অধ্যায় পাঁচ – যে অধ্যায়ে আমরা পরেরদিন সকালের ঘটনা অণুবীক্ষণের নিচে ফেলে দেখি
অধ্যায় পাঁচ – যে অধ্যায়ে আমরা পরেরদিন সকালের ঘটনা অণুবীক্ষণের নিচে ফেলে দেখি
গলা ফাটার দশা মোটকু চার্লির।
তৃষ্ণা পেয়েছে মোটকু চার্লির, সেই সঙ্গে ব্যথায় ফেটে পড়ছে মাথা।
তৃষ্ণার্ত মোটকু চার্লি মাথাব্যথার চোটে অন্ধকার দেখছে চোখে, মুখে অশুভের স্বাদ, চোখ যেন এঁটে বসেছে অক্ষিকোটরে: বত্রিশখানা দাঁতের সবগুলো শিরশির করছে। পাকস্থলীতে যেন আগুন জ্বালিয়েছে কিছু একটা; কোমরও ব্যথা করছে, যা শুরু হয়েছিল হাঁটু থেকে, উঠে যাচ্ছে কপাল পর্যন্ত। মগজটা যেন বের করে নেওয়া হয়েছে তার জায়গা থেকে, সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ তুলোর বল। তবে তাতেও থামেনি, সুঁই-টুইও ঢুকিয়ে দিয়েছে; কিছু ভাবতে চাইলেই জন্ম নিচ্ছে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা। চোখগুলো বোধহয় গত রাতে মুক্তি পেয়ে বাজার ঘুরে এসেছে, ফেরার সময় সঙ্গে করে এনেছে তীক্ষ্ণ পেরেক। এখন বুঝতে পারছে; বাতাসের অণুগুলো সাধারণত আরামসে ঘুরে বেড়ায়, তার ভিন্ন কিছু হলেই ব্যথায় ককিয়ে উঠছে ওর দেহ।
ভাবছে, এর চাইতে মরলেই ভালো হতো।
চোখ খুলল মোটকু চার্লি, বিশাল বড়ো ভুল বলে প্রমাণিত হলো কাজটা। চোখের ভেতর প্রবেশ করল দিনের আলো, যাতে আরও বেড়ে গেল ব্যথা। তবে কোথায় আছে এই মুহূর্তে, বুঝতে পারছে সেটা (ওর নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়), বিছানার পাশে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাল একবার।
সাড়ে এগারোটা বাজে!
এরচাইতে খারাপ খবর আর হতে পারে না, ভাবল সে। যে হ্যাংওভার ধরেছে, সেটা ব্যবহার করেই পুরাতন টেস্টামেন্টের ঈশ্বর মিডিয়ানাইটসদের[১০] একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। সন্দেহ নেই, পরেরবার গ্রাহাম কোটস যখন ওকে দেখতে পাবে তখন জানিয়ে দেবে—চাকরি আর নেই!
[১০. মাদায়েনবাসী।]
ফোনে নিজেকে কীভাবে অসুস্থ প্রমাণ করবে, সেটাই ভাবছে। পারবে তো?
গত রাতে বাড়ি কীভাবে ফিরেছে, সেটা মনেও করতে পারছে না।
অফিসে ফোন করতে হবে, তবে নম্বরটা মনে হবার পর। ক্ষমা চাইতে হবে চব্বিশ ঘণ্টা যে ফ্লু-টা জ্বালায়, সেটার অজুহাত দেবে। জানাবে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই…
‘আচ্ছা শোনো,’ বিছানায় ওর পাশেই শুয়ে থাকা একটা কণ্ঠ বলে উঠল। ‘তোমার পাশে একটা পানির বোতল আছে। একটু এদিকে দেবে?’
মুখ খুলতে চাইল মোটকু চার্লি, বলতে চাইল-ওর পাশে পানির বোতল নেই। তাই পানি খেতে চাইলে যেতে হবে বাথরুমের সিঙ্কের কাছে। টুথব্রাশ রাখার মগটাকে ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত করতে না পারলে সেটাও মিলবে না। কিন্তু তার আগেই আবিষ্কার করল কয়েক বোতল পানি, বিছানার পাশের টেবিলেই আছে! হাত বাড়িয়ে একটা আঁকড়ে ধরল ও, মনে হলো যেন আঙ্গুলগুলো ওর নিজের না…বরঞ্চ অন্য কারও। তারপর—পাহাড় চড়ার সময় শেষ কয়েকটা ফুট মানুষ যেভাবে সর্বশক্তি খাটায়–তেমন শক্তিতে বিছানায় গড়ান খেল।
কমলা-ভদকা শুয়ে আছে ওর পাশে!
তাও আবার নগ্ন হয়ে। অন্তত যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, ততটুকু নগ্নই।
পানিটুকু নিলো মেয়েটা, তারপর বিছানার চাদর টেনে তুলে বুক ঢাকল। ‘ঘুম ভাঙলে তোমাকে জানাতে বলেছে,’ বলল সে। ‘অফিসে ফোন করে অসুস্থতার গপ্পো ফাঁদার কোনো দরকার নেই। ওদিকটা সামলে নেব।’
মোটকু চার্লির মন শান্ত হলো না। ওর দুশ্চিন্তা আর ভয়ের ঘনত্বও রইল আগের মতোই। অবশ্য যে অবস্থা তার, তাতে মনের ভেতর শুধু একটা চিন্তারই স্থান হয়। এই মুহূর্তে সেটা হলো: দেরি হয়ে যাবার আগেই বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে কি না।’
‘তোমার আসলে তরল পানীয় দরকার,’ বলল মেয়েটা। ‘ইলেক্ট্রোলাইটের পরিমাণ কমে গেছে, বাড়াতে হবে।’
পারল মোটকু চার্লি, পৌঁছে গেল বাথরুমে। তারপর দাঁড়াল শাওয়ারের নিচে, ঘরটা কাঁপাকাঁপি বন্ধ করার আগে থামল না। অতঃপর বমি না করেই সক্ষম হলো দাঁত মাজতে।
বাথরুম থেকে ফেরার পর দেখতে পেল, কমলা- ভদকা আর নেই কামরায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে, আশা করছে – মেয়েটা হয়তো ওর মাতাল মনের আবিষ্কার। সেই সঙ্গে হয়তো গত রাতে মঞ্চে উঠে গান গাইবার স্মৃতিটাও।
ড্রেসিং গাউনটা খুঁজে বের করতে কষ্টই হলো বেচারার, তাই ট্রাকস্যুট বের করে পরে নিলো। হলের অন্য মাথায় থাকা রান্নাঘরে যাওয়ার আগে, কিছু একটা তো গায়ে দেওয়া দরকার।
আচমকা বেজে উঠল ওর ফোন, সেটার খোঁজে পকেট হাতড়াল জ্যাকেটের। জ্যাকেটটা আবার পড়ে আছে মেঝেতে, বিছানার পাশে। খুঁজে পেয়ে ফ্লিপ সেটটা খুলে ইচ্ছে করেই একবার ঘোঁত করল, ওপাশ থেকে যদি গ্রাহাম কোটস এজেন্সির কেউ ফোন করে তো তাকে শোনানোও হয়ে যাবে।
‘আমি বলছি,’ শোনা গেল স্পাইডারের কণ্ঠ। ‘সব ঠিক আছে।’
‘অফিসে বলেছটা কী? আমি মারা গেছি?’
‘নাহ, তার চাইতে ভালো কথা বলেছি। বলেছি, আমিই তুমি।’
‘কিন্তু,’ মাথা পরিষ্কার করার চেষ্টা করল মোটকু চার্লি। ‘কিন্তু তুমি তো আমি না।’
‘সেটা আমি জানি। তবে অফিসে বলেছি যে আমিই মোটকু চার্লি।’
‘আমাদের চেহারাও তো এক না!’
‘ওহে ভাই আমার, এত ছোটো করে দেখছ আমার ক্ষমতাকে? ঝামেলা হচ্ছে না কোনো, খুশি? যাই হোক, যেতে হবে। বিগ বস ডেকে পাঠিয়েছেন।’
‘গ্রাহাম কোটস? শোনো, স্পাইডার-’
কিন্তু ততক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছে স্পাইডার, পর্দা কালো হয়ে গেছে।
আচমকা কামরার ভেতরে প্রবেশ করল মোটকু চার্লির ড্রেসিং গাউন, পোশাকটার ভেতরে এক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে ওর চাইতে অনেক বেশি মানিয়েছে মেয়েটাকে। হাতে ধরে আছে একটা ট্রে, তাতে পানি ভরতি গ্লাস; সেই পানিতে ফেলেছে আলকা-সেলটযার[১১]। সঙ্গে একটা মগও আছে, কিছু একটা আছে ওতেও।
[১১. পানিতে ফেললেই গলে যায়, এমন অ্যান্টিসিডের বড়ি।]
‘দুটোই খেয়ে নাও,’ ওকে বলল মেয়েটা। ‘মগটা আগে শেষ করো, পুরোটাই।’
‘কী আছে ওতে?’
‘ডিমের কুসুম, ওরচেস্টাশায়ার সস, টাবাস্কো, লবণ, হালকা ভদকা— ইত্যাদি,’ জানাল মেয়েটা। ‘হয় মরবে, নইলে সুস্থ হয়ে যাবে। কথা অনেক হলো,’ এমন স্বরে বলল যে বোঝাই গেল, আর কোনো বাক্য বিনিময় চলবে না। ‘এখন শেষ করে ফেলো।’
নির্দেশ পালন করল মোটকু চার্লি।
‘হায় ঈশ্বর,’ বলল পরমুহূর্তেই।
‘হুম, স্বাদটা অমনই,’ সায় দিল মেয়েটা। ‘তবে বেঁচে যখন আছ—’
আসলেই বেঁচে আছে কি না, নিশ্চিত না মোটকু চার্লি। তারপরও আলকা- সেলটারের গ্লাসটা শেষ করে ফেলল। ঠিক তখনই মাথায় এলো ভাবনাটা।
‘উম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘উম, দেখো, গত রাতে…আমরা…মানে…কিছু…’
শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা। ‘আমরা কিছু…কী?’
‘আমরা কিছু করেছি নাকি?’
‘মানে বলতে চাইছ তোমার মনে নেই?’ কালো হয়ে গেল বেচারির চেহারা। ‘অথচ রাতে তো বললে, আমার মতো প্রেমিকা আগে কখনও পাওনি! বললে, এই প্রথম নারী-সঙ্গ পাচ্ছো; কেননার আগেরগুলো নারীই ছিল না! তুমিও অবশ্য কম যাও না। খানিকটা দেবতা, খানিকটা পশু, আর অনেকটা সেক্স মেশিনে পরিণত হয়েছিলে…’
নিজেকে নিয়ে কী করবে, তাই ভেবে পাচ্ছে না মোটকু চার্লি। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল মেয়েটা।
‘আরে ধুর, আমি ঠাট্টা করছি,’ বলল মেয়েটা। ‘তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল তোমার ভাইয়ের, তাই সাহায্য করেছি ওকে। তারপর তোমাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করলাম… এরপর কী হলো তা তো বুঝতেই পারছ।’
‘নাহ,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না…’
‘তাহলে খুলেই বলি। তুমি একরকম অজ্ঞানই হয়ে গেছিলে। বিছানাটাও ছোটো ছিল না, তোমার ভাই কোথায় ঘুমিয়েছে তা জানি না। কিন্তু ব্যাটা ষাঁড়ের মতো শক্ত। সেই সক্কাল বেলা উঠে পড়েছে! রাতের ধকলের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।’
‘অফিসে গেছে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘সবার কাছে নিজেকে… আমি বলে চালিয়ে দিয়েছে!’
‘কিন্তু, ধরা পড়বে না? তোমরা তো আর যমজ নও!’
‘পড়েনি বলেই তো মনে হচ্ছে,’ মাথা দোলাল মোটকু চার্লি, তারপর তাকাল মেয়েটির দিকে। ওর দৃষ্টি নিজের ওপর টের পেয়ে ছোট্ট, টকটকে গোলাপি জিভ দেখিয়ে দিল পুতুল। ‘তোমার নাম কী?’
‘বলো কী? ভুলে গেছ? তোমার নাম কিন্তু আমার মনে আছে। তুমি মোটকু চার্লি।’
‘চার্লস,’ বলল যুবক। ‘শুধু চার্লস বললেই চলবে।
‘আমি ডেইজি,’ হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’ গম্ভীর ভঙ্গিতে করমর্দন করল ওরা।
‘এখন একটু ভালো লাগছে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘আগেই বলেছি,’ মেয়েটা জবাবে বলল। ‘হয় সুস্থ হবে, নইলে পটোল তুলবে!’
.
অফিসে দারুণ একটা দিন কাটছে স্পাইডারের। বলতে গেলে কখনওই ওর অফিস করা হয়নি। অফিস কেন, কোনো চাকরিই করা হয়নি! ওর পৃথিবীটা যেন বদলে গেছে, যা দেখে নতুন লাগে; আর নতুন সব কিছুই অদ্ভুত, তবে অসাধারণ। ষষ্ট তলায় ওঠার ছোট্ট লিফট থেকে শুরু করে, গ্রাহাম কোটস এজেন্সির খোপের মতো অফিস-সবই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখে নিলো কাচের কেসে রাখা, লবির ধুলো পড়া ট্রফিগুলো। তারপর এই অফিস থেকে ওই অফিসে ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। যে-ই পরিচয় জানতে চাইছে তাকেই বলছে ‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি’।
তবে হ্যাঁ, বলছে নিজের দেবতাসুলভ কণ্ঠে, যার অর্থ—যা বলছে তা এক হিসেবে সত্যই!
চা পানের কামরাটা খুঁজে বের করে, নিজের জন্য কয়েক কাপ বানাল সে। তারপর সবগুলো কাপ নিয়ে ফিরে এলো মোটকু চার্লির ডেস্কে, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল ওগুলোকে। এরপর শুরু করল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক নিয়ে খেলা। ওর কাছে পাসওয়ার্ড চাইল যন্ত্রটা, ‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি’– কম্পিউটারকে এতটুকু জানানোই যথেষ্ট হলো। কিন্তু তারপরেও দেখা গেল, কিছু কিছু জায়গায় ঢুকতে পারছে না। তাই বলল ‘আমি গ্রাহাম কোটস’…
ব্যস, খুলে গেল সব কটা জানালা!
একঘেয়ে লাগতে শুরু করল যখন, তখন বন্ধ হলো ওর ঘাঁটাঘাঁটি।
মোটকু চার্লির যে যে কাজগুলো করার কথা ছিল, সেগুলো ঝট করে শেষ করে ফেলল ও। তারপর শেষ করে ফেলল যে কাজগুলো পরে করার কথা ছিল, সেগুলোও।
আচমকা মনে হলো, মোটকু চার্লির এখন জেগে ওঠার কথা। তাই বাড়িতে ফোন করল একটা, ভাইকে আশ্বস্ত করতে। যখন মনে হচ্ছিল, কিছুটা হলেও পেরেছে, ঠিক তখনই ভেতরে উঁকি দিল গ্রাহাম কোটস। নেউলের মতো ঠোঁটের ওপর দিয়ে আঙুল চালিয়ে ইঙ্গিতে ওকে বলল অনুসরণ করতে।
‘যাই হোক, যেতে হবে,’ ভাইকে বলল স্পাইডার। ‘বিগ বস ডেকে পাঠিয়েছেন।’ রেখে দিল ফোন।
‘অফিসে বসে, কাজের সময় ব্যক্তিগত ফোন,’ কেবল এতটুকুই বলল গ্রাহাম কোটস।
‘বি-ল-কু-ল ঠি-ক,’ সায় দিল স্পাইডার।
‘বিগ বস বলতে কী আমাকেই বোঝানো হচ্ছিল?’ জিজ্ঞেস করল গ্রাহাম কোটস, হলের শেষ মাথায় অবস্থিত নিজের অফিসে চলে এসেছে ওরা।
‘আপনিই তো সবচেয়ে বড়ো,’ জবাব দিল স্পাইডার। ‘এবং সবচাইতে অসাধারণ বস!’
হতবাক দেখাল গ্রাহাম কোটসকে। সম্ভবত তার মনে হচ্ছে যে ঠাট্টা করা হচ্ছে তাকে নিয়ে; কিন্তু নিশ্চিত না। আর তাই বিভ্রান্ত বোধ করছে।
‘হুম, বসো। বসে পড়ো।’ বলল সে।
নিজেকে বসালো স্পাইডার।
ইচ্ছে করেই এজেন্সিতে কর্মচারীদের বেশিদিন রাখে না গ্রাহাম কোটস। তবে সব কিছুই করে হিসেব-নিকেশ করে। কিছু আসে যায়। আবার কিছু লোককে রেখে দেয় সে, তবে যতদিন কাজ করলে কিছু অধিকার বলবত হয়ে যায় ততদিন থাকতে দেয় না। অন্য যেকারও চাইতে বেশি সময় হলো এখানে চাকরি করছে মোটকু চার্লি: এক বছর এবং এগারো মাস। আরেক মাস পেরোলেই ব্যাটাকে ‘শ্রমিক অধিকার’ আইনে নানা সুবিধে দিতে হবে।
কাউকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার আগে, একটা বক্তৃতা শুনিয়ে দেয় গ্রাহাম কোটস। বলা যায়, গর্বই করে সেই বক্তব্যটাকে নিয়ে।
‘প্রত্যেক জীবনেই,’ শুরু করল সে। ‘বৃষ্টিপাতের দরকার আছে। আকাশে কালো মেঘ দেখা মাত্র ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সেটা প্রাণদায়ী বর্ষণও সঙ্গে করে আনতে পারে।’
‘কিন্তু অশুভ বাতাস, পালটা উক্তি শুনিয়ে দিল স্পাইডার। ‘কারও ভালাই করতে পারে না।’
‘আহ, তা তো বটেই। যাক সে কথা। কষ্টের এই সময়টা অতিক্রম করার মুহূর্তে আমাদেরকে ভাবতে হবে, আর সেজন্য দরকার একটু থমকে দাঁড়ানো–’
‘তা নাহয় ভাবলাম। কিন্তু প্রথম ক্ষতটাই,’ জানাল স্পাইডার। ‘সবচাইতে গভীর হয়।’
‘কী? ওহ!’ এরপর কোন লাইনটা বলার কথা, তা মনে করতে বেগ পেতে হলো গ্রাহাম কোটসকে। ‘আনন্দ,’ অবশেষে খুঁজে পেয়ে ঘোষণা করল সে। ‘ডানা ঝাপটাতে থাকা প্রজাপতির মতো।’
‘অথবা ব্লুবার্ডের মতোও হতে পারে,’ পরামর্শ দিল স্পাইডার।
‘ঠিক বলেছ, এবার আমার কথা শেষ করতে পারি?’
‘অবশ্যই, অবশ্যই।’ আনন্দের সঙ্গে বলল স্পাইডার।
‘গ্রাহাম কোটস এজেন্সির প্রত্যেক সদস্যের আত্মা যেন আনন্দে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা আমার জন্য ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা গুরুত্বপূর্ণ আমার নিজের আত্মার আনন্দ নিশ্চিত করা।
‘কথাটা শুনে যে কী আনন্দ পেলাম—’ বলল স্পাইডার। -তা বলে বোঝানো সম্ভব না।’
‘হুম,’ বলল গ্রাহাম কোটস।
‘কথা বলে ভালো লাগল, কিন্তু অনেক কাজ বাকি আছে,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু বলার মতো কথা থাকলে, আমাকে ডাকতে ভুলবেন না। কোথায় বসি, তা তো জানাই আছে আপনার।’
‘আনন্দ, আত্মতৃপ্তি,’ বলেই চলছে গ্রাহাম কোটস, তবে কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ‘মাঝে মাঝে ভাবি, ন্যান্সি, চার্লস, যে তুমি কি… এখানে আনন্দে আছ? পাচ্ছ আত্মতৃপ্তি? অন্য কোথাও আরও বেশি পাবে, সে কথা কি তোমার মনে হয় না? ভাবো না এমন কিছু?’
‘নাহ, ভাবি না।’ জানাল স্পাইডার। ‘কী ভাবি, শুনতে চান?’
কিছুই বলল না গ্রাহাম কোটস। আগে কখনও এই দশা হয়নি ওর। সাধারণত এই পর্যায়ে এসে প্রত্যেকের চেহারা কালো হয়ে যায়, ধাক্কা খায় প্রচণ্ড। অনেকে তো কেঁদেও ফেলে। তা অবশ্য গ্রাহাম কোটসের খারাপ লাগে না।
‘আমি ভাবি যে,’ শুরু করল স্পাইডার। ‘কেম্যান আইল্যান্ডের[১২] অ্যাকাউন্টগুলো খুলতে হলো কেন? কেননা দেখে মনে হয়, যে টাকাটা আমাদের মক্কেলদের অ্যাকাউন্টে যাবার কথা ছিল, সেটা মাঝে মাঝে ওই কেম্যানের অ্যাকাউন্টগুলোয় চলে যাচ্ছে! হিসেব রাখার এই পদ্ধতি কেমন অদ্ভুত মনে হয় না? টাকাটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য এভাবে অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠানোটা আরকী। এমন কিছু আগে দেখিনি। আশা করি আপনার কাছ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা শিখতে পারব।’
[১২. ক্যারিবিয়ানের একটি দ্বীপ।]
একেবারে সাদা হয়ে গেছে গ্রাহাম কোটস। এখন ওর চেহারার যে রং, সেটাকে রং বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানরা বলে—পার্চমেন্ট, অথবা ম্যাগনোলিয়া। সে বলল, ‘ওই অ্যাকাউন্টগুলোর হদীস পেলে কীভাবে?’
‘কম্পিউটার ঘেঁটে,’ বলল স্পাইডার। ‘উলটোপালটা জায়গায় নিয়ে যায় আমাকে, আপনার সঙ্গেও কি তেমন করে? করলেই বা আর কী করার আছে!’
গ্রাহাম কোটস কিছুক্ষণ ভেবে নিলো। সবসময় ভেবে এসেছে, ওর অর্থনৈতিক লেনদেন এমন প্যাঁচালো ভাবে করা হয়েছে যে ফ্রড স্কোয়াড হাজার বার ঘেঁটেও কিচ্ছু আঁচ করতে পারবে না। আর যদি পারেও, কীভাবে অপরাধটা করা হয়েছে তা জুরিকে বোঝাতে গিয়ে গলদঘর্ম হবে।
‘দেশের বাইরে অ্যাকাউন্ট রাখাটা বেআইনি কিছু না,’ আলগোছে বলে ফেলল সে।
‘বেআইনি?’ পালটা প্রশ্ন করল স্পাইডার। ‘আমিও সেটাই আশা করি। বেআইনি হলে তো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে দৌড়াতে হতো।’
ডেস্কের ওপর থেকে একটা কলম তুলে নিলো গ্রাহাম কোটস, তারপর নামিয়ে রাখল আবার। ‘আহ,’ বলল সে। ‘কথা বলে, আলোচনা করে তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে আমার, চার্লস। তবে করার মতো কাজ বোধহয় আমাদের দুজনেরই আছে। সময় এবং স্রোত, হাজার হলেও, কারও জন্যই অপেক্ষা করে না। গড়িমসি করা মানেই মূল্যবান সময় হারানো।’
‘জীবন পাথরের মতো ভারী,’ বলল স্পাইডার। ‘কিন্তু রেডিয়ো আমাদেরকে স্থির হতে দেয় না।’[১৩]
[১৩. ১৯৭০-এর বিখ্যাত একটি গানের কলি!]
‘বাদ দাও।’
.
নিজেকে আবার মানুষ মনে হচ্ছে এখন মোটকু চার্লির। ব্যথা-ট্যাথা আর নেই। ধীর, কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে ছুটে আসতে থাকা বমির ধাক্কাও এখন আর ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। পৃথিবীটাকে এখনও আনন্দঘন কোনো জায়গা বলে মনে হয় না ওর, কিন্তু নরকের নবম স্তর বলেও মনে হচ্ছে না।
অন্তত এই ব্যাপারটা আশাপ্রদ।
বাথরুম দখল করে রেখেছে ডেইজি। কল ঘোরাবার আওয়াজ পেয়েছে মোটকু চার্লি। তারপর পেয়েছে তৃপ্তির সঙ্গে কারও পানিতে গা ছেড়ে দেওয়ার শব্দ।
দরজায় টোকা দিল সে।
‘আমি ভেতরে,’ জানাল ডেইজি। ‘গোসল করছি।’
‘জানি তো,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘মানে, জানতাম না; তবে আন্দাজ করেছিলাম।’
‘কী চাই?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মেয়েটা।
‘ভাবছিলাম,’ দরজার ওপাশ থেকে বলল যুবক। ‘এখানে এসেছিলে কেন, মানে গত রাতে?’
‘আসলে,’ জবাব দিল মেয়েটা। ‘তোমার অবস্থা একটু বেশিই খারাপ হয়ে গেছিল। আর তোমার ভাইকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার সাহায্যের দরকার। এদিকে আজ সকালে আমার ছুটি। তাই দুই দুগুণে চার।’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই,’ বলল মোটকু চার্লি। ওর প্রতি করুণা জন্মেছিল মেয়েটার মনে, আবার স্পাইডারের প্রতি ভালোলাগাও ছিল। হুম, মাত্র একদিনের খানিকটা বেশি হয়েছে ওদের ভ্রাতৃত্বের বয়স, এরই মাঝে সম্পর্কের ধরনটা বোঝা হয়ে গেছে। স্পাইডার হচ্ছে জনপ্রিয় ভাই; আর ও?
শুধুই স্পাইডারের ভাই।
দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ, ‘তোমার গানের গলা বেশ ভালো।’
‘কী?’
‘ট্যাক্সিতে গান গাচ্ছিলে, বাড়িতে ফেরার সময়… আনফরগেটেবল। দারুণ লেগেছে।’
ক্যারিয়োকির ঘটনাটা কীভাবে কীভাবে যেন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে মোটকু চার্লির। অথবা বলা যায় মনের যে কোণে অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসপত্র বন্দি করে রাখা হয়, সেখানে সেঁধিয়ে দিয়েছে। এখন মুক্ত হয়ে গেছে সেই ঘটনা, যদিও না হলেই খুশি হতো।
‘আসলেও ভালো গাও তুমি,’ বলল মেয়েটা। ‘পরে আমাকে গেয়ে শোনাবে?’
মরিয়া হয়ে ভাবল মোটকু চার্লি, কিন্তু কিছু বলতে পারার আগেই ওকে বাঁচিয়ে দিল ঘণ্টি।
‘কেউ এসেছে,’ বলল সে।
নিচ তলায় গিয়ে দরজা খুলতেই আবিষ্কার করল—পরিস্থিতি মুহূর্তে হাজারগুণে খারাপ হয়ে গেছে! রোজির মা এমন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে, যে দৃষ্টি দেখে দুধও দই হয়ে যাবে! কিছুই বলল না মহিলা, হাতে একটা বড়োসড়ো সাদা খাম ধরে আছে।
‘হ্যালো,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘উম, মিসেস নোয়াহ। আপনাকে দেখে খুশি হলাম।’
নাক টানল মহিলা, তারপর খামটা এগিয়ে দিল সামনে। ‘ওহ,’ বলল সে। ‘তুমি বাড়িতেই আছ… যাক, ভেতরে আসতে বলবে না?’
ঠিক ঠিক, ভাবল মোটকু চার্লি। তোমার প্রজাতির সদস্যরা তো আবার দাওয়াত না পেলে ভেতরে আসতে পারে না[১৪]। না বলাই যথেষ্ট, মহিলা চলে যেতে বাধ্য। ‘অবশ্যই, মিসেস নোয়াহ। দয়া করে ভেতরে আসুন।’ বোঝা গেল, রক্তচোষারা বাড়িতে ঢোকে কীভাবে! ‘চা দেব?’
[১৪. মোটকু চার্লি বোঝাতে চাচ্ছে, রোজির মা আসলে রক্তচোষা।]
‘এসব কথা বলে আমাকে ভজাতে পারবে না,’ বলল মহিলা। ‘তাই সেই চেষ্টাও কোরো না।’
‘উম, আচ্ছা।’
সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওরা, পা রাখল রান্নাঘরে। রোজির মা চারপাশটা তাকিয়ে দেখে এমন চেহারা বানালো যে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা পছন্দ হয়নি তার, হয়তো খাবারের অনেক আইটেম এখনও সেখানে পড়ে আছে বলে। ‘কফি? পানি?’ মোমের ফল খাওয়ার দাওয়াত দিয়ো না আবার। ‘মোমের ফল?’
ধ্যাত।
‘রোজির কাছে শুনলাম, তোমার বাবা নাকি কদিন আগেই মারা গেছেন?’
‘হ্যাঁ। গেছে।’
‘রোজির বাবা যখন মারা যায়, তখন কুকস অ্যান্ড কুকারি ম্যাগাজিনে চার পাতার শোকসংবাদ ছাপা হয়েছিল। এই দেশে ক্যারিবিয়ান ফিউশন ধাঁচের খাবার তার হাত ধরেই জনপ্রিয় হয়েছে—এমনটাই লেখা হয়েছিল তাতে।’
‘বাহ।’
‘আমাকে অকুল পাথারে ফেলে অগস্ত্য যাত্রা করেনি। জীবন-বিমা ছিল। তাছাড়া দুটো সফল রেস্তোরাঁয় অংশীদারও ছিল সে। আমি যথেষ্ট ধনী মহিলা। মারা গেলে, সেসব রোজিকেই দিয়ে যাবো।’
‘আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আপনার মেয়ের খেয়াল আমি রাখতে পারব। ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।’
‘বলছি না যে রোজিকে শুধু আমার পয়সার জন্য বিয়ে করছ,’ এমন সুরে বলল রোজির মা যে পরিষ্কার বোঝা গেল, ভদ্রমহিলা আসলে সেটাই বলতে চায়।
মাথা আবার ব্যথা করতে শুরু করেছে মোটকু চার্লির। ‘মিসেস নোয়াহ, আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘রোজির সঙ্গে কথা বলছিলাম, ঠিক করেছি তোমাদের বিয়ের পরিকল্পনায় সাহায্য করবো।’ আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া তার কণ্ঠে। ‘তোমার তরফ থেকে কারা কারা আসবে, তা জানা দরকার। নাম, ঠিকানা, ই-মেইল আর ফোন নম্বর। একটা ফর্ম বানিয়েছে, পূরণ করে দিয়ো। ভাবলাম, ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে যেহেতু যাচ্ছি তখন পথে নিজেই দিয়ে যাই; ডাকের খরচটা তাতে বাঁচবে। কিন্তু ভাবিনি তোমাকে বাসায় দেখতে পাবো।’ সাদা খামটা ধরিয়ে দিল মহিলা। ‘বিয়েতে মোট নব্বই জন মানুষ থাকবে। তাই তুমি দাওয়াত দিতে পারো আট জন আত্মীয় আর ছয় জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। টেবিল-জ তে বসবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সবাই আর আত্মীয়দের চার জন। বাকিদের জায়গা টেবিল-গ- তে। তোমার বাবাকে আমাদের সঙ্গে মূল টেবিলে বসাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তিনি যেহেতু আর নেই, তাই তার জায়গাটা দিয়েছি রোজির খালা উইনিফ্রেডকে। তোমার নিতবর কে হতে যাচ্ছে, ঠিক করেছ?’
মাথা দোলাল মোটকু চার্লি।
‘ঠিক করা হলে দয়া করে তাকে জানিয়ে দিয়ো, বক্তব্য দেবার সময় যেন বাজে আর অশ্লীল কোনো কৌতুক ব্যবহার না করে। চার্চে যে কথা বলা যায় না, সেই কথা তোমার নিতবরের মুখ থেকে শুনতে চাই না। বোঝা গেল?’
একবার ভাবল মোটকু চার্লি, রোজির মা চার্চে ঠিক কোন ধরনের কথা শোনে? সম্ভবত ‘হট যাও! নরকের কীট!’…এবং তারপর আঁতকে ওঠার আওয়াজের সঙ্গে ‘বেঁচে আছে এখনও?’ পরের কথাটা নিশ্চয়ই প্রশ্ন, উপস্থিত মানুষরা জানতে চায়—সঙ্গে করে কেউ হাতুড়ি আর কাঠের গোঁজ এনেছে কি না!
‘আমার আত্মীয়ের সংখ্যা,’ শুরু করল মোটকু চার্লি। ‘দশের বেশি হবে। দূর-সম্পর্কের ভাই-বোন আর ফুফু-খালাদের ধরলে।’
‘একটা জিনিস তুমি বুঝতে পারছ না,’ জানাল রোজির মা। ‘বিয়ে মানেই খরচ। আমি ক থেকে ঘ পর্যন্ত টেবিলের প্রত্যেকের জন্য ১৭৫ পাউন্ড করে খরচ ধরেছি। ক মানে মূল টেবিল আরকী। এগুলোয় বসবে রোজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আর আমার ক্লাবের সদস্যারা। ঙ থেকে ছ পর্যন্ত টেবিলে মাথাপিছু বাজেট ১২৫ পাউন্ড, যেগুলো দূরের আত্মীয় আর বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য।’
‘আপনি বললেন, আমার বন্ধুরা বসবে টেবিল-জ-তে!’ অবাক হয়ে গেল মোটকু চার্লি।
‘হুম, মইয়ের নিচের দিককার ধাপ। খাবার হিসেবে পরিবেশিত হবে অ্যাভোকাডো দিয়ে চিংড়ি অথবা শেরি ট্রাইফেল।’
‘শেষ বার যখন এসব নিয়ে রোজির সঙ্গে আমার কথা হলো, তখন ঠিক করেছিলাম যে খাবার হবে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ধাঁচের।’
নাক টানল রোজির মা। ‘আমার মেয়ে যে কী চায়, তা নিজেই অনেকসময় ধরতে পারে না। সে যাই হোক, এখন আমি আর ও মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘দেখুন,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এসব নিয়ে আমি নিজে রোজির সঙ্গে আলোচনা করে আবার আপনাকে জানানোই ভালো হবে বলে মনে করছি।’
‘ফর্মটা ভরে দাও, আর কিছু করতে হবে না।’ রোজির মা জানাল। ‘কাজে যাওনি কেন?’
‘আমি, উম, মানে, আজ সকালে ছুটি নিয়েছি বলতে পারেন। মানে আজ কাজে যাচ্ছি না।’
‘আশা করি রোজি সেটা জানে? দুপুরের তোমার সঙ্গে লাঞ্চ করার পরিকল্পনা করেছিল বেচারি, আমাকে বলল। সেজন্যই আমার সঙ্গে খেতে পারবে না!’
তথ্যটা হজম করে নিলো মোটকু চার্লি। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘যাই হোক, কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ, মিসেস নোয়াহ। আমি রোজির সঙ্গে কথা বলে নেবো। আর-’
ঠিক তখনই রান্নাঘরে পা রাখল ডেইজি, চুল বেঁধে রেখেছে তোয়ালে দিয়ে। পরে আছে মোটকু চার্লির গাউন, এই মুহূর্তে ভেজা শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে পোশাকটা। বলল, ‘কমলার রস আছে তো, নাকি? আগেরবার এখানে ঘুরঘুর করার সময় দেখেছি। মাথার কী অবস্থা? ভালো লাগছে?’
বলেই ফ্রিজের দরজা খুলে ফেলল মেয়েটা, লম্বা একটা গ্লাসে নিজের জন্য কমলার রস ঢালল।
কেশে গলা পরিষ্কার করল রোজির মা। তবে শুনে গলা খাঁকারি দেওয়ার আওয়াজ মনে হলো না, বরঞ্চ সৈকত বেয়ে গড়িয়ে চলা নুড়ির শব্দের মতো লাগল।
‘হ্যাল্লো,’ বলল ডেইজি। ‘আমি ডেইজি।’
রান্নাঘরের তাপমাত্রা নেমে গেল ধপ করে। ‘তাই নাকি?’ বলল রোজির মা, শেষ বর্ণটা উচ্চারণ করার সময় মনে হলো যেন বরফের টুকরো মিশিয়ে বলছে!
‘আচ্ছা, এগুলোর নাম কমলা না হলে–’ নীরবতা ভাঙতে বলল মোটকু চার্লি।
‘—কী হতো? যদি আমরা নতুন ভাবে কোনো নীল রঙের ফল আবিষ্কার করি, তাহলে কি ওটার নাম নীল রেখে দিব? নীলের রস ঢালব গলায়?’
‘কী?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রোজির মা।
‘ঈশ্বর! তোমার মুখ থেকে যে কী কী সব কথা বের হয়, তা যদি নিজের কানে শুনতে,’ ঝলমলে মুখে বলল ডেইজি। ‘যাক গে, আমার পোশাক খুঁজে পাই কি না দেখি। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল।’
বেরিয়ে গেল মেয়েটা, কিন্তু দম নিতে সেই যে ভুলে গেছিল মোটকু চার্লি, তা আবার নেওয়ার কথা মনেও পড়ল না বেচারার।
‘কে—,’ একদম শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল রোজির মা। ‘এই-মেয়ে?’
‘আমার বোন—দূরসম্পর্কের। কাজিন আরকি,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘তবে বোনের নজরেই দেখি। বেড়ে ওঠার সময় বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলাম। গত রাতে হঠাৎ করে চলে আসে। একটু উরা-ধুরা। যাই হোক, ওকে আবার বিয়ের দিনে দেখবেন।’
‘টেবিলে বসাবো তাহলে,’ জানাল রোজির মা। ‘ওখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।’ এমন ভাবে কথাটা বলল মহিলা, যেভাবে পাগল কোনো খুনি বলে: ‘তুমি দ্রুত মরতে চাও? নাকি মঙ্গোকে একটু মজা নিতে দেবে?’
‘বেশ বেশ,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘তাহলে,’ যোগ করল সেই সঙ্গে। ‘দেখা হয়ে ভালো লাগল। আর,’ আরও যোগ করল বেচারা। ‘অনেক কাজ নিশ্চয়ই বাকি আছে। তাছাড়া,’ বলেই চলছে সে। ‘আমাকেও কাজে যেতে হবে।’
‘আজ না তোমার ছুটি?’
‘সকালটা ছুটি, আর সকাল তো ফুরিয়েই এসেছে প্রায়। কাজে যেতে হবে, তাই বিদায়।’
দেহের সঙ্গে হ্যান্ডব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে, উঠে দাঁড়াল মহিলা। মোটকু চার্লি তার পিছু পিছু চলে এলো হলে। ‘দেখা হয়ে খুশি হলাম,’ বলল সে।
চোখ পিটপিট করল মহিলা। অজগররাও এভাবে চোখ পিটপিট করে, আক্রমণ করার আগে। ‘বিদায় ডেইজি,’ বলল সে। ‘বিয়ের দিন দেখা হবে।’
হলে উঁকি দিল ডেইজি, পরনে তার এখন কেবল ব্রা আর প্যান্টি। টি-শার্টে গলা ঢোকাচ্ছে। ‘ভালো থাকবেন,’ বলে ঢুকে পড়ল মোটকু চার্লির শোবার ঘরে।
আর একটা কথাও বলল না রোজির মা, মোটকু চার্লির পিছু পিছু নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। দরজা খুলে ধরল যুবক, ওকে অতিক্রম করার সময় মহিলার চেহারায় ভয়ানক একটা অনুভূতির খেলা দেখতে পেল সে। পেটের ভেতরটা যেন খামচে ধরেছে কেউ; নাহ, খামচে তো আগেই ধরেছিল…এখন সেটা শক্ত হয়েছে আরও: রোজির মায়ের চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে। ঠোঁটের দুই কোণ বেঁকে গেছে ভূতুড়ে ছোঁয়া নিয়ে। শুধু ঠোঁটঅলা কোনো খুলি হাসলে যেমন দেখাবে, রোজির মায়ের হাসিটাও অবিকল তেমনি দেখাচ্ছে!
দরজা বন্ধ করে, নিচতলার হলেই কেঁপে উঠল বেচারা। তারপর ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষের মতো, ধীরে ধীরে ভাঙতে লাগল ওপরে ওঠার সিঁড়ি।
‘কে ছিল মহিলা?’ পোশাক পরা প্রায় শেষ ডেইজির, জানতে চাইল মোটকু চার্লির কাছে।
‘আমার বাগদত্তার মা।’
‘খুব হাসিখুশি মহিলা, তাই না?’ গত রাতে যে পোশাক পরেছিল, সেটাই আবার পরেছে মেয়েটা।
‘এভাবে অফিসে যাবে?’
‘আরে নাহ। আগে বাসায় গিয়ে বদলে নেব। তাছাড়া কাজের সময় আমি এই সাজে থাকি না। ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে পারবে?’
‘যাবে কই?’
‘হেনডন।’
স্থানীয় একটা ট্যাক্সি সার্ভিসে ফোন লাগাল মোটকু চার্লি। তারপর হলওয়ের মেঝেতে বসে বসে ভাবতে লাগল: সকালের এই মোলাকাতের ফলাফল কী হতে পারে? কিন্তু কোনোটাই ওর পছন্দ হলো না।
কেউ একজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ব্যাগে ভিটামিন বি-এর কিছু বড়ি আছে,’ জানাল সে। ‘চাইলে চামচে মধু নিয়ে চেটে দেখতে পারো। আমার লাভ হয়নি, কিন্তু যার সঙ্গে থাকি সে কিড়া কেটে বলে—হ্যাংওভার কাটাতে নাকি দারুণ কাজে দেয়।’
‘সমস্যা সেটা না,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘রোজির মাকে বললাম, তুমি আমার কাজিন। নইলে আবার ভেবে বসত যে আমরা… মানে তুমি আর আমি…মানে অদ্ভুত একটা মেয়েকে অপরিচিত কারও ফ্ল্যাটে দেখা গেলে লোকে যা ভাবে আরকি…’
‘কাজিন? বেশ তো, দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমার কথা বেমালুম ভুলে যাবে মহিলা। আর যদি না যায় তো বলো – রহস্যময় ভাবে আমি দেশ ছেড়েছি। এমনিতেও আমাদের আর কখনও দেখা হবে না।’
‘সত্যি? কথা দিচ্ছ?’
‘এটা এত আনন্দ পাবার মতো কোনো কথা নাকি?’
বাইরে, রাস্তা থেকে ভেসে এলো হর্নের আওয়াজ। ‘ট্যাক্সি বোধহয় এসে পড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় দাও।’
তাই করল মোটকু চার্লি।
‘এত ভেবো না তো,’ বলে ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
‘জীবনটা বোধহয় ধ্বংস হয়ে গেছে।’
‘আরে নাহ, তা হবে কেন?’
‘আমি শেষ, পুরাই শেষ!’
‘ধন্যবাদ,’ বলে সামনে ঝুঁকল ডেইজি। চুমু খেল মোটকুর চার্লির ঠোঁটে। এতটাই জোরে এবং এতক্ষণ ধরে যে তাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যাবে না! নিদেনপক্ষে সদ্য পরিচিত দুজন মানুষের জন্য তো একদমই না। তারপর হেসে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে, নিজেই দরজা খুলে পা রাখল বাইরে।
‘এসব,’ মোটকু চার্লি জোরালো কণ্ঠে বলে উঠল দরজা বন্ধ হলে। ‘কল্পনা ছাড়া আর কিচ্ছু না।’
এখনও চুমুটার স্বাদ পাচ্ছে সে ঠোঁটে, রাজবেরি আর কমলার রসসহ। কী অসাধারণ এক চুমু…সেই সঙ্গে কী গভীরও! সেই চুমু এমন একটা অনুভূতির জন্ম দিয়েছে ওর মনে, যা সারা জীবনে আর কারও চুমু দিতে পারেনি। এমনকী সেটা—
‘রোজি,’ আচমকা মনে পড়ে গেছে প্রেমিকার কথা।
ফ্লিপ ফোনটা খুলল সে, স্পিড ডায়ালেই আছে মেয়েটার নম্বর।
‘রোজির ফোন,’ রোজির কণ্ঠ শোনা গেল। ‘আমি ব্যস্ত, আর নয়তো আবার হারিয়ে ফেলেছি ফোনটা। ভয়েস মেইলে আছ তুমি, হয় বাড়ির নম্বরে ফোন করো আর নয়তো মেসেজ রেখে যাও।’
ফোন রেখে দিল মোটকু চার্লি। তারপর ট্রাকস্যুটের ওপর চাপালো কোট। প্রবল সূর্যের আলোর সামনে পড়ে মুখ কুঁচকাল একটু, তারপর পা রাখল রাস্তায়।
.
দুশ্চিন্তায় পড়েছে রোজি নোয়াহ, ব্যাপারটা টের পেয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল বেচারির। রোজির জীবনের অধিকাংশ সমস্যার মতোই, বর্তমান দুশ্চিন্তার কারণ মূলত ওর মা…সেটা নিজের কাছে স্বীকার না করলেও!
মোটকু চার্লি ন্যান্সিকে ও বিয়ে করতে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা যে ওর মায়ের পছন্দ না একদমই—সেটা মোটামুটি মেনে নিয়েছে রোজি। অবশ্য মায়ের একগুঁয়ের মতো এই বিয়ের বিরুদ্ধাচরণ করাটাকে সে ঐশ্বরিক শুভ ইঙ্গিত হিসেবেই ধরে নিয়েছে! যদিও বিয়েটা নিয়ে দ্বিধায় আছে ও নিজেই।
সন্দেহ নেই, ভালোবাসে সে ছেলেটাকে। নিরেট, নির্ভরযোগ্য, বুদ্ধিমান ছেলে মোটকু চার্লি…
বিয়েটা মেনে নিয়ে সাহায্য করতে চেয়েই আসলে রোজিকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে ওর মা। গত রাতেই মোটকু চার্লিকে ফোন করেছিল ও, ভেবেছিল ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবে। কিন্তু তোলেনি ছেলেটা, হয়তো আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছে — ধরে নিয়েছিল রোজি।
সেজন্যই লাঞ্চের সময় কথা বলতে চাইছে ব্যাপারটা নিয়ে।
অলডউইচের একটা ধূসর, ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের দালানের একেবারে ওপরের তলায় অবস্থিত গ্রাহাম কোটস এজেন্সি; ছয়টি তলার সিঁড়ির মাথায়। লিফট একটা আছে বটে, তবে বহু প্রাচীন এই লিফট লাগানো হয়েছিল প্রায় একশো বছর আগে, থিয়েটার এজেন্ট রুপার্ট ‘বিনকি’ বাটারওয়ার্থ লাগিয়েছিল। একেবারে ছোটো, ধীর একটা লিফট; যেটা ওঠার সময় কাঁপে প্রবল ভাবে। কেন, সেটা জানতে হলে অবশ্য বিনকি বাটারওয়ার্থের ব্যাপারে জানতে হবে। ছোটোখাটো একটা জলহস্তীর সমান ছিল ভদ্রলোক। লিফটটার নক্সা এমনভাবে করেছে যেন তার সঙ্গে আর মাত্র একজন আঁটে লিফটে: কোরাসে অংশ নেওয়া কোনো পাতলা-সাতলা মেয়ে, কিংবা ছেলে-বিনকির কোনোটাতেই আপত্তি ছিল না। তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটা বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট ছিল, লিফটে তার সঙ্গে আঁটতে পারলেই হলো। ধীরে ধীরে লিফট ওপরে ওঠায় প্রায়শই দেখা যেত—একদম ওপরের তলায় উঠতে গিয়ে বিনকির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যেত যে একটু ঘুমিয়ে নিতে হতো তাকে। তাই সঙ্গী বা সঙ্গিনী চুপচাপ বসে থাকতে হতো ওয়েটিং রুমে, দুশ্চিন্তার সঙ্গে ভাবত—লাল হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে শেষের তলাগুলো ওঠার সময় হাঁপাতে থাকা বিনকির আবার এম্বোলিজমের সমস্যা দেখা যায়নি তো?
বিনকি বাটারওয়ার্থের সঙ্গে যারা একবার লিফটে চড়ত, তারা এরপর থেকে সিঁড়ি ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করত না।
গ্রাহাম কোটস, যে বিনকির নাতনির কাছ থেকে বছর বিশেক আগে দ্য বাটারওয়ার্থ এজেন্সি কিনে নেয়, ইতিহাসের অংশ হিসেবে লিফটটাকে ওভাবেই রেখে দিয়েছে।
ভেতরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল রোজি, এরপর বাইরের দরজা বন্ধ করে পা রাখল রিসেপশনে। চার্লস ন্যান্সির সঙ্গে দেখা করতে চায়, জানাল রিসেপশনিস্টকে। গ্রাহাম কোটসের অনেকগুলো ছবি ঝোলানো আছে কামরায়, যাদের এজেন্ট হিসেবে সে কাজ করছে বা করেছে তাদের সঙ্গে; ওগুলোর ঠিক নিচে বসল রোজি। মক্কেলদের মাঝে আছে কৌতুকাভিনেতা মরিস লিভিংস্টোন, এককালের বিখ্যাত বয়-ব্যান্ড, এবং একগাদা বিখ্যাত খেলোয়াড় যারা পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে ‘ব্যক্তিত্ব’-এ। জীবন থেকে যতটা সম্ভব আনন্দ লুটতে চায় এই ব্যক্তিত্বরা, নতুন একটা যকৃত দরকার হবার আগপর্যন্ত।
রিসেপশনে পা রাখল এক যুবক। তাকে দেখে মোটকু চার্লির মতো লাগছে না, অনেক বেশি রহস্যময়; হাসছে এমনভাবে যেন চারপাশের সবই তাকে আনন্দ দিচ্ছে। ঘন, কিন্তু বিপজ্জনক সেই আনন্দ।
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি,’ বলল যুবক।
মোটকু চার্লির কাছে হেঁটে গেল রোজি, গালে চুমু খেল ছোট্ট করে। ‘আমি চিনি তোমাকে?’ জিজ্ঞেস করল যুবক। অদ্ভুত বাক্যটা উচ্চারণের পরেই আবার যোগ করল, ‘অবশ্যই চিনি, তুমি রোজি। দিনকে দিন আরও সুন্দর হচ্ছ।’ পালটা চুমু খেল সে, ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে। ওদের ঠোঁট শুধু স্পর্শ করল একে-অপরকে, কিন্তু তাতেই লাফাতে শুরু করল রোজির হৃদয়…
…লিফটে করে ওপরে ওঠার সময় যেভাবে লাফাত বিনকি বাটারওয়ার্থের হৃৎপিণ্ড।
‘লাঞ্চ,’ কোনোমতে বলল রোজি। ‘পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, হয়তো আমরা কিছু আলোচনা সেরে নিতে পারব।’
‘অবশ্যই,’ যে যুবককে মোটকু চার্লি বলে ভাবছে এখন রোজি, সে বলল। ‘লাঞ্চ।’ রোজির কাঁধে আলগোছে হাত রাখল সে। ‘কোথায় যাবে? ঠিক করেছ?’
‘ওহ,’ বলল মেয়েটা। ‘যেখানে…যেতে চাও।’ এত সুন্দর করে হাসছে, ভাবল রোজি। আগে কেন দেখতে পাইনি সেই সৌন্দর্যটুকু?
‘খাওয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে,’ বলল যুবক। ‘সিঁড়ি বেয়ে নামবে?’
‘যদি তোমার আপত্তি না থাকে তো,’ বলল রোজি। ‘লিফটেই নামি।’ ভেতরের দরজা বন্ধ করে দিল রোজি, তারপর কাঁপতে কাঁপতে নেমে এলো নিচতলায়; দুজনের দেহ লেগে রইল একে-অন্যের সঙ্গে।
শেষ কবে এত উল্লসিত হয়েছিল, তা মনে পড়ছে না রোজির।
রাস্তায় পা রাখার পর, বিপ শব্দ করে বেজে উঠল রোজির ফোন; জানিয়ে দিল—একটা ফোন কল ধরতে পারেনি সে। কিন্তু যন্ত্রটাকে অগ্রাহ্য করল মেয়েটা।
সামনে প্রথম যে রেস্তোরাঁটা পড়ল, সেটাতেই প্রবেশ করল ওরা। গত মাসেও জায়গাটা হাই-টেক সুসি রেস্তোরাঁ ছিল। একটা কনভেয়ার বেল্ট ছিল ভেতরে, ঘুরে ঘুরে সবাইকে কাঁচা মাছ পরিবেশন করত। তবে জাপানিজ রেস্তোরাঁটা এখন ব্যাবসা গুটিয়ে নিয়েছে। অবশ্য সে জায়গায় আরেকটা রেস্তোরাঁ চালু হতে সময় নেয়নি, লন্ডনে যেমনটা হয় আরকী। এখন ওটা হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁ, কনভেয়ার বেল্টটা রেখে দিয়েছে আগের মতোই; বিশ্বকে হাঙ্গেরিয়ান ধাঁচের খাবারের সঙ্গে আরও সহজে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। যার ফলে দ্রুত ঠান্ডা হতে শুরু করা গুলাশের পাত্র, প্যাপরিকা, ডাম্পলিং আর তিতকুটে ক্রিম দর্শনীয় ভঙ্গিতে ঘুরছে কামরা জুড়ে।
রোজির মনে হয় না বেশিদিন টিকবে এই রেস্তোরাঁ।
‘গতরাতে কী করছিলে?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘বাইরে গেছিলাম,’ জবাব দিল যুবক। ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘তুমি না একমাত্র সন্তান?’
‘আরে নাহ। কদিন আগে আবিষ্কার করেছি, দুই সন্তানের অর্ধেক আমি।’
‘তাই নাকি? তোমার বাবার কৃতিত্ব?’
‘সোনা,’ মোটকু চার্লি বলে যাকে মেনে নিয়েছে রোজি, সেই যুবকটি বলল। ‘আমার বাবার কৃতিত্বের অর্ধেকটাও জানো না।’
‘হুম,’ বলল মেয়েটা। ‘আশা করি বিয়েতে আসবে তোমার ভাই।’
‘অবশ্যই আসবে, কোনো কিছু দিয়েই আটকে রাখা যাবে না তাকে।’ শক্ত করে রোজির হাত আঁকড়ে ধরল যুবক, এতটাই যে হাত থেকে আরেকটু হলেই গুলাশের চামচ ফেলে দিচ্ছিল মেয়েটা। ‘বিকেলে কী করছ?’
‘তেমন কিছু না। অফিসেও খুব একটা কাজ-কর্ম নেই। কয়েকজনকে ফোন করতে হবে, চাঁদা চাইতে। কিন্তু পরে করলেও হবে। কেন-উম-কিছু- মানে করতে চাও?’
‘কী সুন্দর একটা দিন। হাঁটতে যাবে?’
‘তাহলে তো,’ জবাব দিল রোজি। ‘ভালোই হয়।’
খাওয়া শেষে তীরে চলে এলো ওরা, থেমস নদীর উত্তর দিক ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। হাতে-হাত রেখে, ধীরে-সুস্থে, এটা-সেটা নিয়ে কথা বলছে…তবে কোনোটাই তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
‘তোমার কাজ নেই?’ আইসক্রিম কেনার জন্য থামলে, জিজ্ঞেস করল রোজি।
‘ওহ,’ জবাব দিল যুবক। ‘না গেলেও অফিসে কেউ কিছু মনে করবে না। আমি যে নেই, সেটাই বোধহয় ধরতে পারবে না কেউ!’
.
এক রকম দৌড়েই মোটকু চার্লি সিঁড়ি ভাঙল গ্রাহাম কোটস এজেন্সির দালানটার। সব সময় সিঁড়ি ধরেই ওঠে সে। কারণ হিসেবে প্রথমেই বলতে হয়—সেটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাছাড়া লিফটে আরেকজনের সঙ্গে আবিষ্কার করতে হয় না নিজেকে; কেউ নেই–এই ভানটাও তখন করতে হয় না।
রিসেপশনে পা রাখার সময় আবিষ্কার করল, খানিকটা হাঁপাচ্ছে। ‘রোজি এসেছিল, অ্যানি?’
‘কেন, হারিয়ে ফেলেছ?’ পালটা প্রশ্ন করল রিসেপশনিস্ট।
জবাব না দিয়ে নিজের অফিসে চলে এলো মোটকু চার্লি, ডেস্কটা সাজানো গোছানোই আছে…অদ্ভুত! তবে কম্পিউটারের পর্দায় দেখা যাচ্ছে একটা হলদে পোস্ট-ইট। ‘দেখা করো আমার সঙ্গে, জিসি’–লেখা আছে ওতে।
গ্রাহাম কোটসের অফিসের দরজায় নক করল সে। ভেতর থেকে এবার ভেসে এলো একটা কণ্ঠ। ‘কে?’
‘আমি,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘ওহ,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘ভেতরে এসো, মাস্টার ন্যান্সি। বসো, বসো। আজ সকালে আমাদের যে আলোচনা হলো, সেটা মনে দাগ কেটে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, তোমাকে বুঝতে আমি ভুল করেছি। এখানে কত দিন হলো কাজ করছ যেন?’
‘প্রায় দুই বছর…’
‘অনেকদিন হলোই কঠোর পরিশ্রম করছ দেখা যাচ্ছে। তার ওপর তোমার বাবা মারা গেলেন…’
‘আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না।’
‘আহ, সাহসী মানুষ তুমি, ন্যান্সি। এমনিতেও এখন কাজ-কর্ম নেই। তাই কয়েক হপ্তার ছুটি পেতে কেমন লাগবে? তাও আবার পুরো বেতনসহ।’
‘পুরো বেতন?’ হতবাক হয়ে গেল মোটকু চার্লি।
‘হ্যাঁ, পুরো বেতন। তবে তোমার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি। হাতে কিছু টাকা তো থাকতে হবে, খরচ করার জন্য। পারবে না জোগাড় করতে?’
কোন দুনিয়ায় চলে এসেছে, তাই ভাবছে মোটকু চার্লি। ‘আমার চাকরি আছে তো?’
হেসে ফেলল গ্রাহাম কোটস, গলায় হাড় আটকালে নেউলে এভাবে হাসে। ‘একদম না। বরং উলটোটা বলতে পারো,’ জানাল সে। ‘আশা করি এখন আমরা একে-অপরকে ভালোভাবে বুঝতে পারছি। তোমার চাকরি বহাল তবিয়তেই আছে, একদম দালান-বাড়ির মতো নিরাপদ। তবে শর্ত একটাই, এতদিন ধরে যেমন অনুগত ও বাধ্য ভাবে চাকরি করে আসছ, ভবিষ্যতেও তাই করবে আশা করি।’
‘আসলেও কি দালান-বাড়ি নিরাপদ?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘শতভাগ নিরাপদ।’
‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে বাড়িতেই।’
‘তাহলে তো,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘তোমার তো যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরা উচিত।’ মোটকু চার্লিকে চারকোনা একটা কাগজ এগিয়ে দিল সে। ‘গ্রাহাম কোটস এজেন্সি তোমাকে গত দুই বছর ঐকান্তিক ভাবে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে।’ তারপর, সবসময় কাউকে টাকা দেওয়ার সময় যা বলে, তাই যোগ করল। ‘এক ধাক্কায় খরচ করে ফেলো না সব।’
কাগজটা হাতে নিলো মোটকু চার্লি, আসলে ওটা চেক। ‘দুই হাজার পাউন্ড। হায়, ঈশ্বর! মানে, বলতে চাচ্ছি-করবো না খরচ।’
মোটকু চার্লির দিকে চেয়ে হাসল গ্রাহাম কোটস। সেই হাসিতে হয়তো বিজয় মিশে ছিল; কিন্তু হতবাক, হতচকিত, বিভ্রান্ত মোটকু চার্লির নজরে তা ধরা পড়ল না।
‘যাও তাহলে,’ বলল গ্রাহাম কোটস।
নিজের অফিসে ফিরে এলো মোটকু চার্লি।
দরজার ওপাশ থেকে ঝুঁকে তাকাল গ্রাহাম কোটস, এমনভাবে যেন কোনো নেউলে উঁকি দিচ্ছে সাপের ডেরায়। ‘একটা প্রশ্ন ছিল করার। যেহেতু ছুটিতে যাচ্ছ, নিজেকে উপভোগ করতে—যা করাটা খুবই জরুরি—তখন যদি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েও না পারি, অথচ তোমার ফাইলগুলো দেখতে হয়…তাই কম্পিউটারের পাসওয়ার্ডটা দয়া করে জানাবে?’
‘আপনার নিজের পাসওয়ার্ড দিয়েই তো সিস্টেমের যেকোনো জায়গায় ঢুকতে পারবেন।’
‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ গ্রাহাম কোটস সঙ্গে সঙ্গে একমত হলো। ‘তারপরও, যদি দরকার হয়? কম্পিউটারের কথা কি আর কিছু বলা যায়?’
‘মারমেইড,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এম-ই-আর-এম-আ-আই-ডি।’
‘বেশ,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘বেশ বেশ।’ খলনায়কদের মতো হাতে হাত ঘষল না বটে, তবে ঘষলেও অস্বাভাবিক মনে হতো না।
পকেটে দুই হাজার পাউন্ডের একটা চেক নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল মোটকু চার্লি, ভাবছে—গত দুই বছর ধরে গ্রাহাম কোটসকে কত ভুল ভেবেছে। রাস্তার মোড়েই ওর ব্যাঙ্ক, অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিল টাকাটা। তারপর চলে এলো নদীর ধারে, শ্বাস নিতে… ভাবতে।
এই মুহূর্তে ও আগের চাইতে দুই হাজার পাউন্ড বেশি ধনী। সকাল বেলার মাথাব্যথাটাও এখন আর নেই। নিজেকে ধনী মনে হচ্ছে ওর নিজের কাছেই। রোজিকে বলে ছোট্ট একটা ছুটিতে নিয়ে যেতে পারবে কি না, তাই ভাবল। হাতে সময় বেশি নেই, তারপরেও…
ঠিক তখনই দেখতে পেল সে স্পাইডার আর রোজিকে, রাস্তার অন্য পাশে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ওরা। আইসক্রিম হাতে ধরে আছে রোজি, তবে শেষের দিকে। আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে বাকিটুকু ফেলে দিল ময়লার বাক্সে, তারপর স্পাইডারকে টেনে নিলো নিজের দিকে। আইসক্রিমঅলা মুখ নিয়েই, পরম আগ্রহ আর আশ্লেষের সঙ্গে চুমু খেল যুবককে।
মোটকু চার্লি টের পাচ্ছে, ফিরে আসছে মাথাব্যথাটা। কেমন যেন অবশ লাগছে নিজেকে।
ওদেরকে চুমু খেতে দেখল সে। ভাবল: আগে হোক বা পরে, শ্বাস নেওয়ার জন্য হলেও তো থামাতে হবে চুম্বন; কিন্তু না, ওদের তা মনে হচ্ছে বলে মনে হয় না। তাই হতাশ আর বিষণ্ন মোটকু চার্লি হাঁটতে শুরু করল অন্য দিকে। টিউবের কাছে পৌঁছুবার আগে থামল না।
ফিরে এলো বাড়িতে।
যতক্ষণে ফিরতে পারল, ততক্ষণে মোটকু চার্লির অবস্থা এতটাই খারাপ যে শুয়ে পড়ল সে বিছানায়; যে বিছানা থেকে এখনও ডেইজির হালকা গন্ধ ভেসে আসছে। বন্ধ করে ফেলল চোখ।
.
বয়ে যেতে লাগল সময়। মোটকু চার্লি নিজেকে আবিষ্কার করল একটা বালুময় সৈকতে, পাশেই ওর বাবা। খালি পায়ে হাঁটছে উভয়ে, বাচ্চা বনে গেছে মোটকু চার্লি। কিন্তু ওর বাবা?
বয়সের কোনো ছাপ নেই তার চেহারায়।
তো, বলছে ওর বাবা। স্পাইডারের সঙ্গে দিন কেমন কাটছে?
স্বপ্ন দেখছি, জবাবে বলল মোটকু চার্লি। তাছাড়া আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।
হায় রে, বলল ওর বাবা, মাথা নাড়তে নাড়তে। শোনো, তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার আছে।
কী?
কিন্তু জবাব দিল না ওর বাবা। ঢেউয়ের মাথায় এমন কিছু একটা আছে, যা তার নজর কেড়ে নিয়েছে। উবু হয়ে সেটা তুলে নিল লোকটা। সুচালো পাঁচটা পা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
স্টারফিশ, বলল ওর বাবা। দ্বিখণ্ডিত করলে, একটা থেকে দুটো হয়ে যায়।
আমাকে না তোমার কী গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল?
বুক খামচে ধরল ওর বাবা, পরক্ষণেই পড়ে গেল বালুতে। বমি করতে শুরু করল। বালুর ভেতর থেকে কীটপতঙ্গ বেরিয়ে এসে কয়েক মুহূর্তের মাঝে গিলে ফেলল তাকে, হাড় বাদে কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
বাবা?
ঝট করে উঠে বসল মোটকু চার্লি, ঘুম ভেঙে গেছে; গালে পেল অশ্রুর স্পর্শ। কান্না বন্ধ করে দিল সে। মন খারাপ করার কোনো কারণই নেই। ওর বাবা এই মাত্র মারা যায়নি; স্বপ্ন দেখেছে শুধু।
সিদ্ধান্ত নিলো, রোজিকে আগামীকাল রাতে দাওয়াত দেবে। দুজনে মিলে স্টেক খাবে ওরা, রান্না করবে সে-ই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
উঠে, পোশাক পরে নিলো মোটকু চার্লি।
মিনিট বিশেক পর রান্নাঘরে দেখা গেল তাকে, নুডলস খাচ্ছে। ঠিক তখনই মনে এলো কথাটা: খানিক আগে সৈকতে ওর বাবাকে মরতে দেখাটা দুঃস্বপ্নে হলেও, ওর বাবা সত্যি সত্যিই মারা গেছে!
.
সেদিন বিকেলে উইম্পোল স্ট্রিটে, মায়ের ফ্ল্যাটে পা রাখল রোজি।
‘আজ তোমার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম,’ বলল মিসেস নোয়াহ। তার ডাক নাম ইউথেরিয়া, কিন্তু গত তিন দশকে স্বামী বাদে আর কেউ ওকে এই নামে ডাকেনি। ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর, নামটা যেন শুকাতে শুকাতে মিলিয়ে গেছে পুরোপুরি।
সম্ভবত ইহজীবনে এই নামটা আর অন্য কারও মুখে শোনা হবে না।
‘আমিও দেখা করেছি,’ জানাল রোজি। ‘ঈশ্বর, এত ভালোবাসি আমি ওকে!’
‘তা তো বটেই। হাজার হলেও বিয়ে করছ, তাই না?’
‘হ্যাঁ। মানে, সবসময়ই জানতাম যে ওকে ভালোবাসি। কিন্তু আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, কতটা ভালোবাসি আসলে। ওর সবকিছুই আমার ভালো লাগে।’
‘গত রাতে কই ছিল, জানতে পেরেছ?’
‘হ্যাঁ। ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছে। ভাইয়ের সঙ্গে বাইরে গেছিল।’
‘ওর যে ভাই আছে, সেটাই তো জানতাম না।’
‘আগে ভাইটার কথা বলেনি কখনও, ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল না।’
ঠোঁট দিয়ে আওয়াজ করল রোজির মা। ‘পারিবারিক সম্মেলন চলছে বোধহয়। আত্মীয়ের কথা বলেছে তো?’
‘আত্মীয়?’
‘অথবা বোনও হতে পারে। মোটকু চার্লিকেও বিভ্রান্ত মনে হলো। দেখতে ভালোই, তবে একটু উচ্ছৃঙ্খল টাইপের। চাইনিজ মনে হলো আমার কাছে। যাই হোক, এই হলো তার পুরো পরিবার।’
‘মা, ওর পরিবারের সঙ্গে তোমার দেখাই হয়নি!’
‘কাজিনের সঙ্গে দেখা তো হয়েছে। আজ সকালে মেয়েটাকে রান্নাঘরে দেখেছিলাম। প্রায় ন্যাংটো হয়ে বাড়িজুড়ে ঘোরাফেরা করছিল। নির্লজ্জ কোথাকার, কাজিন হলেও এভাবে কেউ হাঁটা-চলা করে?’
‘মোটকু চার্লি মিথ্যে বলবে না আমাকে।’
‘ও পুরুষ তো, নাকি?’
‘মা!’
‘কাজে যায়নি কেন আজ, সেই প্রশ্নের জবাব দাও।’
‘গেছিল তো কাজে। একসঙ্গে লাঞ্চও করলাম।’
ছোট্ট আয়না বের করে তাতে নিজের লিপস্টিকের অবস্থা দেখে নিলো রোজির মা, তর্জনী ব্যবহার করে দাঁত থেকে মুছে ফেলল লালচে দাগ।
‘কী বলেছ ওকে?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
‘বিয়ে নিয়ে কিছু কথা হলো। জানিয়ে দিলাম, ওর নিতবর আজে-বাজে কথা বলুক, সেটা চাই না। আমার তো মনে হলো, মদ খেয়ে খারাপ অবস্থা বেচারার। আগে থেকেই তো বলে আসছি তোমাকে, মাতালকে বিয়ে কোরো না।’
‘আমার সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন তো ভালোই দেখাচ্ছিল।’ সাফ জানিয়ে দিল রোজি। তারপর যোগ করল, ‘ওহ মা, আজকের দিনটা এমন কেটেছে আর কী বলব…আমরা হেঁটেছি, গল্প করেছি—ওর গায়ের গন্ধ কী অসাধারণ, সেটা বলেছি আগে? হাতটাও নরম।’
‘গন্ধ তো আমার নাকেও এসেছে,’ ওর মা বলল। ‘মাছের গন্ধ। পরেরবার যখন দেখা হবে, তখন ওর এই আত্মীয়ার কথা জানতে চেয়ো। বলছি না যে ওরা আত্মীয়, আবার এটাও বলছি না যে আত্মীয় না। যদি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে: ওর পরিবারে পতিতা আর স্ট্রিপার আছে। এমন মানুষের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া উচিত না।’
স্বস্তি পেল রোজি, যেহেতু মোটকু চার্লিকে আবার উলটো-পালটা বলতে শুরু করেছে ওর মা। ‘মা, আর একটাও বাজে কথা বলবে না।’
‘ঠিক আছে, মুখে খিল লাগালাম। আমি তো আর বিয়ে করছি না, জীবনকে নিজ হাতে নষ্টও করছি না। তাছাড়া সারা রাত যখন রক্ষিতা নিয়ে মদ খেয়ে ফূর্তি করবে লোকটা, তখন যে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে, সে-ও আমি হবো না। দিনের পর দিন আর রাতের পর রাত তার জেল থেকে ছাড়া পাবার অপেক্ষর প্রহর আমাকে গুণতে হবে না।’
‘মা!’ কড়া কণ্ঠে ধমক দিতে চাইল রোজি। কিন্তু মোটকু চার্লি জেলে যাবে, এই ধারণাটাই এতটা হাস্যকর যে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও হেসে ফেলতে বাধ্য হলো।
বেজে উঠল ওর ফোন, সেটা কানে ধরল মেয়েটা। ‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘বেশ তো, দারুণ হবে।’ ফোন রেখে দিল তারপর।
‘ও-ই ফোন করেছে,’ মাকে জানাল মেয়েটা। ‘কাল রাতে যাচ্ছি ওর বাড়িতে, আমার জন্য রান্না করবে বলেছে। কী মিষ্টি, তাই না?’ যোগ করল সেই সঙ্গে। ‘জেলখানায়…চার্লি? হাস্যকর!’
‘আমি তোমার মা,’ বলল ওর মা, নিজের খাবারবিহীন ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে যেখানে ধুলোও পড়ার সাহস করে না। ‘যা জানি, তা জানি।’
.
অফিসে বসে আছে গ্রাহাম কোটস, দিন এগিয়ে যাচ্ছে সূর্যাস্তের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে কম্পিউটারের পর্দার দিকে। একটার পর একটা ডকুমেন্ট, স্প্রেডশিট খুলছে সে। কয়েকটায় কাজ করল, অধিকাংশই মুছে ফেলল।
সেই সন্ধ্যাতেই বার্মিংহ্যামে যাবার কথা ছিল ওর। এক প্রাক্তন ফুটবলার, ওর মক্কেল, ওখানে একটা নাইটক্লাব খুলতে চায়। ফোন করে ক্ষমা চাইল গ্রাহাম কোটস: কিছু কিছু ঘটনা এমন ঘটে যায়, যা এড়ানো যায় না।
খানিকক্ষণের মাঝেই সূর্যের আলো পুরোপুরি বিদেয় নিলো দুনিয়ার বুক থেকে। কম্পিউটারের পর্দা থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা আভায় বসে রইল গ্রাহাম কোটস। ঠিক বসে রইল বলা যাবে না। কেননা হাত চলছে তার; বদলাচ্ছে, নতুন করে লিখছে…মুছে ফেলছে ফাইল।
.
আনানসিকে নিয়ে প্রচলিত আরেকটা গল্প শোনাই আপনাদের।
অনেক, অনেক দিন আগে, আনানসির স্ত্রী লাগিয়েছিল মটরশুঁটির খেত। এমন দারুণ, মোটা আর সবুজ মটরশুঁটি আগে কেউ কখনও দেখেনি! আপনি দেখলেই আবিষ্কার করতেন, জিভ থেকে জল ঝরছে!
খেতের মটরের ওপর প্রথম যেদিন নজর পড়ল আনানসির, সেদিন থেকেই ওগুলো খাওয়ার লোভ ঢুকে পড়ল মনে। কয়েক মুঠো দিয়ে কিন্তু মন ভরবে না ওর, বিশাল খিদে আনানসির। ওগুলোর ভাগ আর কাউকে দেওয়ারও ইচ্ছে নেই তার, সব একাই খেতে চায়!
তাই বিছানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, এত জোরে আর এতক্ষণ ধরে যে তা শুনতে পেয়ে ছুটে এলো ওর স্ত্রী আর সব ছেলেরা। ‘আমি মরে যাচ্ছি,’ বলল আনানসি ওদের, একেবারে ক্ষীণ আর দুর্বল কণ্ঠে। ‘এসে পড়েছি জীবনের সায়াহ্নে।’
কথা শুনেই কান্না জুড়ে দিল আনানসির স্ত্রী-ছেলেরা।
সেই একই ক্ষীণ-দুর্বল কন্ঠে আনানসি আবার বলল, ‘মৃত্যুশয্যায় চাই, তোমরা আমার কাছে দুটো বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করবে।’
‘যা চাইবে, যেমন চাইবে আর যেভাবে চাইবে…তাই হবে।’ স্ত্রী আর ছেলেরা জবাব দিল।
‘প্রথমত: কথা দাও আমাকে কবর দেবে ওই বড়ো, ব্রেডফ্রুট[১৫] গাছের নিচে।’
[১৫. কাঁঠালের মতো এক ধরনের ফল, আকারে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র।]
‘মটরশুঁটির খেতের পাশে যে বড়ো গাছটা, ওটার কথাই বলছ তো?’ জানতে চাইল ওর স্ত্রী।
‘হ্যাঁ, আর কোথাও ওই গাছ আছে?’ পালটা প্রশ্ন আনানসির।
তারপর, কণ্ঠ একই রকম দুর্বল রেখেই যোগ করল, ‘আরেকটা কথা দিতে হবে আমাকে। কথা দাও: আমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে, আমার কবরের পায়ের কাছে ছোট্ট করে আগুন জ্বালাবে। আমাকে ভুলে যাওনি প্রমাণ করার জন্য, ওই আগুনটাকে নিভতে দেবে না।’
‘অবশ্যই! অবশ্যই!’ বিলাপ করার ফাঁকে বলল আনানসির স্ত্রী ও ছেলেরা।
‘সেই আগুনে, তোমাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ, চড়াবে একটা ছোট্ট পাত্র; তাতে ভরবে লবণ-পানি। আমার মৃত্যুশয্যায় তোমরা যে উষ্ণ অশ্রু বিসর্জন করেছ, সেটার স্মৃতির উদ্দেশ্যে।’
‘অবশ্যই! অবশ্যই!’ কান্না থামল না আনানসির স্ত্রী-পুত্রদের। তারপর, দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা আনানসি, মুদল চোখ…
…তারপর আর শ্বাস নিলো না সে।
এরপর আরকী? আনানসির দেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মটরশুঁটির খেতের পাশের ব্রেডফ্লুট গাছের নিচে। ছয় ফুট মাটির নিচে কবর দেওয়া হলো তাকে, পায়ের কাছে জ্বালানো হলো একটা ছোট্ট আগুন। তার পাশে রেখে দেওয়া হলো একটা পাত্র, তাতে ঢালা হলো লবণ-পানি।
সারাদিন ঘাপটি মেরে কবরে শুয়ে রইল আনানসি। রাত নামলে বেরিয়ে এলো কবর থেকে। খেতে গিয়ে সবচাইতে মোটা, মিষ্টি আর পাকাগুলো তুলল খুঁজে খুঁজে। তারপর ওগুলোকে ফেলে দিল পাত্রে, সিদ্ধ হওয়ার জন্য। পেট ফুলে যাবার আগপর্যন্ত খেয়ে চলল সে, অচিরেই দেখা গেল— ড্রামের মতো হয়ে গেছে তার শরীর।
তারপর, ভোরের আগে-আগে, ফিরে গেল আবার কবরে। ঘুমিয়ে পড়ল ভরা পেট নিয়ে। সকাল বেলা যখন ওর স্ত্রী-পুত্র আবিষ্কার করল খেত থেকে মটরশুঁটি উধাও হয়ে গেছে, তখন সে গভীর ঘুমে। পাত্রে পানি নেই দেখে, সেটায় আবার লবণ-পানি ঢালল ওরা; বিলাপ করল। আনানসির তবুও ঘুম ডাঙল না।
প্রত্যেক রাতেই কবর থেকে চুরি করে বেরোল আনানসি। নিজের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে নিজেই নাচছে, আর মজা পাচ্ছে। প্রত্যেক রাতে মটরশুঁটি দিয়ে পাত্র ভরে, সিদ্ধ করে পেটে পুড়ে খেল। আর একটা মটরেরও জায়গা হবে না পেটে, সেই অবস্থা হওয়ার আগে থামল না।
দিন বয়ে যেতে লাগল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুকাতে লাগল আনানসির পরিবার। কেননা পাকা সব মটরই তো রাতে তুলে ফেলে আনানসি! তাই খাওয়ার মতো আর কিছুই পায় না বেচারারা।
আনানসির স্ত্রী তাকাল তাদের সামনে থাকা খালি খালার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেদেরকে বলল, ‘তোমার বাবা বেঁচে থাকলে এখন কী করত?
ছেলেরা ভাবল আর ডাবল। আনানসি তাদেরকে যত গল্প শুনিয়েছে, সব মনে করতে চাইল তারা। তারপর চলে গেল আলকাতরা যেখানে বিক্রি হয়, সেখানে। নিজেদের জন্য ছয় পেনি দামের আলকাতরা কিনল, চারটা বালতি ভরার জন্য যা যথেষ্ট। তারপর সেই বালতি ভরতি আলকাতরা নিয়ে ফিরে এলো মটরশুঁটির খেতের কাছে। ঠিক মাঝখানে একটা নকল মানুষ বানালো সবাই মিলে। ওটার চেহারা আলকাতরার, আলকাতরার চোখ, আলকাতরা হাত-বুক- আঙুল। দারুণ হলো তাদের কাজ, নিখাঁদ কালো মূর্তিটা দেখে মনে হলো যেন খোদ আনানসি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
সে রাতে, বুড়ো আনানসি, বেরিয়ে এলো কবর থেকে। জীবনে আগে কখনও এত মোটা ছিল না সে, পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নাচতে নাচতে এগিয়ে গেল মটরশুঁটির খেতের দিকে।
‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল আলকাতরা মানবকে।
কিন্তু আলকাতরা মানব সেই প্রশ্নের জবাব দিল না।
‘এটা আমার সম্পত্তি,’ আলকাতরা মানবকে বলল আনানসি। এই খেতও আমার। তুমি ভাগো, নইলে বলে দিচ্ছি— কপালে খারাবি আছে।’
আলকাতরা মানব কিছু বলল না, এমনকী একটা পেশিও নাড়ল না।
‘দুনিয়ায় যা কিছু আছে, আসবে বা এসেছিল… সবার চাইতে আমি বেশি শক্তিশালী, বেশি পরাক্রমশালী, সবচাইতে সাহসী, আলকাতরা-মানবকে বলল আনানসি। ‘আমি সিংহের চাইতে তেজি, চিতার চাইতে দ্রুত, হাতির চাইতে শক্তিশালী, হয়তো বাঘের চাইতেও ভয়ানক।’ নিজের তেজ, গতি, শক্তির গর্বে ফুলে উঠল তার বুক। ভুলেই গেল, আসলে ও ছোট্ট একটা মাকড়শা। ‘কাঁপো, হুঙ্কার ছাড়ল সে। ‘ভয়ে কেঁপে উঠে পালাও।
আলকাতরা-মানব, না ভয়ে কাঁপল; আর না পালাতে শুরু করল। সত্যি কথা বলতে কী, জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কেবল।
তাই সরাসরি তাকে ঘুসি মারল আনানসি।
কিন্তু ওর হাত ডেবে গেল আলকাতরায়, গেল আটকে।
‘ছাড়, ছাড় আমার হাত, আলকাতরা মানবকে বলল সে। ‘হাত ছেড়ে দে, নইলে পরের ঘুসিটা মুখে বসাবো।’
আলকাতরা-মানবের মুখে এখনও কোনো কথা নেই। এমনকী ছোট্ট একটা পেশিও নড়ালো না। আনানসি এবার সরাসরি ওর মুখে ঘুসি বসালো।
‘অনেক হয়েছে,’ বলল আনানসি। ‘অনেক হয়েছে ঠাট্টা। আমার হাত ধরে রাখতে চাও? রাখো। কিন্তু আরও চারটা হাত আছে আমার, আছে কর্মক্ষম দুটো পা। সবগুলো তো আর ধরতে পারবে না। ছেড়ে দাও, আমিও দয়া দেখাব।’
আলকাতরা মানব হাত ছাড়ল না, মুখেও কিছু বলল না। তাই একে- একে সবগুলো হাত দিয়ে ঘুসি মারল আনানসি, তারপর পা দিয়ে মারল লাখি।
‘হয় আমাকে যেতে দাও’ বলল আনানসি। নইলে কামড়ে দিব।’
ততক্ষণে আলকাতরায় ভরে গেছে ওর মুখ, নাক-কান, চেহারা!
পরেরদিন সকালে স্ত্রী-পুত্ররা ওভাবেই পেল আনানসিকে, মটরশুঁটির খেত আর ব্রেডফ্রুটের গাছের অবস্থা দেখতে এসে। আলকাতরা-মানব একেবারে আঁকড়ে ধরে আছে ওকে। এবার আসলেই মারা গেছে।
ওই অবস্থায় আনানসিকে আবিষ্কার করে অবাক হলো না তারা।
আগেরকার দিনে, আনানসিকে নিয়ে এমন অনেক গল্প প্রচলিত ছিল।