Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত
জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত
0/40
জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত

শুধুই বাঘ

শুধুই বাঘ

আমার মনে হয় সব শিকারীই যাঁদের রাইফেল এবং ক্যামেরা এই দুটি জিনিস দিয়ে বাঘ শিকারের দ্বৈত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ হয়েছে তারা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে এই দুই ধরনের শিকারের মধ্যে বিরাট পার্থক্য–এ পার্থক্য যদি বেশি নাও হয় তাহলেও অনেকটা হাল্কা ছিপ নিয়ে পাহাড়ের বরফগলা ঝরনায় ট্রাউট মাছ ধরা আর রৌদ্রতপ্ত পুকুরপাড়ে একটা স্থির ছিপ দিয়ে মাছ মারার পার্থক্যের মত।

ক্যামেরা এবং রাইফেল দিয়ে শিকারের মধ্যে খরচের ব্যবধানের কথা এবং ব্যাঘ্ৰকুলের দ্রুত বিলুপ্তির মূলে এর অবদানের কথা বাদ দিলেও বলা যায় যে একটা ভাল ছবি তোলা শিকারীকে বাঘ মারার ট্রফি পাওয়ার থেকেও অনেক বেশি আনন্দ দেয়; তা ছাড়া ছবি আনন্দ দেয় বন্য প্রাণী সম্বন্ধে উৎসাহী সবাইকে আর ট্রফি লাভের আনন্দ শুধু ট্রফি বিজেতার ব্যক্তিগত। উদাহরণ স্বরূপ আমি ফ্রেড চ্যাপম্যানের দৃষ্টান্ত দেখাব। চ্যাম্পিয়ন যদি ক্যামেরার বদলে রাইফেল দিয়ে বাঘ শিকার করতেন ওর ট্রফিগুলি সব গৌরব হারিয়ে এতদিনে ডাস্টবিনে স্থান পেত কিন্তু ওঁর ক্যামেরায় ধরা তথ্যগুলি ওর নিজের কাছে একটা চিরন্তন আনন্দের উৎস এবং পৃথিবীর সর্বপ্রান্তের শিকারীদের কাছে গভীর আগ্রহের জিনিস।

চ্যাম্পিয়নের বই with a camera in Tiger-land’ দেখতে দেখতেই আমার, প্রথম বাঘের ছবি তোলার কথা মনে হয়। চ্যাম্পিয়নের আলোকচিত্রগুলি স্থির ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ লাইটে তোলা, এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার জন্যে আমি চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় দিনের আলোয় ছবি তোলা স্থির করলাম। একজন অত্যন্ত সহৃদয় বন্ধুর উপহার, একটি বেল অ্যান্ড হাওয়েলের ১৬-সি. মি. ক্যামেরা আমার ঠিক প্রয়োজনমত অস্ত্রটি আমার হাতে তুলে দিল এবং যে অরণ্যের স্বাধীনতার অধিকারী আমি তা আমাকে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবাধে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ দিয়েছিল। দশ বছর ধরে আমি ব্যাঘ্ৰ অধ্যুষিত অঞ্চলে শয়ে শয়ে মাইল ঘুরে বেড়াই। কোনো কোনো সময়ে বাঘরাই তাদের মড়ির কাছে আমার এগোনো বিশেষ পছন্দ না করায় আমায় বিদায়জ্ঞাপন করে আর অন্যান্য সময় বাঘিনীরা তাদের বাচ্চাদের কাছে আমার এগোর প্রতিবাদে আমায় জঙ্গল থেকে তাড়িয়ে দেয়। এই সময়টিতে আমি বাঘদের স্বভাব ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে সামান্য কিছু শিখি এবং যদিও বাঘ সম্ভবত দুশো বার দেখেছি তবু আমি সন্তোষজনক কোনো ছবি তুলতে সমর্থ হই নি। ফিল্ম আমি বহুবার এক্সপোজ করেছি কিন্তু প্রতিবারই বেশি আলো, কম আলো, ঘাস পাতায় বাধা বা লেসে মাকড়সার জাল হওয়ার দরুন ফল হতাশাজনক হয়েছে; একবার ছবি খারাপ হয়ে গিয়েছিল ধোয়ার সময়ে ফিল্মের ওপরের প্রলেপটি গলে যাওয়ার দরুন।

অবশেষে ১৯৩৮ সালে আমি পুরো শীতকালটা একটা ভাল ছবি তোলার শেষ চেষ্টায় কাটাব ঠিক করলাম। অভিজ্ঞতার থেকেই আমি বুঝেছিলাম যে যেমন তেমনভাবে বাঘের ছবি তোলা সম্ভব হবে না। আমার প্রথম চিন্তাই হল একটা ভাল জায়গা বেছে নেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত আমি একটা খোলা পঞ্চাশ গজ চওড়া গিরিবর্ত বেছে নিলাম, তার মধ্যিখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটা ঝরনা আর দু পাড়ে ঘন গাছ আর ঝোঁপঝাড়ের ভিড়। খুব কাছাকাছি ছবি নেওয়ার সময়ে ক্যামেরার আওয়াজ বন্ধ করাবার জন্য আমি ঝরনাটা কয়েক জায়গায় আটকে কয়েক ইঞ্চি উঁচু ছোট ছোট জলপ্রপাতের মত তৈরি করলাম। এবার আমি বাঘের খোঁজ করলাম এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন তিনটি জায়গায় সাতটি বাঘের খোঁজ পেয়ে তাদের কয়েক গজ করে আমার জঙ্গলের স্টুডিওর দিকে আকৃষ্ট করতে আরম্ভ করলাম। এটা খুব সময়সাপেক্ষ এবং পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার–এর প্রতি পদে বাধা এবং হতাশা, কারণ যে অঞ্চলটায় আমি এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম সেখানে বহু শিকার হয়ে গেছে এবং একমাত্র দৃষ্টির বাইরে রেখেই অবশেষে আমি বাঘগুলিকে ঠিক যে জায়গাটিতে চাই সেখানে নিয়ে আসতে পারলাম। একটি বাঘ আমার না জানা কোনো কারণে পৌঁছনোর পরদিনই চলে যায় কিন্তু আমি তার একটা ভাল ছবি নেওয়ার আগে নয়। আর ছটিকে একত্রে করে আমি তাদের ওপর প্রায় হাজার ফুট ফিল্মে আলোকসম্পাত করি। দুর্ভাগ্যক্রমে সে শীতটা ছিল আমার অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে বেশি ভিজে স্যাঁতসেঁতে এবং লেন্সের ওপর জলকণা জমে, ক্যামেরায় কম আলো যাওয়ার ফলে, এবং তাড়াতাড়ি ও সযত্নে ফিল্মের রিল গোটানোর দরুণ বেশ কয়েকশো ফুট ফিল্ম নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার প্রায় ছ’শো ফুট ফিল্ম আছে যার সম্বন্ধে আমার গর্ব অসীম কারণ সেটি হচ্ছে ছটি পূর্ণবয়স্ক বাঘের জীবন্ত আলেখ্য-তার মধ্যে চারটি পুরুষ–দুটির দৈর্ঘ্য দশ ফুটেরও বেশি আর দুটি বাঘিনী, দুটির মধ্যে একটি সাদা বাঘিনী–ছবিটি তোলা দিনের আলোয়, দশ থেকে ষাট ফুট দূরত্বের মধ্যে।

পুরো ছবি তোলার ব্যাপারটা শুরু থেকে শেষ অবধি সাড়ে চার মাস সময়। লেগেছিল আর যে অগুন্তি ঘণ্টা আমি আমার ছোট্ট ঝরনা আর ক্ষুদে জলপ্রপাতগুলির কাছে শুয়ে কাটাই একটি বাঘও আমায় কোনোদিন দেখতে পায় নি। ছটি বাঘের কাছে দিনের আলোয় কয়েক ফুটের মধ্যে এগনো একটা অসম্ভব ব্যাপার সেইজন্যে রাত চলে যাওয়ার পর দিনের আলো ফোঁটার আগে খুব ভোরে এগোতে হয় ওদের দিকে–শীতকালের জমে থাকা শিশিরের দরুনই সম্ভব হত সেটা আর ছবি তুলতে হয়েছিল যেমন আলো আর সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল সেই অনুযায়ী। ১৬ মি. মি. ফিল্ম পর্দায় প্রতিফলনের পর যতই পরিষ্কার দেখাক না কেন এর এনলার্জমেন্ট ভাল হয় না। যাই হক এই বইয়ের সঙ্গে ছবিগুলির থেকে আমার অরণ্য স্টুডিও এবং আমার ছবির বিষয়বস্তুদের আকার এবং অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারবেন।