আলোর ফুল
আলোর ফুল
জগতে অনেক অসাধারণ ঘটনা ঘটে, এটা হয়তো তারই একটা উদাহরণ। নন্দিতা আর সুমন্তর কাহিনীর কথা বলছি।
প্রথম একদিন মাত্র ট্রামে একটু কাছাকাছি বসার সূত্রে দু জনে দু জনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিল, আর সেই আকর্ষণের জোরে অনবরত আরও কাছাকাছি হবার চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত যে দুজনে একসূত্রে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল, এ ঘটনাকে আমি ‘অসাধারণ’ বলছি না। এ তো সৃষ্টির আদিকাল থেকেই চলছে, দর্শন মাত্রেই প্রেম সঞ্চার, আর প্রেমের পরিণতি পরিণয়।
ওটা উল্লেখযোগ্য কথা নয়।
সুমন্ত যে একটি সদ্য তরুণ অধ্যাপক, আর নন্দিতা যে একটি সন্তানবতী বিধবা যুবতী, এ ঘটনাকেও এখন আর অঘটনের পর্যায়ে ফেলা চলে না, মাত্র বলা চলতে পারে ঘটনাচক্র। ঘরে—বাইরে পথে—ঘাটে এত তরুণী কুমারী মেয়ের ছড়াছড়ি থাকতে সুমন্ত প্রায় সমবয়সী এক বিধবা মহিলার প্রেমে পড়তে গেল কেন ভাবতে গেলে বলতে হয়—তা অমন যায়।
ওকেই ঘটনাচক্র বলে।
সমাজ আগে সব কিছুই বজ্রমুষ্টিতে আগলে রাখত। ভাগ্যের হাতের ইঁট খেয়ে একবার যদি কারো কপাল ভাঙত তো বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করত—’ব্যস আর নয়, তোমার সব খতম হয়ে গেছে। এর পর আর যদি তুমি পৃথিবীর আলো হাওয়ার দিকে তাকিয়েছ তো যাও—দূর হও। দূর হও সম্মান সম্ভ্রমের আসন থেকে, সংসারের কেন্দ্র থেকে।’
এখন আর তা হয় না।
এখন সমাজের অবস্থা বাড়ির পেনসহ—হয়ে—যাওয়া কর্তার মত। মুষ্টি শিথিল, কণ্ঠ ক্ষীণ। ঘোষণা করে কোন কিছু রায় দেবার সাহস নেই। আড়ালে আবডালে অসন্তোষ প্রকাশ আর ফিসফিসিয়ে সমালোচনা করা ছাড়া আর কিছু করে না সে।
‘আইন’ নামক সংসারের নতুন কর্তা, বুড়ো কর্তা ‘সমাজে’র সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে! কাজেই সুমন্ত যে এত কুমারী কন্যার ছড়াছড়ি থাকতে বিধবা নন্দিতার দিকে তাকিয়েই আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না, সেটা এখন আর অসাধারণও নয়, অসম্ভবও নয়। এখন অমন অনেক হচ্ছে।
কপাল ভাঙলেই যে চিরকালের মতন মন ভাঙে না, এ সত্যটুকু এখন প্রকাশ করছে অনেকেই।
অদ্ভুত আর অসাধারণ বলে উল্লেখ করছিলাম ওদের পরবর্তী জীবনের—
কিন্তু তা হলে গোড়া থেকেই বলতে হয়। পরবর্তীর মূল শিকড় তো পূর্ববর্তীতেই।
দু জনে একই ট্রামে সেদিনের আগে আর কোনদিন উঠেছিল কি না ঈশ্বর জানেন। হয়তো উঠেছিল, একদিন কি অনেকদিন। হয়তো যেদিন যেদিন উঠেছিল নন্দিতার মুখটা ফেরানো ছিল ঠিক সুমন্তর চোখের উলটো দিকে, হয়তো বা অনেকের ভিড়ে মুখটা চোখে পড়লেও চোখে পড়ে নি। কিন্তু সেদিন পড়ল।
সেদিন দু জনে বড় বেশী কাছাকাছি বসতে হয়েছিল। তাই দু জনে দু জনের দিকে স্পষ্ট পরিষ্কার চোখে তাকিয়ে দেখল।
একজন দেখল ধবধবে ফর্সা মিহি ধুতি, আদ্দির পাঞ্জাবী, মাঝারি রং, লম্বাগড়ন, উজ্জ্বল মুখ, উলটানো চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা। আর একজন দেখল সরুপাড় সাদা শাড়ি, মিহি ব্লাউস, সোনালী রং, মাঝারী গড়ন, নীলচে চুল, চশমাহীন উজ্জ্বল নীলচে চোখ।
শুধু দেখল।
তাও বারবার নয়। বারবার দেখাটা অসভ্যতা, তবু কয়েকবারই দেখল। না দেখে পারল না বলেই দেখল।
দিন দুই পরে ঠিক ওই একই ট্রামে, প্রায় একই জায়গায় আবার বসতে হল দু জনকে কাছাকাছি। আজ দেখাটা আরও খুঁটিয়ে হল। একজন দেখল চুড়িদার পাঞ্জাবীর আগায় পোর্টফোলিও ধরা আঙ্গুলগুলোর লম্বাটে ছাঁদটি বড় সুন্দর। দেখল সেই আঙ্গুলের মধ্যের আঙ্গুলটায় যে সাধারণ চৌকো গড়নের সোনার আংটিটা ঝকঝক করছে, সেটা যেন আঙ্গুলের গুণেই অসাধারণত্ব লাভ করেছে। দেখল ঘড়ির ব্যাণ্ডটা শৌখিন, ঘড়িটা দামী।
আর একজন দেখল গলায় সুতোর মত সরু সোনার হারে যে একটা ঝিনুক বসানো পেণ্ডেণ্ট গলার নিচে ঝুলছে, তার কিনারার সূক্ষ্ম সোনার বর্ডারটুকু গায়ের রঙের সঙ্গে প্রায় একাকার হয়ে গেছে।
দেখল একটা হাতে শুধু ঘড়ি, আর একটা হাতে ঝিরিঝিরি কাটা সরু একটা বালা। দেখল হাতের ব্যাগটা সাদা হলেও বেশ একটু বিশিষ্ট, আর সেই ব্যাগ—ধরা আঙ্গুল—কটি এত কমনীয় যে দেখলে মনে হয় না ওরা পৃথিবীর কোন কিছু মুঠিয়ে ধরতে এসেছে। যেন বলিষ্ঠ একখানি হাতের মধ্যে নিজেকে একেবারে শিথিল ভঙ্গীতে সমর্পণ করে দেবার জন্যেই ওই কমনীয় করপল্লবের সৃষ্টি।
দু জনের চেহারার মধ্যে খুঁৎ আছে অনেক, সেগুলো ঠিক ধরতে পারল না ওরা, অথবা ওদের চোখ। চোখেরা শুধু বারে বারে তাকাল।
পরদিনই আবার সেই ঘটনাচক্র।
আজ সুমন্ত একটু হাসল, ‘রোজ এইসময় কোথায় যান?’
নন্দিতাও হাসল।
কোথায় যাই বলল না কিন্তু, শুধু বলল, ‘আপনিও তো রোজ এই সময়!’—
তা এই সময় রোজ যে নন্দিতা চার বছরের মেয়েটাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরে, এ খবরটা অনেক দিন পর্যন্ত বলে নি সুমন্তকে।
কেন বলে নি নিজেই জানেনা সে।
সুমন্ত অধ্যাপক, সপ্তাহের সবদিনই যে ওর ক্লাস থাকে তা নয়, আর ঠিক একই সময়েও থাকে না। কাজেই প্রথম জোয়ারটা তেমন প্রবল হতে পেল না। আর জোয়ার এলেই ভেসে যাবে, এমন পারিপার্শ্বিকতাও তো নয় নন্দিতার।
সমাজ না হয় পেনসন নিয়েছে, লোকচক্ষু তো আর পেনসন নেয় নি। সে চির অনলস! তা ছাড়া মস্ত শিকড়ের বাঁধন মিঠু। চার বছরের ওই মেয়েটা। বাপের সঙ্গে যার চোখোচোখি হয় নি। সে পৃথিবীর আলো দেখবার আগেই তার বাপ পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে চলে গিয়েছিল।
তা জোয়ার প্রবল না হলেও নদীর পাড় ভাঙে বৈ কি! প্রতিদিনের ঢেউয়ের ধাক্কায় ধাক্কায় মাঝেমাঝে ধস নামে, তারপর পাড় ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
প্রথম ধস নামল এক হঠাৎ নামা বৃষ্টির দিনে। সেদিন মিঠুর ছুটি, নন্দিতা কয়েকটা জামাকাপড় জিনিসপত্র কেনবার জন্যে বেরিয়েছিল, ফেরার সময় ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি। কোনখানটায় দাঁড়ালে মাথাটা না হোক, হাতের জিনিসগুলোও অন্তত বাঁচবে তাই দেখতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, হঠাৎ উজ্জ্বল একটি মুখের ওপর চোখ পড়ল। ভিজে গিয়ে খুশী মুখে চশমা খুলে তার জল ঝাড়ছে। নন্দিতাকে দেখে এগিয়ে এল।
‘কী ব্যাপার! এখানে?’ বলল সুমন্ত।
যেন এখানে এসে দাঁড়ানো নন্দিতার পক্ষে ভয়ানক একটা কিছু অদ্ভুত কাজ হয়েছে।
‘এই যে—’
বেশী কথা বলল না নন্দিতা, শুধু হাতের জিনিসগুলো দেখাল।
‘সওদা করতে! কিন্তু ভিজে যাচ্ছেন যে, চলুন চলুন ওই দিকটায়।’ একটা স্টেশনারী দোকানের সামনের সিঁড়িটায় গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে।
‘কী মুস্কিল দেখুন। বেরোলাম যখন, তখন—’ বলল নন্দিতা।
সুমন্ত হেসে বলল, ‘ঠিক জীবনের মত। যখন বেরোনো হয়েছে, তখন কে—ই বা জেনে রেখেছে কত ঝড়—ঝঞ্ঝা বজ্র—বিদ্যুৎ আসবে!’
বৃষ্টির ছাট লাগছিল চোখে মুখে, পায়ের নিচের দিকে ছাটের প্রাবল্যে ভিজে যাচ্ছিল কাপড়ের প্রান্ত, জুতোর আগা। কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না বৃষ্টির শব্দে, তবু কথার উত্তর দিল নন্দিতা, ‘আপনার কণ্ঠে এমন দার্শনিকের হতাশা কেন? আপনাকে দেখে তো মনে হয় না ঝড়—ঝঞ্ঝা বজ্র—বিদ্যুৎ কোন কিছুর খবর আপনি জানেন?’
‘দার্শনিকেরা কি শুধুই ব্যক্তিগত কথা বলে? আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা সকলের পক্ষেই প্রযোজ্য।’
‘ব্যাখ্যাটা শুনতে লোভ হচ্ছে। কিন্তু ভারী মুস্কিলে ফেললে তো, এত জোর জল এল!’…তারপর গলার স্বর নিচু করে বলল, ‘দেখুন আমরা অপরের প্রতি কত উদাসীন! দোকানের কাউণ্টারে যিনি বসে আছেন তিনি ভদ্রলোক, খুব সম্ভব শিক্ষিত ব্যক্তি, কিন্তু এই যে শান্ত দুটি চোখ মেলে বসে বসে আমাদের দুরবস্থা দেখছেন এটা কি ভদ্রতার চিহ্ন? একবার বলে দেখলে তো পারতেন, বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছেন কেন, উঠে এসে বসুন না!’
‘বলতেন,’ সুমন্ত একটু দুষ্টু হাসি হেসে বলল, ‘শুধু আপনি একা থাকলে বলতেন।’
‘তা হলে ওঁর আমন্ত্রণ নিত কে?’
‘না নেবার কি আছে?’
‘সে আপনি বুঝবেন না।’
‘আরে এ যে দাপট বেড়েই চলছে’—সুমন্ত বলে ওঠে, ‘দোকানদার ভদ্রলোকের ভদ্রতাবোধ জাগ্রত হয়ে ওঠার আশাটা বোকামি হবে। চলুন কিছু কেনার ছুতো করে দোকানে ঢুকে পড়া যাক।’
‘কি আর কেনবার দরকার?’
‘দরকার কিছুই নেই হয়তো। কিন্তু কেনাটাই দরকার! যতক্ষণ না বৃষ্টি থামে, ততক্ষণ আপনি প্রাণ ভরে দোকানের সমস্ত জিনিসের দর করবেন।’
‘সমস্ত জিনিসের দর করব? কি বলে?’
‘অন্য কিছু বলে নয়, কেবলমাত্র আপনি মহিলা বলে। অকারণ দোকানের সমস্ত জিনিসের দর করা মহিলাদের স্বধর্ম।’
‘এ রকম মহিলা কত দেখেছেন?’
‘দেখার চোখ থাকলে অনেক জনকে দেখতে হয় না।’
নন্দিতা একজন বাইরের লোকের কাছে সহসা এত প্রগলভ হয়ে উঠল কি করে? বিধবা হয়ে পর্যন্ত কথাবার্তা তো খুবই সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছিল সে!
স্থির শান্ত নম্র, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে যায় নিয়ে যায়, শিক্ষয়িত্রীদের সঙ্গে দু চারটি কথা বলে কি না বলে। যাবার সময় যদি বা মিঠুকে চালনা করতে দুটো কথা কয়, ফেরার সময় তো নির্বাক।
দৈবাৎ কোন চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বড়জোর সামান্য একটু হাসির স্বীকৃতি। তাও নিষ্প্রভ হাসি। কিন্তু সুমন্ত কী মন্ত্র পড়ল কে জানে! কথা কইতেই ইচ্ছে করছে, কথা কইতে ভাল লাগছে। কথা কইতে নেশা লাগছে। যেমন লাগত সেই কতদিন আগে।
তাই সুমন্তর কথার উত্তরে বলে ওঠে, ‘সব মেয়েই কি এক ছাঁচের?’
‘উঁহু, মোটেই না! আমার বক্তব্য ”মেয়েলি মন” বলে যে একটা জিনিস আছে, তার একটা ছাঁচ আছে, এবং সব মেয়ের মধ্যেই অল্পবিস্তর ওজনে সেই মেয়েলি মনটি অবস্থিত আছে। কাজেই সেই বিশেষ জায়গায় সব মেয়েই এক।’
‘ব্যাপারটা তর্কসাপেক্ষ।’
‘তা হলে তর্কটা মুলতুবি রইল, এখন আপাতচিন্তা। চলুন দোকানে উঠেই পড়া যাক।’
বলে উঠে পড়ল সুমন্ত।
অগত্যা নন্দিতাও।
অথচ পিছু পিছু নন্দিতাকেও যে যেতেই হবে তার কোন মানে ছিল না।
সামান্যই পরিচয়।
কেউ কারো নামটাও জানে না।
জানে না কে বা কোথায় থাকে। কার বা কেমন ঘর—সংসার। শুধু মাঝে মাঝে পথ চলতে দেখা। দু—একটা অর্থহীন সাময়িক কথার আদান—প্রদান এই তো!
শুধু তো এইটুকু।
নন্দিতা অনায়াসেই বলতে পারত, ‘থাক না বেশ আছি।’ বলতে পারত, ‘এই তো এখুনি বৃষ্টি কমে যাবে, চলে যাব বাড়ি।’ বলতে পারত ‘না না, কাজ আছে—দেরি করলে চলবে না।’
কিন্তু এসবের কিছুই সে বলল না।
নিয়তির অন্ধ আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে গেল সুমন্তর পিছু পিছু।
বিশেষ কিছু না। কয়েকটা চকোলেট, এক প্যাকেট কাজু বাদাম, সামান্য কিছু ডালমুট।
তবু ইচ্ছে করেই খানিকটা সময় ক্ষেপণ করল সুমন্ত—এটা ভাল হবে কি না, ওটা টাটকা হবে কি না—এই সব বৃথা প্রশ্নে।
নন্দিতা দাম দিতে চাইল, খুলল বটুয়ার মুখের বাঁধন, সুমন্ত শুধু দৃষ্টি দিয়েই ওর উদ্যত হাতখানা থামিয়ে দিল।
‘বৃষ্টিটা কমল বোধ হয়।’
স্বগতোক্তি করে এগিয়ে এসে একবার দেখে নিল নন্দিতা, পরে বলল, ‘মনে হচ্ছে কমেছে।’
‘চলুন যাওয়াই যাক।’
বলে পথে নামল সুমন্ত।
পিছনে নন্দিতাও।
নেমেই সুমন্ত যেন হাতে ভগবান পেল।
সামনেই একখানা খালি ট্যাক্সি।
ট্যাক্সি নেওয়া সঙ্গত কি না, নিলে দুটো মানুষের সমস্যার সমাধান হবে কি না, এসব আর মনে এল না সুমন্তর, ঊর্ধ্ববাহু হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই—এই ট্যাক্সি!’
আশ্চর্য অঘটনই বলতে হবে, ট্যাক্সিড্রাইভার ডাক শুনে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি হেনে নাকের সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল না, গাড়ির গতি থামিয়ে কাছে এসে দাঁড়াল।
দরজাটা খুলে ধরে সুমন্ত বলল, ‘উঠুন।’
নন্দিতার অবস্থা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ‘উঠুন’ মানে কি! এক গাড়িতে উঠবে কি!
না, কোন সন্দেহ এল না। মনে হল না লোকটা কুমতলববাজ, শুধু নিজের মধ্যে থেকে একটা বিপন্নভাব অনুভব করল।
অথচ দাঁড়িয়ে ভাববার সময় নেই। মাথার ওপর জোর বৃষ্টি, আর হাতের সামনে মাথার আচ্ছাদন, পথ চলার নিশ্চিন্ত আরামের বাহন!
‘উঠবেন না?’
সুমন্তর গলায় প্রকাশ পেল না হৃদয়ে কোন ভাবের খেলা চলছে তার।
নন্দিতা ইতস্তত করে বলল, ‘না—মানে, এই তো কাছেই বাড়ি, পাঁচ—সাত মিনিটের রাস্তা।’
‘গাড়িতে উঠে সে হিসেবটা করলেই ভাল হয় না কি? না কি সাহস হচ্ছে না?’
‘কী যে বলেন!’
বলে ঝপ করে উঠে পড়ল নন্দিতা ট্যাক্সিতে।
‘কোন দিকে বাড়ি?’
‘মনোহরপুকুর রোড।’
‘ও আচ্ছা,’ বলে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে সুমন্ত মৃদু হেসে বলল, দেখছেন তো, হতভাগ্য পুরুষজাতি ভদ্রতা প্রকাশ করতে কেন নারাজ? উঃ কী ভয় আপনাদের!’
নন্দিতা আরক্ত হয়ে বলে, ‘ভয় আবার কি, ভয় কেউ করে নি।’
‘ভরসাও খুব দেখায় নি।’
‘বাঃ অকারণ আপনি আমার জন্যে খরচা করবেন—’
সুমন্ত হেসে উঠে বলে, ‘করলামই না হয়,—আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে!’
‘আপনি এই বয়সে কি করে যে এত তত্ত্বজ্ঞান আর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেন তাই ভাবি।’
হঠাৎ ব্যগ্রকণ্ঠে বলে বসল সুমন্ত, ‘ভাবেন? আমাদের মত হতভাগ্যদের কথা ভাবেন? অপচয় করবার মত এত সময় আপনার আছে?’
‘এমন অদ্ভুত কথা বলেন আপনি! আপনার সঙ্গে কতদিন দেখা হল, কিছু ভাবা যায় না আপনার সম্বন্ধে?…এই…এই যে এই রাস্তা!’
এত ঝঞ্ঝাট বাধানোর পর গাড়িতে চড়তে না চড়তেই বৃষ্টি থামল।
পুরনো গোছের একটা ছাইরঙা দোতলা বাড়ি, সামনে খানিকটা রোয়াক, আর তার কোলে কতকটা পোড়ো জমি।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে নন্দিতা দু হাত জোড় করে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ!’
‘নমস্কার! ধন্যবাদের জন্যে অনেক ধন্যবাদ!’
তবু তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠল না।
নন্দিতা একবার ওই দোতলা বাড়িটার দিকে তাকাল। সামনের সব জানলাগুলো বন্ধ, জলের হাত থেকে রেহাই পেতেই অবশ্য।
মৃদু হেসে বলল, ‘উঠে পড়ুন রথে?’
সুমন্তও তেমনি হেসে বলল, ‘কই বললেন না তো, দরজা থেকে ফিরে যাবেন? একটু বসে যান, ভিজে এসেছেন—এক পেয়ালা চা খেয়ে যান!’
কথা শেষ করা হল না, নন্দিতা তার সেই সোনালি—রঙা মুখের ওপর আঁকা নীলাভ চোখ দুটি বিষণ্ণ ধূসর করে বলল, ‘বলার ভাগ্য কোথায়? বাড়ি কি আমার? আমাকে কি কোন সংসারের কর্ত্রী বলে মনে হচ্ছে?’
লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল সুমন্ত। আস্তে বলল, ‘ক্ষমা করবেন। ওজন বুঝে কথা বলার অভ্যাস আমার কম। নিন খান—’ বলে হাতের প্যাকেটগুলো খপ করে নন্দিতার হাতে দিয়ে পালিয়ে এল।
দ্বিধা করবার সময় হল না। একজন ঢুকে গেল সেই পুরনো দোতলাটার কোন একটি প্রবেশপথে, সুমন্ত উঠে বসল গাড়িতে। কিন্তু দুটি মনের মধ্যে কেমন করে যেন একটা অদৃশ্য সেতু রচিত হয়ে গেল।
ধস নেমে খানিকটা ভাঙল।
দ্বিতীয়বার ধস নামল এক রোদ—ঝকঝকে আশ্বিনের সকালে।
মিঠুর ছুটি নয়, সুমন্তর ছুটি।
যথারীতি মিঠুকে স্কুলে পৌঁছে ফিরছে নন্দিতা, ট্রাম থেকে নেমে দেখা। ‘রোজ কোথায় যান, আজ বলুন।’
বলল সুমন্ত পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে। যেন পথে দেখা হলেই পাশাপাশি হাঁটতেই হবে এমন কোন চুক্তি হয়েছে ওদের।
আর পথে দেখাটাই কি দৈবের ঘটনা?
অন্তত আজকের?
কিন্তু আজও নন্দিতা সে প্রশ্নের যথার্থ উত্তর এড়িয়ে গেল। হেসে বলল, ‘আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখবার কোন চাকরি জুটেছে না কি আপনার?’
পথ কি ঘর মানে না সুমন্ত, বেশ বড় গলায় হেসে ওঠে, ‘সে চাকরি জুটলে কি আর আপনার নিকটবর্তী হয়ে আপনাকেই প্রশ্নটা করতাম? তা হলে প্রশ্ন করতাম আপনার পাড়া—পড়শীকে। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে অনুসরণ করতাম আপনার পিছু পিছু।’
নিঃশব্দ পদসঞ্চারে অনুসরণ যে কেউ করছে—একা তাকে নয়, তাদের দু জনকেই—একথা অবশ্য স্বপ্নেও ধারণা করতে পারল না নন্দিতা। প্রসন্ন মুখে বলল, ‘তা ঠিক।’
‘হাঁটতে আপনার কষ্ট হয়?’
বলল সুমন্ত।
‘না, কেন?’ সচকিত হল নন্দিতা, ‘কোথায় হাঁটতে?’
‘এমনি পথে। একটু কম জনবহুল পথে। মানে আর কি—এমন পথে যেখানে পথের লোক অন্তত ধাক্কা মেরে ফেলে না দেয়। চলুন না একটু গল্প করতে করতে যাওয়া যাক। এতদিন দেখা হল, কেউ কারুর নামই জানলাম না।’
সুমন্ত কি বাঙালী গেরস্ত—বাড়ির ছেলে নয়? সুমন্ত কি নন্দিতাকে দেখে বোঝে নি নন্দিতা বিধবা? একজন বিধবা যুবতীর কাছে এ প্রস্তাব করা সঙ্গত কি না, এ প্রশ্ন তার মনে ওঠা উচিত ছিল না কি?
আর নন্দিতা?
নন্দিতার পক্ষে এ প্রস্তাবে সম্মত হওয়া কি আরো অনেক বেশী অসঙ্গত হল না? স্থান কাল পাত্র সব কিছু বিস্মৃত হয়ে সে চলল কি করে তেমনি পাশাপাশি সেই অপেক্ষাকৃত জনবহুল রাস্তায়?
তা এমনি করেই তো জগতের এইসব সমাজ সংসার গুরুজন পরিজন অননুমোদিত ব্যাপারগুলো ঘটে। সবাই সব সময় স্থানকাল—পাত্রের হিসেব রেখে কাজ করলে, ভুবন জুড়ে যে ফাঁদ পাতা আছে, সে ফাঁদে পড়ত কে?
সেদিন সেই পথ চলতে চলতেই দুজনে দু জনের বিষয়ে অনেক কিছু জ্ঞাতব্য তথ্য জেনে ফেলল।
নন্দিতা জানল, সুমন্ত দু’বছর আগে এম—এ পাশ করে বেরিয়েছে, ইংরিজিতে অনার্স ছিল। মাস আষ্টেক হল একটি প্রতিষ্ঠাপন্ন বেসরকারী কলেজে লেকচারারের পদ গ্রহণ করেছে।
না ছাত্রী নয়, ছাত্রই পড়ায়।
ছাত্রবৃন্দ সুমন্তর প্রতি একান্ত প্রসন্ন। যেটা নাকি এ রকম অল্পবয়সী অধ্যাপকদের ভাগ্যে প্রায় দুর্লভ। সুমন্তর মা নেই, বাপ নেই, দুজন দাদা—বৌদি আছেন। মেজদাদা আলাদা অন্যত্র আছেন। বড়দার কাছেই সুমন্তর স্থিতি।
বাড়িটা ভাড়াটে, কাজেই যে কোনদিন বড়দাও আলাদা হয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারেন, অথবা সুমন্তকে অন্যত্র যাবার নির্দেশ দিতে পারেন। আপাতত দুটোর একটাও হয় নি, অতএব সুমন্ত চেনা হোটেলে থাকার মত নিশ্চিন্তই আছে।
জিনিসপত্র গেঞ্জি—তোয়ালে যেখানে সেখানে ছড়িয়ে রাখলে খোয়া যায় না, ময়লা কাপড়ের বাক্সে ময়লা জামাকাপড় ফেলে রাখলে, সাতদিন পরে সেগুলোকে ধোবার বাড়ি ঘুরে আসা ফরসা চেহারায় নিজের ঘরে পাওয়া যায়, সময়ে খেতে বসলে বাড়া ভাত, এবং অসময়ে খেতে এলে রাখা ভাত পাওয়া যায় পুরো মাপে। এর চাইতে সুবিধে আর কি চাইতে পারে মানুষ? আর কি চাইবার থাকে?
পাতের পাশে নুন—লেবুর অভাব অথবা থালার পাশে জলের গ্লাসের অনুপস্থিতি—এসব ধর্তব্যের বিষয় নয়, ওসব ধরতে গেলে চলে না।
নন্দিতা যে ‘আহা’ বলল সেটা বাহুল্য বলা।
সুমন্ত জানল, ইণ্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তে নন্দিতার বিয়ে হয়েছিল, আর বি—এ পাশের বছরেই সব চুকেবুকে গিয়েছিল। একেবারে আকস্মিক ব্যাপার! নন্দিতা যখন অনাগত শিশুর স্বপ্নে বিভোর, আর ভার—মন্থর দেহ নিয়ে পিত্রালয়ের বিশ্রামসুখে নিমজ্জমান, তখন সহসা তিনদিনের জ্বরে মারা গেল ওর স্বামী।
বাপের বাড়ি কলকাতার বাইরে।
ট্রেনে চড়ে আসার ব্যাপার। সেই অবস্থায় অর্ধমূর্ছিতের মত কে জানে কাদের সঙ্গে যেন বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে এসে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল আলোড়ন উঠল দেহের সমস্ত স্নায়ুশিরায়, মোচড় দিয়ে উঠল প্রত্যেকটি অণু—পরমাণু। স্বামীর শেষ শয্যার ধারে যেতে পেল না নন্দিতা, নিজেরই শয্যা পাততে হল বাড়ির একটা অলক্ষিত কোণের ঘরে।
তাও জন্মাল এক মেয়ে।
ঘরে সংসারে কেউ তার মুখ দেখতে চাইল না, তার ন্যূনতম চাহিদাটুকুও বাড়াবাড়ি বলে মনে করতে লাগল সবাই। এবং সব হাঙ্গাম—হুজ্জুত মিটে যেতে সকন্যা নন্দিতাকে চালান করে দিল বাপের বাড়ি।
কিন্তু ভাগ্যের ফের এমনি, বছর না ঘুরতেই বাপও চলে গেলেন জামাইয়ের কাছে। অতঃপর বিধবা মা দুটি নাবালক ছেলে নিয়ে ভাইয়ের বাড়ি আশ্রয় নিতে গেলেন। সেখানে তো আর নন্দিতাকে চালান করা চলে না? সে যে তাঁদের পক্ষে ‘শাকের ওপর বোঝার পাহাড়’ হয়ে দাঁড়াবে!
অগত্যা আবার নন্দিতাকে সেই দাবিহীন দাবির আশ্রয়ে এসে পড়তে হল। তবে একটা সুবিধে এই, স্বামী কাজ করতেন ভাল, আর জীবনের ওই সামান্য সময়টুকুর মধ্যেই রীতিমত মোটা অঙ্কের একটি জীবনবীমা করে গিয়েছিলেন তিনি। সেই টাকাটার ষোল আনা দাবিদার হয়েছে নন্দিতাই।
এবারে এসে নন্দিতা দেখল খুব বেশী অপ্রসন্নতা জা ভাসুর বা শাশুড়ীর নেই। কারণ বোধ করি টাকার যে উপস্বত্বটা এতদিন অন্য সংসারে পড়ছিল, সেটা ওঁদের সংসারে পড়বে এই চেতনাটা এসেছে তখন। আর একটা কথা, মেয়েটা এত ‘জলি’ হয়ে উঠেছে ততদিনে যে, তাকে ‘দূর ছাই’ করা প্রায় অসম্ভব। শিশুর হাসিখুশি পথের শত্রুকে ফিরে চাইয়ে ছাড়ে, আর এ তো একেবারে রক্তের সম্পর্ক, নাড়ির সম্পর্ক!
অতএব শ্বশুর বাড়িতে বাস করা অসম্ভব হচ্ছে না।
চার বছর হওয়াতে সম্প্রতি মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে নন্দিতা, নিজে পৌঁছে দিয়ে আসে, ফেরার সময় বাড়ির চাকর কিছুটা সময় কাজের ছুটি করে নিয়ে আসে।
নন্দিতারও কোন অসুবিধে নেই, কারণ স্বামীর সংরক্ষিত টাকাটা তার হাতেই আসে। শাশুড়ীর একটা নিরামিষ হেঁসেল আছে, খাওয়ার সুবিধে মন্দ হয় না।
দুজনে দুজনের নামও জানল।
ওর নাম সুমন্ত মিত্র, এর নাম নন্দিতা মজুমদার।
নন্দিতার মেয়ের নাম তার ভাগ্য—বিবেচনায় সর্ববাদিসম্মতিক্রমে স্থিরীকৃত হয়েছে ‘ছায়া’, কিন্তু ওই বুকচাপা শব্দটা দিয়ে সর্বদা মেয়েকে ডাকতে পারে না বলে নন্দিতা নিজে একা ডাকে ‘মিঠু’। এই নামকরণ নিয়ে বাড়ির সকলে ব্যঙ্গহাসি হাসে, এ প্রশ্নও করে, ওই অপয়া মেয়েকে অমন মিষ্টিমধুর নামে ডাকতে পারে নন্দিতা কোন হৃদয় দিয়ে?
সুমন্ত বলল, ‘ঈস!’ এর চাইতে বেশী কথা আর ঠিক এই ক্ষেত্রে ওর মুখ দিয়ে বেরোল না।
এত কথা জানতে খুব যে একটা দেরি হল তাও নয় কিন্তু। কোথা থেকে কোন কথায় এসে পড়ে পড়ে সবই কেমন বলা হয়ে গেল।
আশ্চর্যও বৈকি! নন্দিতার মেয়ে যে তার স্বামীর মৃত্যুর দিনে জন্মেছে, এই ভয়ানক তথ্যটুকু কবে কার কাছে নিজে মুখে বলেছে নন্দিতা?
আর সুমন্তই বা কবে কার কাছে বলে ফেলেছে, ‘খেতে বসে জলটা ধারে কাছে কোথাও দেখতে না পেলেই এক—একদিন হঠাৎ মেজাজ ভারী খারাপ হয়ে যায়।’
‘সেদিন আপনি আমাকে খাইয়েছিলেন, আজ আমি আপনাকে খাওয়াব।’
বলল নন্দিতা। ফেরার মুখে।
সুমন্ত অবাক হয়ে বলল, ‘আমি আপনাকে খাইয়েছিলাম! এত ভয়ানক সৌভাগ্য আমার হল কবে?’
‘বাঃ বিষ্টির সময় সেই ভদ্রতাবোধহীন দোকানদারটার কাছে কত কি কিনলেন, সব তো আমাকে খাওয়ালেন।’
সুমন্ত একবার ওর ওই নীলাভ চোখের দিকে তাকিয়ে যেন আকাশের আশ্বাস পেল, তাই গভীর একটি দৃষ্টিপাত করে বলল, ‘সত্যি খেয়েছিলেন আপনি?’
এ চোখের সামনে যা—তা বলে ভাঁওতা দিতে অপরাধ বোধ আসে, নন্দিতা মাথা নীচু করে বলল, ‘দেওয়া আর নেওয়াটাই তো শেষ কথা, খাওয়াটা বাহুল্যর মধ্যে।’
‘বাহুল্যর বার্তাও পেতে ভাল লাগে।’
নন্দিতা মাথাটা তুলে মৃদু একটু হাসল, ‘ওসব জিনিস যে খেতে হয়, ভুলেই গেছি।’
‘ভুলেই গেছেন!’
‘বাঃ বড় হয়েছি না?’
‘বড় হয়েছেন! আচ্ছা, মাঝে মাঝে একটু ছেলেমানুষ হতে ইচ্ছে হয় না আপনার?’
‘কী মুশকিল, এ আবার একটা প্রশ্ন না কি?’
‘এ একটা বড় প্রশ্ন। আসুন একটু ছেলেমানুষই হয়ে পড়া যাক, চকোলেট খাওয়া যাক।’
নন্দিতা ভুলে যাচ্ছে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে যাচ্ছে সে, ভুলে যাচ্ছে যা কিছু করছে সে এখন, অপরের চোখে সেটা বিরাট অশোভন। ভুলে গেছে বলেই বলে, ‘বেশ চলুন। কিন্তু পূর্ব সর্তটা মনে আছে তো? আজকের ওই চকোলেটের বিপুল ব্যয়ভারটা আমার।’
‘সর্তটা পালন করব, যদি আশ্বাস দেন ভবিষ্যতে আর একদিন আমার পালা আসবে।’ এইভাবেই পাড়ের মাটি আলগা হয়।
ছোট ছোট ঢেউয়ের ধাক্কায়, এক—আধটা বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের আছড়ানিতে।
ওদিকে পুরনো সেই ছাইরঙা দোতলা বাড়িখানার মধ্যে এক প্রচণ্ড তরঙ্গের বিক্ষোভ।
এক—আধ দিন নয়, পর পর কয়েকদিন দেখেছেন মেজ নন্দাই অলক্ষ্য থেকে। এক—আধ দিন দেখায় কিছু বলতে আসতেন না তিনি, ভাবতেন কত সময় কত কারণে কার সঙ্গে কার কথা বলতে হয়!
কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই যদি কাউকে একই লোকের সঙ্গে কথা কইতে দেখা যায়, অবশ্যই ধরে নিতে হবে কারণটা একটা বিশেষ কারণ।
তখনও ফেরে নি নন্দিতা, তাই সমালোচনা উদ্দাম হয়ে উঠেছে। শাশুড়ী আঁচল দিয়ে গরম চায়ের গ্লাসটা চেপে ধরে থেকেই ঠাণ্ডা করে ফেলে বলেন, ‘আমি তোমাদের কদিনই বলছি না বড়বৌমা, ছোটবৌমার আজকাল মেয়েকে ইস্কুলে পৌঁছতে অনেকক্ষণ দেরি হচ্ছে! সেদিন মেয়ের ছুটি, তবু বিকেলবেলা কোথা থেকে এক—গা ভিজে বাড়ি ফিরল! হামেসাই এ রকম হচ্ছে দেখছি তো!’
বড়বৌমা শিথিল কণ্ঠে বলেন, ‘কি করে বুঝব তা বলুন মা? যে কথা স্বপ্নের অগোচর, ধারণার অগোচর, জ্ঞানের অগোচর, সে কথা ভাবব কি করে? ঠাকুরজামাই নিজের চক্ষে দেখেছেন, তাও যেন বিশ্বাস করতে পারছিনে।’
‘পারবে বিশ্বাস করতে, যখন মাথায় মুগুর মারবেন তিনি!’
বলে চায়ের গ্লাসটা ঢকঢক করে শেষ করেন শাশুড়ী।
নন্দাই বলেন, ‘আমার চোখে পড়েছে, আমি খবরটা দেওয়া উচিত বিবেচনায় দিয়েছি। ব্যস, আর আমি এর মধ্যে নেই। তবে আমার মনে হয়, এতটা রাশ আলগা করা উচিত হয় নি আপনাদের! একা উনি মেয়ে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন, দোকানে জিনিস কিনতে যাচ্ছেন—এর মানে কি? কেন বাড়িতে আর লোক নেই?’
মেজ জা এটাকে কেন গায়ে পেতে নেন ঈশ্বর জানেন, তিনি ব্যাজার মুখে বলেন, ‘লোক কেন থাকবে না? বারোশো বাহান্ন জন লোক আছে। তেমনি তাদের কাজও আছে। বসে কেউ থাকে না। কিন্তু একটু রাশ আলগা পেলেই রাশ খুলে বেপরোয়া বেরিয়ে যাবে, এমন মতি বুদ্ধি ভদ্রঘরের মেয়ে—বৌয়ের হবেই বা কেন, তাও তো জানি না। রাস্তায় তো আজকাল শতকরা নিরেনব্বইটা মেয়েই বেরোচ্ছে, বিধবা—টিধবাও আছে বৈ কি, তা বলে কি সবাই রাস্তার লোকের সঙ্গে ভাব করে চকোলেট আর কাজুবাদাম কিনে কিনে একসঙ্গে খাচ্ছে বেড়াচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে?’
‘বাপ মুখপোড়া মরেই যে আমাকে আরো জ্বালিয়ে গেল,’ শাশুড়ী কপালে ঘা মেরে বলেন, ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে গেল আমায়! এখন ওই বলা মুখ আর চলা পা কি করে বন্ধ করি আমি? কি করে খাঁচায় পুরে ছেকল দিই তাকে?’
হঠাৎ মেজ ভাসুর দোতলা থেকে নেমে এসে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের আলোচনা থামাও। আসছেন তিনি, দেখতে পেলাম বারান্দা থেকে। এলোমেলো করে কিছু বলতে যাবার দরকার নেই, মা তুমিও কিছু বলো না। যা বলবার দাদা বলবেন।’
দাদা!
যা বলবার দাদা বলবেন!
দাদার স্ত্রী বিপদ গনে বলেন, ‘মেয়েমানুষ মেয়েমানুষে কথা, এর মধ্যে উনি আর কী বলবেন?’
‘কথাটা নিছক মেয়েয় মেয়েয় কথার মত হালকা নয় বৌদি, এটা হচ্ছে বংশের কলঙ্ক আর কুলের পবিত্রতা অপবিত্রতার কথা। এ নিয়ে যা বলতে হবে একেবারে মোক্ষম করেই বলতে হবে। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে এসব বেয়াড়াপনা আমাদের বাড়ি বসে চলবে না। অন্যত্র গিয়ে যা খুশি করুন গে।’
‘বেয়াড়াপনা বেহায়াপনা কোনখানে বসেই চলবে না,’ শাশুড়ী কেঁদে ফেলে বলেন, ‘আর কোথাও চলে গিয়ে যা খুশি করলেই কি বংশের মুখে চুনকালি কিছু কম পড়বে নিধু? তোরা ওর হাতে পায়ে ছেকল বেঁধে এখানেই ফেলে রাখ। ভেবে দেখ ও কার বৌ, কার পুতবৌ!’
তাঁরা যখন ওই সব ভাবছেন, তখন নন্দিতা ভাবতে ভাবতে আসছে, এইভাবে কদিন চলবে? কদিন চলা সম্ভব? জীবনের ভবিষ্যৎ পথ একটা নির্ণয় করবার দিন কি আসে নি? তার শ্বশুরবাড়ির সংসারটা নেহাৎ আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত আর অন্যের সম্পর্কে উদাসীন বলেই এখনো কেউ কিছু লক্ষ্য করছে না।
লক্ষ্য পড়লে কি আর রক্ষা রাখবে?
তা ছাড়া ওদের নন্দিতা ঠকাবেই বা কেন? নন্দিতা যে নিজের মন বুঝতে পারছে।
সংঘর্ষ উঠল সংসারে।
কিন্তু নন্দিতার এই মন বুঝতে পারা মনের সঙ্গে সংগ্রামটা জোরালো হয়ে উঠতে পারল না।
নন্দিতা অপরাধ অস্বীকার করল না, রাগ প্রকাশ করল না। শুধু মৃদু অথচ দৃঢ়ভাবে বলল,’আমায় আপনারা ছেড়ে দিন!’
ছেড়ে দিন!
হাতে পায়ে ছেকল বেঁধে ফেলে রাখার পরিবর্তে একেবারে ছেড়ে দিন!
বড় জা বললেন, ‘ছাড়ান পেয়ে কি করবি তুই তাই শুনি? ভুলে যাস নি গলায় একটা মেয়ে গাঁথা, ওকে গলায় নিয়ে কোন পথ খোলা তোর?’
মেজ জা মৃদু টিপ্পনি দিয়ে বলল, ‘গলায় মেয়ে নিয়েও আবার ফুলশয্যে হয় আজকাল দিদি, হতে বাধা নেই। ছাড়ান পেয়ে কি করবে ভেবে আকুল হচ্ছ কেন? বই কাগজই না হয় বেশী পড় না, দেশের আইন—কানুন কি আর জান না? বিয়ের আপিস তো খোলা আছে।’
তা মেজ জার কথা মিথ্যে প্রমাণিত হল না।
জা ভাসুর শাশুড়ী ননদের ছেড়ে দেওয়া না দেওয়া প্রশ্নটা ভেসেই গেল, বিয়ের আপিসেই গেল নন্দিতা।
তবে একটি মাত্র সুবুদ্ধির কাজ করল সে, নন্দিতা মজুমদার থেকে নন্দিতা মিত্র হবার আগে আইনবলে প্রাপ্ত মৃত অরুণ মজুমদারের জীবনবীমার টাকাগুলো অরুণ মজুমদারের মাতা সুনীতি মজুমদারের নামে দান করে গেল।
শাশুড়ী অবশ্য নিজে হাত পেতে দানপত্রটা নিলেন না, তবে বড় নাতিকে বললেন ‘তুলে রাখ ভাল করে, বাবা এলে দেখাস।’
বড় নাতির বাবা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘এ টাকার কিছু ছায়ার বিয়ের জন্যে রেখে দিলে পারতেন ছোটবৌমা, এটা ওর বাপের টাকা।’
মেজ বৌ বড় ভাসুরের পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু টিপ্পনি করল, ‘ছায়ার এখন নতুন বাবা হচ্ছে, কত খাওয়াবে পরাবে, কত ভাল বিয়ে দেবে।’
‘যা করবে তা জানতেই পাচ্ছি—’ বলে বড় ভাসুর ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।
তবু টাকাটা দিয়ে এইটুকু হল, হয়তো বা তাঁর নির্দেশেই হল, যাবার সময় নন্দিতাকে কেউ বিশেষ জ্বালাতন করল না।
নিঃশব্দে সকলের অলক্ষ্যে নিজের ঘর থেকে পথে, আর পথ থেকে নিজের ঘরে আনাগোনা করতে লাগল সে। তারপর বিয়ের সপ্তাহখানেক আগে এক কলেজের সহপাঠিনীর কাছে গিয়ে উঠল। সহপাঠিনী বলল, ‘ঠিক করছিস বেশ করছিস, জীবনের এখনও কত বাকী, কে তোকে দেখত? বিধবার সম্মান তো আর এখন কোন সংসারে নেই, মিথ্যে সম্মানের খোলস আঁকড়ে পড়ে থেকে লাথি ঝাঁটা খেয়ে কি হবে? যাদের সংসারে থাকবি, তাদেরও তো জ্বলুনি রে বাবা!’
সহপাঠিনীর স্বামী বললেন, ‘আপনার শ্বশুরবাড়িকে উদার বলতে হবে।’
তা এ হচ্ছে সেই গোড়ার কথা।
বিয়ের আগে ‘লাখ কথা’র মত।
লাখ কথা নইলে কোন বিয়েই হয় না।
বিয়ের কদিন আগে সুমন্ত উঠে পড়ে লেগে একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে ফেলেছিল, আর তার এক বন্ধুর বৌদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ওর দিকের ভার নিয়েছিলেন।
নিজের দাদা—বৌদি তো বলেছিলেন, ‘চুলোয় যাও গোল্লায় যাও।’ মেজদা মেজবৌদি শুনে একদিন দেখা করতে এসে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আইবুড়ো মেয়ের এত আকাল পড়েছিল জানতাম না। শুধু বিধবা নয়, আবার ‘সবৎসা’! ছি ছি!’
তা’ এটা আর বিশদ বলার মত কথাই বা কি? এ ধরণের বিয়ে করে কে আর কবে কার আশীর্বাদ লাভে ধন্য হয়? ‘ছি ছি’ সম্বল করেই তো এ হেন দম্পতির সংসারে নামা।
প্রথম রাত্রিটায় মিঠু সেই সহপাঠিনীর বাড়িতেই থাকল। মানে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা হল। কিন্তু নন্দিতা চলে যেতেই সহপাঠিনী বিপদ গনল, মিঠু বিছানায় পড়ে কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত খেলনা পুতুল, ছবির সব বই ছড়িয়ে ফেললো।
কি হয়েছে?
কি হয়েছে?
মিঠু বলল, ‘তোমরা কেন মিছে কথা বললে? কেন বললে মা নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছে। মা তো বিয়ে করতে গেল।’
সহপাঠিনী স্তম্ভিত হল, বিব্রত হল, কিন্তু ভয়ানক একটা বিস্মিত হল না। ভাবল এতবড় মেয়ের কাছে কি আর এতখানি আগুন চেপে রাখা যায়? তা ছাড়া নন্দিতার শ্বশুরবাড়িতে নন্দিতার শুভানুধ্যায়ীর অভাব অবশ্যই ছিল না, আগুন তারা লাগিয়েই রেখেছে।
সহসা একটা বুদ্ধি আবিষ্কার করল সে।
খপ করে মিঠুর ঠোঁটে একটা হাত চাপা দিয়ে সকৌতুকে বলে উঠল, ‘এই এই চুপ চুপ, এখন ও কথা মুখে আনছিস কি? এখন কি বলতে আছে?’
মিঠু রেগে বলল, হ্যাঁ বলতে আছে।’
‘না রে বাপু না, এখন বলতে নেই। মা আগে বিয়ে করে আসুক তখন বলিস। এখন বললে মা মরে যায়।’
মিঠু বলল, ‘মা মরে যাক। মা বিয়ে করতে পাবে না।’
সহপাঠিনী বলল ‘ছি ছি, ওই কথা বলছ? বিয়ে হলে মা কত গয়না পরবে, কত ফুল মাথায় দেবে, কেমন লাল শাড়ি পরবে, এ সব তোমার ভাল লাগে না?’
এসব যে মিঠুর ভাল লাগে না তা নয়।
সবাই গয়না পরে, লাল কাপড় পরে, মিঠুর মা শুধু ঠাকুমার মতন বিচ্ছিরি একটা কাপড় পরে, এটা মিঠুর কোন দিনই ভাল লাগত না, কিন্তু তার জন্যে বিয়েটা অবশ্য প্রয়োজনীয় হবে কেন? মার কাছে কি টাকা নেই? মা কি দোকানে গিয়ে কিনতে পারে না?
‘কিনে তোর মা কার সঙ্গে বেড়াতে যাবে?’ বলল সহপাঠিনী, ‘এই তো আমি এক্ষুনি তোর মেসোমশাইয়ের গাড়ি চড়ে বেড়াতে যাব, তোর সেই বড়জেঠি মেজজেঠি জেঠামশাইদের সঙ্গে বেড়াতে যায়, মাকে কে নিয়ে যাবে?’
মিঠু বলল, ‘আমি নিয়ে যাব।’
‘তুমি? বাঃ চমৎকার! রাস্তায় যদি বাঘ—ভালুক আসে, যদি চোর—ডাকাত আসে, যদি পুলিস আসে, মাকে কামড়ে দেয়, তুমি মারতে পারবে তাদের?’
মিঠু ঈষৎ বিমনা হয়ে বলল, ‘বিয়ে করলে মা পারবে?’
‘বাঃ মা পারবে কেন? সেই যার সঙ্গে বিয়ে হবে; যে তোমার বাবা হবে, সে সবাইকেই মারবে।’
কথাটা হঠাৎ মিঠুর মনঃপূত হল।
তার একটা বাবা না থাকাটা তার কাছে বিশেষ দুঃখজনক ছিল, হঠাৎ একটা বাবা পাওয়াটাকে বেশ একটু লোভনীয়ই মনে হল যেন।
বলল, ‘বাবা বিচ্ছিরী না ভাল?’
‘ওমা শোন কথা, বাবা আবার কারুর বিচ্ছিরী হয়? খুবই ভাল।’
মনটা অনুকূল হল মিঠুর।
দ্বিতীয় দিনে মিঠুকে নিয়ে গেল ওরা।
সুমন্ত আর নন্দিতা!
মিঠু সম্পর্কে নতুন আর কোন প্রশ্ন উঠবে না, বিয়ের আগে সেসব কথা হয়ে গেছে।
নন্দিতা বলেছিল, ‘তুমি ওকে সহ্য করতে পারবে তো?’
মনের অতলে ডুবুরি নামালে দেখা যেত সুমন্ত প্রথম যখন শুনেছিল নন্দিতার চার বছরের একটা মেয়ে আছে, সেদিন আচমকা একটু যেন অবাক হয়েছিল, আহত হয়ে যাওয়ার মত অবাক। কিন্তু সেটা নিতান্তই মনের অতলের ব্যাপার, বাইরের মন সভ্য মার্জিত হৃদয়বান।
তাই নন্দিতার এই প্রশ্নে সুমন্ত ক্ষুব্ধ ভাব দেখিয়েছিল, বলেছিল ‘এমন বিশ্রী একটা প্রশ্ন করতে বাধল না তোমার?’
‘আমার আবার বাধা! অবস্থাটাই কি খুব একটা সুশ্রী আমার? বল সহ্য করা শক্ত নয় কি?’
‘আমার তো মনে হচ্ছে না শক্ত।’
‘মনে হচ্ছে না?’
‘নাঃ! এতটুকু একটা শিশুকে অসহ্য মনে করব, একথাটা উঠতে পারে তা ভাবতেই লজ্জা করছে নন্দিতা!’
নন্দিতা ওর কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল, ‘তুমি মহানুভব, তুমি মহানুভব!’
কিন্তু মনে মনে একবার বুঝি ভাবল—এ মন তুমি রাখতে পারবে তো?
কে জানে শুনে বিধাতা অলক্ষ্যে হাসলেন কি না।
সহপাঠিনী মিঠুকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবার সময় চুপি চুপি নন্দিতাকে গত রাত্রের কথা বলল, তার সঙ্গে নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কথাটাও বলতে ছাড়ল না। আর বলে দিল, ‘সুমন্তবাবুর যাতে ওর ওপর একটু মন মায়া পড়ে তার চেষ্টা করবি, কাছে কাছে এগিয়ে দিবি। একা নিজস্ব করে রাখতে যাসনি, তাতে ভবিষ্যতে খারাপ হবে।’
কিন্তু আশ্চর্য এই, এগিয়ে দেবার ক্লেশটুকু স্বীকার করতে হল না। নন্দিতাকে মিঠুর ওপর তার সৎ—বাপের মায়া পড়াবার কোন চেষ্টাই করতে হল না। মিঠু এত সাংঘাতিকভাবে সুমন্তকে ভজতে শুরু করল যে, মাঝে মাঝে নন্দিতারই অসহ্য হতে লাগল।
অনেক শূন্যতার মরুভূমি পার হয়ে পূর্ণ জলাশয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নন্দিতা, এখন যদি কেউ অনবরত সেই জলে হাত ডুবিয়ে খেলা করতে আসে, শিশু বলেই কি তাকে সব সময় ভাল লাগে?
মিঠু তার একান্ত আপন ধন, একান্ত প্রাণের প্রাণ, তবু যখন তখনই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নন্দিতার।
যেমন হয়তো সিনেমা যাচ্ছে ওরা, নন্দিতা ঝিকে বলে কয়ে মিঠুকে বুঝিয়ে প্রস্তুত হয়েছে, মিঠু সুমন্তর হাত ধরে ঝুলে পড়ল, ‘আমি যাব বাবু আমি যাব।’
হ্যাঁ, এই ‘বাবু’ ডাকটা নন্দিতাই শিখিয়েছে। মিঠু প্রথমে মায়ের বান্ধবীর শিক্ষা অনুযায়ী সুমন্তকে ‘বাবা’ বলতে চেয়েছিল, সতেজে বলেছিল, ‘হ্যাঁ ও আমার বাবা, মাসী বলেছে।’ কিন্তু নন্দিতার যে কী আপত্তি হল তাতে!
যেন খুব একটা সিরিয়াস ব্যাপার, এইভাবে বিরক্তির ধমক দিয়ে বলতে লাগল, ‘কেন বাবা বলবে কেন? কেউ কি বাবা বলে ওকে? ওই তো খোকার মা বলে বাবু, নিমাই বলে বাবু, ধোবা বলে বাবু, জমাদার বলে বাবু—বলে কি না বল? তুমিও তাই বলবে। আর কোনদিন যেন শুনি না ‘বাবা’ ডাকছ।’
সুমন্ত শুনে বিব্রত হয়ে হেসে বলেছিল, ‘সামান্য ব্যাপারকে অসামান্য করে তুলছ কেন? ছেলেমানুষ যা খুশি বলে বলুক না।’
‘নাঃ!’
‘কেন বল তো?’ একটু কৌতুক করে বলেছিল সুমন্ত, ‘আমাকে ওই সম্ভ্রমের পোস্টটা দিতে আপত্তি?’
নীলচে চোখে বিদ্যুৎ শিখা হেনে নন্দিতা বলেছিল, ‘আজ্ঞে না, কারণ অন্য।’
‘শোনা যায় না?’
‘না। সে একেবারে গোলকের গোপন কথা।’
তা গোপন কথাই বটে।
হৃদয়ের একান্ত কথা।
সুমন্তকে প্রথম ‘বাবা’ বলে সুমন্তর নিজের সন্তানই ডাকবে, এমনি একটু তুচ্ছ অথচ অটুট সংস্কার মনের মধ্যে কাজ করেছিল নন্দিতার।
বারে বারে মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে বাবু—ই বলতে শিখেছে মিঠু, কিন্তু খুব বেশী অসুবিধে তাতে হয় নি ওর। বাবুকে পেড়ে ফেলার ব্যাপারে সত্যিকার কন্যার চাইতে কম কিছু নয় সে।
কেমন করে কে জানে, যে মা ছিল মিঠুর একমাত্র আশ্রয়, সংসারের সকলের কাছে অনাদর আর অবহেলা পাওয়া গুটিয়ে—থাকা মনটিকে কেবলমাত্র যে মায়ের কাছেই মেলে ধরত, সেই মাকে ছাপিয়ে বাবু—ই তার বেশী আপন হয়ে উঠেছে।
কাজেই হাত ধরে ঝুলে পড়ে আবদার জানাতে সে এখন মার থেকে বাবুকেই বেশী উপযুক্ত মনে করে।
‘আমি যাব আমি যাব।’
তারস্বরে বলতে থাকে মিঠু।
‘তুমি যাবে কি?’ নন্দিতা বকে ওঠে, ‘কি বললাম তোমায় এতক্ষণ? বললাম না খোকার মার কাছে দুধ খাবে, নিতাইয়ের কাছে রুটি খেয়ে নেবে, আমরা তোমার ঘুমের আগেই চলে আসব।’
‘না আমি যাব!’
দু হাতে সুমন্তকে নরম দুটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মিঠু বলে, ‘বাবু আমায় নিয়ে যাবে।’
সুমন্ত নন্দিতার দিকে চোখ তুলে বিপন্ন কুণ্ঠিত হাস্যে বলে, ‘এ ছাড়বে না।’
‘ছাড়বে না মানে?’
নন্দিতা গায়ের জোরে ছাড়িয়ে নেয়, ‘আবদারের প্রশ্রয় দিতে নেই।…মিঠু অবাধ্যতা কর না, খোকার মার কাছে চলে যাও।’
‘না, আমি খোকার মার কাছে থাকব না, খোকার মা বিচ্ছিরী পচা।…ও বাবু!
নন্দিতার ভয় অগ্রাহ্য করে মিঠুকে কোলে তুলে নেয় সুমন্ত, বলে, ‘পারা যাবে না নন্দিতা, এভাবে ফেলে গেলে গিয়ে মনে সুখ পাওয়া যাবে না।’
নন্দিতা হতাশভাবে বলে, ‘এভাবে আবদারের প্রশ্রয় দিলে, ও তো ক্রমশ বাড়িয়েই যাবে।’
‘আহা তাই কি আর হয়? বড় হলে ঠিকই সেরে যাবে।’
অতএব মিঠুরই জয় হয়।
হয়তো বা খাওয়ার সময় সুমন্তর কাছে আছড়ে এসে পড়বে, ‘আমি দুধরুটি খাব না, আমি লুচি দিয়ে আলুভাজা খাব।’
আবার সুপারিশ করতে হয় সুমন্তকে, ‘যাকগে একদিন খাক না?’
‘না না, ছোট বাচ্চাদের ঘি—তেল খাওয়া ঠিক না।’
সুমন্ত হতাশভাবে বলে, ‘ওই শোন মিঠু, তোমার মা—জননী বলছেন ছোট্ট বাচ্ছাদের লুচি দিয়ে আলুভাজা খেতে নেই।’
‘হ্যাঁ আছে, হ্যাঁ আছে,’ মিঠু দুর্বার হয়ে ওঠে, ‘আমি দুধরুটি খাব না, আমার বিচ্ছিরী লাগে।’
আবার সুমন্তর সুপারিশ। এবার শুধু চোখের ইশারায়, ‘একদিন খাক গে।’
নন্দিতা কঠিন সুরে বলল, ‘একদিন খাওয়াটা কিছু না, কিছু ওই যে জেনে ফেলেছে বেয়াড়া আবদার করতে পারলেই সব কিছু আদায় করা যায়, ওইটাই খারাপ। কই আগে তো এ রকম করত না।’
সুমন্ত মৃদু হেসে মিঠুর রেশম রেশম চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে বলে, ‘তখন বেচারা পিতৃহীনা দুঃখিনী ছিল, সাহস করত না।’
নন্দিতা সহসা এসে পড়া হাসি গোপন করে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘তা বটে, মনে ছিল না বটে, ওর একটি ভালবাসার অবতার সৎ—বাপ জুটেছে। কাজেই সাপের পাঁচ পা দেখবার রাইট জন্মেছে ওর।’
কথার মোড় ঘুরে যায়।
সুমন্ত কপট গাম্ভীর্যে বলে, ‘ভালবাসার অবতার, সে কথাটা কি মিথ্যে?’
নন্দিতা বাঁকা কটাক্ষে বলে, ‘থাক, নিজের মহিমা—কীর্ত্তনে আর কাজ নেই।’
তবু সব দিনই যে কথার মোড় ঘোরে তা নয়, কোন—কোন দিন নন্দিতা মেয়েকে বাধ্য আর সভ্য করে তোলবার জন্যে সমুচিত শাসন—শক্তি প্রয়োগ করে, সুমন্ত বিমর্ষ মুখে সরে যায়, চলে যায়, হয়তো বিনা প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
কিন্তু এটা একরকম, আর একরকম হচ্ছে রাত্রে। যেটা সত্যি বিরক্তিকর।
নন্দিতা চায় মেয়েকে সকাল সকাল খাইয়ে সকাল করে ঘুম পাড়িয়ে ফেলতে, যাতে নিজেরা ওরা যখন ঘুমোতে আসে, তখন যেন সুষুপ্তির গভীর স্তরে তলিয়ে থাকে চালাকচতুর বছর পাঁচেকের মেয়েটা।
নিজেদের মধ্যের কথা গল্প—হাসির আদান—প্রদান যেন সেই স্তরে গিয়ে পৌঁছতে না পারে। নাড়া দিয়ে সচকিত করতে না পারে।
কিন্তু বেয়াড়া মেয়েটা রাতদুপুর পর্যন্ত জেগে থেকে গল্প শুনবে তার বাবুর কাছে!
আর সুমন্তও তেমনি, মিঠুর ‘কি, কেন, কে, কি জন্যে, কবে, কোথায়, কখনে’র কণ্টকবন ঠেলতে ঠেলতে গল্প যে এগোতেই পারছে না, সে খেয়াল থাকে না তার, নিখুঁৎভাবে উত্তর দিতে বসবে সেই প্রশ্ন শরজালের।
নন্দিতা ভুলে যায় নিজেই সে মেয়ের ওই অভ্যাসটি সৃষ্টি করিয়েছিল। রাতে শোবার সময় দশ—বিশটা গল্প না শুনলে ঘুম আসে না মিঠুর বরাবরই।
মনে পড়ে না এইজন্যে যে, অভ্যাসটা করিয়েছিল মিঠুর প্রয়োজনে ততটা না, যতটা নিজের প্রয়োজনে।
তখন নিজের তাপদগ্ধ মনের একমাত্র শান্তি আর সান্ত্বনা ছিল মিঠু। মিঠুর সেই অর্থহীন কি, কেন, কে, কোথায়, কবে, কখন সারাদিনের বহু বাঁকা—কথা—শোনা কানে মধুবর্ষণ করত।
এখন অবস্থা তা নয়।
এখন তাই মনে হয় সুমন্ত একটু বেশী বাড়াবাড়ি করছে।
সেদিন মিঠু ঘুমোলে কথাটা তুলল নন্দিতা, ‘আচ্ছা ওকে তুমি এত বাড়াবাড়ি আদর কর কেন বল তো? এ কি আমাকে প্লীজ করতে?’
সুমন্ত বোধ করি এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই শুনেই একটু থতমত খেল, তার পর আস্তে বলল, ‘না নন্দিতা, এ রকম ধারণা করো না। বাড়াবাড়ি কি না জানি না, তবে আদর যা করি, তা তোমাকে প্লীজ করতে নয়, ওকে প্লীজ করতেও নয়, নিজেকে প্লীজ করতে।’
নন্দিতা ওর সেই সমর্পিতের মত কমনীয় আঙ্গুল কটি সুমন্তর হাতের ওপর রেখে মৃদু হেসে বলে, ‘তুমি যে মনোবিজ্ঞানকে একেবারে পালটে দিচ্ছ!’
‘কি জানি অত বুঝি না। একটা মিষ্টি শিশু, আগ্রহ আর ভালবাসা নিয়ে ছুটে আসে, তাকে রিফিউজ করা সম্ভব? মানুষ কি ভাইপো—ভাইঝিকে ভালবাসে না? ভাগ্নে—ভাগ্নীকে ভালবাসে না? ভালবাসে না বন্ধুর মেয়ে—ছেলেকে, পাড়ার বাচ্ছা ছেলে—মেয়েদের? ছোট ছেলেকে ভাল না বেসে কে থাকতে পারে?’
হঠাৎ সেই কমনীয় হাতটা দিয়ে সুমন্তর হাতখানায় একটু গভীর চাপ দিয়ে নন্দিতা মাথা নিচু করে অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘এতটা রাখতে পারবে? এই তো আসছে নিজের—’
কথা শেষ করে না নন্দিতা, শুধু হাতটায় আরও গভীর চাপ দেয়।
কিন্তু সুমন্ত অধীর আগ্রহে আকুল হয়ে ওঠে। স্পষ্ট করে শুনতে চায় সে, নির্ভুল হতে চায়।
‘সবটা বল নন্দিতা, থেমে যেও না—’ নীচু করা মুখটা দু হাতে তুলে ধরে সুমন্ত, সেই ওর কাটা—ছাঁটা গড়নের সোনালিরঙ মুখটা।
হয়তো আর একটু স্পষ্ট হত নন্দিতা, নয়তো বা আর একটু অস্পষ্ট, যদি সুমন্তর মুখটা আসত নেমে, কিন্তু নামিয়ে আনতে যাওয়া মুখটা সুমন্ত ঝট করে সোজা করে নিয়েছে ততক্ষণে। কারণ ঠিক তক্ষুনি মিঠু জেগে উঠে একেবারে উঠে বসে বলছে, ‘জল খাব।’
নন্দিতা কঠিন মুখে উঠে গিয়ে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে মেয়ের হাতে দেয়, খাওয়া হলে গ্লাস ফেরত নিয়ে যথাস্থানে রাখে, তারপর একটিও কথা না বলে শুয়ে পড়ে।
অপরাধী যেন সুমন্তই।
তাই সে অপ্রতিভাবে বলে, ‘শুয়ে পড় মিঠু, শুয়ে পড়। শীগগির ঘুমিয়ে পড়, তোমার মা—জননীর মাথা ধরেছে, কথা কয়ো না।’
মিঠু মা—জননী সম্পর্কে কিছুমাত্র সমীহ প্রকাশ না করে বলে ওঠে, ‘গরম হচ্ছে!’
‘গরম হচ্ছে?’
সুমন্ত উঠে পাখার জোর বাড়িয়ে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে নন্দিতা উঠে একখানা চাদর টেনে আগাগোড়া ঢেকে শোয়।
অর্থাৎ তার শীত করছে।
সুমন্ত হেসে হালকা করে নিতে বলে, ‘আচ্ছা ছেলেমানুষ তো! ওর কি কোন বুদ্ধি আছে?’
‘আছে কি না কিছুদিন পরেই টের পাবে।’
বলে পাশ ফিরে শোয় নন্দিতা; এবং রায় দেবার ভঙ্গীতে বলে, ‘কাল থেকে ওঘরে খোকার মার কাছে শোবে।’
ওঘর বলতে অবশ্য আধখানা ঘর। ফ্ল্যাট দেড়খানা ঘরের!
কিন্তু মিঠু তো নেহাৎ অবোধ শিশু নয়?
পরদিন পাশের ছোট্ট ঘরটায় ওর সরু ছোট্ট চৌকিটা নিয়ে যাবার চেষ্টা চলতেই কেঁদে রসাতল করে সে।
‘আমি ওঘরে শোব না, আমি ওই বিচ্ছিরি ঘরে শোব না। খোকার মা কালো, খোকার মার গায়ে গন্ধ।’
সুমন্ত পায়ে চটিটা গলিয়ে পালায়।
অনেকক্ষণ পরে যখন ফেরে, কান পেতে শোনে কান্নার আওয়াজ উঠছে কি না। না, উঠছে না। অতএব সাহস করে ঢুকে পড়ে। দেখে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। সরু চৌকিটা পুরনো জায়গাতেই বিরাজমান এবং নন্দিতা ওই ভারী মেয়েটাকে কোলে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘুমপাড়ানোর ভঙ্গীতে।
সুমন্ত ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘এই এই তুমি ওকে নিয়ে বেড়িও না! ওটা ঠিক হবে না।’
‘আর ঠিক!’ নন্দিতা মেয়ের পিঠে আস্তে হাত বুলিয়ে প্রশ্রয়ের সুরে বলে, ‘মাথাই বেঠিক করে দিচ্ছে।’
‘তা হলে জুনিয়ারেরই জয়?’
সাহস পেয়ে হাসতে থাকে সুমন্ত।
‘তা ছাড়া আর কি! এমন কান্না জুড়লে যে সর্দি হয়ে জ্বর এসে যাবার জো! পাড়ার লোক যে কেন পুলিস ডাকে নি তাই ভাবছি।’
‘ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে!’
‘পড়াই সম্ভব। কাহিল হয়ে গেছে তো।’
‘দাও আমাকে দাও, তুমি আর বেশীক্ষণ এভাবে—’
‘থাক। থাক আর একটু।’
নন্দিতার গলাটা বুঝি অনুতাপে স্নিগ্ধ শোনায়। ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ‘থাকুক এ কটা মাস, এরপর তো শুতেই হবে ওঘরে।’
হ্যাঁ শুতেই হল বৈ কি।
নইলে জায়গায় কুলোবে কি করে? ঘরের জায়গা আর মায়ের মনের জায়গা দুইয়ের ভাগ বসাতে যে আর একজন এল!
কাঁচের পুতুলের মত ছোট্ট সুন্দর মিষ্টি!
এ আরও দামী, মিঠুর থেকে অনেক দামী।
বিশ্বজগৎ সেই কথাই বলে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে এই দামী জিনিসটুকুর দিকে তাকিয়ে থাকে নন্দিতা। এ যেন নন্দিতার প্রথম মাতৃত্ব।
সত্যিকার প্রথম মাতৃত্বের স্মৃতি তো একটা বীভৎস বিভীষিকা!
কতদিন তাকাতে পারে নি মিঠুর দিকে, আতঙ্কে আর দুরপনেয় এক লজ্জায় আদর করতে পারে নি কতদিন। কলঙ্কিতা জননীর অবৈধ সন্তানকে নিয়ে যেমন ভয় লজ্জা যন্ত্রণা, অনুভূতি ছিল মিঠুকে নিয়ে।
অনেকটা বড় হতে, তবে কিছুটা সহজ হয়ে এসেছিল। কিন্তু এ তো তা নয়। এ যেন তার সুখের কমল!
এ জন্মাবার খবর পাওয়া মাত্র সুমন্ত ছুটে গেল হাসপাতালে—আনন্দ আর উৎকণ্ঠা, সুখ আর ভয় মুখে ভরে, বুকে ভরে।
কাছে গিয়ে নীচু গলায় বলেছিল সুমন্ত, ‘যা চেয়েছিলে তাই পেয়েছ তো?
‘পাবই তো!’
নিতান্ত ক্লান্ত মুখেও কৌতুকের হাসি হেসেছিল নন্দিতা। তারপর বলেছিল, ‘কেন তুমি খুসি হওনি?’
সুমন্ত আস্তে ওর নীলচে রুক্ষু রুক্ষু চুলগুলোর ওপর একটু হাত রেখে পরম স্নেহের স্বরে বলেছিল, ‘মেয়ে হলেও কিছু কম খুশি হতাম না।’
নন্দিতা অভিমানের অভিযোগ কণ্ঠে এনে বলেছিল, ‘মেয়ে তো আছেই।’
‘তা অবশ্য।’
‘দেখেছ?’
‘দূর! ছুটে আসছি আগে ছেলের মাকে দেখবার জন্যে। দেখতে যাব! নার্সেরা যেটাকে দেখাবে সেটাকেই নিজের ছেলে বলে বিশ্বাস করব।’ হাসতে থাকে সুমন্ত।
‘যাঃ অসভ্য!’
ক্লান্ত নন্দিতা চোখ বুজেছিল একটুকু। তারপর চোখ খুলে আদরে আর সুখে মেশা গলায় বলে উঠেছিল, ‘এ তোমাকে বাবা বলবে।’
সুমন্তকে যে বাবা বলবে, সুমন্তর ঘরেই তার আসন প্রতিষ্ঠিত হল। মিঠুকে যেতেই হল পাশের ঘরে।
নতুন মানুষটা ছোট্ট, কিন্তু তার আসবাব উপকরণ যে অগাধ!
কোথায় ধরবে মিঠুকে?
প্রথম রাতটা মিঠু টের পায় নি।
টের পায় নি কখন তার খাটখানা ওঘরে চালান হয়ে গেছে, আর কখন তার জায়গায় একটা দাঁড়ানো বেতের দোলনা বসানো হয়েছে।
ও যখন ইস্কুলে ছিল তখনই হয়েছে এসব।
রাত্রে ঘুমন্ত তুলে দিয়ে আসা হয়েছিল মিঠুকে, সকালে ছুটে এসে এঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
সামনেই যা দৃশ্য, সেটা দৃষ্টি—সুখকর নয়।
ওর থমকে দাঁড়ানো দেখে নন্দিতার মনটা কেমন করে উঠল, সস্নেহে ডাকল, ‘আয় মিঠু, সোনা আয়। দেখ কেমন ভাইটি! ছোট ছোট পা, ছোট ছোট আঙ্গুল!’
কিন্তু মিঠু এই সস্নেহ ডাকে সাড়া না দিয়ে ‘ছাই ভাই,’ বলে ছুটে পালিয়ে গেল।
আর আশ্চর্য, নন্দিতার স্নেহকোমল কণ্ঠ মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠল, ‘হিংসুটি খলুটি! যেমন বাড়ির মেয়ে তেমনি স্বভাব!’
মিঠুর বাড়ির কথা তুলে মন্তব্য নন্দিতার এই প্রথম।
মিঠু যে অন্য আর এক বাড়ির এ কথা কি এতদিন মনে ছিল না নন্দিতার? মনে পড়ল এ বাড়ির মালিককে যে বাবা বলবে তাকে দেখে?
নন্দিতার মন্তব্যে সুমন্তর মনটা ধ্বক করে উঠল, আহা বেচারা রে! এ কদিন আশ্বাস ছিল মা হাসপাতালে গেছে, কাল আসবে। কিন্তু মা যে চিরকালের মত আর একজনের হয়ে আসবে, এ কথা তো জানত না।
‘মিঠু মিঠু, শোন শোন—’ বলে তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল সুমন্ত। নন্দিতা আবার ভাবল বড্ড বাড়াবাড়ি করছে সুমন্ত, নিজের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখবারও সময় নেই বাবুর, চাড়ও নেই। চললেন সতাতো মেয়ের মান ভাঙাতে! ভাবল, যা রয় সয় তাই ভাল।
ভাবল, মিঠুকে নন্দিতার চাইতে কিছু আর সুমন্তর বেশী ভালবাসা সম্ভব নয়, এ এক ধরণের আদিখ্যেতা!
কোলের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখল।
মোম দিয়ে গড়া একটি মায়ার পুতুল! একে বুকের মধ্যে ভরে রাখলেও বুঝি তৃপ্তি হয় না, আরো নিবিড় করে নিতে ইচ্ছে করে। মিঠুকে নিয়ে ঠিক এমন অনুভূতি বুঝি আসেনি কোন দিন।
আবার ভাবল, না না, মিঠু তার দুঃখ—সাগর ছেঁচা ধন, মিঠু তার প্রথম সন্তান, মিঠুকে সে ভালবাসে না নাকি! তা বলে শাসন করতে হবে না, শিক্ষা দিতে হবে না? স্নেহে অন্ধ হতে হবে?
‘খোকা কোথায় ছিল বাবু?’
চুপি চুপি প্রশ্ন করে মিঠু।
সুমন্ত ওর চুলের গোছা নেড়ে দিয়ে বলে, ‘তোমার মা—জননীর বুকের ভেতর।’
‘সেখানেই থাকল না কেন? বেরিয়ে এল কেন?’
‘তোমার সঙ্গে খেলা করবে বলে।’
মিঠু একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘খেলতে আমার ভাল লাগে না।’
সুমন্ত হেসে বলে, ‘আরে বোকা মেয়ে, খেলতে ভাল লাগে না? তবে তোর কি ভাল লাগে শুনি?’
‘পড়তে। তুমি আমায় পড়াও বাবু!’
কোথা থেকে খুঁজে আনে ওর রংচঙে ছবিদার বইগুলো। আগে যে গুলোয় হাত দিতে বললেই স্রেফ লুকিয়ে ফেলত মিঠু। স্বচ্ছন্দে বলত, ‘খুঁজে পাচ্ছি না।’
আজ বোধ করি এই পড়া আর পড়ানোর সূত্র দিয়ে একজনকে অন্ততঃ বাঁধতে চায়।
ঘরে আর ইদানীং আসতে চায় না মিঠু, বাইরের ছোট্ট বারান্দাটুকুই তার পীঠস্থান। যেখানে নন্দিতা আর সুমন্তর জন্যে দুটি সৌখিন বেতের মোড়া পাতা থাকে। সন্ধ্যার অবসরে এখানে বসত তারা নিয়মিত।
পুত্র গরবে গরবিনী নন্দিতার আর এখন ফুসরৎ হয় না সেভাবে এসে বসতে। সারাক্ষণই বুঝি কাজ তার।
সুমন্ত মাঝে মাঝে বলে, ‘ওকে ‘খোকার মার’ কাছে দাও না?’
নন্দিতা মুচকে হেসে বলে, ‘খোকার মার কাছেই তো আছে।’
‘হুঁ। লজিকের জ্ঞান পুরোপুরি! না শোন, ওরা বুড়োসুড়ো মানুষ, ছোট বাচ্চা মানুষ করার ব্যাপারটা বোঝে ভাল।’
‘কী যে বল!’ ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে নন্দিতা—’স্বাস্থ্য সম্পর্কে কোন চেতনা আছে ওদের?’
‘তা পুরনোটাকে যে তুমি একেবারে আমলই দিচ্ছ না!’
‘তুমি তো তার সে অভাব পুষিয়ে দিচ্ছ’—বলে একটু ভ্রুভঙ্গী করে নন্দিতা, ‘দেখ দিকি কী চমৎকার ঠোঁটটা, কি চমৎকার আঙ্গুলগুলো!’
খোকার কচি ঠোঁটটার ওপর একটি আঙ্গুল রাখে নন্দিতা।
সুমন্তরই কি মনটা সরস হয়ে ওঠে না অপূর্ব এক স্নেহসুধায়?
আত্মজ!
একেবারে আত্মার আত্মীয়! দেহের অংশ, বংশের ধারক, সুমন্তর আকৃতি, প্রকৃতি, প্রাণসত্তা, শোণিতধারা, সব কিছুর বাহক। ছেলেকে আদরে ভরিয়ে দেয় সুমন্ত, আর বুকে তুলে নিয়ে ভাবে—তা নন্দিতা ভুল বলে না। মেয়ে আর ছেলে অনেক তফাৎ বৈ কি! কন্যা আদরের, পুত্র সম্ভ্রমের! কন্যা খেলার পুতুল, পুত্র গৃহদেবতা! কন্যার মধ্যে নিজের বিকাশ কোথায়?
আর সুমন্তর খেলাঘরে যে মেয়েটি পুতুলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে?
সে তো সুমন্তর কেউই নয়।
স্কুলে তার নাম লেখানো আছে ছায়া মজুমদার। সুমন্ত মিত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কি?
তবু মেয়েটাকে ভালবাসে সুমন্ত, বড় বেশী ভালবাসে। মেয়েটা যে নিজের থেকে এসে ধরা দিয়েছে। যেন সুমন্তর ছায়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।
বারান্দার সেই মোড়াটায় নন্দিতা আর আজকাল বসে না, বসে মিঠু, আর ডাকাডাকি করে, ‘ও বাবু, এস না। বিচ্ছিরী বিচ্ছিরী গরম ঘরে বসে তুমি কি করছ?’
নন্দিতা স্নেহে কৌতুকে বলে, ‘ওঃ দ্রাক্ষাফল অম্ল! ঘরটা এখন বিচ্ছিরী হল! আয় মিঠু এখানে আয়, সবাই মিলে গল্প করি।’
মিঠু অনমনীয় স্বরে বলে, ‘না!’
‘কেন, ‘না’ কেন? আয় না ছোট্ট ভাইটিকে কোলে দেব!’
‘না’।
‘মিঠু মিঠুয়া, তুই বুঝি আমাকে আর ভালবাসিস না?’
‘না!’
‘না? তুই আমাকে ভালবাসিস না?’
‘কেন বাসব? তুমি তো ওই বিচ্ছিরী পুঁচকেটার মা।’
নন্দিতার কৌতুক—হাস্যমণ্ডিত মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। বলে, ‘আমি বলি বলে তুমি ‘ইয়ে’ কর, দেখতে পাচ্ছ দিনদিন কী রকম হিংসুটে হয়ে যাচ্ছে মিঠু?’
‘ছোট বাচ্চারা ওরকম হয়। ওটা হিংসে নয়, অভিমান।’
‘এতই বা কিসের অভিমান? এই তো মেজদির—’ একটু ঢোক গিলে বলে নন্দিতা, ‘মনোহরপুকুরে মেজদির কথা বলছি—প্রত্যেক বছরে একটি করে ‘ইসু’, কই এরকম মান—অভিমান তো দেখি নি ছেলেমেয়েদের।’
সুমন্ত হেসে ফেলে বলে, ‘তাদের বোধ হয় গা সহা হয়ে গেছে।’ একটু থেমে আবার হেসে বলে, ‘মনোহরপুকুরের জন্যে মন কেমন করে তো?’
‘হ্যাঁ করে! বলেছি তোমায়!’ বলে ঝঙ্কার দিয়ে উঠে আবার হেসে ফেলে নন্দিতা, ‘ছোট বাচ্চাগুলোর জন্যে একটু—আধটু না করে তা নয়!’
‘মিঠুরও হয়তো করে!’ সুমন্ত বলে, ‘সেখানে তোমার ওই দিদিদের প্রতি বছরের ‘ইসু’র ফলে সঙ্গী—সংখ্যা তো কম ছিল না ওর? এখানে বেচারার একটিও বন্ধু নেই।’
নন্দিতা মৃদু হেসে বলে, ‘তুমি তো রয়েছ।’
‘ছোটদের বন্ধু হওয়া কি অত সহজ? অনেক বড় না হতে পারলে ছোটদের বন্ধু হওয়া যায় না।’ সুমন্ত বলে।
নন্দিতা কি বলতে যাচ্ছিল, সহসা সুমন্ত ছুটে চলে যায় মিঠুর ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দে। নন্দিতাও গেল।
‘কী হল রে মিঠু, কী হল?’
‘আরে কি হয়েছে তাই বল না?’
কিন্তু মিঠু কিছুই বলে না, শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
এই অহেতুক কান্নাটাকে ভোলানোর চেষ্টায় একেবারে ব্যর্থ হয়ে নন্দিতা ‘শয়তান কোথাকার’ বলে মেয়ের গালে ঠাশ করে একটা চড় বসিয়ে চলে যায়।
আর জীবনে এই প্রথম মায়ের কাছে মার খেয়ে মিঠু একেবারে আড়ষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকে। আড়ষ্ট হয়ে থাকে সুমন্তও এই অহেতুক নিষ্ঠুরতায়।
মিঠুর কচি গালের ওপর যে নীল নীল শিরাগুলো ফুটে ওঠে, সেগুলোকে নন্দিতার নীলচে চোখের বিদ্যুতের মত মনে হয় সুমন্তর।
বারেবারে সেই অনেকদিন আগে ট্রামগাড়িতে দেখা কমনীয় একখানি করপল্লবের ছবি ভেসে ওঠে সুমন্তর চোখের সামনে।
তারপর সে করপল্লব কত অজস্রবার দেখল, অহরহ দেখছে, তবু সেই প্রথম দেখাটাই মনে পড়তে থাকে। মনে পড়ে আর মনে হয়, কোমলতা কমনীয়তা এ কথাগুলো কি তবে অর্থহীন?
কিন্তু নন্দিতারও আজকাল প্রায়ই যখন তখন সেই আগের কথা মনে পড়ে।
ট্রামগাড়িতে শুধু চোখ তুলে দেখা, বৃষ্টির দিনে আচমকা এক ট্যাক্সিতে চড়ে বুকের কাঁপুনি, রোদে ঝকঝকে সকালে স্থান কাল পাত্র ভুলে নিরালা রাস্তায় যত ইচ্ছে হেঁটে হেঁটে বেড়ানো। মনে পড়ে আর মনে হয়—সেই বুঝি ভাল ছিল। সেই বুঝি ছিল সবচেয়ে সুখের দিন, সোনার দিন!
মনে হয় সুমন্তর চোখের সে দৃষ্টি কোথায় বুঝি হারিয়ে গেছে। সেই আবেগে বিহ্বল, প্রত্যাশায় উজ্জ্বল!
সেদিনটা আবার ফিরে আসে না? আসতে পারে না?
আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মনোহরপুকুর রোডের ছাইরঙা পুরনো দোতলা বাড়িটা, ভয়ঙ্কর বিভীষিকায় চোখ বুজতে ইচ্ছে করে।
সুমন্তর চোখের পলাতক দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টায় নতুন করে মোহিনী হয়ে উঠতে চায় নন্দিতা। নীল চোখে কালো কাজলের রেখা টানে, কবরীতে রজনীগন্ধার মালা জড়ায়, দেহবল্লরীতে লাল সিল্কের শাড়ি জড়িয়ে অগ্নিশিখার মত জ্বলতে থাকে।
কিন্তু সুমন্ত কি নন্দিতার মোহিনী মূর্তিতে ভুলেছিল?
‘খোকার দিকে তুমি ফিরেও তাকাও না’, নন্দিতা অভিমানে মধুর হয়ে বলে, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি এই খোকাটারই তুমি সৎ—বাপ।’
সুমন্ত মৃদু হেসে বলে, ‘আর আমারও মাঝে মাঝে মনে হয়, বুঝি মিঠুটার তুমি সৎ—মা।’
সুর কেটে যায়, নন্দিতা তীক্ষ্ন সুরে বলে—’কেন মিঠুর প্রতি সৎমা—জনোচিত কি দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে?’
‘এই সেরেছে! ঠাট্টায় রেগে উঠছ, লক্ষণ তো ভাল না। সন্দেহ হচ্ছে নন্দিতা, তোমার লিভার ফাংশন ভাল যাচ্ছে না।’
নন্দিতা ওর সেই ঝকঝকে দাঁতের হাসিতে আর ভোলে না এখন, ক্রুদ্ধস্বরে বলে, ‘মোটেই ঠাট্টা না, আমি দেখছি তোমার আজকাল একটা ধারণা হয়েছে, মিঠুকে আমি দেখতে পারি না।’
‘আহা তাই কখনো ধারণা করতে পারি? তবে একথা ঠিক, ওর ওপর নজরটা ঠিক মত রাখা হচ্ছে না আর আজকাল।’
‘একটা মানুষ তো দুটো হতে পারে না?’ নন্দিতা বিরক্ত স্বরে বলে, ‘আর একটা অসহায় জীব আমার ভরসাতেই আছে তা ভুলে যেও না।’
সুমন্ত তবু হার স্বীকার করে না, বরং বলে ওঠে, ‘সেই অসহায় জীবটা নেহাৎই একটা জীবমাত্র, তার মন নামক পদার্থটার বালাই এখনও হয় নি। তাকে সময়ে খানিকটা গিলিয়ে দিতে পারলেই তো মিটে গেল তার চাহিদা! মনওলা মানুষটার মনের দিকে তাকানো বেশী দরকার।’
হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে নন্দিতা, বলে বসে, ‘চিরকালের প্রবাদটা ভুলে যাচ্ছ বোধ হয়? মনে রেখো—মার চেয়ে দরদটা হাস্যকর।’
সুমন্তর চির—উজ্জ্বল মুখটা কি একটু মলিন হয়ে যায়? হয়তো হয়, হয়তো হয়ও না। তবু কথা সে সমান হেসেই বলে, ‘ও থিয়োরি আমি মানি না। মানবিকতা বলে একটা জিনিস আছে, সেটা ছকবাঁধা নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না।’
এমনি ছোটখাটো সংঘর্ষ, টুকরো—টাকরা ঘাত প্রতিঘাতে প্রায়ই বাষ্প জমে ওঠে দুজনের মধ্যে।
সব থেকে বিরক্তিকর লাগে নন্দিতার, মিঠুকে পাশের ঘরে রাখা নিয়ে সুমন্তর বাড়াবাড়ি ভাবালুতা। সুমন্তর চোখের নীরব দৃষ্টিতে, সামান্য একটু আক্ষেপোক্তিতে, ধরা পড়ে যায় সেই ভাবালু মনের অভিযোগ!
কেন, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে মা—বাপের কাছছাড়া হয়ে শোয় না? এই তো ছ বছর বয়েস হয়ে গেল মিঠুর, নেহাত কিছু বাচ্ছা নয়। মনোহরপুকুরের মেজদির ছেলেমেয়েগুলো একটু বড় হলেই তো ঠাকুমার ঘরে গিয়ে শোয়।
সভ্যতা ভব্যতা আধুনিকতা কিছুই যেন নেই সুমন্তর, আছে খালি খানিকটা মেয়েলী মায়া। যেটা অর্থহীন।
সেদিন অমনি বলল, ‘রাত্রে মিঠুটা শুতে যাবার সময় এমন বেচারীর মত এ ঘরের দরজার দিকে তাকাতে তাকাতে যায়, দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।’
আর একদিন বলল, ‘একটা বড় ঘরওয়ালা ফ্ল্যাট খুঁজছি, যাতে একটা ঘরে সকলে মিলে শোয়া যায়।’
খোকাটা হয়ে যে এ ঘরের জায়গা জুড়েছে, সেটাই যেন মস্ত এক অপরাধ।
খোকনের সম্পর্কিত ব্যাপারে নন্দিতার বাঘিনীর মনোভাব।
একা ওকে শুইয়ে রেখে নাইতে খেতে গিয়েও স্বস্তি নেই যেন। ঝি ‘খোকার মাকে’ বসিয়ে রেখে যায় এবং কড়া হুকুম দেয়, ‘মিঠুর কোলে টোলে দিও না যেন।’
খোকার মা বলে, ‘মিঠুর তো ভাইকে নেবার জন্যে বয়ে যাচ্ছে। আমি তো কত বলি, চল দেখি তো ভাইটি কেমন হাসছে খেলছে, হাত পা নাড়ছে, মেয়ে তোমার মা যেন কাঠ—গোঁয়ার, খালি বলবে, ভাই বিচ্ছিরী, ভাই পচা! বুড়োদের মতন আবার নিশ্বেস ফেলে।’
‘তা ফেলবে বৈ কি!’ মনে মনে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে যায় নন্দিতা। ‘অপয়া লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে! জন্মাবার আগেই আমার সব সুখ খেয়ে তবে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, আবার এখন এটুকুর ওপর বিষ নিশ্বাস ফেলছে। একবার স্বামীর নাম ঘুচিয়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে, আবার স্বামীর ভালবাসাটুকু কেড়ে নিচ্ছে আমার!’
সুমন্ত যদি মিঠুর সম্পর্কে উদাসীন হত, তা হলেই বুঝি মিঠুর পক্ষে ভাল হত।
খোকার দিকে মিঠু কেমন করে যেন তাকায়!
এই চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না নন্দিতা। মিঠুর চোখের দৃষ্টিটা ঠিক যেন ওর মনোহরপুকুরের ঠাকুমার মত। ওই রকম দৃষ্টিতে তিনি এক—এক সময় তাকিয়ে থাকতেন মিঠুর দিকে, দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত নন্দিতার।
এখনও সহসা মিঠুর দৃষ্টি দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়।
অমন যে লাবণ্য, সব যেন ঝরে পড়েছে মেয়ের মনের আগুনে আগুনে।
কি তবে করবে নন্দিতা? ওকেই খুব করে আদর করবে? খোকাকে ভাসিয়ে দিয়ে ওকে নিয়েই মাতবে? খোকা জন্মাবার আগে পর্যন্ত যেমন মিঠুর নাওয়া খাওয়া স্কুলে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে সারাক্ষণ ব্যাপৃত থাকত তেমনি থাকবে?
কর্তব্য নির্ধারণ করতে থাকে নন্দিতা মনে মনে, হয়তো বা পুরনো সুরে কাছে ডাকেও, কিন্তু মিঠু নিজেই যেন দূরে সরে গেছে।
তার পর একদিন ঘটল সেই অঘটন।
মানে নন্দিতা যেটাকে অঘটন ভাবল। ভয়ঙ্কর একটা গুরুত্ব দিল নন্দিতা জিনিসটাকে। অথচ যে কেউ যদি শোনে, বলবে, ‘এর চাইতে স্বাভাবিক ঘটনা আর কি আছে?’
ব্যাপারটা এই, বিকেলের দিকে নন্দিতা কোথায় যেন গিয়েছিল ছেলে নিয়ে। মাঝে মাঝে ছেলেকে ওজন করাতে যায়, হয়তো সেখানে, হয়তো বা সেই সহপাঠিনীর বাড়ি।
ফিরল সন্ধ্যায়।
রিকশ করে ফিরতে হয়েছে, ছেলে ঘুমিয়ে গেছে।
এদিকে সুমন্তও বেরিয়েছিল মিঠুকে নিয়ে, ঝি খোকার মা একা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত রয়েছে বলে। কিন্তু নন্দিতার আগেই সুমন্তকে ফিরতে হয়েছে, ঘুমিয়ে গেছে মিঠুও। রাত দশটা পর্যন্ত যে মেয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, সাধ্যপক্ষে বিছানায় যেতে চায় না, সে মেয়ের পক্ষে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক। নেতিয়ে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটাকে দেখে মায়া হল সুমন্তর—এক্ষুনি ওকে ওর খোকার মার ঘরের নিরানন্দ বিছানায় নির্বাসন দিতে প্রাণ চাইল না। আস্তে শুইয়ে দিল খোকনের বিছানাটায়। নিজে বসে বই পড়তে লাগল পাশে চেয়ারে।
নন্দিতা ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে করে সিঁড়িতে উঠে, হাঁপিয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকেই খোকনের বিছানা দখলিত দেখে খুব যেন অঘটন ঘটনা ঘটেছে এইভাবে ব্যস্ত আর বিরক্তস্বরে বলে ওঠে, ‘এর মানে? ও আবার এক্ষুনি ঘুমিয়েছে কি করতে? এ বিছানাতেই বা কেন?… খোকার মা! খোকার মা!’
‘খোকার মা শোয়ায় নি, আমি বেড়িয়ে ফিরে—থাক ওকে ডাকতে হবে না, আমি তুলে দিচ্ছি।’
মিঠুকে তুলে ওঘরে শুইয়ে দিয়ে আসে সুমন্ত।
খোকনকে শুইয়ে দিয়ে নন্দিতা হাঁপিয়ে বলে—’বাবাঃ ঘুমন্ত ছেলে নিয়ে—’
হাত ব্যথা হওয়ার কথাটা বলতে গিয়ে থেমে যায় নন্দিতা, নিতান্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেকেলে মায়েদের মতই। কারণ খোকনটি ভারীসারী হয়ে উঠেছে যথেষ্ট। ‘হাত ব্যথা’ কথার মধ্যে পাছে তার ইঙ্গিত ধরা পড়ে।
‘মিঠু আবার ঘুমুল কখন? খেয়েছে?’
‘না কখন আর খেল?’
‘খুব হেঁটেছে বুঝি?’ ছেলের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে নন্দিতা। সুমন্ত বলে, ‘না মোটেই না, আজ তো গাড়ি চড়ে বেড়িয়ে এল।’
‘গাড়ি চড়ে? কোথায় এ অভিযান?’
হেসেই বলল নন্দিতা।
কিন্তু উত্তর শুনে আর হাসিমুখ থাকল না।
সুমন্ত বলল, ‘পরেশনাথের মন্দির দেখিয়ে আনলাম।’
নন্দিতার মুখটা থমথমে হয়ে উঠল, ‘ওঃ। অতটা ট্যাক্সি খরচ করে শুধু মিঠুকে বেড়িয়ে আনা হল! এ সংকল্পটা আগে প্রকাশ করলে আমি না হয় ওখানে যেতাম না। খোকাটা গাড়ী চড়তে কী ভালই বাসে!’
সুমন্ত গম্ভীরভাবে বলে, ‘সংকল্পটা আগে হয় নি।’
‘তা হলে হল বোধ করি আমার নিষ্ঠুরতা দর্শনে! সপত্নীকন্যাকে ফেলে রেখে নিজের ছেলেটিকে নিয়ে বেড়াতে গেলাম!’ বিদ্রূপের সঙ্গে বলল নন্দিতা।
‘তোমার আচরণটা প্রায় সেই রকমই।’ সুমন্ত ক্ষুব্ধ গলায় বলে, ‘মিঠু একটু এ বিছানায় শুয়েছে বলে তুমি এমন আর্তনাদ করে উঠলে, যেন মনে হল বিছানায় একটা সাপব্যাঙ কিছু উঠেছে।’
নন্দিতা বলে, ‘ওঃ দোষটা আমারই হল! বাইরে খেলা করে আসা জামা পরে ছোটদের সঙ্গে মাখামাখি, তাদের বিছানায় শোওয়া, কত অস্বাস্থ্যকর তা জান?’
‘না জানি না। বাঙালী গেরস্থ ঘরে দু—পাঁচ ভাইবোন একই বিছানায় শোয়, কি হয় তাতে?’
‘কি হয় তাতে!’ নন্দিতা বিদ্রূপে মুখ কুঁচকে বলে, ‘চমৎকার! আর কিছু বলার নেই আমার।’
‘সত্যিই আর কিছু বলার নেই,’ সুমন্ত বলে, ‘কারণ ওটা তোমার আসল বক্তব্য ছিল না।’
‘তবে আসলটা কি ছিল?’
‘থাক, বলে আর কি হবে? কিন্তু নন্দিতা, জেনো ভালবাসার তীব্রতা কোন পক্ষেরই কল্যাণকর নয়। না নিজের, না ভালবাসার পাত্রের।’
‘তোমার উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ!’ বলে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে নন্দিতা।
খানিক পরে খোকার মা ডাক দেয়, ‘মা, মিঠু তো খায় নি!’
‘ডেকে খাওয়াও না’—নন্দিতা বিরক্তভাবে বলে, ‘একদিন নিজে থেকে কিছু করতে পার না? আমি বাড়ি নেই, ব্যস মেয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে!’
খোকার মা বলে ওঠে, ‘ডাকাডাকি তো করলাম, মেয়ে সাড়া দিল না। গায়ে হাত দিয়ে দেখছি গা যেন গরম গরম।’
‘তোমার মাথাটাই গরম!’ বলে উঠে পড়ে নন্দিতা, কিন্তু ওঘরে গিয়ে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে তার সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মিঠুর।
তার মানে জ্বর হওয়াতেই মিঠু অসময়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর তার মানেই জ্বরগায়ে খোকনের বিছানা বালিশে শুয়েছে। যে বিছানায় খোকন এখন শুয়ে আছে।
‘মেয়েকে আদর করে খুব গাড়ির হাওয়া লাগাও—’ সুমন্তকে পেড়ে ফেলবার সুযোগ পেয়ে যেন খুশী হয়ে ওঠে নন্দিতা, ‘জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে।’
সুমন্ত আস্তে ওঘরে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মিঠুর মাথার কাছে। এই তো ক’ঘণ্টা আগে কত খেলল, কত লাফাল! কী হল হঠাৎ?
কিন্তু শুধুই কি জ্বর?
পরদিন সকালে মাথা ঘুরে গেল নন্দিতার। শুধু জ্বর নয়, মিঠুর সর্বাঙ্গে হাম বেরিয়েছে।
তার মানে সেই হাম নিয়েই খোকনের বিছানায় শুয়েছে!
তার ওপর আবার মস্ত যন্ত্রণা, জ্বরে ছটফটিয়ে মিঠু খালি ‘মা মা’ করছে। কই এখন তো ‘বাবু বাবু’ ডাক নেই?
মনে মনে একটা উল্লাস অনুভব করে নন্দিতা, কিন্তু যন্ত্রণাও কম নয়। সে যে একটা নেহাত শিশুর মা, মাতৃদুগ্ধেই যে শিশুর প্রাণ। কোন সাহসে তবে নন্দিতা সংক্রামক রোগীর কাছে এসে বসবে? তাকে কাছে টেনে নেবে, বুকে টেনে নেবে?
ডাক্তারও তো মানা করে গেছে নন্দিতাকে ওঘরে ঢুকতে। অথচ ওর ওই ‘মা’ ডাকে প্রাণটা ফেটে যেতে থাকে।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নন্দিতা ছলছল চোখে কাতর কণ্ঠে বলে, ‘এই যে মা আমি! এই এখানে আছি। ডাক্তারবাবু আমায় ওঘরে যেতে মানা করেছে সোনা! তুমি ভাল হয়ে ওঠ, কত কোলে করব।’
মিঠু লাল লাল চোখ মেলে তাকায় আর বলে, ‘তুমি বাতাস কর।’
সুমন্ত বলে, ‘এই যে লক্ষ্মী মেয়ে, আমি বাতাস করছি।’
মিঠু চোখ বুজে পাশ ফিরে শোয়।
আর নন্দিতা?
তার যে শাঁখের করাত!
সে চোখভর্তি জল নিয়েও খোকনকে আলোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে তার গায়ে কিছু বেরোল কিনা। মিঠুর ঘরে না ঢুকলেও বার বার কার্বলিক সাবান দিয়ে হাত ধোয়।
কিন্তু সাবধানেই কি সব আটকানো যায়?
মিঠুর যেদিন জ্বর ছেড়েছে, একটু ভালর দিকে গেছে, নন্দিতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্নেহকোমল স্বরে প্রশ্ন করছে, ‘মিঠু মিঠু, আজ কী খেতে ইচ্ছে করছে রে?’
ঠিক সেই সময় খোকনের কান্না শোনা গেল। অর্থাৎ ঘুম ভেঙেছে তার।
নন্দিতা চঞ্চল হয়ে বলে, ‘কই বললি না মিঠু?’
হঠাৎ মিঠু বিছানায় উঠে বসে।
রোগের ক্ষীণ কণ্ঠ তীব্রতায় চিলের মত করে তুলে বলে, ‘না বলব না! কেন বলব তোমাকে? তুমি কি আমাকে ভালবাস?’
খোকার কান্না তীব্র হয়ে উঠেছে, তবু নন্দিতা ম্লানভাবে বলে, ‘আমি তোকে ভালবাসি না?’
‘না না, তুমি তো আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ, তুমি তো খোকনের মা!’
নীল আকাশের অতল স্নিগ্ধতায় নীল বিদ্যুৎ শিখা জ্বলে ওঠে।
আর কিছু নয়, সুমন্তর কুশিক্ষা।
উঃ কি বিষকন্যা মেয়েই তার জন্মেছিল যে সবটা গ্রাস করতে চায়! বাপের কাছে খোকনের যেটুকু প্রাপ্য পাওনা সেটুকু সে পেল না ওই মেয়ের নজরে নজরে।
রোগা মেয়ের ওপর যে মমতা এসেছিল, উপে যায় তা, তীব্রস্বরে বলে ওঠে নন্দিতা, ‘ঠিক আছে, শুধু খোকনের মা আমি! বেশ করেছি ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। ঢুকবও না তোর ঘরে। ডাকছিস কেন তবে ‘মা মা’ করে?’
বলে বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে যায়।
কারণ খোকনের কান্না তখন প্রবল হয়ে উঠেছে।
কিন্তু রাত্রে ঘুমের অবসরে খোকনের যে এইসব কাণ্ড হয়ে আছে, তা তো ভোরবেলায় ওঠার সময় দেখে নি নন্দিতা?
এ কী! এ কী!
যা ভেবেছিল তাই হল?
আর কিছু নয়, সেই সেদিনের ছোঁয়াচ! হাম নিয়েই তো খোকনের বালিশে শুয়েছিল লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে। সব খাবে ও নন্দিতার, সব খাবে।
খোকনের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
খোকনের সর্বাঙ্গ লাল টকটকে।
সুমন্ত গিয়েছিল ফল কিনতে। নিয়ে এসে দেখল মিঠু শুয়ে শুয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছে।
আবার কি হল!
‘কি হয়েছে রে মিঠু, কি হয়েছে?’
মিঠুর কান্না থামতে চায় না।
রোগা মেয়ে, এ কি বিপদ! সুমন্ত বলে, ‘আরে বাবা, হল কি তাই বল।’
‘মা বলেছে আমার মা থাকবে না, শুধু খোকনের মা হবে।’
সুমন্ত অবাক হয়ে যায়, হতাশ হয়ে যায়। ক্লান্ত স্বরে বলে, ‘কখন বলল মা একথা?’
‘এখন! বলল, বেশ করেছি তোকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। বলল, ঢুকব না তোর ঘরে। বলল ‘মা মা’ করে ডাকিস কেন?’
সুমন্ত ফলের ঠোঙাটা খুলতে থাকে আস্তে আস্তে।
কতকগুলো ছাড়ানো পানিফল প্লেটে করে মেয়ের সামনে ধরে দিয়ে সুমন্ত এঘরে এসে দাঁড়ায়, আর সঙ্গে সঙ্গে নন্দিতা যেন ফেটে পড়ে, ‘হয়েছে, এইবার তোমাদের মনস্কামনা সিদ্ধি হয়েছে? খোকাকেও রোগে ধরেছে!’
‘আমাদের মনস্কামনা!’
কষ্টে উচ্চারণ করে আড়ষ্ট সুমন্ত।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার আর তোমার মেয়ের! অবাক হচ্ছ কেন? খোকন তো তোমাদের চক্ষুশূল, ও এসে জায়গা জুড়েছে, ওর জন্যে তোমার সোহাগের পুতুল ঘরছাড়া হয়েছে, ও না বাঁচলেই বা কি—’
সুমন্ত এবার কথা বলে, স্বভাব—বহির্ভূত চেঁচিয়েই বলে, ‘কি বকছ পাগলের মত?’
নন্দিতা যদি হঠাৎ কেঁদে ফেলত, যদি ছেলের ভাবনায় ভেঙে পড়ত, তা হলে বদলে যেত নাটকের বাকী অংশটা।
সুমন্ত এই ভীরু জননী—হৃদয়কে ভরিয়ে দিত স্নেহ দিয়ে সাহস দিয়ে। ছেলের জন্য তৎপর হয়ে উঠে ডাক্তার আনতে যেত, উৎকণ্ঠিত পিতৃহৃদয় নিয়ে রাত জাগত বসে বসে, আর সেই পথ দিয়ে প্রতিদিনের তুচ্ছ ঘাত—প্রতিঘাতের গ্লানি মুছে গিয়ে নতুন করে ভাস্বর হয়ে উঠত তাদের প্রেম। ভুল ধারণা মুছে ফেলে মিঠুকে আবার অবোধ শিশু ভাবতে শিখত নন্দিতা, মিঠুর অভিমানকে স্নেহে কৌতুকে সহ্য করে নিত।
হয়তো সুমন্ত যোগাড় করে ফেলত একটা বড় ঘরওয়ালা ফ্ল্যাট, যে ঘরে মিঠুকেও কুলতো।
সেই বড় ঘরে মনও বড় হয়ে যেত হয়তো—নন্দিতার, মিঠুর। ছায়া মজুমদার আর খোকন মিত্তিরকে নিয়ে একটি সুখী পরিবার গড়ে তুলত সুমন্ত আর নন্দিতা।
কিন্তু নন্দিতা কাঁদল না, নন্দিতা ভেঙে পড়ল না!
নন্দিতা পক্ষিমাতা নয়, ব্যাঘ্রীমাতা।
হয়তো ঘর ভেঙে অনেক দুঃখের সাগর সাঁতরে এসে আবার ঘর পেয়েছে বলেই সে ঘর ফের হারাবার ভয়ে এত প্রখর হয়ে উঠেছে নন্দিতা।
তাই নন্দিতার কটা কটা নীলচে চুলগুলো সাপের ফণার মত দুলে উঠল, নীলাভ মণি দুটো হঠাৎ জ্বেলে দেওয়া নীল বালবের মত ঝলসে উঠল, আর কণ্ঠ ঝলসে উঠল আগুনের মত, ‘পাগল আমি সাধে হই নি! চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি ওই মজুমদার গুষ্টির মেয়ের বিষাক্ত নিশ্বাসে আমার সব যাবে!’
‘দেখতে পাচ্ছ? বাঃ চমৎকার দিব্য দৃষ্টি তো তোমার!’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সুমন্ত।
আর বেরিয়ে এ ঘরে এসে অদ্ভুত একটা কাজ করে বসল।
মিঠুর কাছে এসে নীচু হয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এই মিঠু শোন শোন, উঠতে পারবি? আস্তে আস্তে ওঠ, আমার কোলে উঠে পড়, চল আমরা এখান থেকে পালাই।’
‘পালাব আমরা বাবু?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ—পালাব।’
ডাক্তার এসে রোগীকে দেখে ভরাট গলায় বলেন, ‘ভাবনার কিছু নেই। বাড়িতে একটা কেস হলে বাচ্ছাদের হবেই, ও রোখা যায় না। বাতাসে করে। বাড়িতে কেন, পাড়াতে এলেও হয়। আপনার মেয়েটিকেও কিন্তু খুব সাবধানে রাখবেন, অসুখের শেষের দিকটাই বেশী সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার! প্রফেসর মিত্র কবে আসবেন?’
কবে আসবেন!
নন্দিতা অবাক হয়ে বলে, ‘কবে আসবেন মানে?’
অবাক ডাক্তারও হলেন।
‘উনি আমাকে কল দিতে গিয়ে যে বললেন, কয়েক দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছেন। আমাকে দু বেলা এসে বাচ্ছাকে দেখে যেতে বললেন।’
নন্দিতা সামলে নিয়ে বলে, ‘যাবার কথা একটা আছে বটে, কিন্তু খুব ঠিক নেই।’
তারপর নন্দিতা বাঘিনীর মত ফুঁসতে লাগলো।…চলে গেল? নিজের শিশু সন্তানের ওই রকম মারাত্মক অসুখ দেখেও চলে গেল?
তা মারাত্মক ছাড়া আর কি!
হাম রোগটি ছোট বাচ্ছাদের যে কতদূর অনিষ্ট করতে সক্ষম, তার নজীর কি জানা নেই নন্দিতার? না কি সুমন্তরই জানা নেই? সেই ভয়ঙ্কর আশঙ্কার গ্রাসের মধ্যে অসহায় নন্দিতাকে একা ফেলে রেখে চলে গেল শাস্তি দিতে?
শাস্তিই।
তাছাড়া আর কী?
স্বস্তি দিতে নিশ্চয়ই নয়!
শাস্তি দিতে। জব্দ করতে। নন্দিতার সঙ্গে সুমন্ত এই রকম দুর্ব্যবহার করেছে, এ কথা যতবারই ভাবছে নন্দিতা, মাথা ঠুকে মরতে ইচ্ছে করছে তার।
কী দুর্ভাগিনী নন্দিতা! কী দুর্ভাগিনী!
যে ভালবাসা সমগ্র পৃথিবীকে তুচ্ছ করে নন্দিতাকে কাছে টেনেছে, সেই ভালবাসা এমন করে নির্মূল হয়ে গেল তার ভাগ্যে!
কেন? কেন?
কেন, ভাবতেই আবার সেই পুরনো অপরাধিনীর চেহারাটাই চোখের উপর ভেসে ওঠে।
সেই কপালের উপর চুল এসে পড়া, গোলগাল মুখ মেয়েটা! অসুখে যে সে মুখ চুপসে গিয়েছিল, তা আর মনে পড়ে না নন্দিতার, ঘুরে বেড়ানো মেয়েটাকেই মনে পড়ে। আর মনে পড়ে যায়, মেয়েটার আকৃতিতে কোথাও নেই নন্দিতার ছাপ। ঠিক ওই মজুমদার বাড়ির মত গোলগাল বেঁটে খাটো!
শনি শনি, ওই মেয়েই নন্দিতার শনি! এখন বুঝতে পারছে নন্দিতা, কেন তার শাশুড়ী ওই মেয়েটাকে বিষ নজরে দেখতেন। বিষকন্যা, তাই বিষ নজরে দেখতেন। আশ্চর্য! আশ্চর্য! নিজের শত্রুকে নিজের গর্ভে ধরেছে নন্দিতা, নিজের সবটুকু স্নেহরস দিয়ে বড় করে তুলেছে।
ওরাই তো ঠিক বলতো।
নন্দিতার শ্বশুর বাড়ির মেয়েরা।
বলতো, ‘কোন প্রাণে যে ওই মেয়েকে অত সোহাগ করে নন্দিতা! মনে পড়ে না ওই অপয়া মেয়ে কী দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে নন্দিতার!’
এখন, এখন ও তাই।
নন্দিতার মরে যাওয়া জীবন আবার যখন ষোলোকলায় বিকশিত হয়ে উঠেছে, তখন ওই অলক্ষণা মেয়ে, তার ভাগ্যের রাহু, সেই জীবনকে থেঁতলে দিল!
তারপর অন্য সন্দেহ আসে। শুধু মিঠুই নয়, আরো অন্য কিছু। খোকনটা হয়ে পর্য্যন্তই যেন সুমন্তর মন ঘুরে গেছে। তার মানে, বিধবা বিয়ের সন্তানকে বরদাস্ত করতে বেধেছে। চিরাচরিত বাঙালী মনের সংস্কার তাকে সহসা বিমুখ করেছে।
ঝোঁকের মাথায় বিয়েটা করে ফেলেছিল, হয়তো সখ মিটে গেলে ত্যাগ করতো, দেখলো বন্ধনের গ্রন্থী শক্ত হচ্ছে, তাই ভয় পেল!
সুমন্ত নামের মানুষটাকে স্বচ্ছ চোখে দেখতে চাইল না নন্দিতা, অন্ধ অভিমানের দৃষ্টিতে একটা কালিমূর্ত্তি চেহারার কল্পনা করতে লাগলো।
আর সেই কল্পনাই ক্রমশঃ ভয়ঙ্করী হয়ে উঠলো যেন।
হয়তো এমনিই হয়।
মিঠুকে নিয়ে মনোহরপুকুরের বাড়িতে থাকতে, ভিতরে ভিতরে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিটা মজবুৎ হচ্ছিল নন্দিতার, আর সকলকেই শত্রুপক্ষ ভাববার অভ্যাস দৃঢ় হচ্ছিল, সেই প্রবৃত্তি আর অভ্যাস নিজের কাজ করে চলছে। তবে তখন অসহায়তায় যেটা ছিল গোপন মৃদু, এখন সহায় সম্বলের সিংহাসনে বসে, সেটাই প্রখর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তাই অনায়াসেই ভাবতে পারে নন্দিতা, ও আমাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। মিঠুর ওপর দরদ দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আচ্ছা আমিও দেখে নেব!
কেস করবো ওর নামে।
খোকা একটু ভাল হয়ে উঠলেই ধরছি হাল। মেয়ে চুরির অভিযোগ আনবো। বলবো বি—পিতার হিংসা বৃত্তি চরিতার্থ করতে কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে। হয়তো গুম খুন করে ফেলতে, হয়তো বেচে ফেলতে। বলবো এই কথা উকিলের কাছে।
আমায় জব্দ করা বার করছি!
সাপিনীর মত ফুঁসতে থাকে।
সুমন্তর সেই আদালতে দাঁড়ানো মূর্ত্তিটা কল্পনা করে হিংস্র একটা উল্লাস বোধ করতে থাকে।
বান্ধবী তার সহায়, তাকে ডেকে পাঠায়।
তার সঙ্গে পরামর্শ করে।
সে এসে গালে হাত দেয়, তারপরে স্বামীকে ধরে তিনজনে পরামর্শ চালায় কী ভাবে কেস সাজানো যায়। তাদের কাছেও অবশ্য নন্দিতা ওই বি—পিতার হিংস্রতার কথাই বলে ঘটা করে।
বান্ধবী একবার বলে বটে, ‘কিন্তু তুই যে বলতিস মেয়েটাকে না কি খুব ভালবাসে—’
‘দেখাতো! দেখাতো!’ নন্দিতা কাঁদো কাঁদো হয়, ‘হাত করবার জন্যে অভিনয় করতো। কচি বাচ্ছা, ভুলেছিল সে অভিনয়ে। তাইনা ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো! ভুলিয়ে কি জোর করে, তাই বা কে জানে! বিছানায় শোওয়া রুগী, গেলই বা কী করে!’
ওদের না তাতালে কাজ এগোবে না, তাই ওদের কাছে যা ইচ্ছে বলে চলে নন্দিতা। আর সেটা মেনে নেওয়া অসম্ভবও হয় না ওদের। বিমাতায় বিষ খাওয়ান, এতো আদি অন্তকালের ঘটনা। বি—পিতাই বা যিশুখৃষ্টের অবতার হতে যাবে কেন?
দিন চারেক পরে সুমন্ত ফিরলো।
একা! দেখেই মনটা ধ্বক করে ওঠে। শূন্যতাটা হিংস্রতা হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই তাই বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে আসে নন্দিতা। ‘কোথায় রেখে এলে তাকে?’
সুমন্ত ইতিমধ্যের খবর জানে না।
জানে না, তার নামে কেস সাজানোর তোড়জোড় চলছে। তাই অবহেলায় বলে, ‘সে কথা না জানলেই বা ক্ষতি কি?’
‘ক্ষতি নেই? আমার মেয়েকে তুমি চুরি করে সরিয়ে ফেলবে, আমার ক্ষতি নেই?’
সুমন্ত আগে ডাক্তার বাড়ি ঘুরে এসেছে, ছেলের সুস্থতার খবর জেনে এসেছে, তাই বলে, ‘তোমার ছেলে নিয়েই থাকোনা নিশ্চিন্ত হয়ে, মেয়ে ভাল জায়গাতেই আছে।’
‘ভাল জায়গায়?’
নন্দিতা ওই অগ্রাহ্য আর অবহেলা আঁকা মুখ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অপরাধীর কুণ্ঠা নেই, লজ্জা নেই, দুঃখ নেই, অকারণ নন্দিতাকে এতখানি অপমান করছে।
নন্দিতাও তবে অপমান করবে না কেন?
নন্দিতাও তাই চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘ভাল জায়গায়? কোথায়? মাটির নীচে না গঙ্গার তলায়?’
‘কী বললে?’
‘যা বলেছি ঠিকই বলেছি’, ক্ষিপ্ত নন্দিতা আরো চেঁচায়, ‘কে বিশ্বাস করবে মিঠুকে তুমি দরদ করে ভালো জায়গায় রেখে এসেছ? আমি বলবো তুমি ওকে খুন করেছ, নয় বেচে দিয়ে এসেছ। কেস করবো তোমার নামে।’
অবর্ণনীয় একটা বিস্ময়ের ধিক্কারে স্তব্ধ হয়ে যায় সুমন্ত, তাকিয়ে থাকে নন্দিতার দিকে। ভাবে একে দেখে আমি ভুলেছিলাম? তারপর ঘৃণার গলায় বলে, ‘বেশ, করো কেস।’
অস্নাত অভুক্ত অবস্থায় চলে গেল সেই দিনই। বালিতে এক পিসতুতো বোনের বাড়িতে রেখে এসেছিল মিঠুকে, চুপিচুপি কিছুটা অবস্থা জানিয়ে। অবশ্য সত্য মিথ্যায় মিশিয়ে।
বলেছিল, ‘ওই ছোঁয়াচ ছোঁয়াচ করে তোদের বৌদি পাগল। অথচ এটার এই অসুখের অবস্থায় অযত্ন হচ্ছে ভেবে অস্থির। তা কে আর এ বেচারার ভার নেবে বল? না ওর পিতৃকুল, না আমার পিতৃকুল, না তোদের বৌদির পিতৃকুল। ভাবতে ভাবতে তোর কথা মনে পড়ে গেল—যদি আপত্তি না থাকে—’
বোন বলেছিল, ‘আমার আর আপত্তি কি? শূন্য ঘর নিয়েই তো আছি, একটা বাচ্ছা যদি দুদিনও ঘোরে বর্ত্তে যাই। ও থাকতে পারবে কি?’
‘পারবে, পারবে।’
তারপর তাকে পারাবার জন্যে অনেক গল্প ফেঁদেছিল। মিঠু অনেক বড় হলে একা মিঠুকে নিয়েই যে সুমন্ত বিলেত যাবে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এবং নিজে দুদিন থেকে, মন বসিয়ে, ‘কাল আসবো’ প্রতিশ্রুতি পত্রে স্বাক্ষর করে তবে এসেছিল।
নতুন পিসিকেও ভারী ভালো লেগে গেছে মিঠুর, সেটাও অবস্থা অনুকূলে আনতে সাহায্য করেছে।
‘এটা যদি তোমার সম্পত্তি হতো তো মানুষ করবার জন্যে চেয়ে নিতাম—’বোন হেসে বলেছিল। ‘বলতাম তোমাকে তো ভগবান নতুন খেলনা দিয়েছেন!’
সুমন্ত হেসেছিল, ‘যদি আমার হতো!’ তারপর বলেছিল, ‘তা নতুন খেলনাটি নিয়ে তোদের বৌদি যে রকম হিমসিম খাচ্ছেন, বলা যায় না তোর অভিলাষ পূর্ণ হয় কি না।’
হাসতে হাসতেই চলে এসেছিল, এবং ভেবেছিল, নন্দিতা এই দু’দিনেই নিশ্চয় যথেষ্ট কাবু হয়ে গেছে, যতই হোক মায়ের প্রাণ! তাছাড়া সুমন্তর ওপরও অভিমান হয়েছে। অতএব শিক্ষা’ একটু হয়েছে, যেটার দরকার ছিল।
মিঠুর অনুপস্থিতি দিয়ে মিঠুর মূল্যটা বোঝাতে চেয়েছিল।
এসে দেখলো নন্দিতাই তাকে শিক্ষা দেবার জন্যে বদ্ধপরিকর।
‘কেস’এ কী কী পয়েণ্ট থাকবে, নিজেই বাহাদুরী করে বললো নন্দিতা।
সুমন্ত এই অবিশ্বাস্য ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়ে বলে গেল, ‘ঠিক আছে! আদালতে যদি কাজীর বিচারের মত বিচার হয়, তুমি নিশ্চয়ই মেয়েকে কেটে আধখানা নেবার পক্ষেই সম্মতি দেবে?’
উত্তরটা শুনল না, চলে গেল।
নন্দিতার ওই চোখরাঙানিকে গ্রাহ্য করল না।
ও তো জানে ‘চোরাই মাল’ তার অনুকূলেই সাক্ষ্য দেবে।…
তারপর ঘর পর আত্মীয় স্বজন বন্ধু কুটুম্ব সকলেই জেনে ফেলল, নন্দিতার দ্বিতীয় স্বামী নন্দিতাকে ত্যাগ করে চলে গেছে। অবিশ্যি একেবারে নৃশংসতা করে নি, বাড়িভাড়াটা যুগিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত, আর কলেজ থেকে দারোয়ানকে দিয়ে টাকাও পাঠাচ্ছে মাসকাবারে। কিন্তু নন্দিতাকে জব্দ করতে ওর পূর্বস্বামীর সন্তান পাঁচ—ছ বছরের মেয়েটাকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে।
বাড়ির ঝি—চাকর বলে, ওই মেয়েটাকে নিয়েই নাকি কলহের সূত্রপাত। হওয়াই স্বাভাবিক, সপত্ন্য সম্পর্ককে বিমাতারাই সহ্য করতে পারে না, তা পিতা! কে বলতে পারে মেয়েটাকে আটকে রেখে গুম—খুন করে ফেলবে কি না।
অবিশ্যি নন্দিতাও নিশ্চেষ্ট বসে নেই, সে মহামান্য সরকার বাহাদুরের কাছে আবেদন করেছে। দুটো চার্জ গড়া হচ্ছে সুমন্তর নামে, স্ত্রী—পুত্র ত্যাগ, এবং মেয়েচুরি।
বেশ কিছুদিন ধরেই হয়তো সে কেস অনেকের খোরাক যোগাবে। উকিলের, ব্যারিস্টারের, সাংবাদিকের।
সকালবেলা খবরের কাগজ খুললেই আমার আপনার সকলেরই চোখে পড়বে সে খবর।
নন্দিতা ভুলে গেছে, সুমন্ত আর সে শুধু একবার দেখা হওয়ার জন্যে মিছিমিছি ট্রামে চড়ত। ভুলে গেছে, বৃষ্টির দিনে শুধু মাথা বাঁচাবার জন্যে অকারণ দোকানে উঠে ডালমুট আর চকোলেট কিনেছিল ওরা, আর রোদে ঝকঝকে সকালে অকারণ রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছিল।
আর সুমন্ত ভোলবার সাধনা করছে একদা একটি ঝিরিঝিরি সরু সোনার বালা পরা হাতের কমনীয় করপল্লবখানি আপন করায়ত্ত করার জন্যে সে ঘর সংসার আত্মপরিজন সব তুচ্ছ করেছিল।
সুমন্ত যদি সেই পিপাসার্ত হাতখানি না বাড়াত, যদি শুধু সেই দূর থেকে দেখাটাই জীবনের কেন্দ্রে অচল করে রাখত জীবনের ধ্রুবতারার মত, তা হলেই কি ঠিক করত?
সুমন্ত ভুল করেছে তপস্বিনীকে মোহিনী বানিয়ে? না কি সেটা ভুল নয়, ভুল শুধু সুমন্ত মিত্র হয়ে ছায়া মজুমদারের জন্যে পিতৃস্নেহের সুধাধারাখানি উজাড় করে দেওয়া!
এখন সকলের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শুধু নন্দিতা আর সুমন্ত।
বহু লোকের বহু অনুমান নানা উল্টোপাল্টা পরিস্থিতিতে ঠেক খেয়ে গড়িয়ে পড়ে, ঝরে পড়ে। সত্যকার সত্যকে অনুমান করতে পারে এতখানি কল্পনাকুশলী হৃদয় সংসারে কোথায়?
থাকবেই বা কোথা থেকে?
একে অপরের জীবনের বহির্দৃশ্যটাই তো শুধু দেখতে পায়, ভিতরের অমৃতকুম্ভের সন্ধান কে পায়?
বাইরেটুকু নিয়েই নাড়াচাড়া সংসারের, সেইটুকু নিয়েই পাশ—ফেলের নম্বর দেওয়া।
জীবনের কত সুর, কত গান, কত কাব্য এমনি করেই রূপ হারায়, ছন্দ হারায়, বিকৃত মূর্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
লোকে বলে, ছি ছি, এই প্রেম! এরই এত বড়াই! বলে, ছি ছি সত্যিই বটে, মানুষ জীবটা ধুলোমাটি ছাড়া আর কিছু নয়।