Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
তিন ভুবনের কাহিনী – আশাপূর্ণা দেবী
তিন ভুবনের কাহিনী – আশাপূর্ণা দেবী
0/3
তিন ভুবনের কাহিনী – আশাপূর্ণা দেবী

ছাইয়ের মধ্যে তাপ : তিন ভুবনের কাহিনী

ছাইয়ের মধ্যে তাপ

বাড়িটি যে পদস্থ ব্যক্তির তা বাইরে থেকেই বোঝা যায়। হয়তো কোম্পানির দেওয়া কোয়াটার্স, হয়তো বা কোম্পানির দেওয়া মোটা ভাড়ায় আহরিত—যাই হোক, বাড়ির চেহারায় মালিকের পদস্থতার ছাপ সুস্পষ্ট।

উঁচু লোহার গেটের ধারেই পালিশ করা টুলে বসা সুসজ্জিত দারোয়ান, ফুলের কেয়ারিতে সাজানো সবুজ মখমলের মত ঘাসের আস্তরণ পাতা লন, একেবারে বাড়ির দেয়ালে বারান্দায় উঠতেই দুষ্প্রাপ্য ক্যাকটাসের সারি বারান্দার মধ্যে গর্বিত ভঙ্গীতে নিঃশব্দে পায়চারীরত বিশালাকায় অ্যালসেসিয়ান, বারান্দায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত খানচারেক বেতের চেয়ারে পুরু ডানলোপিলোর কুশান, এবং ঢুকতেই প্রথম ডানহাতে ঘরটির দরজায় তাম্রফলকের উপর কালো রেখায় লেখা—অফিস রুম।

সুসীমা তাকিয়ে দেখল লেখাটা, রুচি আছে।

এই ঘরের মধ্যে দারোয়ান তাকে পৌঁছে দিয়ে গেল।

অফিস রুমের উপযুক্ত সাজসজ্জা সম্বলিত ঘরে টেবিলের সামনে চেয়ারে কাঁচাপাকা চুল মাথায় যে ভদ্রলোকটি বসে ছিলেন, তিনি সুসীমাকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, বসুন। ভদ্রলোকের ভঙ্গীতে বোঝা গেল, তাঁর বিশেষ কোন পদস্থতা নেই, অফিস রক্ষক কর্মচারী মাত্র।

চেয়ারে বসে ব্যাগ থেকে খবরের কাগজের একটি কাটিং বার করে টেবিলে রেখে সুসীমা বলল, ‘এটা তো আপনারাই দিয়েছিলেন?’

কাঁচাপাকা চুলওলা ভদ্রলোক কাগজটুকুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেই বুঝতে পারলেন, তাঁদের দেওয়াই বিজ্ঞাপন। একটি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞাপনটি দেওয়া হচ্ছে গত দু’ সপ্তাহ থেকে।

‘একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মাতৃহীন শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শিক্ষিতা সেবানিপুণা ধৈর্যশীলা নার্স আবশ্যক।’ এইটিই এরা ইংরেজি দৈনিকে দিয়েছেন, যাতে যেমন তেমন আয়া এসে ভীড় না করে।

অবশ্য কলকাতার বাইরে এই ইস্পাত—নগরীতে কর্মপ্রার্থিনীর ভীড়ের প্রশ্ন কম, তবু এঁরা সাবধানতা অবলম্বন করেছেন।

ভদ্রলোক শান্ত গলায় বসলেন, ‘হ্যাঁ আমাদেরই দেওয়া কনডিশান সব নিচেই দেওয়া আছে—’

সুসীমা আর একবার কাটিংটার দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করল। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়—ভদ্র পরিবেশ, থাকা খাওয়া উচ্চমানের, মাসিক বেতন তিনশত। বলল, ‘দেখেছি।’

‘তাহলে আপনি’—কাঁচাপাকা চুলওলা ভদ্রলোক যেন ইতস্তত করছেন। কারণটা হয়তো এই—এঁরা নিজেদেরকে সম্ভ্রান্ত ঘর বলে বিজ্ঞাপিত করে চাহিদার মান জানালেও এমন সম্ভ্রান্ত চেহারার নার্স এসে হাজির হবে, এটা বোধ করি ধারণা ছিল না ভদ্রলোকের।

মোটা লেন্সের চশমার মধ্যে থেকে মহিলাটিকে বা মেয়েটিকে দেখে নিলেন ভদ্রলোক, সুন্দরী কি রূপসী একথা মনে এল না তাঁর, শুধু মনে এল—ও বাবা, এই মহারাণীর মত মেয়ে ছেলের ধাই হতে এসেছে!

সুসীমার বেশে—বাসে গঠনে ভঙ্গীতে মুখশ্রীর দীপ্তি আর দৃষ্টির দৃপ্তিতে যেন সত্যিই একটি মর‍্যাদাময়ী মহিমাময়ী ভাব।

সুসীমার কথার ভঙ্গী কিন্তু খুব নম্র। বলল, ‘কাজটা পেলে আমার সুবিধে হয়।’

ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়, আমরা তো এরকম একটি লোকের জন্যেই হাঁ করে রয়েছি। মানে একেই তো ছেলেটির মা নেই, তার ওপর আবার বাবা, মানে আমাদের মালিক এম, এন, চ্যাটার্জি—ওঁকে হঠাৎ মাস তিনেকের জন্যে বাইরে চলে যেতে হল, ছেলে একেবারে ক্ষেপে—টেপে—’

‘স্বাভাবিক।’ বলল সুসীমা।

ভদ্রলোক কৃতজ্ঞ গলায় বলেন, ‘এইতো আপনি ঠিক ধরতে পারলেন, এটাই স্বাভাবিক। সবাই বাচ্চার সাইকল্যাজি বুঝতে পারে না। তাহলে এখন থেকেই—মানে আপনার জিনিসপত্র এনেছেন তো?’

সুসীমা বলল, ‘হ্যাঁ, সুটকেস একটা আছে সঙ্গে, স্টেশনমাস্টারের ঘরে জমা রেখে এসেছি—’

ভদ্রলোক বললেন, ‘সে কি, সে কি? রেখে এলেন কেন?’

সুসীমা একটু হেসে বলল, ‘বাঃ চাকরিটা হবে কি না হবে তার ঠিক নেই—’

ভদ্রলোক বিব্রত বিপন্ন বিগলিত গলায় বললেন, ‘এ কি বলছেন! আপনার মত একজন—আচ্ছা আমি এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি—’

সুসীমা ওঁর ব্যস্ততা দেখে মনে মনে হাসল। তবে মুখে খুবই নম্রতা দেখিয়ে বলল, ‘না, আপনাকে আনিয়ে নিতে হবে না, আমি সাইকেল রিকশাটাকে দাঁড় করিয়েই রেখেছি। ভাবলাম ইণ্টারভ্যুর জন্যে ঘণ্টাখানেক সময় লাগতে পারে। তা আপনার মালিক তো আবার—’

ভদ্রলোক আরো ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কিছু না কিছু না। সাহেব আমার উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়ে গেছেন। মানে আমার এ সংসারের ম্যানেজারও বলতে পারেন, কেয়ার—টেকারও বলতে পারেন, বাজার—সরকারও বলতে পারেন, আসলে সাহেবের তো আর—’

নিজস্ব ভঙ্গীতে অসমাপ্ত কথার মাঝখানে ড্যাস টেনে দিয়ে ভদ্রলোক একটু নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আর সংসার বলতেই বা কী? ওই তিন বছরের ছেলেটা।…আমার নাম সুরেশ ঘোষ, নিজের ঘর সংসার নেই, সাহেবই আমায়—’

সুসীমা বলল, ‘এখানেই আপনাদের স্থায়ী বাস তো?’

সুরেশ ঘোষ বোধহয় এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। একটু থেমে বললেন, ‘স্থায়ী মানে আর কি! সাহেব যতদিন এখানে টেলকোয় চার্জ নিয়ে এসেছেন। তা বছর চার পাঁচ হল। আমিও তদবধিই আছি।…আপনি কি টাটা এক্সপ্রেসে এলেন?’…অর্থাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্ত্তন করলেন তিনি।

‘হ্যাঁ, এটাই সুবিধে মনে হল।’ বলল সুসীমা, ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে। তারপর তাকিয়ে দেখতে লাগল চারিদিকে। জানলা দরজার পর্দা, দেয়ালের ছবি।

সুরেশবাবুর মনে হল মেয়েটি যেন বিমনা হয়ে যাচ্ছে। ভয় হল। তবে কি চাকরিটা নেবে কিনা দ্বিধা করছে?

কেন রে বাবা! শয়তান ছেলেটিকে তো দেখেনি এখনো। বাইরে থেকে কি কেউ বলেছে? কিন্তু কে—ই বা বলবে? বর্ত্তমান আয়া মালতির সঙ্গে তো এনার দেখাই হয়নি। তাছাড়া কেনই বা বলবে মালতি, সে তো স্বেচ্ছায় কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। নেহাৎ যে ক’টা দিন শিক্ষিতা ধৈর্য্যশীলা নার্স না পাওয়া যায়, সেই কদিনের জন্যে তাকে খোশামোদ করে রাখা হয়েছে। আসলে তো সেটা বাসন মাজা ঝি, তাকেই ভব্যি করে আয়া বানানো হয়েছে কিন্তু আর তো চলে না, ছেলে যত বড় হচ্ছে ততই তো প্রবলেম প্রবল হয়ে উঠেছে।

বিমনা হবার মানে কী? মাইনে আরো বেশী চায়? তা চায় তো নিক না বাবা, এমন মানুষটি ফস্কে না যায়। এটা ঠিক, এ রকমটি আর মিলবে না।

সুরেশবাবু ব্যস্ত গলায় বলেন, ‘দেখুন, বিজ্ঞাপনে আমরা একটা মোটামুটি ইয়ে ধার্য করেছি বটে, তবে আপনার যদি মনে হয়, ওটা কম হচ্ছে, তাহলে যা বলবেন—’

সুসীমা অবাক গলায় বলে, ‘সে কী? কম মনে হচ্ছে একথা তো বলিনি আমি! ভাবিওনি।’

‘বেশ বেশ। তাহলে ঠিক আছে। তা আগে আপনার ঘর—টর দেখে নেবেন, না আগেই স্টেশন থেকে—’

সুসীমা বলল, ‘রিকশাটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, আগেই ও কাজটা সেরে আসি।’

সুরেশবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মনে মনে ভগবানকে ডাকলেন। ভাগ্যিস!

কে বলতে পারে ছেলে দেখে মেজাজ ঘুরে যেত কি না। একেই তো সেই বিচ্ছু ছেলে, তার আবার ক’দিন জ্বর—টর হয়েছে, ইচ্ছে মত খেতে পাচ্ছে না।

সুসীমা গিয়ে রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে স্টেশনে যাওয়ার নির্দেশ দিল, গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে তরতর করে বেরিয়ে গেল সে।

আসবে তো আবার! কে জানে বাবা! কিন্তু অপছন্দ হবার মত কিছু দেখেইনি এখনো।

হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন সুরেশ ঘোষ কিছুক্ষণ, তারপর নিশ্বাস ফেলে ভিতরে ঢুকে এলেন। আশ্চর্য কপাল সুরেশ ঘোষের! এই সময়টিতেই সাহেব নেই। সাহেব থাকতেই তো বিজ্ঞাপনটা দেওয়া হয়েছিল, কে জানত কোম্পানি একেবারে বিনা নোটিশে হঠাৎ বাইরে পাঠিয়ে দেবে ওঁকে। ঠিক এই সময়ই যেন ওদের ওই এস এন ব্যানার্জিকে আমেরিকা না পাঠালে চলছিল না।

এখন আফশোস হচ্ছে নিজে মেয়েটির সঙ্গে গেলেন না বলে। যদি আর না আসে। কিন্তু যাবেনই বা কোন ছুতোয়।

তারপর ভাবলেন, না আসবেই বা কেন? স্বেচ্ছায় এসেছে, সঙ্গে সুটকেসও এনেছে, তার মানে চাকরিটা দরকার। বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর চিঠিপত্র এসেছে অনেকগুলো, তাঁদের উত্তরও দিচ্ছেন সুরেশ ঘোষ, কিন্তু খুব মনঃপূত হচ্ছে না কোনটাই। ইংরেজি কাগজে দেওয়ার জন্যে অবাঙালীর কাছ থেকেই আবেদন এসেছে বেশী, তার মধ্যে প্রধানত মাদ্রাজী। সুরেশবাবুকে কাটলেও যাদের ভাষার একবর্ণও বুঝতে পারবেন না।…বেহারীও রয়েছে, যাহোক হিন্দিতে চালিয়ে দেওয়া যায়, তবে কেউ কেউ বলেছে, ট্রেন ভাড়া পাঠাতে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছে, বাড়িতে আর কোন মহিলা আছেন কিনা, দু’একজন আবার প্রশ্ন করেছে শিশুর মেজাজ কেমন, গাঁটের কড়ি খরচা করে স্রেফ চলে আসেনি কেউ। এবং বিনা প্রশ্নে রাজী হয়ে যাওয়ার প্রশ্নও ওঠেনি।

তার মানে, টাকাটাই ওর কাছে জরুরী। অথচ মোচড় দেবার সুবিধে পেয়েও দিল না। তার মানে ভদ্র। আর বোধহয় সত্যিই শিক্ষিত। চেহারাটা যেন বড় ঘরের মত। পরিচয়টা নেওয়া হল না। কুমারী, না বিধবা? সধবাও হতে পারে। আজকাল তো সিঁদুর ফিঁদুর পরেও না সবাই। কিন্তু নামটাই বা জিগ্যেস করলেন কই সুরেশবাবু? দেখেই কেন যে কেমন অভিভূত হয়ে গেলেন। মেয়েটার রূপ এবং ভঙ্গীর জন্যেই বোধহয়।

স্টেশন থেকে ঘুরে আসবার টাইমটা দেখতেই হবে ধৈর্য ধরে। কিন্তু তারপর? তারপর আর কোন উপায়ই নেই যোগসূত্র স্থাপনের। যারা চিঠিপত্র দিচ্ছে, তাদের নাম ঠিকানা রয়েছে। এর তো কিছুই—

মনের চাঞ্চল্য দমন করতে না পেরে, ভিতরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন সুরেশবাবু, ‘মালতি—’

মালতির ঝঙ্কার শোনা গেল, ‘কি বলছেন ম্যানেজারবাবু এখানে এসে বলেন! আমার এখন মরণের টাইম নাই।’

মরণের টাইম নাই। অতএব এগিয়ে গেলেন সুরেশবাবু। গিয়ে দেখলেন বিছানার উপর বসে আছে সাগর, তার চারিপাশে বালিশ—টালিশ লণ্ডভণ্ড ভাবে ছড়ানো, ঘরের মেঝেয় দুধের সাগর বইছে। তার সঙ্গে কাঁচের গ্লাস ভাঙা টুকরো।

সাগরের মুখ হিংস্র, তার মুঠোর মধ্যে মালতির শাড়ির একাংশ এমনভাবে ধরা, উঠে চলে যাবার চেষ্টা করলে মালতিকে শাড়িটা ফেলে রেখে শুধু সায়া পরে চলে যেতে হবে।

অথচ সাগরের মুখে বাক্যি—টাক্যি নেই। এক এক সময় এইরকম নীরব হিংস্র হয়ে ওঠে সাগর।

সাগরের রং অতিরিক্ত ফরসা, চুল আর চোখ ধূসর। সাগরের গড়ন রোগাটে, মুখটা শুকনো। খুব সম্ভব ক’দিনের জ্বরে আরো শুকনো।

সুরেশবাবু খুব সন্তর্পণে বললেন, ‘কি হল?’

মালতি তীব্র কণ্ঠে ব’লে উঠল, ‘কি হল সে তো দেখতেই পাচ্ছেন! আজই আমায় ছেড়ে দেন ম্যানেজারবাবু। দেহে প্রাণটা থাকতে থাকতে বিদেয় হই! উঃ কি ছেলে! পিচেশ, না দ্যোত্যি তা জানিনে।’

সুরেশবাবু আস্তে বলেন, ‘সাগর মালতির কাপড়টা ছেড়ে দাও বাবু—’

সাগর একবার তাচ্ছিল্য ভরে তাকিয়ে দেখে হাতের মুঠোটায় আরো একটা পাক দেয়। যাতে শাড়ির আরো খানিকটা অংশ ওর কবলিত হয়ে যায়।

সুরেশবাবু ভীত চক্ষে ছেলেটির দিকে তাকান। তারপর তেমনি ভীত গলায় বলেন, ‘মালতি, একটু আগে একটি মেয়ে এসেছিল, দেখেছিলে?

মালতি তীব্র কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘আমার বাবা এলেও দেখতে পেতুমনি ম্যানেজারবাবু, তা মেয়ে।’

‘না মানে মেয়েটি তো বলে গেল ছেলে দেখার কাজটা নেবে। তবে ঠিক আসবে কিনা বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আসবে নাই বা কেন, অ্যাঁ? চাকরি করবে বলেই তো এসেছে—

মালতি বেজার গলায় বলে, রোজই তো আপনার কাছে লোকের গপপো শুনি। চিঠি নিকেচে, আসব বলেচে তা আসুক চাই না আসুক, আমি আজ বিদেয় নিচ্ছি। সাহেব নেই বলে যদি মাইনে আটকে রাখেন, রাখুন। আমি যাবই!

সুরেশবাবু ব্যস্ত হয়ে বলেন, ‘আহা মাইনে আটকে রাখার কথা উঠছে কেন? আমি তো তোমায়, মানে, মেয়েটি যদি—’

হঠাৎ সাগর ভাঙ্গা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কে আসবে?’

সুরেশবাবু তাড়াতাড়ি বলেন, ‘তোমার নতুন মাসি।’

সাগর হিংস্র গলায় বলে, ‘না, আসবে না, এলে আমি মেরে শেষ করব, চুল ছিঁড়ে দেব, গলা কেটে দেব।’

সুরেশবাবু নরম গলায় বললেন, ‘ছি, বাবু, ও কথা বলতে নেই। দেখবে উনি কত ভাল!’

‘না—আ!’ সাগর আপ্রাণ চেঁচায়, ‘ভাল না হাতী। আমি ওকে খাট থেকে ফেলে দেব।’ বলে বালিশগুলো তুলে নিয়ে খাট থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই অবকাশে মালতি বন্ধনমুক্ত হয়ে উঠে পালায়।

সুরেশবাবু বিচলিত চোখে ঘরের দৃশ্যটি দেখতে থাকেন। এই দৃশ্যের সঙ্গে সুরেশবাবু সেই মেয়েটিকে মনে করেন। প্রথম এসেই যদি ঘরের এই দৃশ্য দেখে, মানসিক অবস্থাটি কেমন হবে তার? মালতি আর এ ঘরে সহজে ঢুকছে না, এটা নিশ্চিত। নিরুপায় হয়ে ঘরমোছা চাকরটাকে ডাক দিতে বেরিয়ে আসেন, আর দেখেন সেই চাকরটা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে—এই মাত্তর যে মেয়েছেলেটা এসে আবার চলে গেছল, সে আবার এসেছে ম্যানেজারবাবু।’

সকলের আগে তাকে নামটাই জিজ্ঞেস করলেন সুরেশবাবু। যেভাবে বললে শোভন হয়।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘মিস মিসেস কিছু বলতে হবে না আপনাকে, স্রেফ ‘সুসীমা’ বলে ডাকবেন।’

সুরেশবাবু কুণ্ঠিত ভঙ্গীতে বললেন, ‘তা কি করে হয়?’

‘কী মুশকিল! কেন হবে না? আমি তো আপনার মেয়ের বয়সী। কী, আপনার মেয়ের বয়স আমার মত হবে না?’

সুরেশবাবু বিষণ্ণ হাসি হেসে বললেন, ‘মেয়ে থাকলে হয়তো তাই হত। তবে ঘর সংসার তো করিনি, বাউণ্ডুলে হয়ে বেড়িয়েছি। সাহেবই প্রথম আমায় ঘরবাসী করেছেন। এমন মানুষ হয় না, দেবতার মতন।’

সুসীমা অভিভূতের মত বলে, ‘তাই বুঝি?’

সুরেশবাবু আক্ষেপের গলায় বলেন, ‘এসেই প্রথম নম্বর দেখতে পেলেন না, এই দুঃখ। যাই হোক এসে যাবেন শীগগিরই। তিনমাসের মধ্যেই এসে যাবেন।’

সুসীমা বলে, ‘তা এইবার আমার আসল ডিউটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন।’

সুরেশবাবুর মনের চোখে সেই আসল ডিউটির ঘরের দৃশ্যটা ভেসে ওঠে।

সুরেশবাবু প্রমাদ গুণে বলেন, ‘আহা সেই পরিচয় তো হবেই। এখন নিজের ঘরটা দেখে—টেখে নিন, হাত—মুখ ধুয়ে নিন, ট্রেনে এসেছেন একটু বিশ্রামের দরকার।’

কিন্তু সুরেশবাবুর বাধা দেবার চেষ্টা বৃথা হয়। বিশ্রামের প্রশ্নটা হেসেই ওড়ায় সুসীমা।—মাত্র ঘণ্টাকয়েকের ট্রেন—জার্ণিতে আবার বিশ্রাম কিসের, বলে হাসে, এবং নিজের ঘর সম্পর্কে কোন রকম ঔৎসুক্য আগ্রহের লেশ না দেখিয়ে, তার চাকরির ফাইলটি দেখার জন্যেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

অগত্যাই সুরেশবাবুকে বলতে হয়, ‘তবে চলুন। ব্যাপার হয়েছে কি সাহেব রওনা দেবার পরই জ্বর হয়ে গেল বাচ্চাটির, ইচ্ছে মতন খেতে—টেতে তো পাচ্ছে না, রেগে যাচ্ছে। এইমাত্র দেখে এলাম দুধের গ্লাস উল্টে ফেলে ঘরের চেহারা যা করেছে না—’

সুসীমা হেসে ফেলে বলে, ‘সে তো অনুমানই করছি। আপনাদের বিজ্ঞাপনের চাহিদার মধ্যে একটা কথা ছিল, ‘ধৈর্যশীলা’ সেটা আমার মনে আছে।’

সুরেশবাবু অভিভূত হন। একী নিধি পেলেন তিনি! তবু ভয় হচ্ছে; ভাগ্যে কি টিকবে? সাহেব আসা পর্যন্ত কি ধরে রাখতে পারবেন? ইস, সাহেব থাকতে যদি এসে যেত মেয়েটা। সুরেশবাবুর আর কোন দায়িত্বই থাকত না। যা কিছু জানাবার তিনিই জানাতেন। সুরেশবাবু কি জানেন, কতটুকু বলতে হবে কতটুকু জানাতে হবে। ভাববার সময়ও তো পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কিছু না বলে দিলেও তো দেখে চমকে যেতে পারে।

সুসীমাকে সঙ্গে করে সাগরের কাছে নিয়ে যেতে যেতে সুরেশবাবু নীচুগলায় বলেন, সাহেব উপস্থিত না থাকায় আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে। একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দেওয়াই উচিত মনে হচ্ছে, না হলে আপনি হয়তো—মানে বাচ্চাটির মা ছিলেন একজন ইউরোপিয়ান লেডি। কিন্তু খুবই দুঃখের ঘটনা, শিশুটি যখন মাত্র বছর দেড়েকের তখন তিনি—’ সুরেশবাবু মাথা নীচু করেন।

সুসীমা মৃদু গলায় বলে, ‘মারা গেলেন?

সুরেশবাবুর মুখটা একটু পাংশু দেখাল। বললেন, ‘হ্যাঁ তাই—ই। সেই অবধি সাহেবের যা অবস্থা! দেখলে দুঃখ হয়।’

সুসীমা আস্তে বলে, ‘এক একজনের ভাগ্যই দুঃখের হয় সুরেশবাবু। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সুখের উপকরণ ওর হাতে সবই মজুত, কিন্তু—’

‘ঠিক বলেছেন আপনি, ঠিক বলেছেন।’ সুরেশবাবু কৃতজ্ঞ গলায় বলেন, যথার্থ শিক্ষিতা তো।

যথার্থ শিক্ষিতা মহিলাটিকে নিয়ে সেই বেহেড ঘরের দরজায় এসে পৌঁছলেন সুরেশবাবু। দেখা গেল ঘরের চেহারা একই আছে, ক্ষুদে চাকর গণেশ সাবধানে মাটি থেকে কাঁচের টুকুরো কুড়োচ্ছে, আর সাগর হি হি হেসে হেসে বলছে, ‘বেশ হবে, ঠিক হবে, তোর হাতে কাঁচ ফুটে যাবে, রক্ত পড়বে—’

সুরেশবাবু ম্লান গলায় বলেন, ‘আপনাকে বলছিলাম না—’

‘আপনি’টা আপনি ছাড়ুন সুরেশবাবু, তা নাহলে আমার খুব অসুবিধে হবে।’

সুরেশবাবু বিপন্ন ভাবে বলেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, তাই হবে।’

তারপর খুব সাবধানে বলেন, ‘সাগর, এই তোমার নতুন মাসি। সেই যাঁর আসার কথা বলছিলাম তখন—’

সাগর খাটের উপর দাঁড়িয়ে উঠে বলে ওঠে, ‘বলেছিলাম না নতুন মাসি আসবে না। এলে আমি গলা কেটে দেব।’

সুরেশবাবুর বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে সুসীমা কৌতুকের সঙ্গে একটু করুণাও অনুভব করে। কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলে না, দিব্যি হৈ হৈ গলায় বলে ওঠে, ‘নিশ্চয়। দেবেই তো। কে ওই মাসিকে আসতে বলেছে? মাসিটাসি এলে তোমাতে আমাতে দুজনে মিলে মেরে শেষ করে দেব না?’

সাগর বোধহয় ঠিক এ রকমের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই সন্দেহের গলায় বলে, ‘তাহলে তুমি কে?’

‘আমি?’ সুসীমা তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, ‘আমি তো আণ্টি।’

‘আণ্টি?’ সাগর চোখ কুঁচকে দেখে নেয়, বোধহয় অনুধাবন করতে চেষ্টা করে ওর সঙ্গে কি ধরনের ব্যবহার সঙ্গত, তারপর বলে, ‘তুমি কোথা থেকে এসেছ?’

‘বাঃ কলকাতা থেকে তো? ওঁরা তোমায় বলেননি আমি আসব?’

সাগর তীব্র ছন্দে বলে, ‘ওরা আমায় কিছু বলে না, দারুণ পাজী।’

বছর চারেকের ছেলেটার ভাষার ছটায় বিগলিত সুসীমা দ্রুত গলায় বলে ‘এই সেরেছে। ওই ভাবে কথা বলছ? ভগবান রেগে যাবেন না?’

এই ছেলেকে যে ‘ছি বাবা, বলতে নেই’ ভাষায় নিবৃত্ত করতে যাওয়া নিছক বাতুলতা, তা এক নজরেই বুঝে ফেলে সুসীমা।

সাগর থমকে গিয়ে বলে, ‘কি করে? ভগবান কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে?’

‘নিশ্চয়!’ সুসীমা বলে, ‘সক্কলের সব কথাই শুনতে পান।’

‘ছাই পান! সব তোমার গুল’—সাগর হি হি করে হেসে উঠে বলে ‘আমায় ঠকাতে এসেছ।’

তবু ভাল যে হেসেছে। সুরেশবাবু আশান্বিত চিত্তে বললেন, ‘কিন্তু আপ—মানে তোমার তো চা—টা খাওয়া হল না।’

‘হবে, হবে, তাড়া কি?’ বলে সুসীমা সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কি বল সাগর, চা খাওয়ার তাড়া কী? পরে খেলেই হবে।’

সাগর কড়া গলায় বলে, ‘না পরে না, তুমি এক্ষুনি চা খাবে, বিস্কুট খাবে, কেক খাবে, রসগোল্লা খাবে।’

সুসীমা আতঙ্কের ভানে বলে, ‘ওরে বাবা, এত খেতে হবে?’

সাগর আত্মতৃপ্ত গলায় বলে, ‘হবেই তো, আমায় কেন গাদা গাদা খেতে দেয়।’

সুসীমা বলে, ‘আর হবে না। আমি সক্কলকে বকে দেব। গাদা গাদা খেতে বিচ্ছিরি লাগে না বুঝি?’

সাগর আবার ভুরু কুঁচকে বলে, ‘তুমি থাকবে?’

‘থাকবই তো।’

‘ক’দিন থাকবে?’

‘যদি তুমি রাগ না কর তো অনেক দিন।’

সাগর উদার গলায় বলে, ‘আমি কেন রাগ করব? তোমার যতদিন ইচ্ছে থেকো। চিরকালও থাকতে পারো।’

সুসীমা হেসে উঠে বলে, ‘অতটা বোধ হয় পেরে উঠব না। কিন্তু আমি একা একা খাব? এস না দুজনে মিলে খাই। সুরেশবাবু আছেন এখানে? কাউকে বলুন না, আমাদের দুজনের খাবার এনে দিতে। সাগর বাবুর তো দুধ খাওয়া হয়নি।’

সাগর ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘আমি দুধ খাব না, তুমি যা খাবে, তাই খাব।’

‘ও মা, তা আর বলতে,’ সুসীমা বলে, ‘যাই দেখিগে ওরা কি দিচ্ছে আমাদের।’

সুরেশবাবু যে এতক্ষণ দরজার আড়ালেই ছিলেন তা বুঝতে দেরী হয়নি সুসীমার। এদিকে চলে আসতে তিনিও সরে আসেন। উৎফুল্ল মুখে বলেন, ‘তুমি পারবে।’

সুসীমা হেসে বলে, ‘এখুনি অত আশা পোষণ করবেন না।’

অনেক কাঠ—খড় পুড়িয়ে রোগীর সঙ্গে রোগীর খাদ্য খেয়ে তাকে ওষুধ খাইয়ে এবং গল্প—টল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে যতক্ষণে ছুটি হল ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে।

এতক্ষণে সুরেশবাবুর নির্দিষ্ট ঘরে এসে দাঁড়ায় সুসীমা। চারিদিক তাকিয়ে একটু হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে।

‘খাওয়া থাকা উচ্চমানের’ এই ভাষাটা নেহাৎ বিজ্ঞাপনের ভাষা নয়, তা বোঝা যাচ্ছে। তবু এতটা উচ্চমানের হবে এমন আশা ছিল না। ডানলোপিলোর গদিদার সিঙ্গল খাট, শৌখিন ডিজাইনের ড্রেসিং টেবল, ছোট আলমারী। নীচু ওয়ার্ডরোব, খাটের ধারে টেবিল চেয়ার, দেয়ালের ধারে একখানা টানা লম্বা সোফা, মেঝেয় কার্পেট, সুদৃশ্য পাপোষ। হাতের কাছে বেডসুইচ, সুন্দর টেবল ল্যাম্প, ছোট বুক শেলফ, জানালার বেদীতে ক্যাকটাস, নীচু আলমারির মাথায় ফুল সমেত ফুলদানী। এ কে ধারণা করতে পারে?

এক কথায় একটি সুরুচিসম্পন্ন শৌখিন মানুষের একক কক্ষ ঠিক যেমনটি হওয়া উচিৎ ঠিক তেমনটি। কিন্তু কার জন্যে সাজানো এই ঘর? সুসীমা আসছে একথা কি জানা ছিল এদের?

‘এই তোমার ঘর। যদি কিছু অসুবিধে হয়, জানাবে।’ বলে চলে যান সুরেশবাবু।

সুসীমা খাটের উপর বসে পড়ে। সুসীমার মুখের উপর যেন একটি হালকা সূক্ষ্ম হাসির জাল। সুসীমা আরো হালকা উচ্চারণে প্রায় মনে মনেই বলে, ‘আমার ঘর!’

তারপর ভাবে অবোধেরা কত অনায়াস অবলীলায় কত অবাস্তব কথা উচ্চারণ করে বসতে পারে। সমস্ত দিনের ক্লান্তি গেছে, তবু সুসীমার যেন শুয়ে পড়ার তাড়া নেই। সুসীমা ঘরটাকে নিরীক্ষণ করে দেখতে থাকে। কে থাকত এ ঘরে? কার জন্যে সাজানো গোছানো হয়েছিল এই ঘর? সেই ইউরোপিয়ান লেডির জন্যে?

তা তাঁর জন্যে একক শয্যার ঘর কেন? মৃত্যুর আগে কি মহিলা কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগেছিলেন? তাই তাঁর জন্য একক কক্ষের প্রয়োজন হয়েছিল? তা সেও তো অনেক দিনের বিগত ঘটনা।

আচ্ছা, শুধু ঘরটা দেখে কি বোঝা যায়, এ ঘর মহিলার অধিকৃত ছিল, কি পুরুষের? ড্রেসিং টেবলটায় কি মহিলার ব্যবহারের ছাপ আছে?

সুসীমা ভাবল, আশ্চর্য, সম্পূর্ণ অজানা এই নতুন জায়গাটায় এসে আমার কিছু ভয় করছে না কেন?

ভয় করছে না, তবু সুসীমা উঠে ঘরের দরজাটায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। সংলগ্ন বাথরুমের দরজাটা খুলে দেখে নিল। এই বাড়ির এই ঘরের সঙ্গে মানানসই বাথরুমের সাজসজ্জা, পাশের দিকে জমাদার ঢোকার দরজাটা শুধু ছিটকিনি দিয়েই বন্ধ নয়, একটা তালাচাবিও লাগানোর রয়েছে।

অতএব নিরাপত্তার অভাব নেই। তবে যেন মনে হচ্ছে দরকার ছিল না, এত নিরাপত্তার দরকার ছিল না। হয়তো দরকার হত, যদি বাড়ির মালিক উপস্থিত থাকতেন। কে বলতে পারে, কী তাঁর মতিগতি, কী তাঁর ধরণ!

যাক, আপাতত তিনমাসের জন্য তো নিশ্চিন্ত, মনে মনে বলে নিল সুসীমা। তারপর ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে, বেডরুম লাইটটা জ্বেলে নিয়ে শাড়ি জামা বদলাবার প্রস্তুতিতে হাত লাগাল।

মৃদু নীল আলোয় প্রায় নিবাবরণ দেহের স্বপ্নিল ছায়াটা প্রকাণ্ড লম্বা আয়নাটার গায়ে প্রতিফলিত হল। সুডৌল সুঠাম এই সুগঠনা নারীমূর্তির দিকে যেন মোহগ্রস্তের মত তাকিয়ে রইল সুসীমা একজোড়া পুরুষের চোখ নিয়ে।

আশ্চর্য, আমি সারারাত দিব্যি চমৎকার একখানা ঘুম ঘুমিয়েছি! ভোর বেলায় ঘুম ভাঙতেই কথাটা ভেবে নিল সুসীমা। ঘুমের কোন ব্যাঘাত হল না, সারারাত কোন অশরীরি আত্মার অতৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস আমার শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেল না, কোন কৌতুকপরায়ণা কঙ্কালের হাড়ের খটখটি শুনতে পেলাম না। শুলাম, আর ঘুমিয়ে পড়লাম! ছিঃ! আমি একটা কী!

উঠে পড়ল সুসীমা, পাপোসের কাছ থেকে চটিটা টেনে নিয়ে পায়ে গলিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এল ঘরের বাইরের ঢাকা বারান্দায়।

এখন খুব ভোর, তবু এখনই এখানে মাঝখানের টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। তার মানে টিপটপ, নিয়মের বাড়ি। লোকজন ট্রেনড। কিন্তু কারো সাড়া শব্দ নেই।

সুসীমার হঠাৎ তার বাবা মারা—যাওয়ার পরের দিনের ভোরবেলাটার কথা মনে পড়ে গেল। অকারণেই! কিছুর সঙ্গেই সাদৃশ্য নেই, তবু।

মনে পড়ল অনেক রাত্রে বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার পর কখন যেন ঘুমিয়ে গেছল সুসীমা, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল যখন, তখনো খুব ভোর কেমন যেন আচ্ছন্নের মত ঘর থেকে বেরিয়ে এল সুসীমা, কাউকে দেখতে পেল না।

মা কোথায় কে জানে! মায়ের মা আর বোনেরা এসেছেন, কোন একটা ঘরে পড়ে আছেন তাঁদের স্নেহচ্ছায়ায়। সুসীমা আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নীচের তলায় নেমে এল, সেখানেও কেউ কোথাও নেই, শুধু এখানে সেখানে কিছু ছেঁড়া ফুল ছড়ানো, শুধু এখানে ওখানে বিসদৃশ দু—একটা জিনিষ পড়ে। বোধহয় কাত হয়ে গড়িয়ে থাকা একটা ঘটি, একখানা তালপাতার পাখা, একখানা দড়ি পাকানো শুকনো গামছা।

একা ওই স্তব্ধতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুসীমার গা ছমছম করে উঠেছিল, সুসীমা খালি মেঝেয় বসে পড়েছিল দেয়ালে ঠেশ দিয়ে।

সেই পরিবেশের সঙ্গে আজকের এই ছিমছাম ফিটফাট পরিবেশের কোন সাদৃশ্য নেই, তবু কেন কে জানে সুসীমার সেদিনের কথাটা মনে পড়ে গেল। সুসীমার রাত্রে একটুও গা ছমছম করেনি, এখন এই ভোর আকাশের কোমল আলো আর গা জুড়ানো বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে সুসীমার গা ছমছম করে এল, গা থরথর করে উঠল। অদ্ভুত বৈ কি?

সুসীমার ইচ্ছে হল সেদিনের মতই মাটিতে বসে পড়ে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেই ভোরের স্তব্ধতা ভেদ করে সাগরের চিৎকার শোনা গেল, ‘তুই কেন আমার কাছে শুয়েছিলি? তুই কেন আমার গায়ে হাত দিচ্ছিস!’

এরপর মালতির গলাও শোনা গেল, ‘আমার কপাল? আর কেন! ম্যানেজার বাবুর হুকুম আরো পাঁচদিন থেকে নতুন আয়াকে বুঝিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। ছেড়ে দাও না বাবা, আমি আজই দেশে চলে যাই।’

ওদের কথার বাঁধুনিতে নতুন আয়ার মুখে একটু ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল।

সুসীমাকে দেখে সাগর উথলে উঠল, ‘তুমি কেন অন্য ঘরে শুয়েছিলে? মালতি কেন আমার গায়ে হাত ঠেকিয়েছে—’

সুসীমা চটপট বলে ফেলল, ‘কী আশ্চর্য মালতি, তুমি ওর গায়ে হাত ঠেকিয়েছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। যাও যাও তুমি চা—টা খাও গে, সাগরের কাছে তো শুধু সাগরের আণ্টি থাকবে, তাই না?’

চট করে সাগরের মুখে অলৌকিক হাসির বিদ্যুৎ খেলে গেল। সাগর সেই হাসি নিয়ে বলল, ‘তুমি আমায় মুখ ধুইয়ে দেবে? তুমি আমায় জামা পরিয়ে দেবে।’

সুসীমা বলল, ‘নিশ্চয়!’

মালতি একটা জ্বালা ভরা চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কর না কর, জন্ম জন্ম কর, মেমসাহেবের বেটাকে সামলানো তোমার মতন মেমসাহেবেরই কাজ। আমি ম্যানেজার বাবুর কাছে আজই ছুটি করিয়ে নিচ্ছি।’

এও এক মজার মনস্তত্ব, যে কাজে মালতি নিজে অহরহ ত্রাহি ত্রাহি করছে, চলে যাবার জন্য অস্থির হচ্ছে, সেই কাজই অন্য আর একজন দখল করতে এল দেখে এখন ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলতে শুরু করেছে।

ঘরের বিছানাপত্র পাট করতে করতে মালতি আপন মনে গজ গজ করতে থাকে, ‘এতটুকুন বয়েসে মা তো ফেলে চলে গেল, সর্ববিধ করা করে মানুষ করে তুলল কে? এই মালতি ছাড়া আর কেউ ছিল? এখন মালতি দু’চোক্ষের বিষ হয়েছে। দেখব ওই বিবি মাসি ক’দিন সুচক্ষের মধু থাকে।’

সুসীমা আস্তে সরে এল। কিন্তু সরে আর কতক্ষণ থাকবে? কতক্ষণ থাকা যায়? উগ্র ভালবাসার মত অত্যাচার আর কী আছে?

যে অত্যাচারে সেই একজনের মত সাজানো ছিমছাম ঘরটি ছেড়ে সাগরের ঘরে এসে শুতে হয়, আগে সাগরকে ঘুমোবার গল্প বলতে হয়, আর সাগরের কাছে সাগরের বাবার গল্প শুনতে হয়। ওটা না শুনলে রক্ষে নেই।

সাগর বলবে, ‘আমার বাপী না, হিমালয় পাহাড়ের মতন উঁচু বুঝলে?’

সুসীমাকে বলতে হবে, ‘ওরে বাবা! বল কী? এত উঁচু মানুষ তো কক্ষনো দেখিনি।’

সাগর পরিতৃপ্তির হাসি হাসে, ‘দেখবে। বাপী বিলেত থেকে আসুক।’

সুসীমাও হাসে, ‘আর আমি যদি তখন না থাকি?’

সাগর অবাক হয়ে বলে, ‘কোথায় যাবে?’

‘যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানে।’

সাগর কপাল কুঁচকে বলে, ‘তোমার নিজের বাড়িতে?’

‘নাঃ। ‘নিজের কিছু বাড়ি টাড়ি নেই আমার।’

‘তবে কোথায় থাকবে?’

‘এমনি অন্যদের বাড়িতে।’

‘কে তারা?’

‘এই চেনা—টেনা লোক—টোক?’

‘তারা তোমায় ভালবাসে?’

সুসীমা মৃদু হেসে বলে, ‘একটু একটু’।’

সাগর সদম্ভে ঘোষণা করে, ‘তুমি যেখানে যাবে না। আমার কাছে থাকবে।’

‘তুমি তো আমায় মারো।’

সাগর কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে বলে, ‘সে তো রাগ হলে—’

‘তোমার তো রোজই রাগ হয়।’

‘তুমি রোজই দুধ খেতে বল যে—’

‘কাল তো দুধ খেতে বলিনি। শুধু চকোলেট খেতে দিয়েছিলাম।’ সাগর গতকালের ঘটনা স্মরণ করে অবলীলায় বলে, ‘তুমি চুল আঁচড়ে দিতে লাগিয়ে দিয়েছিলে কেন?’

‘ও, তা বটে। এবার থেকে আর লাগবে না। তাহলে মারবে না তো? আচ্ছা সাগর, তোমায় যদি কেউ মারে তোমার লাগে না?’

‘ইস, মারবে বৈকি।’

‘বাঃ তুমি লোককে মারবে—’

সাগর সগর্বে ঘোষণা করে, ‘আমি তো বাপীকেও মারি। দুম দুম করে মারি।’

সুসীমা যেন আকাশ থেকে পড়ে। সুসীমা মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘অ্যাঁ! সে কী? তুমি বাপীকে মারো!’

সাগরের মুখে সেই দিব্য জ্যোতি মাখা একটি অলৌকিক হাসি ফুটে ওঠে, ‘কেন মারব না? বাপী কেন অফিস চলে যায়?’

‘বাঃ, বাপীদের তো অফিস যেতেই হয়। সব্বাইয়ের বাপীই অফিস যায়। যায় না? তোমার বন্ধুদের বাপীরা?’

সাগর গম্ভীর আত্মস্থ গলায় বলে, ‘আমার কোন বন্ধু নেই।’

সুসীমা আবার মাথায় হাত দেয়। আবার আকাশ থেকে পড়ে, ‘বন্ধু নেই? ইস, এমন কথা তো কক্ষনো শুনিনি। পৃথিবীতে সব্বাইয়েরই বন্ধু থাকে।’

সাগর একটু বিমনা হয়ে যায়। সন্দেহের গলায় বলে, ‘চোরেদেরও থাকে।’

‘নিশ্চয়। চোরেদের চোর বন্ধুই থাকে।’

‘আর ডাকাতদের?’

‘তাদেরও ডাকাত বন্ধু থাকে।’

‘আর রাক্ষসদের?’

‘তাদেরও তাই। রাক্ষস বন্ধুই থাকে।’

সাগর জোরে জোরে বলে, ‘বাপী এলে বলব অনেক বন্ধু কিনে এনে দিতে।’

সুসীমা যে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে, এতে সাগরের ভারী স্ফূর্তি, তাই সুসীমাকে মুহুর্মুহুই মাথায় হাত দিতে হয়, হায় হায় করে বলতে হয়, ‘বন্ধু আবার কিনে আনা যায়?’

সাগরও মাথায় হাত দেওয়ার দৃশ্যে উৎফুল্ল হয়ে বলে, ‘কেন যাবে না? বাপীর কত টাকা আছে জানো? আকাশের মতন।’

সুসীমা মাথা নাড়ে, ‘তা হলেও হবে না। বন্ধু নিজে জোগাড় করতে হয়।’

সাগর অতএব ক্রুদ্ধ, ‘কি করে? আমি কি রাস্তায় যাই?’

আর কথা বাড়ানো সমীচীন বোধ করে না সুসীমা, মুহূর্ত্তেই পরিস্থিতি ওলোট পালোট হয়ে যেতে পারে। অতএব সুসীমাকে বোকা হাঁদা বুদ্ধু সাজতে হয় এবং নিজের ভুল স্বীকার করতে হয়।—সত্যিই তো যে একা একা পথে বেরোতে পারে না, সে আবার বন্ধু জোগাড় করবে কোন সূত্রে? সুসীমা নেহাৎই বুদ্ধু তাই বলছে—’

নতি স্বীকার করলে সাগরের প্রসন্নতা অর্জন করা যায়, এ তথ্যটি জানা থাকলেও মালতি কিছুতেই সেটুকু করতে রাজী হত না। এমন কি গণেশ, যে গণেশ সাগরের কাছে মার খেতে খেতে যার জান যাচ্ছে, সেও না। কিছুতেই বলবে না, আমার ভুল হয়েছে, আমি বোকা—সুসীমাকে মিনিটে মিনিটে সেই নতি স্বীকার করতে হয়। সাগর উৎফুল্ল হয়, উৎসাহিত হয়, উদ্ভাসিত হয়।

সাগর এখন আহ্লাদ ভরা কণ্ঠে বলে, ‘বাপীও বুদ্ধু!’

সুসীমার মুখে একটু সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে। সুসীমা বুককেসের উপর রক্ষিত ফটোস্ট্যাণ্ডে রাখা ফটোটার দিকে তাকায়। না, চেহারা দেখে এ সন্দেহ কেউ করতে বসবে না লোকটা বুদ্ধু।

সাগরের খাটটা এমন জায়গায় বসানো যে, এখানে বসলেই ওই ছবিটা দেখতে হবে, দেখে দেখে মুখটা মুখস্থ হয়ে যাবে।

সুসীমার মুখস্থ হয়ে গেছে—ওই মুখটার মধ্যে চোখ দুটো দীপ্ত দীপ্ত বুদ্ধি উজ্জ্বল, নাকটা যতটুকু চোখা হলে লাবণ্য হারায় না ঠিক ততটুকু চোখা, ঠোঁটের গঠন ভঙ্গিমায় আশ্চর্য একটি সৌকুমার্য, অথচ দৃঢ়তার ছাপ কপাল প্রশস্ত, চোয়াল সুগঠিত এবং সবটা মিলিয়ে একটা অদ্ভুত আকর্ষণময়। যেন ঘরে ঢুকলে তাকাতেই হবে, আর তাকালেই বার বার তাকাতে হবে।

তবে খুব সাবধানে তাকাতে হয়, বিচ্ছু ছেলেটির কোন কিছুই চোখ এড়ায় না। একদিন তো বলেই বসেছিল, ‘তুমি খালি খালি বাপীর ছবি দেখছ যে?’

সুসীমাকে অতএব অবলীলায় বলতে হয়েছে, ‘ও মা! দেখব না? দেখে দেখে চিনে রাখতে হবে না? যখন আসবেন, যদি চিনতে না পারি?’

সাগর আশ্বাসের গলায় বলেছে, ‘আমি তো চিনিয়ে দেবই।’

সুসীমা আতঙ্কের ভাণ করে, ‘ও বাবা আমি সামনেই যাব না। যদি ভয় পাই?’

‘ভয়?’ শুকনো শুকনো মুখ, কিন্তু টুকটুকে ঠোঁট ঝিকঝিকে দাঁত, সেই দাঁতে ঝিলিক দিয়ে হেসে ওঠে সাগর, হাসতে থাকে—’বাপীকে তুমি ভয় পাবে? বাপী বাঘ? বাপী ভালুক? বাপী রাক্ষস?’

সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে সেই হাসির ঢেউ।

সুরেশ ঘোষ প্রায় করজোড়েই বললে, ‘কি বলে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব মা! তুমি অসাধ্য সাধন করছ। ওই ছেলের মুখে এমন হাসি!’

সুসীমা একটু হাসে।

‘কোন মন্ত্রে যে তুমি ওকে বশ করলে মা?’ সুরেশ ঘোষের অভিভূত উক্তি।

সুসীমা বলে, ‘আসলে প্রবলেম চাইল্ড সম্পর্কে একটু বিশেষ চিন্তার দরকার থাকে। ওরা যখন দেখে ওদের ঠিকমত বোঝা হচ্ছে না, দারুণ ক্ষেপে যায়। আর ওদের ইচ্ছের অনুকূলে রায় না দিয়ে প্রতিবাদ করলে তো কথাই নেই।’ সুসীমা একটু হাসে। সেই হাসির মধ্যে অনেকখানি ইতিহাস উদঘাটিত হয়।

মালতি চলে গেছে কিন্তু যাবার আগে পাড়ার লোকের কাছে অনেক বিষ—উদগীরণ করে গেছে। এবং এই অভিমত ব্যক্ত করে গেছে—’ওই ঘুঘু সুরেশ ঘোষের সঙ্গে নিশ্চয়ই আগে থেকে যোগসাজস ছিল ছুঁড়ির, তা নইলে ওই রকম রূপসী যুবতী বিদ্যেবতী একখানা মেয়ে আয়ার কাজ করতে আসে?’

‘আর কিছুই নয়, ওই আয়াই এরপর বাড়ির গিন্নি হবে, সেই মতলবেই ওকে নিয়ে এসেছে বুড়ো, যাতে আগে থেকে ছেলের মন ভিজিয়ে হাত করে ফেলতে পারে। নচেৎ ওই মেমের ছানা কি সৎমাকে স্থলকূল দেবে? আয়া! আয়া হলে তার এত সমাদর? যেন কুটুম—কন্যে এসেছে! মালতি এ যাবৎ আয়ার কাজ করে এল, কই, কবে তাকে সাহেবের টেবিলে খেতে দেওয়া হয়েছে, রবারের গদিতে শুতে দেওয়া হয়েছে?’

অপরের বাড়ির দাসদাসীর মুখে তাদের হাঁড়ির খবর জানতে পাওয়া গিন্নী মহিলাদের প্রধান প্রধান কয়েকটি সুখের মধ্যে অন্যতম সুখ। কাজেই মালতি অবহেলিত হয় না। লোকে তাকে সমাদর করে বসিয়েছে, চা খাইয়েছে। এমন কি তাকে রাখবার ইচ্ছেও প্রকাশ করেছে, তবে সে এখন বাড়ি যাবার জন্যে ব্যস্ত।…ঝাড়গ্রামে বাড়ি তার, টাটায় আসতে আর কতক্ষণ? আসবে আবার। সাহেব বাড়ির নতুন নাটক দেখবে।

অনেক নাটক তো দেখা হয়েছে, আবার কোন নাটক নামে দেখা যাক।

কিন্তু সুসীমাও কি কোন একটা নাটকের প্রতীক্ষা করছে না? সুসীমা যখন ওই ছবিখানার দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখ সরাতে ভুলে যায়, তখন তার হৃৎপিণ্ডের রক্তস্রোত স্বাভাবিক চলাচলের নিয়ম লঙ্ঘন করে উত্তাল হয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায় না? ওই ছবিটা জলজ্যান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে, ভাবতে অবিশ্বাস্য লাগে না?

নির্জনতা বড় দুর্লভ। একাকীত্বের প্রশ্ন স্বপ্নমাত্র। রাহুর প্রেমে আঁকড়ে ধরে আছে ওই ছেলেটা সুসীমার দিনের সমস্ত ক্ষণটুকু।

শুধু রাত্রে ছুটি। তাও তার অফুরন্ত চাহিদার গল্প শোনাতে শোনাতে তো নিজের চোখে ঘুম ভেঙ্গে আসে।

তবু কোন কোন রাত্রে সাগরকে ঘুম পাড়িয়ে পিছনের বারান্দায় বেরিয়ে এসে বসে সুসীমা। এখানেও বেতের চেয়ার ছড়ানো আছে দু—তিনখানা।

সুসীমার মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটে ওঠে। যেন এক অভিশপ্ত যক্ষপুরী। শূন্য কক্ষ, শূন্য অলিন্দ, শূন্য বাতায়ন। বলতে কি, সবই একটা অর্থহীন শূন্যতায় ভরা, অথচ সর্বত্র আরাম আয়েস আর বিলাসিতার উপকরণ ছড়ানো।

অধিক রাত্রে এই বারান্দায় বসে সুসীমা সমস্ত দিনের হারানো সুসীমাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করে। আর তখনই ভাবতে বসে, আচ্ছা, হঠাৎ আমি এমন একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলাম কেন?

আমার মা, আমার দাদা বৌদি অবাক হয়েছে। ধিক্কার দিয়েছে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে এবং শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছে, যা খুশী কর। বলেছে, যতই ইংরেজি কাগজে ইংরেজি ভাষায় সভ্য করে লিখুক, লোকে কি ছেলের আয়া, না হয় নার্স ছাড়া আর কিছু বলবে? কিন্তু কী জেদই যে চাপল সুসীমার, একটা মাতৃহীন শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবার।

যদিও আবেদনে ‘ধৈর্যশীলা মহিলার’ প্রার্থনা ছিল, তবু ছেলে যে কী সাংঘাতিক সে কথার উল্লেখ ছিল কী? উল্লেখ ছিল—ছেলেটার চোখ আর চুল ধূসর, ছেলেটা অস্বাভাবিক ফর্সা, ছেলেটার মা বিদেশিনী।

সুসীমা আবার এও ভাবে, কিন্তু তাতে আমার কী। এ সংসার থেকে যে চির বিদায় নিয়েছে, সে কী ছিল আর না ছিল, জেনে লাভই বা কী আমার।

সাগর যদি তার সেই সাগরপারের দুহিতা মায়ের শিক্ষা সাহচর্য কিছুটাও পেত, তাহলে এমনটা হত কী? হয়তো হত না। কিন্তু হতভাগ্য শিশু মাকে হারিয়েছে জ্ঞান উন্মেষের আগে, মুখে বাক ফোটবার আগে।

অতএব যা কিছু শিক্ষা—দীক্ষা তার মালতির কাছে, গণেশের কাছে বাসন—মাজা ঝি কুড়ুনির কাছে। তাদের যা ভাষা তাই শিখিয়েছে তারা। অথবা শেখাতে হয় না, শিশু নিজেই শেখে, যা শোনে যা দেখে। চ্যাটার্জি সাহেব এমন অনভিজাত দাস দাসী রেখেছেন কেন, এই আশ্চর্য!

বাচ্চাটা যদি গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলত, দেখতে কী মজাই লাগত! কিন্তু সেই মজাটা আর দেখা গেল না।

আপাতত সাগরের ভাষার নমুনা এই—’ও আণ্টি! আণ্টি। এখনো ওখানে কী করছ? খাচ্ছ? একশো ঘণ্টা ধরে কত খাচ্ছ? শীগগির আমায় গপপো বলবে এস। দেরী করলে চুল ছিঁড়ে দেব। আহ্লাদ পেয়েছ! আমার বুঝি ঘুম পায় না?’ একটা সাহেব মার্কা চেহারার শিশুর মুখে অনর্গল এ হেন বাক্যধারা কী অদ্ভুতই লাগে!

সাগরের দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে ধারণা করতে চেষ্টা করে সুসীমা, ওর সেই মেম মা, সামনে বসে শুনছে তার গর্ভজাত সন্তান এই ভাষায় কথা বলছে।

হিন্দি নয়, ভাঙা বাংলা নয়, একেবারে খাঁটি গাঁইয়া বাংলা। ভাবতে ভাবতে আবারও করে প্রশ্ন জাগে, চ্যাটার্জি সাহেবের বাড়িতে এমন অনভিজাত দাসদাসী কেন? এ কি ইচ্ছাকৃত, না কি সবটাই ওই সুরেশবাবুর নিজস্ব অবদান? তিনিই তাঁর চেনা—জানার জগত থেকে জোগাড় করেছেন এদের? না কি সবটাই কাকতালীয়? মালতি ঝাড়গ্রামের, গণেশ কাঁথির, কুড়ুনি বাঁকুড়ার। জীবিকান্বেষণে কে কোনখান থেকে ছিটকে কোথায় এসে পড়ে।

এই যে এদের মনিব—চ্যাটার্জি সাহেব। তিনিই কি এখানকার? তিনি কি আগে আসামের এক নাম—করা শহরের বাসিন্দা ছিলেন না?

ছিলেন, এবং বড় সুখেই ছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের এক ত্রূর গ্রহ তাঁকে সেই শান্ত ছন্দের জীবন থেকে উপড়ে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিয়েছে এই বাংলা বিহার বর্ডারে।

তা এখানেও তো পেয়েছিলেন সব। ভাল বাড়ি, দামী গাড়ি, সোনালী মুখ স্ত্রী, রূপবান পুত্র, মর‍্যাদাসম্পন্ন থাকায় যখন তখন বিদেশ ঘুরে আসার সুযোগ। তবু চ্যাটার্জি সাহেবের বাড়ি দেখে তার ছেলের পরিচর‍্যাকারিণী অভিশপ্ত যক্ষপুরীর সঙ্গে তুলনা করে বসে।

কিন্তু কতক্ষণই বা নিজেকে নিয়ে বসে থাকার সময় আছে তার? ঘর ছেড়ে একটু সরে এলেই কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় অঘোরে ঘুমন্ত ছেলেটা। হঠাৎ ‘আণ্টি আণ্টি’ করে চিৎকার করে ওঠে, তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়।

‘তুমি চলে গিয়েছিলে কেন?’

সুসীমা গম্ভীর গলায় বলে, ‘আমার গরম হচ্ছিল—’

‘পাখাটা জোরে ঘুরিয়ে দাওনি কেন?’

‘আমার বাগান দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল।’

ছেলেটা বিছানায় উঠে বসে বলে, ‘দিনের বেলা বাগান দেখতে পারো না?’

সুসীমা গাম্ভীর্যের মাত্রা বাড়ায়, ‘আমার রাত্তিরেই ভাল লাগে।’

‘না, তুমি রাত্তিরে বাগান দেখবে না।’

সুসীমা দৃঢ় গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আমি রাত্তিরেই দেখব।’

যে মানুষ সর্বদা নতি স্বীকার করে, হঠাৎ তাকে বিপরীত ভূমিকায় দেখে সদ্য ঘুম ভাঙা ছেলেটা বোধ করি ভয় পেয়ে যায়, হঠাৎ প্রবল ভাবে কেঁদে বিছানায় গড়াগড়ি দিতে থাকে, ‘আমি বাপীকে বলে দেব। তুমি আমায় বকেছ—’

সুসীমা তখন ওকে একটু কাঁদতে দেয়। এ কান্নার উৎস যে অনেক গভীরে তা অনুভব করতে পারে, তাই চুপ করে তাকিয়ে থাকতে ভাবে, আমার যদি ছেলে থাকত, সে কি এইরকম হত—এই রকম উদ্ধত অস্বাভাবিক বেয়াড়া নিষ্ঠুর?

খানিকটা কাঁদতে দিয়ে স্বগতোক্তি করতে হয় সুসীমাকে, ‘বোকারা মোটেই ঠাট্টা বোঝে না।’

হঠাৎ কান্নাটা বন্ধ হয়ে যায়। সুসীমা উঠে গিয়ে কুঁজো থেকে জল খেতে খেতে বলে, ‘যারা ঠাট্টা বোঝে না তাদের লেখাপড়া হয় না। রাত্তিরে কেউ বাগান দেখে? লোকে তো বেড়াল তাড়াতে রাত্তিরে বাগানে যায়।’

আবার উঠে বসে ছেলেটা। হঠাৎ সমস্ত বিশ্বজগৎকে চকিত করে টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁকে ঝিকঝিকে দাঁতের ঝিলিক তুলে বলে, ‘বেলাল এসেছিল?’

সব কথা চোস্ত সাগরের, সুসীমা মাঝে মাঝে বলে, ‘তুমি চার বছরের না চোদ্দ বছরের?’ কিন্তু বেড়ালকে সাগর ‘বেলাল’ বলে। আর দেখলে আহ্লাদে বিগলিত হয়। এবং বেড়াল প্রসঙ্গেই সন্ধি হয়ে যায়। এবং সুসীমা নিজের বিছানায় শুয়েছে দেখে ঘুমিয়ে পড়তে দেরীও হয় না তার।

কিন্তু সুসীমা? না, তার ঘুম আসা এত সোজা নয়। সুসীমা অন্ধকারে ঘরটাকে অনুভব করতে করতে মনে মনে বলে, একেই বোধ হয় বলে অদৃষ্টের পরিহাস।…আমাকে নিজস্ব একটা ঘর দিয়েছিল এরা, সেটুকু সইল না আমার। আমি এখন অনধিকার প্রবেশকারিণী।

সাহেবের শোবার ঘরে শুয়ে আছি আমি সাহেবের ছেলেকে আগলে।

ভাগ্যিস মালিক অনুপস্থিত। তবু আমি কি করে রাজী হয়ে গেলাম এ ঘরে শুতে আসতে! একজন বিপত্নীক পুরুষের শোবার ঘরে আমি—

ছেলেটাকে তো আমি আমাকে দেওয়া সেই ঘরটায় নিয়ে যেতে পারতাম। মালতি অবশ্য বলেছিল, ‘ওই বিচ্ছু ছেলে এ ঘর থেকে নড়বেনি! আমি তো কত বলি চল মাণিক আমার সঙ্গে বড় দালানে শোবে চল, আমার এ ঘরে শুতে নজ্জা নাগে, তা শোনে? বুনো ঘোড়া দিদিমণি, ঘাড় বেঁকিয়ে আছে!’

কিন্তু মালতির কথা গণ্য করার কথা তো আমার নয়। মালতির লজ্জা লাগে অথচ আমার লাগল না। সেই মানুষ যখন এসে দেখবেন আমি নির্লজ্জের মত আস্তানা পেতেছি। ছি ছি!

হলেও আপাতত অনুপস্থিত, তবু একজন বয়স্ক পুরুষের নিজস্ব শয়নকক্ষে তার অশরীরি উপস্থিতি থাকে। সেটাকে হয়তো বলা যেতে পারে সত্তার স্পর্শ।

সেই স্পর্শের স্বাদ কি গভীর রাত্রে আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলে না? আমি কি তার কথা শুনতে পাই না? বাতাসে পাতা নড়ার মত ফিসফিস শব্দে। ওই ছবিখানা কি জীবন্ত হয়ে যায় না তখন?…আমার বিছানার ধারে বসে না? আমার নাম ধরে ডাকে না?

নাঃ! ওই ছবিখানাই আমায় পাগল করে তুলেছে। ওই ছবির চোখ যেন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, আমার বুকের মধ্যেটা পর্যন্ত দেখে। আমার বুকটা ধ্বক ধ্বক করে।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় সুসীমা। মনে মনে বলে, একজন বিপত্নীক এবং সন্তানের পিতা আত্মস্থ ব্যক্তি সম্পর্কে এ কী নির্লজ্জ দুর্বলতা আমার … দাদা আমায় বলেছিল, ‘তোকে দুর্মতিতে ধরেছে—’

ঠিকই বলেছিল! আমার নিয়তিই দুর্মতি হয়ে আমায় এখানে নিয়ে এসে ফেলেছে। এত কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখি, এইটা দেখেই বা হঠাৎ আমার সমস্ত চেতনা এইখানেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল কেন?

বৌদি বলেছিল, ‘হতে পারে থাকা খাওয়া উচ্চমানের আর তিনশো টাকা মাইনে। তবু বলতে হলে তো খাওয়া পরার চাকরি, দিনরাতের আয়া।’ তারপর একটু কটাক্ষ করে বলেছিল, ‘শিশু যখন মাতৃহারা, তখন হতভাগা বাপটাও সর্বহারা, কে জানে কী মতবল?’

সুসীমা হেসে বলেছিল, ‘কে জানে আমরই বা কী মতলব?’

বৌদি বলেছিল, ‘তাহলেও তো বাঁচতাম। তোর একটা হিল্লে হল ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতাম। তা তো আর হবে না, তুমি যে বাবা একেবারে কাঠকবুল!’

বৌদি সুসীমাকে চেনে। কিন্তু সুসীমা নিজে? নিজেকে কি চেনে সুসীমা?

‘তোমার প্রতি খুবই অত্যাচার করা হচ্ছে’—বললেন সুরেশ ঘোষ, ‘একতিলও বিশ্রাম পাচ্ছ না তুমি, রাত্রে পর্যন্ত।’

মিষ্টি করে হাসবার একটি অলৌকিক ক্ষমতা আছে সুসীমার, সেই ক্ষমতাটি প্রয়োগ করে বলে, ‘বাঃ চাকরিটা তো তাই, আপত্তি করলে চলবে কেন।’

সুরেশবাবু বলেন, ‘আসলে কি জান? তোমাকে দেখি আর মনে হয়, আমি যেন সোনার তরোয়ালে ঘাস কাটাচ্ছি।’

‘ও বাবা! আপনি যে দেখছি রীতিমত কবি মানুষ।’

‘ব্যক্তিগত জীবনের কথা নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়’। সুরেশবাবু বলেন, ‘তবে তুমি আমায় কাকাবাবু বলে ডাকো তাই সাহস করে জিগ্যেস করছি, কে আছেন সংসারে?’

সুসীমা হেসে হেসে বলে, ‘ও মা, এতে এত কুণ্ঠা কেন আপনার? বাড়িতে মা আছেন, দাদা বৌদি আছেন, ছোট্ট একটি ভাইঝি আছে—’

‘কলকাতা ছেড়ে এত দূরে চলে আসায় ওঁরা আপত্তি করলেন না?’

সুসীমা বলে, ‘ওরে বাবা, করলেন না আবার? মেয়েরা একবার বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে চাইলেই তো আপত্তি! ছেড়ে দিন ও কথা।’

ব্যস ওইখানেই ইতি সুরেশবাবুর ঠোঁটের কাছে আসা প্রশ্নটা আবার পেটের মধ্যে চলে যায়।

সুরেশবাবু লোকটি ভাল, তবে বড্ড বেশী দাস্যভাব। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। সুসীমা মনে মনে বলে তোমরা সাহেবের দাস আছ থাক, আমার কাছে এত বিনয়াবনত কেন?

কিন্তু মুখে তো আর এভাবে বলা যায় না? শুধু সহজ ভাবটা আনতে কাকাবাবু ডাকটা চালু করেছে এই পর্যন্ত। প্রথম দু’দিন মেসোমশাই বলে কথা বলেছিল, হঠাৎ খেয়াল হল। হেসে উঠে বলল সুসীমা, ‘এ মা, আমি কাকে কী বলছি? মাসিমা ব্যতীত মেসোমশাইয়ের অস্তিত্ব কোথায়? দাদামশাই জ্যেঠামশাই সব হতে পারেন আপনি, কিন্তু মেসোমশাই পিসেমশাই? অসম্ভব।’

শুনে সুরেশবাবু তাঁর স্বভাবছাড়া জোরে হেসে উঠেছিলেন। সুরেশ ঘোষের জোরে হাসি মনে পড়ে না কারুর। সেদিন বাড়ির লোককে চমকে দিয়ে হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘আরে তাই তো। এটা আমিও তো খেয়াল করিনি।’

তখনো মালতি ছিল। আড়ালে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, ‘এই এক ছেনাল মেয়েমানুষ এল। বোবার বোল ফোটায় উইঢিবিকে হাসায় নাচায়। ম্যেনেজার বাবুর মুখে হাসি! যে মানুষ মেয়েছেলের হাওয়া সইতে পারে না, ধারে কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ালে ছিটকে সরে যায়। তুইও তো দেখেছিস কুড়ুনি?

কুড়ুনি স্রেফ একটা জঙ্গুলে মেয়েমানুষ, তার চুলে তেল পড়ে না, গায়ে সাবান পড়ে না, কাপড়ে ক্ষার পড়ে না, তবু কুড়ুনি মুচকে হেসে বলেছে, এ্যাখোন মেনেজার বাবু, এরপর মনিববাবু। দেখে নিয়ো।’

রূপ আর বয়েস, বড় সন্দেহের বস্তু।

সাহেবের অবিশ্যি মেমসাহেব ছিল রূপ সম্বন্ধে যারা তুলনীয়। কিন্তু তাঁকে কি রূপসী বলা যেতে পারত? কেমন যেন এক তীব্রতা ছিল তার মধ্যে। লাবণ্য বস্তুটার অভাব বড় বেশী চোখে পড়ত।

তাছাড়া স্বভাব? কুড়ুনির ভাষায়, ‘পরিবার তো নয়, যেন সাক্ষেৎ রণচণ্ডী! রাগ হল তো হম্বি দীঘ্যি জ্ঞেয়ান নেই। এটা ফেলছে ওটা ছুড়ছে কাঁচের বাসন আছড়ে ভাঙছে আর ইনজিরি বোলে মুখ ছোটাচ্ছে। বাক্যি ভাষা বুজতে না পারি, কথাগুলো যে গালমন্দল তা তো বুজতে আটকায় না। মুখ চোখের চ্যায়রা কি ত্যাখন? যেন আগুনখাকী! গেছে, না, সায়েব বেঁচেছে।’

একলপ্তেই বলে ফেলেছে। যেই একবার ফুলষ্টপ দিয়েছে, সুসীমা তাড়াতাড়ি বলেছে, ‘ওসব কথা আমার কাছে বলতে এস না কুড়ুনি। আমার শুনে কি দরকার? যে মানুষ নেই, তার কথা এভাবে বলতেও নেই।’

কুড়ুনি অগত্যা নিবৃত্ত হয়েছে, হয়তো বা বিড়বিড় করতে করতে বলে গেছে, ‘দেখনি তাই এত সমেহা! দেখলে বুঝতে।’

হতভাগ্য চ্যাটার্জি সাহেবের জন্যে দুঃখ হয় সুসীমার। মনের মধ্যে যেন কি একটা যন্ত্রণা পাক দিয়ে ওঠে। আর ওই ছবির মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, মেমবৌ তো আর মা বাপের ধরে দেওয়া বৌ নয়, নিজের আহরিত। কোন গুণে মজেছিলে তাতে? এত রূপ তোমার, এত গুণ, এত বিদ্যে সাধ্যি, বাড়ির লোকেরা বলে মানুষ না দেবতা অথচ মানুষ চেনবার ক্ষমতা ছিল না?

ছবিটার সঙ্গে দস্তুরমত কথাই কয় সুসীমা। শুধু যা উচ্চারিত হয় না সে কথা। এ রকম কথায় তো আপনি আজ্ঞের দরকার হয় না। তাই ইচ্ছেমতই বলে।

কুড়ুনী বলে, ‘গেছে, গেছে না সাহেব বেঁচেছে।’

কিন্তু সাহেবকে বাঁচিয়ে গেছে কি মেমসাহেব নিজে মরে গিয়ে? সকলে অবশ্য তাই বলে। বাপের অসুখ শুনে বাপের দেশে গেছল কোলের কচি ছেলেটাকে রেখে, আর এসে তাকে কোলে নিতে হল না, সেখানেই মারা গেল হঠাৎ।

কিন্তু সেই ছেলেটা অন্য কথা বলে। যদিও তার জ্ঞানের জগতের কথা নয়, অজ্ঞান শৈশবের কথা, তবু বলে যেন ছুরির ধারে।—’মরে গেছে না হাতী! বাপী সকলের কাছে গুল মারে। বলে মরে গেছে। ও তো কারখানার ছোট মেনেজার মরিস সাহেবের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। ওর বাবার অসুখ করেছিল না কচু। পালিয়ে যাবে বলে গুল দিয়েছে। মালতি আমায় সব বলেছে।’

সুসীমা ব্যথিত হয়েছে, কাতর হয়েছে, এসব কথা বলতে বারণ করেছে, কিন্তু নিষেধ না শোনাই তো পেশা সাগরের। অবাধ্যতাতেই আনন্দ।

তাই সুসীমা যদি শুনব না বলে দু’হাতে কান চাপা দিয়েছে, সাগর হাত খামচে খামচে নামিয়ে ছেড়ে বলেছে, ‘ও তো বিচ্ছিরি মা। পাজী মা! মদ খেয়ে খেয়ে মাতাল হয়ে বাবাকে মারত—’

সুসীমা প্রায় আর্ত্তনাদের মত বলেছে, ‘মালতির কথা তুমি বিশ্বাস কোরো না সাগর! মালতি নিজেই দুষ্টু পাজী বিচ্ছিরি—!’

কিন্তু সাগরের যখন মুড আসে তখন তাকে রোখা ভগবানেরও কর্ম নয়। অতএব সুসীমাকে বসে বসে শুনতে হয়েছে, ওর মায়ের যত ভাল আয়া বকুনি খেয়ে খেয়ে রাগ করে করে চলে গিয়েছিল বলে মালতি আর কুড়ুনিকে রাখা হয়েছিল। রসিদ বাবুর্চি চলে গেছে বলে ভাগ্যধর ঠাকুর রান্না করে, আর বয় বলে ছেলেটা চলে যাওয়ায় গণেশকে আনা।

মাত্র চার বছরের ছেলেটা যে এত চোস্ত কথা বলে কি করে এই এক রহস্য।

সুসীমা আসার পর মালতি মাত্র দিন চারেক ছিল, তবু তার মধ্যেই অনেক বিষের থলি উজাড় করে গেছে। সোচ্চারে ঘোষণা করেছে, ‘আমড়া গাছে কি ল্যাংড়া ফলবে? যেমন মা তার তেমনি ছা হবে না? মাতাল অসচরিত্তির মেয়েছেলেকে কি মেম বলে পুজ্যি করব আমি?…আহা, ভালমানুষ মানুষটাকে একদিনের জন্যে শান্তি দেয়নি গো—’

হয়তো নতুন একজন শ্রোতা পেয়ে মালতির নতুন উৎসাহ জেগেছিল।

এদের সমবেত চেষ্টা সুসীমার কাছে একটা বিধ্বস্ত জীবনের সম্পূর্ণ ছবি পৌঁছে দিয়েছে। অবিরতই দিচ্ছে।

সেদিন কোথা থেকে একখানা ফটো অ্যালবাম বার করে এনে দেখাতে বসল সাগর।—’দেখ দেখ, বাপী যখন ছোট্ট ছেলে ছিল তখন কী রকম দেখতে ছিল।…এইটা বাপীর মা’র ছবি, এইটা বাপীর বাবার, এটা বাপীর দাদার—’

সাগরের বাপীর বাল্য কৈশোরের স্মৃতি—খচিত অ্যালবামটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সুসীমা।

‘তুমি ছবি দেখছ, না আকাশ দেখছ?’

সুসীমা বলে, ‘ও মা সেকী! ছবিই তো দেখছি। ভাবছি তুমিও তো এখন এইটুকুন ছেলে, আবার পরে বাপীর মতন বড় হবে।’

সাগর হি হি করে হেসে বলে, ‘তুমি কী বোকা! বাপীর মতন কী করে হব? বাপী তো তখন আরও অনেক অ—নে—ক বড় হয়ে যাবে।’

শোনা কথা মুখস্থ কথা যখন বলে, তখন ছেলেটাকে শয়তান মনে হয়, আবার যখন নিজের বুদ্ধিমত শিশুসুলভ কথা বলে, তখন এই অভাগা ছেলেটার জন্যে মমতায় মন ভরে যায়।

অভাগা ছাড়া আর কীই বা? হতভাগা বাপের অভাগা ছেলে। ওর বাপ ওর মায়ের উপর ঘৃণায় আর আক্রোশে ওকে ওর ‘মাতৃভাষা’র স্পর্শ পেতে দেয়নি, আর এ যাবৎ ওকে যাদের হাতে সমর্পণ করে রেখেছে, তারা ওর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

হ্যাঁ, একটা দরকারি কাজ অবশ্য করে দিয়েছে ওরা, ছেলেটাকে বাঙালী করে তুলেছে ঠিকই। ওই কটা চুল, কটা চোখ, আর অতিরিক্ত ফর্সা রং নিয়ে ছেলেটা যে পরিবেশে ঘুরে বেড়াবে, তারা কি ওকে সহজ সমাদরে নেবে? না, ব্যঙ্গ কৌতুক আর অবিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করবে?

তাছাড়া ওর মাতৃসূত্রে পাওয়া রক্তে উচ্ছৃঙ্খলতা আর অবাধ্যতার বীজ। যেটা কোনদিনই ওর জীবনকে সুপথ্য জোগাবে না। ছেলেটার জীবন দুঃখের সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ছেলেটার জন্যে আমার মন ভারাক্রান্ত হয় কেন?

সুসীমা ভাবে, একটা বিদ্যেসাধ্যি সম্পন্ন বেকুব, আর একটা বেহায়া বেপরোয়া মেয়েমানুষ, এই দুইয়ের যোগফল এই ছেলেটা ভালই বা হতে যাবে কোন ভগবানের কৃপায়? আর ভাল না হলেই বা আমার কী এসে যাচ্ছে?

লোকটাকে বেকুব বলে কি ভুল করছি? উঁহু। কর্মক্ষমতায় দেশ বিদেশে খ্যাতি অর্জন করলেও ওই ইঞ্জিনীয়ার সাহেব যে বেকুব তাতে সন্দেহ কি? ওই মেয়েমানুষটার খপ্পরে যে পড়তে পারে, কি বলবে তাকে লোকে?

তবু ওই বেকুব আর বেহায়ার যোগফল ছেলেটাকে নিয়ে আপ্রাণ খাটে সুসীমা। ধীরে ধীরে তাকে বর্ণপরিচয়ের জগতে নিয়ে আসে, তার তীব্রতাকে হ্রাস করিয়ে আনে মাত্রা মাপা বশ্যতা আর শাসন প্রয়োগ করে করে।

আণ্টি চলে যাবার ভয়ে নিজেকে রীতিমত সামলে নেয় সাগর নামের সমস্যা শিশুটি।

ওই একটি ব্রহ্মাস্ত্র আছে সুসীমার হাতে। এই শ্মশানতুল্য সংসারে আণ্টি যে তার একটা পরম আশ্রয়, সে বোধ জন্মে গেছে ছেলেটার।

সুরেশবাবু রোজ দু’চারবার করে কৃতজ্ঞতার ফুলচন্দন দিয়ে পূজো করেন, রোজ দু’চারবার করে জানতে চান সুসীমার এখানে কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না। আর রোজ একবার করে সাগরকে সন্তর্পণে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি কেমন ভাল আণ্টি এনে দিয়েছি?’

সাগর একটু হাসির প্রসাদ বিতরণ করে। সাগরের শুকনো শুকনো কাঠ বার করা মুখটা পুরন্ত হয়ে ওঠে, হাসিটা ভারী লাবণ্যময় দেখায়।

সুসীমা ওকে ছড়া শেখায়, বাংলা, ইংরেজি।

সাগর প্রথমটা বলেছিল, না, ইংরেজি শিখব না, বাপী রাগ করবে।

শুনে সত্যিই মাথায় হাত দিতে হয়েছিল সুসীমাকে।

সাগর বলেছিল, হ্যাঁ সত্যি বলছি, বাপী বলেছে, কক্ষণো ইংরিজি বলবি না।

‘তোমার বাপী একটি বুদ্ধু’—সুসীমা বলে ফেলেছিল। কিন্তু বলা কথা তো আর ফেরৎ নেওয়া যায় না। অতএব সাগর যখন হাততালি দিয়ে বলে উঠেছিল, ‘এ মা বাপীকে বুদ্ধু বলেছ—বাপী এলে বলে দেব।’

তখন সুসীমাকে সতেজে বলতে হয়েছে, ‘দিও না বলে। আমি তোমার বাপীর সামনেও বলতে পারি।’

মাঝে মাঝে সাগর খুব সহৃদয় প্রশ্নও করে। সাগরের মধ্যে যে একটি দয়ালু হৃদয়ও বর্তমান তা আজকাল মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায়। সাগর বলে, ‘আণ্টি, তোমার বাপী নেই?’

‘না রে!’

‘তোমার বাপী বিলেত গেছে?’

‘উঁহু। আমার বাপী মারা গেছেন।’

সাগর আতঙ্কিত মুখে বলে, ‘খুব বুড়ো?’

সুসীমা এ প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে সামলে নিয়ে বলে, ‘নিশ্চয়! খুব বুড়োই তো।’

সাগর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আর তোমার মা? ভাল না বিচ্ছিরি?’

‘ওরে বাবা! দারুণ ভাল। বুড়ো মানুষ তো’—মায়ের প্রতি করুণা জাগাতে শেষের কথাটা বলা।

অতঃপর দাদা বৌদির কথা ওঠে, এবং সবাই ভাল শুনে সাগর কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলে, ‘তুমি ওদের কাছে থাকো না কেন?’

‘বাঃ তোমাকে তাহলে কে দেখবে?’

সাগর এ প্রশ্ন নস্যাৎ করে দিয়ে বলে, ‘ভাগ। তুমি কি আমায় চিনতে নাকি?’

অগত্যাই হার স্বীকার করতে হয় সুসীমাকে। নিজেকে বুদ্ধু বলতে হয়।

এই ভাবেই চলছে—

সাগরের সর্বাঙ্গে স্বাস্থ্যের লাবণ্য, সাগরের চোখে মুখে সভ্যতার লাবণ্য, সাগরের এখন অনেকখানি সময় কাটে ছবির বই দেখে, বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পরিচয় সাধন করে। সাগর সুসীমার সঙ্গে রাস্তায় বেরোয়, বেড়ায়, খেলে। সাগরকে যেন একটি সুস্থ জীবনের দরজায় এনে দিচ্ছে সুসীমা।

কিন্তু কতদিন আর চলবে এভাবে।

বাড়ির মালিক তিনমাসের জন্যে গিয়ে ছ’মাসে তুললেও এবার তো ফিরবেন। তখন কি সুসীমার থাকা সম্ভব হবে? সুসীমা যদি ওর নিজস্ব পোষ্টে থাকত তাহলেও কথা ছিল।

কিন্তু সুসীমা তো কেবলমাত্র মাতৃহীন শিশুর পরিচর‍্যাকারিণীর পোস্টেই অধিষ্ঠিত নেই, সুসীমা যে কোন ফাঁকে এ সংসারের মূল কেন্দ্রেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসে আছে। কেনই যে এ সংসার তাদের ছেলের সেবিকাকে সংসারের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে বসে আছে কে জানে।

সুরেশবাবু অনায়াসেই সকালে এসে প্রশ্ন করেন, ‘মা কি বাজার আসবে?’

ভাগ্যধর অনায়াসে প্রশ্ন করে, ‘দিদিমণি কি রান্না হবে?’

কুড়ুনি মাছ কুটতে বসে নির্দেশ চায়, ধোবা এসে সুসীমাকেই খোঁজে, বাগানের মালি ফুলের তোড়া বানিয়ে সুসীমার হাতেই দিয়ে যায়। এবং ভাঁড়ারে কি আছে কি নেই, কি আনার দরকার সেটা সুসীমাকেই জানতে হয়।

প্রথম প্রথম সুসীমা বলেছে, ‘এ কি, আমায় জিগ্যেস করছেন কেন?’

সুরেশবাবু অবলীলায় বলেছেন, ‘জিগ্যেস করতে পেরে বেঁচে যাচ্ছি মা। সুখটুকু থেকে বঞ্চিত কর না বুড়ো মানুষটাকে। বড় আরাম পাই।’

প্রথমে সাগরের পথ্যের নির্দেশ দিতে এসেই এই খাল কেটে কুমীর আনা। কুড়ুনীও বলে, কেউ তো বলে দেয় না দিদিমণি, বড় মুশকিল লাগে। আপনি বলে দিলে বেঁচে যাই।’

সুসীমা সবাইকে বাঁচাবার ভার নিয়েই এসেছে।

কারণ অবশ্যই সাগর। সাগরের বিস্কুট ফুরিয়েছে কিনা, সাগরের মাখন আছে কিনা,সাগরের বিনা মশলায় রান্নার প্রক্রিয়াটা কি, সাগরের ভাত কতটুকু সিদ্ধ হবে—এই সবের তদারক করতে গিয়েই মস্ত এক গাড্ডায় পড়ে গেছে সুসীমা।

সুসীমা জানালা দরজার পর্দা বদলায়, সুসীমা দেয়ালে ঝুল কি মেঝেয় ধুলো দেখলে গণেশকে তাড়া লাগায়। কুড়ুনিকে বকে।

সুসীমা সাগরের বাপীর ঘরের সব জিনিস ঝাড়ে মোছে, নতুন করে গোছায়। সুসীমা লেশ বুনে সোফা সেটের পিঠের ঢাকা বানিয়ে দিয়েছে, বালিশ—টালিশের নতুন ওয়াড় বানিয়ে দিয়েছে।

সাগরের বাবার ড্রয়ারের চাবি সাগরের তীব্র প্ররোচনায় সুরেশবাবুর হাত থেকে মাঝে মাঝেই সুসীমার হাতে এসে যায়। অতএব সেই মনিব ভদ্রলোকের ফেলে রেখে যাওয়া পোশাক পরিচ্ছদগুলির সেবাযত্ন করতে হয়।

মাস দুয়েকেই সুসীমা যেন এ বাড়ির চিরকালের হয়ে বসে আছে। আসল কথা, এখানে যারা বাস করে, সবকটাই অনাথ অসহায়, তারা করিৎকর্মা মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে।

একমাত্র মালতিই ছিল ব্যতিক্রম, তা…সে তো আগেই বিদায় নিয়েছে। আর সে বিদায় নিয়েছে বলেই হয়তো সংসারে কুচক্রের চাষ বন্ধ হয়েছে।

সুরেশবাবু বলেন, ‘আহা, প্রথম থেকেই যদি তোমায় পেতাম মা, ছেলে কখনই অমন বেয়াড়া বেসামাল হয়ে উঠত না।’

সুসীমা হেসে বলে, ‘বাঃ ওর বাবা তো ছিলেন। এখনই না হয়—’

‘বাবার কথা আর কি বলব মা’, সুরেশবাবু আক্ষেপ করেন, ‘মানুষটাকে যেন তুলো ধুনে দিয়ে গেছেন মেমসাহেব। এখন তোমার কাছে বলি, মারা যাওয়াটা রটানো, আসলে—’

‘সুসীমা বাধা দিয়ে বলে, ‘জানি।’

সুরেশবাবু একটু থেমে বলেন, ‘তবে তো বুঝেছই মা। মা ছাড়া ছেলেটাকে কেবল আদরই দিয়েছেন সাহেব। যা বলছে তাই, যা চাইছে তাই। হয়ে গেল বেয়াড়া, তোমার হাতে পড়ে যা চেঞ্জ হয়েছে ধারণাই করা যায় না। আমি লিখে দিয়েছি সাহেবকে, আপনি কোন চিন্তায় ব্যস্ত হবেন না, যতদিন দরকার ওখানে থেকে আসুন। যা রত্ন একটি পেয়েছি, তার তুলনা হয় না।’

‘ওরে সর্বনাশ!’ সুসীমা আতঙ্কের ভান করে বলে, ‘তাহলে তো আমায় আগেই পালাতে হবে। বলবেন, কি বাজে কথা বানিয়েছেন।’

সুরেশবাবু আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বলেন, ‘ঠিক উল্টো। বল, কতখানির মধ্যে কতটুকু বলেছেন সুরেশবাবু?’

কিন্তু ক্রমশ আর গল্প কথা থাকছে না। আসার দিন সন্নিকট হয়ে আসছে। খবর এসে গেছে তারিখ ঠিক করে—এখন অহরহই বাতাসে যেন কার পায়ের শব্দ!

‘সাগর তোমাদের আর অ্যালবাম নেই?’

‘হুঁ কত আছে। বাপীর আলমারিতে আছে।’

‘সে সব ছবি তুমি দেখেছ?’

‘হুঁ!’

‘তাতে কার ছবি আছে?’

‘কত লোকের।’

‘তোমার মার ছবি নেই?’

সাগর সবেগে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘মোটেই না। মা’র ছবি তো বাপী সব ফেলে দিয়েছে।’

সুসীমা আহত গলায় বলে, ‘এটা খুব অন্যায় তোমার বাপীর। তোমার মা’র মুখ তোমার মনে থাকবে না।’

সাগর একটু মিইয়ে গিয়ে বলে, ‘আমার মা যে দুষ্টু পাজী।’

‘হোক! তবু মাকে ভক্তি করতে হয়, ভালবাসতে হয়।’

সাগর একটু মলিন মুখে বলে, ‘বাপী এলে আলমারী থেকে অ্যালবামগুলো বার করে নেব, দেখাব—’

সুসীমা আবার এখন মনে মনে হাসে।

মালতির মত ভাষায় মনে মনে বলে, আমার কপাল! তাই সেই বেহেড মেয়েমানুষটার ছেলেকে আমি মাতৃভক্তি শেখাচ্ছি!

সুরেশবাবু তাঁর অফিসরুম আলো করে বসে ছিলেন, ঝড়ের মত গিয়ে পড়ল সাগর, ‘জ্যাঠামশাই। বাপীর আলমারি খুলে দাও। অ্যালবাম নেব।’

সুরেশবাবু হতচকিত।—’কিসের অ্যালবাম?’

‘জানি না। আণ্টি দেখবে। তুমি শীগগির দাও বলছি।’

সুরেশবাবু বিপন্ন মুখে বলেন, ‘ওসব কিসে আছে জানি না তো বাবা।’

‘আমি জানি, উঁচু আলমারিতে। তুমি চাবিটা দাও না।’

‘বাপী তো দুদিন পরেই এসে যাবেন বাবু, এখন আর ওসব নাড়াচাড়া কেন।’

এরপরও সাগর নিজমূর্তি করবে না, এ তো হতে পারে না। সাগরের চোখের আগুন জ্বলে ওঠে। সাগর তীব্র হয়ে বলে, ‘তুমি দাও বলছি। আণ্টি দেখবে, আর তুমি দেবে না?’

দমদম এয়ারপোর্টে প্লেন এসে থামল। হুড়মুড়িয়ে নেমে আসতে চায় সবাই। নামার সময় সকলেরই ভঙ্গীতে ক্ষিপ্রতা।

শান্তনুও নামল দ্রুত ভঙ্গীতে। অবশ্য লাইনের আইন মেনেই। পাখী হয়ে উড়ে আসাটাও ক্রমশ এত অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে অভিজাতদের যে সেই আসাটা মনের গতির থেকে অনেক পিছিয়ে গিয়ে অধৈর্য অপেক্ষার স্বাদই এনে দিচ্ছে।

তাই শান্তনু চ্যাটার্জির মনে হচ্ছিল, জটায়ুর ডানা ঝিমিয়ে যাচ্ছে কেন! এখন এই দণ্ডে আরো দ্রুত উড়ে গিয়ে সাগরের কাছে পৌঁছে যেতে পারলে ভাল হয়, কিন্তু উপায় নেই। কাজ বড় নিষ্ঠুর শাসক। কলকাতায় কিছু কাজ আছে ঘণ্টাকয়েকের মত, অতএব সে সব সেরে ট্রেনই ধরতে হবে।

আসার আগে ছেলেটা ‘বাপী কেন চলে যাবে, বাপী কেন চলে যাবে’ করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জ্বর এনে ছেড়েছিল, সেই অবস্থাতেই চলে আসতে হয়েছে। পরে অবশ্য সুরেশবাবুর চিঠিতে জেনেছে শান্তনু, ভাল হয়ে গেছে সাগর এবং কাগজের বিজ্ঞাপনের সূত্রে তার এমন একজন পরিচর‍্যাকারিণীও পাওয়া গেছে, যেমনটি না কি বহুজন্মের পুণ্যফলেই মেলে।

নানা জায়গায় ঘুরেছে শান্তনু, এই ছ’মাসের মধ্যে সুরেশ ঘোষের মাত্র দু’খানা চিঠি তার হাতে পৌঁছেছে। প্রথমখানায় নানা কথার মধ্যে ওই পুণ্যফল প্রাপ্তির সংবাদ, দ্বিতীয়খানায় শুধু পুণ্যচরিত কাহিনী। অতিমাত্রায় ভাবপ্রবণ লোকটার ভাবের অতিশয্য দেখে মনে মনে হাসলেও বেশ একটু নিশ্চিন্তও হয়েছিল শান্তনু। যাই হোক, সাগর যে ওই শিশুমনস্তত্ব অভিজ্ঞা, শিক্ষিতা মহিলাকে ভাল মনে গ্রহণ করেছে এই ঢের।

সমস্যা তো ওইখানেই। সাগরের জন্যে যারা প্রাণপাত করছে, সাগর তাদের নিচ্ছে না। সাগর তাদের প্রাণপাতের উপর পদাঘাত করছে। মালতি আর গণেশ যে কত মার খায়। সাগর চায় বাপী সারাক্ষণ তার কাছে থাকুক। তার সঙ্গে লুডো খেলুক, বল খেলুক, গল্প বলুক, বেড়াতে নিয়ে যাক, খাইয়ে দিক, ঘুম পাড়াক।

এই দুরন্ত চাহিদা মেটাবার ক্ষমতা তো আর এক বিরাট কোম্পানির বিশিষ্ট চ্যাটার্জি সাহেবের হতে পারে না। তবু ছুটির দিনগুলো তো সম্পূর্ণই উৎসর্গ করে সে ছেলের চরণে।

কিন্তু বয়েস যত বাড়ছে, চাহিদাও তো ততই বাড়ছে, ক্রমশ শিক্ষা দীক্ষাও প্রয়োজন জাগছে। তাই কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শান্তনু দেশে থাকতে একটাও ঠিকমত লাগেনি।

সুরেশবাবুর নাম ঠিকানা দিয়ে বিজ্ঞাপনটা দেওয়া। যদিও ঠিকানাটা শান্তনুরই। সুরেশ ঘোষের আর ঘর বাড়ি কোথা?

ইদানীং বলছিল সুরেশ ঘোষ, সাহেব আপনার নাম দিয়ে অ্যাডভার্টিজমেণ্টটা দিলে বোধহয় ভাল সাড়া পাওয়া যেত। যাক, সুরেশ ঘোষের নামেও ভাল সাড়া পাওয়া গেছে তাহলে শেষ পর্যন্ত।

সুসীমা দেবীর গুণমুগ্ধ সুরেশ ঘোষের চিঠির উচ্ছ্বাস থেকে পঁচাত্তর ভাগ বাদ দিলেও, যা থাকে মন্দ নয়। তবে বলা যায় না সরল ভদ্রলোক কোন ভয়ঙ্কর ঘোরেল মহিলার কবলে পড়েছে কিনা।

আশ্চর্য, এত কথা লিখেছে সুরেশ ঘোষ অথচ মহিলাটির বয়েস কি রকম সধবা না বিধবা, নাকি বুড়ি আইবুড়ি সে সবের কিছুই লেখেনি। তবে তার যত্নে সাগরের স্বাস্থ্য ফিরেছে। এটা আশার কথা। আর একটা বেলা পরেই দেখতে পাওয়া যাবে এ চিঠির কতটা সত্যি, কতটা অতিশয়োক্তি।

ট্যাক্সিতে উঠে বুকপকেট থেকে পার্সটা বার করে তার খাঁজ থেকে সাগরের ফটোখানা বার করল শান্তনু। বহুবার দেখা, বলতে কি প্রায় রোজ রাত্রেই দেখা এই ছবিটা আবার নতুন করে দেখতে ইচ্ছে হল। ছেলে তো কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে চায় না, ছবি তুলতে গেলেই মুখ ভ্যাঙচায়, দাঁত বার করে—অনেক কষ্টে এই একখানা ভাল ছবি করা হয়েছিল ওর। তারই এককপি সঙ্গের সাথী করে নিয়ে গিয়েছিল শান্তনু।

ছবিটা দেখতে দেখতে যখন ভয়ানক মন কেমন করে উঠত, তখন কতদিন ভাবতে চেষ্টা করত শান্তনু, সারার গর্ভজাত ওই ছেলেটা এভাবে আমার মন—প্রাণ দখল করে বসল কী করে? কেন আমি ওর জন্যে এমন উতলা হই? কেন মনে হয় ওই ছেলেটাই আমার জীবনের সার?

প্রকৃতির এ এক আশ্চর্য পরিহাস বৈকি! সারা যখন চলে গেল, আমি তো ওকে ঘৃণা করতে চেষ্টা করেছিলাম, বিদ্বেষের চোখে দেখব ভেবেছিলাম, কিন্তু সে চেষ্টা ভাবনা ধোপে টিকল না। আমার পিতৃস্নেহ বরং শতধারায় উপছে পড়ে মাতৃ পরিত্যক্ত হতভাগ্য শিশুটাকে ভাসিয়ে দিল, ভিজিয়ে দিল। মমতায় মরে যেতে লাগলাম আমি ওর জন্যে।

অথচ ছেলেটার জন্মের সূচনা থেকেই তো সারা মোহিনী মূর্তি পরিত্যাগ করে বাঘিনী মূর্তি ধরেছিল। সে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ডিব্রুগড়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সারাকে নিয়ে যখন আমি ভাগ্যান্বেষণে অকূলে ভেসেছি, তখন সারার কী মূর্তি!

একাধারে প্রিয়া জায়া বান্ধবী জননী! হ্যাঁ জননীও! সারা আমায় সাহস জুগিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে, আর তারই দুরতম এক আত্মীয় মরিস সাহেবকে ধরে আমাকে টেলকোর এই মস্ত কাজটা পাইয়ে দিয়েছে।

কিন্তু মরিসকে দেখেই সারা যেন হঠাৎ বদলে গেল, সারা যেন এত দিনে হঠাৎ তার অভীষ্টকে খুঁজে পেল। আর সেই থেকেই ক্রমশ অশান্তির মাত্রা বেড়ে উঠতে লাগল।…বেড়ে উঠতে লাগল ওর উচ্ছৃঙ্খলতা।

অতএব তখনই আমি প্রশ্ন তুললাম, ‘মরিসকেই যদি তার দরকার ছিল, তাহলে আমার একটা সাজানো জীবনের ছন্দ ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়ে, আমাকে আমার জীবন, সমাজ, আত্মীয়স্বজনের ভালবাসা, সব কিছু থেকে বিধ্বস্ত বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আমার স্কন্ধে ভর করেছিলে কেন?’

এই প্রশ্নেই ও আরো ক্ষেপে উঠল, আমাকে মিথ্যাচারী শয়তান বলে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল, আর চূড়ান্ত মাতাল হয়ে যা তা করতে শুরু করল।

যাকগে ওর কথা ভাবতে প্রবৃত্তি হয় না, শুধু অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি, তারই রক্ত—মাংসে গঠিত, তার চেহারার চিহ্নে কলঙ্কিত ওই ছেলেটা আমার এতখানি কেড়ে নিয়েছে।

যখন ও জন্মাল, তখনো তো সারা সম্পর্কে আমার আশা একেবারে নির্মূল হয়নি। ডাক্তার বলেছিল অনেক মেয়ে গর্ভাবস্থায় এ রকম ক্ষেপে যায়, উগ্রমূর্তি হয়ে ওঠে, প্রসবের পর সেরে যায়, সেই আশ্বাসটা ছিল তখনো মনের মধ্যে। তাই শখ করে সাগরপারের দুহিতার সন্তানের নাম রেখেছিলাম সাগর।

ডাক্তারের আশ্বাস ধূলিসাৎ করে দিয়ে সারা উত্তরোত্তর উগ্র উচ্ছৃঙ্খল আর মাতাল হয়ে উঠতে লাগল। তখন আমি ওই ছেলেটার দিকে আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভেবেছি, আমার চেহারার লেশমাত্রও পায়নি কেন ও? আরো কুটিল সন্দেহে ওর প্রতি নিষ্ঠুর হতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে সন্দেহ দানা বাঁধবার অবকাশ তো পায়নি। ওর যখন জন্মের সূচনা, তখন কোথায় ওই রাস্কেল মরিসটা, আর কোথায় সারা! সারা তো তখন প্রিয়া জায়া বান্ধবী এবং জননীর ভূমিকায় এখানে সেখানে।

ছেলেটা আমারই। আমার জীবন বৃক্ষের প্রথম ফল। তাই ছেলেটা আমার বুক জুড়ে চেপে বসে গেছে। কিন্তু ক্রমশই বুকজোড়া দুশ্চিন্তাও এনে দিচ্ছে।

প্রথম প্রথম মনে হত, মা ছাড়া শিশু দাস দাসীর কাছে মানুষ হচ্ছে এ রকম জেদি আবদেরে তো হবেই, কিন্তু ক্রমশই আমার ভয় জন্মে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ও ওর মায়ের মতই জেদি একগুয়ে স্বার্থপর নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। মায়ের মত মতলববাজও। ও যখন কিছু বাগাবার ইচ্ছে করে, তখন ও দেবশিশুর ভূমিকা নিতে পারে। যেমন পেরেছিল ওর মা।

একজনের জীবনবৃন্ত থেকে ফুটন্ত ফুলটি ছিঁড়ে কেড়ে নেবার চেষ্টায় সারাও তো পবিত্র দেবদূতীর মূর্তি নিয়ে দেখা দিয়েছিল আমার চোখে। নিজেকেও আমি ক্ষমার যোগ্য মনে করি না, তবু দেখে বিস্মিত হই আমার সারা প্রাণ জুড়ে সারার ছেলে! ওকে কি করে মানুষ করে তুলতে হবে, সৎ সভ্য করে তুলব, এই বিষয়ে আমার দিন রাত্রিগুলো পীড়িত ক্লিষ্ট হয়ে আছে।

ছবিটা আবার ভাল করে দেখতে থাকে শান্তনু।…আমি কি চায়ের পেয়ালায় ঝড় তুলছি? এইটুকু তো শিশু! এর সম্বন্ধে এতই বা ভাবছি কেন? ছেলেবেলায় কত ছেলে কত দুষ্টু থাকে।

সুরেশবাবুর উচ্ছ্বাস আর আশ্বাস ভরা চিঠিখানা, অনেক অনেকবারের পর আরও একবার চোখের সামনে খুলে ধরল—’এতদিনে আশা হইতেছে সাগর বাবাজীবনের সম্বন্ধে দুশ্চিন্তার আর কোন কারণ থাকিতেছে না। দিনে দিনে যা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখিতেছি। মনে হয় বড় ঘরের মহিলা, বাড়ির উপর রাগ অভিমান বশত চলিয়া আসিয়া এই চাকুরি গ্রহণ।’

সেই আশ্চর্য পরিবর্তন—সাধিনী আশ্চর্য ক্ষমতাময়ী বড়ঘরের মহিলাকে দেখবার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠে শান্তনু। তার স্থির বিশ্বাস—নিশ্চয় কোন স্কুল মিস্ট্রেস ছিলেন মহিলা। হয়তো বা কোন রিফরমেটারি স্কুলের।

রোদ উঠেছে চড়া, পোস্ট অফিস থেকে ফিরছিল সুসীমা। দুটো চিঠি আর একটা বই নিয়ে। বইটা পোস্টে আনিয়েছে। শিশু মনস্তত্ব সম্পর্কিত বই। এসে পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই চালু রেখেছে সুসীমা। এসেই পোস্ট অফিসে নিজের নাম—ঠিকানা লিখে রেখে গিয়েছিল, এবং ব্যবস্থা করেছিল সপ্তাহে তিনদিন করে ও নিজেই এসে চিঠির খোঁজ করে যাবে।

এ এক খেয়াল! কোথায় রয়েছি বাড়িতে জানাবে না।

এসেই মাকে জানিয়েছিল, বাড়ির মালিক বিদেশে। বাড়ির ঠিকানা সম্বন্ধে এখনও সঠিক হইনি, আপাতত তোমরা পোস্ট অফিসের কেয়ারেই চিঠি দিও। পরে সঠিক ঠিকানা জানাব।

সেই সঠিকটা আর জানানো হয়নি। ওই আপাততের পিরিয়ডই চলছে। সুসীমা দাদাকে বৌদিকে কি মাকে চিঠি লেখে, সেটা নিয়ে পোস্ট অফিসে চলে যায়, নিজের কোন চিঠি এসেছে কিনা খোঁজ করে নিয়ে আসে।

আজ মা আর দাদা দুজনের চিঠিই একসঙ্গে এসেছে। যদিও আলাদা আলাদা তারিখে লেখা। দু’দিন আসা হয়নি তাই পড়ে ছিল।

মা লিখেছেন, তুমি তো এ যাবৎ সঠিক কোন ঠিকানা দিলে না। জানি না, কোথায় আছ কি ভাবে আছ। তোমার বয়েস হয়েছে, স্বাধীনতা আছে, কাজেই আমার কিছু বলার অধিকার নেই, তবে তোমার বুদ্ধি বিবেচনার উপর আস্থাও আর আমার নেই। কাজেই খুবই উদ্বিগ্ন আছি। তোমার দাদাকে বারংবার অনুরোধ করছি একবার ওখানে গিয়ে তোমার খোঁজ করে আসতে সে অনুরোধে কান দেয় না। আমারও তো বেশী বলার মুখ নেই। তুমি তার বালিকা কুমারী বোন নও। বৌমা তো আমার উদ্বেগ দেখলে ব্যঙ্গ হাসি হাসে। কী করব, আমার হয়েছে শাঁখের করাত। ভগবান আমায় একবার বন্ধনমুক্ত করে সুখের সাগরে ভাসিয়ে আবার যে এমন করে বন্ধনগ্রস্ত করবেন তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। যাই হোক, তুমি একটা ঠিকানা জানিয়ে নিশ্চিন্ত করবে। যে শিশুটির রক্ষণাবেক্ষণ করছ—তার উন্নতি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ভাল হচ্ছে, তোমায় ভালবাসছে জেনে সুখী হলাম। তবে তোমার এই ‘লক্ষ্মী হয়ে ভিক্ষে মাগা’ দেখলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। আজ কোথায় তোমারই চারিদিকে দাসদাসী পরিচর‍্যা করবে, নিজের রাজত্বে রাজত্ব করবে, তা নয় এই হীন দাস্যবৃত্তি। সকলই আমার অদৃষ্ট।

ইতি—আশীর্বাদিকা মা

এ চিঠিটি অবশ্যই খামে। দাদার চিঠিটা পোস্টকার্ডে। দাদার ভাষাটা হচ্ছে—তোমার জন্য মা সর্বদাই দুশ্চিন্তিত। নিয়মিত চিঠি দিয়ে এবং ঠিকমত ঠিকানা দিয়ে মা’র চিন্তা দূর করবে! আশা করি কুশল।—দাদা

দাদার চিঠিটা পড়ে একটু কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল মুখে। মা উদ্বিগ্ন মা’র দুশ্চিন্তা দূর কোরো—

সাইকেল রিকশা করেই পোস্ট অফিসে যায় আসে সুসীমা, চিঠি দুটো ফেরার পথে রিকশাতেই পড়া হয়ে গেল। পড়ার শেষে ব্যাগে পুরে ফেলে সামনের পথের দিকে তাকিয়ে দেখল। সোজা গেলে স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যায়, চ্যাটার্জি সাহেবের পদস্থ কোয়ার্টার্সে যেতে হলে ডাইনে বাঁক নিতে হয়।

সুসীমা যদি ওই ডাইনের মোড়টা না ফেরে? যদি সোজা চলে যায়? থাকার মধ্যে একটা সুটকেস, খানকয়েক শাড়ি জামা। মস্ত একটা মাথা ঘামাবার মত কিছু নয়। চলে গেলে কী হয়?

হঠাৎ বুকের মধ্যে তোলপাড় করে উঠল। বেরোবার সময় সাগরকে এ, বি, সি, ডি, লিখতে বলে এসেছে, এবং চালাক ছেলে সাগর সঙ্গে সঙ্গে শর্ত আরোপ করেছে, ‘তাহলে তুমি টফি আনবে?’

সাগরের সেই টফির ঠোঙা সুসীমার হাত ব্যাগের মধ্যে। আর সকালবেলা সুরেশবাবু ছেলেমানুষের মত বলে বসেছিলেন, ‘বাজারে হঠাৎ ভাল ইলিশ দেখলাম মা, নিয়ে এলাম। রান্নার সময় তুমি যদি ওই ভাগ্যধরটাকে একটু দেখিয়ে দাও—শুধু ওর হাতে পড়লে দফা শেষ করে দেবে।’

ব্যাচেলার মানুষ, কে বা কবে যত্ন করে খাইয়েছে, অথচ মানুষটা খেতে—টেতে ভালবাসেন। মায়ার বশেই সুসীমা বাজার থেকে এটা ওটা আনতে বলে, এবং রান্নার তদারক—টদারকও করে একটু।

আজ সেই প্রত্যাশা নিয়ে বলেই ফেলেছেন ভদ্রলোক লজ্জার মাথা খেয়ে। সুসীমা সেই প্রত্যাশার মুখে ছাই দেবে? তাই এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়াটা তখন অবাস্তব মনে হল।

আমি এত নার্ভাস হচ্ছি কেন? ভাবল সুসীমা। নিজেকে তো এত ভীরু মনে হয়নি এতদিন। সাগর নামের ওই বাচ্চাটার ‘বাপী’র সঙ্গে দেখা হওয়ার আনার এত ভয় কিসের?

বাড়ি ঢুকতেই সুরেশবাবু যাকে বলে হন্তদন্ত বলে ওঠেন, ‘মা এসে গেছ? এতক্ষণ আমি একা একা—’

সুসীমার ভয়ে প্রাণ উড়ে হায়, সাগরের হঠাৎ কোন অসুখ করেনি তো? তাকিয়ে থাকে চুপ করে। কথা বলতে পারে না। সুরেশবাবু এই ভাবান্তর লক্ষ্য করেন না, সেইভাবেই বলে চলেন, ‘সাহেবের তো পরশু প্লেনে আসার কথা? আজই এসে গেছেন হঠাৎ। তুমি বেরোবার পরই ট্রাঙ্ক টেলিফোন, বললেন, হঠাৎ একটা টিকিটের সুবিধে হওয়ার দু’দিন আগেই—গলার স্বরটা শুনে হঠাৎ যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না—’

একটু দম নেন ভদ্রলোক, আবার বলেন, ‘কিন্তু কলকাতায় কিছু কাজ আছে। সেটা সেরে নিয়ে যে গাড়িটা পাবেন চলে আসবেন। বললেন বাই কারে আসতে পারতেন, মাণিকজী না কে যেন আসছে। কিন্তু তাতে হয়তো দেরী হতে পারে। ওদের সুবিধে মত তো? তাই ট্রেনেই—তোমার কথা খুব আগ্রহ করে জিগ্যেস করছিলেন।’

এতক্ষণে একটা কথা বলে সুসীমা, ‘আমার কথা? আমার কথা তিনি কী জানেন?’

সুরেশবাবু বিগলিত হাস্যে বলেন, ‘সবই জানেন। আমি বুঝি আমার মায়ের কথা লিখতে ছেড়েছি?’

নিজের নাম করা সেই ঘরটায় এসে বসে সুসীমা, এখানেই তার দৈনন্দিন জীবনের সব সরঞ্জাম। ব্যাগটা রাখল, টফির ঠোঙাটা বার করে নিল, সাগরকে ডাক দিল না, নিজেই গেল ওর সন্ধানে।

বলা বাহুল্য হাতের লেখার খাতা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে। ভিতর বারান্দার পিছনে রান্নাঘরের লাগোয়া বাগান থেকে সাগর এবং গণেশের উদ্দাম কলরোল ভেসে আসছে।

কান পাতল। না। কলহ নয়—উল্লাস। শুনতে পেল, ‘কী মজা, কী মজা! বাপী আজ আসবে—কী মজা!’ গণেশও চেঁচাচ্ছে, ‘সাহেব আসবেন কী মজা!’ সুসীমা এগিয়ে গিয়ে তাকাল। দুজনই ঊর্দ্ধবাহু হয়ে উদ্দাম নৃত্য করছে, গণেশ সাগরের থেকে আড়াই গুণ বড় হলেও ভঙ্গীতে পার্থক্য নেই। সুসীমার মনে হল, সুসীমাও যদি ওদের ওই উল্লাস নৃত্যের শরিক হতে পারত!

সুসীমাকে দেখেই সাগর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল, ‘আণ্টি, আণ্টি, আজ বাপী আসবে। তুমি আমার বাপীকে ভালবাসবে?’

দেখা হল, নির্জনে নয়, একান্তে নয়, একেবারে হাটের হট্টগোলে, উপায় ছিল না। ঠাকুর চাকর মালি ঝি সুরেশবাবু এই সমবেত সভার মধ্যে সবলে টানতে টানতে নিয়ে এল সাগর তার আণ্টিকে।

‘বাপী এই দেখ আণ্টি, আসছিল না, আমি না টানতে টানতে—’

আশ্চর্য, ভয়ানক একটা কিছু ঘটল না। আকাশের নক্ষত্ররা খসে পড়ল না, পৃথিবীটা ভূমিকম্পে ওলোট পালট হয়ে গেল না।

এমন কি পায়ের তলা থেকে মাটিটা ধসে পাতালেও নেমে গেল না।’

শান্তনু তাকিয়ে দেখল ‘সুসীমাদেবী’কে, সুসীমা সাহেবকে। কিন্তু ‘চ্যাটার্জি সাহেব’কেই তো জানে সে, ‘শান্তনু’ বলে কে কবে ডেকেছে? বাদে বন্দনা!

এক সময় শান্তনুকে সেই বন্দনার মুখোমুখি হতে হল। হাটের হট্টগোলে নয়, হঠাৎ পেয়ে যাওয়া একটু নিরালার অবকাশে। শান্তনু অভিভূতের মত বলল, ‘বন্দনা এ কী দয়া তোমার!’

বন্দনা ঠোঁটের কোণায় একটু তিক্ত হাসি মাখিয়ে বলল, ‘দয়া! দয়ার কথা উঠছে কোথা থেকে? কতদিন আর ভাইয়ের ঘাড়ে চেপে থাকা যায়? পয়সাকড়ির তো দরকার, হয়ে গেলাম সাহেব বাড়ির ছেলের আয়া! মাসে মাসে তিনশো টাকা মাইনে, খাওয়া থাকা উচ্চ মানের—মন্দ কি?’

‘বন্দনা!’ শান্তনুর ঠোঁট কাঁপছে। শান্তনুর ভিতরের চাঞ্চল্য ভিতরে থাকতে চাইছে না। শান্তনু পড়ে থাকা একটা টুলের উপর বসে পড়ে বদ্ধ গভীর গলায় বলে, ‘বন্দনা! এর থেকে আরো অনেক অনেক বেশী ধিক্কার আমার প্রাপ্য, নিজেকে ধিক্কার দেবার ভাষা আমি নিজেই পাই না। তবু জিজ্ঞেস না করেও পারছি না—এটা কী করে সম্ভব হল?’

বন্দনা অন্যদিকে চোখ রেখে আবছা গলায় উত্তর দিল, ‘বললাম তো চাকরির দরকার হচ্ছিল।’

‘এটা তো বিশ্বাসের বাইরের কথা।’

‘তাহলে কোনটা বিশ্বাসের?’ বন্দনা আবার বাঁকা হাসির চেষ্টা করে বলে, ‘সাহেবের বৌ মরেছে শুনে করুণা পরবশ হয়ে তার মাতৃহীন শিশুর আয়াগিরি করতে এলাম?’

‘আমার কোনটাই বিশ্বাসের বলে মনে হচ্ছে না বন্দনা।’ শান্তনু হঠাৎ বন্দনার দুই কাঁধ চেপে ধরে খাদে নামা গলায় বলে ওঠে, ‘এই তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছ, তোমাকে ছোঁয়ার মধ্যে পাচ্ছি। তবু বিশ্বাস হচ্ছে না এটা সত্যি! মনে হচ্ছে স্বপ্ন, মনে হচ্ছে এক্ষুনি ভেঙে যাবে।’

ওই চেপে ধরা হাতের নীচে থেকে সরে যাবার চেষ্টা করে আস্তে বলে সুসীমা দেবী নামের বন্দনা, ‘ছোঁয়ার মধ্যে না পাওয়াই ভাল, দাসী চাকররা হঠাৎ দেখতে পেলে ভাববে বিলেত ঘুরে এসে সাহেবের তো খুব উন্নতি হয়েছে দেখছি। ছেলের আয়ার গলা ধরছেন।’

‘বন্দনা, তুমি আমায় যা খুশি বল, আমায় অপমান করতে পারবে না। শুধু তোমায় একবার বলতেই হবে, কেন এখানে এসেছ তুমি? কেন সারার ছেলেকে এমন প্রাণপাত করে মানুষ করে তুলছ?’

বন্দনা এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘বাঃ আসল কথাটা সাহেব মানতে না চাইলে আমি কী করব? ডিব্রুগড়ের চ্যাটার্জি সাহেবের সেই বড় সাধের দ্বিতীয় পক্ষের মেমবৌ কেটে পড়েছে, সাহেব তার ছেলেকে মাতৃহীন বলে চালিয়ে বেশী মাইনের টোপ ফেলে লোক চাইছে, এসব আমি জানব কেমন করে? জগতে আর কোন চ্যাটার্জি সাহেব থাকতে পারে না?’

শান্তনু আবার ওর বাহুমূল চেপে ধরে বলে ওঠে, ‘তুমি বলতে চাও, তুমি না জেনে এখানে এসে পড়েছিলে?’

বন্দনার মুখ লাল হয়ে উঠেছে, বন্দনা এখন যেন আর চেষ্টাকৃত সমাহিত ভাবটা রাখতে পারছে না, বন্দনা প্রায় উত্তেজিত গলায় বলে, ‘আমি কিছুই বলতে চাই না শান্তনু! শুধু যেতে চাই। কালই আমি চলে যাব—হাতটা ছেড়ে দিলে ভাল হয়।’

শান্তনু তবু ছাড়ে না, তেমনি শক্ত ভাবে চেপে ধরে বলে, ‘না ছাড়ব না, কেন তুমি এভাবে এলে, কেন এতদিন রইলে, এর জবাব দিতেই হবে তোমায়।’

বন্দনা হঠাৎ সরাসরি মুখ তুলে তাকায়, একটুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, ‘যার জবাব নিজেই জানি না সে আর কি করে দেব?’

‘বন্দনা, তবু কি মনে হয় জানো? তুমি জেনে বুঝে আমাকে দয়া করতেই এসেছিলে—’

বন্দনা আস্তে বলে, ‘তা ঠিক নয় শান্তনু। অত মহৎ আমি নই। অ্যাডভার্টিজমেণ্টটা দেখেই হঠাৎ যেন মাথার মধ্যে কি হয়ে গেল। ডিব্রুগড়ের ইঞ্জিনীয়ার সাহেব কোথায় কোথায় ঘুরল, কোথায় গিয়ে বসল, সবই কেমন করে যেন জানা হয়ে গিয়েছিল, তাই ভাবলাম সুযোগ যখন একটা জুটে যাচ্ছে, গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি, এত আদরের মেমগিন্নীকে রাখতে পারলে না? সে হঠাৎ মরল যে?’ বন্দনা হঠাৎ একটু হেসে উঠে বসে; একেবারে রঙ্গমঞ্চে প্রতিহিংসাপরায়ণা খল নায়িকার মত আর কি!…

কিন্তু এসে দেখি পরিস্থিতি উল্টো। তারপর আর কি, অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে পড়লাম। সতীনের ছেলের মায়ার বন্ধন কাটিয়ে উঠতে পারছি না।’

‘বন্দনা অনেক কিছুই হয়তো শুনেছ, তবু সবটা তো শোননি, সব বলতে ইচ্ছে করছে তোমায়—’

বন্দনা নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘লাভ কি শান্তনু। আর তো আমরা সেখানে নেই, যেখানে পরস্পরের কাছে মনের কথা বলতে ইচ্ছে করে।’

শান্তনু হঠাৎ জেদের গলায় বলে, ‘আবার আমরা সেইখানে ফিরে যেতে পারি না বন্দনা? মাঝখানের এই দুঃসহ দিনগুলো আবার ঘসে মুছে ফেলতে পারিনা? সারা যেদিন আমার জীবনের শনি হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তার আগের দিন থেকে আবার শুরু করি এস বন্দনা। মনে কর ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলে এসেছি আমরা।’

বন্দনা শান্ত গলায় বলে, ‘এটা একেবারে অতি—নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে শান্তনু। এক সময় যা—ই ঘটুক এখন আর তুমিও পাগল নয়, আমিও পাগল নই।…চল ওদিকে। হঠাৎ যদি কারো চোখে পড়ে সে ভাল বলবে না।’

শান্তনু আবার জেদের গলায় বলে, ‘পড়ুক চোখে। আমি আমার নির্বুদ্ধিতার ইতিহাস ব্যক্ত করব সকলের কাছে, আমি ওদের কাছে তোমার সত্য পরিচয় দিয়ে দেব।’

বন্দনা হঠাৎ কঠিন হয়। কঠিন গলাতেই বলে, ‘কি সত্য পরিচয় দেবে তুমি আমার? এক সময় বন্দনা নামের এই মেয়েটা ডিব্রুগড়ের চ্যাটার্জি সাহেবের মিসেস ছিল, ভারী খাতির ছিল মিসেস চ্যাটার্জির সেই শহরের শহুরে সমাজে? হঠাৎ একদিন অন্য কোন এক অফিসের সাহেবের মেমকে দেখে চ্যাটার্জি সাহেব উন্মাদ হয়ে গেল, বাহ্যজ্ঞান হারাল, উঠতে বসতে গঞ্জনা দিতে শুরু করল তার নিজের মিসেসকে? ডিভোর্স আদায় করবার জন্যে আদাজল খেয়ে লাগল আর শেষ অবধি করে তবে ছাড়ল—বলবে এসব? বলবে, সেই হতভাগ্য সাহেব বেচারার জীবনও অতিষ্ঠ করে দিয়ে দু—দুটো বিবাহ বিচ্ছেদের দলিলের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে তোমরা দুই উন্মাদ নারী পুরুষ একটা নতুন বিয়ের দলিল গাঁথলে? আর তারপর—’

বন্দনা ওই নিরালা জায়গাটা থেকে সরে আসতে আসতে বলে, ‘যা হয় না, তা নিয়ে বাজে ভাবনা ভেবে লাভ নেই শান্তনু। মানুষ গায়ের গহনা নয় যে তার একটা ডিজাইন আগুনে গলিয়ে ভেঙে আবার তা দিয়ে নতুন ডিজাইনের গহনা বানানো যাবে। আমি কাল সকালেই চলে যাব।’

কিন্তু চলে যাব বলে ঘোষণা করলেই কি যাওয়া এত সহজ? সহজ হত, যদি সত্যিই সেই সত্য ইতিহাসটা ব্যক্ত করতে পারত সুসীমা নামের ছদ্মবেশে ঢাকা বন্দনা। কিন্তু তার চাইতে কঠিন কাজ আর কি আছে?

অথচ আর একটা দরজা কঠিন করে তুলেছে দুর্ধর্ষ দুর্বার সাগর চ্যাটার্জি। ঘুম থেকে উঠেই তার উদ্দাম ডাক সারা বাড়িটা তোলপাড় করে তোলে, ‘আণ্টি, তুমি কাল আমার কাছে শুলে না কেন? তুমি মিথ্যে কথা বললে কেন? কেন বললে পরে শোব?’

ছেলেটার আণ্টি কি তখন ওর সঙ্গে কথা বলবে না? না কি নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে থাকবে? বাড়িতে আরো অনেক চোখ আছে সাহেব ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলের নার্সের এই উৎকট পরিবর্তন কি চোখে পড়বে না তাদের?

সুসীমার খোলশটা ছিঁড়ে—খুঁড়ে ওদের চোখের সামনে ছড়িয়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবে কি সুসীমা?

তা হয় না। যা খুশি হওয়ানো গেলে তো শান্তনুর প্রস্তাবও গ্রহণীয় হতে পারত। নতুন করে গাঁটছড়া বেঁধে আবার সেই আট বছর আগের একটা তারিখ থেকে শুরু করা যেত। বড় দুঃসহ গোলমেলে অবস্থা—কিন্তু এ অবস্থা তো বন্দনার নিজের সৃষ্টি।…

বন্দনা বলল, ‘বাঃ, কাল তো তুমি তোমার বাপীর কাছে শুয়েছিলে—।’

‘বাপী তো শোয়ইনি। বাপী তো সোফায় বসে ছিল সারা রাত্তির।’

সুসীমার মধ্যে বন্দনা একটু কেঁপে ওঠে, তারপর চট করে দিব্যি সুসীমা হয়ে গিয়ে বলে ‘আর তুমি বুঝি সারারাত্তির বসে থেকে পাহারা দিচ্ছিলে?’

‘আমি দেখেছি। বাপী খালি খালি সিগারেট খাচ্ছে আর বসে আছে।’

এ সময় শান্তনু ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এসে দরজায় দাঁড়াল। শান্তনুর মুখের চেহারায় তার শিশুপুত্রের কথার স্পষ্ট প্রমাণ। শান্তনুর মুখ শুকনো, চোখের কোলে কালি। শান্তনুর পরণে রাতের ঢিলে পোশাক। চুল এলোমেলো, চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ। সমগ্র চেহারায় একটা বিধ্বস্ত জীবনের ছাপ।

সুসীমা তাকিয়ে দেখল। যেন হঠাৎ হোঁচট খেল একটা।

সুসীমা হোঁচট খেয়ে আট দশ বছর আগের একটা দিনে পৌঁছে গেল। দেখল—ডিব্রুগড়ের সেই বাড়িটা, যেখানে বন্দনা নামের একটা মেয়ে আহ্লাদে ডগমগিয়ে এই শান্তনুকে নিয়ে ঘর পেতেছে, উছলে উছলে সংসার করছে।

সেই বাড়ির একটা দরজায় ঠিক এই রকম শান্তনুকে দেখতে পেল সুসীমা। ঠিক এই রকম পরণে ঢিলে পোশাক, মুখ শুকনো শুকনো, চুল এলোমেলো। শুধু চোখের দৃষ্টিতে তারতম্য। সে দৃষ্টিতে কৌতুকের হীরের ছটা। সমগ্র চেহারায় যেন বিজয়ীর উল্লসিত ঔদ্ধত্য।

সুসীমা দেখল বন্দনার স্নান হয়ে গেছে, ঝকঝকে মাজা ঘসা মুখ, ভিজে চুল পিঠে ছড়ানো, পরণে একখানা দেশী তাঁতের সবুজ রঙা শাড়ি, তার সঙ্গে লাল টুকটুকে হাতকাটা ব্লাউজ। বন্দনার হাতে একটা গরম দুধ ভরা সসপ্যান, এঘর থেকে ওঘরে যাচ্ছে—

দরজায় দাঁড়ানো লোকটা বলে উঠল, ‘আরে আরে একটা ম—স্ত টিয়াপাখি কোথা থেকে উড়ে এল!’

বন্দনা চমকে হাতের বাসনটা নামিয়ে রেখে ঘরের সীলিঙের দিকে তাকাল, ‘কই? কোথায়?

‘এই তো, এই তো সামনেই, কী মুশকিল, দেখতে পাচ্ছ না? এই এই, আয় আয় টিয়ে—’

বন্দনার তখন নিজের শাড়ি ব্লাউজের রঙের দিকে নজর পড়ল, বন্দনা বলে উঠল,’সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই অসভ্যতা শুরু হয়ে গেল।….ছুটি বলে বুঝি রাজ্যপদ পাওয়া হয়েছে? এতক্ষণে ঘুম ভাঙল সাহেবের?

শান্তনু একটা হাই তুলে এলোমেলো চুলগুলো কপাল থেকে পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘কী করা যাবে? মেমসাহেব রাত্তিরে সাহেবের ঘুমের বিঘ্ন ঘটায় কেন?’

বলল। কারণ তখনো সুখের গাছের শিকড় মাটির গভীরে। সেই গাছে সোনার ফুল হীরের ফল ফলছে। তখনো ‘মেমসাহেব’ শব্দটা কৌতুকের জোগানদার। সাহেবের বৌ মেমসাহেব। সেই নকল মেমসাহেব কটাক্ষে অমিয় ঢেলে বলল, ‘দেখ ভাল হবে না বলছি কিন্তু—’

‘ভাল? হায় গড! যেদিন মাথায় টোপর পরেছি, সেইদিন থেকেই তো ভাল হবার আশা ত্যাগ করেছি।’

‘আহা! জগতে যেন আর কেউ মাথায় টোপর পরে না—’

তারপর খুনসুটি আর খুনসুটি।

দেখে বন্দনার মুখ লজ্জায় লালচে। বন্দনা বলছে, ‘অনেক তো হল সাহেব, এবার চায়ের টেবিলে বসার যোগ্য হয়ে বোসো।’

আর সেই সাহেব হাসতে হাসতে বলে গেল ‘মেমসাহেব বড় বেরসিক।’

‘দুজনেই সমান রসিক হলে সংসারটা যে ভেসে যাবে।’ হি হি করে হেসে পাশের ঘরে চলে যায় বন্দনা।

অবশ্য গৌরব করেই ‘সংসার’ বলল, সংসার বলতে শুধু ওই দুটো আহ্লাদে ভাসা প্রাণী। বন্দনা আর শান্তনু। নতুন কোন প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেনি।

তারপর সত্যিকার এক সোনালী চুল সোনালী চোখ মেমসাহেবের পদার্পণ হল ওদের ওই ছন্দে গাঁথা জীবনখানির উপর। আর কেমন করে কে জানে সে ওই নকল মেমসাহেবের সুখের গাছটি উপড়ে ফেলে দিল শিকড় সুদ্ধু।

বদলে গেল শান্তনু নামের ওই মানুষটা, বদলে গেল জীবন, বদলে গেল সমস্ত পৃথিবী। বিশ্বাস বলে যে একটা শব্দ ছিল একদার পুরণো পৃথিবীতে, সেকথা ভুলে গেল বন্দনা।

সেই শিকড় ছেঁড়ার ইতিহাসের ছেঁড়া পাতাগুলো ফরফরিয়ে উড়ছে সুসীমার সামনে—সুসীমা দেখতে পাচ্ছে বন্দনার মুখ বিরক্ত বেজার, ‘ওখানে তোমার এত কী? তাস খেলার নেশা না আর কিছুর নেশা? কতকগুলো জুয়াড়ির সঙ্গে মিশে তাস ধরে উচ্ছন্নে যেতে বসেছ তুমি, বুঝতে পারছ না?’

দেখতে পাচ্ছে শান্তনু মাথা চুলকিয়ে বলছে, ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে, আর কখনও যাব না।’

কিন্তু অন্য পাতা উড়ছে। সেখানে বন্দনাকে দেখা যাচ্ছে আরক্ত, উত্তেজিত—লজ্জায় নয়, আবেশে নয়, রাগে দুঃখে—বলেছিলাম, ‘গোড়া থেকে বলেছিলাম, উচ্ছন্নে যেতে বসেছ তুমি। তখন হেসে উড়িয়েছ, নিজের ওপর বড্ড বেশী আস্থা ছিল যে! এখন? এখন কী বলবে?’

সুসীমা দেখল সেই শান্তনু জবাব দিচ্ছে উদ্ধত ভঙ্গীতে।—’আমি কারো কেনা চাকর নই। আমার যা খুশি আমি তাই করব।’

অন্য পাতা খুলে পড়ছে। বন্দনার মূর্তি বদলে গেছে। বন্দনা পাথরের পুতুলের মত মুখে বলেছে—’কী চাও তুমি? ওই অসভ্যটাকে নিয়েই ঘর করতে চাও? তাই কর তবে। আমায় বিদেয় দাও। কলকাতায় পাঠিয়ে দাও আমায়।’

তখনো শুধু ওইটুকুই বলতে পেরেছিল বন্দনা। কারণ তার ঊর্ধ্বে আর কিছু ভাবা যায়, তা ভাবতে জানেনি।

অতঃপর সেটা সেই ভয়ঙ্কর ভাবে বদলে যাওয়া শান্তনুই জানাল। পালা বদলে গেল। শান্তনু নামের এক ভদ্র মার্জিত পুরুষ ওইটুকুতেই ক্ষান্ত হল না। একেবারে শেষ পর্যন্ত গেল, বন্দনা নামটাকে তার জীবন থেকে নির্বাসিত করে তবে ছাড়ল। কারণ সে তখন ভাবতে বসেছে, এতেই তার সুখ, এতেই তার আনন্দ।

আর এখন? এখন সে একটা ধ্বংসস্তূপের মত দাঁড়িয়ে আছে।

সুসীমা ওদিক থেকে ছেলের দিকে চোখ ফেরাল।

বলল, ‘কাল যা ঘুম পেয়েছিল আমার, বাববাঃ। নড়তেই পারছিলাম না, বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছি।’

সাগর তীব্র গলায় বলে, ‘আজ শোবে। বুঝলে? বাপীকেও তোমার সব গপপোগুলো বলতে হবে। বাপী কিচ্ছু গপপো জানে না।’

সুসীমা শান্ত গলায় বলে, ‘আর কী করে হবে ওসব, বাঃ। আমি তো আজ চলেই যাব।’

‘চলেই যাবে!’ সাগর ঝিকঝিকে হাসি হেসে বলে, ‘য্যাঃ।’

‘বাঃ যাব না? আমার মা’র জন্যে মন কেমন করছে আমার।’

সাগর স্বচ্ছন্দে বলে, ‘তোমার মাকে চলে আসতে চিঠি লিখে দাও।’

‘বাঃ, মা কেন তোমাদের বাড়িতে আসতে যাবেন?’

সাগর উত্তেজিত গলায় বলে, ‘কেন আসবেন না? আমরা কী পাগল?

আমরা কী রাক্ষস? ডাকাত? পাজী? তুমি তাহলে আছ কী করে?’

সুসীমা অন্য পথে যায়।—’এখন তো তোমার বাপী এসে গেছেন। আবার কী ভাবনা।’

‘তা হোক, তুমি যাবে না।’

‘বললেই হল। আমি বুঝি তোমাদের বাড়ি চিরকাল থাকতে এসেছি?’

‘এসেছই তো। চিরকাল থাকবে তুমি।’

স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে থাকা চ্যাটার্জি সাহেব এতক্ষণে কথা বলেন, ‘শিশুর মুখে ভগবান কথা কন।’

সুসীমা মুখ তুলে তাকায়। ছোট একটু হাসির সঙ্গে বলে, ‘যাদের ভগবান আছেন তাদের কাছে বলেন হয়তো, সকলের কাছে নয়।’

‘ভগবান সকলের কাছেই আছেন, শুধু এক এক সময় লুকিয়ে পড়েন।’

সাগর চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বাপী, তুমি আণ্টিকে চেনো?’

আণ্টিই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘বাঃ, তুমি কাল চিনিয়ে দিলে না?’

‘ও।’ সাগর নিশ্চিন্ত গলায় বলে, ‘আমি ভাবলাম তোমার চেনা। আণ্টি, আজ তুমি পুডিং করবে?’

ছেলেটার এটা প্রিয় খাদ্য। সুসীমার মনে পড়ে, দু’দিন আগে থেকে এটার বায়না করেছে সাগর। মনের মধ্যেটা মুচড়ে ওঠে, আস্তে বলে, ‘করব বাবু।’

‘আর ঝাল না দিয়ে চপ, অ্যাঁ? আর খেজুরের চাটনি, আর মুরগীর—’

‘বাঃ, তোমার যে ফিরিস্তি বেড়েই যাচ্ছে এত সব করে কখন যাব আমি?’

‘আবার যাবার কথা! হঠাৎ সাগর অনেকদিন পরে নিজমূর্তি ধরে। ‘বলছি না যাবে না। গেলে আমি তোমার গলা কেটে দেব—চুল ছিঁড়ে দেব, পা ভেঙে দেব।’

সুসীমা হেসে উঠে বলে, ‘তা তাই কর। আমি তো তাহলে বেঁচে যাই।’

এরপর আর তেজ রাখতে পারে না বেচারা। মাটিতে আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে থাকে, ‘তুমি যাবে না। তুমি যাবে না। তুমি গেলে আমি বনে চলে যাব। আমি মরে যাব।’

হিষ্টিরিয়াগ্রস্তের মত শিশুর এই কান্নাটা ভীতিকর। অগত্যাই সুসীমাকে বলতে হয়, ‘আচ্ছা আজ যাব না।’

শান্তনু এ দৃশ্যের দর্শক হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল, এখন শান্তনু আস্তে বলল, ‘এখন কি হতে পারে না বন্দনা?’

সুসীমা চাপা গলায় বলে, ‘পাগলামী করবেন না।’

কিন্তু এ বাড়ির সবাই বুঝি পাগল। সুরেশবাবু একরাশ মাছ নিয়ে এসে হাজির করেন।—’মা, আজ তোমার কাজ বাড়িয়ে দিলাম। তোমার সেই স্পেশাল রান্নাগুলো সাহেবকে না খাওয়ালে তো চলবে না। তার মানে আমাদেরও বেশ একটা ভাল ভোজ হবে।’

সুসীমা কি এই সরল অবোধ লোকটার মুখের ওপর বলে দেবে—’ওসব আশা ছাড়ুন? আমি আজই চলে যাব।’

সুসীমাকে সেদিন থেকে যেতে হয়। তারপর দিন তারও পর দিন।

এক হতভাগ্য জীবন বিধ্বস্ত পুরুষ যদি খেতে বসে পরিতৃপ্তির মুখ নিয়ে বলে, ‘জীবনে এ সবের স্বাদ ভুলে গিয়েছিলাম। এবং তার ছেলের আণ্টির অসতর্ক মুহূর্তে বলে এত ঝড় বয়ে গেল জীবনে তবু হাতটা ঠিক তেমনিই কী করে রেখেছ বন্দনা? মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে বুঝি ডিব্রুগড়েই রয়েছি।…তুমি রান্না করছ, যত্ন করে খাওয়াচ্ছ। স্বপ্নের মত লাগছে—’

তাহলে কি মনে হয় না, কী এসে যায় আর দু’একটা দিনে? যদি এক অনুতপ্ত পুরুষ অহরহ ভিক্ষুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ক্ষমার আশায় তাহলে মেয়ে—মন মমতায় কোমল, ক্ষমায় স্নিগ্ধ না হয়ে পারে?

কিন্তু শুধুই কি তাই? নিজের দিক থেকেই কি কিছু নেই? শান্তনুর জন্যে বন্দনার যে এখনো এতখানি ভালবাসার প্রাণ মজুত ছিল তা কি বন্দনা কোন দিন নিজেই জানত?

বন্দনার সেই প্রাণটা হঠাৎ খুব একটা কষ্টে মুচড়ে মুচড়ে ওঠে, যখন দেখে শান্তনুর চোখে আশা আর বিশ্বাসের আভা, শান্তনুর মুখে প্রত্যাশার দীপ্তি।

সেই দীপ্তি যেন স্থির বিদ্যুতের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে তাকিয়ে থাকে, যখন বন্দনা সুরেশ ঘোষকে স্নেহের তিরস্কার করে বেআন্দাজি বেশী বাজার করার জন্যে, কুড়ুনীকে বাসন ভাল করে না মাজার জন্যে, ধোবাকে ইস্ত্রী ভাল না করার জন্যে, আর সাগরকে দুধ ফেলার জন্যে, ভাত খেতে দুষ্টুমীর জন্যে, রোদে ঘোরার জন্যে, সময়ে পড়তে না বসার জন্যে।

‘ছ’ মাসে তুমি ওর এতটা ইমপ্রুভমেণ্ট করেছ বন্দনা, অবিশ্বাস্য।’

বন্দনা বলে, ‘অবিশ্বাস্য কিছু না। পড়ার বয়েসটা হয়ে এসেছিল ওটা যে কারো হাতেই হতে পারত।

‘তোমার স্বচ্ছন্দ সংসার পরিচালনা দেখলে বিশ্বাসই হয় না, ছ’মাস আগেও তুমি এখানে ছিলে না।’

বন্দনা বলে, ‘কত অবিশ্বাস্য জিনিষই বিশ্বাস করতে হয়, এটা তো তুচ্ছ।’

‘সাগর তোমার কী ভক্ত তা তুমি হয়তো নিজেও বুঝতে পারো না বন্দনা।’

‘নিজে তো অনেক কিছুই বুঝি না। নিজেকেই না। নাহলে তোমার সংসার তরণীর হাল ধরে বসে আছি, তোমার জন্যে সযত্নে রান্নাবান্না করছি তোমার ছেলেটাকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবে যন্ত্রণায় মরছি।’

শান্তনু ব্যাকুল হয়, শান্তনু ওর হাত চেপে ধরে বলে, ‘ছেড়ে যাওয়ার কথাটা ছেড়ে দাও না বন্দনা।’

‘ছেড়ে দেব?’ বন্দনার কণ্ঠে তীব্রতা নয়, তীক্ষ্নতা নয়, অদ্ভুত একটা শূন্যতা।

আশান্বিত পুরুষ মন বলে ওঠে, ‘তাহলে পাথর গলেছে।’ বলে, ‘বন্দনা, আমার ভিতরের সবটাই তো তুমি দেখতে পাও। দেখতে তো পাচ্ছ সেখানে কী দাহ কি যন্ত্রণা! শুধু যদি তুমি—ছেলের গভর্ণেসকে বিয়ে—করা কিছুই আশ্চর্যের ব্যাপার নয়।’

‘জগতে কোন ব্যাপারই আশ্চর্যর নয় শান্তনু! কারণ মানুষের মত আশ্চর্য প্রাণী আর নেই।’

অনেক সাবধানতা তবু সাগর এক সময়ে চমকে উঠে বলে, ‘বাপী তুমি আণ্টিকে বন্ধনা বন্ধনা বলে ডাকো কেন?’

শান্তনুর আগে বন্দনাই উত্তরটা দেয়, ‘তার মানে, তোমার বাপী আমায় জানিয়ে দিচ্ছেন, তোমার সব খোলা, কিছুই বন্ধ না।’

সাগর এখন ধরে নিয়েছে, চলে যাব বলাটা সাগরের আণ্টির দুষ্টুমী! সাগর তাই বাপীর কাছে বায়না ধরে তিনজনে মিলে বেড়াতে যেতে, তিনজনে এক টেবিলে খেতে।

সাগরের উদ্দাম ভালবাসার কাছে হার স্বীকার করতেই হয় মাঝে মাঝে। তিনজনে একসঙ্গে বেরোনো হয়, অথবা চারজনে। পরেশও বন্দনার হাতে জাতে উঠেছে।

গাড়ি করে অনেক দূরে চলে যায় ওরা, এক মুখর শিশু আর দুই স্তব্ধ নরনারী। শিশু ওই স্তব্ধতা ধরতে পারে না, সে আপন আনন্দে বিভোর।

কোন কোনদিন ওই নারীও হঠাৎ তার স্তব্ধতার খোলশ ফেলে মুখর হয়ে ওঠে, সাগরের সঙ্গে মাতামাতি করে, হঠাৎ অসতর্ক মুহূর্তে বলে ওঠে এক একদিন, ‘তোমার মনে আছে ডিব্রুগড়ে সেবার আমরা—’

আর হঠাৎ হঠাৎ বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে নিঃসঙ্গ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ভাবে বিধাতার কি এসে যেত, যদি এই জীবনটা সত্যি আমার নিজের হত এই কৃত—কৃতার্থ পুরুষ, এই সমর্পিত—প্রাণ শিশু, এই সুখময় সংসার, মাঝখানে আমি।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হেসে ওঠে। মনে মনে বলে, বন্দনা সরে পড়, আর নয়। ওই পুরুষ হঠাৎ কোনদিন তার প্রাক্তন স্বামীত্বের মোহে আর নিশ্চিন্ততায় তোমায় ধ্বংস করে বসবে।

বন্দনা তোমার লোভকে ঠেকাও, মমতাকে ঠেকাও। সব যাক, সম্ভ্রম থাক।

অতএব একদিন, যখন সুরেশবাবু আর তার সাহেব এক গভীর গোপন পরামর্শে নিমগ্ন তখন বন্দনা এসে দাঁড়াল।

‘আপনাকে তো বলাই হচ্ছে না সুরেশবাবু, সব সময়ই আপনি ব্যস্ত, কাগজে আবার একটা অ্যাডভার্টিজমেণ্ট দিন, আমায় তো যেতেই হচ্ছে—’

হ্যাঁ, তবু চলে যেতে হবে সুখশূন্য সেই স্বর্গধামে। সম্মানের স্বর্গে। সম্ভ্রমের স্বর্গে। সেই স্বর্গের টিকিট যে কিনে বসে আছে, তাকে নিবৃত করতে থাকার ধৃষ্টতা আর আসে না কারো।

বন্দনা বলেছিল, ‘ট্রেনে তুলে দিতে যাবার দরকার নেই, আমি তো একাই এসেছিলাম।’

সুরেশবাবু কোঁচার খুঁটে চোখ মুছে বললেন, ‘তখন তুমি সাগরের আণ্টি ছিলে না, আর এই বুড়ো ছেলেটার—। তারপর সামলে নিয়ে বলেন, কিন্তু আর কোনদিনই কি—’

বন্দনা হেসে উঠে বলে, ‘সাগরের বিয়ের সময় বুড়ি আণ্টি হয়ে আসব।’

সাগর এসব ষড়যন্ত্রের কিছুই জানে না। রুমাল উড়িয়ে উড়িয়ে বলে—’টা টা’ ‘টা টা।’ দু’দিন পরেই চলে আসবে তোমার মাকে দেখে।’

জানালার ধারে বসেছিল বন্দনা, নীচে শান্তনু। শান্তনুর একটা হাত জানালার উপর রাখা। বন্দনা হাতটার উপর একটা চাপ দিয়ে আস্তে বলে, ‘গাড়ি নড়ে উঠেছে, সরে যাও।’

‘বন্দনা, ভেবে দেখবার জন্যে কোন আশাই কি অবশিষ্ট রাখা যায় না?’

বন্দনা আরও একটু চাপ দিয়ে হাতটা তুলে নিয়ে বলে, ‘পাগল!’

গাড়ি গতি নেয়। পরিচিত মুখগুলি সরে সরে হারিয়ে যায়। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো কিছুক্ষণ হতাশ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে ফিরতি মুখে হাঁটতে থাকে মাথা নীচু করে।