উড়াল – ১৫
পনেরো – মালবিকার ডায়েরি
আজকাল নানারকমের গল্প বলে টুবলু। সেদিন বলল, ”আমি একটা বিরাট মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। যাচ্ছি, যাচ্ছি, উটের পিঠে চড়ে। উট চলেছে মুখটি তুলে। চারিদিকে ধু ধু বালির সমুদ্র—শেষকালে একটু জল দেখা গেল, কাছেই একটা লেক—ও মা। যতই কাছে যাচ্ছি, লেকটা ততই দূরে সরে যাচ্ছে, কী মুশকিল! এদিকে রোদে আমরা ক্লান্ত, ভীষণ তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে। বোতলে একটুও জল নেই। কী করি? ওই লেকটা আসলে জলই নয়, রোদ্দুর পড়ে ঝকঝক করছে বালি। যেই জানতে পারলুম ওটা চোখের ভুল, ওটা একটা মিরাজ—মালু, মিরাজ—এর বেঙ্গলি কী?”
—”মরীচিকা।”
—”যেই জানা হয়ে গেল ওটা জল নয়, মরী—চিক্কা, অমনি আমাদের ক্যারাভানসুদ্ধু মানুষের মুখ শুকনো—ভীষণ কষ্ট হচ্ছে—ইটস সো হট—উই আর থার্সটি—”
—”থাক, থাক, ও গল্পটা আর শুনে কাজ নেই টুবলুসোনা, ওটা খুব ক্রুয়েল গল্প—কে তোমাকে মিরাজ—এর কথা বলল?”
—”ড্যাড! আমরা টিভতে দেখছিলাম। ভেরি বিউটিফুল। সোনালি বালি, সোনালি আকাশ দিয়ে সারি সারি ক্যারাভ্যান যাচ্ছিল—তখনই তো ওয়েসিস দেখলাম, পামট্রি দিয়ে ঘেরা। মিরাজও দেখলাম—মালু, ঘুম পাচ্ছে—আমি একটু ঘুমোই?”… টুবলু আমার একটা আঙুল চেপে ধরেছে।
—”ঘুমোও, ঘুমোও ডার্লিং। আমি বসে আছি তোমার কাছে—”
আঙুলটা ধরে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা, মুহূর্তের মধ্যে। প্রচণ্ড ক্লান্তি সর্ব শরীরে। আর বেশিদিন কষ্ট পেতে হবে না ওকে। বুঝতেই পারছি, নিবে আসছে। জ্বল ছাড়ছে না। জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ওর মায়ের মতো ওরও শেষ পর্যন্ত সেই মালটিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকুলোসিস—থার্ড লাইন, ফোর্থ লাইন, কোনোরকম অলটারনেটিভ ড্রাগই চলছে না। হাসপাতালে, অধিকাংশ এইডস রোগীই শেষ পর্যন্ত এই রোগে যাচ্ছে। শেষটা সামলানো যাচ্ছে না। আগে ছিল প্রধানত নিউমোনিয়া—যাতে শেষ দরজাটা বন্ধ হয়ে যেত। এখন হয়েছে এই এম.ডি.আর.টি.বি—র ধাক্কা।
এবারে নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলতেই হবে। টুবলু তো কবে থেকেই তৈরি হয়ে আছে।
পাশ ফিরে শুয়েছে।
পিঠের ওপাশে আপনা—আপনি খচমচ করে ভাঁজ হয়ে গেল ডানা জোড়া। এখন তো পাশ ফিরে ছাড়া শুতেই পারে না ওই ডানার জন্যে।
ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমায় আঙুলটা এখনও ওর ছোট্ট মুঠোর মধ্যে আঁকড়ে—ধরা।
এমন করে ধরে রাখতে কি পারবি তুই আমাদের, টুবলুসোনা? না আমরাই পারবো তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে? এমনকি বিমলদাও?
.
কেতকী, তোমার মেয়ে এখন ছায়াময় ওয়েসিস—এর কাছে—আর মিরাজ নয়, সব মিরাজ পার হয়ে গেছে। ক্যারাভ্যান এবার থামবে। সামনেই সরোবর।
সেই মরু—উদ্যানে কি তুমি রয়েছো কেতকী?