ছোটবাবুর জমিদারী পরিদর্শন – নবনীতা দেবসেন
ছোটবাবুর জমিদারী পরিদর্শন
খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে ঠাকুদ্দা বললেন, ”হাঁপানিয়া গ্রামে একটা ইশকুল করে দিয়েছি, সেটার উদ্বোধন হচ্ছে রোববার—আমি যেতে পারছি না, তোমার বাবাও যেতে পারছেন না, বাড়ি থেকে তো কাউকে একবার যেতে হয়। খোকা, তুমি আজ বাদে কাল কলেজে পড়বে, আমার ইচ্ছে তুমি যাও। একটু একটু করে বেরুতে থাকো, জমিদারীগুলো তো চিনে—টিনেও নেওয়া দরকার।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বসে রয়েছি। মন দিয়ে ”স্বাধীনতা” পড়ি আর ”সোভিয়েত দেশ” পড়ি। বাড়িতে নয় মেজ জামাইবাবুর বাড়িতে। ”কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো”টা পড়া হয়ে গেছে, কিন্তু ”ডাস ক্যাপিটাল”টা কিছুতেই শেষ করতে পারছি না। ঠাকুদ্দার কথায় উৎসাহিত হয়ে উঠলুম। গ্রাম—ট্রামে আমাদের যাওয়াই হয় না একেবারে—জমিদারী—টারি দেখাশুনো করা দূরে থাক। সঙ্গে সঙ্গেই মা অ্যাটাচিকেস গুছিয়ে দিলেন।
শনিবার সকালে আমীনবাবু এসে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। রবিবার মিটিং করে ফিরব। ট্রেন যখন মাঝে একটা স্টেশন দাঁড়িয়েছে, আমীনবাবু ব্যস্ত হয়ে দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা ঝাঁকায় করে কয়েক হাঁড়ি মিষ্টি উঠল গাড়িতে। আমীনবাবু একটি হাঁড়ি খুলে মিষ্টির সাইজটা পরীক্ষা করে নিলেন, তারপর ময়রা নেমে গেল। আহা কী অপরূপ সেই মিষ্টান্নের চেহারা। আমার তো বেজায় লোভ হয়ে গেল। কিন্তু আমি যে হচ্ছি ছোটদাদাবাবু, আমীনবাবুর সামনে আমার লোভটা প্রকাশ করা মানায় না। আমীন বুড়ো মানুষ। তাঁর অনেক ছোট ছেলে দেখা আছে। আমীন মিষ্টি হেসে বললেন—”আজ থাক? কালকে খাবে’খন। এখনও রস ঢোকেনি” একটু লজ্জা পেয়ে, তাড়াতাড়ি কোলে ”সোভিয়েত দেশ” পত্রিকা খুলে বসি। সুন্দর করে মেঠাইতে গোলাপজল ছিটিয়েছে। সুগন্ধে সারা কামরা ‘ম’ ‘ম’ করছে। রস ঢুকছে। ঢুকুক রসটা।
পূর্বস্থলী নামে একটি স্টেশনে আমীনবাবু মিষ্টির ঝাঁকাটি নামালেন, খোকাবাবুকেও। স্টেশনে গাড়ি আসার কথা গ্রাম থেকে। হাঁপানিয়া এখান থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। একটা ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন রোগামতন লোক। আমীনবাবুকে দুজনেই পেন্নাম করল খুব খাতির করে। আমীন আমাকে দেখিয়ে দিলেন—’ইনিই এসেছেন জমিদারমশায়ের প্রতিনিধি, তাঁর সাক্ষাৎ নাতি। বাপ—ঠাকুদ্দার জমিদারীর খোঁজখবর নেয়া এখন থেকেই শুরু করা দরকার।”—শুনে রোগা লোক আর ছোকরা আমাকে ভক্তিসহকারে ‘শতকোটি প্রণাম’ জানাল পা ছুঁয়ে। আমি তো লাফিয়ে সরে আসি। রোগা লোকটার সব চুল প্রায় পাকা। আমাকে প্রণাম করবে কি? আমীন বললেন, ‘জগু, গাড়োয়ান কই?”
লোকটা তখন আঙুল দিয়ে ছোকরাকে দেখিয়ে দিল। ছোকরাকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করে আমীনবাবু বললে, ”এ তো কচি ছেলে। এ পারবে? দশ মাইল আমাদের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে?” ছেলে তখন মন দিয়ে নাক খুঁটছিল—সে—কর্ম ছেড়ে, ঘাড় কাৎ করে, ধবধবে হেসে বললে—”হিঁ কত্তা। খুব পারব।” প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে দেখা গেল বিছানা পাতা, ছই ঢাকা দেয়া চমৎকার গরুর গাড়ি নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট দুটি বলদ দাঁড়িয়ে আছে। গাড়োয়ানের খুব পৈটিক গোলযোগ তা সেই ছেলেকে পাঠিয়েছে। ছেলেটার পরনে ফর্সা গেঞ্জি আর খাটো ধুতি। আমি পরে আছি নীল শার্ট আর সাদা প্যান্ট। শহরে অতটুকু ছেলেরা ধুতি পরে না। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে ধুতি শার্ট পরার রেওয়াজ ছিল যুবকদের। পাঞ্জাবি পরাটা বেশি সাজগোজ করা হয়ে যেত, বিয়েবাড়ির যোগ্য। অন্যান্য অনুষ্ঠানে ধুতি—শার্ট। সেই ফ্যাশানটাই হেমন্ত, দ্বিজেন, সাগর, সুবীরের মধ্যে দেখা গেছে। কালকের উদ্বোধনীতে পরবার জন্যে বাক্সে আছে ঘি—রঙের সিল্কের শার্ট আর সোনার বোতাম। এ ধুতি পরা ছোকরার বয়েস আমার থেকে কম। ছোকরা আর জগুকে নিয়ে মিষ্টির ঝাঁকা গাড়িতে তুলে, রওনা দিলুম হাঁপানিয়া গ্রামের দিকে। শীতের বেলা বুঝি এখনই পড়ে এসেছে। কাল সকালে সুধারানী মেমোরিয়াল গার্লস প্রাইমারি ও জুনিয়ার স্কুল খোলা হবে। ঠাকুদ্দা বলেছেন তিন বছরের মধ্যে হাইস্কুল করে দেবেন।
গাড়ি চলতে চলতে একটা বাঁক নিল। আমীনবাবু আর জগু দুজনেই হাঁহাঁ করে উঠলেন, ”এ কী? এটা আবার কোন রাস্তা?” ছোকরা বললে, ”শটকাট পথ।” জগু বললে, ”কিন্তু এই পথটা যে একদম ভালো নয় রে। বড্ডো এবড়ো—খেবড়ো হয়ে রয়েছে। সাইকেল পর্যন্ত চালাতে পারি না এটাতে। ঘুর হয় হোক তুই বড় রাস্তা দিয়ে চল। এ পথে অত ঝাঁকুনিতে ছোটবাবুর হাড়পাঁজরা ঝরঝর করবে, গায়ে বেদনা হয়ে যাবে।” শুনেই আমার গায়ে ব্যথা হবার যোগাড়। কিন্তু গাড়ি আর বাঁকানো গেল না। ছোকরা গাড়োয়ানটি অতি অবাধ্য। সে কারুর কথাই শুনলে না। ওই শর্টকাটেই চলল। ”বাবা বলে দিয়েচে, এই রাস্তা ভাল”—তার মুখে এই এক বাক্যি। পথের মধ্যে বড় বড় গর্ত উঁচু—নিচু খাদ—খোন্দল, যেন মধ্যপ্রদেশের সেই বেহড়ের মিনি সংস্করণ। দুপাশে বড় বড় ঘাসের বন। নাকি নলখাগড়া একেই বলে? কে জানে। জগুর মুখে আর বাক্যি নেই, সে চুপচাপ ছোকরার পাশে বসে আছে। যে—সে রাস্তা তো নয়, যেন চন্দ্রগ্রহের রাস্তা। তখনও অবশ্য চাঁদে মানুষ যায়নি, চাঁদ কেমন দেখতে আমরা জানি না। এখন ভাবতে গেলে মনে হচ্ছে। ভয়ংকর বন্ধুর পথে, গাড়ি টালমাটাল হয়ে চলল। মাঝে মাঝে আমরা আর আমীনবাবুর মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে। গর্তে ভরা, কত উপত্যকা, কত মালভূমি। আমাদের গরুরা তার ওপর দিয়ে সার্কাসের কসরৎ করতে করতে চলেছে। আর আমীনবাবু সমানেই বিড়বিড় করে গাল দিয়ে চলেছেন।
বিড়বিড়টা চীৎকারে পরিণত হলো যখন হঠাৎ একটা বিশাল টাল খেয়ে গাড়িটা উলটে পড়ল ঘাসবনের ভেতরে, ঝপাৎ করে জল—কাদার মধ্যে। মহাভাগ্যি আমার, আমি পড়লুম রাস্তার ওপর, শুকনো ডাঙাতে। জগু, সেই রোগা লোকটি আর আমীনবাবু ঘাসবনে। ঘাসবন এতই ঘন যে গাড়ি তাতে আটকে রইল। ওঁরাও। গাড়োয়ান ছোকরার কী হলো কে জানে। সে ছুটে পালাল, আর সঙ্গে সঙ্গে দড়িদড়া ছিঁড়ে পালিয়ে গেল বলদ দুটোও। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। আমার সর্বাঙ্গে এখন গোলাপজলের গন্ধ, গায়ে মাথায় রস চটচট করছে। আমার চারিদিকে সেই সমস্ত বড় বড়, চমৎকার, অতি লোভনীয়, গজমোতির মতন মেঠাই ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ট্রেনে আমার অত ইচ্ছে করেছিল খেতে, তখন কেন যে আমীনবাবু খেতে দিলেন না। আহা, এখন তো সবটাই নষ্ট।
জগু নামে রোগা লোকটাই আগে উঠল, তারপর আমীনবাবুকে তৃণশয্যা থেকে উৎপাটন করল। গা ঝেড়েঝুড়ে আমার কাছে এসে আমার অবস্থা ভাল করে নিরীক্ষণ করে আমীনবাবু বললেন, ”শীতকাল। সন্ধ্যাবেলায় তো ডোবার জলে খোকাবাবুর চান করা চলবে না। দেখি যদি ভিজে গামছা দিয়ে ভাল করে রগড়ে রগড়ে গা মুছিয়ে দিলে রসটা ওঠে। নইলে তো পিঁপড়েতে ছিঁড়ে ফেলবে। এখেনে আবার কাঠপিঁপড়ের রাজত্ব।” একেই আমার সারা গায়ে রসে চিটচিটে, তার চতুর্দিকে ভাল ভাল রাজভোগ গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং আমাদের গাড়ি দয়ে পড়েছে, গাড়োয়ানও নেই, বলদও নেই। এর মধ্যে লাল পিঁপড়ে? হা ভগবান। এখন কী হবে? আমীনবাবু কাছাকোঁচা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন লোকের খোঁজে সেই রোগা লোকটার সঙ্গে।
একটু পরে লোকজন এবং আরেকটা গরুর গাড়ি নিয়ে ওঁরা ফিরলেন। গ্রামে বিরাট সম্বর্ধনা অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ছোটবাবুর রসালো মূর্তি দেখে সবাই ঘাবড়ে গেল। ততক্ষণে রসটি শুকিয়ে চুল সব খোঁচা খোঁচা। আমি তো এদিকে পিঁপড়ের ভয়ে মরছি। ”যা থাকে কপালে” বলে ডোবার মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়লুম। ”শীতের সন্ধ্যে” বললে তো কাঠপিঁপড়ে শুনবে না। ওফ! হাড় হিমকরা ঠাণ্ডা জল। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এসে দেখি মস্ত এক গেলাস গরম দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আমীনবাবু। ”ছোটবাবুর” স্বাস্থ্য তাঁর জিম্মায়। আমীনবাবুর ভিজে গামছার সাজেশন আমি গ্রহণ করলাম না বলে তিনি ক্ষুণ্ণ এবং উদ্বিগ্ন। গরম দুধের পরে এবার তো ভাত খেতে বসতে হবে। স্কুলের হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আমরা উঠেছি, কিন্তু সেখানে ভাত খাওয়া হবে না। কেননা তিনি অব্রাহ্মণ। আমীনবাবু আমার ভাত খাবার ব্যবস্থা করেছেন এক বামুনবাড়িতে। তখন ভারত স্বাধীন হয়েছে। তবুও বাংলার গ্রামে এরকম কানুন চলত। আমি নেহাৎ ছেলেমানুষ নই কিন্তু জমিদারের নাতি বলে কথা! তাই আমাকে আতপ চাল, আর কাঁচা আনাজ ধরে দিয়ে ঠাকুর, স্বপাকে অন্ন রেঁধে নিন”, বলতে পারছে না প্রজারা।
বামুনবাড়িটি মাটির, কিন্তু পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। দাওয়ায় সুন্দর করে একটি কার্পেটের কাজকরা আসন পেতে, একলা আমাকে সোনার মতন ঝকঝকে কাঁসার থালাতে বামুনগিন্নি ভাত বেড়ে দিলেন। এদিকে ডোবায় চান করে গায়ের রসে টইটম্বুর ভাবটা কমে গেলেও, শীতের দিব্যি কাঁপুনি লাগছে, গরম দুধেও কমেনি, শালমুড়ি দিয়েও কমছে না। গরম গরম ভাতে ঘি, সাতরকম ভাজা, আর গোল করে থালার ধারে বাটির সারি তাতে সব তরিতরকারি। একটা মস্ত বড় বাটি থেকে মনে হলো যেন দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বেশ সকাতর, করুণ চাউনি। নিশ্চয় মনের ভুল। আঁধার নেমে গেছে, শীতের রাত, দাওয়ায় লণ্ঠন জ্বলছে, তার আবছায়া, গা—ছমছমে আলোর মধ্যে নিশ্চয় ভুলভাল দেখছি। ডোবার জলে ঠাণ্ডা লেগে জ্বরটর এসে গেল না তো? জ্বরে লোকে প্রলাপ বকে। প্রলাপ দ্যাখেও কি? যতবার ভাবি আর তাকাবো না, ঠিক ততবারই ওই বাটিটার দিকে চোখ চলে যায়। আর দুটি কাতর চোখের প্রার্থনা নজরে আসে। শেষে মনে হলে এটা ভুল হতে পারে না।
—”ওই বাটিতে যেন দুটো চোখের মতন কী যেন?”
—”ওঃ ওই চোখ? ও তো পাঁঠার মুড়োর। পাঁঠার মুড়ো চমৎকার রান্না করেন যে আপনাদের বামুনজেঠিমা। খেয়ে দেখবেন, ভালো লাগবে।”
ওরে বাবা! পাঁঠার চোখ? আর সেই পাঁঠা আমাকে সামনে বলছে—”ওগো, আমাকে খেয়ো না, আমাকে ছেড়ে দাও।” ওই বাটি আমি ছুঁলুম না, আর অন্যান্য বাটিও প্রায় না ছুঁয়েই খাওয়া সেরে উঠে পড়লুম, চমৎকার ক্ষীর আর পাটালি দিয়ে খাওয়া শেষ করে। বামুন আর বামুনগিন্নি খুব দুঃখিত। শহরের ছেলেরা কিছুই খায় না। ওদের পেট এইটুকুনি। যেন চড়াইপাখির পেট। হতো একটা গ্রামের ছেলে, ঠিক ওই বয়সের? দেখিয়ে দিত, খাওয়া কাকে বলে। আমিও দেখিয়ে দিতে পারতুম, তবে ওই দুটি চোখকে নয়।
এদিকে আমীনবাবু পথ থেকে কুড়িয়ে সবকটা মিষ্টি তুলে এনেছেন। তারপর সেগুলো ভলো করে মুছে, ঝেড়ে, তাতে বেশ করে খোয়া ক্ষীরের গুঁড়ো মাখানো হয়েছে। পরদিন সকালে ইস্কুলের উদ্বোধনে ওই মেঠাই বিলি হবে। শুনে তো আমি হাঁ হাঁ করে আছড়ে পড়ি। ও কী কথা? ও কী কথা? সে কখনো হয়? যেই না বলা, অমনি আমীনবাবু খেপে লাল—”ছোটবাবু, সবকথায় কথা বলতে হয় না। তোমাদের হাতে পড়লে জমিদারী আর টিকবে না। সব উড়ে—পুড়ে যাবে। সম্পত্তি রাখা তোমার কম্মো নয়। পঞ্চাশ টাকার মিষ্টি। সব ফেলে দেবো? আমি কি পাগল হয়েছি না আমি বেইমান?”
সকালে উঠে দেখি সেই গাড়োয়ানের ছেলেটা, যে গাড়ি উলটে দিয়ে পালিয়েছিল, বিশাল এক গেলাস দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে করে নিয়ে দেখি গেলাসটা ঠাণ্ডা। মুখে দিয়ে দেখি ব্যাপারটা দুধ না তালের রস। মানে তাল গাছের রস। যেমন খেজুরের রস হয় রোজ সকালে এখানে টাটকা তালের রস খাওয়া অভ্যেস। একটু বেলা পড়লেই সেটা আর রস থাকে না, তাড়ি হয়ে যায়। এরকম খেজুর রস খাবার কথা জানতুম। তালের রস খেয়ে দেখলুম চমৎকার খেতে। গ্রামে বাথরুমের বালাই নেই। ছোকরা আমার সঙ্গে চলল মাঠে, পেতলের গাড়ু করে জল নিয়ে। এক জায়গায় একটা গাছের কাছে এসে বললে—”ছোটবাবু। এই যে, আমরা ব্যাটাছেলেরা এখন যাব ডানদিকে। আর ওই বাঁদিকে মেয়েছেলেরা মাঠে যায়।” শুনেই তো আমার হয়ে গেল। ডাইনে—বাঁয়ে কোনোদিকেই না গিয়ে ”থাক। আজ আমার দরকার নেই” বলে আবার সোজা পালিয়ে এলুম। সেখানে এলো লুচি হালুয়া। এটা নাকি খেতে পারি। অন্নটা শুধু ব্রাহ্মণবাড়িতে। তারপর এক গেলাস চা নিয়ে আমি বসে আছি, রোদে পা ছড়িয়ে, একটিমাত্র আরামকেদারায়। কে যেন আমার পায়ের কাছে একটা খালি থালা রেখে গেল। তাতে কিন্তু খাবার—দাবার কিচ্ছু নেই। এখানে সকালে কাগজ আসে না। রীডিং মেটিরিয়াল বলতে সঙ্গে এনেছি ”ডাস ক্যাপিটাল”—ইঁটের মতন বইটা কিছুতেই এগোচ্ছে না। সেটা নিয়েই বসেছি। হঠাৎ মনে হলো নিচে থালায় টং টং শব্দ হচ্ছে। একটু পরে টের পেলুম গাঁয়ের লোকেরা ওইখানে আমাকে দূর থেকে প্রণাম করছে, আর দু’এক টাকা করে প্রণামী দিয়ে যাচ্ছে। এই তো প্রথম আমাকে তারা চোখে দেখছে। মুখ দেখানি দেবে না? আমি প্রচণ্ড লজ্জিত। আমিনবাবু ধারেকাছে নেই। আমি কোঁচানো ধুতি, সিল্কের শার্ট, সোনার বোতাম পরে, শাল জড়িয়ে বসে আছি। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন, তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছি। জেলার গণ্যমান্যরা সকলেই এসে গেছেন। গান্ধীটুপি মাথায় জেলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি এসেছেন। আমীনবাবু বললেন—”ইশকুল ওপেন করবেন ডি. এম সাহেব। তাঁর পরেই তুমি।”
—”আমি মানে?”
—”মানে তুমি বক্তৃতা দেবে।”
—”আমি বক্তৃতা দেবো?”
—”নিশ্চয়ই। তোমার গ্রাম। তোমারই ঠাকুর্দাদার তাতে তৈরি করে দেওয়া গার্লস ইশকুল তোমারই ঠাকমার নামে। তুমি তাতে বক্তৃতা না দিলে মানায়? তোমাকে দু’চার কথা কিছু বলতেই হবে। শিক্ষিত ছেলে তোমরা।”
ম্যাজিস্ট্রেট বাঙালী। তিনি এসে গেলেন। লাল ফিতে কাঁচি দিয়ে কেটে ইশকুল ওপেন করলেন। গ্রামের মেয়েরা শাঁখ বাজাল। সাত—আটটি ছোটো—বড়ো মেয়ে পরিষ্কার, খাটো লালপেড়ে শাড়ি পরে এসেছিল। তারাই এ ইশকুলের প্রথম ছাত্রী হবে। তারা একপাশে লাইন করে দাঁড়িয়ে ছিল। হেডমাস্টারমশাই তাদের নিয়ে একটা ক্লাসরুমে ঢুকবেন, চকখড়ি, ডাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড, সবই সাজানো আছে সেই ঘরে। ডি. এম.—এর বক্তৃতার পরই আমাকে কিছু বলতে হবে। ঠাকুদ্দার হয়ে ডি. এম. বেশ সুন্দর করে বললেন স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে মিনিট পনেরো। তারপর আমি। মাইক ম্যাজিক জানে। মাইক দু’হাতে মুঠো করে ধরে আমি উদ্দীপ্ত কণ্ঠে একখানা যা বক্তৃতা দিয়ে ফেললুম, আমি নিজে তাতে যত অবাক, উপস্থিতি ব্যক্তিবর্গেরও তাতে অপার বিস্ময়। শুধু আমীনবাবু আমাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়েছিলেন। আর ডি.এম.ও ফিসফিস করে ধমকে বলেছিলেন—”সব কথার একটা জায়গা আছে। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে গেলে তো চলবে না?” অথচ কথাগুলো আমি যা বলেছিলুম, তাতে শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রেরিত হওয়া উচিত ছিল। আপত্তিকর কিছুই বলিনি। আমি বলেছিলাম অবিকল ”স্বাধীনতা”র ভাষায়—”বন্ধুগণ, আমার কিষাণ মজদুর ভাইরা, যুগ যুগ ধরে যারা তোমাদের লাঞ্ছনা গঞ্জনা, বঞ্চনা ছাড়া কিছুই দেয়নি, যারা তোমাদের শাসনের নামে শোষণ করেছে, তোমাদের রক্তঢালা ধান কেড়ে নিয়ে যারা শহরে চারতলা বাড়ি তুলেছে, তোমাদেরই মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকায় যারা শহরের রাস্তায় মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে, তোমরা তাদের এত সহজেই ক্ষমা করে দিলে? জমিদারমশাই একটা ইশকুল করেই না হয় দিয়েছেন গাঁয়ের মেয়েদের জন্যে—এটা তো বহুবছর আগেই করা উচিত ছিল। অন্তত একশো বছর আগে। আজ ভারত স্বাধীন হয়েছে। সরকারই এবার গ্রামে গ্রামে ইশকুল গড়ে দেবে। জমিদারের কৃপার মুখ চেয়ে আর তোমাদের বসে থাকতে হবে না। শাসক ইংরেজ চলে গেছে, কিন্তু তোমাদের শোষণ ঘোচেনি। নিজেদের প্রাপ্য জোর করে দখল করে নিতে হবে।” এতদূর বলেছি, আমীনবাবু জোরে জোরে আমার কাঁধে টোকা দিলেন। আমি গ্রাহ্য না করে বক্তৃতা চালিয়ে যাই।
”জমিদারমশাই ইশকুল করে দিয়েছেন বলেই যেন তোমরা ভুলে যেও না যে জমিদার শোষকশ্রেণী। আর শোষকশ্রেণী কখনোই কিষাণ মজদুরের বন্ধু হয় না, হতে পারে না—” বক্তৃতা শেষ করা হলো না। কনুই ধরে হ্যাঁচকা এক টান মেরে ”এবার থামো” বলে আমীনবাবু আমাকে বসিয়ে দিলেন। তখন জেলা কংগ্রেসের সেই ভদ্রলোক উঠে জলদগম্ভীর কণ্ঠে অপূর্ব এক ভাষণ শুরু করলেন। তাতে ঠাকুদ্দার প্রশংসা, ঠাকুদ্দার বাবার প্রশংসা। অজস্র হাততালি পড়ল। তারপরে সেই ক্ষীরের গুঁড়ো মাখানো ধূলিধূসরিত পথে গড়াগড়ি মেঠাই সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর মধ্যে বিতরিত হলো। লোকে বেশ খুশি হয়েই খেল। তাদের পরে কিছু হয়েছিল কিনা জানতে পারিনি।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরেই আবার ভাত খেতে বামুনবাড়ি যাওয়া। আজকে সবাই কেমন গম্ভীর। তারপর সেই গরুর গাড়ি চড়ে পূর্বস্থলীর দিকে রওনা। আমি বারবার একটা সাইকেল চাইলুম। গরুর গাড়ির চেয়ে বরং সাইকেলে চলে গেলে সুবিধে বেশি। কিন্তু ”ছোটোবাবুকে” সাইকেলে পাঠানোর কথা কেউ কানেই তুলল না। এবার ছোকরা নয়, তার বাবা, আসল গাড়োয়ানই গাড়ি নিয়ে চলল, তার অসুখ সেরেছে। বড় রাস্তা দিয়েই যাওয়া হলো। ‘শটকাটে’ নয়।
কলকাতায় এসে আমীনবাবু ঠাকুদ্দাকে কী বলেছিলেন জানি না, ঠাকুদ্দা আমাকে বললেন—”ছিঃ ছিঃ ওইরকম যাচ্ছেতাই বক্তৃতা দিয়ে এসেছ? আমাদের বাড়ির ছেলে হয়ে? আর কোনোদিন তোমায় কোনওখানে পাঠাবো না।” ঠাকুদ্দা বললেন—
—সেলামীগুলো কৈ?
—সেলামী? সে আবার কী?
—কেন, ওরা থালা রাখেনি? তোমার চেয়ারের সামনে?
—রেখেছিল তো।
—তাতে টাকা পড়েনি?
—হ্যাঁ—টং টং করে অনেক টাকা পড়েছিল।
—সেগুলো গেল কোথায়?
—সে তো আমি জানি না।
—কে জানবে তাহলে?
—থালার কথা আমীনবাবু জানেন।
—ছিঃ ছিঃ তুমি সেলামীটুকুও সামলাতে পারোনি? সেও আমীন জানে? নাঃ। জমিদারী তুমি রাখতে পারবে না। এই তোমার শেষ যাওয়া। আর তোমাকে কখনো পাঠাব না।
ঠাকুদ্দা তাঁর কথা রেখেছিলেন, আমাকে আর সেলামী কুড়োতে কোথাও যেতে হয়নি। কেননা ঠিক তারপরেই, আমারই ভবিষ্যদ্বাণী সফল করে, জমিদারী প্রথা উঠে গেল। কিন্তু সুধারানী মেমোরিয়্যাল গার্লস এখন হাই স্কুল। সম্প্রতি তার পঞ্চাশ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধনের আমন্ত্রণ এসেছে আমার কাছে। এই আমন্ত্রণ, এক ঔপন্যাসিকের কছে তাঁর প্রিয় পাঠকদের দাবি। ওরা কি জানে, ওঁদের এই সুধারাণী আমার ঠাকুমা?
নবকল্লোল, এপ্রিল ১৯৯৮