অবৈধ : তিন ভুবনের কাহিনী
অবৈধ
প্রসাধনের শেষে ড্রেসিংটেবিলের লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন চারুপ্রভা।
গাঢ় নীল রঙের পিওর সিল্কের শাড়ির উপর আলাদা বসানো চওড়া জরির ভারী পাড়টা এমন প্লেন আর টাইট ভাবে বুকের উপর থেকে টেনে কাঁধ ডিঙিয়ে পিঠে ফেলে দিয়েছেন মনে হচ্ছে ওর আর ওখান থেকে সিকি ইঞ্চিও নড়বার ক্ষমতা নেই, অর্ধচন্দ্রাকৃতি বৃহৎ কাটা গলা ব্লাউজটার অন্তরাল থেকে নিটোল অটুট গঠন—সৌষ্ঠবের যে রেখাটি উঁকি মারছে, তাকে কিছুতেই ঢাকা দিয়ে ফেলবে না।
বুক আর গলার অনেকখানি ফর্সা ধবধবে অনাবৃত অংশের মাঝখানে সরু একছড়া শুধু মুক্তোর হার চারুপ্রভার রুচির এবং অবস্থার পরিচয় বহন করছে। চারুপ্রভার নিটোল মোলায়েম বাহুবল্লরীও সম্পূর্ণ অনাবৃত, ব্লাউজে যে দুটো ‘হাতা’ থাকা আবশ্যক, এই বাজে সেকেলে নিয়মে বিশ্বাসী নন চারুপ্রভা। ঘন নীল শাড়ির ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে তিনি যে সাদা সার্টিনের ব্লাউজের ‘অনুকল্পটি’ শ্রীঅঙ্গে ধারণ করেছেন, তার কাঁধের উপর ইঞ্চি দেড়েক চওড়া দুটি টেপ বুক পিঠ দুদিকের অংশকে আটকে রাখার কাজে আত্মনিয়োগ করে ‘হাতা’ নামের গৌরবটুকু অর্জন করে নিয়েছে।
অন্য অনেক বিষয়ে ব্যয়বাহুল্যের অপবাদ থাকলেও এই একটি ব্যাপারে চারুপ্রভা মিতব্যয়ী। এক মিটার কাপড়ে দু’দুটো ব্লাউজ বানিয়েও ফালতু খানিকটা ফালি বাড়তি হয়ে যায় চারুপ্রভার।
শুভ্র মরালগ্রীবাটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেহের পাশ এবং পিছন যতখানি দেখতে পারা সম্ভব দেখে নিলেন চারুপ্রভা, কোথাও কোনখানে ঢিলেঢালা না থাকে।
দেখতে দেখতে ঠোঁটের কোণায় সূক্ষ্ম একটু হাসি ফুটে উঠল চারুপ্রভার। কেউ বলুক দিকি সাতচল্লিশ—আটচল্লিশের কাছে বয়েস হয়েছে তাঁর। নিজের কাছেও একটু কারচুপি করলেন চারুপ্রভা, করেন অনেক সময়। মনকে চোখ ঠারেন, সাল—তারিখগুলোর ওপর দিয়ে যেন আলগা হয়ে ভেসে যান।
আসলে চারুপ্রভার এখন ঊনপঞ্চাশী চলছে, সামনের মাসেই তাঁর থেকে গড়িয়ে পড়বেন পঞ্চাশের সীমারেখায়। তবু সেটা এখন ভাবতে পারছেন না।
চারুপ্রভার পঞ্চাশ বছর বয়েস হবে এ কখনো ভাবা যায়?
প্রসাধনের সরঞ্জামগুলো তাড়াতাড়ি আয়নার ড্রয়ারে পুরে ফেলে চাবি লাগিয়ে চাবিটা হ্যাণ্ডব্যাগে রেখে দিলেন চারুপ্রভা। অনেক কিছুই তো রীতিমতো সিক্রেটের ব্যাপার। চোখের কোণায় যে পটে আঁকা ছবির ভাবরেখা, চিবুকের ধারে যে ছোট্ট কালো তিলটি, সে সব যে চারুপ্রভার স্বোপার্জিত, বিধাতাপুরুষ এতটা দিয়ে পাঠান নি, একথা চারুপ্রভা বাড়ির লোকের কাছেও ভাঙতে রাজী নয়।
অবশ্য বাড়ির যে লোকটাকে নিয়ে এই তিরিশ বছর ঘর করলেন, সে লোকটাকে তিনি ‘লোক’ মাত্রই মনে করেন, ‘ব্যক্তি’ বলে গণ্য করেন না, কারণ স্ত্রীকে সে স্ত্রী ছাড়া আর কিছু ভাবতেই জানে না। ‘সুন্দরী স্ত্রী’ এই পর্যন্ত। সেই সৌন্দর্যের মধ্যে যে অগাধ সুষমা, অপার রহস্য, অপূর্ব শিল্পবিন্যাস, তা বুঝতেই পারে না।
চারুপ্রভাদের সমিতির ‘বাচাল বেহেড’ নামে বিখ্যাত সদস্যা উজ্জ্বলা বলে, ‘উঃ চারুদি, যাই বলুন, ভাগ্যিস ভগবান আমায় পুরুষ করে পাঠায় নি, পাঠালে আর আপনার রক্ষে ছিল না, হালুম করে খেয়ে ফেলতাম।’ …বলে, ‘স্থিরযৌবনা’ শব্দটা অভিধানেই দেখেছি, শব্দের মানেটা জানছি আপনাকে দেখে।’…কখনো বলে, ‘রাস্তায় বেরোবার আগে কড়ে আঙুলটা একটু কামড়ে নেবেন চারুদি, নইলে নির্ঘাৎ নজর লাগবে। মেয়েমানুষেরই মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিচ্ছেন—’
যতবার দেখে ততবারই যেন চমকে ওঠে উজ্জ্বলা।
আর সে কথা বলার পরই অন্যেরা যোগ দেয়। যে কথাগুলো শুনতে তোয়াজের মত।…এটা কিন্তু চারুপ্রভা সমিতির প্রেসিডেণ্ট বলে নয়, বা চারুপ্রভা সমিতিতে মোটা মোটা ডোনেশান দেন বলেও নয়, চারুপ্রভার অসাধারণ ব্যক্তিত্বই সকলের থেকে ঊর্দ্ধে তুলে রেখেছে চারুপ্রভাকে। ব্যক্তিত্ব আছে, কিন্তু বেশী রাশভারী নয়। বাচাল মেয়েটার বেহেড কথাবার্তাও তো সহ্য করে চলেন। তোয়াজ জিনিসটা বড় মারাত্মক, বশীকরণের মাদুলীকবচের মতই ওর অলৌকিক ক্ষমতা। একমাত্র তোয়াজই পারে একজন বিশিষ্টকে করায়ত্ত করে ফেলতে।
আবাল্য রূপের খ্যাতি শুনে আসছেন চারুপ্রভা তবু পুরনো তো লাগে না। বরং যেদিন কেউ তেমন লক্ষ্য করে না, সেদিন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে।
রূপলাবণ্যকে অটুট রাখবার, ‘স্থিরযৌবনা’ শব্দটার প্রত্যক্ষ অর্থ হয়ে ওঠবার জন্যে যে কলা—কৌশলের প্রয়োজন, সেটি চারুপ্রভার সম্পূর্ণ করায়ত্ত। রূপচর্চার পাঠ নিতে দেশী—বিদেশী সব রকম পদ্ধতির দ্বারস্থ চারুপ্রভা।
চারুপ্রভা জানেন শরীরের বাঁধুনী ঠিক রাখতে কোন খাদ্য গ্রহণীয়, আর কোন খাদ্য বর্জনীয়, চারুপ্রভা জানেন রাতে শোবার আগে মুখের রেখায় রেখায় কী ধরনের মাসাজ করলে মুখের পেশী সতেজ থাকে, আর সকালে জাগার পর কোন কোন প্রক্রিয়ায় মুখ ফোঁটা ফুলের মত টাটকা দেখায়।
চারুপ্রভা জানেন, কোন স্টাইলের সাজের সঙ্গে বব করা চুল মানায়, কোন স্টাইলের সঙ্গে ‘তাল’ খোঁপা, চূড়া খোঁপা। ছাঁটা চুল, বড় খোঁপা, সবই মজুত আছে চারুপ্রভার ভাঁড়ারে।
বলতে গেলে এটাই চারুপ্রভার জীবনের সাধনা। ছেলেবেলায় রান্নাঘরের কোণে মায়ের হাতের কলাইয়ের ডাল আর ডাঁটা—চচ্চড়ি মেখে ভাত খেতে খেতে চারুপ্রভা সিনেমার ছবিতে দেখা ঘরবাড়ির মত ঘরবাড়ির স্বপ্ন দেখত। যেখানে যা ঐশ্বর্যের ছবি দেখত তার মাঝখানে নিজেকে বসিয়ে বসিয়ে দেখত।
অথচ চারুপ্রভার মেয়ে?
যার ভাল নাম লোপামুদ্রা, ডাক—নাম জিপসি। সে এক অদ্ভুত!…নিজের নামটা নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই চারুপ্রভার, এবং পরলোকগত অভিভাবকদের উপর অভিযোগেরও শেষ নেই। কেন? জগতে আর নাম ছিল না? তাই চারুপ্রভার জন্যই এই সেকেলে গাঁইয়া নামটা! এর কোন অংশটাকে ভেঙে—চুরে বাঁকিয়ে আধুনিকীকরণ সম্ভব? বরং চারুপ্রভার বড়দির নামটা শতগুণে ভাল। নীরপ্রভাকে সহজেই নীরা করে নেওয়া যায়। চারুপ্রভা? সমস্ত সম্ভাবনা রহিত।
কী অবিচার!
নিজের মেয়ের উপর তাই সুবিচারের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন চারুপ্রভা। পোশাকী নামটি রেখেছেন মহাভারত ঘেঁটে, অথচ ডাক—নামটি কত স্মার্ট স্বচ্ছন্দ!
জিপসি! যেন বিদ্যুতের চমক। যেন বেতের ডগার আচমকা আস্ফালন। শুনলেই বোঝা যায়—তার নামকরণকারী আর যাই হোক গাঁইয়া নয়।
কিন্তু এমনি কপাল চারুপ্রভার যে, স্বভাবে মেয়েটা পুরো গাঁইয়া। আপ্রাণ চেষ্টা করেও চারুপ্রভা তাকে স্মার্ট করে তুলতে পারছেন না, পারছেন না কায়দাদুরস্ত করতে। আগে ভাবতেন বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে, এখন দেখছেন ধারণাটা ভুল, বলতে গেলে একেবারে উল্টো। যত বড় হচ্ছে জিপসি, ততই মায়ের ইচ্ছার বিপরীতে চলে যাচ্ছে। চারুপ্রভা গ্রাম্য শব্দ ব্যবহার করেন না তাই, নাহলে বলতেন তাঁর মেয়ের উপযুক্ত বিশেষণ হচ্ছে ‘ল্যাদাড়ু’। যেটা নাকি স্মার্টের একেবারে বিপরীত।
আবার তার উপর এককাঠি সরেশ, নিজের এই অপটুতার জন্যে লজ্জার বালাই নেই মেয়ের, বরং সুযোগ পেলেই মাকে ব্যঙ্গ করতে ওস্তাদ। অথবা বলা যায়, মা—র এই টিপটপ কায়দা—দুরস্থ সভ্য—ভব্য প্রকৃতিকে ডাউন করবার তালে সুযোগ খুঁজে বেড়ায়।
অতএব নিজের প্রসাধনের সরঞ্জামরাশি চাবি—বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় কী চারুপ্রভার? একটা কিছু চোখে পড়লেই জিপসি সেটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, আর হেসে হেসে বলে, ‘মা, তোমার এই অপরূপ রূপরাশির কতটা নিজের আর কতটা দোকান থেকে কেনা, সেটা ভাগ্যিস তোমার ভক্তরা জেনে ফেলে না।’ বলে, ‘যাই বলো বাবা, শ্রমবিমুখতা নিয়ে মাকে কিছু বলা যাবে না। কী পরিমাণ পরিশ্রম যে করেন ভদ্রমহিলা আসল রূপটাকে খানিকটা বাড়িয়ে আর আসল বয়সটাকে খানিকটা কমিয়ে দেখাতে! উঃ, ভাবা যায় না।’
ঠিক বাপের মত হয়েছে মেয়েটা।
ওই একটাই মেয়ে। একাধিক সন্তান চারুপ্রভার কাছে বিভীষিকাতুল্য, তাই ওই একজনের আবির্ভাবের পরই দ্বিতীয় তৃতীয়ের আসার পথ বন্ধ করে ফেলেছিলেন চারুপ্রভা। ভাগ্যিস ফেলেছিলেন, তা নইলে এই রূপলাবণ্য, এই নিটোল যৌবন এমন অটুট থাকত? তাছাড়া ওইরকমই তো হত আরো দু’চারটি? জীবন মহানিশা করে ছাড়ত চারুপ্রভার।
বিজনবিহারী অবশ্য খুব ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন তখন। বলেছিলেন, ‘একটাও অন্ততঃ ছেলে দরকার নেই মানুষের?’
চারুপ্রভা হেসে উঠেছিলেন।
‘আসবার দরজা খোলা পেলে, যার ইচ্ছে সে আসবে, তোমার দরকার মাফিক আসবে? পর পর মেয়েই আসতে পারে পাঁচ সাত দশবারও। তোমার নিজেরই ছয় পিসি নেই, পাঁচ বোন?’
বিজনবিহারী অবশ্যই এ যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। অতএব একমেবাদ্বিতীয়ম ওই ‘জিপসি’। যাকে বিজনবিহারী মাঝে মাঝে ‘খুকু’ বলেন।
তা বলে খুকুটি যে বাবারই ‘নিজ জন’ তাও নয়।
খুকু যেন দুটো অর্বাচীন বৃহৎ মাপের খোকা—খুকুর বোকাটে বোকাটে খেলার একটি বিজ্ঞ বুদ্ধিমান বয়স্ক দর্শক। তাই তার ঠোঁটের কোণায় সর্বদাই একটা কৌতুকহাসির ছাপ।
জিপসি যদি তেমন সীরিয়াস টাইপের মেয়ে হত, হয়তো ওর মনের মধ্যে মা—বাপ দু’জনের জন্যেই সঞ্চিত থাকত বিরক্তি বিদ্বেষ অবজ্ঞা ঘৃণা। কিন্তু তা নেই। জিপসির টাইপ আলাদা।
তাই সুবিখ্যাত ‘ইণ্ডিয়ান গ্রীল অ্যাণ্ড গেট’—এর মালিক বি. বি. দত্ত যখন দিনান্তে সারাদিনের কর্মকাণ্ডের বেশভূষা ছেড়ে ধুতি—পাঞ্জাবি পরে, ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজে তোলার হুকুম দিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে যান, তখন জিপসির মুখে ফুটে ওঠে ওই তরল কৌতুকের হাসিটি।
চারুপ্রভা অবশ্য সে সময় বাড়ি থাকেন না, তবে দৈবাৎ কোনদিন থাকলে, জিপসি হেসে হেসে বলে, ‘এ বাড়ীটা কী মজার দেখছ মা? সন্ধ্যে হতে না হতেই বাড়ির হেড শ্রীমতী চারুপ্রভা দাসী, মিসেস দত্ত হয়ে বেরিয়ে যান; আর মিষ্টার বি. বি. দত্ত বেরিয়ে যান স্রেফ বিজনবাবু হয়ে।’
চারুপ্রভা দাসী!
চারুপ্রভা রেগে আগুন হয়ে বলেন, ‘দাসী মানে? দাসী মানে কী? দাসী লিখতে তুই দেখেছিস কোনদিন আমায়?’
‘আহা তোমায় না দেখি, তোমার মাকে তো দেখেছি। এখনো লেখেন শ্রীমতী হেমপ্রভা দাসী।’
চারুপ্রভা আরো উত্তেজিত হন, ‘চিরকাল লিখে এসেছেন বলেই এখনো লিখতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়িটা ওঁর নামে—’
‘আহা হা সেই কথাই তো বলছি—চিরকাল যা করে এসেছেন তাই করে চলেছেন। বুড়ি মহিলাটি লোক খাঁটি।’
‘অমন খাঁটি হওয়াকে আমি ঘৃণা করি।’—চারুপ্রভা রাগে কাঁপেন, ‘দাসী! হাতে করে লিখতে লজ্জাও করে না!’
জিপসি সরলতার প্রতিমূর্তি।
ওঁমা লজ্জা করবে কেন? তোমার বাবাও তো লেখেন পান্নালাল দাস।’
‘তোমাকে আর আমার মা—বাপকে নিয়ে কথা বলতে হবে না।’
‘এ মা। তুমি রাগ করছ? তাহলে বলব না বাবা।’ বলে জিপসি হয়তো তখন ফট করে রেডিওটা খুলে দেয়, নচেৎ পোষা কুকুর লুসিকে আদর করতে বসে।
জিপসি অবশ্য লুসিকে লুসি বলে না, বলে ‘ঢিপসি’।
এই বিটকেল শব্দটা শুনতে হয় বলে চারুপ্রভা রেগে আগুন হন, কিন্তু জিপসি অবলীলায় বলে, ‘ঠিকই তো বলি মা। জিপসির বোন ঢিপসি। বেশ কেমন মিল আছে।’
‘ও তোর বোন?’
‘নয়ই বা কেন? তোমার যখন পালিতা, আর আদরে যখন কন্যাতুল্য, তখন বোন বলাই তো উচিত।’ বলে জিপসি তারস্বরে ডাকে ও আমার বোনটি! ও আমার বোনটি! আমার ঢিপসি বোনটি!
চারুপ্রভা যখন সান্ধ্যভ্রমণে, অথবা বৈকালিক ভ্রমণে বেরোন, তখন সেটা দেখায় যেন সম্রাজ্ঞীর বিজয়—অভিযান। চারুপ্রভা সাজসজ্জা করেন ঘণ্টা দুয়েক ধরে এবং সবসময়ই ঝকমকে ঝকঝকে হয়ে। আর বেরোবার সময় সংসারের সকলকে সচকিত করে জোরাল ঘোষণায় জানিয়ে যান, ফিরতে রাত হতে পারে, বেশী রাত হলে চারুপ্রভার জন্যে যেন কেউ বসে না থাকে। ধরে নিতে হবে বাইরে থেকে খেয়ে আসছেন তিনি। এই ঘোষণার মধ্যে কর্ত্রীর দাপট আছে।
বিজনবাবু হয়ে যাওয়া বি. বি. দত্তর কিন্তু ব্যাপারটা আলাদা।
বিজনবাবুর এ সময়কার ভূমিকাটি যেন চোর চোর। বেরোবার সময় কারুর চোখে না পড়লেই যেন বাঁচেন। আর মোটা মাইনে দিয়ে রাখা রাতদিনের ড্রাইভারকে সাততাড়াতাড়ি ‘ছুটি’ দেবারই বা কী আছে তা কাউকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে বোঝাতে পারেন না। শুধু বলেন, ‘সারাদিন ঘুরছে বেচারা।’
‘ঘুরছে তা কী? তুমি ঘুরছ না?’
‘আমার কথা বাদ দাও।’
কেন বাদ দেওয়া হবে, সে কথার উত্তর নেই।
মোটের মাথায় বাড়িতে দু’দুখানা গাড়ি থাকতেও নিজস্ব ভ্রমণে ট্যাক্সিই পছন্দ করেন বিজনবিহারী। এবং পছন্দ করেন চারুপ্রভা বেরিয়ে যাবার পরে বেরোতে।
সোস্যাল ওয়ার্কার মিসেস দত্তকে তো রোজই বেরোতে হয়। ভয়ানক কাজের মানুষ তিনি।
প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে অথবা সন্ধ্যার প্রাক্কালে সাজসজ্জার শেষে সর্বাঙ্গে রূপের হিল্লোল ছড়িয়ে, আর সমস্ত পরিবেশটাতে দামী সেণ্টের গন্ধ ছড়িয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান চারুপ্রভা।
নিজের ঘর থেকেই টের পান বিজনবিহারী, কারণ বেরোবার আগে মেয়ের ঘরের সামনে একবার দাঁড়িয়ে সুরেলা গলায় বিশেষ একটি টোনে ‘জিপসি’ বলে ডেকে যাওয়া চারুপ্রভার নিয়ম।
কেন নিয়ম তাও জানেন বিজনবিহারী, চারুপ্রভা যে এখনো কত তাজা, কত সুন্দরী সেটা মেয়েকে দেখিয়ে যাওয়া।
বিজনবিহারী না শুনেও বুঝতে পারেন চারুপ্রভা একটুক্ষণ দাঁড়াবার কারণ সৃষ্টি করতে মেয়েকে কী কী বলেন।
হয়তো মেয়ের এই মনোরম সন্ধ্যাকালে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকার জন্যে, হয়তো বিকেলবেলাটাও অপ্রসাধিত অবস্থায় থাকার জন্যে। বিস্ময় প্রকাশ করবেন, ক্ষোভ প্রকাশ করবেন, এবং চারুপ্রভার মেয়ে হয়েও সে যে এমন অদ্ভুত হল কেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে তার কৈফিয়ৎ চাইবেন।
বিজনবিহারী জানেন, মেয়েও পাল্টা বিস্ময় প্রকাশ করবে মায়ের প্রতিদিনই এই একই বিস্ময়ের বহর দেখে!
বলবে, ‘তোমার আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতা দেখে আমি তো হাঁ হয়ে যাই মা।
তোমার কথা শুনলে মনে হয় জীবনে এই আজই প্রথম দেখলে আমাকে।’
তখন রাগ করে তর—তর করে নেমে যান চারুপ্রভা।
সেণ্টের গন্ধটা অনেকক্ষণ থাকে। বাতাসে ভেসে ভেসে একেবারে মিলিয়ে যেতে সময় লাগে।
আজ কিন্তু চারুপ্রভা মেয়ের ঘরের দরজায় না গিয়ে এ ঘরে এলেন।
বিজনবিহারী টেবিলে একরাশ কাগজপত্র ছড়িয়ে বোধকরি হিসেব মেলাচ্ছিলেন।
চারুপ্রভা তীক্ষ্ন প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাঙ্কের ভল্টের চাবিটা রেখে যেতে বলেছিলাম, রেখে যাওয়া হয়নি কেন?’
বিজনবিহারী মুখ তুলে চাইলেন।
বিজনবিহারীর মনে পড়ল দোকানে বেরোবার সময় একবার যেন শুনেছিলেন কথাটা। ব্যবসাপত্তরের অবস্থা জটিল, নানা চিন্তায় কথাটা আর মনে পড়েনি।
স্বীকার করলেন সে—কথা।
‘ঈস! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।’
‘আশ্চর্য ভুল! বলেছিলাম না আজ একটা বিয়ের নেমন্তন্ন আছে, জড়োয়ার দু’একটা বার করে আনব।’
‘হ্যাঁ, মানে তাড়াতাড়িতে—’
বিজনবিহারী বলতে পারতেন, ‘জড়োয়া গহনাটা বাহুল্য, তুমি এমনিতেই বিয়ে—বাড়ি মাৎ করতে পারবে।’ তাহলে হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা হালকা হয়ে যেত, কিন্তু বিজনবিহারীর শব্দচয়নের জ্ঞানের বালাই নেই, নেই প্রকাশভঙ্গীর।
তাই বিজনবিহারী বলে বসলেন, ‘আজকালকার দিনে বেশী গহনা—টহনা পরে না যাওয়াই ভাল। চারিদিকে যা শুনতে পাই।’
‘চমৎকার। তা তোমার মত ভোঁতা ব্যবসাদারের উপযুক্ত কথাই বটে! বিয়ে—বাড়ি—টাড়িগুলো একবার দেখে আসা উচিত তোমার। ছিনতাইয়ের ভয়ে কে কে ভিখিরি সেজে এসেছে দেখতে পেতে।’
বিজনবিহারী অন্য কোন কথা খুঁজে না পেয়েই বোধহয় বলেন, ‘বিয়েটা কোথায়, মানে কাদের বাড়ি?’
‘বললে তুমি চিনবে?’
অবজ্ঞার একটি বিশেষ ভঙ্গীতে কাঁধ নাচিয়ে বেড়িয়ে যান চারুপ্রভা। নেহাত দেরী হয়ে গেছে, তাই। নচেৎ আরো দু’চারটে কথা শুনিয়ে যেতেন।
চারুপ্রভা বেরিয়ে যাবার পরও ঘরে সেণ্টের গন্ধটা ছড়িয়ে রইল।
হঠাৎ বিজনবিহারীর চোখের সামনে একটা সুন্দর কাটগ্লাসের ছোট খালি শিশির চেহারা ভেসে উঠল।
অথচ সেটা আজকের দেখা নয়, বহু বহুদিন আগের কথা।
বিয়ের সময় গায়ে—হলুদের তত্ত্বে যথারীতি সাবান পাউডার আলতা সিঁদুর তেল চিরুনী ইত্যাদির সঙ্গে একটা সেণ্টও পেয়েছিল চারুপ্রভা।
বিজনবিহারীদের বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছিল। তখন বিজনবিহারীর বাবা—কাকা সবাই বেঁচে, অতএব বৌ—তত্ত্বর মাল—মশলা কেনায় বিজনবিহারীর কোন হাত ছিল না। বোধকরি কাকাই কিনে এনেছিলেন। এবং কাকার জ্ঞান—বুদ্ধি অনুযায়ীই এনেছিলেন, তবু চারুপ্রভার কাছে খুব আদরণীয় হয়েছিল জিনিসটা। কোথাও যাবার সময় একফোঁটা করে মাখত, বেশী খরচ করত না। তবু এক সময় তো খরচ হবেই। হল।
কিন্তু চারুপ্রভা খালি শিশিটা ফেলে দিতে পারেনি প্রাণ ধরে। কত কত দিন যাবৎ বাক্সের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। বাক্স খুললেই বলত, ‘ফাঁকা শিশি তবু গন্ধ দেখ। বাক্স খুললেই পাই।’
হ্যাঁ, তখন তো চারুপ্রভার ওই বাক্সই সার, আলমারীর স্বপ্ন নেহাতই স্বপ্নলোকে।
ঠাকুর্দার আমলের সামান্য একটা লোহা—লক্কড়ের দোকান ছিল, বাপ—কাকার সঙ্গে সেটাতেই খাটছিলেন তখন বিজনবিহারী। কিন্তু মাথার মধ্যে অনেক প্ল্যান ছিল তাঁর, সেও এক প্রকার দুর্লভ স্বপ্ন।
চারুপ্রভার বাবা পান্নালাল দাসের ছিল বড়বাজারে রঙের দোকান। অবস্থা খারাপ ছিল না, কিন্তু হাড়কিপ্পন ছিল। মেয়েদের মানুষ করেছিল হাড়ির হালে, আর বিয়ে দিয়েছিল স্রেফ শাঁখা—শাড়ি দিয়ে।
কাজেই চারুপ্রভার জীবনে সেই বিয়েয় পাওয়া সেণ্টের শিশিটাই হয়েছিল প্রথম বিলাসিতার সৌরভবাহী।
কিন্তু নিজের সম্বন্ধে তার মূল্যবোধ ছিল বেশ প্রবল।
আর শখ—শৌখিনতাটা চারুপ্রভার মজ্জাগত প্রকৃতি। আয়ত্তের মধ্যে যা ছিল তাই দিয়েই সে রূপচর্চা করত। শাশুড়ী ছিল না, দিদিশাশুড়ী বলত, ‘রোজ আলতা পরা! তরল আলতার শিশিগুলো পাঁচদিনে শেষ।’…বলত, ‘গেরস্থঘরের বৌ সর্বদা ধোপ কাপড় পরার অভ্যেস কেন? উড়নচণ্ডী বৌ!’
কিন্তু হঠাৎ একসময় ভাগ্যের চাকাখানা যেন হুড়মুড়িয়ে ঘুরে গেল। যেন কোন দেবদেবীর বর পেয়ে গেলেন বিজনবিহারী। ওই গ্রীল আর গেটের ব্যবসা থেকে টাকা আসতে লাগল অপ্রত্যাশিত, কারবার ফুলে ফেঁপে বেড়ে উঠতে লাগল বর্ষার নদীর মত, এবং বিজনবিহারীর যত টাকা বাড়তে লাগল, চারুপ্রভার তত পাখা গজাতে লাগল।
টাকাই তো চলার চাকা।
টাকাই তো ওড়ার পাখা।
টাকাই তো পরমানন্দমাধব, যার কৃপায় মূক বাচাল হয়, পঙ্গু গিরি লঙঘায়।
যে চারুপ্রভা একদা শাড়িখানাও গুছিয়ে পরতে জানত না, সেই চারুপ্রভা এখন এখানে এসে পৌঁছেছেন।
বাড়িতে একখানা মাত্র গাড়ি থাকাটা যে কিছুই নয়, প্রত্যেকেরই নিজস্ব একখানা গাড়ি থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়, না থাকা মানেই জীবনের মানে না থাকা, একথা অনেকদিন আগেই জেনে ফেলেছিলেন চারুপ্রভা, এবং এটাও জেনে ফেলেছিলেন কোন এক রকমের ‘সোস্যাল ওয়ার্কের’ সঙ্গে জড়িত না থাকলে অভিজাত হয়ে ওঠা যায় না।
জেনে ফেলার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে চারুপ্রভার। প্রায় অলৌকিকের মত। তাই এই আধুনিক নক্সার বাড়িখানা বানানো থেকে, অতি—আধুনিক নক্সার আসবাবপত্রে সে বাড়ি সাজিয়ে ফেলার সব কিছু গৌরবই চারুপ্রভার। সে গৌরবের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
বিজনবিহারী যেন দিশেহারা হয়ে যান এই সব ঘটনায়। তাঁর ধারণা ছিল মা—লক্ষ্মীর কৃপায় টাকা যখন হয়েছে চারটি, তখন বেশ দেখবার মত একটা বাড়ি হোক, আর সে বাড়িটা ভাল করে একবার সাজিয়ে টাজিয়ে নিয়ে বসাও হোক, কিন্তু অবিরতই সেটা হোক, হয়েই চলুক, রোজ নতুন নতুন ফার্নিচার আসুক, নতুন নতুন পর্দা, বেডকভার, সোফা—সেটির ঢাকা, টী—সেট, ডিনার—সেট আসতেই থাকুক, এমন অভাবিত বস্তু—টস্তুগুলি যে আগামীকালই একেবারে বাতিল করে দিতে হয়, তাও জানা ছিল না বিজনবিহারীর।
বিজনবিহারীর শৈশব—বাল্যের ফার্নিচারের স্মৃতি হচ্ছে ভারী একখানা কাঁঠাল কাঠের ঢাউশ চৌকী, যাতে ঠাকুমাকে মধ্যমণি করে তাঁরা অনেকগুলো তুতো ভাই বোনে মিলে শুতেন। একটা প্রকাণ্ড উঁচু আলনা, যার পিঠটা সর্বদাই গাধার পিঠের যত উঁচু হয়ে থাকত, এবং তার মধ্যে থেকে নিজের জামাকাপড় খুঁজে বার করতে পারা বেশ একখানা দুরূহ কর্ম ছিল।
বাড়িতে আর ছিল ক’খানা গুমো চেয়ার, যাতে বসবার অধিকার বড়দের ছাড়া ছোটদের ছিল না।
বিজনবিহারীর ধারণায় টাকা হলে ব্যাঙ্কে রাখতে হয়, বিষয়—সম্পত্তি বাড়াতে হয়, চিত্ত উদার করতে পারলে দান ধ্যান করতে হয়। কিন্তু এমন একটা সর্বনাশা বুদ্ধি নিয়ে দুহাতে উড়িয়ে—পুড়িয়ে দিতে হয়, এ—ধারণা ছিল না।
কিন্তু চারুপ্রভা তাঁকে তাঁর ধারণাতীত পথে টেনে নিয়ে চলেছেন দুর্বার গতিতে।
অথচ প্রতিবাদের ক্ষমতা নেই ভোঁতা বিজনবিহারী দত্তর।
উপায়ও নেই।
বিজনবিহারীর কোষ্ঠিকারক জ্যোতিষী বলে রেখেছেন বিজনবিহারীর যা কিছু সুখ—ঐশ্বর্য সবই স্ত্রীভাগ্যে। সুখের কথা বলতে পারেন না বিজনবিহারী, তবে ঐশ্বর্যের কথা অস্বীকার করা চলে না। চারুপ্রভা আসার পর থেকেই এ সংসার উথলোতে শুরু করেছে। বিজনবিহারীর বাবা তার সূচনা দেখে গেছেন। তিনি সহৃষ্ট চিত্তে বলতেন, ‘মা আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।’
তখন চারুপ্রভা পিঠে আঁচল ফেলে শাড়ি পরতে জানতেন না, আঁচলে চাবি বেঁধে পিঠে ফেলতেন। আর তখনো হয়তো সেই ফাঁকা শিশিটা বাক্সের কোনখানে তোলা ছিল তাঁর।
তারপর তো ধাপে ধাপে উঠেছেন।
উঠেছেন তো উঠেছেন। আর ওই ওঠার সূত্রেই চারুপ্রভার বি. বি. দত্তর সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশই কমে আসছে, কারণ সময় নেই দুজনেরই। এখন শুধু দেনদার আর পাওনাদারের সম্পর্কটি বলবৎ। এখন আর বিজনবিহারী ব্যাঙ্কের খাতা সামলাতে চেষ্টা করেন না, এবং ‘মা—লক্ষী’ ঘরে এলে তাঁকে যত্ন করে তুলে রাখতে হয়, এই পুরনো ধারণাটাকে ত্যাগ করেছেন।
যার ভাগ্যে ধন, সেই করুক ভোগ। খেলুক তা নিয়ে ছিনিমিনি।
তবে বিজনবিহারীকে যে ‘সাহেব’ হতে হয়েছে এইটাই কষ্ট। বিজনবিহারীকে সকালে জলখাবারের বদলে ব্রেকফাষ্ট করতে হয়, দুপুরে মধ্যাহ্ন—ভোজনের বদলে লাঞ্চ, আর সন্ধ্যায় নৈশ আহারের বদলে ডিনার। মাছের সর্ষে কাঁচালঙ্কার ঝালের স্বাদ ভুলেই যেতে হয়েছে বেচারীকে, পেঁয়াজ রসুন আদা টোম্যাটো সম্বলিত ‘কারি’ই সার। ফ্যাশনের প্রয়োজনে নিজের রসনাকেও প্রশ্রয় দেন না চারুপ্রভা।
আহারে বাহারে চলনে বলনে, চারুপ্রভার নির্দেশ মানতে মানতে অবাক হয়ে ভাবেন বিজনবিহারী, আশ্চর্য! ও এতো সব জানল কোথা থেকে! আমার সঙ্গেই তো জীবনযাত্রার শুরু। এই অচেনা যাত্রাপথটা ও চিনল কী করে? যে পথে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছুটে চলেছেন বিজনবিহারী।
শুধু ওই একটা সময় বিজনবিহারী স্ব—ভূমিতে।
ওই সন্ধ্যাবেলাটায়।
জিপসির ভাষায় মিষ্টার বি. বি. দত্ত যখন স্রেফ বিজনবাবু হয়ে যান।
চারুপ্রভার গাড়ি বেরিয়ে যাবার শব্দ হল।
খাতাপত্তর গুটিয়ে উঠে পড়লেন বিজনবিহারী।
আসলে কাজটা খুব কিছু দরকারী ছিল না। বলতে পারা যায় এই খাতাগুলো বিজনবিহারীর আত্মরক্ষার অস্ত্র। বাড়িতে ড্রয়ারে রেখে দেন এই রকম চারটি।
চারুপ্রভা ঘরে আসছেন টের পেলেই তাড়াতাড়ি ওগুলোকে টেবিলে বিস্তার করে বসেন। ওর আড়ালে মুখটাকে বাঁচানো যায়, এবং চারুপ্রভার তীব্র আক্রমণাত্মক বাণীগুলি উচ্চারিত হবার সময় অন্যমনস্ক হবার ভান করা যায়।
এখন আর ভানের প্রয়োজন নেই।
উঠে পড়ে চটপট বি. বি. দত্ত থেকে বিজনবাবু হয়ে গেলেন। পাঞ্জাবির ভিতর পকেটে কিছু টাকা রাখলেন, ‘লকারে’র চাবিটা কোঁচার খুটে বেঁধে কোমরে গুঁজে নিলেন। বাপ—ঠাকুর্দার আমল থেকে এই জায়গাটিকে সব থেকে নিরাপদ মনে করে থাকেন বিজনবিহারী। তবে চারুপ্রভার সামনে এখন আর চলে না এসব। আগুন হয়ে যাবেন চারুপ্রভা এরকম গাঁইয়ামীতে।
অথচ এভাবে সর্বস্ব ফেলে রেখে কর্তা—গিন্নী দুজনে বেরিয়ে যাওয়া! মন সায় দেয়না। কিন্তু উপায় কী?
ঘরে চাবি—তালা দিয়ে যাওয়াটাও যে চারুপ্রভার না—পছন্দ। ওতে নাকি চাকর—বাকরদের কাছে প্রেসটিজ থাকে না, এবং তাদেরও প্রেসটিজের হানি করা হয়।
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় দরজায় তালা লাগিয়ে যাওয়া বিজনবিহারীর ঠাকুর্দার আমলের ব্যাপার।
অতএব আর কিছু করার নেই বিজনবিহারীর লকারের চাবিটি কোঁচার খুটে বেঁধে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। আবার একথাও ভেবে উদাস হাসি হাসেন, সোনা রূপোর থেকে অনেক দামী জিনিসটাই তো অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে যাচ্ছি আমরা!
একথা তুলে চারুপ্রভাকে সাবধান করে দিতে গিয়ে ঝঙ্কার খেতে হয়েছিল।
চারুপ্রভা ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলেন, ‘বোকার মত কথা বোল না। মেয়ে বড় হয়েছে বলে তাকে আগলে বসে থাকতে হবে? আর নয়তো চাকরগুলোকে ছাড়িয়ে দিতে হবে? এই চিন্তাটা শুধু বোকাটেই নয়, অশ্লীল। হ্যাঁ, আমি বলব তোমার এই মনোবৃত্তিটা অশ্লীল। ভদ্র সভ্য ঘরে একথা কেউ ভাবতেই পারে না।’
বিজনবিহারী তবু বলেছিলেন, ‘একথা শুধু একা আমিই বলি? মেয়ে বড় হলে আগলাতে হয় সংসারে আর কেউ বলে না?’
‘বলবে না কেন? তোমার মত বুনোলোকের তো অভাব নেই সংসারে। বেশ তো এতই যদি ইয়ে, নিজেই থেকো না সন্ধ্যা বেলা মেয়ে আগলে।’
‘আমি?’
‘কেন? মায়েরই শুধু দায়িত্ব? বাপের নেই?’
‘সেকথা বলছি না আমি! বলছি এতগুলো শার্ট—পায়জামাপরা মস্তান চাকরের কী দরকার? ঝি—টি দিয়ে চলে না?’
‘চলবে না কেন? কিছু না থাকলেও চলে। তোমার মা—ঠাকুমার তো চলত।’
বিজনবিহারী বলে উঠতে পারতেন, ‘তোমার মা—ঠাকুমারও চলত। এখনো একটামাত্র বুড়ি ঝি দিয়েই তোমার মা—র চলে।’
কিন্তু বলতে পারলেন না।
পান্নালাল দাস সম্প্রতি মারা গেছেন। সেই কথা উঠিয়ে কথার বন্যা বহাবেন চারুপ্রভা। বললেন অন্য কথা, ‘তোমারও একদা একটামাত্র ঝি দিয়ে চলেছে—’
চারুপ্রভা মুখ বাঁকান, ‘সেই সুখস্মৃতি আর নাই তুললে। তাতে তোমার নিজের গৌরব বাড়বে না। একদা তো হাওড়াহাটের শাড়ি পরেও দিন কেটেছে আমার। সেটাই জীবনযাত্রার আদর্শ নয়! ভাত না জুটলে ফ্যান খেয়েও কাটাতে পারে লোকে। তোমার মেয়েই বা কুনো হয়ে বাড়ি বসে থাকে কেন? বেরোতে পারে না? বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে না?’
‘সেটাই বা কী এমন নিরাপদ?’
বলে ফেলেছিলেন বিজনবিহারী।
আর শুনে চারুপ্রভা ঝলকে ঝলকে হেসেছিলেন।
‘নিরাপদ? ওঃ! তা পয়সাকড়ি তো আছে, একটা লোহার হারেম বানিয়ে ফেল না। মেয়েকে ভরে রাখতে পারবে।’
এর পর আর কোন কথা?
তখনকার সেই সদ্য বড় হয়ে ওঠা মেয়ে তো এখন প্রস্ফুটিত কুসুম। তবে মায়ের রূপের ধারে—কাছেও লাগে না। বাবার দিক ঘেঁষা চেহারা। তাও চারুপ্রভার হাতে পড়লে ঘসে—মেজে সমাজে তুলতে পারতেন। মেয়ে ‘তেলি হাত পিছলে গেলি’ বলে পিছলে গেছে।
মেয়ের সম্পর্কে অতএব কোন মূল্যবোধ নেই চারুপ্রভার।
অতএব জিপসি সারা সন্ধ্যা এই তিনতলা প্রাসাদের কোন একখানে একা একা পড়ে, লেখে, গান গায়, রেডিও শোনে, ফ্রীজ খুলে খুলে ঠাণ্ডা জল খায়, এবং ওই মস্তান চাকরগুলোকে শাসন করে, ফরমাশ খাটায়।
বাকি সময় শুয়ে থাকে।
গ্র্যাজুয়েট হওয়া হয়ে গেছে, আর পড়বে না। অধিক উচ্চশিক্ষার প্রতি মোহ নেই তার।
এ হেন জিপসি।
হেলা ফেলা হালকা—স্বভাবের মেয়ে। তবু বিজনবিহারী কেন যে ভয় করেন তাকে!
উনিও বেরোবার আগে মেয়ের ঘরের পর্দা ফেলা দরজার কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ান, একটু ইতস্ততঃ করেন, কিন্তু ডাকেন না।
বরং পাছে টের পায় তাই যাকে বলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে হেঁটে পার হয়ে যান সেখানটা।
হঠাৎ আজ দাঁড়িয়ে পড়লেন।
গলা শোনা যাচ্ছে খুকুর।
কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। কার সঙ্গে?
বান্ধবী, না বন্ধু?
কী বলছে!
বিজনবিহারী ওর সেই তরল কৌতুকের গলা শুনতে পেলেন, হি হি হি।
‘আমাদের বাড়ির তো সবই মজার। বাবা জানে মা মহিলা সমিতিতে যাচ্ছে, আর মা জানে বাবা বোধহয় গুরু আশ্রমে যাচ্ছে। অবশ্য ওটা অনুমান। গাড়ি টাড়ি ছেড়ে দিয়ে যে রকম দীনহীন ভাবে যায়। হি হি হি।’
এই কথা বলছে খুকু! এ কী কথা!
কী ভাবে যে চলে এলেন বিজনবিহারী সেখান থেকে, সে তাঁর অন্তরাত্মাই জানে।
বুকের মধ্যে যেন ধমাস ধমাস করে হাতুড়ির ঘা পড়ছে।
বাবা জানে না মহিলা সমিতিতে যাচ্ছে, মা জানে বাবা—
কিন্তু খুকু নিজে কী জানে?
অন্য সকলের জানার পরিধি সঙ্কীর্ণ করবার জন্যে বিজনবিহারী নিজের গাড়িতে যান না, পাছে ড্রাইভারের দ্বারা জানাজানিটা বাহিত হয়ে আসে। তবু একথা বলছে খুকু!
কাকেই বা বলছে?
আচ্ছা খুকু কি তাহলে কোনদিন ফলো করেছে বিজনবিহারীকে?
আজও কি করবে?
বিজনবিহারী ঠিক করলেন আজ আর সেখানে যাবেন না, যেখানে নিতান্ত দীনহীন বেশে যান।
ট্যাক্সিটাকে বললেন, ‘ময়দান চল।’ ঘুরলেন খানিকটা অকারণ, কিন্তু মন ছটফট করতে লাগল। পাঞ্জাবির ভিতর পকেটের বস্তুটা যেন ঠ্যালা মারছে।
গতকাল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিলেন, নিয়ে যাওয়া হয় নি, আজ টাকাটা না দিলেই নয়। অসুবিধেয় পড়ে যাবে গৌরী।
অতএব কিছুক্ষণ পরে শশী বড়াল লেনের একটি ছোট একতলা বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে দেখা গেল বিজনবিহারীকে।
বি. বি. দত্তকে যারা জানে চেনে, তারা দেখতে পেলে অবাক হয়ে যেত সন্দেহ নেই।
কড়াটাকে একবার বৈ দু’বার নাড়তে হল না, দরজা খুলে গেল।
একজন মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক দরজাটি খুলে ধরেই অস্ফুটে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করল, ‘এত দেরী যে?’
‘দেরী হয়ে গেল একটু—’
ঢুকে গেলেন বিজনবিহারী।
কথাটা প্রশ্নের উত্তর নয়, তবু আপাতত ওর বেশী কথা মুখে জোগাল না বিজনবিহারীর।
দরজাটা বন্ধ করে স্ত্রীলোকটিও পিছন পিছন চলে গেল।
জগতে কত রকম অবিশ্বাস্য ঘটনাই ঘটে।
না, প্রকৃতির রাজ্যে নয়, মানুষেরই রাজ্যে।
ভেবে দেখলে—মানুষ জাতটাই অবিশ্বাস্য রকমের ‘অবিশ্বাস্য’। সে যে কী করতে পারে, আর কী করতে না পারে!
জীব—জগতে সব প্রাণীরই নিজস্ব একটা রীতি—নীতি আছে, নিজস্ব ধর্ম আছে, অবিচল একটা চরিত্র আছে। সাপ সাপেরই মত, বাঘ বাঘের মত। হরিণ, ময়ূর, কুকুর, বিড়াল, প্রজাপতি, টিকটিকি, সকলেই নিজ নিজ চরিত্রের নির্ভুল ভূমিকা পালন করে চলেছে। ওদের চরিত্রহীন হবার ভয় নেই। একমাত্র মানুষ নামের প্রাণীটারই নিজস্ব কোন ধর্ম নেই, নেই নিশ্চিত একটা চরিত্র। কাজেই তার সম্পর্কে কোন নিশ্চিন্ততাও নেই।
যে—কোন লোক যে—কোন সময় যাহোক একটা কিছু করে বসতে পারে। তার নিজস্ব বিধানে যেটা অন্যায় অবৈধ উল্টোপাল্টা।
নইলে বিজনবিহারীর মত একজন ভদ্র, শান্ত, ভীরু প্রকৃতির লোক এমন একখানা কাণ্ডের নায়ক হতে পারেন?
কে ভাবতে পারবে বালিগঞ্জ প্লেসের ওই বিরাট তিনতলা অতি—সুসজ্জিত বাড়ির সংসার এবং চারুপ্রভার মত অতি—উজ্জ্বল একখানি স্ত্রীর মালিক বিজনবিহারী দত্ত শশী বড়াল লেনের একখানা পচা পুরনো একতলা বাড়িতে গৌরীবালা নামের নেহাত বাজে চেহারার আর নেহাত সাধারণ বুদ্ধির একটি স্ত্রীলোককে নিয়ে দ্বিতীয় একটি সংসার পেতে রেখেছেন। আর কে ভাবতে পারবে এই সংসারটিতেই তাঁর সংসার স্বাদের, পরম পরিতৃপ্তির। যেন এটাই আসল।
অথচ কে না বলবে এটা অবৈধ।
কিন্তু বিজনবিহারীর মুখের রেখায় অপরাধীর গ্লানি নেই। অথচ অন্য আর সব কারবারী লোকেদের মতন দোকানে ইনকামট্যাক্সের নাকের সামনে ধরে দিতে দ্বিতীয় একখানা খাতা রাখার কথা ভাবতেই পারেন না বিজনবিহারী। খুব গর্হিত বলে মনে করেন ওই কাজটাকে।
তবে?
মানুষ জাতটা একটা অবিশ্বাস্য রকমের উল্টোপাল্টা জীব কিনা।
বাড়িটা সেই আদ্যিকালের প্যাটার্নের।
ছোট্ট উঠোন, নীচু দাওয়া, দাওয়ার সামনে খান দুই শোবার ঘর ধারের দিকে রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, উঠোনের একধারে করোগেট শেডের নাইবার ঘর—টর। অর্থাৎ শশী বড়াল লেনের একেবারে প্রান্তসীমায় যেমন বাসটি হওয়া উচিত ঠিক তেমন।
দাওয়ায় উঠে সামনে পড়ে থাকা সরু বেঞ্চটাতেই বসে পড়ছিলেন বিজনবিহারী, গৌরীবালা তাড়াতাড়ি বলে উঠল ‘এখানে কেন? একেবারে ঘরেই চল।’
‘ঘরে বড্ড গরম না?’
‘গরম তা কী?’
গৌরীবালা জোর দিয়ে বলে, ‘বাতাস করতে আমার হাত ক্ষয়ে যাবে নাকি?
বিজনবিহারী জানেন, ওই ‘ঘরে বসানো’ নিয়ে গৌরীর বিশেষ একটা আকুলতা আছে। বিজনবিহারী যদি কোনদিন দশ—পনেরো মিনিটের জন্যেও আসেন, গৌরীবালা ঘরে না বসিয়ে ছাড়ে না। যেন বিজনবিহারী একবার ওই ঘরে ওই অযত্নে পাতা বিছানায় না বসলে গৌরীর সব মিথ্যে।
‘তবে চল।’
বলে বিজনবিহারী ঘরে ঢুকে এলেন। ছোট ঘর, তবু তার মধ্যেই ঘরজোড়া এক তক্তপোষ।
এ দেখে বিজনবিহারীর বালিগঞ্জ প্লেসের সেই বৃহৎ ঘরের দু দেয়ালে ঘেঁসে পাতা দু’খানা সিঙ্গল খাটের ছবি মনে পড়ে না। মনে পড়ে যায় অতীত যুগের একখানি মাঠসদৃশ খাট।
বিজনবিহারী হেসে হেসে বলেন, ‘নাতি—নাতনী হলেও এই চৌকীতেই শুতে পারবে তুমি, কী বল গৌরী? আমার ঠাকুমা যেমন শুতো।’
নাতি—নাতনী?
গৌরীও হেসে ওঠে ‘ও বাবা! ততদিন বাঁচব?’
গৌরীর হাসিটা বেশ।
চেহারা সাধারণ, কিন্তু অমার্জ্জিত ভাবের ছাপ নেই। বেশ ঝরঝরে, কাটাছাটা হাসি—হাসি। গৌরীর পরনে একটা ঢলঢলে সাদা সেমিজ, আর একখানা বেগুনী চুড়িপাড় মিলের সাদা শাড়ি। হাতে গাছকয়েক চুড়ি আর সরু একজোড়া রুলির সঙ্গে বেশ জবরদস্ত একজোড়া শাঁখা। বয়সের পক্ষে চেহারাটা একটু ছেলেমানুষ—ছেলেমানুষ।
সাজের মধ্যে গৌরীর কপালের সিঁদুরটিপটি। বেশ নিপুণ হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরু করে পরা একখানা লুডোর ঘুঁটির সাইজের টিপ একেবারে কপালের মাঝখানে। মাজা—মাজা শ্যামবর্ণ কপালে মানিয়েছে মন্দ নয়।
বিজনবিহারী এদিক—ওদিক তাকিয়ে গৌরীর পিঠটা একহাতে একটু জড়িয়ে চাপ দিয়ে বলেন, ‘বাঁচবে না মানে? বললেই হল?’
অতঃপর বিজনবিহারী সেই ঢাউশ চৌকীটার উপর উঠে বসেন পা মুড়ে গুছিয়ে।
সারাদিনই তো চেয়ারে সোফায় কৌচ কেদারায় পা ঝুলিয়ে বসা, এই একটুক্ষণ সময় পা মুড়ে গুছিয়ে বসার আরাম।
ঘরের দেয়াল বিবর্ণ মলিন, জানলা—দরজা রং—চটা, কিন্তু বিছানাটি সাদা ধবধবে। রঙিন চাদর টাদর নয়, স্রেফ সাদা। ঠিক শোবার মতও নয়, মাথার বালিশ পাশের বালিশ বলতে কিছু নেই, মশারীও নেই ধারে—কাছে, ফর্সা ফরাসের উপর ফর্সা ফর্সা গোটা দুতিন ছোট বড় সাইজের তাকিয়া।
তার মানে এটা গৌরীর বেডরুম নয়, ড্রইংরুম।
চৌকীটাই প্রায় ঘরজোড়া, তবু দেয়ালের ধারে ধারে একটা বইয়ের র্যাক, একটা পালিশ খসে যাওয়া টেবিল, একটা ছোট্ট কাঁচের আলমারি, যার মধ্যে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর কিছু খেলনা—পুতুলের সঙ্গে বেশ দামী দামী কিছু খেলনা—পুতুল সাজানো।
টেবিলের ওপর দু একটা বই—খাতা, র্যাকেও ব্রাউন পেপারের মলাট দেওয়া কিছু বই সাজানো। মলাট খুললে দেখা যাবে সবই পাঠ্যপুস্তক। স্কুলপাঠ্য।
বাড়িতে ইলেকট্রিক আলো আছে, কিন্তু পাখা নেই।
লাল শালুর ঝালর দেওয়া একখানা পাখা এনে কাছে দাঁড়িয়ে বাতাস করতে থাকে গৌরী।
বিজনবিহারী কিন্তু বেশীক্ষণ এ আরাম উপভোগ করেন না, গৌরীর হাত থেকে পাখাটা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘বোস তো চুপ করে! আমিই তোমায় বাতাস খাওয়াই।’
বলে পাখাটা নিয়ে জোরে জোরে নাড়েন যাতে দু’জনেরই গায়ে বাতাস লাগে।
এখন আবার গৌরী ব্যস্ত হয়, ‘তুমি আমায় বাতাস করবে? নরকেও ঠাঁই হবে না যে আমার। দাও তো!’…কাড়াকাড়ি চলে।
কাড়াকাড়িতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজনবিহারীরই জিত হয়।
‘তোমার সঙ্গে কে পারবে?’
বলে সাদাসিধে একটু মিষ্টি হেসে গৌরী বলে, ‘তবে খাও নিজে নিজে হাওয়া, আমি যাই চা—টা নিয়ে আসি।’
বলে চলে যেতে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘সন্ধ্যেটা তো সবই পুইয়ে এলে চায়ের সঙ্গে খাবে তো কিছু?’
দোকান থেকে ফিরে বাড়িতে টাইম—মাফিক চা—টা বিজনবিহারীকে খেতেই হয়। অনিয়ম চারুপ্রভা বরদাস্ত করতে পারেন না। তিনিও খান এসময়।
সকাল বিকেল দু’বেলা মেয়েকে এবং কর্তাকে চায়ের টেবিলে বসিয়ে, কতকগুলো কেক, পেস্ট্রী, স্যাণ্ডুইচ, বিস্কুট এবং তৎসহ কিছু কাজু—টাজু তাদের পেটের মধ্যে চালান করিয়ে দেওয়াটা চারুপ্রভা গৃহিণীর অবশ্যকরণীয় বলে মনে করেন। কাজেই বিকেলের চা—টা খেতেই হয় বাড়িতে।
তবু বিজনবিহারীর শশী বড়াল লেনের কয়লার উনুনে জল গরম করা মোটামুটি পেয়ালায় রাখা একটু চা না খেলে চলে না। তার সঙ্গে আনুষঙ্গিকও কিছু।
গৌরীর কাছে খাওয়া বলতে তো শুধু এই সময়টুকুই! এটুকুও যদি ও না পায়, সেটা ওর প্রতি রীতিমত অবিচার করা হয়। তাছাড়া—এখানে বিজনবিহারী খাবার পাত্রে হারানো অতীতকে ফিরে পান।
গৌরীর প্রশ্নের উত্তরে প্রতি—প্রশ্ন করলেন বিজনবিহারী, ‘কী আছে?’
‘আমার কাছে আর কী থাকবে?’ গৌরী একটু বিষণ্ণ হাসি হাসে, ‘ভাগ্য তো করে আসিনি। তুমি মুড়ি ভালোবাসো বলে বিকেলে মুড়ি আর ঝালছোলা নিয়েছিলাম, আর ঘরে চারটি কলাইয়ের ডালের ফুলুরি ভেজেছিলাম—’
‘চমৎকার! চমৎকার! অতি উপাদেয় হবে,’ বিজনবিহারী বলে ওঠেন, ‘এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, তুমি বললে বলে টের পাচ্ছি, দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। নিয়ে এসো চটপট।’
গৌরী একটু অভিমান—অভিমান মুখে বলে, ‘এখন নিয়ে এসো চটপট।
আর সন্ধ্যে থেকে আমার একেবারে যা প্রাণ ছটফট করছিল।’
বিজনবিহারী মৃদু হেসে বলেন, ‘এখনো প্রাণ ছটফট? বয়েস কত হল?’
‘আহা! কী কথার ছিরি! দুর্ভাবনা হয় না বুঝি?’
‘দুর্ভাবনা আবার কিসের?’
‘নয়ই বা কিসের? জগতে রাতদিন কত কী ঘটছে!’
বিজনবিহারী বড় একটা ও—বাড়ির কথা এ—বাড়িতে বলেন না, তবু আজ বলে ফেললেন। বললেন, ‘জানো গৌরী, ওখানে যদি আমি সারারাতও না ফিরি, চারু ভাবনা—টাবনা করবে না।’
গৌরী বিস্ময় প্রকাশ করে না, সমালোচনার দিকেও যায় না, বরং ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, ‘না করবে না। বলেছে তোমাকে। মেয়েমানুষের প্রাণ, ভাবনা না করে থাকতে পারে বুঝি?’
‘সব মেয়েমানুষের মধ্যেই ‘মেয়েমানুষের প্রাণ’ থাকে না গৌরী।’
‘থাকে না বৈ কি। থাকতে বাধ্য। তবে কেউ কেউ হৈ—চৈ করে বলে মরে, কেউ শক্ত হয়ে বসে থাকে, প্রকাশ করে না।’
‘তা হবে।’
বলে পকেট থেকে লাইটার বার করে সিগারেট ধরান বিজনবিহারী।
গৌরী বেরিয়ে যাবার সময় বলে যায়, ‘খুব চটপট হবে না কিন্তু, তেল জ্বলিয়ে ফুলুরি ক’টা আর একবার ভেজে নেবো। ন্যাতা হয়ে গেছে।’
বিজনবিহারী কেমন অভিভূতের মত বসে থাকেন। ওঁর মনে হয় যেন বহুযুগের ওপার থেকে মাকে কথা বলতে শুনলেন।
ডালের বড়া বাবার ভারী প্রিয় ছিল।
অনেক সময় বাসি বড়াও রেখে দিতেন মা, সকালে বাবাকে চায়ের সঙ্গে খেতে দিতেন আর একবার ভেজে। আর ঠিক এই ভাবে বলতেন, ‘দাঁড়াও আর একবার ভেজে দিই, ন্যাতা হয়ে গেছে।’
আচ্ছা গৌরীর গলার স্বরটা কি বিজনবিহারীর মায়ের মত? তা নইলে ওর কথা শুনলেই হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় কেন কোথায় যেন শুনেছি। কেন মাকে মনে পড়ে যায় হঠাৎ?
সেই অনেক অনেক দিন আগে, প্রথম দিন তো ওই গলার স্বরেই আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বিজনবিহারী।
কার্যগতিকে হঠাৎ নবদ্বীপে যেতে হয়েছিল বিজনবিহারীকে, আর সেই সময় কিসের যেন একটা মেলা বসেছিল ‘পোড়া মা’ তলায়।
মেলার ভীড় কাটিয়ে চলে আসছিলেন বিজনবিহারী, হঠাৎ কানে এল, ‘খোকা, অ খোকা। তুই আবার কোন দিকে গেলি?’
বিজনবিহারীর মধ্যে সহসা যেন একটা ভূমিকম্পের আলোড়ন উঠলো।…
বিজনবিহারীর মনে হল কোনখানে বসে মা ডাকছেন তাকে। মা তো কোনদিন ‘বিজন’ কি ‘বিজু’ বলতেন না, বলতেন ‘খোকা’।
সেই স্বর লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন বিজনবিহারী। মেলার ভীড়ের মধ্যে অমন কতজন কত কাউকে ডাকে, কে কার দিকে তাকায়। ওই আর্ত মেয়ে—গলাটা যে তখনো ডেকে চলেছে, ‘খোকা! অ খোকা! এই লক্ষীছাড়া ছেলে তো দেখছি আমায় আচ্ছা জ্বালাল…’ কে—ই বা শুনছে।
বিজনবিহারী ভেবেছিলেন, কোন মায়ের ছেলে হারিয়ে গেছে ভীড়ের মধ্যে। কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলেন মা নয়, একটা মেয়ে মাত্র। কুমারী মেয়ে।
একখানা সবুজ ডোড়া শাড়ি আর একটা টুকটুকে লাল ব্লাউজ পরা ডাগর—ডোগর স্বাস্থ্যবতী গ্রাম্যমেয়ে।
বিজনবিহারী একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে ওঠেন, ‘কে হারিয়েছে তোমার?’
‘বালাই ষাট হারাবে কেন?’ মেয়েটা ভ্রুভঙ্গী করে বলে, ‘দেখতে পাচ্ছি না। আমার ছোটভাই খোকা। একটু আগে পয়সা নিয়ে ওই দিকে কোথায় গেল—’
বিজনবিহারী সেই অনির্দিষ্ট ‘ওদিক’টায় তাকিয়ে বললেন, ‘কেমন দেখতে তোমার ভাই?’
মেয়েটা এ প্রশ্নকে খুব একটা গ্রাহ্য না দিয়ে নিজেই এগোতে এগোতে বলে, ‘বলে চেহারা বোঝানো যায়? আমার ভাই আমারই মত।’
বিজনবিহারীর অধ্যবসায়ের প্রশংসা করতেই হয়, ভীড় ঠেলে ঠেলে সেই ‘খোকা’কে খুঁজে বার করলেন তিনি।
যেদিকে ধামা কুলো ঝুড়ি চুপড়ির হাট, সেই দিকে একধারে বসে পাঁপরভাজা খাচ্ছিল খোকা।
বিজনবিহারীর সঙ্গে সঙ্গে গৌরীও গিয়ে পৌঁছেছিল, ভাইকে দেখতে পাওয়া মাত্রই সে কোন কথা না বলে টেনে একটা চড় কসায় ঠাশ করে?
বছর আষ্টেকের ছেলেটা আচমকা এমন মার খেয়ে প্রথমটা থতমত খেয়ে গেল, তারপরই রুখে উঠে বলল, ‘মারলি যে?’
‘বেশ করেছি মেরেছি, লক্ষীছাড়া ছেলে! আমি খুঁজে খুঁজে মরছি আর তুমি এই কর্ম করছ? পাজী ছেলে।’
বসাল পার একটা চড়।
বলাবাহুল্য পাঁপর ভরা মুখেই কেঁদে উঠল।
‘দিদি আমায় মারলি?’
এবার দিদির পালা।
‘তুই আমায় এত ভোগালি কেন?’ বলে সে—ও কেঁদে ফেলল।
‘আহাহা মার—টার কেন,’ কান্নাকাটি কেন, বলে বিজনবিহারী তাদের ভীড়ের পাশ কাটিয়ে বার করে আনলেন।
টের পেলেন না অদৃশ্য কোন গ্রহের চক্রান্তে সেই মুহূর্তে নিজে নাগপাশে পড়ে গেলেন।
গ্রহের চক্রান্ত ছাড়া পথে যেতে যেতেই ছেলেটা বমি শুরু করবে কেন? এবং শেষ পর্যন্ত বিজনবিহারীকে দিয়েই শেষকৃত্য করিয়ে নেবে কেন?
গৌরী আর গণেশ মা—বাপমরা দুই ভাই—বোন ঠাকুমার কাছে মানুষ হচ্ছিল, কিছুদিন আগে ঠাকুমা মরেছে। ছোটভাইটাকে বাঘিনীর মত আগলে রাখছিল গৌরী, রাখতে পারল না।
পাড়ার লোকজন কেউ তেমন গা করে উঁকি মারল না। শুধু কলেরা রুগীর বাড়ি বলেই নয়, বেশী সহানুভূতি দেখাতে গেলেই পাছে ওই নির্বান্ধব নিঃসহায় মেয়েটা ঘাড়ে পড়ে যায়, এ ভয়ও ছিল।
অতএব ওই নিঃসহায় মেয়েটা মাটিতে লুটোপুটি করে কাঁদতে লাগল, ‘ওরে খোকা, আমি যে তোকে জীবনে কখনো মারি নি। একদিন মারলাম বলে তুই চলে গেলি?’
এ দৃশ্যের দর্শকের আসনে শুধু বিজনবিহারী, কলকাতার কাজকর্ম ফেলে পুরো দুটো দিন এদের নিয়েই উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরছেন। চেষ্টার ত্রুটি হয়নি, বিজনবিহারী এমন দৈবপ্রেরিত হয়ে এসে না পড়লে কিছুই হত না, তবু সব কিছুই বৃথা হল।
কিন্তু সে যা হল তা হল, বিজনবিহারী এখন এই দীনদুঃখী শোকার্ত মেয়েটাকে একলা ফেলে রেখে ফিরে যান কী করে? অথচ নিজের বাড়ীতে নিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
জিপসি তখন বছর খানেকের মেয়ে এবং চারুপ্রভা তখন ধাপে ধাপে উঠেছেন। বাড়িতে নিয়ে এসে ওর ইতিহাস বলে চারুপ্রভার কাছে গছিয়ে দেওয়া?
ও বাবা!
ভাবাই যায় না।
তাছাড়া—যদিই তেমন অসমসাহসিক কাণ্ড করতে পারেনও বিজনবিহারী, চারুপ্রভা কি মনে রাখবে ও একটা ভদ্র গেরস্থঘরের মেয়ে? নির্ঘাৎ ওকে বাচ্চার ঝি বানিয়ে ছাড়বে!
বিজনবিহারী অন্য চিন্তায় গেলেন।
ভাবলেন কিছুদিন ওকে সাবধানে কোথাও রেখে, দেখে—শুনে একটা বিয়ে দিয়ে ফেলবেন।
সাবধানে রাখতেই অত খুঁজে খুঁজে শশী বড়াল লেনের ওই বাসাটা ভাড়া করে ফেললেন, এবং একটা ঝি রেখে দিলেন। কিনে কিনে জড়ো করলেন একটা সংসারে যা লাগে, একটা মেয়ের যা লাগে।
কিন্তু মনের মত পাত্র কোথায়?
অমন গুণের একটা মেয়েকে তো যা—তা ছেলের হাতে সঁপে দেওয়া যায় না।
বিজনবিহারী পাত্র খুঁজছেন।
মানে কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, আর ভাবছেন গৌরীর ভাগ্যে যেন একটি মহাদেব তুল্য বর জোটে।…কিন্তু—
ইত্যবসরে গৌরী নামের মেয়েটা কৃতজ্ঞতায় কৃতজ্ঞতায় মরে বসে আছে।
বিজনবিহারীর এ খবর জানার কথা নয়, তিনি শুধু উপযুক্ত পাত্র খুঁজে খুঁজে জেরবার হচ্ছেন।
অনেকগুলো দিন মাস বছর কাটিয়ে ফেলে বিজনবিহারী যখন ওকে বাড়ি ছাড়া করবার আয়োজন প্রায় সম্পূর্ণ করে তুলেছেন, তখন হঠাৎ একদিন গৌরী আছড়ে পড়ে কেঁদে ঘোষণা করল, শশী বড়াল লেনের এই স্বর্গধাম থেকে এক পা—ও কোথাও যাবে না।…বিজনবিহারী যদি তবুও ওকে তাড়াবার ফন্দী করেন, তাহলে গৌরী নিজেই বিজনবিহারীর পায়ের বেড়ি খুলে দিয়ে যাবে, বিষ খেয়ে অথবা গলায় দড়ি দিয়ে।
কান্না—টান্না সইতে পারে না বিজনবিহারী তাই বিচলিত হয়ে গিয়ে ‘তুমি আমার পায়ের বেড়ি গৌরী? তাই জন্যেই আমি তোমায়—’ বলে তাকে টেনে নিয়ে আদর—ফাদর করে একাকার করে বসলেন।
এরপর আর পাত্র খোঁজার কথা ওঠে না। বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
গৌরী বেশ কিছুকাল যাবৎ ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ অবস্থায় তার সাধের স্বর্গধামে অবস্থান করল, কিন্তু খুব অধিক দিন চলল না সেটা।
বিজনবিহারীর অনবরত আসা—যাওয়া এবং সমস্ত সময়ই উপঢৌকন আনা, পাড়ার লোকের দৃষ্টিকে পীড়িত করল। লোকটা এ পাড়ায় পরিচিত নয়, আসল নামও কেউ জানে না, কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় পয়সাকড়ি আছে।
তবে?
একটা বয়স্থা কুমারী মেয়েকে এইভাবে পুষে রেখে দিয়ে আসা—যাওয়ার অর্থটা কি, বোঝে না কেউ? ভদ্রপাড়ায় এসব চালাতে দেওয়া চলবে না। পাড়াটা বেওয়ারিশ নয়।
বেওয়ারিশ নয়, কাজেই পাড়ার দায়িত্বশীল ওয়ারিশগণ একদিন ওই আসা—যাওয়ার পথের ধারে ওৎ পেতে বসে থেকে চেপে ধরলেন অজানা—অচেনা এই দুশ্চরিত্র লোকটাকে।
তাঁদের দাবি সামান্য।
হয় ওই পাপের মূল সমেত এপাড়া থেকে উচ্ছেদ হয়ে যান বিজনবিহারী, নচেৎ ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে ভদ্রভাবে জীবন যাপন করুন।…বিজনবিহারীকে বলতেই দিল না তিনি বিবাহিত এবং মেয়েটার ইতিহাস কি।
সমূলে উচ্ছেদ হওয়া বড় শক্ত। কলকাতায় তখন আর ইচ্ছে করলেই ভাড়াটে বাড়ি জোটে না। তাছাড়া ওই বুড়ি ঝিটা? ও না—থাকা মানেই তো চোখে অন্ধকার। অন্য পাড়ায় গেলে ওকে হারাতে হবে। তাহলে?
পরামর্শটা গৌরীই দিল।
মাথায় খানিকটা সিঁদুর লেপে দিলেই যদি ওই ক্ষেপে যাওয়া লোকগুলোকে শান্ত করা যায় তো তাই করা হোক। আট আনায় এক থান সিঁদুর কিনে নিয়ে এসে দাও ঢেলে।
বিজনবিহারী অবশ্যই এমন অদ্ভুত প্রস্তাবকে এক কথায় মেনে নেননি। কিন্তু ফোঁটা ফোঁটা জলে পাথর ক্ষয় হয়, সে জায়গায় মানুষ তো কোন ছার।
ক্ষয় হয়ে যাওয়া পাথর অবশেষে একদিন সিঁদুর কিনে নিয়ে এলো, দেগে দেবে বলে!
কিন্তু হঠাৎ মন ঘুরে গেল বিজনবিহারীর। বলে বসলেন—’তাই যদি করতে হয় তো একটা দেবস্থানে গিয়েই হোক। তোমার তো এই প্রথম সিঁদুর পরা?’
হল তাই।
কালীঘাটে নয়, কালীঘাটের নামেই যেন বিয়ে—বিয়ে গন্ধ। দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে গেলেন বিজনবিহারী মিথ্যে সিঁদুর দিতে মেয়েটাকে। বেশ বেড়ানোও হবে। তারপর?
তার পরের ঘটনা?
তার পরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত ।
তার পরের ঘটনা অতি প্রাঞ্জল। সেই মিথ্যে সিঁদুর কখন কোন ফাঁকে যে সত্যি হয়ে উঠল, দুজনের একজনও খেয়াল করেনি!
এক সময় দেখা গেল দুজনেই ওই মিথ্যেটাকে পরম সত্যি বলে গ্রহণ করে বসে আছে।
আছে।
তদবদিই আছে।
ঋতুচক্রের আবর্তনে গৌরী নামের সেই সবুজ ডোরা শাড়ি পরা মেয়েটা দিব্যি ‘গিন্নী’ হয়ে গেছে।
প্রথমদিকে ও বিজনবিহারীকে ‘আপনি’ করে কথা বলত, বিজনবিহারীই শোরগোল তুলে আপত্তি করলেন। ‘আপনি’ বললেই কেমন পর পর লাগে। এখন যখন এতটা ঘনিষ্ঠতা এসে গেছে।
তবে আর কী।
যাতে বর বর লাগে তাই বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেল গৌরী।
অভ্যাসটা পাকা হল একবার নবদ্বীপে গিয়ে দিন চারেক থেকে।
‘কাজের খাতিরে’ যেতে হয়েছিল বিজনবিহারীকে, গৌরী গেল জন্মভূমিকে আর একবার দেখতে।
চারুপ্রভাকে অবশ্য বলতে হয়েছিল ‘আসানসোল যাচ্ছি।’
নবদ্বীপ শুনলে চারুপ্রভা নাক তুলে প্রশ্ন করবে নবদ্বীপে আবার ভদ্রলোকের বার বার কোন কাজ থাকতে পারে?
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই বিজনবিহারীকে ‘কাজের খাতিরে’ বাইরে যেতে হয়েছে, যেমন আসানসোল, রাঁচী, দুর্গাপুর, টাটা। এখনো হয় মাঝে মাঝে।
তবে এখন আর চারুপ্রভা প্রশ্ন তোলেন না। পুরুষমানুষ কাজের খাতিরে বাইরে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক। সভ্যতা।
‘ঘরকুনো’ পুরুষ চারুপ্রভার দু’চক্ষের বিষ।
শশী বড়াল লেনের এই ছোট্ট বাসাটা গৌরীর কাছে স্বর্গধাম, তবু মাঝে মাঝে ওই রেলগাড়ী চড়ে বাইরে চলে গিয়ে দু’দশদিন কাটিয়ে আসা, যেন বৈকুণ্ঠলোকের স্বাদবাহী।
কিন্তু গৌরী বুদ্ধিমতী।
গৌরী আত্মস্থ।
গৌরীকে যে মানায়, গৌরী শুধু সেইটুকুই করে, যে মানায় না, তা শত লোভনীয় হলেও গ্রহণ করে না।
বিজনবিহারীর তো টাকার অভাব নেই, বিজনবিহারী দামী দামী শাড়ী—গহনা দিতে এসেছেন গৌরীকে, গৌরী হেসে বলেছে, ‘ও যাকে মানায়, তাকেই দাও গে।…আমার এই সংসারে যেমন মানায়, তেমনি এনো। এই বাসায় থেকে যদি নিত্যনতুন দামী দামী শাড়ী—গয়না পরি লোকে ফের ভাববে বাবু ‘মেয়েমানুষ’ রেখেছে।’
তাছাড়া এখন তো আবার ছেলে—মেয়েরা বড় হয়ে উঠেছে।…
হ্যাঁ, ছেলে—মেয়ে গোটা তিনেক এসে গেছে।
গৌরীর তো সেই খেলার সিঁদুরটাই জীবনের আসল সিঁদুর। তার কাছে ওটা পরম সত্য। কাজেই ছেলে—মেয়ে এসে যাওয়াকে গৌরী গর্হিত বলে ভাবেনি। এবং চারুপ্রভার মত ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ মন্ত্রেও বিশ্বাসী নয় সে।
ছেলে—মেয়েরা বড় হয়ে ওঠা পর্য্যন্ত ডুরে শাড়ি, রঙিন শাড়ি ছেড়েছে গৌরী।
বলে, ‘মা সাজগোজ করছে, এটা বড় দৃষ্টিকটু।’
এমনিতেই তো বাপের সম্পর্ক ওদের বহুবিধ কৌতূহল, প্রশ্ন।
বাবা কেন অন্য জায়গায় থাকে? ইস্কুলের আর সব ছেলেমেয়েদের বাবা তো একই বাড়িতে থাকে। বাবা যেন কুটুম।
এই রকম সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে গৌরীকে।
গৌরীর অবশ্য গল্প বানানোর ক্ষমতা অসীম।
বিজনবিহারীর অগাধ কাজের ফিরিস্তি দিয়ে দিয়ে তাদের বুঝিয়ে রেখেছে গৌরী। তাছাড়া নবদ্বীপের ইতিহাসটিও শাখা পল্লবিত করে বলে বলে ওদের কাছে ওদের বাপকে দেবতা করে রেখেছে।
বিজনবিহারীর ভেবে আশ্চর্য লাগে চারুপ্রভার জীবনের ধ্যান—জ্ঞান হচ্ছে বিজনবিহারীকে মেয়ের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করা।
মনটা আবার চঞ্চল হয়ে উঠল।
খুকু তখন ও—কথা বলল কেন?
খুকু বিজনবিহারীর এই দ্বিতীয় সংসার—জীবনের কথা জানে?
যদি জানে, তো কী করে জানল?
একটা থালার ওপর বসিয়ে ফুলুরি, চা, আর তেলমাখানো মুড়ির বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকল গৌরী।
বলে উঠল, ‘কী গো, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
‘ঘুমিয়ে?’
‘তা সেই রকমই তো দেখছি, হাতের সিগ্রেটটা তো পুড়ে এতটুকু হয়ে গেছে, আরটু হলেই ছ্যাঁকা লাগত আঙুলে।’
বিজনবিহারী মৃদু হেসে বলেন, ‘ঘুম নয়, স্মৃতি!’
‘স্মৃতি!’
‘হ্যাঁ, হঠাৎ সেই নবদ্বীপের মেলার কথা মনে পড়ে গেল, যেখানে তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা।’
গৌরী চৌকীর ধারে একটা টুল টেনে এনে থালাটা নামিয়ে রেখে বলে, ‘ভাবছ তো কী কুক্ষণেই সেই দেখাটা হয়েছিল!’
‘কুক্ষণ?’
বিজনবিহারী গভীর গলায় বলেন, ‘না গৌরী, ভাবছিলাম কী শুভক্ষণই ছিল সেটা আমার জীবনে! এই শশী বড়াল লেনের বাড়ীতে, তোমার সঙ্গ—সাহচর্যে আমি যেন আমার নিজেকে খুঁজে পাই, যে আমি তালতলার দত্তবাড়ির ছেলে—’।
গৌরীও একবার গভীর চোখে তাকায়। তারপর বলে ‘নারায়ণ বিদুরের ঘরে ক্ষুদ খেয়ে সব থেকে তৃপ্তি পেয়েছিলেন, সেটা নারায়ণের মহত্ত্ব।…এখন ভাবনা—চিন্তা ছেড়ে খাও তো। চা—টা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
বিজনবিহারী মুড়ির বাটি থেকে একথাবা তুলে নিয়ে বলেন, ‘একা খাব?’
‘খাও না বাপু। আমাদের তো হয়ে গেছে একবার।’
‘উহুঁ তোমার হয়নি…’
গৌরী হেসে ফেলে।
‘বেশ বাপু হয়নি তো হয়নি। ফুলুরি ভাল লাগছে?’
‘ভাল লাগবে যদি তুমিও একসঙ্গে’—বলে গৌরীর হাতে দুটো ফুলুরি তুলে দিয়ে, নিজে একটাতে কামড় দিয়ে বলেন, ‘অপূর্ব!’
আচ্ছা চারুপ্রভা যদি এই দৃশ্যটি দেখতে পেতেন?
একটা দীনহীন ঘরের মধ্যে জারুলকাঠের একটা ঢাউশ চৌকিতে বসে বিজনবিহারী কলাইডালের ফুলুরিতে কামড় দিয়ে পরিতৃপ্তিতে চোখ মুদে বলছেন ‘অপূর্ব’!
চারুপ্রভা কি তদ্দণ্ডে বিষ খেতে যেতেন?
অথবা খেতে হত না, এমনিতেই হার্টফেল করতেন?
নাকি বিজনবিহারীকেই শক্ত কায়দায় ফেলে মেণ্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দিতেন?
কী যে করতেন ভাবা যায় না।
দেখতে পান না এই রক্ষে।
এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরকাল অদ্ভুত এক কৌশলে দৃশ্যটাকে বিজনবিহারী তাঁর পরিচিত সমাজ থেকে আড়াল করে রেখে আসছেন।
চারুপ্রভার একটা অবজ্ঞাসূচক ধারণা আছে, বোধহয় কোন গুরু—ফুরুর বুজরুকির গাড্ডায় পড়ে আছে লোকটা, চারুপ্রভার ব্যঙ্গহাসির সামনে থেকে আড়াল করে রাখতে চায়।
গৌরী হেসে বলে, ‘তোমার যেন সেই রূপকথার সুয়োরাণীর মত পদ্মপাতা পেতে নুন—পান্তা খাবার সাধ। বাড়িতে তোমার কত ভাল খাবার গড়াগড়ি মাড়ামাড়ি, আর তুমি এখানে এই তুচ্ছ বস্তু—’
‘গৌরী! বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, আমার কাছে বাড়ি বলতে এটাই। এখানে এসে বসলেই যেন আমি নিজেকে খুঁজে পাই। মনে বিশ্বাস আসে আমি সেই তালতলার দত্তবাড়ির ছেলে।…আমার মা—র ঘরের দেয়ালে মায়ের হাতের বোনা ঠিক এমনি একটা কার্পেটের ছবি টাঙানো থাকত, জান? ওই যে গাছের ডালে দুটো পাখি, তলায় লেখা ‘দুটি পাখি দুটি প্রাণ, সুখে রেখো ভগবান’। আচ্ছা তুমি তো সেটা দেখনি, ঠিক তেমনি বোনা বুনলে কী করে? আশ্চর্য!’
গৌরী হেসে ফেলে, ‘ও মা’ এ তো ছকে বাঁধা প্যাটার্ন, দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। ঘর গুণে কাজ তো, ঠিক একরকমই হয়।… আসলে ওটা আমার মায়ের আমলের, বাক্সের তলার দিকে রেখে দিয়েছিল মা, হয়তো পরে বুনবে বলে। আর সময় পায় নি।…আমার দেখে মন কেমন করেছিল, তাই বসে বসে বানিয়েছিলাম।’
‘তোমার সঙ্গে আমার ভাগ্যের একটা আশ্চর্য মিল আছে গৌরী। তোমারও ছেলেবেলায় মা গেছে, আমারও—’
গৌরী আস্তে বিজনবিহারীর হাঁটুর উপর একটা হাত রাখে। ওই হাতের ছোঁওয়াটুকুর মধ্য দিয়েই যেন প্রবাহিত হয়ে আসে ভালবাসা সহানুভূতি শ্রদ্ধা।
গৌরী মনে—প্রাণে জানে বিজনবিহারী তার স্বামী, তবু গৌরী নিজেকে অনেক নীচেয় রেখে ভাবে। যেন বিজনবিহারী এক দূর আকাশের তারা, আপন মহত্ত্বে মাটিতে নেমে এসেছেন তৃণখণ্ডটুকুকে দয়া করতে।
গৌরী এত কিছু লেখাপড়া জানে না যে এমন সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে নিজেকে বুঝবে, অথবা বিজনবিহারীকে ঠিক অনুভব করবে, তবু সহজাত অনুভূতিতে যেন অনেকটা বুঝতে পারে।
বিবাহিত জীবনে যে সুখী নয় লোকটা, এত টাকা রোজগার করে, ধনবান নাম অর্জন করেও যে ভিতরে ভিতরে কাঙাল, এটা বুঝতে পারে গৌরী।
‘এদের দেখছি না যে?’
খাওয়ার শেষে হাত ধুয়ে বিজনবিহারী এদিক—ওদিক তাকিয়ে গৌরীর আঁচলটায় একপ্রান্তে ভিজে হাত মুছতে মুছতে বলেন, ‘এদের দেখতে পাচ্ছি না যে?’
এই একটা ছেলেমানুষী আছে বিজনবিহারীর, ওই শাড়ির আঁচলে হাত মোছা। ছেলেবেলার স্মৃতিতে দৃশ্যটা যেন জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। বাবা ভাবত বিজুটা বাচ্চা, ও কিছু বুঝতে পারে না, তাই কাজে বেরোবার সময় খাওয়ার পরের ভিজে হাতটা মায়ের শাড়িতে মুছে নিত। মা চাপাগলায় বলত, ‘এই যা! বাইরের কাপড়ে ছুঁয়ে দিলে তুমি আমায়! মায়ের রান্নাঘরে কাজ রয়েছে এখনো—’
বাবা হেসে বলত, ‘তবে গঙ্গাজল মাথায় ছিটোওগে, মেথরে ছুঁয়েছে যখন—’
এই সব বাক্য—বিনিময়ের মধ্যে মা—বাবার মধ্যে যে দৃষ্টি—বিনিময় হত, সেটা যে অন্য আর সকলের সঙ্গে পৃথক তা ওইটুকু ছেলেও বুঝে ফেলত। তাই অন্যমনস্কের ভান দেখিয়ে আজেবাজে খেলা খেলতে খেলতে আড়ে আড়ে তাকিয়ে দেখত পাকা ছেলেটা।…
দাম্পত্য সুখের এই সব ছবিই বিজনবিহারীর ধারণার জগতে ছিল।
চারুপ্রভা তাঁকে সেই ছবির রাজ্য থেকে টানতে টানতে বহু বহু দূরে নিয়ে চলে গেছেন, যেন কর্তিত বৃক্ষকাণ্ডের মত।
বিজনবিহারীর প্রায়ই এই তুলনাটা মনে আসে।
বৃহৎ একটা গাছ, মাটির নীচে ছিল গভীর শিকড়, তাকে সমূলে উৎপাটিত করে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে কাঠ চেরাইয়ের আড়তে। ইচ্ছে মত সাইজে কেটে ছেঁটে র্যাঁদা ঘষে প্লেন করবে তাকে, পালিশ করবে।
তার মানে ওরা ভাবছে ওই রাফ গুঁড়িটাকে সুন্দর চেহারা দেবে।
চারুপ্রভাও বলেন, ‘কী ছিলে আর কী করে তোলা হয়েছে তোমায় ভাবো। ভেবো না শুধু পয়সা রোজগার করারই গুণ। এই তো তোমার মামারা তো খুব পয়সাওলা, তাকিয়ে দেখেছ তাদের বাড়ি? এখনো কর্তারা সকলের সামনে গামছা পরে বসে তেল মাখেন, গিন্নীরা পুরুষ দেখলেই ঘোমটা দেন। এখনো দালানে পিঁড়ে পেতে কাঙালী—ভোজনের মতন লাইন দিয়ে খেতে বসে সবাই, কাচের বাসন ভেঙে যাবার ভয়ে কলাই—করা গেলাসে চা খায়। তা হলেই বোঝ পয়সাটাই সব নয়।’
বিজনবিহারী বলতে পারেন না, ‘সে তুমি যাই বল, মামার বাড়ীতে গেলে এখনো আমার খুব ভাল লাগে।’ বিজনবিহারী সুন্দরী চারুপ্রভার ব্যঙ্গতিক্ত সূক্ষ্ম হাসিটাকে বড় ভয় করেন।
অতএব স্বীকার করতেই হয়, চারুপ্রভাই তাকে দশের একজন করে তুলেছেন।
ছেলেদের কথা তুলতে গৌরী বলল, ‘দেবু তো কোন বন্ধুর বাড়ি পড়তে গেছে, মিঠুর কাল পরীক্ষা তাই পড়া করছে, আর মুনমুনটা ঘুমিয়ে পড়েছে।’
বিজনবিহারী যেন বড় আহত হন।
যেন একটা লোকসান হয়ে গেল তাঁর। বললেন, ‘এত শীগগির ঘুমিয়ে পড়ল?’
‘দুপুরে একটু শোয় না, দস্যিবৃত্তি করে বেড়ায়, আমিও তুমি আসছ না দেখে ঘর—বার করছি, কোন ফাঁকে মাদুরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
‘খাবে না?’
‘রাত্তিরে তুলে খাওয়াব।’
‘মিঠুর এবার কোন ক্লাস হবে?’
গৌরী হেসে ফেলে বলে, ‘হবে ছেলে দেব ভাত, নাম রাখব রঘুনাথ! এটা তো হাফ ইয়ার্লি না কী বলে তাই। শীতকালের পরীক্ষায় ক্লাসে ওঠাওঠি। তখন ক্লাস টেন ছেড়ে এগারো ক্লাসে উঠবে। যদি পাস করে।’
‘কেন, কখনো তো ফেল হয় না, ফার্স্ট সেকেণ্ড হয় তো!’
‘তা হয় বটে।’ গৌরী হাসে, ‘মুখ্যু মায়ের বিদ্বান মেয়ে হবে।’
‘পাস না করলেই যে মুখ্যু হয় তা নয়’, বিজনবিহারী বলেন, ‘তা এত পড়া, একবারও এল না?’
গৌরী অপ্রতিভ হাসি হেসে বলে, ‘আমিই মানা করেছিলাম। আজ যেন মনে হল তোমার মনটা ভাল নেই, অন্যমনা মতন, তাছাড়া—রাতও হয়ে গেছে, তাই ব্যস্ত করতে বারণ করলাম।’
বিজনবিহারী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, ‘এতটা দেখতে পাও তুমি গৌরী? আজ আমার মনটা ভাল নেই একথা তো জানতে দিইনি—’
হেসে ফেলে গৌরী বলে, ‘সবই কি আর জানিয়ে দিলে তবে জানতে হয়?’
বিজনবিহারী গভীর গাঢ় গলায় বলেন, ‘সত্যিই আজ মনটা ভাল নেই গৌরী! মনটায় হঠাৎ একটা খটকা লাগল—আচ্ছা বলব কাল। আমার ওই রাজকন্যে মেয়েটা যে কী টাইপের, বুঝতেই পারি না। কী যে বলে কী যে করে, কাদের সঙ্গে মিশছে তাও ঠিক জানি না। মা তো কিছুই দেখে না।’
গৌরীর মনে হয়তো প্রশ্ন অনেক ওঠে, কিন্তু গৌরী সমালোচনার সুরে কথা বলতে জানে না, অথবা বলতে রাজী নয়। তাই শান্ত গলায় বলে, ‘লোকজন চাকর দাসী তো অনেক। মা আর আলাদা করে কী দেখবে? যাক, রাজকন্যেটির বিয়ে দিয়ে দাও না একটি রাজপুত্তুর যোগাড় করে।
‘পাগল হয়েছ? ওটা হচ্ছে মিসেস চারুপ্রভা দত্তর বিজনেস?
‘বাঃ, পাত্তর খুঁজবে তো তুমি?’
‘তুমি এখনো পঞ্চাশ বছর আগের যুগে পড়ে আছ গৌরী! ওসব আজকাল আর বাবাদের দায়িত্ব নয়।’
গৌরী একটু আবদেরে গলায় বলে ওঠে, ‘তা আমি যখন পঞ্চাশ বছর আগের মানুষ তখন আমার মেয়ের সেই রকমই হোক, মেয়ের বাপ পাত্তর খুঁজে আনুক।’
‘বল কী? এক্ষুনি?’
‘বাঃ এক্ষুনি কী, ষোলয় পা দিয়েছে।’
‘ও তো এখন নেচে বেড়াবার বয়েস।’
‘না না, সে সব আমার ভাল লাগে না বাপু। ষোল কি কম বয়েস নাকি? এই তো বয়েসকাল। বেশি পাকা হয়ে গেলে কি এক গাছের ডাল আর এক গাছে জোড়া লাগে?’
বিজনবিহারী একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বলেন, ‘যে ডাল জোড়া লাগবার জাতের নয়, তাকে কাঁচায় জুড়ে দিলেও কিছু লাভ হয় না গৌরী! তা যাক, তোমার যখন এক্ষুনি শাশুড়ী হবার শখ, তখন পাত্র দেখতে হয়।’
‘আহা আমার যেন শাশুড়ী হবার বয়েস হয়নি?’ গৌরী বলে, ‘দেবু যদি মেয়ে হত, এতদিনে হতাম না শাশুড়ী? পঁয়তাল্লিশ বছর পার করতে চললাম।’
‘আচ্ছা খুব বুড়ি হয়ে গেছ, মেয়েটাকে ডাকো একটু দেখে যাই।’
গৌরী ডাক দেয়, ‘মিঠু এদিকে আয়।’
মিঠু নামের ষোলর পা দেওয়া মেয়েটা লজ্জিত মুখে এসে দাঁড়ায়।
মেয়েটার মুখটাই লজ্জা—লজ্জা।
বিজনবিহারী সস্নেহে তার মাথায় একটা হাত রেখে বলেন, ‘পড় ভাল করে। তোমার মায়ের খুব পড়ার সাধ ছিল, হয়ে ওঠেনি। কিছু চাই—টাই, বল তাহলে, কাল নিয়ে আসব।’
মিঠু মাথা নেড়ে বলে, ‘না চাই না কিছু, সবই তো আছে।’
বিজনবিহারী হেসে ওঠেন, ‘ঠিক মায়ের মত প্রকৃতি হয়েছে। চাই না কিছু। সবই তো আছে। আমার কিন্তু কাল একটা জিনিস আনতে ইচ্ছে আছে।’
‘ওমা, কি আবার?’
‘এখন বলব না। কাল আনলে দেখতে পাবে।’
বিজনবিহারী দাওয়া থেকে নেমে উঠোনে পা দেন। আনমনা গলায় বলেন, ‘এই তো এতক্ষণ দিব্যি আরামে কাটল, এবার যেই বালিগঞ্জ প্লেসের সেই গেটওলা বাড়ির গেটটা পার হব, মনে হবে যেন দিল্লী—বম্বের একটা দামী হোটেলে এসে ঢুকলাম।’
‘বাঃ, সাজানো—গোছানো তো ভালই।’
গৌরী বলে ওঠে কথাটা।
‘ভাল যদি তো নিজে ভালবাসো না কেন? সংসারে যা কিছু করতে যাই, বল কেন অত বাবুয়ানায় কাজ নেই, অত আড়ম্বরে দরকার নেই!’
গৌরী হেসে ফেলে বলে, ‘ঘুঁটেকুড়ুনী রাণীরা তাই বলে।’
‘মাথায় খালি রূপকথা ঘুরছে’—বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন বিজনবিহারী।
দেবু বাড়ি থাকলে দেবুই ট্যাক্সি ডেকে দেয়, আজ নিজেকেই ডাকতে হবে। আজ একটু রাত হয়ে গেছে। ট্যাক্সি পাওয়া শক্ত, তাছাড়া—শশী বড়াল লেনের মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। একটু হেঁটে বড়রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হয়।
তা সেটাও মন্দ নয়।
ট্যাক্সিওলাটাকে যদি কেউ জিগ্যেস করে বসে, ‘কোনখান থেকে এই সোয়ারীকে আনলে তুমি?’
কিন্তু কে প্রশ্ন করবে?
চারুপ্রভার তো ফিরতে আরো রাত হয়। চারুপ্রভার মহিলা সমিতির সংলগ্ন আরো একটি ক্লাব আছে, ব্রীজ ক্লাব। সেটি হচ্ছে স্ত্রী—পুরুষ মিলিত ক্লাব।
অনেক চেষ্টায় খেলাটা মোটামুটি শিখে এই ক্লাবের মেম্বার হয়েছেন চারুপ্রভা। জেদের মাথায় খেলতে খেলতে ঘড়ির দিকে দৃষ্টি প্রায় কারোরই থাকে না।
আজ অবশ্য আলাদা ব্যাপার…মিসেস খাস্তগীরের মেয়ের বিয়ে। পরলোকগত খাস্তগীর সাহেব এত টাকাকড়ি রেখে গেছেন যে ব্রীজের আড্ডায় রোজ হেরেও মেয়ের বিয়ের ঘটাপটায় ঘাটতি হবার প্রশ্ন ওঠে না।
আলোয় মোড়া বাড়িতে সুদৃশ্য ডেকোরেটিং করা মণ্ডপে উঁচু মঞ্চে বর—কনেকে বসানো হয়েছে, এবং একটি নাট্যদৃশ্যের দর্শকের মত চারিদিকে দামী গদি মোড়া চেয়ারে বসে আছেন নিমন্ত্রিতের দল।
কিছুক্ষণ আগে সকলের হাতে হাতে গোলাপের বোকে দেওয়া হয়েছে, এখন গায়ে সেণ্টের স্প্রে দেওয়া হচ্ছে।
এরপর খাওয়া।
পর্দার আড়ালে কোন এক কক্ষে টেবিলে থরে থরে সাজানো আছে সুখাদ্যর রাশি, আর গোছা গোছা শূন্য প্লেট। তুমি ঢুকে যাও, যা ভাল লাগে তুলে নিয়ে খাও, মিটে গেল। আবাহনও নেই, বিসর্জনও নেই।
চারুপ্রভার মনে হচ্ছিল এর থেকে সুন্দর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা আর হতে পারে না। জিপসির বিয়েতে তিনি এই রকমই করবেন।….বরং খরচ আরো বেশীই করবেন।
কিন্তু জিপসি?
ভাবলে প্রাণে সুখ আসে না।
বেচারী চারুপ্রভা!
লোকে বাইরে থেকে দেখে ভাবে, সুখের সাগরে ভাসছেন তিনি, কিন্তু চারুপ্রভা নিজে তো জানেন ভিতরটায় তাঁর কী দাবাদহ।
স্বামী কন্যা, এই দুটোর একটাও তাঁর নিজের নয়, তাঁর মনের মত নয়। জিপসিটাও যে এমন হবে কে জানত। লোকে অবশ্য ভাবে বিজনবিহারীর মত বশংবদ স্বামী পাওয়া বহু ভাগ্যের ফল, এমন কি আত্মীয় নামের শত্রুমহল থেকে স্ত্রৈণ অপবাদও ওঠে বিজনবিহারীর, কিন্তু সে—সব যে কত ফাঁকা চারুপ্রভার মত কে জানে?
তবু চারুপ্রভা ওই লোকসমাজে জগতের সেরা সুখীর ভূমিকায় ঝলসে বেড়ান।
বিজনবিহারী যখন বাড়ির গেটে ঢুকে চারুপ্রভার গ্যারেজটা ফাঁকা দেখে একটা বুক—হালকা—করা নিশ্বাস ফেলে বাড়ি ঢুকলেন, তখন, ঠিক সেই মুহূর্ত্তে উজ্জ্বলা হাসিতে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে বলছে, ‘ভাগ্যিস মিষ্টার দত্ত ভল্টের চাবি রেখে যেতে ভুলে গেছলেন! নইলে কী করে টের পেতাম আমরা চারুদি, বিনা অলঙ্কারেও আপনি কত সুন্দরী।….পুরুষরা তো আপনাকে দেখতে দেখতে মুগ্ধ। ওখানে বলাবলি হচ্ছিল, কতকগুলো গহনা—টহনা পরাই যে সাজা নয়, সেটা ওঁকে দেখে শিখতে পারে মেয়েরা।’
চারুপ্রভা অমায়িক গলায় বলেন, ‘পুরুষদের দায় পড়েছে এই বৃদ্ধা মহিলার সম্পর্কে আলোচনা করবার।’
‘বৃদ্ধা মহিলা?’
উজ্জ্বলা হেসে গড়িয়ে পড়ে।
‘কথাটা রাষ্ট্র করে দেব নাকি? আর তাই যদি বললেন চারুদি, সদ্য তরুণীদের থেকে অনেক বেশী লোভনীয় হচ্ছে পূর্ণ পরিণত যৌবন। যার থেকে প্রমাণিত হয়—ইনি অগাধ ঐশ্বর্যের মালিক। যথেষ্ট পরিমাণে খরচ করেও এখনো বিত্তশালী।’
পিছনের চেয়ার থেকে মিষ্টার সরকার বলে ওঠেন, ‘আমার বলবার কথাগুলো সব আপনি বলে নিচ্ছেন মিসেস হালদার? ভারী অন্যায়, ভারী অন্যায়। এ আপনার অপরের অধিকারের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ। আমায় বলতে দিন।’
চারুপ্রভা চোখ ভুরু পাকিয়ে কৃত্রিম কোপে বলেন, ‘মিস্টার সরকার, আমার বয়েস আপনি জানেন?’
চারুপ্রভার অলক্ষ্যে উজ্জ্বলা হালদারের সঙ্গে সাগর সরকারের একটি কৌতুক দৃষ্টির বিনিময় হয়, অতঃপর সাগর সরকার জোরালো গলায় বলেন, ‘জানি। পঁচিশ।’
চারুপ্রভা হেসে প্রায় ভেঙ্গে পড়েন।
‘ওঃ হো হো! মিষ্টার সরকার, আপনি চশমা বদলান! আমার মেয়েরই যে প্রায় পঁচিশ হল—’
পঁচিশ অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে পার হয়ে গেছে জিপসি, তবু ওই ‘প্রায়’টাই বলেন চারুপ্রভা।
অবশ্য দরকার ছিল না তার, সাগর সরকার বলে ওঠেন, ‘অসম্ভব! নিশ্চয় সে মেয়ে আপনার সপত্নী—কন্যা। আপনি যতই লুকোন মিসেস দত্ত, আপনি নির্ঘাৎ মিষ্টার দত্তর দ্বিতীয় পক্ষ! বয়েসের যা ডিফারেন্স!’
‘আপনি দেখেছেন ওঁকে?’
‘হুঁ!’ কাজে পড়ে ইণ্ডিয়ান গ্রীলে ঢুকে। রীতিমত একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।’
চারুপ্রভা যেন হেরে যাচ্ছেন, অথচ দুর্বল হাতে লড়ছেন, এমনি ভঙ্গীতে বলেন, ‘হ্যাঁ বয়েসে আমার সঙ্গে ওঁর অনেকটা ডিফারেন্স, তবে বিশ্বাস করুন সরকার সাহেব, আমি দ্বিতীয় পক্ষ নই। মেয়েও আমার, মানে সত্যিকার নিজের মেয়ে।’
বারে বারেই সুকৌশল দৃষ্টি—বিনিময় ঘটে সাগর সরকারের সঙ্গে উজ্জ্বলা হালদারের। চারুপ্রভার উঁচুচূড়ো খোঁপার আড়ালে আবদ্ধ থাকে সে রহস্য, চারুপ্রভা চালিয়ে যান, ‘মেয়েদের রূপ—টুপ থাকাও বিপদ সরকার সাহেব, বাল্যেবিবাহের বলি হয়ে বসতে হয়। যখন জ্ঞানবুদ্ধির বালাই মাত্র হয়নি—(সরকার সাহেব অনুচ্চার মন্তব্য করেন, যেন এখনই হয়েছে) তখন স্রেফ বলির পশুর মত বিয়ের পীড়িতে উৎসর্গ করে দেওয়া হয়েছিল আমায়।’
চারুপ্রভার সাজ, আর চারুপ্রভার বয়েস কমানো নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, কিন্তু টের পেতে দেয় না। চারুপ্রভার হাত দরাজ, মেজাজ দরাজ, তার তো একটা মূল্য আছে সমাজে।
গল্প করতে করতে একসময় বলে ওঠেন, ‘উঃ কী কাণ্ড! সবাই যে চলে গেল। আমায় বাড়ি ফিরতে হবে না?’
মিস্টার ভাদুরী বলে ওঠেন, ‘আহা হা থাকুন না আর একটু। অন্ততঃ পরোপকারের জন্যেও।’
‘পরোপকার! আমি আবার কার কী উপকার করছি?’
‘আপনার উপস্থিতিই উপকারী মিসেস দত্ত। সমস্ত পরিবেশটা তাজা থাকে, সরস থাকে।’
চারুপ্রভা বিগলিত বিনয়ের হাস্যে বলেন, ‘আপনারা বড্ড বাড়ান মিস্টার ভাদুড়ী!’
‘ভুল বলছেন। যতটা বলা উচিত, ততটা বলেই উঠতে পারি না, ভাষার দৈন্য।’
সাগর সরকার চলে যাচ্ছিলেন, চেয়ারের পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, ‘শুধু শুধু বাড়াতে যাব কেন বলুন? আমরা মিস্টার দত্তর কারখানায় চাকরি চাইতে যাচ্ছি না।’
হো হো করে হেসে উঠলেন দুই পুরুষ।
এখন আর হাসতে বাধা কী?
হাসির কথা যখন হয়েছে একটা।
চারুপ্রভার অলক্ষ্যে একটা নিশ্বাস পড়ে।
এই আলো, এই ঔজ্জ্বল্য, এই মুগ্ধ—মুগ্ধ দৃষ্টির নৈবেদ্য, এ সমস্তই ক্ষণিকের।
যতক্ষণ পারেন উপভোগ করে নেন সত্যি, তবু তো এখান থেকে বেরিয়েই গিয়ে পড়তে হবে একটা প্রাণহীন বদ্ধ জলাধারের মধ্যে।
যতই কেননা চারুপ্রভা তাঁর পরিবেশটাকে নিত্য নতুন সাজে চমকপ্রদ করে তুলুন, প্রাণ কোথায়? এত চেষ্টাতেও প্রাণসঞ্চার করতে পারছেন না।
নিজের বাড়ীতে যেদিন যেদিন মহিলা সমিতির অধিবেশন বসান, কিছুক্ষণের জন্যে ওই আমন্ত্রিতরাই জমজমাটি করিয়ে যায়, চারুপ্রভার নিজের দিকে কী?
ঠিক সেইদিনেই বুঝে বুঝে বিজনবিহারীর বিশেষ কাজ পড়বে, আর জিপসির অসম্ভব পড়ার চাপ পড়বে।
বিজনবিহারীর জন্যে তত না, লোকসমাজে বার করবার মত নয়ও, কিন্তু জিপসি, সে তো পারত চারুপ্রভার সহকারিণী হতে, চারুপ্রভার সংসারের একটু নমুনা দেখাতে।
রাত বেড়ে যাচ্ছে আর দেরী করা সঙ্গত নয়।
চারুপ্রভা উঠলেন।
আবার উঠেও উঠলেন না।
জনে জনে দেখা করে বলতে লাগলেন, ‘চলি তাহলে। খুব আনন্দ পেলাম।’
সভ্যরা যে এটা করে না, যেই নিজের কাজ মিটে যায় অবলীলায় উঠে যায় কারো দিকে দৃকপাত মাত্র না করে, সেটা চারুপ্রভা ঠিক ধরতে পারেন না। চারুপ্রভার এই সব আলোকোজ্জ্বল উৎসব—মঞ্চ থেকে চলে যেতে মন চায় না। চারুপ্রভার ভিতরটা সমারোহের কাঙাল।
বিজনবিহারী অবশ্য চারুপ্রভার গ্যারেজ ফাঁকা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, তবু হঠাৎ কেমন একটা রাগও এসে গেল।
মেয়েমানুষ তুমি, একা নেমন্তন্ন গেছ, রাত বাড়ছে খেয়াল নেই? আবার জড়োয়া গহনার অভাবে রাগে অগ্নিশর্মা। বাইরে কত বিপদ আছে জানো না তুমি?…ওই ড্রাইভার ছোকরাও…তো নতুন, ক’মাস মাত্র কাজ করছে।
বদ মতলব থাকলে ও তোকে নাকে ক্লোরোফর্ম রুমাল ঠেকিয়ে সর্বস্ব নিয়ে নিতে পারে না? ব্যাগেও তো গাদা গাদা টাকা নিয়ে যাওয়া হয়। একদিন শিক্ষা হয় তো বেশ হয়।
নিজের স্ত্রীর জন্য এই শুভকামনাটি করে বিজনবিহারী হঠাৎ বাড়ির সবদিক তাকাতে লাগলেন, চারুপ্রভা যতই বাহাদুরি দেখাক, এই সমস্তই বিজনবিহারীর টাকায়। বিজনবিহারী এই সমস্ত কিছুরই মালিক।
অথচ—বিজনবিহারী সবাইকে ভয় করে চলেন। নিজের স্ত্রী—কন্যাকে তো বটেই, বাড়ির চাকর—বাকরদের পর্যন্ত। ভয় হয়, কিছু বললে পাছে চারুপ্রভাকে লাগিয়ে দেয়।
আর চারুপ্রভা ‘সাহেবের’ মান—মর্যাদার জ্ঞান ভুলে ওদেরই সমর্থন করেন, ‘লোকজনকে পায়ের তলায় রাখার যুগ চলে গেছে, বুঝলে? জমিদারীর কাল আর নেই। ওরাও ভদ্রঘরের ছেলে, অসুবিধেয় পড়ে খাটতে এসেছে। তোমার দোকানের কর্ম্মচারীদের সঙ্গে ওদের কিছু তফাত নেই!’
বিজনবিহারীর সব কিছুতেই অনধিকারীর ভূমিকা। তাঁর যদি দেওয়ালের একটা ছবি অথবা ঘরের একটা টেবিল এদিক—ওদিক করবার ইচ্ছে হয়, করতে সাহস হয় না।
জানেন সেটা করে ফেললে, চারুপ্রভা বিজনবিহারীর সৌন্দর্যজ্ঞানের তীব্র সমালোচনা করে যেখানকার জিনিস ঠিক সেইখানেই রেখে দেবেন।
হঠাৎ মনে হল, ‘কেন? কেন আমি সব সময় সকলকে ভয় করব? আমি বাড়ির কর্তা নই?’
এই যে খুকু, কার সঙ্গে না কার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি না, কে সে? কাদের সঙ্গে মেশো তুমি? এই যে আমি তখন নিজের ঘরে গিয়েই ধুতি—পাঞ্জাবি ছেড়ে রেখে শার্ট—পায়জামা পরব কেন? আমার বাড়িতে আমি যা ইচ্ছে করতে পারব না কেন?
ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন। দেখলেন জিপসির ঘর অন্ধকার। ঘুমিয়ে পড়েছে? রাত তো মাত্র সাড়ে দশটা, এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে? ওর মা আসা পর্যন্ত তো থাকেই জেগে।
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ।
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মত একটা কুটিল সন্দেহ পা থেকে মাথা অবধি চড়াৎ করে উঠল।
জোরে জোরে ধাক্কা দিলেন দরজায়।
বার তিনেকের পরই জিপসি উঠে এল। চোখ মুছতে মুছতে অবাক হয়ে বলল, ‘কী বাবা? কী হল?’
বিজনবিহারী ঘরটার মধ্যে তাকিয়ে দেখলেন ঘর আলোয় ভাসছে, একার মত সরু খাটের বিছানা থেকে যে উঠে এসেছে, তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
ভারী অপ্রতিভ হয়ে গেলেন বিজনবিহারী। এতক্ষণের কর্তা মনোভাব অন্তর্হিত হয়ে গেল। তার মনের মধ্যে যে কুটিল সন্দেহ উঁকি মেরেছিল সেটা জিপসির জানবার কথা নয়, তবু বিজনবিহারীর মনে হল, যেন জেনে ফেলেছে খুকু।
সেই অপ্রতিভ ভাবনা সামলাতে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এক্ষুনি শুয়ে পড়েছিস! এরকম তো ঘুমোস না, শরীর খারাপ—টারাপ হয় নি তো? হঠাৎ ভয় হল, তাই—’
জিপসি একবার বাবাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে ‘শরীর খারাপ তো আমার হয় নি বাবা, মনে হচ্ছে তোমারই হয়েছে।’
‘আমার কেন হবে। আমার কেন হবে।’ বলে চলে আসেন বিজনবিহারী। তবে খুকু তো ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়! তাই বলে ওঠে, ‘অসুখ আমার হবে, অথচ তোমার ‘কেন হবে?’ এর উত্তর হয় না বাবা! আমি বলছি তোমার এক্ষুনি শুয়ে পড়া উচিত!’
‘না না, আমি বেশ আছি। তোর খাওয়া টাওয়া হয়েছে?’
‘হুঁ, কখন! শ্রীমতী মাতৃদেবী যে আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন, আমি যেন—কিন্তু তোমার তো—’
‘দ্যাখ আমারও আজ তেমন খিদে নেই।’
‘ওই তো। বলেছি তোমার শরীর খারাপ—’ বলেই ভীত গলার ভান করে বলে ওঠে, ‘ও বাবা, সর্বনাশ হয়েছে, বোধহয় মা ফিরলেন, গাড়ির শব্দ পেলাম। আর তুমি এখনো ধুতি পরে? যাও যাও, শীগগির বদলে ফেল গে—’
বিজনবিহারী মিয়োনো চড়া গলায় বলেন, ‘যদি না বদলাই? যদি বলি আমার যা খুশী আমি তাই পরব।’
জিপসি মুখে একটা চুক চুক শব্দ করে বলে, ‘ওঃ মাই পুওর চাইল্ড। এতদিনে তোমার এই জ্ঞানোদয় হল? বড় লেট—এ বাপী, বড় লেট—এ। আর হবে না।’
‘হয় কিনা দ্যাখ।’
বিজনবিহারী জোর দেখিয়ে বলেন, ‘এবার থেকে দেখিস।’
‘দেখব।’
বিজনবিহারী একটু দাঁড়ান, বলেন, ‘আমি তোর মাকে ভয় করি? ভয় করি অপমানের। রাগলে তো জ্ঞান থাকে না তোর মার, লোকজনের সামনে যা মুখে আসে বলে—’
জিপসি একটু চকিত হয়।
বাবা মায়ের ভয়ে কাঁটা এই জানে সে, সেই ভয়ের স্বরূপটা কী তা ভেবে দেখেনি কোনদিন।
জিপসি কিছু বলার আগে বিজনবিহারী আবার কথা বলেন, ‘বিকেলবেলায় কে এসেছিল রে?’
‘বিকেলবেলা? কই কেউ তো আসেনি।’
বিজনবিহারী বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘আসেনি বললেই শুনব? আমি নিজের কানে শুনে গেলাম তুই কার সঙ্গে যেন কথা বলছিস—’
‘ওমা! তুমি যখন বেরোলে তখন? সে তো তিলকদার সঙ্গে! সে তো রোজই আসে—’
‘তিলকদা! তিলকদাটি কে?’
‘বাবা! তুমি কী গো! তিলকদাকে চেন না? তিলক গাঙ্গুলী পাড়ার সব থেকে ফেমাস ছেলে।’
তিলক গাঙ্গুলী! জীবনে নাম শোনেননি বিজনবিহারী, অথচ পাড়ার সব থেকে ফেমাস ছেলে।
রোজ আসে।
তার মানে লাভার।
লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে তার সঙ্গে আড্ডা দেয়, আর মা বাপের কথা নিয়ে হাসাহাসি করে।
হঠাৎ যেন মাথায় রক্ত চড়ে যায় বিজনবিহারীর।
চেঁচিয়ে উঠে বলেন, ‘তা তারই বা রোজ আসার কী দরকার? বেছে বেছে সেই সময়, যখন তোমার মা বাড়ি থাকে না, আমি বেরিয়ে যাই—’
বাবার এই চীৎকারের মুখেও জিপসি আশ্চর্য্য রকম ঠাণ্ডা গলায় প্রায় যেন অবাক গলায় বলে, ‘তা তখন এলেই তো ভাল বাবা, নেহাত একা পড়ে থাকতে হয় আমায়। ও না এলে তো ঢিপসির সঙ্গেই গল্প করে কাটাতে হত। অথচ তোমাদেরও না বেরুলেই নয়, কত—সব দারুন দরকারী কাজ।’
মাথায় চড়ে ওঠে রক্তটা কি সারা শরীরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে মাথার আগুনটাকে বয়ে নিয়ে?
তা নইলে হঠাৎ এত গরম হচ্ছে কেন?
প্রত্যেকটি লোমকূপ থেকে ফুটন্ত রক্তস্রোত ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কেন?
গলার স্বরটাও কি তাই স্বক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে না থেকে শিথিল হয়ে ঝুলে পড়ল?
সেই ঝুলে পড়া স্বরটা বলল, ‘তা তুমিই বা ঘরে বসে থাকো কেন? কলেজের মেয়ে— টেয়ের বাড়ি বেড়াতে যেতে পার না?’
জিপসি এই স্খলিত স্বরটা চিনতে ভুল করল। জিপসি ভাবল ভীরু স্বভাব বিজনবিহারী ভয় পেয়ে—
জিপসি তাই খুব অমায়িক গলায় বলল, ‘এ কথাটা তোমায় মা শিখিয়ে দিয়েছেন বুঝি বাপী?’
এখন একটা অভাবিত কাণ্ড ঘটল।
বিজনবিহারী ‘হল’—এর ধারে রাখা একটা ভারী পিতলের বুদ্ধমূর্তি সানো টেবিলের কোণ চেপে ধরে হুমড়ি খাওয়া মত অবস্থায় ছেলেমানুষের মত হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন, ‘তোমরা সবাই মিলে আমায় অপমান করবে? সবাই মিলে? আমি আর থাকব না তোমাদের বাড়ি। সাতের এক শশী বড়াল লেনে চলে যাব আমি। তারা আমায়—তারা আমায়—তা—রা আমা—য়—’
টেবিল এবং ভারী মূর্তিটা সমেত গড়িয়ে পড়ে গেল বিজনবিহারীর হালছাড়া পালছেঁড়া ভারী শরীরটা।
ভয়ঙ্কর একটা শব্দ যেন বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে ধাক্কা মেরে মেরে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
কতক্ষণ সময় জিপসি ওই গুঁজড়ে পড়ে যাওয়া শরীরটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল?
অনেক অনেকক্ষণ? হয়তো তাই।
না হলে ওর যখন চমক ভাঙল, তখন সারা ঘর লোকে ভর্তি কেন?
ওই শব্দটাই সবাইকে ডেকে এনেছে।
আধডজন চাকর থাকার উপকারিতা—এখন বোঝা যাচ্ছে। ওরাই তো সবাই মিলে ধরাধরি করে ভাল জায়গায় সরিয়ে এনে শুইয়ে দিল বিজনবিহারীর দেহটাকে।
এখন জিপসিকে হাল ধরতে হবে।
ডাক্তারকে খবর দিতে ফোন তুলল। কিন্তু কী বলবে সে তাদের পারিবারিক চিকিৎসককে?
‘ডাক্তারবাবু, আমি বাপীকে খুন করে ফেলেছি, এখন আপনি আসুন, বাঁচান।’
চারুপ্রভা যখন ফিরলেন, তখন সারা বাড়িতে আলো জ্বলছে, বাড়ি লোকে ভর্ত্তি।
পরিচিত ডাক্তার তো এসেইছেন, আরো দুজন বিশিষ্ট ডাক্তার এসে গেছেন।…এসেছেন পাড়ার কর্তা—ব্যক্তিরা অনেকেই বন্ধ হয়ে যাওয়া সদর দরজা খুলে।
হলেই বা অনেকটা রাত, যে ব্যক্তি মারা যেতে বসেছে, তার টাকাকড়ি আছে না প্রচুর? যেটা সব বন্ধ দরজা খোলার চাবি!
চারুপ্রভা এক সমারোহ থেকে আর এক সমারোহের মধ্যে এসে পড়ে প্রথমটা যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন।
তা সমারোহ বৈ কি।
মৃত্যু যখন ভাগ্যমন্তের দরজায় এসে দাঁড়ায়, তার অভ্যর্থনার আয়োজন সমারোহময়ই হয়। বাড়িতে শুধু একা একটা তরুণী মেয়ে মাত্র ছিল বলে কি আয়োজনের ত্রুটি হয়েছে কিছু।
বাড়ি আলোয় ঝলমলে, দরজায় গাড়ির সারি, লোকজন ছুটোছুটি করছে।
জিপসিকে অবশ্য এসবের জন্যে বেশী কিছু করতে হয় নি, জিপসির বাবার টাকাই এসব করে তুলেছে মুহূর্তে।
প্রথমটা দিশেহারা হয়ে গেলেও সামলে নিলেন চারুপ্রভা। ওর মনে পড়ল, মৃত্যুর প্রবল প্রবেশের ধাক্কায় যখন সকল দরজা হাট হয়ে খুলে পড়ে, তখন সেই হাট—হয়ে—যাওয়া দরজার মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়ে হাটের হট্টগোল।
হাটের লোকের সাহস বেড়ে যায়, হঠাৎ তারা যেন একটা অনধিকারের ক্ষেত্রে প্রবেশের ছাড়পত্র পেয়ে যায়।
তাই চারুপ্রভার ‘হল’—এর মেঝেয় পাতা পুরু কার্পেটের উপর এসে দাঁড়িয়েছে বাসন—মাজা ঝিয়ের বাসার লোক, পাড়ার চায়ের দোকানের চাকর, পানের দোকানের মালিক।
প্রথমে এসেই চারুপ্রভার সব থেকে জরুরী মনে হয়েছিল পড়ে যাওয়ার ভঙ্গীটা কী ছিল তার তদন্ত করা।
তাই জেরা করতে শুরু করেছিলেন সক্কলকে। কখন ফিরেছিলেন বিজনবিহারী, তারপর কী করেছিলেন, ঠিক কোন পজিশনে পড়ে ছিলেন, মাথা ঘুরে পড়া, না কিছু পায়ে বেধে পড়া?
কিন্তু কে দেখেছে ওসব?
সকলেই তো পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে এসেছে।
একমাত্র দিদিমণি।
যার সঙ্গে নাকি কথা বলছিলেন সাহেব।
তা সেই জিপসি বলছে কি না আমিই ফেলে দিয়েছি। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি বাপীকে।
সে মেয়েকে ঘরে পুরে দিয়ে পাখার তলায় শুইয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় কী? আচমকা ‘শক’—এ পাগলের মত কী বলছে না বলছে! হঠাৎ কারো কানে গেলে তো কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে ওকে।
চারুপ্রভার নার্ভ অমন খেলো মালমশলায় তৈরী নয়, আচমকা শক খেয়ে এলোমেলো হয়ে যান না চারুপ্রভা।
চারুপ্রভা বরং বিচলিত হয়েছেন বিজনবিহারীকে অমন ধুতির কোঁচা লটপটিয়ে ন্যাতাজোবড়া হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে।
চারুপ্রভার ইচ্ছে হচ্ছিল এখুনি মানুষটাকে পোশাক বদলে সভ্য—ভব্য করে শুইয়ে দেন।
সেটা সম্ভব না হওয়ায়, যেটা সম্ভব সেটাই করেন চারুপ্রভা, সবলে রায় দেন, ‘আমি বলছি, স্ট্রোক ট্রোক নয়, স্রেফ কোঁচা লটপটিয়েই জড়িয়ে পড়ে গিয়ে—অবাক হয়ে যাচ্ছি হঠাৎ এ শখ হল কেন ওর!’
চারুপ্রভার অঙ্গে এখনো বিয়ে—বাড়ির সাজ। ঝকঝকে চকচকে। শুধু চূড়ো খোঁপাটা ভেঙে পিঠে লুটোনোর দরুন আর চুলগুলো মুখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার দরুন উগ্র আর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।
চারুপ্রভা এখন খাঁচায় বন্ধ বাঘিনীর মত ছটফট করছেন, গর্জন করছেন, ছুটোছুটি করছেন, ‘এরা সব কারা? এরা এখানে ভীড় বাড়াচ্ছে কেন? জগদীশ, এদের সবাইকে সরিয়ে দাও।…চাবি লাগিয়ে দাও সব দরজায় দরজায়।…দোকানের চাবি কার কাছে থাকে?—ম্যানেজারবাবুর কাছে? কী আশ্চর্য! সে লোক নর্থের দিকে থাকে না? তার কাছে দোকানের চাবি? জিপসি, এবার উঠে পড়, দেখ তোমার বাবার কাণ্ড। দোকানের চাবি ম্যানেজারের কাছে।…এক্ষুনি যে করে হোক খবর পাঠাও তাকে চাবিটা এখানে পৌঁছে দিয়ে যেতে। দোকান এখন খোলা হবে না।…লিস্ট মিলিয়ে সব দেখে তবে—তোর বাবার লকারের চাবিই বা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো! শীগগির দ্যাখ, গোলেমালে কেউ সরিয়ে ফেলল কি না। উঃ কতদিক যে এখন দেখতে হবে আমায়, কোথায় কী কাগজপত্র, কোথায় ভল্টের চাবি—কোনদিকটা যে দেখব—’
জিপসি উঠে বসে, এত কথার উত্তরে শুধু বলে, ‘সব কিছু দেখার আগে তোমার এই বিয়ে—বাড়ির সাজটা বদলে ফেল মা।’
চারুপ্রভা ক্রুদ্ধ মুখে বলেন, ‘কেন? সাজটায় তোমায় কী কামড়াচ্ছে? তুমি কি আমায় এক্ষুনি থানপরা বিধবা মূর্তিতে দেখতে চাও?—উঃ আশ্চর্য! আর কোন কথা খুঁজে পেল না। তুমি ভিন্ন কেউ ভাবতে বসছে না, আমি স্বামী মারা যাওয়ার পর সেজে—গুজে শোক করছি। এরপর কী জ্বালাতন যে করবে তুমি আমায়, তা টের পাচ্ছি। কিন্তু মনে জেনো চারুপ্রভা দত্ত শক্ত মেয়ে।’
শক্ত মেয়ের অহঙ্কার নিয়ে চারুপ্রভা চারিদিকে আটঘাট বাঁধতে বসেছিলেন, ভেবেছিলেন ঐ আলগাবুদ্ধি লোকটা কোথায় কি করে রেখেছে তীক্ষ্নচোখে সে—সব বুঝে নিয়ে সব কিছু নিজের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলতে হবে, দোকানের কর্মচারীদের দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। বোকাসোকা সরল সাদা বিজনবিহারী সবাইকেই বিশ্বাস করতেন, কে জানে তারা কত আখের গুছিয়ে নিয়েছে। চারুপ্রভা অত চোখ বুজে বিশ্বাস করতে রাজী নন, চারুপ্রভা জানেন জগতের কাউকে বিশ্বাস নেই।
চারুপ্রভা এখন সব কিছুতে বজ্রআঁটুনি কসবেন।
চিরকাল চারুপ্রভা ওই বজ্রআঁটুনিতেই বিশ্বাসী, ওতেই সব থেকে নিশ্চিন্ত।
কিন্তু এখন?
এখন কি চারুপ্রভা শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখবেন তাঁর সারাজীবনের সমস্ত বজ্রআঁটুনির তলায় তলায় গেরোটা কী ফস্কাই ছিল!…নাকি চারুপ্রভা জোরগলায় ঘোষণা করবেন, ‘দেখো, দেখো তোমরা! বলিনি আমি জগতে কাউকে বিশ্বাস নেই!’
তা চারুপ্রভা যদি নাও বলে বেড়ান, যদি আপন জীবনের দৈন্য উদঘাটিত করতে না চান, লোকে কি বলতে ছাড়বে? ছাড়ছে কি?
দেশসুদ্ধু লোকই তো অবাক হয়ে গালে হাত দিচ্ছে। ঘৃণায় লজ্জায় ছি ছি—ক্কার করছে ‘ইণ্ডিয়ান গ্রীল অ্যাণ্ড গেট’—এর একমাত্র মালিক বি. বি. দত্তকে।
কে জানত ওর ‘সৎচরিত্রের’ মুখোশের আড়ালে এতখানি দুশ্চরিত্রতা ছিল।
পঁচিশ বছর ধরে লোকটা দ্বিতীয় একটা অবৈধ সংসার পেতে বসে দিব্যি চালিয়ে গেছে! কেউ ধরতে পারেনি।
কী করে পারবে ধরতে?
‘জীবন’ যে সবকিছু আড়াল করে রাখে তার দু’হাত বিছিয়ে তার সব ত্রুটি, সব দৈন্য, সব ভালবাসা।
মৃত্যু দুরন্ত পদপাতে সব তছনছ করে দিয়ে যায়। দিয়ে যায় সব আড়াল ঘুচিয়ে, সব দেওয়াল ভেঙ্গে। যা থাকে একান্ত গোপনতার মধ্যে, মৃত্যু তাকে উদঘাটিত করে ফেলে, পৃথিবীর সামনে মেলে ধরে।…তবু হয়তো এত তাড়াতাড়ি সবটা মেলে ধরতে পারত না, যদি না বিজনবিহারীর নিজের মেয়েই এই উদঘাটনের সহায়ক না হত।
এখন বিজনবিহারী নামের লোকটার নির্লজ্জতায় সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছে। সে কিনা তার ওই অবৈধ সংসারটাকে বৈধ প্রতিপন্ন করতে উইলে লিখে রেখে গেছে—’আমার দ্বিতীয়া পত্নী শ্রীমতী গৌরী দত্তর গর্ভজাত আমার একমাত্র পুত্র শ্রীমান দেবনাথ দত্ত ‘ইণ্ডিয়ান গ্রীল অ্যাণ্ড গেট’—এর একমাত্র মালিক হইবেন।’
বাকি সবই অবশ্য প্রথমা স্ত্রী চারুপ্রভা দত্ত, আর তার গর্ভজাত কন্যা লোপামুদ্রা দত্তর নামেই উৎসর্গ করে গেছে লোকটা। ব্যাঙ্কের অগাধ টাকা, বালিগঞ্জ প্লেসের বিরাট বাড়ি, দুখানা গাড়ি, লাইফ ইনসিওরেন্সের টাকা, সবই।
তবু আসলটাই তো হাত ফসকে গেল।
দোকান গেলে চারুপ্রভার রইল কী!
কী চক্ষুলজ্জাহীন! কী কুৎসিৎ নোংরামি!
মরবার কোন ঠিকঠাক ছিল না, অথচ কোনকাল থেকে এই দলিল করে রেখেছে, পাকা দলিল! যাতে ওর ওই ‘মিথ্যে’ স্ত্রী—পুত্র ‘সত্য’ বলে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু চারুপ্রভা মানবেন নাকি ওই উইল? কুচি—কুচি করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেবেন না? আদালতে ‘নকল’ আছে ওর? তা থাকল তো বয়েই গেল। আদালতে কত আসল ‘নকল’ হয়ে যাচ্ছে, আর এ তো পুরোটাই নকল।
সেই ‘বিবাহিতা দ্বিতীয়া পত্নী’ প্রমাণ করুক কবে কখন কোথায় তার ওই বিবাহটি হয়েছিল। কে পুরুত? কে নাপিত? কে সাক্ষী?
চারুপ্রভার ভাগ্য!
চারুপ্রভা যখন নিশ্চিন্ত হচ্ছেন ওই ‘প্রমাণ’টা আর হবে না, তখন চারুপ্রভার ভাগ্যের শনি এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি সাক্ষী দেব।’
‘তুই সাক্ষী দিবি?’
‘দেবই তো ঠিক করছি।’
‘ওঃ! তুই তোর বাপের বিয়ে দেখেছিস তাহলে?’
‘সবই কি দেখতে হয় মা? তুমি কি তোমার বাবার বিয়ে দেখেছ? দেখনি? তবু নিজেকে বৈধ বলে জানো।’
‘তুই আমার এতবড় শত্রুতা করবি?’
‘শত্রুতা নয় মা, মিত্রতা!’
‘ওঃ! মিত্রতা! অত মহত্ত্বে আমার দরকার নেই।’
‘তোমার নেই আমার আছে মা! মহত্ত্বের নয়, প্রায়শ্চিত্তের।’
হ্যাঁ, প্রায়শ্চিত্তের মনোভাব নিয়েই জিপসি ‘শশী বড়াল লেন’ নামের জায়গাটা শহরের কোনখানে থাকতে পারে তার খোঁজ করেছিল। হয়তো ওই খোঁজটা করতে না গেলে আর কিছুদিন চাপা থাকত ঘটনাটা।
কতদিন ধরে যেন ভয়ানক একটা যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছিল জিপসি। কেবল ভেবেছিল, আমি কেন ভাবিনি সেদিন, সবসময়ই মজা করতে বসা ঠিক নয়। বাবাকে রাগিয়ে মজা দেখবার জন্যে কেন হঠাৎ আমি এক ‘তিলকদা’ তৈরী করে বসলাম!—যার কোন অস্তিত্বই নেই।
আমি তো সত্যিকথাটাই বলতে পারতাম, ‘বাপী, আমি ঘরের মধ্যে বসে আমার মনে—প্রাণে যা উদয় হয় ঢিপসিকে বলি। ও এমন ভাবে ল্যাজ নাড়ে, মনে হয় সব বুঝছে।’
যদি আমি ওই ‘তিলক’দাকে না গড়তাম, বাপী হয়তো পড়ে যেত না, মরে যেত না।
যন্ত্রণাবোধের মধ্যেই বিজনবিহারীর সেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলা কথাটা মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে, ‘আমি তোমাদের বাড়িতে থাকব না, আমি সাতের এক শশী বড়াল লেনে চলে যাব।’
শশী বড়াল লেনে গিয়ে কোন দৃশ্যের সামনে দাঁড়াতে হবে তার কোন ধারণাই ছিল না জিপসির। তবু অস্পষ্ট একটা সন্দেহের বিষ মনের এক কোণে ছায়া ফেলেছিল।
কোন স্ত্রীলোক ঘটিত ব্যাপারই!
রোজ সন্ধ্যায় ওই অন্যবেশ ধারণ করে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে যোগ আছে শশী বড়াল লেনের।
অধ্যবসায়ে সবই হয়।
শশী বড়াল লেনের সাতের এক বাড়িটা খুঁজে বার করে কড়া নেড়েছিল জিপসি।
একটি বছর ষোলর মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে একটু তাকিয়ে থেকে, প্রায় আর্তনাদের মত ডেকে উঠেছিল, ‘মা!’
কিন্তু জিপসি কি ধারণা করেছিল, রোদে ঝলসে যাওয়া শাকের মত চেহারার ওই ময়লা থান পরা বিধবাটিকে দেখবে?
আচ্ছা ইনি যে থান—টান পরে বসে আছেন, এঁদের খবর দিয়েছিল কে? কার দায় পড়েছিল শশী বড়াল লেন খুঁজে বার করে খবর দিয়ে যেতে—’ওগো সেই বিজনবিহারী দত্ত হঠাৎ হার্টফেল করেছেন। যাঁকে তুমি ‘স্বামী’ বলে মনে করতে।’
না, কারো দায় পড়েনি, শুধু পরদিন সকালে স্থানীয় সংবাদে আকাশবাণী কলকাতা জানিয়ে দিয়েছিল, ‘সুবিখ্যাত ইণ্ডিয়ান গ্রীল অ্যাণ্ড গেট—এর মালিক বিজনবিহারী দত্ত গতকাল রাত্রি বারোটার সময়—’
তিনজন ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওরা কেউ কথা কইছিল না, শুধু নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছিল, আর জিপসি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। এই বাড়ির মেঝেয় পা ফেলে ফেলে হেঁটেছে বাবা, এদের ঘরের ওই চৌকীতে বসেছে, হয়তো ওদের হাতে চা খেয়েছে। আর এই দেয়াল—ভাঙা বালি—খসা দীনহীন বাড়িটাতেই বাবা চলে আসবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল ঠিক মারা যাবার আগে।
অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে চেষ্টা করল, বিজনবিহারী দত্তকে এই পরিবেশে কেমন মানায়। …তারপর ওই মলিনমূর্তি মহিলাটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, আর তখনই ওর বাবার শেষ কথাটা, যেটা সমাপ্ত করতে পারেননি বিজনবিহারী, আর যাকে সমাপ্তি দিতে এই ক’দিন ধরে অনেক কথার টুকরো বসিয়েছিল জিপসি সেখানে, আবার তুলে তুলে ফেলে দিয়েছিল, সেই কথাটা আপনি সমাপ্ত হয়ে উঠল। ‘ওরা’ আমাকে—ওরা আমাকে—ওরা আমাকে ভালবাসে।’
এই কথা।
আর কিছু হতে পারে না।
এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মলিন নিষ্প্রভ চারটি মূর্তি নিরুচ্চারে ওই কথাটাই উচ্চারণ করছে, ‘আমরা তাঁকে ভালবাসতাম। আমরা তাকে ভালবাসি।’
আচ্ছা জিপসি কি তার বাবাকে ভালবাসত না? বাসে না? না বাসলে এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন জিপসির বাবা মরে গেল বলে?
তবু জিপসির নিজেকে যেন ওদের থেকে অনেক নীচেয় মনে হচ্ছে, অনেক ছোট। কিন্তু জিপসির তো সবই উল্টোপাল্টা, তাই সেখানে জিপসি ছোট হয়ে মরছে, সেখানেই বার বার আসছে।
‘কোথায় যাস তুই রোজ রোজ?’
চারুপ্রভা মারমুখী হয়ে থাকেন। মারমুখী হয়ে জিগ্যেস করেন।
জিপসি বলে, ‘ঠাকুর—মন্দিরে যাই।’
‘ঠাকুর—মন্দিরে! আমি জানি না? জগদীশকে দিয়ে খবর নিইয়েছি আমি। আমি বলছি জিপসি, ওই সর্বনাশীর খপ্পরে যাসনি তুই, ও তোর বাপকে তুকতাক করে বশ করে রেখেছিল, এখন তোকে করছে। শেষ পর্যন্ত মরবি, বলে রাখছি।’
‘শেষ পর্যন্ত তো সবাই মরবে মা’ বলে হেসে ওঠে জিপসি।
‘আমি তোকে বারণ করছি জিপসি—’
জিপসি আবার হাসে, ‘কবে আবার আমি তোমার বারণ শুনেছি মা! আমি তো তোমার চিরকেলে অবাধ্য মেয়ে।’
‘আমি তোকে দিব্যি দিচ্ছি জিপসি—’
‘ও মা! কি বললে গো! মিসেস চারুপ্রভা দত্তর মুখে এই গাঁইয়া কথা!’ দিব্যি! এসব তুমি মানো?’
‘আমি তোকে চাবি দিয়ে রাখব—’ সাপিনীর মত হিসহিসিয়ে গর্জন করে ওঠেন চারুপ্রভা।
জিপসি মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে।
রূপের জেল্লায় আজও অম্লান চারুপ্রভা, শুধু চোখের কোণের সেই মদির কটাক্ষের ছায়াটা কোথায় সরে গিয়ে সেখানে সর্বদাই যেন ধ্বক ধ্বক করে দু ড্যালা আগুন জ্বলছে।
চারুপ্রভার সাজসজ্জা আজও অপরিবর্তিত, শুধু সরু সিঁথির মাঝখানে ঘন চুলের অন্তরালে যে ক্ষীণ লাল রেখাটুকু ছিল সেইটুকু নেই, আর কিছু না।
চারুপ্রভার একটা যুক্তি আছে।
চারুপ্রভাকে বৈধব্যের বেশে ঘুরে বেড়াতে দেখলে লোকজনে মানবে না, আত্মীয়স্বজন অবহেলা করবে, পাড়াপড়শীর কাছে মূল্য কমে যাবে আর নিজের কাছে নিজেকে বেচারী মনে হবে। এতগুলোর ভার বহন করতে পারবেন না চারুপ্রভা।
কিন্তু জিপসিকে এঁটে ওঠা না গেলে যে চারুপ্রভার সবই যায়।
অথচ ও প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে তুকতাকে বশীকরণগ্রস্ত ওর বাপের মতিচ্ছন্নের পরাকাষ্ঠা ওই উইলটাকে প্রতিষ্ঠিত করে তবে ছাড়বে।
লড়াইটা অভাবনীয়, সন্দেহ নেই।
হয়তো মহামান্য আদালত বাহাদুরও বলবেন, ‘না, আমার জীবনে এমন সৃষ্টিছাড়া লড়াই আমি দেখিনি।…’
মায়ে—মেয়েতে মামলা?
অজস্র, আকছার। কিন্তু এমন অদ্ভুত বিষয় নিয়ে? কখনো নয়। বাপের অবৈধ সন্তানকে বিষয়ের ভাগ পাওয়াবার জন্য, মায়ের সঙ্গে মামলা।
পাগল ছাড়া আর কেউ করবে?
অথচ ডাক্তারে ওকে পাগল বলবে, এমন আশা নেই চারুপ্রভার।
কিন্তু মা—র সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে সাতের এক শশী বড়াল লেনে রোজ রোজ যেতে হচ্ছে কেন জিপসিকে? যাবার দরকার তো উকিলবাড়িতে।
হয়তো শুধু ওইটুকুর জন্যেই নয়, জিপসি যেন একটা আবিষ্কারের কাজে নেমেছে, শশী বড়াল লেনে গিয়ে তার কাজের মালমশলা সংগ্রহ করছে।
জিপসির আবিষ্কারের বিষয়বস্তু হচ্ছে তালতলার দত্তদের ছেলে বিজনবিহারী দত্ত লোকটা সারাজীবন ধরে যা করে গেছে, সেটা বৈধ কি অবৈধ, সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছে জিপসি। নাকি বুঝেই ফেলেছে?…
তাই জিপসিকেও শশী বড়াল লেনের দাওয়ায় বসে কাঁসার বাটি করে মুড়ি খেতে দেখা যায় তার বাপ বিজনবিহারী দত্তর মতই।
চারুপ্রভা ভাগ্যিস দেখতে পান না।
ভাগ্যিস শুনতে পান না জিপসি ওই থানপরা ন্যাড়াহাত বাসন মাজা ঝিয়ের মত দেখতে গৌরীবালাকে ‘মা’ বলে ডাকছে। দেখলে শুনলে চারুপ্রভা বিষ খেতেন, না গলায় দড়ি দিতেন কে জানে।