Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
তিতাস একটি নদীর নাম – অদ্বৈত মল্লবর্মণ
তিতাস একটি নদীর নাম – অদ্বৈত মল্লবর্মণ
0/34
তিতাস একটি নদীর নাম – অদ্বৈত মল্লবর্মণ

২.০৭ প্রবাস খণ্ড

কিশোরের মনে একটা অস্বাভাবিক আশা জাগিয়াছে। সেই মেয়েটির সঙ্গেই তার বিবাহ হইবে। আশাটা আরও অস্বাভাবিক এইজন্যঃ সে নিজে কাউকে কিছু বলিতে পারিবে না, তাকেই বরং কেউ আসিয়া বলুক। মনে মনে সে কল্পনার রঙ ফলায়ঃ আচ্ছা এমন হয় না, মেয়েপক্ষ কেউ আসিয়া তাকে বলে, ‘অ কিশোর, এই কন্যা তোমারে দিলাম, লইয়া গিয়া বিয়া কর।’

 

খলার কাছে নদী-স্রোতের একটা আড় পড়িয়াছে। বিকালে সেখানে জাল ফেলিতে যাইয়া কিশোর বলিল, ‘আজ জাল লাগামু গিয়া খলার ঘাটে।’

খলার ঘাটে গিয়া কিশোর বাঁশের আগায় জাল জুড়িতেছে আর তৃষিতের দৃষ্টিতে ঘরগুলির দিকে তাকাইতেছে।

তাহারই সমবয়সের একটি তরুণকে খলার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখা গেল। লোকটা কিশোরের নৌকার দিকেই আসিতেছে। তার এদিকে আসার কি হেতু থাকিতে পারে?

কিশোর ভাবিয়া রোমাঞ্চিত হইলঃ এ বোধ হয় তারই কোনো ভাই হইবে। আসিতেছে সম্বন্ধের কথা চালাইতে। এ না হইয়া যায় না।

সত্যই লোকটা কিশোরের নিকট আসিয়া আত্মীয়তার ভঙ্গিতে কথা বলিল।

‘আপনেরার দেশ নাকি সুদেশ। দেখতে ইচ্ছা করে। কায়স্থ আছে, বরাহ্মন্ আছে, শিক্ষিৎ লোক আছে। বড় ভাল দেশে থাকেন আপনেরা ।’

সময় নাই। এখনই জাল ফেলিতে হইবে। শিক্ষিৎ লোকের দেশে থাকার যে কি কষ্ট, আর এদের মত দেশে থাকার যে কি সুখ, এ কথাগুলি অনেক যুক্তিপ্রমাণ দিয়া বুঝাইয়া দিবার কিশোরের সময় নাই। কিশোর কেবল শুনিয়া গেল।

‘আপনের সাথে একখান্ কুটুম্বিতা করতে চাইল।’

কিশোরের সকল শিরা-উপশিরা একযোগে স্পন্দিত হইতে লাগিল।

বলি, ‘আমরা গরীব মানুষ, আমরার সাথে কি আপনেরার কুটুম্বিতা মানায়?’

‘গরীব ত আমরাও। গরীবে গরীবেই কুটুম্বিতা মানায়। কি কন্ আপনে?’

এই কুটুম্বিতার জন্য কিশোর যে কতখানি ব্যাকুল, এই অনভিজ্ঞ ছেলেটাকে কিশোর সে কথা কি করিয়া বুঝাইবে। না বলিয়া দিলেও সে কি নিজেনিজেই বুঝিয়া লইতে পারে না’

কিশোরের মনের আকাশে রঙ্ ধরিল। জানিয়া শুনিয়াও কেবল পুলকের তাড়নায় জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি কুটুম্বিতা করতে চান্।’

‘বন্ধুস্তি, আপনের-আমার মধ্যে বন্ধুস্তি। কত দেশ ঘুরলাম, মনের মত মানুষ পাইলাম না। আপনেরে দেইখ্যা মনে অইল, এতদিনে পাইলাম।’

‘আচ্ছা, বন্ধুস্তি করলাম, বেশ।’

‘মুখে-মুখের বন্ধুস্তি না। বাদ্য-বাজনা বাজাইয়া কাপড় গামছা বদল কইরা –’

বাদ্য-বাজনা বাজাইয়া একটা আড়ম্বর করা যায় কি রকম কাজে – সে কেবল, ঐ মেয়েটাকে লইয়া করা যায়। মিতালি করা মুখের কথাতেই হয়। ওকাজে কি বাদ্য-বাজনা জমে, না, ভাল লাগে? কিশোর খুশির স্বর্গ হইতে মরুর বালিতে পড়িয়া বলিল, ‘আমার সাথে না, সুবলার সাথে গিয়া আপ্‌নে বন্ধুস্তি করেন।’