১৭
সারা সকাল কেটে গেল কোন গাড়ি এল না।
দুপুর দেড়টা বাজে।
আয়েষা গম্ভীর হয়ে বসে ছিল। আরিফের পরে ঘুম ভেঙেছে। তিন দিন পরে ঠিক করে ঘুমিয়েছে বলেই হয়ত।
রজ্জাক একটা ক্যাম্বিস বল পেয়েছে ঘরের ভিতর। সেটা দেওয়ালে মারছে আর ক্যাচ নিচ্ছে। আমির সোফায় শুয়ে আছে।
আমির বলল, “কী ম্যাডাম, আমাদের এখানে গ্যারাজ করে দিয়ে তারপর কী হল?”
আয়েষা বলল, “চাচার দোকানে কোন প্রবলেম হয়েছে নিশ্চয়ই। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমার ফুপাজি কাশ্মীর বিধানসভায় কাজ করেন। এই বাড়িতে আর্মি হানা দেবে না। এটুকু শিওর”।
আমির বলল, “ঠিক আছে, দিল না। কিন্তু আমরা এখানে কি ঘুমাতে এসেছি? ঠিক কী করতে এখানে পড়ে থাকব সেটা জানতে পারি কি?”
আয়েষা বলল, “নিশ্চয়ই পারো। সমস্যা হল তুমি যেখানে আছো, আমিও সেখানেই আছি। তুমি তো পাকিস্তানি আর্মিতে ছিলে। তুমি জানো না শত্রুপক্ষ যখন অ্যালার্ট থাকে, তখন মুভমেন্ট করতে নেই? এর মানে নিশ্চয়ই এখন ইন্ডিয়ান আর্মি পুরো হাইওয়ে দখল করে আছে”।
আমির বলল, “ইয়া খুদা, আপনি কত জানেন। আপনার কথা শুনে মনে হয় না আপনি আই এস আইতে নতুন রিক্রুট”।
আয়েষা কয়েক সেকেন্ড আমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “অনন্তনাগ ব্লাস্টের কথা মনে আছে? লাস্ট ইয়ার হয়েছিল? ইন্ডিয়ান আর্মির একটা জিপে বম্ব ব্লাস্ট হয়েছিল?”
আমির বলল, “হ্যাঁ। কেন মনে থাকবে না?”
আয়েষা বলল, “ওই ব্লাস্ট আমি করিয়েছিলাম”।
আমির হাঁ করে আয়েষার দিকে তাকিয়ে উঠে বসে বলল, “সত্যি?”
আয়েষা বলল, “তো তুমনে ক্যা সোচা থা আমির আলী? আই এস আই মেয়েদের সুন্দর মুখ দেখে টিম লিডার করে দেয়? নাও স্টপ বিহেভিং লাইক আ চাইল্ড এন্ড কো অপারেট”।
আমির রজ্জাকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “বান্দী সহী হে ইয়ার”।
রজ্জাক বলল, “কিউ, শাদী করনি হে?”
আমির বলল, “শাদী তো আরিফ করেগা। দুজনে কত প্যার দেখো নি?”
রজ্জাক আর আমির দুজনেই হেসে উঠল।
আয়েষা বলল, “শাদি করার হলে আমি এত কষ্ট করে একা লড়াইটা চালিয়ে যেতাম না। কোন বড়লোক ছেলে দেখে বিয়ে করা গৃহস্থ সামলাতাম। কেন এতদূর আমি দৌড়ে বেড়াচ্ছি, তোমরা বুঝতে পারো না? তোমরা কেন এই মিশনে জয়েন করেছো?”
আরিফ বলল, “আমি জানি না আমি কেন এই মিশনে জয়েন করেছি”।
সবাই আরিফের দিকে তাকাল।
রজ্জাক বলল, “তোমার ঠিক করে ট্রেনিং দরকার ছিল। মোটিভেশনাল স্পিচ দরকার ছিল। সেই ভিডিওগুলো দেখার দরকার ছিল যেখানে ইন্ডিয়াতে মুসলিমদের ওপর কতখানি অত্যাচার হয়। তোমার সমস্যা হল তোমার ফ্যামিলিতে একটা হাদসা হল আর তোমাকে মিনিমাম প্রিপারেশনের সময়টুকু না দিয়ে মিরান সাব আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। তুমি জানো না আরিফ, কাশ্মীরে আমাদের লোকেরা কী করে আছে। মেয়েদের লাইফ বলে কিছু নেই। ইন্ডিয়ান আর্মি এখানকার মানুষদের গলায় পা দিয়ে রেখে দিয়েছে”।
আয়েষা আরিফের পাশে বসে ওর হাত ধরল, “বি স্ট্রং আরিফ। ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং”।
আমির আওয়াজ দিল, “ওই দেখ, দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গের শুটিং শুরু হয়ে গেছে”।
আয়েষা আরিফের পিঠে হাত রেখে বলল, “ওর কথা শুনো না আরিফ। লিসেন টু ইওর সেলফ। উই নিড ইউ। আমাদের সবাইকে আমাদের সবার দরকার। নইলে আমরা এদের শাস্তি দিতে পারব না। উই হ্যাভ টু ডু আ বিগ থিং”।
আমির বলল, “আর সেটা কী? এবার বলা যায়?”
আয়েষা বলল, “আমি জানি না”।
আমির অবাক হয়ে বলল, “মানে? এতক্ষণ জানতাম তুমি জানো। এখন বলছো জানো না? ইয়ার্কি হচ্ছে?”
আয়েষা বলল, “মিরান সাহাব জানাবেন। মে বি টুডে, মে বি টুমরো। আফটার রিচিং শ্রীনগর”।
আমির বলল, “আজ এখানে থাকতে হলে আমরা কী খাব? এ বাড়িতে খাবার দাবার নেই মনে হয় কিছু”।
আয়েষা বলল, “দেশের জন্য একদিন রোজা রাখতে খুব সমস্যা হবে?”
আমির বলল, “এখন রমজান না, তো রোজা করব কেন খামোখা?”
আয়েষা তীক্ষ্ণ চোখে আমিরের দিকে তাকিয়ে রইল।
১৮
সন্ধ্যেবেলা। গাড়ি আসে নি।
আমির বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোন খাবার পেল না। বলল “এ কেমন কাশ্মীরিরে বাবা? আখরোট থাকত অন্তত! আমি বেরোই। গ্রামে কিছু পাই নাকি দেখি”।
আয়েষা বলল, “একদম না। কোথাও যাওয়া যাবে না। প্রশ্নই ওঠে না”।
আমির বলল, “একী বিগ বস, বিগ বস খেলা হচ্ছে নাকি?”
আয়েষা বলল, “ধরে নাও তাই। কিন্তু বেরনো যাবে না একেবারেই”।
আমির গুম হয়ে বসে রইল।
রজ্জাক শুয়ে ছিল। মোম জ্বলছে ঘরে। আমির বলল, “কোন রকম কমিউনিকেটিং ডিভাইস ছাড়া কেন আমরা এখানে এলাম? যদি মিরান সাব আমাদের খবর দিতে চান, কী করে দেবেন?”
আয়েষা বলল, “কিছু না দিয়ে পাঠানোর ডিসিশন মিরান সাহাবেরই। নিশ্চয়ই উনি কিছু ভেবেই কাজটা করেছেন। যখন সময় হবে, ঠিক গাড়ি পাঠানো হবে। সেরকমই ইন্সট্রাকশন আছে”।
আমির বলল, “তুমি বোরখা পরে কোন কিছু নিয়ে আসতে পারো তো”।
আয়েষা বিদ্রুপের সুরে বলল, “বাহ, খুব বুদ্ধি তো! আমি গ্রামে বেরোব, আর তারপর ইন্ডিয়ান আর্মি আমার পিছন পিছন এসে সবাইকে এনকাউন্টার করে দিক। এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি লেফটেনান্ট হয়েছিলে কী করে?”
আমির চুপ করে গেল।
আয়েষা জানলা ফাঁক করে বাইরের দিকে দেখল। রাস্তাঘাট জনহীন। সে বলল, “অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই”।
আমির বলল, “তুমি আমাদের নিয়ে এলে। তুমি আমাদের টিম লিডার। তোমার এখানে নাকি সব চেনা। এখন তুমি বলছো অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। যদি কালকেও কেউ না আসে, পরশুও না আসে, কী করব? না খেয়ে থাকব?”
আয়েষা বলল, “আমি যা করছি সব শুধু আমার নিজের জন্যই করছি তাই না? পরিস্থিতি যেমন হবে, সেভাবেই থাকতে হবে। আর কেউ কিছু বলছে না, তোমার এত সমস্যা হচ্ছে কেন? আর্মি ট্রেনিং তো অনেক কঠিন হয়, না খাইয়েও রাখা হয়, তোমার সেরকম ট্রেনিং হয় নি?”
আমির বলল, “সে যখন হয়েছে হয়েছে। এখন আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মিশনটা শেষ করে দেশে ফিরতে”।
আয়েষা বলল, “তো ঠিক আছে। ইউ মে গো নাও। ফ্রি টু গো এনি হোয়ার। যাও”।
আমির বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “বাহ, কী ভাল টিম লিডার পেয়েছি আমরা। মাঝরাস্তায় বলে দিচ্ছে ইউ আর ফ্রি টু গো। বাহ বাহ। খুব ভাল। বড়িয়া হে”।
আয়েষা থমথমে মুখে বসে রইল।
রজ্জাক বলল, “আমার মনে হয় মিরান সাহেব আমাদের বেশিক্ষণ আটকে থাকতে দেবেন না। কিছু একটা ওয়ে আউট নিশ্চয়ই হবে। যদি আয়েষার চাচার দোকানে রেইড হয় আর আর্মি কিছু সন্দেহ করে, সেক্ষেত্রে কিছু টাইম তো লাগবেই। ফায়ারিঙে পয়েন্ট ফোর ক্যাম্পের ইন্ডিয়ান আর্মি মরেছে। ওরা কুকুরের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের। এটাই স্বাভাবিক। এটা সেফ হাউজ”।
আমির রজ্জাকের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেফ হাউজ হোক না, আমার কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু না খেয়ে কত দিন থাকব আমরা?”
রজ্জাক বলল, “আরেকটা দিন দেখাই যাক। তারপর না হয় আমরা এখান থেকে বেরিয়ে নিজেরাই নিজেদের খাবার খুঁজে নেব? কাশ্মীরে উই আর নট সেফ এটা বুঝতে হবে। ইন্ডিয়ার অন্যত্র কোন বড় শহরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা যায়। কাশ্মীরে যেভাবে ইন্ডিয়ান আর্মি অপারেট করছে এখন, সেখানে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো ইজ নট সেফ”।
আমির বলল, “তাহলে বসে থাকো। আর কী করবে”?
রজ্জাক বলল, “একজ্যাক্টলি। আপাতত এটাই কাজ। এটাও তো পার্ট অফ দ্য প্ল্যান ছিল। ছিল না?”
আমির চুপ করে গেল।
আয়েষা “থ্যাংক্স রজ্জাক” বলে অন্য ঘরে চলে গেল।
আমির রজ্জাকের দিকে তাকিয়ে আয়েষাকে ভেঙিয়ে বলল, “যা উসকে পাস যা, বুলা রহি ও তুঝে। দেগি। যা যা”।
রজ্জাক হাসতে লাগল।
১৯
রাত এগারোটা। আরিফ বাদে সবাই শুয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ দরজায় শব্দ হওয়া শুরু হল।
ঠিক যে প্যাটার্নটা আয়েষা দেখিয়েছিল, সেই প্যাটার্ন।
আরিফ কিছু না ভেবেই দরজা খুলে দিল। একজন তরুণ কাশ্মীরি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে বলল, “চলুন”।
আরিফ ছেলেটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। বলল, “কোথায়?”
ছেলেটা হাসল, “জন্নত”। তারপর হাসতে হাসতে বলল, “মিরান সাহাব পাঠিয়েছেন। জলদি করুন। হাতে সময় নেই”।
আরিফের ঘোর কাটল। সে সবাইকে ডেকে তুলল।
আমির উঠেই খুশি হয়ে বলল, “মাশাল্লাহ, বাঁচলাম”।
তারা দশ মিনিটের মধ্যে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। আয়েষা ছেলেটাকে বলল, “আপনার নাম কী?”
ছেলেটা বলল, “জি মেরা নাম তবরেজ”।
আয়েষা বলল, “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
তবরেজ বলল, “শ্রীনগর। রাস্তায় যদি আর্মি দাঁড় করায়, বলবেন ট্যুরিস্ট। গুলমার্গ থেকে ফিরছি”।
আয়েষা বলল, “ঠিক আছে”।
আমির বলল, “খিদে পেয়েছে তবরেজ। কী খাওয়াবে?”
তবরেজ বা হাত দিয়ে একটা বাক্স বের করে বলল, “মিষ্টি পাউরুটি আছে। খেয়ে নিন সবাই”।
আমির বাক্স থেকে একটা পাউরুটি বের করে বাক্সটা পিছনে দিয়ে দিল। সবাই খেতে শুরু করল।
আয়েষা বলল, “তবরেজ, আপনি খাবেন না?”
তবরেজ বলল, “আমি খেয়ে এসেছি”।
গাড়ি বড় রাস্তায় উঠল। ভারতীয় সেনার টহলদারি ভ্যান আছে রাস্তায়। তাদের গাড়ি দেখেই দাঁড়াল। তবরেজ নেমে কথা বলে এসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “এত রাতে বেরিয়েছি কেন জিজ্ঞেস করছিল। বললাম গুলমার্গ থেকে ফেরার সময় গাড়ি খারাপ হয়ে গেছিল। এখন কারফিউ টাইম। বেরনোর কথা না। বললাম শ্রীনগরের হোটেলে সব সামান আছে আপনাদের। এই গল্পটাই সব জায়গায় দিয়ে যেতে হবে”।
আমির বলল, “ওদের আব্বুর বিয়ে দিতে বেরিয়েছি। জানি না ম্যাডাম কী মিশনে নিয়ে যাচ্ছে, আমার তো ইচ্ছা করছিল এখানেই সব ক’টাকে গুলি করে উড়িয়ে দি”।
তবরেজ কোন উত্তর না দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল।
আমির খেতে খেতে বলল, “পাকিস্তানী আর্মি চাইলে একদিনে কাশ্মীর দখল করতে পারে। ব্লাডি পলিটিশিয়ান্স। শুধু ভয় পাবে। এত ভয়ের কী আছে?”
রজ্জাক চুপ করে খেয়ে যেতে লাগল।
আরিফ একটু একটু করে পাউরুটি খেতে খেতে ভাবছিল এরকম পাউরুটি করাচীতে কেন পাওয়া যায় না? কী সুন্দর খেতে! অফিসের ক্যান্টিনে এক ধরণের পাউরুটি পাওয়া যায়, সেগুলো একেবারেই মিষ্টি না। খেলে গলা শুকিয়ে যায়। আয়েষা বলল, “শরীর গরম থাকা ভাল জনাব আমির, কিন্তু সব সময় এত গরম থাকাও ভাল না যে সব সময় সবাইকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করবে”।
আমির গজগজ করতে করতে চুপ করে গেল।
তবরেজ বলল, “গত মাসে আমি ওপারে গেছিলাম”।
আয়েষা বলল, “কোথায়? কীভাবে?”
তবরেজ বলল, “শাদি ছিল এক বন্ধুর বন্দীপুর ডিস্ট্রিক্টে। সেখান থেকে ব্যবস্থা হয়েছিল। ওখানেই মিরান সাহাবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল”।
আয়েষা বলল, “ফির? কোন ইন্সট্রাকশন?”
তবরেজ বলল, “আপনাদের শ্রীনগরে ছেড়ে দিয়ে আমার ছুটি। ওখানে পৌঁছেই কী করতে হবে জানতে পারবেন”।
আয়েষা বলল, “কোথায় থাকব আমরা শ্রীনগরে?”
তবরেজ বলল, “দ্য গ্র্যান্ড হাউজবোটে। পুরো হাউজবোট ভাড়া নেওয়া আছে ট্যুরিস্ট কোম্পানির নামে। ডাল লেকের কাছে চাচার শিকারায় আপনাদের তুলে দিতে হবে। এমনই বলা আছে”।
আয়েষা বলল, “এখন আর্মি নেই ওখানে?”
তবরেজ বলল, “পারমিট করা আছে। পাকা কাজ। মিরান সাহাব আপনাদের জন্য কাঁচা কাজ করবেন ভাবলেন কী করে?”
আয়েষা বলল, “তাও ঠিক”।
হঠাৎ আরিফ বলল, “কী কাজ করতে হবে আপনি কিছুই জানেন না তবরেজ?”
তবরেজ হেসে বলল, “সবই আল্লাহর ইচ্ছা জনাব। আমরা তার কাজ করে যাচ্ছি শুধু। আজকে বিকেল চারটেয় আপনাদের পিক আপ করার কথা ছিল। সেই মত গ্রামে ঢুকতে গিয়ে টের পেলাম ইন্ডিয়ান ড্রোন টহলে বেরিয়েছে। দেরী করলাম। যদি তখন যেতাম, এতক্ষণে আপনারা ইন্ডিয়ান সেনার কাস্টোডিতে থাকতে”।
আমির বলল , “না, জন্নতে থাকতাম। কাস্টোডিতে থাকার লোক আমির আলী না”।
তবরেজ কিছু বলল না। রজ্জাক একটু কাঁচ নামিয়েছিল। প্রবল জোরে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি কাঁচ তুলে দিল রজ্জাক।
আমির গুণ গুণ করে গান করতে শুরু করল, “ও সাকি সাকি রে সাকি সাকি”…