অধ্যায় নয় – যেখানে চার্লি দরজা খুলে দিল আর স্পাইডার মুখোমুখি হলো ফ্ল্যামিঙ্গোর
অধ্যায় নয় – যেখানে চার্লি দরজা খুলে দিল আর স্পাইডার মুখোমুখি হলো ফ্ল্যামিঙ্গোর
ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে মোটকু চার্লির, আর সেটা অনুভবও করতে পারছে সে। যে বিমানে করে ইংল্যান্ডে ফিরছিল, সেটার টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে; তাই ইকোনমি থেকে ফার্স্ট ক্লাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে। খাবারটাও অসাধারণ। আটলান্টিকের মাঝপথে এসে, ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ওকে জানাল- চকলেটের একটা বাক্স পুরষ্কার হিসেবে জিতেছে সে; শুধু তাই না, সঙ্গে সঙ্গে দিয়েও দিল ওর উপহার। মাথার ওপরের লকারে সেটা রাখল মোটকু চার্লি, তারপর অর্ডার দিল বরফঅলা ড্রামবুই[২৪]।
[২৪. এক ধরনের সোনালি মদ যা বানানো হয় স্কচ হুইস্কি, হেদার গাছের রস ও জুড়িবুটির মিশ্রণে।]
বাড়ি ফিরে আগে অফিসে যাবে। গ্রাহাম কোটসের সঙ্গে বসে ভুল বোঝাবুঝির একটা ইতি টানবে প্রথমেই। কেননা অন্তত এই একটা ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে- হিসেবে কোনো ভুল হয়নি ওর। রোজির সঙ্গেও ঝামেলা চুকিয়ে ফেলবে।
দিনশেষে ভালোই হবে সবকিছু।
স্পাইডারকে দেখতে পাবে কি না, সেটা ভাবল ও। হয়তো তার ভাই এরইমাঝে বিদেয় নিয়েছে, আবার কপাল ভালো হলে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার সৌভাগ্যও হতে পারে। পরেরটা হলেই খুশি হবে সে।
মোটকু চার্লি দেখতে চায়: ওর ভাই ক্ষমা চাইছে, এমনকী নাকখত দিলে আরও ভালো। জবাবে কী বলবে সে, সেটাও ভেবে রেখেছে।
‘ভাগো!’ বলবে মোটকু চার্লি। ‘সঙ্গে নিয়ে যাও তোমার সূর্যালোক, তোমার জ্যাকুজি আর শোবার ঘর!’
‘কী বললেন?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট।
‘নিজের সঙ্গে কথা বলছিলাম,’ মোটকু চার্লি জবাব দিল। ‘উম, দুঃখিত।’
এভাবে লজ্জা পেয়েও খারাপ লাগছে না ওর। বিমান ক্রাশ করে সব শেষ হয়ে যাক—সেই প্রার্থনাও করছে না। মনে হচ্ছে: বেঁচে থাকাটা মন্দ না!
এটা-সেটা ভরতি একটা বাক্স দেওয়া হয়েছে ওকে বিমানের কোম্পানির পক্ষ থেকে। চোখে ঢাকনি দিল সে, যতদূর সম্ভব হেলিয়ে দিল ওর আসনটা; প্রায় শুয়েই পড়ল বলা চলে। রোজির কথা ভাবল একবার, যদিও ওর মনে থাকা রোজির চেহারা প্রায়শই বদলে যাচ্ছে; রূপ নিচ্ছে এমন একজনের, যার পরনে বলতে গেলে কিছুই নেই। অপরাধ বোধে ক্লিষ্ট হয়ে মেয়েটাকে পোশাক পরাল সে, হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল—পোশাকটা আসলে পুলিসের ইউনিফর্ম! খুবই খারাপ লাগছে, নিজেকেই শোনাল। তবে অনুভূতিটা তেমন জোরাল হলো না। নিজেকে নিজেই লজ্জা পাওয়া উচিত ওর, উচিত হলো…
সিটে নড়ে-চড়ে বসে, তৃপ্তির সঙ্গে নাক ডাকাতে শুরু করল মোটকু চার্লি। হিথরোতে যখন নেমেছে, তখনও মেজাজ খুবই ভালো ছেলেটার। হিথরো এক্সপ্রেসে করে চলে এলো প্যাডিংটনে, ইংল্যান্ড থেকে স্বল্প সময়ের যে বিরতি নিয়েছে তার মাঝে সূর্য বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে খুশিই হলো।
মেঘ দেখে তোরা করিসনে ভয়, নিজেকে শোনাল সে। আড়ালে তাহার সূর্য হাসে…
তবে একমাত্র অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল ট্রেনের যাত্রাপথের মধ্যখানে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সে বাইরে, হিথরোতে যে কেন খবরের কাগজ কিনল না—সেই কথা জিজ্ঞেস করছে নিজেকেই। এক টুকরো সবুজ অতিক্রম করছে ট্রেনটা—সম্ভবত স্কুলের মাঠ হবে। মনে হলো, আচমকা অন্ধকার হয়ে গেছে আকাশ; সিগন্যাল পেয়ে হিসহিসিয়ে ব্রেক করে ক্রসিঙে থামল ট্রেনটা।
তাতে খুব একটা কিছু যায় আসে না মোটকু চার্লির। শরৎকালে ইংল্যান্ড এমনই হয়: সূর্য কেবল তখনই দেখা দেয়, যখন বৃষ্টি হয় না কিংবা মেঘ জমে না আকাশে। কিন্তু ওই সবুজ মাঠের ধারেই, একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একখানা অবয়ব!
প্রথম দেখায় মোটকু চার্লির মনে হলো, ওটা আসলে একটা কাকতাড়ুয়া।
কিন্তু ভাবনাটাই হাস্যকর। কাকতাড়ুয়া হবে কীভাবে? তাদেরকে তো পাওয়া যায় খেতের মাঝে, ফুটবল মাঠে না; বনের পাশে তো কোনোদিনই না। যাই হোক, এমনিতেও ওটাকে কাকতাড়ুয়া বলা যায় না…
…চারপাশে কাকের ঝাঁক, সবখানে; বিশাল বিশাল কালো সব কাক।
পরক্ষণেই নড়ে উঠল ওটা!
অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে বলে অবয়বটা ঝাপসা, মনে হচ্ছে যেন পাতলা একটা দেহ গায়ে বাদামি রেইনকোট পরে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তাকে চিনতে মোটকু চার্লির বেগ পেতে হলো না। জানে, যদি কাছে যায় তাহলে দেখতে পাবে অবসিডিয়ানে খোদাই করা একটা চেহারা, দাঁড় কাকের মতো কালো চুল আর উন্মাদনায় ভরা চোখ।
ঠিক তখনই কেঁপে উঠে নড়তে শুরু করল ট্রেনটা, চোখের পলকে বাদামি রেইনকোট পরা মহিলা হারিয়ে গেল।
অস্বস্তি বোধ করছে মোটকু চার্লি। এতক্ষণে নিজেকে সে বুঝিয়ে ফেলেছিল যে মিসেস ডানউইডির বসার ঘরে যা হয়েছে, কিংবা যা হয়েছে বলে ভাবছে, তার সবই ভ্রম। হয়তো কিছুটা সত্যি, কিন্তু পুরোটা বাস্তব হতেই পারে না। ঘটেছে বটে ঘটনাটা: কিন্তু প্রকৃত সত্যের রূপক হিসেবে। কেননা সত্যিকারের কোনো জায়গায় ও যায় কীভাবে ওখান থেকে? কীভাবে চুক্তি করে কারও সঙ্গে?
আসলে, পুরোটাই ছিল ভ্রম…বড়োজোর রূপক।
তাহলে সবকিছু ভালো হতে শুরু করবে, কেন এই ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত ছিল—নিজেকে সেই প্রশ্ন করতে গেল না। বাস্তবতা যেমন আছে, তেমনি আছে বাস্তবতার বাস্তবতা… আর কিছু জিনিস অন্য সবকিছুর চাইতেও বাস্তব!
ক্রমেই ওকে বহনকারী ট্রেনটার গতি বেড়ে চলল।
.
গ্রিক রেস্তোরাঁটা থেকে বাড়িতে প্রায় ফিরে এসেছে স্পাইডার, গালের সঙ্গে চেপে ধরে আছে ন্যাপকিনটা। আচমকা ওর কাঁধে হাত রাখল কেউ।
‘চার্লস?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
লাফ দিল স্পাইডার; অবশ্য সেটাকে লাফ না বলে চমকে উঠে ছোট্ট আর্ত-চিৎকারও বলা যেতে পারে।
‘চার্লস? তুমি ঠিক আছ? গালে কেটে গেল কীভাবে?’
মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল সে। ‘তুমি… তুমিই তো?’ ছুড়ে দিল প্রশ্ন।
‘কীহ?’
‘তুমি, রোজি তো?’
‘এ আবার কেমনতর প্রশ্ন? অবশ্যই আমি রোজি। গালে ব্যথা পেলে কীভাবে?
আরও শক্ত করে ন্যাপকিনটা গালের সঙ্গে ঠেসে ধরল স্পাইডার। ‘কেটে গেছে,’ জানাল।
‘দেখি দেখি,’ ছেলেটার হাত গালের ওপর থেকে সরিয়ে দিল রোজি। সাদা ন্যাপকিনের ঠিক মধ্যখানটায় খয়েরি দাগ পড়ে গেছে, যেন রক্ত লেগেছে ওতে। কিন্তু গালে কাটা-টাটা কিচ্ছু নেই! ‘কিছুই তো নেই!’
‘ওহ!’
‘চার্লস? ঠিক আছ তো?’
‘হ্যাঁ, জবাব দিল স্পাইডার। ‘ঠিক আছি। কিন্তু নাও থাকতে পারি, হয়তো ধরতেই পারছি না! তবে বাড়িতে গেলে ভালো হবে মনে হচ্ছে, সেখানে নিরাপদে থাকব।’
‘আমাদের না আজ লাঞ্চ খাওয়ার কথা ছিল?’ বলল রোজি, এমন কণ্ঠে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল স্পাইডার। ‘জানি আমি। কেউ সম্ভবত আমাকে খুন করার চেষ্টা চালিয়েছে। যদিও তোমার রূপ ধরে এসেছিল সামনে।’
‘কেউ তোমাকে খুন করতে চাইছে না,’ বলল রোজি, যদিও কথা শুনে মনে হলো না যে স্পাইডারকে আশ্বস্ত করছে।
‘ধরে নিলাম কেউ আমাকে খুন করতে চাচ্ছে না। তারপরেও কি আমরা লাঞ্চের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে, বাড়িতে যেতে পারি? খাবার আগে ওখানে।’
‘অবশ্যই।’
ওকে অনুসরণ করল রোজি। ভাবছে, মোটকু চার্লির ওজন এত কমে গেল কীভাবে? অবশ্য দেখতে ভালো লাগছে, ভাবল ও। খুবই ভালো দেখাচ্ছে আসলে। একসঙ্গে হেঁটে ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে চলে এলো ওরা।
‘ওই যে দেখো,’ বলল স্পাইডার।
‘কী?’
মেয়েটাকে দেখিয়ে দিল ও। ন্যাপকিনের খয়েরি দাগটাও হাওয়া হয়ে গেছে, সাদা হয়ে গেছে আবার।
‘জাদু নাকি?’
‘হতে পারে, তবে আমি করিনি,’ জানাল স্পাইডার। একটা বিনে ফেলে দিল ন্যাপকিনটা। ঠিক সেই মুহূর্তে মোটকু চার্লির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটা ট্যাক্সি, ভেতর থেকে বেরোল…খোদ মোটকু চার্লিই! তার হাতে একটা প্লাস্টিকের সাদা ব্যাগ।
একবার মোটকু চার্লির দিকে চাইল রোজি, আরেকবার স্পাইডারের দিকে। ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে ততক্ষণে চকলেটের বিশাল একটা বাক্স বের করে এনেছে মোটকু চার্লি।
‘তোমার জন্য,’ এগিয়ে দিল ছেলেটা।
চকলেট নিয়ে কোনোমতে বলল রোজি, ‘ধন্যবাদ।’ দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি, দেখতে-শুনতে আর চলনে-বলনে একে-অন্যের থেকে একেবারেই আলাদা। এমনকী কণ্ঠস্বরেও মিল নেই কোনো। অথচ তারপরেও বুঝতে পারছে না, কার সঙ্গে বাগদান হয়েছে তার। ‘আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, তাই না?’ বলেই বসল মেয়েটা, কণ্ঠেই বোঝা যাচ্ছে মনের চাপ। এখন বুঝতে পারছে, সমস্যা কোথায়; আর তাই পরিস্থিতি বোধহয় সহজ হয়ে এসেছে অনেকটা।
দুই মোটকু চার্লির মাঝে যে পাতলা, যার কানে দুল ঝুলছে, ওর কাঁধে হাত রাখল। ‘তুমি বাড়ি ফিরে যাও,’ বলল সে। ‘তারপর ঘুমিয়ে পড়ো। যখন উঠবে, তখন সব ভুলে যাবে।’
তাতে, ভাবল সে। জীবন তুলনামূলক সহজই হবে বটে। পরিকল্পনা সর্বদাই পরিস্থিতিকে সহনশীল করে তোলে। অনেকটা লাফাতে লাফাতেই ফিরে এলো সে নিজের ফ্ল্যাটে, হাতে চকলেটের বাক্স।
‘কী করলে?’ মোটকু চার্লি প্রশ্ন ছুড়ে দিল। ‘আচমকা এভাবে বদলে গেল যে?’
শ্রাগ করল স্পাইডার। ‘চাই না ও কষ্ট পাক,’ জানাল সে। ‘তাহলে সত্যিটাই বলে দিতে। বললে না কেন?’
‘কাজটা ঠিক হবে বলে মনে হয়নি।’
‘কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তার তুমি কী জানো?’
সদর দরজাটা স্পর্শ করেই খুলে ফেলল স্পাইডার।
‘আমার কাছে চাবি আছে,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘বাড়িটাও আমারই!’
হলওয়েতে পা রাখল ওরা, তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওপরে।
‘গেছিলে কই?’ জিজ্ঞেস করল স্পাইডার।
‘কোত্থাও না, এই তো…বাইরে।’ জানাল মোটকু চার্লি, ঠিক টিনেজারদের মতো ভঙ্গিতে।
‘আজ সকালে একটা রেস্তোরাঁয় গেছিলাম। সেখানে পাখির ঝাঁক আক্রমণ করে বসে আমাকে। এই ব্যাপারে কিছু জানো? নিশ্চয়ই জানো, তাই না?’
‘নাহ… কিংবা হয়তো জানি। তবে এখন সময় হয়েছে তোমার চলে যাওয়ার….এই যা।’
‘নতুন করে কিছু শুরু কোরো না,’ সাবধান করে দিতে চাইল স্পাইডার। ‘আমি? আমি শুরু করব? ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে ছিলাম পুরোটা সময়। তুমি আমার জীবনে অনুপ্রবেশ করলে, আমার বসকে খেপালে, পুলিস লেলিয়ে দিলে। তুমি, আমার প্রেমিকাকেও ছাড়োনি! আমার পুরো জীবন নষ্ট করে দিয়েছ।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও,’ বলল স্পাইডার। ‘আমি আসার অনেক আগে তুমি নিজেই তোমার জীবনকে নষ্ট করেছ!’
হাত মুঠো করে, সরাসরি স্পাইডারের চিবুকে ঘুসি বসিয়ে দিল মোটকু চার্লি; মুভিতে যেমন করে। টলে পিছিয়ে গেল স্পাইডার, যতটা না ব্যথা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি চমকে গেছে। ঠোঁটে হাত দিল সে, তারপর তাকিয়ে রইল আঙুলের ডগায় থাকা রক্তের দিকে। ‘আমাকে মারলে!’
‘আবারও মারতে আপত্তি নেই,’ বলল মোটকু চার্লি, যদিও জানে না আসলেও পারবে কি না। ব্যথা পেয়েছে যে হাতে।
‘তাই নাকি?’ স্পাইডার বলল, তারপর মোটকু চার্লির দিকে ঝাঁপ দিল সে; ঘুসি মারল গায়ের জোরে। পড়ে গেল মোটকু চার্লি, তবে তার আগে স্পাইডারের কোমর আঁকড়ে ধরল সে; নিজের সঙ্গে টেনে ফেলল ভাইকেও।
হলওয়ের মেঝেতে গড়াগড়ি খেল দুই ভাই, একে-অন্যকে ঘুসি মারছে ইচ্ছে মতো। মোটকু চার্লি ভেবেছিল, স্পাইডার হয়তো জাদু ব্যবহার করে কিছু একটা করবে; নিদেনপক্ষে অস্বাভাবিক রকমের শক্তিশালী তো হবে। তবে বোঝা গেল, দুজনে মোটামুটি সমানে-সমান। কারও হাত চালাবার মাঝেই গোছানো বলতে কিছু নেই। বাচ্চারা——উহু, ভাইয়েরা যেভাবে হাতাহাতি লড়াই করে, সেভাবেই করছে ওরাও। গড়াগড়ি খেতে খেতেই মোটকু চার্লির মনে হলো, অনেক অনেক আগে সম্ভবত এভাবে মারামারি করেছে ওরা। স্পাইডার তুলনামূলক বুদ্ধিমান ও দ্রুত, কিন্তু যদি একবার খালি ওপরে উঠতে পারে মোটকু চার্লি…আর স্পাইডারের দুই হাত আটকে ফেলতে পারে তবে…
স্পাইডারের ডান হাতের দিকে নিজের হাত বাড়াল মোটকু চার্লি, তারপর মুচড়ে নিয়ে এলো ভাইয়ের পিঠের পেছনে; তারপর বসে পড়ল ছেলেটার বুকের ওপর, নিজের সব ওজন দিয়ে চাপ দিল।
‘হার মানছ?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘না,’ নিজেকে ছাড়বার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাল স্পাইডার, কিন্তু মোটকু চার্লি যেভাবে স্পাইডারের বুকের ওপর বসে পড়েছে তাতে করার আর কিছু নেই ওর।
‘তোমার কাছ থেকে ওয়াদা চাই,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘আমার জীবন থেকে বেরিয়ে যাও, আমাকে আর রোজিকে মুক্তি দাও।’
কথা শুনে রাগের সঙ্গে মুচড়ে উঠল স্পাইডার, পড়ে গেল মোটকু চার্লি। রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে গেল মোটকু চার্লি। ‘এমন যে হবে,’ বলল স্পাইডার। ‘সে কথা তো আগেই বলেছিলাম।’
নিচের তলার দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ, তবে শুনেই বোঝা যাচ্ছে–যে নাড়ছে তার ভেতরে আসার তর সইছে না। স্পাইডারের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল মোটকু চার্লি, এক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল স্পাইডারও। দুজনেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
‘দরজা খুলে দেব?’ জিজ্ঞেস করল স্পাইডার।
‘না,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এইটা আমার বাড়ি। নিজের দরজা আমি নিজেই খুলতে পারি, সাহায্য করতে চেয়েছ বলে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
‘যা মন চায় করো।’
সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল মোটকু চার্লি। পরক্ষণেই ফিরে তাকাল, ‘আগে এই ঝামেলাটা শেষ করি,’ বলল সে। ‘তারপর তোমাকে দেখছি। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, খানিকক্ষণের মাঝেই চলে যেতে হবে তোমাকে।’ নিচতলায় নামল সে, তবে পোশাক থেকে ধুলো ঝেড়ে; যাতে ওকে দেখে বোঝা না যায়, একটু আগেও মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল!
দরজা খুলতেই নজরে পড়ল পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত দুই দশাসই ব্যক্তি; সঙ্গে আছে একজন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, তবে অন্যরকম দেখতে সাদা পোশাকের নারী-পুলিস।
‘চার্লস ন্যান্সি?’ জিজ্ঞেস করল ডেইজি। এমনভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে যেন কোনো অচেনা মানুষকে দেখছে, চোখ অনুভূতি-শূন্য।
‘গ্লাম্ফ,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি।
‘মিস্টার ন্যান্সি,’ বলল মেয়েটা। ‘আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আপনি চাইলে—’
মোটকু চার্লি ঘুরে বাড়ির ভেতরটা দেখে নিলো। ‘হারামজাদা!’ চেঁচিয়ে উঠল সে; লক্ষ্য ওপরের তলার দিকে। ‘হারামজাদা হারামজাদা হারামজাদার- বাচ্চা-হারামজাদা!’
ওর হাতে টোকা দিল ডেইজি। ‘নিজে থেকে আসবে আমার সঙ্গে?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘যদি রাজি না হও, তাহলে জোর করব আমরা। যদিও পরামর্শ থাকবে—নিজ থেকেই চলো। আমার সঙ্গীরা আবার হাত-পা চালাতে ভালোবাসে।’
‘আসছি,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘খুব ভালো, বলল ডেইজি। মোটকু চার্লির সঙ্গে বাইরে পা রেখে, কালো একটা পুলিসি ভ্যানে তুলে নিলো তাকে।
পুরো ফ্ল্যাট খুঁজে দেখল পুলিস, প্রতিটা কামরা নির্জীব; প্রাণের কোনো চিহ্নও নেই। হলের শেষ মাথার ছোট্ট কামরাটা বাড়তি শোবার ঘর; ভেতরে আছে বইয়ের কিছু বাক্স আর খেলনা গাড়ি। বাক্স খুঁজেও দেখল ওরা, কিন্তু কিচ্ছু মিলল না।
.
নিজের শোবার ঘরে গাল ফুলিয়ে শুয়ে আছে স্পাইডার। মোটকু চার্লি যখন দরজা খুলতে নিচে নামে, তখনই নিজের কামরায় চলে আসে সে। নির্জনতা দরকার তার, ঝামেলা একদম পছন্দ করে না। সেই সম্ভাবনা জন্ম নিলেই পালিয়ে যায়, স্পাইডার জানে এই মুহূর্তে ওর এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। কিন্তু কেন যেন যেতে ইচ্ছে করছে না।
রোজিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াটা ঠিক হলো কি না, তাই ভাবছে।
যা সে করতে চায়—সত্যি কথা হলো, স্পাইডার তার জীবনকে নিজের চাহিদা মোতাবেক পরিচালনা করে—তা হলো রোজিকে বলা যে ও আসলে স্পাইডার, মোটকু চার্লি না। জানাতে চায়, ও আসলে একদমই আলাদা কিছু একটা; তবে সেটা সমস্যা না। চাইলেই মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলতে পারে, ‘আমি স্পাইডার, মোটকু চার্লির ভাই। তা নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি এতে খুশি। ব্ৰহ্মাণ্ড তখন রোজিকে খানিকটা হলেও ধাক্কা দিত, ব্যাপারটা খুশি মনে মেনেও নিত মেয়েটা। একদম কিচ্ছু মনে করত না রোজি।
কিন্তু অন্তরের গহিনে ভালো করেই জানে–রোজি এত সহজে মেনে নিত না!
দেবতাদের খেলার বস্তুতে পরিণত হতে পছন্দ করে না মানুষ। তাদেরকে দেখে হয়তো মনে হয়, আপত্তি নেই কোনো। কিন্তু অন্তরের অন্তস্তলে, একদম গভীরে, তারা ঘৃণা করে ব্যাপারটাকে। কীভাবে কীভাবে যেন জেনে ফেলে তারা! স্পাইডার বলতে পারত মেয়েটিকে, যেন পরিস্থিতি নিয়ে খুশি থাকে; খুশি থাকতও রোজি, কিন্তু ব্যাপারটা হতো তার চেহারায় হাসি এঁকে দেওয়ার মতো—যে হাসিটাকে রোজি একেবারে শতভাগ নিজের হাসি বলেই ধরে নিত। অল্প সময়ের জন্য হলে (এতদিন স্পাইডার কেবল অদূর ভবিষ্যতের কথাই ভেবেছে), ব্যাপারটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ হতো না। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে গিয়ে ঠিকই সমস্যার জন্ম দিত। রাগান্বিত, ক্রোধান্বিত কাউকে দরকার নেই ওর, যে একেবারে অন্তর থেকে ঘৃণা করে ওকে; অথচ বাইরে বাইরে ধরে রাখে আনন্দের মুখোশ।
ওর দরকার রোজিকে।
সেই রাগান্বিত প্রাণিটা আর যা-ই হোক, রোজি নিশ্চয়ই হতো না। হতো কী?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অস্বাভাবিক সুন্দর ঝরনার দিকে চেয়ে রইল স্পাইডার, চাইল তারও ওপাশের আকাশের পানে। শুয়ে শুয়ে ভাবছে, মোটকু চার্লি ওর কামরার দরজায় কখন টোকা দিতে আসবে? আজ সকালে রেস্তোরাঁয় কিছু একটা হয়েছে, সেই ব্যাপারে যে ওর ভাইয়ের জানা আছে– তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার।
বেশ কিছুক্ষণ পর, অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে; তাই ফিরে গেল মোটকু চার্লির ফ্ল্যাটে। কিন্তু কেউ নেই ওখানে। জায়গাটা নোংরা হয়ে আছে—দক্ষ, পেশাদার কেউ উলটে-পালটে খুঁজেছে কিছু একটা। ধরে নিলো স্পাইডার—নিশ্চয়ই মোটকু চাৰ্লিই লড়াইয়ে জিততে না পেরে করেছে কাজটা।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ও পুলিসের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কালো পুলিস ভ্যানের পাশে। ওর চোখের সামনেই চলে গেল ভ্যান আর গাড়ি।
নিজের জন্য টোস্ট বানিয়ে, তাতে মাখন মাখিয়ে খেয়ে নিলো ও। তারপর ফ্ল্যাটের ভেতর ঘুরে বেড়াল, সাবধানে টেনে দিল পর্দা।
বেজে উঠল দরজার ঘন্টি, শেষ পর্দাটাও টেনে দিয়ে নিচে নেমে এলো স্পাইডার।
দরজা খুলতেই আবিষ্কার করল রোজিকে। এখনও আচ্ছন্ন দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে, ‘আমাকে ভেতরে আসতে বলবে না?’
‘অবশ্যই, এসো… এসো!’
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো মেয়েটা। ‘কোনো সমস্যা? মনে হচ্ছে যেন ভূমিকম্প হয়েছে!’
‘তাই?’
‘অন্ধকারে বসে আছ কেন?’ পর্দার দিকে এগিয়ে গেল রোজি। ‘থামো, থামো। টানাই থাকুক।’
‘ভয় পাচ্ছ কাকে?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল স্পাইডার। ‘পাখি’ অনেকক্ষণ পর বলল সে।
‘কিন্তু পাখিরা তো আমাদের বন্ধু,’ যেন ছোটো কোনো বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে, এভাবে বলল রোজি।
‘পাখি,’ শুরু করল স্পাইডার। ‘হচ্ছে ডাইনোসরের শেষ বংশধর। পাখাঅলা ছোট্ট ভেলোসিরাপটর। অসহায় কীট, বাদাম, মাছ আর অন্য পাখি খায় তারা। সব ধরনের কেঁচোর খোঁজ ওরাই পায়! মুরগিকে কখনও খেতে দেখেছ? দেখে নিষ্পাপ মনে হয়, কিন্তু পাখিরা আসলে ভয়ানক!’
‘সেদিন খবরের কাগজে একটা প্রতিবেদন দেখলাম,’ রোজি জানাল। ‘মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল একটা পাখি।’
‘তাতে কিচ্ছু যায় আসে না–’
‘সম্ভবত দাঁড়কাক ছিল ওটা, কিংবা এমনি কাঁকও হতে পারে। মানে ওই বড়ো, কালোগুলোরই কোনো একটা ছিল আরকি। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ির লনে বসে ছিল লোকটা, ম্যাগাজিন পড়ছিল। আচমকা পাখির ডাক শুনতে পেল, ওরই যেন দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তাই উঠে দাঁড়িয়ে, দাঁড়কাকটা যে গাছে বসে আছে সেখানে গেল লোকটা। দূর থেকেই দেখতে পেল, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওঁত পেতে ছিল একটা পাহাড়ি সিংহ। তাই বাড়িতে ফিরে গেল লোকটা। যদি দাঁড়কাক না থাকত, ওকে সাবধান না করে দিত, তাহলে সিংহের পেটে যেতে হতো তাকে!’
‘আমার মনে হয় না, দাঁড়কাক সাধারণত অমনটা করে,’ জানাল স্পাইডার। ‘যেটাই হোক না কেন, একটা দাঁড়কাক কারও জীবন বাঁচালেই পাখিরা মহান কিছু হয়ে যায় না। পাখিরা এখনও আমার পেছনে লেগে আছে।’
‘হুম,’ বলল রোজি, তবে কণ্ঠে আনতে চাইল নকল আন্তরিকতা। ‘পাখিরা তোমার পেছনে লেগেছে।’
‘আমি ভুল বলিনি।’
‘কেন লেগেছে যেন…?’
‘উম।’
‘কারণ নিশ্চয়ই আছে। হঠাৎ করে পুরো বিশ্বের সব পাখি এক হয়ে এমনি এমনি তোমার পেছনে নিশ্চয়ই লাগেনি?’
জবাব দিল স্পাইডার, ‘বলতে পারি, তবে তুমি বিশ্বাস করবে না,’ অন্তর থেকেই বলল সে কথাটা।
‘চার্লি, তুমি সব সময়ই সত্যি কথা বলে এসেছ। যদি আমাকে কিছু বলো, তাহলে যত কঠিনই হোক না কেন তা বিশ্বাস করার চেষ্টা করব। ভালোবাসি তোমাকে, বিশ্বাস করি তোমার কথায়। আগে বলো তো, বিশ্বাস করা না-করা তো পরের কথা!
এক মুহূর্ত ভাবল স্পাইডার। তারপর বাড়িয়ে দিল হাত, রোজির হাত ধরে চাপ দিল একটু।
‘তোমাকে একটা জিনিস দেখানো দরকার,’ বলল সে।
করিডোরের শেষ মাথা পর্যন্ত রোজিকে নিয়ে এলো ও, মোটকু চার্লির বাড়তি কামরার মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। ‘ভেতরে কিছু একটা আছে,’ বলল স্পাইডার। ‘আমার চাইতে ভালো ব্যাখ্যা ওটাই করতে পারবে।’
‘তুমি সুপারহিরো,’ বলল মেয়েটা। ‘তার ভেতরে অপরাধের সঙ্গে লড়াইয়ের যন্ত্রপাতি রাখো?’
‘না।’
‘উলটো-পালটা কিছু না তো? বাচ্চা মেয়েদের পোশাক পরে নিজেকে ডোরা নামে ডাকো নাকি?’
‘না।’
‘মডেল ট্রেন সেট নাকি?’
ধাক্কা দিয়ে মোটকু চার্লির বাড়তি কামরার দরজা খুলে ফেলল স্পাইডার, যেটা আবার ওর নিজের শোবার ঘরের দরজাও। কামরার শেষ প্রান্তের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা ঝরনা, যেটা আছড়ে পড়ছে নিজের জঙ্গলের হ্রদে। আকাশ একেবারে নীল, নীলকান্তমণির মতো।
আঁতকে উঠল রোজি।
ঘুরে দাঁড়াল সে, ফিরে এলো হলে…তারপর রান্নাঘরে; জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নিলো লন্ডনের ধূসর আকাশ…বিষণ্ণ আর মন-খারাপ- করে দেওয়ার মতো। ফিরে এলো খানিক পরেই। ‘বুঝতে পারছি না কিছুই, ‘ বলল সে। ‘চার্লি? কী হচ্ছে এসব?’
‘আমি চার্লি নই,’ জানাল স্পাইডার। ‘আমার দিকে তাকাও, মন দিয়ে দেখো।’
আর অভিনয়ের ধার ধারল না মেয়েটা, চোখ ভয়ে বিস্ফারিত।
‘আমি ওর ভাই,’ জানাল স্পাইডার। ‘আমি সব কিছুতে ভজকট পাকিয়েছি…এক্কেবারে সব কিছুতে। তাই তোমাদের জীবন থেকে চিরতরে চলে গেলেই বোধহয় ভালো হবে।’
‘তাহলে মো—মানে চার্লি কই?’
‘তা জানি না, ঝগড়া হয়েছে আমাদের। দরজা খুলতে নিচে গেল, আমি গেলাম আমার কামরায়। আর ফেরেনি।’
‘ফেরেনি? আর তুমিও বসে আছ চুপচাপ? খোঁজ-খবর নাওনি?’
‘উম, ওকে সম্ভবত পুলিস ধরে নিয়ে গেছে,’ বলল স্পাইডার। ‘সম্ভবত… প্রমাণ নেই।’
‘নাম কী তোমার?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজি।
‘স্পাইডার।’
শব্দটা নিজেই আবার উচ্চারণ করল রোজি, ‘স্পাইডার।’
জানালার বাইরে, ঝরনার ঠিক মাথায় দেখা যাচ্ছে এক ঝাঁক ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি; রোজি ওদের গোলাপি আর সাদা পালক ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না সূর্যালোকের কারণে। সংখ্যায় তারা অনেক, সুবিন্যস্ত। এত সুন্দর দৃশ্য রোজি আগে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। স্পাইডারের দিকে ফিরে ভাবল, এই লোকটাকে সে কীভাবে মোটকু চার্লি হিসেবে মেনে নিয়েছিল? মোটকু চার্লি হাসিখুশি, খোলা মনের কিন্তু অস্বস্তিকর মানুষ; কিন্তু এই লোকটা ইস্পাতের দণ্ডের মতো টান-টান হয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যাবে! ‘তুমি আসলেও ও নও, তাই না?’
‘সেটা তো এইমাত্রই বললাম।’
‘তাহলে-তাহলে কার সঙ্গে… মানে আমার সঙ্গে কে…মানে কার সঙ্গে আমি শুয়েছি?’
‘আমার সঙ্গেই,’ জানাল স্পাইডার।
‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম,’ বলেই সর্বশক্তিতে থাপ্পড় মারল রোজি, স্পাইডারের গাল বরাবর। ঠোঁট কেটে আবার রক্ত ঝরতে লাগল ছেলেটার।
‘থাপ্পড়টা আমার প্রাপ্যই ছিল,’ বলল স্পাইডার।
‘অবশ্যই ছিল,’ একটু বিরতি দিয়ে যোগ করল রোজি। ‘মোটকু চার্লি জানত? মানে তোমার ব্যাপারে? আমাদের ব্যাপারে?’
‘উম, হ্যাঁ। কিন্তু ও…’
‘তোমরা দুজনেই মানসিক রোগী,’ গর্জে উঠল রোজি। ‘অসুস্থ আর অশুভ দুজন মানুষ। নরকে পুড়ে মরো তোমরা, এই প্রার্থনা করি।’
বিশাল শোবার ঘরটায় বিহ্বল একটা দৃষ্টি হানল রোজি, তারপর তাকাল জানালার বাইরের জঙ্গলের দিকে; বিশালাকার ঝরনা আর ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝাঁকটাকে আরেকবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেল হল ধরে।
মেঝেতে বসে রইল স্পাইডার, রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা গড়িয়ে পড়ছে নিচের ঠোঁট থেকে; নিজেকে বোকা বলে মনে হচ্ছে ওর। কানে ভেসে এলো সদর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আওয়াজ। বাথটাবের কাছে এসে, গরম পানিতে ডুবাল তোয়ালের একটা প্রান্ত। তারপর সেটা চিপে পানি ঝরিয়ে, ঠেসে ধরল ক্ষতের ওপর। ‘এসবের কোনো দরকার আমার নেই,’ বলল সে। উচ্চকণ্ঠে, কেননা জোরেশোরে বলে নিজেকেও মিথ্যে কথা বিশ্বাস করানো যায়। ‘তোমাদের কাউকেই আমার এক হপ্তা আগে দরকার ছিল না, সামনেও দরকার পড়বে না। অনেক হয়েছে…আর না!’
ঠিক তখন জানালার কাচে আছড়ে পড়ল ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝাঁক, ভেঙে গেল কাচ। কামরার ভেতর ছড়িয়ে পড়ল তার টুকরোগুলো। দেওয়াল, মেঝে আর বিছানায় গেঁথে গেল কাচের টুকরো। কামরার ভেতরটা ভরে উঠল ধূসর গোলাপি দেহে; বাঁকানো, তীক্ষ্ণ ঠোঁট আর বিশাল বিশাল গোলাপি পাখা ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কামরার ভেতরে যেন শুরু হয়ে গেল ঝরনার গর্জন।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকাতে বাধ্য হলো স্পাইডার। ওর আর দরজার মাঝে এখন রয়েছে ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝাঁক; সংখ্যায় যারা হাজারো হবে: পাঁচ ফুট লম্বা পাখির ঝাঁক, গলা আর পা ছাড়া দেহে আর কিছু নেই বললেই চলে। দৃঢ় পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেল স্পাইডার, রাগান্বিত ওই গোলাপি পাখির মাইনফিল্ডের ভেতর দিয়ে; প্রত্যেকটাই উন্মাদনায় ভরা গোলাপি চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। দূর থেকে দেখলে এদেরকে হয়তো সুন্দর মনে হয়, কিন্তু কাছ থেকে দেখে?
আচমকা স্পাইডারের হাতে কামড় বসালো একটা পাখি। চামড়া বিদীর্ণ হলো না বটে, কিন্তু ব্যথা পেল ঠিক।
স্পাইডারের শোবার ঘরটা বিশাল বড়ো। কিন্তু দ্রুতই তা ভরে উঠছে ফ্ল্যামিঙ্গোয়। ঝরনার নীল আকাশে ভর করেছে অন্ধকার মেঘ, বোঝাই যাচ্ছে যে আরেকটা ঝাঁক আসছে এদিকেই।
পাখিগুলো ঠোকর মারছে ওর দিকে, আঘাত হানছে নখ দিয়ে। তবে জানে স্পাইডার, সমস্যা অন্যখানে — পাখিগুলোর ফোলা ফোলা পালকের নিচে চাপা পড়তে হতে পারে ওকে। মরার এই উপায়টা চরম অপমানজনক মনে হচ্ছে ওর কাছে: পাখির দেহের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু।
সেই পাখি বুদ্ধিমান হলেও হতো…
ভাবো, নিজেকে নির্দেশ দিল সে। এগুলো নিছক ফ্ল্যামিঙ্গো, আর তুমি? স্পাইডার!
তো? নিজেকেই জবাব দিল স্পাইডার। এমন কিছু বলো যা আমার জানা নেই!
মেঝেতে দাঁড়ানো ফ্ল্যামিঙ্গোগুলো ঠোকর মারছে ওকে, ভাসতে থাকা পাখিগুলো ছুটে আসছে ওর দিকে। জ্যাকেট দিয়ে মাথাটা ঢাকল স্পাইডার। পরক্ষণেই বাতাসে ভাসমান ফ্ল্যামিঙ্গোগুলো আক্রমণ চালাল ওকে লক্ষ্য করে। কেঁপে উঠে মেঝেতে পড়ে গেল সে।
বোকা বানাও ওদের, গাধা কোথাকার
উঠে দাঁড়াল স্পাইডার, পাখনা আর ঠোঁটের সাগর পেছনে ফেলে চলে এলো জানালার কাছে; ভাঙা কাচের জন্য যেটা পরিণত হয়েছে প্রকাণ্ড গর্তে।
‘হতচ্ছাড়া পাখি,’ আনন্দের সঙ্গে বলল সে, তারপর লাফ দিল জানালা দিয়ে বাইরে।
বুদ্ধিমত্তার জন্য ফ্ল্যামিঙ্গোরা বিখ্যাত না, এমনকী সমস্যা-সমাধানের যোগ্যতার জন্য বহুল পরিচিত নয়: খাওয়ার মতো কিছু একটা যদি বোতলে ভরে কাকের সামনে সেটা আর বাঁকানো তার ফেলা হয়, তাহলে হয়তো পাখিটা সেই তার ব্যবহার করে বোতলের ভেতরের খাবার বের করার চেষ্টা চালাবে। কিন্তু ফ্ল্যামিঙ্গো সরাসরি খেতে চাইবে ওই তারটাকেই…যদি দেখতে ওটা চিংড়ি মাছ বলে মনে হয়…এমনকী যদি না হয় তাহলেও হয়তো! তাই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে অপমান করতে থাকা মানুষটার মাঝে যদি ধোঁয়াশায় ভরা আর বিমূর্ত একটা ভাব থেকেও থাকে, তাহলে সেটা ওরা ধরতে পারল না। উন্মাদনায় ভরা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে, ছুট লাগাল।
জানালার ওপাশে লাফ দিল লোকটা, ঝরনার পানিতে ডুবে গেল ওর দেহ। তার পিছু পিছু ঝাঁপ দিল আরও এক হাজার পাখি, অধিকাংশই টুপ করে পড়তে শুরু করল পাথরের মতো… কেননা বাতাসে ভাসার জন্য ফ্ল্যামিঙ্গোর খানিকক্ষণ দৌড়ুতে হয়
অচিরেই দেখা গেল, শোবার ঘরটা ভরে আছে আহত কিংবা নিহত পাখিতে: কিছু পাখি জানালা ভেঙেছে, কিছু আছড়ে পড়েছে দেওয়ালে…আর কিছু হয়েছে অন্যান্য ফ্ল্যামিঙ্গোর শিকার। যেগুলো এখনও বেঁচে আছে, দেখতে পেল—আপনা থেকেই খুলে গেল শোবার ঘরের দরজা। তারপর আবার বন্ধও হয়ে গেল। কিন্তু ওরা ফ্ল্যামিঙ্গো বলে, ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ভাবল না।
মোটকু চার্লির ফ্ল্যাটের করিডোরে দাঁড়িয়ে দম ফিরে পেতে চাইল স্পাইডার। শোবার ঘরটা যেন অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, সেটা ভাবতে লাগল একমনে। কাজটা করতে একদম ভালো লাগে না ওর, কেননা সাউন্ড সিস্টেমটা নিয়ে গর্ব করে সে…
…আরও একটা কারণ আছে——ওই কামরাতেই রেখেছে নিজের সব কিছু।
তবে চাইলেই সেগুলো আবার ফিরে পাবে।
যার নাম স্পাইডার, তার জন্য শুধু মন থেকে চাওয়াটাই যথেষ্ট।
.
রোজির মা চোখে আঙুল দিয়ে সাধারণত গর্ব করে না; তাই চিপেনডেল থেকে কেনা সোফায় বসে যখন কান্নায় ভেঙে পড়ল তার মেয়ে, তখন অনেক কষ্ট করে নিজেকে থামাল সে; যদিও ইচ্ছে হচ্ছিল, গান গাইতে গাইতে নাচে কামরা জুড়ে! তবে সাবধানী কোনো পর্যবেক্ষক তাকে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারত: মহিলার চোখের তারায় বিজয়ের গর্ব।
ভিটামিন মিশ্রিত পানির একটা বড়ো গ্লাস রোজিকে দিল সে, একটা বরফের টুকরোসহ। প্রতারণা আর ধোঁকাবাজির কারণে মেয়ের হৃদয় কীভাবে ভেঙে গেছে, সেই গল্প শুনল মন দিয়ে। কিন্তু গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে, বিজয়ের আভা চোখ থেকে সরে গিয়ে সেখানে ভর করল বিহ্বলতা; সেই সঙ্গে ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে মহিলার মাথা!
‘তাহলে মোটকু চার্লি আসলে মোটকু চার্লি ছিল না?’ জিজ্ঞেস করল রোজির মা।
‘না। মানে, মোটকু চার্লি আসলে মোটকু চার্লিই ছিল। কিন্তু গত হপ্তাটা আমি কাটিয়েছি ওর ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘যমজ নাকি?’
‘নাহ, আসলে দেখতেও এক রকম না। আমি জানি না… বিভ্রান্ত লাগছে নিজেকে।’
‘তাহলে কার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করলে?’
নাক ঝাড়ল রোজি। ‘স্পাইডারের সঙ্গে, মোটকু চার্লির ভাই ও।’
‘তোমাদের তো বাগদান হয়নি, তাহলে ভাঙল কীভাবে!’
‘নাহ, হয়নি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, আসলে সে-ই মোটকু চার্লি।’
‘তাহলে কি মোটকু চার্লির সঙ্গেও বাগদান ভেঙে দিয়েছ?’
‘তেমনই কিছু একটা। তবে ওকে বলিনি এখনও।’
‘ছেলেটা তার ভাইয়ের সঙ্গে… তোমার সম্পর্কের কথা জানে? দুইয়ে মিলে আমার বেচারা মেয়েটার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেনি তো?’
‘আমার তা মনে হয় না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, ওকে বিয়ে করতে পারব না।’
‘তা তো বটেই,’ একমত হলো রোজির মা। ‘কোনোভাবেই না।’ মনে মনে অবশ্য জয়ের আনন্দে নাচল কিছুক্ষণ। ‘ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করব আমরা। ভেবো না ওসব নিয়ে। ওই মোটকু চার্লি…ব্যাটাকে আমার কখনওই পছন্দ হতো না। প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছিলাম। আমার মোমের ফলে কামড় দিয়ে বসল ও, ভাবা যায়? বুঝতেই পারছিলাম, ঘাপলা আছে ব্যাটার ভেতর। এখন সে কই?’
‘জানি না, স্পাইডার বলেছিল—সম্ভবত ওকে পুলিস ধরে নিয়ে গেছে, ‘ জানাল রোজি।
‘হাহ!’ মাথার ভেতর এখন আতশবাজি ফুটতে শুরু করেছে মহিলার। আকারে আর আকৃতিতে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় শুধু ডিজনিল্যান্ডের নিউ ইয়ার্স ইভ উদযাপনের সময়। মুখে বলল, ‘আমার তো মনে হয়, জেলে আছে এখন। ওটাই তার জন্য সর্বোত্তম স্থান। সবসময়ই বলেছি—ছেলেটা দিন শেষে ওখানেই পৌঁছুবে।’
কাঁদতে শুরু করল রোজি, আগের চাইতেও বেশি। টিস্যু পেপারের একটা দলা কাছে টেনে নিয়ে, শব্দ করে নাক ঝাড়ল তাতে। তারপর ঢোক গিলে কেঁদে নিলো আরও খানিকক্ষণ। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে রোজির হাতের পেছনে আলতো চাপড় দিল তার মা, অন্তত যতটুকু ওর জানা আছে ততটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে। ‘ওকে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না,’ বলল মহিলা। ‘হাজার হলেও, জেলঘুঘু ছেলেটা! তবে মন্দের ভালো হলো, ও জেলে থাকা অবস্থায় সহজে বাগদান ভেঙে দেওয়া যায়।’
মহিলার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠল ভুতুড়ে হাসি, যোগ করল, ‘চাইলে তোমার হয়ে আমি কল করতে পারি। অথবা কোনো এক দিন গিয়ে বলা যায়: তুমি একটা জঘন্য অপরাধী, আর কখনও তোমার মুখদর্শন করতে চাই না। চাইলে একটা রেস্ট্রেইনিং অর্ডারের ব্যবস্থাও করা যায়!’
‘বিয়ে ভাঙতে চাওয়ার কারণ এগুলো না,’ জানাল রোজি।
‘তাই নাকি?’ নিখুঁত ভাবে পেন্সিলে আঁকা ভ্রুজোড়ার একটা উঁচু করে জিজ্ঞেস করল তার মা।
‘না,’ জানাল রোজি। ‘বিয়ে করব না, কারণ মোটকু চার্লিকে আমি ভালোবাসি না।’
‘বাসো যে না, সেটা তো আমি আগে থেকেই জানতাম। বড়োজোর মেয়েলি ভালোলাগা বলা যায় এটাকে। কিন্তু এখন যখন সত্যিটা জানতে পেরেছ—’
‘আমি ভালোবাসি,’ মাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করল রোজি, ওর ভাই স্পাইডারকে!’ কথাটা শোনামাত্র ওর মায়ের চেহারায় এমন একটা অনুভূতি খেলে গেল যা পিকনিক ভণ্ডুল করতে মৌমাছির ঝাঁক উপস্থিত হলে বাচ্চাদের চেহারায় দেখা যায়। ‘তবে তাতে কিছু যায় আসে না,’ বলল রোজি। ‘ওকেও আমি বিয়ে করছি না। বলে এসেছি—আর কখনও দেখতে চাই না তাকে!’
ঠোঁটে ঠোঁট চাপল রোজির মা। ‘বেশ,’ বলল সে। ‘তোমার কথার কিছুই আমি আসলে বুঝতে পারছি না। তবে ব্যাপারটাকে সব মিলিয়ে খারাপ খবর বলে ধরছি না,’ ঘুরতে শুরু করেছে ওর মাথার চাকা। কলকব্জাগুলো নতুন নতুন উপায়ে একে-অন্যের সঙ্গে জোট বাঁধছে। ‘একটা কথা কী জানো,’ বলল মহিলা। ‘তোমার এই মুহূর্তে একটু ছুটি কাটিয়ে আসা দরকার! খরচ সব আমার, তোমার বিয়ের জন্য জমাচ্ছিলাম…’
কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কেননা শোনামাত্র আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল রোজি। কিন্তু ওর মা পাত্তা না দিয়ে বলে চলছে, ‘যাই হোক, খরচাপাতি আমি দিব। চাকরিতেও সমস্যা হবে না, ছুটি জমিয়েছ অনেক। তাছাড়া নিজেই বললে, কাজে চাপ নেই খুব একটা। এমন একটা সময়ে, যেকোনো মেয়েরই উচিত হবে সব কিছু থেকে দূরে সরে একটু বিশ্রাম নেওয়া।।’
ভাবল রোজি, এতগুলো বছর কি তাহলে মাকে ভুল ভেবে এসেছে? নাক টেনে ঢোক গিলল সে, তারপর বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হয়।’
‘সে কথাই রইল তবে,’ বলল ওর মা। ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাবো, আমার সোনা বাচ্চাটার খেয়াল রাখার জন্য।’ এদিকে মাথায় তখনও ফুটছে আতশবাজি। মনে মনে যোগ করল, নিশ্চিত করব যেন সঠিক পুরুষটির দেখা আমার মেয়ে পায়।
‘কোথায় যাবো আমরা?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
‘আমরা যাবো,’ জবাব দিল ওর মা। ‘ক্রুজে।’
.
হাতকরা পরানো হয়নি মোটকু চার্লিকে। এই ব্যাপারটা ভালো… কিন্তু বাকি সব কিছুই খারাপ। মন্দের ভালো আরকি ওর এই হাত মুক্ত থাকাটা। মোটকু চার্লির জীবনটা যেন পরিণত হয়েছে বিভ্রান্তিতে ঝাপসা হয়ে আসা একটা চিত্রকল্পে, যেখানে থেকে থেকে দেখা যাচ্ছে তীক্ষ্ণ এটা-সেটা: ডিউটি সার্জেন্ট নাক চুলকাতে চুলকাতে ওর সই নিয়ে ঢুকিয়ে দিল ‘সেল নম্বর ছয়’-এ। একটা সবুজ দরজার ভেতর দিয়ে ঢুকতেই নাকে ধাক্কা দিল দুর্গন্ধ। এহেন গন্ধ আগে কখনও না পেলেও, চিনতে সময় লাগল না; গতকালের বমি আর জীবাণুনাশকের সঙ্গে মিশেছে ধোঁয়া, বাসি কম্বল, ফ্ল্যাশ না করা টয়লেট আর হতাশার বাজে গন্ধ। সামাজিক ধাপের একেবারে নিচের তলার গন্ধ এটা, যেখানে এখন বাস করে বেচারা।
‘ফ্ল্যাশ করার দরকার হলে,’ যে পুলিসম্যান ওর সঙ্গে করিডোর ধরে এগোচ্ছিল, সে জানাল। ‘সেলে বোতাম আছে, চেপে ধোরো। আমাদের কেউ- না-কেউ সময় পেলে ফ্ল্যাশ করে দেবে। তোমরা যেন প্রমাণ মিটিয়ে দিতে না পারো, সেজন্য এই ব্যবস্থা।’
‘কীসের প্রমাণ?’
‘নাটক বাদ দাও, চান্দু।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি। সেই ছোটোবেলা থেকে, যখন কৃত কোনো কাজের জন্য গর্বিত হতে শিখেছে, তখন থেকেই নিজের মল-মূত্র নিজে ফ্ল্যাশ করেছে। স্বাধীনতা হারানোয় যতটা না দুঃখ পেল, তারচেয়ে অনেক বেশি পেল এই কাজটা করার ক্ষমতা ওর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে। বাস্তবতা আরও শক্ত করে জাঁকিয়ে বসল ওকে ঘিরে।
‘এই প্রথম?’ জিজ্ঞেস করল পুলিস।
‘বুঝলাম না!’
‘মাদক?’ আবার জানতে চাইল পুলিস।
‘নাহ, লাগবে না।’ জবাব দিল মোটকু চার্লি।
‘আরে নাহ, জানতে চাচ্ছি—জেলে শুভাগমন হলো কেন?’
‘জানি না কেন,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘আমি নিরপরাধ।’
‘দেওয়ানি অপরাধ, তাই না?’ জানাল পুলিস, মাথা নাড়ল দুপাশে। ‘অন্যরা যা জানে, সেটা তোমাকে বলে দিচ্ছি। আমাদেরকে যত কম জ্বালাবে, আমরাও তোমাকে তত কম জ্বলাবো। তোমরা, দেওয়ানি অপরাধীরা, সবসময় নিজের অধিকার আদায়ে চিল্লাফাল্লা করো। মানে নিজের জন্য গাড্ডা নিজেই খুঁড়ে নাও!’
ছয় নম্বর সেলের দরজা খুলল লোকটা। ‘এই যে, তোমার স্বস্তির নীড়,’ জানাল সে।
সেলের ভেতরে দুর্গন্ধটা অনেক বেশি তীব্র, বিশেষ এক প্রকার রং ব্যবহার করা হয়েছে তাতে যেন গ্রাফিতি আঁকতে না পারে কেউ। ভেতরের বিছানাটাকে তাকের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায়, একপাশে দেখা যাচ্ছে ডালাহীন টয়লেট।
মোটকু চার্লিকে যে কম্বলটা দেওয়া হয়েছে, সেটাকে বিছানার ওপর বিছিয়ে দিল সে।
‘তাহলে,’ বলল পুলিস। ‘আরাম করো। আর যতই একঘেয়েমি পেয়ে বসুক না কেন, দয়া করে কম্বলটা দিয়ে টয়লেট আটকে ফেলো না।’
‘তা কেন করতে যাবো?’
‘সেটা তো আমিও ভাবি,’ জানাল পুলিস। ‘কেন যে অপরাধীরা কাজটা করতে যায়! হয়তো একঘেয়েমি দূর হয় তাতে, আমি জানি না। আইন মেনে চলি, অবসরের পর কিছু টাকাও পাবো। তাই সেলের ভেতরে খুব একটা সময় কাটাতে হয়নি আমাকে।’
‘আমি আসলেও নিরপরাধ,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘যদিও জানি না, আমাকে কোন অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে!’
‘তাহলে তো ভালোই।’
‘আরেকটা কথা,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘পড়ার মতো কিছু পাওয়া যাবে?’
‘কেন? জায়গাটা দেখে তোমার কাছে লাইব্রেরি বলে মনে হচ্ছে?’
‘না।’
‘চাকরি যখন নতুন শুরু করেছি, তখন এক অপরাধী আমার কাছে বই চেয়েছিল। যেটা পড়ছিলাম, সেটাই এনে দিই—–জে.টি. এডসন, নইলে হয়তো লুই লামুর। কী করেছিল, নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ? টয়লেটে বই ফেলে আটকে দিয়েছিল সব! ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়, বুঝলে?’
পরক্ষণেই সেল থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে। নিজে চলে গেল বাইরে, ভেতরে রয়ে গেল মোটকু চার্লি।
.
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, গ্রাহাম কোটস যে কিনা সাধারণত নিজের অনুভূতি নিয়ে খুব একটা ভাবে না-স্বাভাবিক আর ভালো বোধ করে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে।
সিটবেল্ট শক্ত করে বাঁধার নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন, তারপর জানাল অচিরেই তারা সেন্ট অ্যান্ড্রুজে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপ এই সেন্ট অ্যান্ড্রুজ, ১৯৬২ সালে যারা স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে নিজেদের স্বাধীনতা প্রমাণ করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয় তারা; যার মাঝে আছে —নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বন্দি-বিনিময় চুক্তিতে সই না করা।
ল্যান্ড করল বিমানটা। নিচে নেমে গ্রাহাম কোটস হাঁটল রৌদ্রজ্জ্বল টারমাক ধরে, সঙ্গে নিয়েছে ঢাকাঅলা ব্যাগটাকে। যথাযথ পাসপোর্টটা দেখাল—বাসিল ফিনেগানেরটা আরকি—তাতে স্ট্যাম্প মারা হলে, ক্যারোসেল থেকে সংগ্রহ করল লাগেজ। তারপর ছোট্ট বিমানবন্দরটা থেকে বেরিয়ে পা রাখল দিনের আলোতে। ওর পরনে একটা টি-শার্ট, শর্টস আর স্যান্ডেল; দেখে মনে হচ্ছে, বিদেশে ছুটি কাটাতে আসা কোনো ইংরেজ।
বিমানবন্দরের বাইরেই অপেক্ষা করছিল ওর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক। কালো একটা মার্সিডিজের পেছনে বসল গ্রাহাম কোটস, বলল, ‘বাড়িতে নিয়ে যাও।’ উইলিয়ামসটাউন থেকে বেরোবার সময়—ওই রাস্তার শেষ মাথায় গ্রাহাম কোর্টসের ক্লিফটপ এস্টেট—জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, হাসি মুখে দেখল দ্বীপটাকে।
এতক্ষণে মনে পড়েছে যেন ওর: ইংল্যান্ড ছাড়ার আগে এক মহিলাকে মরার জন্য ফেলে রেখে এসেছে। হয়তো বেঁচেও থাকতে পারে মেইভ, যদিও সন্দেহ আছে তার। অবশ্য খুন করেছে বলে একদমই খারাপ লাগছে না তার। বরঞ্চ মারাত্মক তৃপ্তি বোধ করছে, যেন এই চাহিদাটা পূরণ করা অনেকদিনের দরকার ছিল।
এমনকী এটাও ভাবল, আবার কি কাজটা করার সৌভাগ্য হবে? তারচেয়ে বড়ো কথা, সেজন্য কি বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে ওকে?