Accessibility Tools

আমি গাধা বলছি – কৃষণ চন্দর

আমি গাধা বলছি – ১১

এগার

ব্যাংকের একজন এসিন্টেট গিয়ে ম্যানেজারকে জানালো যে, তাঁর সাথে দেখ করার জন্য এক গাধা অপেক্ষা করছে। ম্যানেজার চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘গাধা? ব্যাংকে গাধার আবার কি কাজ?’

আমি ব্যাংকে পা দিতেই চারদিকে একটা হৈ চৈ পড়ে গেল। কেরানীরা হাতের কাজ রেখে চোখ ছানাবড়া করে আমাকে দেখছিল। শেঠ ভুসুরিমল সেসব উপেক্ষা করেই আমাকে নিয়ে সোজা ম্যানেজারের কামরাতে ঢুকে পড়ল।

‘এসব কি হচ্ছে?’ ম্যানেজার প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। শেঠকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ ‘জনাব এটা ব্যাংক, এটা আস্তাবল নয়।’ শেঠ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

‘ম্যানেজার সাহেব, বিপদ তো এখানেই যে, যারা থাকবে ব্যাংকে তাদেরকে আস্তাবলে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, আর যারা থাকবে আস্তাবলে তারাই আজ ব্যাংকের চেয়ার দখল করে আছেন।’

ম্যানেজার আমাকে কথা বলতে দেখে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। গাধা, এই আমার মস্তবড় পরিচয়, আমি আপনার ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে চাই।’

আমার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার, মানে আপনার পরিচয়?’ ‘গাধাদের আবার পরিচয় কি? তবে আমি আপনার সময় নষ্ট করব না। আমি

‘আমাদের এখানে গাধাদের একাউন্ট খোলার কোন বন্দোবস্ত নেই।’ ‘বন্দোবস্ত করে নিলেই হয়। আমি নগদ টাকা নিয়ে এসেছি। ব্যাংকের যাবতীয় ফর্মালিটিজ মেনে চলতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

‘না, তা হয় না। আপনি যদি মানুষ হতেন তবে এক কথা ছিল।’

‘এটা কি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন যে, আপনার কাছে যারা আসে তারা সবাই মানুষ। আমি অনেক মানুষকে পশুদের চেয়েও নিকৃষ্টভাবে জীবন যাপন করতে দেখেছি। আপনার এই অফিসেই এমন সব মানুষ আছে যাদের তুলনায় পশুজাত অনেকাংশে শ্রেয়।’

‘আমাকে ক্ষমা করবেন। এ ব্যাংকে কোন চতুষ্পদ জন্তু বা পশু পাখি একাউন্ট খুলতে পারে না।’

‘পশু আর মানুষের মধ্যে প্রভেদ কি? যে কথা বলে সেই তো মানুষ। আমি যখন কথা বলতে পারছি, আমাকেও মানুষ বলতে পারেন আপনি।’

‘দয়া করে তর্ক করে বৃথা সময় নষ্ট করবেন না। পশুদের কোন একাউন্ট হয় না এখানে, এর বেশি আমি আর কিছুই বলতে পারিনা।’

‘ঠিক আছে তাহলে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিবেন কি?’ ‘বলুন।’

‘এই যে এতলোক আপনার ব্যাংকে টাকা জমা দিতে আসে তাদেরকে আপনি কি দেন?’

‘তাদেরকে দেব আবার কি, বরং আমরা সুদ নিয়ে থাকি তাদের কাছ থেকে।’

‘তার মানে হচ্ছে আমাদের টাকাও আপনার কাছে থাকবে আর সুদও আমরাই দেব, বেশ তো।’

‘আপনি যদি সেভিংস বা ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা রাখেন তখন আমরাই আপনাদেরকে আবার সুদ দেই।’

‘আপনিই বা আমাকে সুদ দিতে যাবেন কেন? আমার টাকা আপনার কাছে বসে বসে ডিম পাড়ে নাকি?’

ম্যানেজার উঠে বললেন,

‘মশাই, আসল কথা হচ্ছে একজন দু’জন করে এই যে এত লোকের টাকা জমা হয়ে লাখ লাখ টাকা হচ্ছে আমরা সে টাকা বড় বড় শিল্প কারখানায় খাটাই এবং তা দিয়ে নানা কায়-কারবার করি। তা থেকে ব্যাংক প্রতি বছর লাখো লাখো টাকা আয় করে থাকে।’

‘তার মানে হচ্ছে, গবী বেচারীরা তাদের কষ্টার্জিত পুঁজি এনে এখানে জমা রাখে আর তা দিয়ে আপনারা নাড়া-চাড়া করে বেশ দু’পয়সা কামিয়ে নিচ্ছেন, এই না?’

‘হ্যাঁ—অনেকটা তাই।’

‘তাই যদি হয়, এখানে গাধাদের একাউন্ট খুলতে বাধা কি?’ ‘আপনি দেখছি বড্ড রসিক।’

‘গবীদের রসিকতাই তো বড় সম্বল। দুঃখ বিষাদকে হেসে উড়িয়ে না দিতে পারলে তাদের বাঁচবার উপায় আছে? আচ্ছা ম্যানেজার সাহেব, মনে কিছু করবেন না। আপনাকে বিরক্ত করলাম। এখন আসি।’

বলেই আমি ম্যানেজার-এর কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি বাইরে চলে এলে শেঠ ভুসুরিমল ম্যানেজারকে বলল, ‘তুমি বড্ড ভুল করেছ দয়ালুরাম। এ গাধা ত্রিশ লাখ টাকা জমা করতে এসেছিল।

‘ত্রিশ লাখ? ম্যানেজার একেবারে আকাশ থেকে পড়ল

। ম্যানেজার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল।

‘গাধাটা গেল কোথায়?’ বলেই ম্যানেজার দৌড়াতে

ম্যানেজারকে দৌড়াতে দেখে ব্যাংকময় একটা হৈ চৈ পড়ে গেল

‘আরে ও গাধা, মানে জনাব গাধা সাহেব, দয়া করে একটু দাঁড়ান। স্যার, একটু কথা শুনে যান।’

আমি পেছন ফিরে দেখলাম ম্যানেজার দৌড়ে আসছে।

‘কি ব্যাপার, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?’

দৌড়াতে চলে এলো।।

ম্যানেজার আমার রশিটা হাতে নিয়ে অত্যন্ত বিনীত হয়ে

বললেন,

‘আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে স্যার। চলুন আপনি ফিরে চলুন। আপনার একাউন্ট খুলতে আমাদের কোন বাধা নেই।

‘কিন্তু আমি যে এক গাধা।’

‘আপনি গাধা হোন আর যাই হোন, কোন আপত্তি নেই আমাদের। চলুন ভেতরে চলুন।’

ম্যানেজার প্রায় পা ছুঁয়ে সালাম করলেন আমার। কামরায় ঢুকেই ঘন ঘন বেল বাজালেন।

‘একাউন্ট ফরম আনো, সই ফরম আনো, পাসবুক ফরম আনো। আর হ্যাঁ আপনি ত্রিশ লাখ টাকাই কি জমা করবেন স্যার?’ বলতে বলতে ম্যানেজার হাঁফিয়ে উঠলেন।

আমি সংক্ষেপে বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে এক কাজ করুন। বিশ লাখ ফিক্সড ডিপোজিট, পাঁচ লাখ সেভিংসে আর পাঁচ রাখ জেনারেল একাউন্টে রাখুন’।

‘না, আমি একুশ লাখ রাখব ফিক্সড ডিপোজিটে, চার লাখ জেনারেল একাউন্টে।’

‘বিশ লাখ না রেখে একুশ লাখ কেন?’ শেঠ জিজ্ঞেস করল।

‘একুশ লাখ গুরুর জন্যে রাখতে চাই। টাকাটা জমা না করে,। হিমালয়ে যাই।’ কি করে আমি

কৈলাস পর্বতের গুরুর কথা মনে পড়তেই শেঠজি চুপসে গেল। ম্যানেজার আমার সামনে ফরম এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘নিন, সই করুন।’

‘আমি সইতো জানি না, গাধারাতো লিখতে জানে না।’

‘ঠিক আছে তাতে কিছু আসে যায় না, টিপ সহি দিলেও চলবে।’

‘টিপ সইও তো দিতে পারব না, আমার কোন আঙ্গুল নেই। পায়ের ছাপ ছাড়া

সই করার মত আমার আর কোন যোগ্যতা নেই।’

‘তাতেও চলে যাবে। ত্রিশ লাখ টাকার জন্যে পায়ের ছাপ কেন, লেজের ছাপ দিলেও চলবে।’ বলেই ফরমটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘নিন পায়ের ছাপ দিন।’

‘শেঠ ভুসুরিমল বলল, ‘একটু থামুন গুরু।’

‘কেন?’

আমার কথার উত্তর না দিয়ে সে ম্যানেজারকে বলল,

‘এ টাকার জন্য ওভার ড্রাফট কত পাবো?

‘ওভার ড্রাফট আবার কি?’ আমি বললাম।

‘শেঠ আমাকে ওভার ড্রাফট সম্পর্কে বুঝিয়ে বলল :

‘ওভার ড্রাফট হলো আপনার একাউন্ট আছে, প্রয়োজন বোধে আপনার জমাকৃত টাকার চেয়েও বেশি টাকা তুলতে পারেন।’ ম্যানেজার বললেন,

‘এক লাখ টাকা পর্যন্ত ওভার ড্রাফট দিতে

পারবো আমি।’

‘না, দু’লাখ দিতে হবে।’ শেঠ বলল।

‘ঠিক আছে, দু’লাখই দেব। ঝটপট আপনি সইটা মানে পায়ের ছাপটা দিয়ে ফেলুন। আমি যখন বিভিন্ন ফরমে পায়ের ছাপ দিচ্ছিলাম এমন সময় একজন গো’বেচারী ধরনের লোক এসে ম্যানেজারকে অনুনয় করে বলতে লাগল,

‘ম্যানেজার সাহেব, আমার স্ত্রীর অবস্থা মরণাপন্ন। ঔষধ কেনার জন্যে দেড়শ টাকার দরকার। আমার একাউন্টে আছে মাত্র পঞ্চাশ টাকা, দয়া করে আমাকে দেড়শত টাকার বন্দোবস্ত করে দিন। এ যাত্রা আমাকে বাঁচান। দু’দিন পর যখন বেতন পাব টাকাটা তখন পরিশোধ করে দেবো।’

‘ব্যাংক আপনাকে ওভার ড্রাফট দেবে এমন কথা বলেছে?’

‘না। কিন্তু আমার স্ত্রীর যে কঠিন অসুখ। ওষুধ না কিনতে পারলে মরেই যাবে, দয়া করে …

‘না, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারি ľ

এ কথা শুনে লোকটি কাঁদ কাঁদ হয়ে বেরিয়ে গেল। আমি ম্যানেজারকে বললাম, ‘বিশ লাখ টাকা জমা দিচ্ছি বলে এক গাধা দু’লাখ টাকা ওভার ড্রাফট পাচ্ছে আর একজনের বউ মারা যাচ্ছে তাকে আপনি একশ’টাকা দিতে পারলেন না। এটাকে আপনি মানুষের ব্যাংক বলতে চান?’

ম্যানেজার কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় দরজা ঠেলে আবার একজন লোক ঢুকল। গায়ে বাদামী রং-এর কামিজ। পরনে সাদা প্যান্ট আর পায়ে পেশোয়ারী চপ্পল। লোকটির হাতে একখানা চেক। সে ম্যানেজারকে উদ্দেশ্যে করে বলল,।

‘কাটাকাট ফিল্ম কোম্পানি আমাকে দেড়’শ টাকার চেকটা দিয়েছে অথচ ক্লার্ক বলছে একাউন্টে নাকি মাত্র একশ চল্লিশ টাকা আছে।’

‘একশ চল্লিশ টাকা আছে তো আমি কি করব?’ ম্যানেজার বলল।

‘আপনি এক কাজ করুন, কাটাকাট ফিল্ম-এর একাউন্টে আমার কাছ থেকে দশ টাকা নিয়ে ফটাফট আমার চেকটা ক্যাশ করে দিন। আমার টাকা যায় যাক, একশ চল্লিশ টাকাতো উসুল হয়ে যাচ্ছে।’ ম্যানেজার বলেন, ‘ও কে।’

আমি লোকটির চালাকীতে মুগ্ধ হয়ে ম্যানেজারকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম। ম্যানেজার বললেন, ‘ইনি হলেন দাদা ধূমল। কাটাকাট ফিল্ম কোম্পানির ডিরেক্টর।’

একথা বলেই তিনি আমাকে চেকবুক ইত্যাদি বুঝিয়ে দিয়ে বললেন,

‘নিন, আপনার ব্যাপার চুকে গেল। বলেন আর কি করতে পারি আপনার

জন্যে?’

‘এখন আমি একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারি?’ ‘আলবত—একশ’বার। যত টাকা ইচ্ছে তুলতে পারেন।’ ‘শুধু পায়ের ছাপ দিয়েই চেক কাটতে পারব?’ ‘আলবত–আপনার ছাপকেই আপনার সই মনে করা হবে।’ ‘বেশ।’

তারপর শেঠকে বললাম,

‘শেঠ, এক লাখ টাকার একটা চেক কেটে দাও আমি পায়ের ছাপ দিয়ে দিচ্ছি।

এক লাখ টাকা নিয়ে বাইরে এলে শেঠ আমাকে বলল, ‘এ টাকা দিয়ে কি হবে গুরু?’

‘বেশি ববক্ করো না বলছি। ঐ মোড়ের জেনারেল স্টোরে গিয়ে একটা টাকার থলে কিনে এনে তাতে টাকাগুলো রেখে আমার গলায় ঝুলিয়ে দাও।’ শেঠ কোন কথা বলতে না পেরে গজর গজর করে বলতে লাগল, ‘শেষকালে গাধাটার মাথা খারাপ হয়েছে দেখছি।’

‘শেঠ মনে করেছে আমি শুনি নি। মনে মনে বললাম, ‘আচ্ছা, তোকেও জ্ঞান দান করতে হবে দেখছি।’

যখন শেঠ মোড়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল, কে যেন ডাক দিল ‘শেঠ’। আমি চারদিকে তাকিয়ে কাউকেই দেখলাম না। আবার কে যেন বলল, ‘‘শেঠ, আমি তোমাকেই ডাকছি শেঠ ৷’

এবার চেয়ে দেখলাম দাদা ধূমল আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘শেঠ আইসক্রীম খাবে?’

‘না।’

‘জিলিপি খাবে?’

‘না।’

‘চমৎকার সাচিপান খাবে?’

‘না, কিছুই খাব না। কেন, কি জন্য তোষামোদ করছ খুলেই বলো না।’ ‘তোষামোদ আমি আমার বাবাকেও করি না। কিন্তু তোমাকে একটা মজার কথা শুনাব। একটু এদিকে কোণের দিকে এসো।”

আমি তাকে অনুসরণ করে এক কোণের দিকে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরে সে আমার সাথে ফিফাস করছিল। শেঠকে আসতে দেখে হঠাৎ আবার দেখা হবে

বলে কেটে পড়ল সে। শেঠ তাকে চলে যেতে দেখল না। আমার সাথে কথা বলতেও দেখল না। শেঠ থলেতে টাকাগুলো গুনে থলে ভর্তি করে আমার গলায় বেঁধে দিল। তারপর আমার পা ছুঁয়ে হাত জোড় করে বলল,

‘গুরু মহারাজ—এখন কবে নাগাদ আপনি হিমালয় রওয়ানা হবেন?’ টাকাগুলো আমার গলায় বেঁধে দিতেই আমার সারাদেহ শক্তি সাহসে টগবগ করে উঠল। শিরা-উপশিরায় যেন রক্তপ্রবাহ ছুটে সারা দেহমন এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে উজ্জীবিত হয়ে উঠল। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,

‘বোকা কোথাকার, হিমালয় যাব মরতে?’ ‘কেন কৈলাস গুরুর চাঁদা আর …’ ‘কৈলাস গুরুর ভক্তি ভজন সব এখন বোম্বেতেই হবে।’ ‘তার মানে?’

‘তার মানে একটা ফিল্ম কোম্পানি খোলা হবে।’