জোচ্চোর – ২
২
আকাশের আলো কখন বিদায় নিয়েছে, কখন কোন ফাঁকে কে যেন একটা হ্যারিকেন জ্বেলে বসিয়ে রেখে গেছে—খেয়াল নেই কারো। চলছে এই ভাবেই। দীর্ঘ দিন পরে দুটো সহিষ্ণু শ্রোতা পেয়ে যেন স্থানকালপাত্র হারিয়ে ফেলেছে মানুষ দুটো। হারিয়ে ফেলেছে বয়েসের ভার।
সুদত্তা অবাক হয়ে দেখছে, একশোবার বাদ প্রতিবাদ চালালেও, গল্পও এরা এমন ভাবে চালাচ্ছে, যেন এই ক’দিন আগের ঘটনা।
প্রবাল অবশ্য হেসে হেসে বলেছে, কি সুদত্তা, কেমন গল্প শুনছ? এক যে রাজা, ‘থামনা দাদা! রাজা নয় সে রাজপেয়াদা’ মনে পড়ে যাচ্ছে না?
সুদত্তা হাসল, কিন্তু সে হাসি কৌতুকের মাটিতে দাঁড়িয়ে নয়, কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাবে।
প্রবাল বলল, কি যেন ভাবছ মনে হচ্ছে?
হুঁ ভাবছি।
কী?
নিজেও এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি বুঝতে পারছি।
তাই বুঝি?
হুঁ। ভাবছ তো, এই ভাবে এরা জীবনটা কাটাচ্ছে কী করে? আর কেনই বা কাটাচ্ছে।
সুদত্তা একটু হাসল। বালকের কথায় বিজ্ঞরা যেমন হাসে।
এভাবে হাসলে যে?
এমনি।
আমার ব্যাখ্যাটা অর্বাচীনের মতো লাগল মনে হচ্ছে?
আচ্ছা থাক।
খেতে বসে তিনজনেই রেকাবির মিষ্টি আলাদা থালায় তুলে রেখেছিল, বাদে নেবুমাসি। এখনকার ছেলেমেয়েদের খাওয়া নিয়ে ধিক্কার দিয়েছেন নেবুমাসি, এবং অধিকতর ধিক্কার দিয়েছেন তৃতীয় ব্যক্তিটিকে। আধুনিকদের দেখাদেখিই যে ঢ্যাঙার এমন অধঃপতন, সেটি সরবে ঘোষণা করে। নিজে নিষ্ঠার সঙ্গে চারখানা ছানার জিলিপি, দুটো কাঁচাগোল্লা, দুটো খাস্তা গজা ও খানকয়েক হিংয়ের কচুরি সহযোগে চা খেয়ে বাড়তিগুলো ঘরে তুলতে গেছেন। ঢ্যাঙা গেছেন তাঁকে আলো ধরতে। আলো অবশ্য আধুনিকতার পাপে কলঙ্কিত টর্চ।
এই অবকাশে এরা কথা বলে নিচ্ছে।
প্রবাল সুদত্তার হাতটা একটু ছুঁয়ে বলল, ভাবছি এঁদের ভ্রান্তি নিরসন না করলেই বা কি ক্ষতি ছিল?
তার মানে?
মানে হচ্ছে, ইয়ে আর কি, নন্দর ধারণা মতো থাকলে মন্দ কি হত? আমাদের একটু নিজস্ব গল্প—টল্প করার সুযোগ সুবিধে জুটত। নেবুমাসির বিচক্ষণতা আমাদের সাহায্য করত। তা তুমি যা না খেপচুরিয়াস হয়ে উঠলে।
ওঃ। তুমি বলছ, সেই অসভ্যতাটা চালিয়ে যাওয়াই ঠিক ছিল?
ওই আর কি! মানে ক্ষতিটা আর এমন কি হত!
থামো! শেষ পর্যন্ত জল কোথায় পৌঁছত তা খেয়াল আছে?
প্রবাল মাথা চুলকে বলল, সেটা কোন ভাবে ম্যানেজ করা যেত না? ধর আমি আবদার করে বললাম, ঢ্যাঙাদাদু, আজ তোমার সঙ্গে আমি একঘরে শোব, গল্প—টল্প করব।
আজ! তা বেশ! কাল? পর্শু? তর্সু?
আচ্ছা আচ্ছা, ভুল হয়েছে। তুমি অমন অগ্নিমূর্তি হয়ো না। বসে বসে সত্তর বছর আগের এক বিয়ের ঘটা—পটার গল্প শোন। যা দেখছি, সেই রাজসূয় যজ্ঞে কোন দিন কী রান্না হয়েছিল তাও শুনতে হবে আমাদের।
সুদত্তা বলল, হোক না। সেটাই বা মন্দ কী? এও তো এক ধরণের ইতিহাস। শতবর্ষ পূর্বের বাঙালীর সমাজজীবনের ইতিহাস।
তুমি যে এমন হার্টলেস, আগে অনুভব করিনি।
অথচ তুমিই আমার কাছে তোমার নেবুমাসির গল্প করেছ।
সে আলাদা! এখন ওই দুই বুড়ো—বুড়ির বোকার মতো ঝগড়া দেখে—
থামতে হল। কারণ অভিযুক্ত আসামী যুগল সেই একই অপরাধ করতে করতে এসে পড়ল।
তোর ক্ষুরে আমি নমস্কার করি ঢ্যাঙা। বাচ্চুকে মাংস আনার কতা বলে রাকতে ভুলে গেলি? ও কি আর ভোর সকালে আসবে? হয়তো বেলায় অ্যাকেবারে মাচ নিয়েই চলে আসবে। এরা এয়েচে—শুধু মাচ দিয়েই চালাবার মতলব, কেমন?
প্রবাল তাড়াতাড়ি বলল, ওই মাছই তো ভালো নেবুমাসি। আবার মাংস—ফাংস কেন? ওখানে তো কেবলই ওই খাওয়া হয়। বরং তোমার ঘরের সেই সব ঘণ্ট নাকি, আর পোস্তর বড়া, ছেলেবেলায় যেগুলোয় দারুণ আকর্ষণ ছিল—সেই কর না।
নেবুমাসি হেসে উঠে বললেন, সে সব থেকেই কি আর বঞ্চিত হবি? শহুরে নাতনীকে কি আমি মোচার ঘণ্ট, গুঁড়ো মশলার সুক্তো, বড়িপোস্ত না খাইয়ে ছাড়ব? তবে শুধু তাই দিয়েই কাজ সারব নাকি? সকালে মাচ ভাত, পাঁচটা বেঞ্জন হোক, রাত্তিরে নুচি মাংস, পায়েস, মিষ্টি—
নেবুমাসি, তোমার রান্নাঘরের বারোমাসের অতিথি হয়ে থেকে যাব না কি? যা লোভ দেখাচ্ছ।
আহা রে। সবাই অমন বলে। বেণুও সেবার এসে বলেছিল, দৌলতপুরে এখনো যা দৌলতের নমুনো দেকচি, থেকে যেতে ইচ্ছে করচে। ওই দু—চার দিনই ভালো লাগে রে। কাজের তাড়ায় ছুট ছুট।
ওইতো! ‘কাজ’ বলে একটা কড়া মনিব আছে। সে যাক, তুমি আর ওই মাংস—টাংসর জন্যে লোক ছুটিও না।
নেবুমাসি আত্মস্থ গলায় বললেন, ছোটাতে বাকি আচে নাকি? ঢ্যাঙা চলে গেল দেকলি না? গিয়ে নন্দর বৌকে বলে রাকবে, সে নন্দকে দিয়ে বাচ্চুকে খবর দেবে। ও হয়ে যাবে।
কী আশ্চর্য? এত ঝঞ্ঝাটের কী দরকার ছিল মাসিমা? সুদত্তা বলল, ভীষণ লজ্জা করছে আমার। আমি এলাম বলেই তো এত ব্যস্ত করা।
নেবুমাসি হঠাৎ গলা খাটো করেন। বলেন, এই ছুতোয় ওরও একটু খাওয়া হবে, তাতেই আরো ব্যস্ত করা, বুজলে না? এদিকে ওই জিনিসটিতে খুব মন। কিন্তু আমার অসুবিধে হবে বলে কিচুতে আনতে দেবে না। বলে, একটা মানুষের জন্যে এত হ্যাঙ্গামা। আমি যদি বাচ্চুকে বলে রাকি, তলে তলে বারণ করে রাকে। তা এই কেউ এলে গেলে তার সুবাদে হুকুম করি। নচেৎ মিচে করে বানিয়ে বলি, বাচ্চু খেতে চেয়েচে, নন্দ মুক ফুটে বলেচে একদিন একেনে পাতা পাড়বে। ওই করে ওই একটু হয়। পেটে খিদে মুকে লজ্জা, এই মানুষকে ভাল মন্দ একটু খাওয়ানো দুষ্কর। আগে কেবলই বলত বসে বসে অন্ন ধ্বংসাচ্চি কোতাও চলে যাই। একদিন আচ্ছা করে তুলো ধোনা করে গাল দিতে তবে সে বাতিক ছেড়েচে। জম্মোকাল এ বাড়িতে রইল, তবু পর পর ভাব গেল না। ওই যে আসচেন বাবু!
হুকুম তামিল করে আসা হয়েছে—বেশ প্রাবল্যের সঙ্গে কতাটা বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন সরোজমোহন।
সঙ্গে সঙ্গেই নেবুমাসি বলে উঠলেন, কেতাত্ত হলাম। একটু বেশী করে আনতে বলা হয়েচে কি? বাচ্চু ছোঁড়াটাও খাবে তো। সুখী সুখীর মা রয়েচে।
ও সব জানি না। আনতে হবে সেটাই বাচ্চুকে বলে এলাম। ওর সঙ্গেই দেখা হল।
ঠিক আচে। বললেন নেবুমাসি, বাচ্চুর আন্দাজ বুদ্ধি তোর থেকে বেশী আয় খুকু, তখনকার গপ্পোর বাকিটা শেষ করি আয়।
সরোজমোহন ব্যঙ্গের গলায় বললেন, বাঃ, চমৎকার! এখুনি ভদ্রলোকের মেয়েটাকে তুই—তোকারি আরম্ভ করা হয়ে গেছে?
গেচে! আমি গাঁইয়া ভূত, ওই রকমই ব্যাভার। তোর সাধ হয়, আপনি আজ্ঞে কর। নয়তো বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে বসে থাকগে। একেনে থাকলেই তো কতায় কতায় ফোড়ন কেটে গপ্পো এগোতে দিবি না।
ঢ্যাঙা জেদের গলায় বলে উঠলেন, ঠিক আছে। আয় পলা, আমরা বেটাছেলেরা বৈঠকখানা ঘরে গিয়েই বসিগে।
নেবুমাসি কথার ডানা মেলে এক ঝাপট মারেন, কেন? পলা যাবে কেন? ও বলে পুরনো গপপো শুনতে কত ভালোবাসে।
ও ভালোবাসে কিনা জানি না, আমি কিন্তু ভীষণ ভালোবাসি মাসিমা। বলল সুদত্তা।
ও পাগল মেয়ে! মাসি কেন? বল দিদিমা। পলা ছোঁড়া মায়ের দেকাদিকি নেবুমাসি বলে তাই। নচেৎ দিদিমা হই তো।
বলায় কি আসে যায়? সুদত্তা বলল, একটা কিচু বললেই হল।
শোন কতা! একটা কিচু বললেই হল? নেবুমাসি নিজস্ব ভঙ্গীতে হি হি করে হেসে ওঠেন, যাকে তাকে তুই প্রাণেশ্বর বলতে পারিস? যাকগে তামাশার কতা, পুরনো অট্টালিকায় বসে পুরনো কালের কাহিনী শোন। একেনে বাতাস বইচে দেক কী প্রাণ জুড়ানো। একেই কবিরা বলে মলয় বাতাস, তাই না রে পলা?
অতঃপর সেই মনোরম মলয় বাতাসের স্পর্শে উদ্বেলিত হৃদয়টি নিয়ে পলাকে শোনা গল্পই বসে বসে শুনতে হয়, গাঁ—সুদ্ধু লোকের কারো ঘরে ওই একটি মাস উনুন জ্বলেনি। বাবার হুকুম। জ্বলতে দেওয়া হয়নি। সব এই যুজ্ঞিবাড়ি থেকে হবে। মায় কচি ছেলের দুধটা বার্লিটা পর্যন্ত।….
দেখা যায় ঢ্যাঙা তাঁর লম্বা ছায়া নিয়ে এই আসরেই বসে আছেন একটি গোলালো তাকিয়া কোলে নিয়ে, এবং যথারীতিই কথার মাঝে মধ্যে ফোড়ন কেটে চলেছেন।
যে সব জ্ঞাতি গোত্র ওই এক মাস ধরে ভোজ খেলো, তারাই শেষে বলে বেড়াতে লাগল—মেয়ে বছরের মধ্যে বিধবা হবে এ আর আশ্চর্য্যি কী, এত বাড়াবাড়ি ভাগ্যে সয়? ভাগ্যেরও একটা সহ্যশক্তির সীমা থাকে।
নেবুমাসি বললেন, তা কেন? সেই সোনার কড়ি নিয়ে কড়ি খেলার—
সোনার কড়ি! সুদত্তা অবাক হল।
ওই তো। আমার মায়ের উদ্ভুট্টি শক। তাঁর এত আদরের মেয়ের এত সাধের বিয়ে, মেয়ে বরের সঙ্গে কড়ি খেলবে সোনার কড়ি নিয়ে। তাই নিজের আঠারো ভরির গোট ভেঙে সওয়া পাঁচগণ্ডা কড়ি গড়িয়ে রেখেছিলেন। তাই দেখে সব গিন্নীরা রাগারাগি করতে লাগল—পয়সার গুমোরে শাস্তর নিয়ম উল্টানো…বাপের কালে কেউ শুনেচে সোনার কড়ি দিয়ে শুভকাজ হয়!…শেষ পর্যন্ত রাগারাগি করে সবাই আবার সমুদ্দুরের কড়ি এনে খেলাল, আর কোন ফাঁকে কে যে সেগুলো সরিয়ে ফেলল!
আবার হঠাৎ হেসে ওঠেন নেবুমাসি, সত্যি কথা বলি ভাই, সেই কড়ি ক’টা হারানোয় যত দুঃখু হয়েছিল, কপাল পোড়ায় তত নয়। এমন খাশা গড়েছিল যেন সদ্য কড়ি। আমাদের সেই শশীস্যাকরার যা হাত ছিল—
এলোমেলো কথা বলছিস কেন নেবু? তোর বিয়ের সময় আবার শশীস্যাকরা কোথা? তখন তো শশীর বাবা তারাপদ—
তুই বড়ো জানিস, না? বলি তুই বড়ো না আমি বড়ো?
তোর তিন মাসের বড়ো—গিরি তুলে রাখ নেবু। তুই বিয়ের কনে, তুই এত সব খবর জানতিস?
আর তুই যেন মস্ত গার্জেন ছিলি। তাই সব খবর রেখে বেড়াতিস।
তা বেড়াতামই তো। ফাঁকে ফাঁকে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে তোর কাছে সব খবর সাপ্লাই করতে হত না?…ঢ্যাঙা জোর গলায় বলেন, তখন কী খোসামোদ! বুজলি পলা? হেই ঢ্যাঙা লক্ষ্মীছেলে, কোতায় কী হচ্চে আমায় বলে যা। জিগ্যেস করলে লোকে বেহায়া বলবে। এদিকে আমার প্রাণ ছটফট করচে। বাবা যদি আর কারুর বিয়েতে এমন ঘটা করত, আমি প্রাণ ভরে আমোদ করতে পেতাম।
প্রতি পদে এহেন বাদ প্রতিবাদ সত্ত্বেও, সুদত্তার সেকালের ঐশ্বর্যশালী বাঙালীর সমাজ জীবনের ইতিহাস একটু একটু করে জানা হয়ে যায়।…সুদত্তা বলে, ঐশ্বর্যটা তারা কেবল মাত্র স্ত্রী—পুত্রের উপভোগের গণ্ডির মধ্যেই নিবন্ধ রাখতেন না। ভাগ করে ভোগ করতে জানত।…
সবাই তাই করত না হাতী—নেবুমাসি ঝঙ্কার দিয়েছেন, বাবার আমার জমিদারীর আর কোলিয়ারির পয়সা সব বারো ভূতে খেয়েচে।
কিন্তু সেই ঝঙ্কারের মধ্যে শুধু শব্দ ঝঙ্কারই দেখা গেছে, আক্ষেপ নয়।