সম্ভাবনা : তিন ভুবনের কাহিনী
সম্ভাবনা
‘এই এই ভেঙে যাবে, ভেঙে যাবে কাঁচের জিনিষ—’
ভর দুপুরের স্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে প্রায় আর্তনাদের মত এই সাবধান বাণীটি কোথা থেকে উঠলো, কোথায় আছড়ে পড়লো বোঝা গেল না। অথচ সাবধানতাটি যেন একেবারে সঙ্কট মুহূর্তের।
অভীক কিছু কাঁচের জিনিস ভেঙে পড়ার ঝন ঝন শব্দ শোনার অপেক্ষা করতে লাগলো।
এক মিনিট, দু’ মিনিট, কয়েক মিনিট।
না শ্রুতির এলাকায় তেমন কোনো দুর্ঘটনা প্রমাণ পাওয়া গেল না।
বোঝা যাচ্ছে হুঁশিয়ারিটি কাজে লেগেছে, কোথাও কিছু ভাঙেনি। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার, অভীকের মাথার মধ্যে যেন একটা কাঁচ ভেঙে যাওয়ার ঝনঝন শব্দ পাক খেতে লাগলো।
লেখাটা শেষ করার কথা ছিল আজকে, কথা দেওয়া আছে, রাত্রেই নিতে আসবে, অথচ শব্দটাকে মাথার মধ্যে থেকে ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না।
শব্দটা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। কথার পর কথা সাজিয়ে যে জালটা বোনার কথা, সেই জালটার বুনুনি ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো পিছলে পিছলে পড়ে যাচ্ছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
‘তার মানে আর কোথাও কিছু না ভাঙুক, আমার সম্পাদকের কপালটা আজ ভাঙলো।’
কলমটা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো অভীক, বারান্দার নীচেই কী ঘটনা ঘটছে বোঝবার উপায় নেই।
এটা তিন তলা, এর নীচে দোতলার বারান্দাটা। ঠিক এমনি, একই মাপের একই গড়নের। তার নীচের বাড়ীর সংলগ্ন রাস্তাটায় কী হচ্ছে না হচ্ছে কে জানে।
তবে একটা কিছু হচ্ছে মনে হচ্ছে। কোনো অসন্তুষ্ট কুলি বা রিকশ—ওয়ালার অভিযোগ বাণীর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
এই তিন তলাতেও উঠে আসছে সেই রুষ্ট ক্ষুব্ধ অনমনীয় কণ্ঠস্বর।
অভীক বুঝলো নীচের তলায় টলায় কেউ ওদের কারো সঙ্গে বচসা করছে।
অভীক ভারী আশ্চর্য হয় এতে।
সামান্য একটা কুলি অথবা রিকশওলা কতটা দাবি করতে পারে? দশ বিশ টাকা। নিশ্চয়ই নয়? যৎসামান্যই, অথচ সেইটুকু নিয়েই কী মারামারি লোকের।
অভীকের নিজের দাদাই করে।
অভীক এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে অনায়াসে বলে, ‘থাম বাবা। তুই আর আমায় জ্ঞান দিতে আসিস না। পয়সা গাছে ফলে? আর ওদের ওই অ্যাটিচিউডটাই আমার ভাল লাগে না। যতই দাও, অসন্তোষ করবেই।
অভীকের ইচ্ছে হয় বলে ওঠে, ‘তাই কি আর সত্যি দাদা? তুমি কোনোদিন দুটো টাকা দিয়ে দেখেছ? মাত্র দুটো টাকা? তা তো দেখনি? তবে কেন বলছো ‘যতই দাও অসন্তোষ ওরা করবেই।’
বলতে পারে না, তার কারণ দাদা তার থেকে অনেকটা বড়। দাদার আর তার মাঝখানে একটি পাল দিদি বর্ত্তমান। আধডজন দিদির নীচেকার ছেলে তাই তার নামকরণ উৎসবে নাকি খুব ঘটা হয়েছিল। আর নাকি অভীকের নামকরণের ভারটা দাদা নিয়েছিল। বলেছিল, তোমাদের যা পছন্দ, ‘অ’ দিয়ে নাম রাখতেই হবে ভেবে হয়তো নামকরণ করে বসবে ‘অভয়’ কি ‘অবিনাশ’। আর নয়তো আমার সঙ্গে মিলিয়ে রাখবার উৎসাহে রেখে বসবে ‘নবীন’। আমি নাম দিচ্ছি—ওর নাম থাক ‘অভীক’।
এই নামের অবদানটির জন্যে দাদার উপর রীতিমত কৃতজ্ঞ অভীক। কে জানে বাবা মা কী ঠাকুমার হাতে পড়লে কী সর্বনাশই করে রাখতেন তাঁরা অভীকের।
অবিশ্যি দাদার কাছে কৃতজ্ঞ হবার কারণ অনেক আছে, বলতে গেলে দাদাই অভীককে মানুষ করেছে, দাদাই অভীককে নিজের মানসিকতার পথে যেতে আনুকূল্য করেছে। দাদার গুণও বিস্তর।
কিন্তু ওই একটি বিরাট দোষ, দাদা পয়সাকড়ির ব্যাপারে বড্ড হুঁশিয়ার। অথচ দাদা যখন বাড়ি থাকে না, দাদার অসাক্ষাতে বৌদি ফেরিওয়ালা ডেকে ডেকে কত পয়সা নষ্ট করে, কত টাকা ঠকে।
ওদের এই নতুন বাড়িটিতে আসার পর থেকেই যেন, ওদের দুটো জিনিষই বেড়েছে।
দাদার ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, আর বৌদির ঘর সাজানো। এই পাড়ায় সবাই বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, এসেই সেটা আবিষ্কার করে ফেলেছে বৌদি। এবং সকলের তালে তাল মিলিয়ে চলবার সাধনা করছে। অবশ্য মাঝে মাঝেই তাল ভঙ্গ হয়।
দাদা হঠাৎ হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলে বাড়িতে বেশ কিছু নতুন জিনিষ আমদানি হয়েছে, দাদা তখন প্রশ্ন করে, ‘এসব আবার কোথা থেকে এলো?’
বৌদি জিনিসগুলোকে ‘উপহার’ পেয়েছি বলে চালাতে চায়, কিন্তু এতো উপহারই বা দিচ্ছে কে রমলাকে?
অতএব মিথ্যে কথাটা ধরা পড়ে যায়।
দাদা পরম ক্ষমার মুখে বলে, ‘যা করেছো, করেছো, আর যেন না হয়। পয়সা জিনিসটা নষ্ট করার জন্যে নয়। বাড়ির পেছনে কত ধার হয়ে গেছে।’
আর এতেই বোধ হয় বৌদির মান সম্মান বেশী আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এর থেকে যদি অবনী রাগারাগি করতো, ছিল ভালো।
তা জগতে কি আর সবকিছুই ভাল হয়?
এই তো অভীকের আজ লেখাটা শেষ করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু হল না। এই ছুটির দিনের দুপুরে হঠাৎ অভীকের মাথার মধ্যে কাঁচ ভেঙে পড়ার ঝনঝন শব্দ পাক খেতে লাগলো।
এত শব্দয় কি লেখা হয়?
কলম টলম তুলে ফেলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অভীক।
এত দুপুর রোদে বেরোনোর মানে হয় না, তবু এমন মানে হীন কাজ অভীক বরাবরই করে। লিখতে লিখতে মন না লাগলেই কলম তুলে রেখে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তা সেটা সকাল সন্ধ্যে দুপুর বিকেল যাই হোক।
এখন অবশ্য দুপুরগুলো সীমিত।
কেবলমাত্র ছুটির দিনটাতেই ‘দুপুরে’র স্বাদ।
যদিও সদ্য কলেজ জীবনে, যখন সবে দু’ চারটে লেখা ছাপা হচ্ছে এবং অপ্রত্যাশিত প্রশংসা জুটেছে, তখন অভীকের স্বপ্ন ছিল, চাকরী ফাকরীর দিকে যাবে না, শুধু লিখবে। ‘কায়মনবাক্যে’ সাধনা না করলে সত্যিকার ভাল লেখা তৈরী হয় না।
কিন্তু ছাত্র জীবন শেষ করে বাস্তবভূমিতে পা দিয়ে দেখলো, ওই স্বপ্নটা নেহাৎই অবাস্তব স্বপ্ন।
পায়ের তলায় একটা মাটি থাকা; আবশ্যক। ওটা থাকলে আকাশের দিকে চোখ তোলা সহজ হয়।
অভীক একটা চাকরী জোগাড় করে ফেললো।
কফি হাউসের আড্ডার বন্ধুরা অভীকের এই ‘শোচনীয় পরিণামে’ রীতিমত আহত হয়েছিল, বলেছিল ”আর কিছুটা দিন ধৈর্য্য ধরে দেখা উচিত ছিল। তোর ওই লেখা থেকেই শুধু জীবিকা কেন, গাড়ি বাড়ি সব হতো। এ একেবারে লেখার বারোটা বেজে গেল।”
‘বারোটা বেজে যাবার ভয়টি একেবারে যে ছিল না তা নয়, তবু অভীক সংকল্পে স্থিরই রইল! তখন তো ‘প্রোডাকশান’ কম, চাহিদার শুরু মাত্র! মাঝে মাঝে কিছু গলদ কি দু’ একটা ছোট উপন্যাসের জন্য দক্ষিণা, এই! নির্দিষ্ট কিছু নেই।
নিজেকে কেমন বেকার বেকার লাগতো।
একটা চাকরীতে লেগে থাকা গৌরবের না হলেও সৌষ্ঠবের।
পরে দেখলো, সৌষ্ঠব থেকেই স্বস্তি। আর স্বস্তি থেকেই অনুশীলনের স্থিরতা!.. কফি হাউসের উদ্দাম আড্ডার মধ্যে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গী, অনেকের চিন্তাধারা, এবং অনেকের বক্তব্য যুক্তি আর ভঙ্গী মনে প্রবল ঢেউ তুলতো, ‘নিজের কথা’ প্রায়শঃই ঝাপসা হয়ে যেত।
দেখছে সেই ঝাপসা পর্দাটি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, অনুভূতিতে আসছে স্বচ্ছতা, আসছে স্বকীয়তা!
মাঝে মাঝেই অনুভবে আসছে। ‘পৃথিবী নামক ঠাঁইটাতে কেবলমাত্রই যে জ্বালা আছে, যন্ত্রণা আছে, অন্যায় আর অবিচারই আছে তা নয়, সেখানে রং আছে, রূপ আছে, স্বাদ আছে, ভালবাসা আছে, এবং ‘মানুষ’ ও আছে।
এই মানুষগুলিই গল্পের প্লট।
লেখার প্রেরণা।
আরো একটা জিনিস অনুভবে এসেছে, লেখার জন্যে ‘অনেক অবকাশে’র দরকার হয় না। বরং অবকাশের প্রাচুর্য্যই লেখার শত্রু।
অবকাশ নিশ্চিন্ততার সুখ দেখিয়ে অলস করে তোলে। হয়তো ব্যতিক্রম আছে, সত্যিকার সাহিত্যসাধকরা হয়তো প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে পারেন। অভীক পারতো না।
অভীকের অনেক সময় অপব্যয় হতো।
সকাল থেকে আড্ডা দিতে দিতেই ‘বারোটা বেজে যেত’।
এখন রোদের দুপুরটা আটকে থাকতে হয় বলে ভোরের সকালটা কাজে লাগাচ্ছে (যেটা আগে আদৌ হয়ে উঠতো না), আর সপ্তাহে একটা মাত্র ছুটির দুপুর বলে সেটাকে পরম মূল্যবানের পর্যায়ে ফেলছে।
‘সময়’ জিনিসটা যে এমন মূল্যবান বস্তু এটা কি টের পেতো অভীক? জানতো—সকালের পর দুপুর আছে আবার, দুপুরের পর বিকেল। আর তারপর সন্ধ্যা এবং রাত্রি।
এখন সেটা নেই বলে; মাত্র ‘একটুখানি আমার’ বলে, সেইটুকুকে যত্নে সাবধানে খরচ করতে মন হয়।
তবু ওই অভ্যাসটি রয়ে গেছে।
লিখতে লিখতে মুড চলে গেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া!
ঘড়িটা দেখলো।
মাত্র দুটো কুড়ি!
চায়ের আগে চলে আসা যাবে! তা হলে বৌদির অভিযোগের মুখে পড়তে হবে না!
বৌদি অভীকের থেকে বড় জোর বছর আষ্টেকের বড়, কিন্তু এমন এমন ভাবে শাসন চালান যে মনে করা যেতে পারে বৌদিই শৈশবে মাতৃহীন দেবরটিকে মানুষ করেছেন! অক্লেশে—ই ‘তুই’ করে কথা বলেন এবং সমস্ত গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন!
অভীক যখন তীব্র প্রতিবাদ জানায় একজন লোককে এভাবে পাহারা দিয়ে রাখা অন্যায় অসঙ্গত, তাতে তার চিন্তার বিকাশে বাধা আসে, রমলা অনায়াসে বলে, ‘তোকে ‘লেখক’ হতে কে মাথায় দিব্যি দিয়েছিল?’
‘ধর আমার জন্ম নক্ষত্র।’
‘তাহলে ধরে নে এই একখানি দজ্জাল ‘শাসিকা’ও তোর সেই গ্রহনক্ষত্রের অবদান।’
অভীককে অতএব হেসে ফেলতে হয়। তবে সেও শাসিয়ে রাখে, ‘দেখো একদিন তোমাদের এই খাঁচার শিক কেটে উড়ে পালাবো!’
‘তার আগে একখানি ইস্পাতের তৈরী মজবুত খাঁচায় ভরে ফেলা হবে লেখক মহোদয়কে। ভারী আমার লেখক রে।’
তা এক হিসেবে তাই।
লেখক নামের অযোগ্যই অভীক।
তা নইলে এই সাতাশ আটাশ বছর বয়েস পর্য্যন্ত এমনি বসে থাকে? একটা, প্রেমে পড়তে পারে না?
অথচ ওর বন্ধু স্মরজিৎ?
যে নাকি আবার অভীকের থেকে বয়সে খানিকটা ছোটও। স্মরজিৎ অন্ততঃ বার আষ্টেক দশ প্রেমে পড়েছে।
তেরো বছর বয়েস থেকে প্রেমে পড়ে আসছে স্মরজিৎ।
ছ’ ছমাস অন্তরই স্মরজিৎকে নতুন বান্ধবীর সঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়, এবং তার কাছ থেকে ‘নতুন প্রেমের’ গল্প শোনা যায়। প্রত্যেকবারই স্মরজিৎ বলে, ‘নাঃ ভাই, এতদিনে বুঝলাম…এযাবৎ কী ছেলেখেলাই করেছি। রাংকে সোনা ভেবে আহ্লাদে বিগলিত হয়েছি। এই প্রথম বুঝছি—সোনা কাকে বলে! প্রেম কী বস্তু!’
অভীক ওকে ওর নামটা নিয়ে ক্ষ্যাপায়।
বলে ‘স্মরজিৎ ও বলে, ‘তোর নামটাই বা কোন সার্থক? অভীক মানে কী? নির্ভীক না? অথচ বছর আষ্টেক দশ ধরে শুধু বানানো প্রেমের গল্পই লিখে চলেছিস, নিজের একটা প্রেম বানিয়ে তোলবার সাহস হল না। মেয়ে ফেয়েগুলো কি তোর জগতের ছায়া মাড়ায় না?’
অভীক হাসে।
বলে,—’মেয়ের মত মেয়ে বোধহয় মাড়ায়নি।’
‘ওই আশাতেই থাকো বন্ধু। দূরে থেকে যাকে ‘মেয়ের মত মেয়ে মনে হবে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেই দেখবে সেও আর পাঁচটা মেয়ের মতই স্রেফ মেয়ে।’
‘তা’ হলে তো যতদিন না ছুঁয়ে দেখা যায় ততদিনই লাভ।’
‘লাভের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সুখ।’
‘সেটাই বা কম কী?’…
‘দূর দূর কোনো মানে হয় না। আমি তো বাবা বুঝি মেয়ের মত মেয়ে যখন সোনার পাথরবাটি, তখন যেমন তেমনই একটা জুটিয়ে নিয়ে একটু লাট খাটিয়ে বেড়াই। হোক ক্ষণিক, হোক সাময়িক, তবুতো জীবনে কিছুটা রস আসে?
‘তোর জীবন দর্শনটা ভাগ্যিস ছোঁয়াচে রোগ হয়। হলে সমাজের বিপদ হতো।’
‘সমাজ।’
স্মরজিৎ একটি মুখভঙ্গীর সাহায্যে ‘সমাজ’ শব্দটাকে স্রেফ নস্যাৎ করে দিয়ে বলে, ‘সমাজ ধুয়ে জল খেগে যা। আমি তোদের ওই পচা সমাজের ধার ধারি না। আমার যা ভাল লাগে আমি তা করবো। আনন্দই আমার একমাত্র লক্ষ্য।’
‘কিন্তু তুই যে ওই এক ডাল থেকে আর এক ডালে বিচরণ করে বেড়াস, লাফ দেবার সময় আগের ডালটা ভেঙে পড়ে গেল কিনা দেখিস তাকিয়ে?’
অত দেখতে গেলে চলে না ব্রাদার? তা’ হলে তো জীবনে একটা বৈ দুটো প্রেম হয় না। যেটাকে দেখতাম, তার সঙ্গেই সারাজীবনের মত নিজেকে জুড়ে দিতাম। রাবিশ! তবে খুব বেশী ভয় করিস না, ভেঙে গুঁড়িয়ে টুড়িয়ে যায় না। মেয়ে গুলোই কি কম চালু? বিয়ের প্রতিশ্রুতি আদায় না করে একটু ইয়ে মানে বেশী ঘনিষ্ঠতা করতে দেয় না। কে বাবা দিয়ে বসবে সে প্রতিশ্রুতি? তবে যাও কেটে পড়।
স্মরজিৎ কথা থামিয়ে মাঝে মাঝে মিটি মিটি হাসে।
বলে, ‘তবে আমার থেকেও মস্তান মেয়ে আছে রে ভাই। তাদের দুঃসাহস আর কলা কৌশল দেখলে আমিই হাঁ হয়ে যাই। সত্যি বলতে ও রকম মেয়েও আমার ভালো লাগে না। দেখে শুনে বাৎ মারি।’
‘খুব মহৎ কাজ করো।’
স্মরজিৎ বলে, ‘তা তখন আমি তাই ভাবি।…আমি নিজে পাজী তা জানি, কিছু পাজী পাজী সঙ্গীও যে নেই তা নয়, কিন্তু পাজী মেয়ে আমার বরদাস্ত হয় না।’
‘তার মানে তোমার বাসনা ভালো ভালো সৎ সরল মেয়েগুলিকে গোল্লায় দিয়ে তুমি সরে পড়বে আবার নতুন সুখের সন্ধানে।’
‘দেখ অভীক, ওই ‘গোল্লায়’ শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে। ওই জন্যেই পাজী মেয়েদের সহ্য করতে পারি না আমি।’
‘ওঃ তার মানে তুমি শুধু স্বর্গীয় প্রেমের স্বাদ দেখে দেখে বেড়াও।’
‘ঠিক তাই।’
স্মরজিৎ হেসে ওঠে, ‘অতএব সেই সৎ সরল ভালো ভালো মেয়েগুলি যথাসময়ে ভালো ভালো লাভের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সৎ সরল বৌটি হয়ে চলে যায়। হয়তো অশ্রুজল একটু বেশী পড়ে। দীর্ঘশ্বাস একটু বেশী ওঠে।…তা ওটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। তাছাড়া ‘ব্যর্থ প্রেম’ জীবনের একটা সম্পদ বুঝলি?’
‘বুঝলাম না।’
‘দূর দূর। তোকে ওই লেখক হওয়াটা আদৌ মানায় না।…ওই যে অবকাশ সময়ে একটু দীর্ঘশ্বাস, বিশেষ কোনো মুহূর্তে একটু বাষ্পোচ্ছ্বাস, এইটিই হলো কী বলবো—যাকে বলে স্ত্রী ধন। বুঝলি? এই তো দেখনা, আমি প্রথম প্রেমে পড়ি আমার মাসতুতো বোনের। সেজমাসির মেয়ে মনে হয়েছিল এই বোধহয় সেই জন্ম জন্মান্তরের ব্যাপার। আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি প্রবল প্রাণের স্রোতে, অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে।…আমার বয়েস তেরো, নীলার সাড়ে তেরো। মামার বাড়িতে একটা বিয়ে উপলক্ষ্যে গিয়ে দশদিন থাকার সূত্রে প্রণয় গভীরতর হলো, দুজনে প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, সমাজ যখন আমাদের অনুমোদন করবে না, তখন সমাজের মুখে চুণকালি লেপে আমরা হয় পালাবো নয় মরবো।…তারপর? তারপর কিনা নীলা বিয়ের কিছুদিন পরেই আমার সামনে ওর বরকে সেই কথাগুলো বললো হি হি করে। আবার বললো কিনা এই স্মরজিৎ বাজে কথা বলিস না, ভুলে গেছিস বৈ কি। খুব মনে আছে। বলে জীবনের প্রথম প্রেম।’…আমি তখন সেকেণ্ড ইয়ারে উঠেছি। আমার যে একটা মান মর্যাদা আছে, তা ভাবলোই না। এখনো—এই সেদিনও হেসে হেসে বললো, তোর মনে আছে স্মরজিৎ, সেই আমাদের ছাতের কোণে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে থাকা?’…
‘…তার মানে নিজেই মনে রেখে দিয়েছে। তা বলে কোনো কিছুতে ঘাটতি আছে তা মনে কোরোনা। সুখের সাগরে ভাসছে।’
‘মনে হচ্ছে তোর ওই মাসতুতো বোন দুঃখের সাগরে ভাসলেই যেন তোর শান্তি হতো।’
‘পাগল। তারপরে বলে কতো এলো, কত গেলো। আমার বাবা যায় তো যায়ই, মেয়েগুলো সেই যাওয়া জিনিষের ভগ্নাংশটুকু রেখে দেয়। তা’ ওদের কথা বাদ দে। ওরা ভাঙা কাঁচের চুড়িও বাক্সে তুলে রেখে দেয় বেশ সুন্দর দেখাত বলে, একদা ওর হাতটা সুন্দর দেখতে হয়েছিল বলে। মাঝে মাঝে কারুর সঙ্গে দেখা হয়, স্বপ্না বিশ্বাস, মাধবী রক্ষিত, শিবানী রুদ্র, শ্যামলী ঘোষ, এরাতো কলকাতাতেই থাকে? অজন্তা অবশ্য আমেরিকায় চলে গেছে, রেখা বোস বম্বেয়। তা এদের সঙ্গে দেখাটেখা হলে দিব্যি একটি গাল হেসে বলে, কী স্মরজিৎ, কী খবর? এখনো বিয়েটিয়ে করনি? তেমনি ছেলেমানুষী করে বেড়াচ্ছো?’…কেউ কেউ আবার বাড়িতে ডেকে নিয়ে যেতে চায়, চা খাওয়াতে চায়। দিব্যি অম্লান মুখ অমলিন ভাব।’…
অভীক শোনে, হাসে।
জানে এই পাখি যখন নীড়ে বসবে, তখন ডানা ঝাপটানো তো দূরের কথা পালকও নাড়বে না। বুড়িয়ে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। ….দিব্যেন্দুর কথা মনে পড়ে।
কী ঝটপটানিই করেছে একদা।
বিয়ে সম্বন্ধে কী নতুন নতুন থিওরি তার।
তারপর?
তারপর একটি মোটাসোটা কালোকালো মেয়েকে যথারীতি নাপিতে পুরুতের বিয়ে করে ফেলে যাকে বলে সুখে স্বছন্দে ঘরকন্না করছে। সকালে থলি হাতে বাজারে যায়। মেয়ের জন্যে ‘খাঁটি দুধ’ জোগাড় করতে গোয়ালা বাড়ি যায়। হপ্তায় হপ্তায় মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়িতে জমা দিয়ে বৌকে নিয়ে সিনেমায় যায়, আর তাকে মাসে মাসে ব্লাউজ পীস কিনে দেয়। একেবারে আদর্শ পিতা, আদর্শ পতি!
দুপুর রোদে রাস্তায় বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎই এইসব বন্ধুদের কথা মনে পড়লো অভীকের।
স্মরজিৎ নাকি এখন বিভাসের বৌটাকে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে এন্তার বেড়াচ্ছে। সেদিন জোসেফ বলছিল। হেসে বলছিল জোসেফ, ‘গাড়ি একখানা থাকলে, আর নিজে মানিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারলে অনেক মাছরাঙাকে জালে ফেলা যায়। গাড়ি আর শাড়ি এই দুটি জিনিষ মেয়েদের হৃদয় জয়ের অস্ত্র।’
এই খবরটা পছন্দ হয়নি অভীকের।
আবার বৌ টৌ কেন?
বিভাসের সংসারে একটা অশান্তি টেনে আনা। কে বলতে পারে যে সে অশান্তি ‘দিনের খাতা’ থেকে জীবনের খাতায় উঠে পড়বে কি না। বিয়ে না হওয়া মেয়েদের তুমি তোমার ওই রাজপুত্তুর মাফিক চেহারা আর হীরো হীরো ভঙ্গী এবং দরাজ পকেটের টোপ ফেলে, ছিপে গাঁথ গে যাও, কারো বিবাহিতা স্ত্রীকে কেন?
বিভাস অবশ্যই ফ্যাসানের খাতিরে প্রথমটা উদারতা দেখাবে, কিন্তু শেষরক্ষা হবে কি?
মনে পড়ে গিয়ে ভাল লাগলো না।
আরো কতদূর কী এগোচ্ছে কে জানে।
অভীকের কি কিছু বন্ধুকৃত্য ছিল?
অভীক কী একদিন যাবে বিভাসের বাড়ি?
কিন্তু গিয়েই বা কী?
বিভাসের বৌ বিভাসের বন্ধুর গাড়িতে মার্কেটিং করতে যাচ্ছে, এবং হয়তো সে বন্ধু সৌজন্য দেখাতে তাকে তার বটুয়ার মুখ খুলতে দিচ্ছে না। এই তো। এর বেশী কিছু জানবার তো কথা নয়।
এইটার ওপর ভর করে কি বিভাসকে সাবধান করতে যাবে অভীক?…আগুন আর পতঙ্গ যে যার নিজের ধর্ম পালন করবেই।
নিজের বোকামী ভেবে একটু হেসে বাড়ি ফেরার পথ ধরলো অভীক। ফিরেই চটপট চা খেয়ে নিয়ে লেখাটা শেষ করে ফেলবে।
কিন্তু দরজার কাছেই যে এমন একটা বাধার সম্মুখীন হতে হবে কে জানতো।
অভীকদের অর্থাৎ অবনীর এই নতুন বাড়ির একতলা দোতলা দুটোই ভাড়াটে কবলিত। মাত্র তিন তলাটাই নিজেদের ব্যবহারে আছে। অবনীর মতে বাড়ির ধার শোধ করে ফেলে দোতলার ভাড়াটে তুলে দেবে। বাড়ি মেনটেনেন্সের খরচ তুলতে ওই একতলার ভাড়াটে রেখে দেবে।
রমলা বলেছিল, ‘একবার যে ঢুকছে, তাকে আর তুমি তুলতে পারবে?’
অবনী হেসেছিল, ‘বুঝেসুঝেই ভাড়াটে যোগাড় করেছি। বদলীর চাকরী, নিজে থেকেই চলে যাবে।’
আপাততঃ তারা আছে।
অভীকদের নিজেদের ‘গৃহপ্রবেশের’ দরজাটি হচ্ছে পাশের প্যাসেজ দিয়ে?…সিঁড়িতে উঠতে উঠতে দোতলা বাসীদের সঙ্গে কখনো মুখোমুখি হতে হয়, কখনো নির্জনই থাকে।
একতলার সঙ্গে মুখ দেখাদেখির অন্ততঃ অভীকের কোনো প্রশ্ন নেই।
আজ ওই প্যাসেজটার মুখেই বাধা।
‘কী রকম বাড়ি আপনাদের? কলে জল পড়ে না।’
অভীক চমকে ওঠে।
অভীক যে শব্দটাকে মাথা থেকে তাড়িয়ে ফেলে নিশ্চিন্ত হয়ে গল্পটাকে শেষ করবে বলে তাড়াতাড়ি যাচ্ছিল, সেই শব্দটা আবার এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো অভীকের অনুভূতির নার্ভগুলোর ওপর!
সেই কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ!
অভিযোগের ঝঙ্কার তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কিন্তু অভিযোগটা কী?
কেন? কে এ?
অভীকদের বাড়িতে কলে…জল পড়ে না?
এ আবার কেমন কথা? এইতো একটু আগে বেরোবার আগেই কলের জলে হাত মুখ ধুয়ে গেছে অভীক।
জলটা খুব গরম লেগেছিল।
পাম্পের জল তো, রিজার্ভারের গায়ে রোদ লাগে।
কিন্তু অভিযোগতো জলের গরমত্ব নিয়ে নয়। জলবিহীনতা নিয়ে।
অতীতের এইটুকু অনুপস্থিতির মধ্যেই বাড়িতে কী এমন ওলট—পালট হয়ে গেল, যে এই মহিলাটি—তা মহিলাই বলা উচিত, চেহারায় সে ভারভারীত্ব না থাক, মাথায় যখন সিঁদুর রয়েছে। সে যাক মহিলাটি এসে ‘জল নিয়ে’ তম্বি করতে বসলেন অভীককে?
জলটা গেলই—বা কখন?
অভীক দিশেহারা হয়ে বলে, ‘দেখুন আপনার কথা আমি তো ঠিক বুঝতে পারছিনা।’
বুঝতে পারছেন না?’
মহিলাটি একবার অভীকের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনি অবনীবাবুর ভাই নয়?’
‘নিশ্চয়! কিন্তু তা’তে কী?
‘তাতে আর কি। আপনি যদি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে কিছু বুঝতে পারছি না বলেন, আমার কিছু বলার নেই। অবনীবাবুকেই বলবো।’
অভীক আরো বিমূঢ় হয়।
কোনো ভাড়াটেই মনে হচ্ছে।
কিন্তু কোনখানের?
এ বাড়ির একতলা দোতলা দুটো ফ্ল্যাটেই তো—অভীক যতদূর জানে—ভাড়াটে আছে। তাহলে?
আরো কোথাও ফ্ল্যাট আছে নাকি দাদার? থাকলে অভীকের অজানা থাকতো? তাছাড়া—এই মহিলাটি কি নিজেকে ‘অজানা’ থাকতে দিতেন?
ওঁর এই কাঁচের গেলাস ভাঙ্গার ঝনঝনানি তোলা কণ্ঠস্বর, আর এই দৃপ্ততপ্ত মেজাজ, এতো অজানা থাকার কথা নয়।
নাঃ। অভীকের কর্ম নয় অনুমান করা—ইনি কে?
অভীক অতএব আবার সেই একই কথা বলে, আরো বিনীতভাবে।
‘দেখুন আপনি অকারণ রাগ করছেন। সত্যিই আমার পক্ষে কিছু বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। দাদার মানে অবনীবাবুর যে আর কোথাও কোনো ফ্ল্যাট আছে, আমার জানা নেই।’
‘আর কোথাও! আর কোথাও মানে?’
শ্যামলাঙ্গী সুন্দরী পড়ন্ত রোদের আঁচে এবং রাগের আঁচে রক্তাভ হয়ে ওঠেন, ‘কী বলছেন আপনি, আমারও তো বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। আপনি এই বাড়িতেই থাকেন, না অন্য কোথাও?’
এধরনের অভিযোগ নিয়ে যদি কোনো হতভাগ্য পুরুষ এভাবে কেটে পড়তো, আর এরকম প্রশ্ন করতো, তাহলে অভীক কিছু আর উত্তর দেবার জন্য—দাঁড়িয়ে থাকতো না। নিশ্চয়ই উপেক্ষা ভরে মাপ করবেন আমি কিছু জানিনা। বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেত।
কিন্তু পরিস্থিতি আলাদা।
অভিযোগকারিনী একটি বিদ্যুৎ শিখার সঙ্গে তুলনীয় মহিলা।
গায়ের রং অবশ্য শ্যামল।
অনেকটা সদ্য চারা গাছের কচিপাতার মত উজ্জ্বল শ্যামল। তবু ‘বিদ্যুৎ শিখা’ শব্দটাই মনে এসে গেল অভীকের।
ওর কপালে এসে পড়া ঝরো চুল গুলো কাঁপছে, ওর চোখের পাতা দুটোর আগায় ঝিরঝির করা বড় বড় পল্লব গুলো কাঁপছে, আর ওর বুকের ওপরকার পাতলা শাড়ির আচ্ছাদনটুকু ভেদ করে দেখা যাচ্ছে লাল টুকটুকে ব্লাউজটাও কাঁপছে।
অভীকের এই উল্টোপাল্টা সময়ে ও হঠাৎ মনে হলো শাড়িটা কী পাতলা। শুধু ওই লাল টুকটুকে ব্লাউজটাই নয়। ওর নীচের জালিকাটা কাজ করা সায়াটাও দেখা যাচ্ছে সেলাই সমেত।
প্রিণ্টেড শাড়ি। কিন্তু কী শাড়ি? অভীক কি বলে উঠবে, ‘আপনি এতো পাতলা শাড়ি পরে রাস্তার ধারে বেরিয়ে এসেছেন কেন? একজন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে নেমেছেন কেন? যান একটা ভালমত শাড়ি পরে আসুন।’
না। বলে ওঠেনি। অভীক আপাততঃ এই অভিযোগের আক্রমণে হঠাৎ বেকুব বনে গেলেও, সত্যি কিছু আর বেকুব নয়।
অভীক এরকম ‘জল শাড়ি’ ‘হাওয়া শাড়ি’ পরা মেয়ে যে রাস্তায় হরদম দেখছে না তাও নয়।
তখন যে সহসা এমন চোখে ঠেকলো। মহিলার শাড়িটা এলোমেলো করে জেরার ভঙ্গী দেখে। মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধ করে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মেয়েটা দেখতে আকর্ষণীয় তাতে সন্দেহ নেই।
অভীক অন্যদিকে তাকিয়ে খুব মার্জিত গলায় বললো, ‘হ্যাঁ, এই বাড়িতেই থাকি।’
‘বাড়ির কোন খবর রাখেন না বোধহয়?’
অভীক সেইভাবেই বললো, ‘খুব বেশী নয়।’
‘খুব বেশী কেন, আদৌ নয়। আপনাদের এই ফ্ল্যাটে কখন কে চলে যাচ্ছে, আর কখন কে আসছে আপনি জানেন?’
পড়ন্ত বেলায় সেই চির কাব্যময় কনে দেখা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে আকাশের পটে, বৈশাখের বিকেলের বাতাসও চঞ্চল।
উড়ন্ত আঁচলটাকে টেনে কোমরে জড়ানো মেয়েটা। অথবা বৌটা।
অভীক আরো ভদ্র বিনীত গলায় বললো, ‘বোধহয় জানি না। একতলায় এস দাশগুপ্ত, আর দোতলায় পি চন্দ্র, এই তো আছেন বলে জানি।’
‘ভুল জানেন।’
এইমাত্র কোমরে জড়ানো আঁচলটাকে আবার টেনে খুলে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে মহিলা বলেন, ‘ভুল জানেন। পি চন্দ্র বলে কেউ নেই আর এখন! তাঁরা সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন।’
‘তাই নাকি? আশ্চর্য তো!’
পি চন্দ্রর ছোট্ট মেয়েটাকে মাঝে মাঝে বাসের টিকিট দিতো অভীক। বাসের টিকিট জমানো বাতিক তার।
সক্কলের কাছে নেয়। গোছা গোছা টিকিট রবার ব্যাণ্ড দিয়ে আটকে রেখে দেয়।
চলে গেছে ওরা।
অভীক তো কই দেখতে পেলো না।
সকালবেলা কোথায় ছিল অভীক?
ওঃ। সকালবেলা দমদমে গিয়েছিল অভীক। বারীন কানাডা যাচ্ছে বলে তুলে দিতে গিয়েছিল।
পি চন্দ্রর পুরো নামটা ঠিক জানে না অভীক, প্রভাত না প্রমথ কী যেন। কিন্তু মেয়েটার নাম জানে, প্রমিতা।
অভীক বলতো, ‘তুমি এইটুকুন মেয়ে তোমার এতবড় নাম কেন?’
ও বলতো, ‘বাঃ আমি বুঝি বড় হবো না? তখন আমি একটা মস্তবড় নাম কোথায় পাবো? মার যা দশা হয়েছে তাই হবে। মা যখন ঠাকুমা হয়ে যাবে তখনও সবাই মাকে টুনু বলবে। টুনু চন্দ্র।’
শিশুর সঙ্গে টেপ রেকর্ডারের তুলনা করা যায়। যা কানে শোনে, তাই গলায় তুলে নেয়।
মেয়েটা চলে গেল!
‘আশ্চর্য তো!’
সামনের মহিলাটি বোধহয় অভীককে বেশ ভাল করেই অবলোকন করছিলেন। ওই আগের ভাড়াটেরদের চলে যাওয়াটা যে এনার জানা নেই তা বোঝা যাচ্ছে। এবং ওই চলে যাওয়াটা যে একটি অপ্রত্যাশিত আঘাত হেনেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
ব্যাপারটা কী?
কোন প্রণয় ঘটিত ব্যাপার ছিল নাকি? আর সেই জন্যেই এনার অজানতে এবং অসাক্ষাতে আসামী পাচার করা হয়েছে?
এটা ভেবে নিয়ে বোধহয় বেশ কৌতুক বোধ করে সে।
তথাপি গম্ভীরভাবে বলে, ‘আশ্চর্যটা আপনার না হয়ে আমারই হবার কথা। আপনি এই বাড়িতেই থাকেন বলছেন, অথচ টের পেলেন না ভাড়াটে বদল হয়ে গেল। পি চন্দ্র—রা সকালে চলে গেছেন। আমরা এই দুপুরে এসেছি। মিষ্টার এ্যাণ্ড মিসেস বোস। ওঁরা আমাদের একটু আত্মীয় মত। এ ফ্ল্যাটের খবর ওঁরাই দিয়েছিলেন। অবশ্য বদলটা খুব আকস্মিক হয়ে গেল। ফ্ল্যাটটা ভালো। কিন্তু এসে পর্যন্ত এক ফোঁটা জল পাইনি তা জানেন?’
অভীক ওই রুষ্ট ক্ষুব্ধ এবং গ্রীষ্মতপ্ত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে বোকার মত বলে ফেলে, ‘কেন?’
‘কেন?’
মহিলা আশ্চর্য রকমের শান্ত হয়ে গিয়ে বলেন, ‘সেটা আপনি আমায় জিগ্যেস করছেন?’
অভীক নিজের এই বোকামীতে নিজের ওপর রেগে যায়।
খেয়াল হয় আগাগোড়াই বোকা বোকা কথা বলেছে সে।
এবারও অবশ্য ওই বোকাটে কথাই বলে।
তাছাড়া আর কী বলার ছিল?
বললো, ‘আচ্ছা আমি বৌদিকে জিগ্যেস করে—’
‘আপনার বৌদিকে? মানে অবনীবাবুর স্ত্রী রমলা দেবীকে? আপনার কি ধারণা ওই জিগ্যেস করাটা আপনার অপেক্ষায় রেখে দিয়েছি?’
‘ওঃ। জিগ্যেস করেছেন? কী বললেন?’
‘বলবেন আর কী?’
মহিলা দু’হাত উল্টে হতাশার ভঙ্গী করে বললেন, ‘মহিলা জনোচিত কথাই বলেছেন। …পাম্পে জল না উঠলে তিনি আর কী করবেন।
পাম্পে জল উঠছে না। তিনি আর কী করবেন।
কিন্তু অভীকই বা কী করবে?
অভীকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
এ হেন দুর্ঘটনা সংসারে আরো ঘটে কিনা, এবং ঘটলে কী করতে হয় তা জানা নেই অভীকের।
দাদা তাকে ডিসটার্ব করতে চায় না।
অভীক জানেনা, বাড়িতে কে বাজার করে,…কখন বাজার করে, রেশন আসে কী প্রকারে। সংসারে আরো কী লাগে না লাগে, কিছুই জানা নেই অভীকের।
কখনো কোনো সময় বৌদি কোন কাজের ভার দিতে চান, দাদা বলে ওঠে, আচ্ছা ওকে আবার এসব নিয়ে ডিসটার্ব করছো কেন?
অবনী তার ছোট ভাইয়ের লেখা কোন দিন পড়েছে কিনা জানে না অভীক অন্তত দেখেনি পড়তে; কিন্তু ভায়ের লেখা সম্পর্কে অবনীর খুব সমীহ।
এখন অভীকের মনে হলো। দাদার এই মমতাটি অযাচিত।
কিছু কিছু জানতে দেওয়া উচিত।
পাম্পের জল না উঠলে কোথায় গিয়ে মিস্ত্রী ডাকতে হয় রে বাবা।
‘থাক ঠিক আছে—’
মহিলাটি হঠাৎ পাক খেয়ে ঘুরে বলেন, আপনাকে আর ভেবে কাতর হতে হবে না। দেখে মনে হচ্ছে এই সংসারে যন্ত্রপাতি কলকব্জা এরা যে মাঝে মাঝে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে এ খবর আপনার জানা নেই। এবং আপনি বাড়িতে থেকেও নেই, কবি টবি নাকি?
—তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যায়। দরজাটা বন্ধ করার শব্দ হয় দড়াম করে।
অভীক ওঠে, আস্তে ধীরে সুস্থে।
রমলা চায়ের টেবিলের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল, অভীককে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘বেশ তো ঘরে বসে লেখা টেখা করছিলি, হঠাৎ কখন বেরিয়ে গেলি? আমার এদিকে কী যন্ত্রণা!’
যন্ত্রণাটা যে কী, অভীকের বুঝতে দেরী হয় না। তবু ভালমানুষের মত মুখ করে বলে, ‘কীসের আবার যন্ত্রণা হল তোমার? পেটের? না মাথার?’
‘পেটের? মাথার?’
রমলা নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, ‘ওসবের নয়, আসলে এই কপালের। যাকে বলে ললাটলিপি। তা নইলে দোতলার ফ্ল্যাটে নতুন একটা ভাড়াটে এলো আজ, আর আজই পাম্প খারাপ? ওপরে এসে যাচ্ছেতাই করে গেল আমায়।’
‘যাচ্ছেতাই করে গেল? মানে?’
অভীক চমকে দাঁড়িয়ে ওঠে।
‘আরে বাবা ওই ওই! সত্যি কি আর যাচ্ছেতাই? মানে জলের অভাবে ওর কী কী কষ্ট হচ্ছে সেটাই বেশ বিশদ করে জানিয়ে বলে গেল, ভাড়াটে ঢোকার আগে বাড়িওয়ালার নাকি এগুলো চেক আপ করা উচিত।’
অভীকের মাথার মধ্যে এখনো যেন সূক্ষ্ম সুরে একটা কাঁচের গেলাস ভাঙার শব্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তবু অভীক জোর দিয়ে বললো, ‘কথাটথা বলার ধরন খুব খারাপ মহিলার।
‘ওমা! তুই জানলি কী করে?’
‘এই তো—আসছিলাম যখন, বেশ একপালা হয়ে গেল।’
‘তোকেও বললো তো ওইসব?’
‘ঠিক ওইসব বলেননি? তবে যা বললেন, তাও খুব আরামদায়ক নয়।’
‘দেখছিস তো, এক ফোঁটা মেয়ে, কী মুখ।’
অভীক ভুরু কুঁচকে বলে, ‘একফোঁটা না কি? বেশ তো বড়ই মনে হল।’
‘এমন কিছু না। ভদ্রলোক তো তোর দাদার থেকে কমবয়সী।’
‘তার থেকেই তোমরা ক্যালকুলেশান করে ফেলতে পারো?’
‘মোটামুটি পারি বৈকি। মেয়েটা বরং তিরিশের নীচে তো ওপরে নয়।’
‘তার নাম এক ফোঁটা!’
অভীক হেসে ফেলে।
‘তিরিশ বছরের মহিলাকে তোমার একফোঁটা বলে মনে হয়? তোমার বয়েস কতো?’
‘আমার? আমার বয়েসের গাছ পাথর আছে না কি?’
‘তা বটে।’
অভীক তাকিয়ে দেখে।
কথাটা বলার অধিকার বৌদির আছে। বৌদিকে কোনোদিন সাজতে দেখেছে কি না মনে পড়ে না অভীকের।
ওই চিরকালীন বেশ।
চওড়া পাড় তাঁতের শাড়ি, ঢলঢলে ব্লাউজ, কপালে সিঁদুরের টিপ হাতে একগোছা চুড়ি।
একেই রীতিমত ভারী শরীর, তার সঙ্গে ওই বিরাট চওড়া পাড় শাড়ি, আর ঢিলে জামা রমলাকে দেখলে মনে হয় বেচারা সবসময় হাঁসফাঁস করছে।
রমলাকে ‘গিন্নী’ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।’
‘যৌবন’ নামক হালকা চরিত্রের লোকটা কোনোদিন রমলার ঘরের দরজায় উঁকি মেরেছিল কি না বলা শক্ত।
আর ওই মহিলাটি।
কেন জানি না ওর তুলনাটাই মনে এলো অভীকের।
যৌবন ওকে কোনদিনই ছেড়ে যাবে কিনা বলা শক্ত।
রমলা, ‘মেয়েটাকে বললাম জলতো আমাদেরও নেই। তবে বালতিতে জল ভরা আছে। তুমি গাটা ধুয়ে নাও, তা গ্রাহ্যই করলো না কথা। বললো, শুধু নিজে গা ধুয়ে ঠাণ্ডা হলেই তো হবে না।’
‘খুব অসভ্য তো! কোথা থেকে পেলো দাদা ওদের?’
‘ওইতো আগেকার ওদের কে যেন হয়। ওরাই বলে কয়ে—’
‘আমি জানতাম না—’
অভীক হাসে, ‘জানতাম না, ইতিমধ্যে ভাড়াটে বদল হয়ে গেছে। বেশ বোকা বনে গেলাম।’
‘ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে। যেমন সবসময় আকাশ পানে মন। কেন, সকালে চায়ের টেবিলে বললো না তোর দাদা, চন্দনের আরো—সাতদিন পরে বাড়ি ছাড়ার কথা, হঠাৎ নাকি দিল্লী থেকে টেলিগ্রাম ‘কালই চলে এসো।’
‘কী জব্দ করা বল? তা ওদের সব মালপত্র নাকি নিয়ে যেতেও পারেনি, তাই এদের—আজই আসতে বলে দিয়েছে। …এরা তো একেবারে আলগোছ হয়েই ছিল।—বিনা ঝঞ্ঝাটে এমন একখানা ফ্ল্যাট পেয়ে গেলি। তার কৃতজ্ঞতা নেই। একটু জলের অসুবিধের জন্যে—এই ভাড়াটে নিয়ে কী ভাবে কাটানো যাবে তাই ভাবছি।’
রমলার মুখে চিন্তার ছাপ।
‘মেলামেশা না করলেই হবে।’
‘তাই দেখছি। আমি আবার বাবা তেমন পারিও না। এক বাড়িতে থাকবো, অথচ ভাব করবো না—’
অভীক হেসে ফেলে বলে, ‘তবে তো এই দণ্ডেই পাম্পের মিস্ত্রী ডাকতে যেতে হয়। বল কোথায় সেই দুর্লভের দর্শন মিলবে?’
‘তুই যাবি মিস্ত্রী ডাকতে?’
‘কেন পারি না? আমি এতোই অধম?’
‘অধম কেন বাবা, উত্তম। এসব তুচ্ছ কাজ তোমার জন্যে নয়।’
‘দাদা ওই করে করেই আমার বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। তোমার ওই ‘এক ফোঁটা মেয়েটি’ আমায় অনায়াসে বলে দিলেন, ‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সংসারের যন্ত্রপাতি কলকব্জা যে মাঝে মাঝে খারাপ হয় এ আপনার জানা নেই।’—না না এটা ভারী অন্যায়।’
‘কোনটা অন্যায়? তোর না জানাটা, না ওর ওই বলাটা?’
‘না জানাটাই।’
‘মোটেই না।’
‘রমলা বলে, ‘তোর দাদা বলে, জগতে বাজার করবার, রেশন আনবার, মুচি ডাকবার, মিস্ত্রী ডাকবার লোক অনেক আছে, বই লেখবার লোক কতজন আছে?’
অভীক হেসে ওঠে।
বলে ‘টন টন আছে। এ যুগে অন্ততঃ পাঠকের থেকে লেখকই বোধহয় বেশী।’
‘সবাই তোমার মতন ভাল লেখে?’
‘আমি ভাল লিখি কি ছাই পাঁশ লিখি, জানো তুমি?’
‘আহা একখানাও যেন পড়িনি? যেটা সেই সিনেমা হলো? সেটা আগাগোড়াই পড়েছি। ছবিতে কী বদলে দিয়েছে মা গো। দেখতে দেখতে মনে হল কার বই দেখছি। না পড়লেই হতো!’
‘ওই একটাই পড়েছ তাহলে?’
রমলা হেসে ফেলে বলে, ‘আমি না পড়লেই বা তোর কী? পাঠকের অভাব? আমার কী দশা জানিস? একখানা বই হাতে নিলাম কি জগতের ঘুম আমার চোখে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
‘ভালই করে ওই ঘুমেরা।’
অভীক হাসে, জগতের অনেক গোলমেলে চিন্তার হাত থেকে তোমায় বাঁচায়। চিন্তা ওই মনের কী হবে?
‘তোর দাদার তো এসে পড়বার সময় হলো। এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’
অভীক বৌদির ওই নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখে।
বৌদিকে ভারী সুখী সুখী দেখতে লাগে। সুখী হওয়ার আশ্চর্য একটি ক্ষমতা আছে বৌদির, ভাবলো অভীক, এ ক্ষমতা সকলের থাকে না।
আচ্ছা এটা আসে কোথা থেকে?
এই সুখী হওয়ার ক্ষমতাটি?
বিশ্বাস থেকে? নিশ্চিন্ততা থেকে?
ভালবাসা থেকে?
না কি বুদ্ধির ঘরের ঘাটতি থেকে?
তাই কী? বোকা লোকের তো অভাব নেই সংসারে, সবাই এমন সুখী? সবাই এমন উজ্জ্বল? রমণীর ওই সুখী মুখটা যেন সব সময় জ্বলজ্বল করে।
অথচ বৌদি দাদাকে লুকিয়ে ফেরিওয়ালা ডাকে, দাদাকে লুকিয়ে মহিলা সমিতিতে মোটা চাঁদা দেয়, আর দাদা বুঝে ফেলেছে দেখলে দারুণ চটে যায়। তখন যত ঝাল ঝাড়ে অভীকের কাছে। অনায়াসে বলে, এতো বাঁধাবাঁধির মধ্যে বাঁচতে পারে মানুষ? আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
আবার তখুনি বৌদি সে ইচ্ছে সংবরণ করে হয়তো রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে দাদার জন্যে মোগলাই পরটা ভাজতে বসে।
জিনিষটা দাদার প্রিয়।
অভীকের বন্ধুরা অভীককে ধিক্কার দেয়। দিলীপ সুধাংশু স্মরজিৎ।
বলে, ‘তুই যেভাবে জীবনের সমস্ত ঝড় ঝাপটা থেকে দূরে মাতৃক্রোড়ে শিশুর মত লালিত পালিত হয়ে আছিস, তাতে তোর দ্বারা যথার্থ বাস্তব সাহিত্য রচিত হতে পারে না। সৃষ্টির মূল উৎস হচ্ছে যন্ত্রণা। ছন্নছাড়া হতে হবে, দুর্দশাগ্রস্ত হতে হবে, জীবনকে দেখতে হবে, জানতে হবে। তবে তো?…সমস্ত বড় বড় লেখকের জীবনের ইতিহাস খুঁজে দেখ—প্রারম্ভে দারিদ্র দুর্দ্দশা, ব্যর্থতা, যন্ত্রণা, হতাশা প্রেম। আর তুমি এতখানি সম্ভাবনা নিয়ে এসেও—
‘তা’ হলে কী করতে বলিস আমায়? দাদার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাইস হোটেলে খাবো, বড়লোকের বাড়ির রোয়াকে শুয়ে থাকবো, আর ফুটপাথে বসে রাস্তার আলোয় লিখবো?’
সুধাংশু বলে, ‘ঠাট্টা নয়। তোমায় জীবনকে জানতে হবে। জীবন শুধু দাদার আওতায় থেকে আর বৌদির হাতের ছানার জিলিপি খেয়ে একটি মার্চেণ্ট অফিসে চাকরী করা নয়।…জীবনকে দেখতে হবে হাটে বাজারে, রাস্তায়, বস্তিতে, মদের দোকানে, পতিতালয়ে, পাহাড়ে, জঙ্গলে, সাধুর আশ্রমে, শুভ সাধুর আখড়ায়, তথাকথিত নীতি দুর্নীতির বেড়া ভেঙ্গে, চরিত্র নষ্ট করে, প্রেম করে, ও গুণ্ডা বদমাইসের সঙ্গে মিশে জেল খেটে—’
বলতে বলতে সুধাংশুর মুখ লাল হয়ে ওঠে, খুব উত্তেজিত হয়ে যায় সুধাংশু।
তখন অবশ্য হাসি পায় অভীকের।
বলে, ‘তার থেকে তুইই লেগে পড়না কলম নিয়ে। এসব অভিজ্ঞতার কিছু কিছু বোধহয় তোর আছে।’
সুধাংশু বলে, ‘আমার বিধাতা যদি আমায় সে ক্ষমতা দিত, দেখিয়ে দিতাম। কিছুর পরোয়া করতাম না। কিন্তু সে গুড়ে যে বালি। পোষ্টকার্ডে একটা চিঠি লিখতে পারি না।’
অভীক তখন অবশ্য হাসে।
কিন্তু বাড়িতে ফিরে সত্যিই হয়তো ছানার জিলিপি আর কড়াই শুঁটির কচুরী দিয়ে জলযোগ সেরে যখন লিখতে বসে, তখন নিজেকে সত্যিই যেন জোলো জোলো লাগে।
নাম হয়নি তা নয়। প্রতিষ্ঠাও যে কিছু হয়নি তা নয়, টাকা পয়সাও আসছে বেশ, তবু যেন কোথায় একটা বড় রকমের শূন্যতা। যেন ওই রকমই একটা ঝড়ঝঞ্ঝা বিশৃঙ্খলা, নিয়মের বেড়াভাঙা জীবনের জন্যে তীব্র পিপাসা জাগে।
যেন সত্যিই তেমন একটা কিছুর মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলেই অভীকের ভিতরের সত্যকার সৃষ্টি শক্তি জেগে উঠবে, জ্বলে উঠবে। এই আরামের শয্যাতল থেকে টেনে নিয়ে যাবে অভীককে।
আবার অন্য সময় ওই সব ভেবেছে, ভেবেই হাসি পায়।
হাসি পায় তখন, যখন সম্পাদকের কাছ থেকে মোটা দক্ষিণা আসে, যখন প্রকাশকের কাছ থেকে বইয়ের জন্য জোর অনুরোধ উপরোধ আসে, ছবির জন্যে কন্ট্যাক্ট হয়।
জীবনটাকে এলোমেলো করলেই কি এর থেকে অধিক কিছু পাওয়া যাবে?
অক্ষমতার মধ্যে একটা প্রেমে পড়া হল না।
কিন্তু করা যাবে কি?
তেমন মেয়ে কোথায়? যে মেয়ে হৃদয়ের মর্মমূল পর্যন্ত নাড়া দিয়ে অলসতা আর নিশ্চেষ্টতার শিকড় ছিঁড়ে উপড়ে নেবে অভীককে?
যারা কাছাকাছি আসে, তাদের বিগলিত বিগলিত ভাব দেখলে হাসি পায়। নিতান্ত বালিকা মনে হয়। … কেউ কেউ আবার এমন আবদার আর আদিখ্যেতায় গলে পড়ে যে বিরক্ত ধরে যায়।
অটোগ্রাফ নিতে এসে—’আমায় ভীষণ ভালো করে লিখে দিন—’ বলে হাতের ওপর হুমড়ে পড়ে, চোখের কোণে মায়া কটাক্ষ হানতে চেষ্টা করে, করে না তা নয়। কিন্তু তারা তো শুধুই মেয়ে।
মেয়ের মত মেয়ে কি?
‘হায় অভীক সেন!’ নিজেই নিজেকে বলে অভীক, ‘তোমার ললাটে স্রেফ ওই রমলা দেবীর খুঁজে এনে দেওয়া বৌ—ই নাচছে!
যে বৌ তোমার সংসার দেখবে তোমার পুত্র কন্যা সামলাবে, তোমার এই সংসারের ত্রিতাপ জ্বালার আওতা থেকে বাঁচিয়ে লেখার টেবিলে বসিয়ে রেখে ঘণ্টায় ঘণ্টায় চায়ের জোগান দেবে, আর তোমার অনুরক্তজনের হামলা থেকে তোমায় রক্ষা করতে অক্লেশে বলবে—’উনি তো বাড়ি নেই! কোথায় গেছেন জানি না, কখন ফিরবেন জানি না।’
লিখতে বসলো, মন বসলো না।
জলাভাব মানুষের কী কী কষ্ট হতে পারে ভাবতে চেষ্টা করলো। যদিও স্নানের অভাব ছাড়া কিছু মনে করতে পারলো না।
কতক্ষণ যেন পরে হঠাৎ একসময় পাম্প চলার পরিচিত আওয়াজটা কানে এসে ধাক্কা মারলো।
তার মানে শ্রীযুক্ত অবনী সেন কর্ম অন্তে ঘরে ফিরেছেন, এবং অচল যন্ত্রটাকে সচল করতে যা করবার তা করেছেন।
শব্দটা সব সময় বিরক্তিকর, আজই শুধু মধুর ধ্বনিতে বাজতে লাগলো।
পরদিন সকালেই আবার সেই আবির্ভাব।
আজ আর প্যাসেজে নয় ঘরের মধ্যে!
প্রাণ ভরে চান করছে বোধ হয়, চুলগুলো খোলা, মুখ ঝকঝকে, শাড়িটা ফাঁপানো।
আগে পর্দা ঠেলে রমলা, পিছনে সেই নবাগতা।
রমলা বললো, ‘এই যে তোমার এক ভক্ত পাঠিকা। তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে।’
অভীক কলমের মাথায় টুপি পরিয়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, ‘কেন ক্ষমা চাইবার কী হলো?’
অভীক চেয়ে চেয়ে দেখলো বৌদি যে বলেছিল ‘এক ফোঁটা মেয়ে, খুব ভুল বলেনি। এখন ওকে সত্যিই নেহাৎ কমবয়সী দেখাচ্ছে। তিরিশ পর্যন্তই কি পৌঁছেছে?
যেখানে পৌঁছক হালকা পাতলা গড়নটার জন্য কোথাও কোনোখানে বয়সের ভার লাগেনি।
চোখে মুখে ক্ষমাপ্রার্থীর ভাবের বদলে বরং কৌতুকের ঝলমলানি। সেই চোখ দিয়ে ঘরটার সবটা খুঁটিয়ে দেখছে। বিস্ময় কৌতূহল আগ্রহ আবেগ সবকিছু মিলিয়ে চোখের তারকায় একটা আশ্চর্য দীপ্তি।
রমলা বললো, ‘ওই যে কাল তোমার সঙ্গে খুব ঝগড়া করেছে না কি—’
‘ঝগড়া!’
অভীক ইচ্ছে করে আকাশ থেকে পড়ে। ‘ঝগড়া মানে? ঝগড়া শব্দটার তো একটাই মানে আমার জানা আছে, সেটা হচ্ছে—’উভয়পক্ষের বিতণ্ডা।’ কিন্তু তেমন কিছু হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না।’
‘আচ্ছা বাবা আচ্ছা—’
সেই ঝঙ্কার তোলা ধ্বনি তুলে বলে ওঠে মেয়েটা, (হ্যাঁ এখন মেয়েটাই বলছে অভীক মনে মনে) ‘আমিই’ না হয় একাই বাক্যযন্ত্রণা দিয়েছি—তা তার জন্যে তো আরো বেশী করেই ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ হাত জোড় করে দিব্যি।
অভীক হাসি চেপে বলে, ‘আমার মনে হচ্ছে ওটা এই মহিলাটির কাছে চাইলেই চলবে। অবনীবাবুর স্ত্রী রমলা দেবীর কাছে। বাক্য যন্ত্রণাটি বোধ হয় ওঁরই মর্মস্থলে গিয়ে বিঁধেছিল।’
‘সেটা বাকি নেই—’
বলল মেয়েটা।
বৌদি বলে উঠলো, ‘আর বলিসনে ভাই, এ এক আচ্ছা পাগলা মেয়ে! সক্কালবেলা ওপরে উঠে এসে কিনা আমার রান্নাঘরের দরজায় এসে দুহাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কথাটি নেই।…আমি তো দেখে হাঁ।…কী ব্যাপার। না, কালকের রাগ দেখানোর জন্যে মার্জনা ভিক্ষা করতে এসেছে।’
রমলা ওকে এক হাতে বেষ্টন করে ধরে আর এক হাত নেড়ে বলে, ‘বোঝ আমার অবস্থা। তখন ওকে নিয়ে বুকে রাখি না মাথায় রাখি তার ঠিক নেই।’
এই রকমই কথাবার্তা রমলার। কথাকে সাজানো গোছানোর বালাই নেই।
অভীক তেমনি হাসি চেপে বলে, ‘মনে হচ্ছে বোধ হয় মাথাতেই রাখলে।’
‘উহু।’ রমলা হেসে হেসে বলে, ‘বুকে’।
কাল থেকে যা দুর্ভাবনাই হয়েছিল। সারা রাত ঘুম নেই। না জানি কী রণচণ্ডীই বাড়িতে এসে অধিষ্ঠিত হলেন। বাব্বা ‘ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।’
অভীক মৃদু হেসে বলে, ‘আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, ও জ্বরটা ম্যালেরিয়া জ্বরের মত—আবার আসবে যখন তখন—
বৌদি হেসে উঠে বলে, ‘আর আসবে না। আমি হচ্ছি বাবা ওর অভীক সেনের গার্জেন। …সত্যি জানিস যখন আমার কাছে শুনলো, আমার দ্যাওর একজন নামকরা লেখক, তখন গায়েই মাখেনি। ভেবেছে বোধ হয় নামকরা না হাতী। কী অলকা, তাই ভাবোনি?’
অলকা অনায়াসে ঘাড় হেলিয়ে বলে, ‘তাই তো। ভাবলাম মরে বেঁচে একখানা বই বোধহয় নিজের খরচায় ছাপিয়েছে দ্যাওর—বৌদি তাতেই বিগলিত।’
বৌদির কথা শুনে জানা গেল ওর নাম অলকা, এবং ও আগে এই বাড়ির বাড়িওয়ালার ভাইয়ের নাম জানত না!
অথবা কে জানে সবটাই চালাকি কিনা। যে প্যাটানে ক্ষমা চাওয়াটি মিটোলো, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না, মহা ধুরন্ধর মেয়ে।
রমলা হাসে।
ঠিক ওই ভাবটাই মুখে ফুটিয়ে বলে কিনা, ‘নামটা কী?’…যেই না তোর নামটা বলেছি, একেবারে ‘অ্যাঁ’ বলে ছিটকে উঠলো।’
অলকা অমায়িক গলায় বলে, ‘শুধু ছিটকে উঠলো বলছেন কেন? তখন যা বলেছেন, সেটাও বলুন?’
‘কী আবার বলেছিলাম তখন?’
‘বাঃ বললেন না, ‘ও কী তুমি ওর নাম শুনে গরম তেলে কৈ মাছের মতন ছিটকে উঠলে কেন?’
হেসে ওঠে রমলা, বলে, ‘তা তুমি যে ভাই তাই করলে।’
‘হোপলেস।’
অভীক বলে, ‘বৌদি, ভাষা—টাষাগুলো আর একটু সভ্য করলে ভাল হয় না?’
রমলা অম্লান বদনে বলে, ‘ভাবি তো করবো, ফট করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় বাপু।’
‘ঠিক আছে।’
অলকা বলে, ‘আপনার বৌদির প্রকাশভঙ্গী আপনার থেকে অনেক বেশী প্রাঞ্জল।’
‘তাহলে আর কিছু বলার নেই।’
রমলা ব্যস্তভাবে বলে, ‘আপাতত আমারও আর কিছু শোনার নেই। রান্নাঘর আমার বিরহে পড়ে কাঁদছে, চললাম। এখন লিখবে না পাঠিকার সঙ্গে আলাপ করবে। অলকা, তুমি কিন্তু ভাই চা না খেয়ে যেতে পাবে না।’
রমলা চলে যেতেই অলকার সেই কৌতুক কৌতুক ভাবটা অন্তর্হিত হয়। অলকার মুখে ফুটে ওঠে, একটি গভীর পরিতাপের ভাব।
একটু সরে আসে ও, টেবিলের কোণটা ধরে দাঁড়ায়, আস্তে আস্তে বলে, ‘আপনার কাছে যে কি বলে ক্ষমা চাইবো।’
‘বাঃ ওসব কথা তো হয়ে গেছে।’
‘সে তো কথার কথা। ঠাট্টার কথা। এখন তো আপনাকে মুখ দেখাতে পারছি না।’
অভীক মৃদু হেসে বলে, ‘বেশ তো পারছেন। এই তো দেখতে পাচ্ছি আপনার মাথা থেকে পা পর্যন্ত। বসুন দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?’
অলকা চেয়ারে বসে।
এদিক ওদিক আরো ভাল করে দেখে, তারপর বলে ওঠে, ‘উঃ কত বই, কত পত্রিকা। আপনার বৌদির কি মজা।’
অভীক আর একটু গম্ভীর হাসি হাসে।
‘মজা জিনিসটা আবার সকলে টের পায় না। বৌদির বই হাতে করলেই ঘুম আসে।’
‘বলেন কি।’ অলকা এখনো আবার প্রায় গরম তেলে কৈ মাছের মত ছিটকে ওঠে, ‘বই হাতে ধরলেই ঘুম আসে? আর আমার আপনার এই ঘরটা দেখলে কী মনে হচ্ছে জানেন? যদি আমায় কেউ এই ঘরটায় থাকতে দিতো আহার নিদ্রা ত্যাগ করে পড়ে থাকতাম।’
‘খুব ভালবাসেন বই পড়তে?’
‘খুব বললে কিছুই বলা হয় না।’
অলকার চোখে মুখে যেন লোভের আহ্লাদ। ‘পেটুক লোককে খাবারের রাজত্বে এনে ছেড়ে দিলে তার যা অবস্থা হয়, আমারও তাই হচ্ছে এই ঘরটা দেখে।’
‘ঘরটাতো সারাদিন পড়েই থাকবে।’
অভীক বলে, ‘অতএব আপনিও এসে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে পড়ে থাকতে পারেন।’
আশ্চর্য! এই কথা বললো অভীক?
যে লোক ঘরে ঝি—চাকরদের পর্যন্ত অসাক্ষাতে ঢুকতে দেয় না, পাছে কিছু নড়িয়ে সরিয়ে বসে, রমলাকে টেবিল গুছিয়ে দিতে দেয় না যদি কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে যায়।
এমন সাদা কাগজে সই দিয়ে বসা, অভীকের পক্ষে নতুন।
ভাগ্নীটাগ্নী আসবার কথা থাকলেও তো নিজের বইপত্র লেখা, ফাইল কপি, সব গুছিয়ে সরিয়ে রেখে যায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছেলেমেয়ে আসবার কথা থাকলে কাতরভাবে বলে যায়, ‘বৌদি, আমার যথাসর্বস্ব তোমার কেয়ারে রেখে গেলাম।’
বৌদিও চক্ষুলজ্জার মায়া ত্যাগ করে অভীক চলে গেলেই ঘরটায় চাবি লাগিয়ে রাখে সেসব দিনে।
ওরা লেখক ছোটমামার ঘরটা দেখবে বলে ব্যাকুলতা প্রকাশ করলে, রমলা দালানের জানালাটা খুলে দেখায়। বলে আমার ঘরের আলমারিতে ওর সব বই একখানা করে আছে, পড়বি তো ওখান থেকেই পড়।’
তরুণীরা অবশ্য পত্রিকাগুলোর ওপরই লোভার্ত দৃষ্টি হানে বেশী, কিন্তু সুবিধে করতে পারে না।
আর আজ হঠাৎ অলকার ভাগ্যে এমন অঘটন ঘটলো? এতো সৌজন্য দেখাবার মতো এমন কি পরিচয়?
বরং পরিচয়ের গোড়াতেই তো তিক্ততা।
নেহাৎ মেয়েটা চালাক বলেই—
অথচ অভীক বোকা হল।
অভীক বললো, ‘আপনার যদি সময় থাকে কষ্ট করে চলে আসবেন সিঁড়িটা ভেঙে।’
‘বাঃ আপনি থাকবেন না, আর আপনার ঘরে এসে উপদ্রব করবো?’
‘ঘরের মালিক ঘরে না থাকা কালেই তো উপদ্রব করার সুবিধে।’
অলকা উঠে গিয়ে র্যাক থেকে দু’ একটা বই বার করে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, ‘আপনি সত্যি বলছেন না ঠাট্টা করছেন বুঝতে পারছি না।’
‘ঠাট্টা করছি? এই মনে হচ্ছে আপনার?’
‘তাই হওয়াই তো স্বাভাবিক। কাল আপনাদের সঙ্গে যা ব্যবহার করেছি!’
অভীক হেসে ফেলে বলে, ‘ভালই করেছেন। টিকে দেওয়া হয়ে গেল। আর কোনদিন দুর্ব্যবহার করবেন না।’
তারপরই কী ভেবে হেসে বলে, ‘আচ্ছা ধরুন আমি যদি আপনাদের লেখক অভীক সেন না হতাম। তাহলে কি আপনি ক্ষমা চাইতে আসতেন?’
অলকা ঝরঝরিয়ে হেসে ওঠে, ‘পাগল হয়েছেন! তা’হলে—কালকের ওই ঝগড়াটি আরো পাকিয়ে রোজ একবার করে কমপ্লেন করতে আসতাম।’
‘রোজ?’
‘রোজ।’
‘এতো বিষয় পেতেন কোথায়?’
‘ইস আপনি এতবড়ো লেখক, আর আপনি এইটি জানেন না, কমপ্লেনের কারণের অভাব হয় না।’
‘আমাকে কি আপনার খুব বড় লেখক মনে হয়?’
‘শুধু আমার কেন, সকলেরই হয়।’
অভীক হেসে বলে, ‘সামনে বসে প্রশংসা শোনাটা খুবই কষ্টকর। কিন্তু কেন জানিনা আপনার মুখ থেকে বেশ ভালই লাগলো।’
‘ওটা মুখের গুণ।’
‘সে তো একশোবার! যাক এই বলা রইলো, আপনি যখন ইচ্ছে আসবেন, বইটই পড়বেন।’
অলকা বলে, ‘এমন অবাধ স্বাধীনতা কে কবে দিয়েছে বলুন? বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘অবিশ্বাসের কী আছে? মানুষই শুধু বই পড়ে, অন্য জীবেরা পড়ে না। বই যার কাছে আছে সে মালিক হলেও, পড়বার অধিকার সকলেরই আছে।’
অভীক হেসে বলে, ‘অবশ্য ছেঁড়বার নয়। বই ছিঁড়ে গেছে দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’
‘কলে জল না থাকলে যেমন হয়?’
মৃদু হেসে বলে অলকা।
অভীক বলে, ‘ওতো কিছুই নয়। যে আমি একেবারে ফায়ার!’
‘আমাকে দিয়ে কি আপনার মনে হবে, আমি বই পড়তে নিয়ে ছিঁড়ি?’
‘দেখে?’
অভীক বলে, ‘বাইরে থেকে দেখে কি কাউকে কিছু বলা যায়?’
‘যায় না, না? তা সত্যি।’
অলকা কেমন উদাস উদাসভাবে টেবিলের ওপর রাখা বইগুলোর পাতা ওলটাতে বলে, ‘লেখকরা এসব ঠিক ধরতে পারেন।…’
তারপর চঞ্চল হয়ে বলে, ‘আমি যাই। আপনার কত দামী সময়—’
‘আমার সেই দামী সময়টাতো এখন একটি বেনের দোকানের টেবিলে ব্যয় হবে।
‘বেনের দোকানে?’
‘ওই আর কি। মার্চেণ্ট অফিসকে আমি বেনের দোকানই বলি।’
অলকা যেন আকাশ থেকে আছড়ে মাটিতে পড়েছে।
অলকার মুখে সেই আঘাতের যন্ত্রণা।
‘আপনি একটা সাধারণ অফিসে চাকরী করেন?’
‘অফিসটা সাধারণ কিনা জানিনা, তবে আমার চাকরীটা সাধারণ! নেহাৎ সাধারণ।’
অলকা হঠাৎ যেন খোলস ছাড়া সাপিনীর মত ফোঁস করে ওঠে, ‘এই কথা বলছেন আপনি হেসে হেসে? এইভাবে আপনার শক্তির অপচয় করছেন কেন? চাকরী করার আপনার কি দরকার?’
‘দরকার নেই তাই বা কি করে জানলেন? আপনার কি ধারণা আমাদের মত লেখকদের শুধু লেখার টাকাপয়সা থেকেই চলে যায়?’
‘আমারতো তাই ধারণা। নিশ্চিত ধারণা।’
‘ধারণাটা ভুল!’
অলকা ব্যগ্র গলায় বলে, ‘আমি বলছি, ঠিক এখনই না হলেও—আপনার অনেক প্রতিষ্ঠা হবে। আপনি আপনি—নাঃ আপনার ওই বেনের দোকানের চাকরীটি করা চলবে না। না কিছুতেই চলবে না।’
অলকার কথাটা যে কতো হাস্যকর তা কি অলকা খেয়াল করে না?
নাকি সত্যিই মেয়েটার মাথা খারাপ?
অভীক হেসে বলে, ‘আপনার অনুরোধটি বিবেচনা করে দেখতে হবে।’
অলকা এক অদ্ভুত কাজ করে বসে, হাত বাড়িয়ে অভীকের জামার একটা কোণ টেনে ধরে বলে ওঠে। ‘অনুরোধ? অনুরোধ কে করছে আপনাকে? এ আমাদের আদেশ। বাংলা সাহিত্যের পাঠক পাঠিকার প্রতিনিধি হিসেবে এই আদেশ জানাচ্ছি আপনাকে।…উঃ অসহ্য। যে সময়টাকে আপনি আমাদের মানসভোজের পাত্র সাজাতে কাজে লাগাতে পারতেন, সেই সময়টাকে কি না একটা বাজে কেরাণীর কাজে ব্যয় করছেন?’
অভীকের মনে হলো কথাগুলো যেন সাজানো সাজানো। তবু প্রাবল্যের একটা আকর্ষণ আছে। আকর্ষণ আছে আর পাঁচজনের থেকে ভিন্ন ধরণের প্রকৃতির প্রতি।
অভীক তাই ওকে নস্যাৎ করে দেওয়ার বদলে খুব মার্জিত গলায় বললো, ‘তা আপনার জন্যে তো করছিই। করছি না? ওই যে কী বললেন, মানস ভোজের পাত্র নাকি, ওটাকে তো সাজিয়ে চলেছি—’
‘আরো বেশী করে করবেন। অন্যসমস্ত চিন্তা ছেড়ে দিয়ে করবেন।’
অভীক অলকার তীব্র ইচ্ছায় মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে।
তার পক্ষে কী বলা শোভন, একেবারেই জানে না মেয়েটা। জানে না কতটুকু পরিচয়ে কতটা আন্তরিকতার দাবী করা যায়।
তবু আসামী একটা ছেলে নয়।
একটা মেয়ে।
হয়তো বোকা, হয়তো বাচাল, তবু মেয়ে বলেই পার পেয়ে যায়। আচ্ছা অভীক মুখের উপর অবজ্ঞা অগ্রাহ্য না করুক, হেসে উড়িয়ে দিতেও পারতো? অভীক আবার ওর সামনে যুক্তির ঝুলি খুলে বসতে গেল কেন?
অভীক কেন বোঝাতে বসলো, ‘অগাধ অবকাশ শিল্প সৃষ্টির পক্ষে বরং প্রতিকূলতাই করে, আনুকূল্য নয়।’ …বোঝাতে বসলো, ‘এই যে সারাদিন কাজে বন্দী মন ছটফট করতে থাকে তা’তে প্রেরণা বেশী আসে।’
অনেকক্ষণ বলে চলে অভীক।
আশ্চর্য বৈ কি!
খুবই আশ্চর্য।
এমন কি দাদাকেও কখনো অভীক এসব কথা বোঝাতে বসে না। দাদা একটু ‘গোলা’ লোকের মত কথা বললে হেসে উড়িয়ে দিয়ে চুপ করে থাকে।
যুক্তি তর্কের জালে পড়ে যাওয়া অলকা বলে, ‘বেশ করতেই যদি হয় তো কাগজের অফিসে চাকরী করেন। যেখানে অন্ততঃ সাহিত্যের আবহাওয়া। বেনের দোকানে নয়। কিছুতেই নয়।’
অভীকের অস্বস্তি হতে শুরু করেছে।
কারণ অভীক যতই সংস্কারমুক্ত লেখক হোক, গেরস্থবাড়ির ছেলে।
একদিনের পরিচিত মেয়েটা তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল তো পড়লই, চালিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, একী?’
এ প্রসঙ্গ বদলানো দরকার।
অভীক বলে উঠলো, ‘কাল আপনার কোনো কাঁচের জিনিষ ভেঙে গেছে?’
অলকা বলে, ‘হঠাৎ একথা কেন?’
‘বলুনই না।’
‘ভাঙেনি। আর একটু হলে এক ঝুড়ি কাঁচের বাসন ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। ওই কুলিটুলিগুলো এমন অসাবধান! আমি তো কাল শুধু ওই কাঁচগুলোই সামলেছি। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?’
‘হাত গুনতে জানি।’
অলকা কি বলতে যাচ্ছিল কে জানে, কথায় ছেদ পড়লো। রমলা এলো চা নিয়ে।
তার সঙ্গে ‘টা’য়ের সমারোহ।
‘কী আশ্চর্য্য! আপনি এতো সব বয়ে নিয়ে এলেন? আপনার ওই লোকটা তো রয়েছিল।’
‘কে? ওই হারুর মা? ওর হাতে চা পাঠাবো? না ভাই ওসব আমি ভালবাসি না। খেতে দেব মানুষকে। নিজে হাতে করে না দিলে কি মন ভরে?’
‘এইসব নিমকি বেগুনী এখন করলেন?’
‘ও আর শক্ত কী? রোজই তো করি।’
অলকা বলে, ‘আশ্চর্য্য!’
অভীক হেসে ওঠে বলে, ‘এইটুকুতেই আশ্চর্য্য হয়ে আশ্চর্য্য হওয়াটা খরচ করে ফেলবেন না। বৌদির ষ্টকে আশ্চর্য্য করে দেবার মত আরো অনেক বস্তু আছে।’
‘আমার দ্বারা এসব কিছু হয় না।’
অলকা অম্লান মুখে বলে, ‘সকাল বেলা রান্নাঘরের দিকে যেতে হলে আমার হৃদকম্প হয়।’
রমলা অবাক হয়।
‘ওমা! তা বললে মেয়েমানুষের চলে? যতই তোমার রান্নার লোকজন থাক, ঠিক কি আর বাড়ির লোকের মত হয়?’
অলকা বলে, ‘তবু ওর রান্না খাওয়া চলে, আমার তো আমি নিজেই মুখে তুলতে পারি না।’
রমলা গালে হাত দেয়।
বলে, ‘অবাক করলে যে তুমি অলকা? না ধেৎ! ঠাট্টা করা হচ্ছে। এমন চটপটে খরখরে মেয়ে তুমি রান্না করতে পারো না? তা আবার হয় নাকি?’
‘সবাই কি আপনার মত হয়, অলকা বলে, এসব আজে বাজে কাজ আমার ভাল লাগে না।’
রমলা আহত হয়।
রমলা দুঃখের গলায় বলে; ‘রান্নাটা আজে বাজে কাজ নয় অলকা! মেয়েমানুষের ওটাই প্রধান কাজ। তোমায় বোধহয় কেউ এসব শেখায় নি, তাই ওর আনন্দটি জানো না। কাল থেকে এসো তো আমার কাছে। সব রকম রান্নাটান্না শিখিয়ে দেব। রান্নায় নেশা ধরিয়ে দেব দেখো। আসছো কাল থেকে—।’
‘আসবো।’
অলকা দুষ্টু হাসি হেসে একবার অভীকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নিশ্চয় আসবো। তবে আপনার নেশায় আসক্ত হতে নয়। আমার নিজের নেশার সুখ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করতে।—আজ কিন্তু কিছু বই নিয়ে যাচ্ছি। লোভ সামলাতে পারছি না।’
তারপর হাতে বুকে যতগুলো ধরে, ততগুলো বই বেছে বেছে নিয়ে, বুকে চেপে ধরে হাসতে হাসতে বিদায় নিলো অলকা।
কিন্তু সত্যি কি বিদায় নিল।
রমলা বললো, ‘সারা সকালটা এখানেই কাটানো, স্বামী খাবে টাবে খেয়াল নেই। মেয়েমানুষে রান্না করতে নারাজ, এ বাবা বড় আশ্চর্য্য।’ তারপর আবার সহানুভূতির গলায় বলে, ‘ঘরে মন বসে না। ছেলেপুলে তো নেই। স্বামী নাকি বিজনেস করেন। বলছিলেন তোর দাদা।’
অভীক বলে, ‘মহিলাটিকে বেশী প্রশ্রয় দিও না বৌদি। সন্দেহ হচ্ছে হেড অফিসে কিছু গণ্ডগোল আছে। বেশী এলে না আবার তোমার সব ভেঙে চুরে তচনচ করে।’
বলে ফেলে অবাক হলো অভীক।
একথা কেন বললাম আমি?
একথা তো বলার ছিল না।
রমলাও অবাক হলো।
বললো, ‘ওমা। শোন কথা। বাচ্চা মেয়ে নাকি, যে ভাঙবে চুরবে?’
তাইতো ভাবা স্বাভাবিক।
কিন্তু অলকা নামের ওই মেয়েটা?
এই শান্ত ছন্দ সংসারটার ছন্দ ভাঙতেই কি তাকে তার বিধাতা এখানে এনে ফেললেন।
সে কি এতদিন যাবৎ এই রকম ছিল? তার এই উনত্রিশ বছরের জীবনে সে অনেক হৈ চৈ করেছে, অনেক হেসেছে কথা বলেছে, বাচালতা করেছে, ঝগড়া করেছে, কিন্তু কোনদিন সর্বনাশা ভাঙনের মূর্তি নিয়ে দাঁড়ায় নি। বরং কাঁচের জিনিস ভাঙবার ভয়ে সবকিছু সামলে সামলেই এসেছে এযাবৎ।
হঠাৎ ওর মধ্যেও কি একটা ভাঙনের হাওয়া এসে হাজির হল।
কে ভেবেছিল অতগুলো বই নিয়ে গিয়েও সত্যিই পরদিন সক্কালবেলা আবার এসে হাজির হবে অলকা?
অভীক প্রমাদ গণে।
কারণ অভীকের ঘরেই তার পদার্পণ।
অভীক কোনদিনই ভীরু নয়।
তবু অভীকের বুকটা কেঁপে ওঠে। অভীক যেন ওর ওই আসার মধ্যে একটা সর্বনাশের ছায়া দেখতে পায়।
অভীক সেই ছায়াটাকে ঢাকা দিতে তাড়াতাড়ি বলে, ‘বৌদির শুভ—প্ররোচনা কাজে লেগেছে তাহ’লে! যান এখন সো—জা রান্নাঘরে চলে যান। মোচার ঘণ্ট রাঁধতে শিখুন গে।’
‘রান্নাঘরে যেতে আমার দায় পড়েছে—’অলকা বলে, ‘আমি তো আপনার কাছেই বসতে এলাম। লেখক অভীক সেনকে যে এভাবে আমার একেবারে চোখের সামনে দেখতে পাব তারই ঘরে বসে বসে, একী কোনদিন ভেবেছিলাম?’
অভীক বিচলিত হয়।
অভীক সেগুলো গোপন না করে বলে, ‘কিন্তু আপনার না দুপুরবেলায় আসবার কথা ছিল? ঘরের মালিকের অনুপস্থিতিতে ঘর তচনচ করবার কথা?’
অভীক কথা বলছে, আর নিজেই অবাক হচ্ছে। একথাও তো বলার ইচ্ছে ছিল না আমার।…একমুহূর্ত্ত আগেও তো এ কথাটা বলবে বলে ভাবেনি।’
কেন বললাম ঘর তচনচ, করার কথা ছিল। এমন আবদার দিয়ে কথাতো কাউকে বলি না!
তবু বলে ফেলে।
বলে, ‘কেউ বই পড়তে ভালবাসে, শুনলে আমার ভীষণ ভাল লাগে।’
অলকা দুষ্ট হাসি হেসে বলে, ‘তাকেও ভালবাসতে ইচ্ছে করে।’
অভীক ওর আবেগ আর আবেগে ভরা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে একটুক্ষণ। তারপর বলে, ‘বোধহয় ইচ্ছে করে।’
অলকা টেবিল হাতড়ায়, র্যাক থেকে বই নামায়, চাবি দেওয়া আলমারিটার পাল্লা ধরে টানাটানি করে। আর তার সঙ্গে কথার ফুলঝুরি ঝরায়, ‘আচ্ছা কখন লেখেন আপনি? মুড এলেই? যদি অফিসে বসে, কি রাস্তায় যেতে যেতে মুড এসে যায়? আচ্ছা—বইয়ের চরিত্রগুলো কি আপনার দেখা? নিশ্চয়ই দেখা। না দেখলে কখনো, অতো জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে? আচ্ছা আপনার ‘নদীর চরে’ উপন্যাসটার নায়িকাকে অমন মারাত্মক মুহূর্তের মুখে ঠেলে নিয়ে গিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলেন কেন?’…
আর কেউ কোনদিন এভাবে অভীকের বই কাগজ নিয়ে লণ্ডভণ্ড করেছে? চাবিবন্ধ আলমারির পাল্লা ধরে টেনেছে কেউ?
অভীক হাঁ হাঁ করে উঠল না, অভীক বিরক্ত হল না। অভীক শুধু ড্রয়ার থেকে চাবিটা বার করে ওর হাতে দিল।
অলকা সেটা তুলে নিয়ে বললো, ‘আমি খুব অসভ্য, না?’
অভীক আস্তে বললো, ‘আপনি যে ঠিক কী, তা এখনো বুঝতে পারছি না।’
আজ আবার প্রথম দিনের সেই হাওয়া শাড়িটা পরেছে অলকা।
যেন ব্লাউজ আর শায়ার ওপর একটা প্রজাপতির ডানার ওড়না উড়িয়েছে।
অভীকের মনে পড়ে দাদা বাড়িতে রয়েছেন। মনে হয় বৌদি হয়তো অপেক্ষা করছেন অলকা ওঁর কাছে যাবে বলে।
অভীক হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আপনি এতো পাতলা শাড়ি পরেন কেন?’
অলকা বোধহয় একটু চমকালো।
অলকা অবশ্যই এ প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তাবলে ঘাবড়ায়ও না। অভীকের বিছানার ওপর একখানা বই নিয়ে বসে তার পাতা ওলটাচ্ছিল, তেমনি ভাবেই বসে থেকে বলে, ‘শাড়ীগুলো দোকানে বাজারে বিক্রী হয় বলে? কেন আপনার কী এসে যাচ্ছে তাতে?’
‘দেখতে খারাপ লাগছে।’
অলকা মুখ তুলে একটু হেসে বলে, ‘খারাপ মোটেই লাগছে না, ‘খারাপ লাগছে’ বলাটা ভাল দেখায় তাই বলছেন।’
‘আপনার কথাবার্তা খুব সাংঘাতিক। এভাবে আর কেউ কথা বলতে সাহস করেনি কখনো।’
অলকা সকৌতুকে হেসে বলে, ‘তাই নাকি? তাহলে তো বলতে হয় আমিই আপনার প্রথমা!’
অভীক একটু শক্ত হবার চেষ্টা করে।
বলে, ‘আপনি আবার কী হতে যাবেন? নেহাত পাম্পে ঠিক জল উঠছে, ইলেকট্রিক ঠিক আছে, নর্দমার জল আটকাচ্ছে না, তাই ঝগড়া ঝাঁটি হচ্ছে না। এই পর্যন্ত!’
‘ইস। তাই বৈকি।’
অলকা মাথা দুলিয়ে বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনি ভয় পাচ্ছেন বলেই সত্যি কথাটা অস্বীকার করছেন!’
আজও অনেকক্ষণ অভীককে জ্বালিয়ে আজও অনেক বই নিয়ে বিদায় হয় অলকা। অলকা আজ চান করেনি, অলকার খোলা রুক্ষ এলোচুলগুলো যেন সাপের ফনার মত দুলে ওঠে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়।
‘মেয়েটা কে রে?’
অবনী এঘরে এসে প্রশ্ন করে।
এটা আশ্চর্য্য!
অভীকের ঘরে কতরকমের লোক আসে। কত ছেলেমেয়ে আসে, অবনী কখনো ‘ও কে রে?’ এ প্রশ্ন করে না।
অভীক চকিত হয়, কিন্তু আত্মস্থ হয়। বলে, ‘কেন বৌদি বলেনি?’
‘বৌদি তো বলছিল, দোতলার নতুন ভাড়াটে মনিবাবুর স্ত্রী। কিন্তু—’
অভীকের হঠাৎ মনে হয়, দাদা নিশ্চয় বৌদি প্রেরিত হয়ে এসেছে। অলকা কেবলমাত্র এঘরে এসে গল্প করে চলে গেছে তাই বৌদির রাগ হয়েছে। কিন্তু সেকথা দাদাকে দিয়ে বলাবে?
অভীক আর একটু শক্ত হয়, ‘ওর আর কিন্তু কী? মহিলাটি ভীষণ বইপাগল, তাই এসে আর নড়তে পারছিলেন না।’
‘সে তো দেখলাম।’
দাদা তার স্বভাবজাত অন্যমনস্কতার সঙ্গে বলে, ‘মেয়েটার জামা কাপড়গুলো দেখতে ভাল নয়।’
হয়তো অভীকের মধ্যে চিরাচরিত যে সংস্কারজনিত উদ্বেগ কাজ করছিল, সেটাকে জোর করে তাড়াতে চেষ্টা করছিল বলেই দাদার ওই সহজ প্রশ্নটাই কৈফিয়ৎ তলবের মত লাগলো তার। ভিতরে রয়েছে অকারণ একটা অপরাধবোধ। তাই নিজেকে কাঠগড়ায় আসামীর মত লাগলো।
অভীক কখনো যা করে না তাই করলো।
দাদার মুখের ওপর একটু ক্ষুব্ধ বিদ্রূপের হাসি হেসে বললো, ‘এসব তোমার নজরে পড়ে? জানা ছিল নাতো। আমি অত দেখিনি।’
কিন্তু বিদ্রূপের হাসি দিয়ে অবনী সেনকে চুপ করিয়ে রাখবে তুমি অভীক সেন?
তাছাড়া রমলা নেই?
রমলা যদি দিনের পর দিন দেখে দোতলার ওই বেহায়া বাচাল বৌটা তার দেওরের ঘরে এসে হড়েপড়ে পড়ে থাকে, ঢুকলে আর বেরোতে চায় না, সকাল নেই সন্ধ্যে নেই, ছুটির দুপুর নেই, অভীককে যেন গ্রাস করে রাখে, তাহলে রমলার গৃহিণীসত্তা রুখে দাঁড়াবে না—তার অভীকের সম্পর্কে কল্যাণ চিন্তা?
প্রথম প্রথম রমলা অভীককে বলতো, ‘ব্যাপারটা কী বলতো অভী? বেহায়া ছুঁড়ির বরটা কি হাবাকানা? বৌটা যে এখানে সারাদিন, পারলে রাতটাও কাটাতে আসে, কিছু বলে না কেন?’
বলতো, ‘আচ্ছা অসভ্য মেয়ে বাবা! একটু সমীহ নেই। বাড়িতে যে আরো দুটো লোক রয়েছে, তা যেন খেয়ালই নেই। এসেই তোর ঘরে ঢুকে বসে আছে। তোর তো লেখা টেখা ‘ডকে’ উঠছে। কিছু বলতে পারিসনা?’
অভীক ঠাণ্ডা গলায় বলে, ‘কী বলবো? আপনি আর আসবেন না?’
রমলা ওই চিরপরিচিত মুখটায় যেন অপরিচয়ের ছায়া দেখতে পায়।
রমলা ভয় পায়।
তাড়াতাড়ি বলে, ‘তাই কি আর বলা যায়? একটা ভদ্রতা সৌজন্য নেই। একটু ঘুরিয়ে টুরিয়ে বলা আর কি।…এদিকে তো লেখক অভীক সেন শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন মেয়ে, সেই লেখাই তো ঘুচিয়ে দিতে বসেছিল বাবা।’
অভীক তেমনি ঠাণ্ডা গলায় বলে, ‘লেখা ঘুচিয়ে দেবার সামর্থ্য কারো নেই। তবে হ্যাঁ ভদ্রমহিলার অবস্থা দেখলে দুঃখ হয়।…ওর মধ্যে সাহিত্যের প্রতি, শিল্পের প্রতি, গানের প্রতি কী অসীম পিপাসা। আর সেই ভদ্রলোকের কিসের বিজনেস জানো? ভুষির।’
‘ভুষির? কিসের ভুষির?’
‘সে তাঁর ভগবানই বলতে পারেন। ভদ্রলোক এ জগতে ওই ভুষি ছাড়া আর কিছু চেনেন না। কোনো একদিন ক’জনে মিলে ওই সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির দুটো মানুষকে কতকগুলো আবার নিয়মের দড়াদড়িতে বেঁধে রেখেছে বলে যার একটু পৃথিবীর খোলা বাতাস নিতে ইচ্ছে করে সেটুকুও নিতে পারে না?’
রমলা মনে মনে বলে, ‘পাবে না কেন? পৃথিবীতে তো চারিদিকেই খোলা বাতাস, নিকগে না দু’ডানা ছড়িয়ে উড়ে উড়ে। আমার ঘরে এই শান্তির হাওয়াটুকুকে নষ্ট করতে আসা কেন?’
কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
রমলাকে যত বোকা মনে হয়, তত বোকা সে নয়। সোজা হাওয়া উল্টো হাওয়া সে বোঝে। বোঝে হাওয়া উল্টো বইছে।
রমলা নিতান্ত বোকা সেজে বলে যায় ‘ভুষির আবার ব্যবসা কী বাবা? এ ব্যবসা ভদ্রলোকে করে? তাতে পয়সা হয়?’
কিন্তু রমলা অবনী সেনের কাছে গিয়ে পড়ে। ‘ও মেয়ে জাদুকরী! ও তোমার ভাইটাকে জাদু করেছে! কী হবে? তুমি একটা বিহিত করবে না?’
অবনী সেন তলে তলে ভাড়াটে তোলার চেষ্টা করে।
বাড়িটা দু’মাস ছ’মাস পড়ে থাকলে যে পয়সার লোকসান সেটা আর এখন খেয়ালে আসে না হিসেবী অবনী সেনের।
এইভাবেই ‘উপায়’ ভাবে অবনী সেন।
এতোদিনে বুঝি অভীকের বন্ধুদের ইচ্ছেটা পূরণ হচ্ছে।
অভীক আর মাতৃক্রোড়ে শিশুর ভূমিকায় থাকছে না। অভীকের এখন প্রায় প্রায় অখিদে থাকে বলে রমলার যত্ন করে তৈরী খাবার টাবার গুলো পড়ে থাকে।
অভীকের কথা—টথা এতো সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে যে রমলাকেও প্রায় মৌনী করে ফেলেছে।
রমলার সেই সুখী সুখী উজ্জ্বল মুখটা যে আর তেমন সুখী সুখী নেই তাও আর দেখতে পায় না অভীক।
অভীক এটাই ভাবে, সত্যিই এতোদিন আমি যেন নেহাৎ আঁচল চাপা হয়ে পড়েছিলাম। আমি একটা বয়স্ক পুরুষ, বলতে কি একজন নামকরা লেখক, আমাকে একটু দেখার আশায় ছেলেমেয়েগুলো মরে যায়, একবার সভায় নিয়ে যেতে পারলে তরুণদল কৃতার্থ হয়, অথচ আমি কিনা কোনো একজন ভক্ত পাঠিকাকে একটু প্রশ্রয় দিচ্ছি বলে ভয়ে কাঁটা হচ্ছে?
ওই কাঁটা হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠে। গড়ে তোলে যুক্তি খাড়া করে করে।
অবনী সেন যা ভেবেছিল তা হল না। ভাড়াটে এমন এক কথায় বিদেয় করা যায় না।
সিঁড়ির—তলায় বাইরে বেরোবার পথে অলকা সেই প্রশ্নটাই উপস্থাপিত করে অভীক সেন নামের বাসনাছন্ন লোকটার সামনে।
অভীক চমকে বললো, ‘তার মানে?’
‘মানে আপনারাই বলতে পারেন। আপনারা বাড়ির মালিক।’
‘আচ্ছা আমি ফিরে এসে সন্ধ্যেবেলা দাদাকে জিগ্যেস করছি—’
‘অনে—ক ধন্যবাদ। আপনার কাছাকাছি আসতে পেয়ে আমার জীবনে যে কী বিরাট ওলোট পালোট হয়ে গেছে, তা’ বোঝাবার ক্ষমতা আমার নেই।’
অভীক ওই ঢলঢলে চোখের চাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে।
‘কী দেখছেন?’
‘আপনাকে।’
‘এমা আমি কী একটা দ্রষ্টব্য বস্তু?’
‘আমার তো তাই মনে হয়।’
‘বেশ তাহলে আরো কিছুক্ষণ দেখতে দেখতে চলুন। আমিও বেরোচ্ছি।’
‘কোথায়?’
‘কোথায়—?’ অলকা হেসে ওঠে, ‘এই যে দিকে দু’চক্ষু যায়—’
‘ও রিক্সা নেবেন না’, অভীকও হাসে, ‘দিকভ্রান্ত হবার ভয়।’
অলকা অভিমানের গলায় বলে, ‘আমার তো আর আপনার মত একটা নির্দ্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র নেই যে, দিক ঠিক করাই আছে। আপনি চলে যাবেন, আর আমিও সারাদিন বোকার মত নিঃশ্বাস ফেলবো হাঁপাবো, ‘যেকানে যেতে ইচ্ছে হয় না, সেখানে বেড়াতে যাবো। আর যদি আমার ‘ভুষিমাল’ দয়া করে যখন একসময় বাড়িতে ফেরেন, তখন তাঁর নৈবেদ্য সাজাবো।’
অভীকের মনের মধ্যের সহানুভূতির তারটা ঝনঝনিয়ে বেজে ওঠে।
অভীকের ইচ্ছে হয় ওকে অঙ্গসুধায় ভরিয়ে দেয়, কিন্তু সমাজবদ্ধ মানুষ কী হাত পা বাঁধা।
বাসের রাস্তার দিকেই যাচ্ছিল, অলকা হঠাৎ বলে উঠল, ‘ভাবলে আশ্চর্য্য লাগে আপনিও শুধু কেরাণীর মত প্রতিটি দিন অফিসে হাজরি দেন!’
‘আমারও আশ্চর্য্য লাগে।’
‘তবু তাই করে চলেছেন।’
‘তবু তাই করে চলেছি।’
‘বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে হয় না?’
‘হয় বৈ কি। তবু নিজেকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বেঁধে রাখাকেও শ্রেয় বলে মনে হয়।’
অলকা রাস্তার মাঝখানেই শব্দ করে হেসে ওঠে। ‘ঠিক আমারই মত দশা। আমিও ওই শ্রেয়র খাজনা দিচ্ছি বসে বসে। ভুষিমালের নৈবেদ্যি সাজাচ্ছি।’
‘যাক। যেতে দিন।’
অভীক সহসা অলকার পিঠে একটা হাত রেখে তার মধ্যে গভীর স্পর্শের স্বাদ ঢেলে দিয়ে বলে, ‘আজ কাট মারলাম। চলুন কোথাও বেড়িয়ে আসা যাক।’
‘বেড়িয়ে? আপনার সঙ্গে?
অলকার চোখে আষাঢ়ের আকাশের ছায়া!
‘মিছে কেন আর একদিনের জন্যে স্বর্গের স্বাদ দিতে আসছেন?’
‘মাত্র একদিনের জন্যেই বা ভাবছেন কেন? বলুন কোথায় যেতে চান।’
‘আমার কি কোনো জগতের খবর জানা আছে? আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন, সেখানেই যাবো।’
‘আচ্ছা চলুন ‘শালিমারে’ ঘুরে আসি। এসময় আপনার বাড়িতে কোনো কাজ নেইতো?’
‘আমার বাড়িতে আমার কোনো সময়েই কোনো কাজ থাকে না অভীক বাবু। আমি অবান্তর, আমি অপ্রয়োজনীয়, আমি ফালতু।’
এরপর আর ভয় কিসের? একটা ফালতু অবান্তর অপ্রয়োজনীয় প্রায় বেওয়ারিশ জিনিষকে তুলে নিতে বিবেকের প্রশ্নই বা কী?
‘আগে একটু চা কি কফি খেয়ে নেওয়া যাক।’
বললো অভীক।
নির্ভয়েই ঢুকলো একটা একেবারে নাম না করা জায়গায়।
নামী—দামী জায়গায় গিয়ে বসলে তো নামকরা লোকদের বিপদ। কোথা থেকে কে চিনে ফেলে।
কেউ কি জানতো অমন নিশ্চিন্ততার শিবিরের মধ্যে সহসা এক শত্রু হানা দেবে।
তা এখন এই দণ্ডে স্মরজিৎকে শত্রুই মনে হলো অভীকের।
জীবনের এই প্রথম দিনটা কিনা বরবাদ!
স্মরজিৎ একেবারে হৈ হৈ করে উঠলো, ‘কী বাবা লেখক, তোমার যে আর দর্শনই পাওয়া যায় না। ওঃ তাই।’
পশ্চাৎবর্ত্তিনীর প্রতি দৃষ্টি পড়ে এতক্ষণে।
স্মরজিৎ অলকাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে ওঠে, ‘তা শুভ কাজটি সারা হল কবে? বন্ধুবান্ধবদের কলা দেখিয়ে?’
অভীক ধমকে ওঠে, ‘কী যা তা বলছিস?’
‘ওঃ মাপ করবেন মিসেস মিসেস।’
‘মিসেস টিসেস নয়, শ্রীমতী অলকা রায়।’
অলকা হাতজোড় করে একটি নমস্কার করে।
অভীক বলে, ‘আমার প্রতিবেশিনী। আমার বন্ধু স্মরজিৎ।’
অতএব আর একখানি ‘নিভৃত কুলায়’ ‘দুজনে কূজনে’ কফিপান হয় না, বাইরের টেবিলেই তিনজন।
এতেও যদি স্মরজিৎকে শত্রু মনে না হবে তো কিসে হবে?
স্মরজিৎ একবার অলকার কান বাঁচিয়ে বলে নেয় ‘কী বাবা ভাল ছেলে, উচ্চমার্গের জীব। কবে থেকে এ উন্নতি?’
অভীক চাপা গলায় বলে, ‘থাম।’
তারপর খোলা গলায় বলে ওঠে, ‘তা তুই আজ এমন হতভাগ্যের মত একা যে? জানেন অলকাদেবী, জীবনে আজ এই প্রথম আমি আমার এই বন্ধুটিকে একা ঘুরতে দেখছি। একটি করে বান্ধবী থাকবেই সঙ্গে—’
বলবেই তো। ওকে অপদস্থ করাই ঠিক।
যেমন শত্রুতা সাধলো স্মরজিৎ।
কিন্তু অপদস্থ কোথায়?
স্মরজিৎ দিব্যি হেসে উঠে বলে, ‘তাহলেই বুঝুন? জগতের সার বস্তুটি কি, সে জ্ঞান জন্মাতে ওর এতদিন লাগলো, আর আমি তাকে কোন কালে জেনে বুঝে আস্বাদ নিয়ে এখন জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে পরিত্যাগ করে ফেলেছি।’
অতএব অভীকই অপদস্থ।
রাগে অভীকের মাথা জ্বলে যায়।
অভীক ফট করে একটা নির্লজ্জ উক্তি করে বসে, ‘একবারে পরিত্যাগ? তা ওহে জ্ঞানবৃদ্ধ! তোমার সর্বশেষ শিকারটি যেন কে? বিভাসের শ্রীমতী না? তাই শুনছিলাম মনে হচ্ছে।’
স্মরজিৎ মুখটিকে করুণ করুণ আর অনুতপ্ত অনুতপ্ত করে আস্তে বলে, ‘হ্যাঁ ভাই। যা শুনেছিলি ঠিকই কিন্তু তারপরেই মনটা কেমন বদলে গেল। মনে হলো, দূর ওতে কোন সুখ নেই। ‘পরস্ত্রী’ জিনিষটা কেমন ভারী ভারী, কুমারী মেয়েগুলো তা নয়। এবার ঠিক করে ফেলেছি একটা নিজস্ব স্ত্রী সংগ্রহ করে নেবো।’
‘আরে তাই নাকি?’
অভীক লাফিয়ে ওঠার ভান করে। ‘কবে সেদিন আসছে? তোমার মতে যেটা মতিচ্ছন্ন ছিল? জানেন অলকাদেবী, এই লোকটার মতে মতিচ্ছন্ন না হলে কেউ বিয়ে করে না।’
অলকা চোখ ভুরু নাচিয়ে বলে, ‘তবে? হঠাৎ মতিচ্ছন্নে মতি কেন?’
‘ওই তো ভেবে দেখলাম যতরকম পরকীয়া হতে পারে তার স্বাদ তো চাখা গেল, ‘স্বকীয়া’র কেমন না জেনেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেব?’
‘এখুনি আপনার সে চিন্তাও এসে গেছে? পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার চিন্তা।’
‘ওর আর এখন তখন কী?’ স্মরজিৎ উদাস ভাবের অভিনয় করে বলে, ‘সর্বদাই মনে করা উচিত ‘শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনটির’ কথা। পৃথিবীর যা অবস্থা।’
‘স্মরজিৎ তোর বারোটা বেজে গেছে মনে হচ্ছে।’
‘আমারও হয়েছে।’
স্মরজিৎ প্রসন্ন হাস্যে বলে,’তাই এবার আবার একটা থেকে শুরু।’
কথার মাঝখানে কফি আর কাজু খাওয়া হয়েছে, স্মরজিৎ ‘জবরদস্তি করে তার দাম দিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘চল তোরা কোথায় যাবি পৌঁছে দিই!’
‘সঙ্গে গাড়ি আছে বুঝি?’
অলকা বলে।
অভীক বলে, ‘স্মরজিৎ আছে, গাড়ি নেই দৃশ্য কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
‘কিন্তু এখন, এই বেলা এগারোটার সময় এতো রোদ্দুরে কোথায় যাবি?’
স্মরজিৎ বলে, ‘অফিস থেকে যে কাট মেরেছিস সে তো বুঝতেই পারছি। যাবার জায়গাটা ঠিক করেছিস কিছু?’
‘কিছু না। এমনি হঠাৎ আর যেতে ইচ্ছে হল না। আর ইনিও—’
‘থাক ও আর আমায় বিশদ বোঝাতে হবে না।’
স্মরজিৎ হেসে বলে, ‘আমায় ডিরেকশানটা দিয়ে দে।’
অভীকের ইচ্ছে ছিল না তার আজকের এই নতুন দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতার সুখের ওপর এমন একটা অবাঞ্ছিত ছায়া এসে সবটুকু গ্রাস করে ফেলে, তাই ভেবেচিন্তে কিছু একটা ঠিক করছিল, মাঝখান থেকে অলকা বলে বসে, ‘তার থেকে আপনিই ঠিক করুন।’
‘আমি? আমি আপনাদের ব্যাপারে—’
অলকা হতাশ হতাশ ভাব দেখিয়ে বলে, ‘ব্যাপার ট্যাপার কিছু নয় মশাই। যা ভাবছেন তার কিছু না। আমি হচ্ছি ওঁনাদের বাড়ির একটা ফ্ল্যাটের ভাড়াটের স্ত্রী এবং ওঁনার লেখার একটি পরম ভক্ত পাঠিকা। এইমাত্র ব্যাপার। জীবনে এই প্রথম উনি বললেন, ‘আজ আর অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না, চলুন কোথাও বেড়িয়ে আসি। ফিরে এসে ওঁনার বৌদির জেরার মুখে পড়বার প্রস্তুতি নিয়েই যাচ্ছি।’
‘বৌদি, ও হো হো—তোর সেই বৌদি?’
স্মরজিতের হাসির মধ্যে বিস্ময়ের ভাগটাও অনেকটা থাকে।
‘এখনো তাহলে তুই দাদা বৌদির হেপাজতেই আছিস? আমি ভাবছিলাম কিছুটা বুঝি উন্নতি হয়েছে—’
অলকা বলে, ‘ও আর হবার নয়। দেখে দেখে অবাক হয়ে যাই। এভাবে একটা নানাবিধ সংস্কারের আওতার মধ্যে ভয়ে ভয়ে থাকা, ওঁর পক্ষে যে কীভাবে সম্ভব হয়।’
আলাপের ধারাটা মাত্র অলকা আর স্মরজিতের মধ্যেই বয়ে যাচ্ছিল।
অভীক যেন হঠাৎ ওর বাইরে পড়ে গেছে পিছনে।
অভীকের খুব রাগ হচ্ছিল।
স্মরজিৎকে এত ভিতরের খবর দেবার দরকার কী। অভীক কি করে না করে তা’ অন্যকে বলার কি আছে?
অভীক যেন ওর থেকে আরো বিরাট বিশাল হতে পারতো, শুধু তার কাপুরুষতার জন্যে পারছে না, এইটা ঘোষণা করে বলার মধ্যে অভীক সেনের গৌরবের পরিচয় কোথায়?
অভীক গম্ভীর গলায় বলে, ‘সব ভয়—ই যে সত্যি ভয় তা নাও হতে পারে।’
‘দেখে তো তা’ মনে হয় না।’
বলে অলকা।
যেন উত্তেজিত ভাবেই বলে, ‘আমার কেবল মনে হয়, উনি ওঁর নিজের শিল্পীসত্তার মূল্য কতটা তার খবর রাখেন না। উনি ওঁর ওই বাধ্য ছোট ভাই লক্ষ্মণ দেবর আর ভদ্র সামাজিক মানুষের সত্তাটাকেই পরম মূল্য দিয়ে রেখে দিয়েছেন।
স্মরজিৎ…গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘চলুন ব্যাণ্ডেল পার্কে যাওয়া যাক।’
অলকা ছেলেমানুষের মত হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, ‘কী মজা! কী মজা!’
তারপর হেসে হেসে বলে, ‘সাধে আর আপনাকেই জায়গা নির্বাচন করতে বললাম। জানলাম তো আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতার সঞ্চয় রয়েছে।’
সেদিনটাকে সবটাই গ্রাস করে নিল স্মরজিৎ। স্মরজিৎ নিজের গাড়ি চড়িয়ে বেড়িয়ে আনলো, নিজের পকেট হালকা করে খাওয়ালো এবং পৌঁছেও দিয়ে গেল বাড়ি অবধি।
স্বভাবতঃই অলকার কথা হাসি সবই স্মরজিৎ অভিমুখী হতে থাকলো।
অভীক একটা মৌন দাহ নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
শুধু দাহর একটু প্রকাশ হয়ে গেল স্মরজিৎকে বিদায় দেবার সময়।
বললো, ‘খুব তো ঘোষণা করে বলা হলো, পাখিজুকি খাই না এখন ধর্মে দিয়েছি মন—দেখে তো তা মনে হল না।’
স্মরজিৎ হেসে বললো, ‘পুরনো পাপী তো? এমন হয়ে যায়। তবে ভয় নেই আর জ্বালাতনে ফেলবো না, একেবারে নেমন্তন পত্তর নিয়ে আসছি।’
অভীক তীব্র দৃষ্টিতে ওর গাড়ির নম্বরটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
অভীকের মনে হলো আজকের দিনটা একেবারে বরবাদ গেল।
আর অদ্ভুত মনোভাবে মনে হলো, অভীকের একটা সম্পত্তি যেন স্মরজিৎ অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করে নিতে এসেছে।
আশ্চর্য্য! কোথা থেকে যে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
এটা ভাবলো না, ওই অলকা নামের মেয়েটা ‘আমার সম্পত্তি’ কেন?
বাড়ি ফেরার সময়টা অফিস টাইমের কাছাকাছি, অতএব নিশ্চিন্ত হয়েই দরজায় বেল দিল। সঙ্গে সঙ্গে খুলেও গেল দরজা, কিন্তু যিনি খুললেন, তিনি আর কেউ নয়, স্বয়ং দাদা—শ্রীঅবনী সেন।
অবনী সেন চিরদিনই ধৈর্য্যের জন্যে বিখ্যাত, তবু আজ অধৈর্য্য হলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তুমি আজ অফিস যাওনি?’
একেই মেজাজ ছিল খিঁচড়ে, আবার এসেই এই।
তার মানে সেই পাহারা।
অভীক দপ করে জ্বলে উঠে বললো, ‘আমার ওপর পাহারা দেওয়ার কাজটা তা হলে ঘরে বাইরে চলছে?
অবনী সেন অবাক হল না, আর ওই চিরপরিচিত মুখটায় অপরিচয়ের ছায়া দেখে রমলার মত ভয়ও পেল না। গম্ভীর হয়ে বললো, ‘সেটা যখন বুঝতেই পেরেছো, তখন আর একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল।
‘তার মানে?’
‘মানেটা তোমাকে বোঝাবার সময় এখন আমার নেই। তবে দোতলার মনিবাবু এসে আমায় যাচ্ছেতাই শুনিয়ে গেছেন সেটাই জানিয়ে রাখলাম তোমায়।’
অভীক ভিতরে ভিতরে একটু নিভে গেল।
তবু মুখে জোর দেখিয়ে বললো, ‘এর মধ্যে মনিবাবুর সম্পর্কটা কী?’
‘সম্পর্ক এই, তুমি মনিবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে একটা জটিল সম্পর্ক বাধিয়ে তুলছো বলে?’
দাদা চলে গেল।
এরপর এলো বৌদি।
বললো, ‘কিছু খাবার মত জায়গা পেটে আছে না সবটা ভরিয়ে এসেছো?’
রমলা ওকে ‘তুমি’ বললো।
অভীক উদ্ধতভাবে বলল, ‘জায়গা নেই।’
‘জানতাম।’
রমলার সেই হাঁসফাঁস ভাবটা গেল কোথায়, রমলা অমন স্থির হয়ে আছে কী করে?
রমলা শান্ত গলায় কথা বলতে শিখেছে।
‘তোমার দাদার সুখে দুঃখে মাথাটা কখনো হেঁট হয়নি, আজ হলো। দোতলার মনিবাবু যা তা বলে গেল, বলবে না কেন, সুযোগ পেয়েছে যখন।’
অভীক কোন কথা বললো না।
রমলা আবার বললো, ‘ভদ্রলোক বলে গেল ‘দু—দশখানা বই লিখেছেন বলে উনি কি ভেবেচেন সমাজের মাথা কিনেছেন? আমার স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে যাবার উনি কে?’
‘ওঁর স্ত্রী নাবালিকা?
‘নাবালিকা কি সাবালিকা তা জানি না বাবা, তবে ওনার বাড়ির চাকরই বলেছে, ‘মা বাড়িওয়ালার ভাইয়ের সঙ্গে কোথায় চলে গেলেন।’ তা কেনই বা নিয়ে যাওয়া বাবা?’
‘আমি এ সম্পর্কে আর আর একটাও কথা বলবো না।’
বলে ঘরের মধ্যে চলে যায় অভীক।
আজকের দিনটাই অশুভ।
আশ্চর্য্য। অলকা বলেছিল ওর স্বামী রাত দশটায় আসবে।
মানুষ কত বদলাতে পারে। কত দ্রুত বদলাতে পারে।
কদিন পরে কোন এক সময় অবনী সেনের চিরকালের স্নেহবাধ্য ছোট ভাই উদ্ধত মূর্তিতে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বিনা ভূমিকায় বলে ওঠে, ‘দাদা, ভাড়াটেকে নির্দেশ দিলেই উঠে যেতে বাধ্য?’
অবনী সেন স্থির স্বরে বলে, ‘আইনে তা বলে না।’
‘আইনে বলে না! অথচ তোমার ভাড়াটে নোটিশ পেয়েই চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।’
অবনী খবরের কাগজ পড়ছিল, একটা জরুরি খবরের ওপর চোখ রেখে বললো, ‘তাহলে বুঝতে হয় বাধ্য হয়ে নয়, স্বেচ্ছায়ই যাচ্ছেন।’
‘এই বাজারে এমন চমৎকার একটা ফ্ল্যাট পাওয়া নিশ্চয়ই সহজ নয়? কি করে ভাবা যাবে উনি স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন।’
‘সাধারণ বুদ্ধিটা হারিয়ে না ফেললে বুঝতে পারতে। যেতে বাধ্য নয়, তবু চলে যাচ্ছেন, এ থেকেই বোঝা যায় কারণটা অন্যত্র।’
তারপর কাগজটা মুখ আড়াল করে ধরে সহজভাবে বলে, ‘আমাকে নোটিশ দিতে হয়নি, উনিই নিজে নোটিশ দিয়েছিলেন। আজ চলে যাচ্ছেন। এখানে তাঁর নানা অসুবিধে হচ্ছিল।’
কথার সুরে মনে হলো এতে বড় সুখী হয়েছে অবনী।
ওইটা যদি মনে না হতো, হয়তো ব্যাপারটাকে বুঝতে পারতো। বুঝতে পারতো দোষটা দাদার নয়।
কিন্তু পারলো না, তাই সব দোষটা দাদার ওপর চাপিয়ে একটা বড় কিছু প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করে বসলো।
কিন্তু কীইবা প্রতিশোধ নিতে পার তুমি অভীক, ওই কৃতী আত্মস্থ স্বয়ং নির্ভর ব্যক্তিটির উপর? বাইরে কোন স্কোপই নেই নেবার।
আছে যা তা ভিতরে।
একেবারে অন্তরের অন্দর মহলে।
তবে সেখানেই আঘাত হানো।
একেবারে মর্মমূলে ছুরি বিঁধিয়ে উপড়ে তুলে নাও সেই আশাটুকুকে, সেই ভালবাসাটুকুকে।
এতোদিন ধরে যেটুকুকে সমস্ত হৃদয় দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল ওরা। অবনী সেন আর তার অবোধ স্ত্রী রমলা সেন।
এখানে নাকি অভীকের লেখাটেখার অসুবিধে হচ্ছে, তাই অন্যত্র থাকতে যাবে সে।
ছোট্ট একটু চিরকুটে বক্তব্যটিকে লিখে দাদার টেবিলে পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রেখে এল অভীক। প্রতীক্ষা করতে লাগলো প্রতিক্রিয়ার। কিন্তু কোন সাড়া নেই।
মানেটা কী?
দেখতে পায়নি, না কী?
নাকি না পাওয়ার ভান।
ঠিক আছে সোজাসুজিই বলে দেবো। এতো ভয় কিসের?
তা সোজাসুজি বলার পরিশ্রমটা আর করতে হল না।
খেতে বসে অবনী বললো, ‘ওরে এই কাগজটুকু কি তোর উপন্যাস—টুপন্যাসের কিছু?’
বাঁহাতে ছিল সেটা এগিয়ে ধরলো।
অভীক ভাবলো, ওঃ কায়দা। হাতে নিল না। শুধু বললো, ‘ওটাকে কি তাই মনে হচ্ছে তোমার?’
‘তাই তো ভাবছিলাম, হয়তো হঠাৎ এসে পড়া কোনো ‘থট’ তাড়াতাড়ি—’
অভীক বেশ শান্ত স্থির গলায় বললো, ‘না হঠাৎ এসে পড়া কোনো ‘থট’ নয়, ওটা অনেকদিন ধরে ভেবে স্থির সিদ্ধান্ত!…এখানে আমার লেখাটেখার অসুবিধে হচ্ছে।’
কিছুদিন আগে হলেও রমলা তাড়াতাড়ি দুই ভাইয়ের কথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো, বোকার মত কথা—টথা বলে, পরিস্থিতিটা হালকা করে দিতো, পরিণামটাকে ঠেকাতো।
কিন্তু এখন রমলা শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ওই কঠিন কঠোর মুখটার দিকে চেয়ে।
রমলা যেন একটা মাতৃশোক অনুভব করছে।
রমলা আর কোনোদিন ওই ছেলেটাকে ‘তুই’ করে কথা বলতে পারবে না, রমলা আর কোনোদিন ওর থালায় জোর করে কিছু বাড়তি খাবার চাপিয়ে দিতে পারবে না।
হয়তো ও যখন চলে যাবে, তখন তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে বলতে পারবে না ‘ঠিকানাটা দিয়ে যাও?’…বলতে পারবে না, ‘একবার এসো—’
অবনী অবাক হয়ে বললো, ‘এখানে তোমার অসুবিধে হচ্ছে? বাচ্চা টাচ্চা নেই বাড়ীতে।’
‘তাহলেও, পরিবেশটা অসুবিধের।’
‘এই পরিবেশের মধ্যেই তুই নামকরা লেখক অভীক সেন হয়ে উঠেছিস, অভী।’
‘আমার আরো সম্ভাবনা ছিল। সে যাক, সে তোমাদের বোঝানো যাবে না। এখানে আমি চিন্তা করতে পারছি না—’
অবনী সেন লাভ ও লোকসানের হিসেব খতাতে ভুলে গিয়ে বলে, ‘তা তাই যদি তোর মনে হয়, দোতলাটা তো খালি পড়ে রয়েছে, সেখানেই থাক না। কেউ তোকে ডিসটার্ব করতে যাবে না।’
অভীক একটু বাঁকা বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে, ‘সে ও তো তোমারই দয়ার আশ্রয়।’
‘দয়ার আশ্রয়। আমার দয়ার আশ্রয়?’
‘তাছাড়া আর কী?
‘তার মানে তুই এতোদিন আমাদের দয়ার আশ্রয়ে ছিলি, অভী!’
অভীক সেন এসব সেণ্টিমেণ্ট পছন্দ করে না। তাই সোজা শক্ত গলায় বলে, ‘ভেবে দেখ তাই কি না। এ বাড়িতে আমার কোনো দাবি আছে?’
অবনী বলে, ‘বেশ তাই যদি মনে হয়, আমি বাড়ির অর্ধেকটা তোর নামে লেখাপড়া করে দিচ্ছি।’
অভীক সেন ওই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎ সে হো হো করে হেসে ওঠে।
সিনেমার নায়কের মত টেনে টেনে শুকনো হাসি।
তারপর?
তারপরের ঘটনা বড় দ্রুত প্রবাহিত।
একটা ‘বিরাট সম্ভাবনার বীজ’ বহন করে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে যখন চোখে প্রায় ধোঁওয়া দেখছে অভীক সেন; আর ভাবছে ‘অলকা’ নামের সেই মেয়েটা শহরের এই জনারণ্যে কোথায় হারিয়ে গেল? যে মেয়েটা বলেছিল—’ওদেশের যে কোন বিখ্যাত কবি শিল্পী বা সাহিত্যিকের একটি বিশেষ প্রেরণা—দায়িনী থাকে, থাকে বিশেষ ভালবাসার পাত্রী। এদেশে কবি শিল্পী লেখক টেখকদের ওপর ও সাধারণ মানুষের মত সমান আইন। ভাবলে, অবাক লাগে।’
অভীক অলকার ঠিকানা জানে না, কিন্তু অলকাতো অভীকের জানে?
সেই জানার পরিচয়টুকু দিচ্ছে না কেন?
প্রেরণার অভাবে যে অভীক সেনের কলম বন্ধ হবার জোগাড়।
কিন্তু ও আসার আগে কী লিখতাম না আমি?
ভাবতে চেষ্টা করে অভীক।
তখন মনে হয় যা লিখেছি সব জোলো জোলো পানসে। ওতে আর আত্মসন্তুষ্টি নেই। সেই লেখা কোথায়? যা অভীক সেনের বিদ্রোহী আত্মার দৃপ্ত প্রতিবাদকে প্রতিফলিত করবে? যা তীব্র তপ্ত মদের মত?
সেই লেখাটা আসে না, কিন্তু সত্যিকারের তীব্র তপ্ত মদটা আসতে পারে।
অলকার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে যায়।
‘কই আপনার ঘরে তো বোতল টোতল দেখি না। তবে যে শুনি লেখকদের ঘরে ওটা থাকেই।’
হেসে উঠেছিল অভীক, ‘কার কাছে শুনলেন?’
‘এই সব বন্ধু—টন্ধুর কাছে। তারা বলে, ওসব না খেলেটেলে নাকি লেখা আসে না।’
সেদিন হেসেছিল অভীক, এখন হাসে না। এখন দেখে কথাটা ঠিক।
তাই এখন হাসে ‘এতোকাল কী বোকার মত শুচিবাই ছিল তার।’
কিন্তু স্মরজিতের সেই নেমন্তন্নপত্তরটার কী হল?
সন্ধান করলে হয়।
গেল একদিন, বাড়ির দরজার কাছেই দেখা। ফিরছে কোথা থেকে।
অভীককে দেখে হৈ হৈ করে উঠলো যথারীতি। ‘কী ব্যাপার? আর নতুন বইটই বেরোতে দেখছি না। অথচ বাড়িতে গিয়ে শুনলাম লেখা—টেখার অসুবিধে হচ্ছিল বলে দাদার বাড়ি থেকে কোথায় চলে গেছিস—’
অভীক বললো, ‘গিয়েছিলি কেন? নেমন্তন্ন পত্তর নিয়ে?’
স্মরজিৎ মুচকে হেসে বলে, ‘না ভাই, ওটা এখন স্থগিত রাখলাম।’
আর একটু হেসে বললো, ভাবলাম—’ওটা তো হাতের পাঁচ আছেই। শেষবারের মত একবার চুটিয়ে অবৈধ প্রেমটা করে নিই।’
‘ওঃ। বড় ভাল সংবাদ! তা এটি কোন বনের হরিণী?’
স্মরজিৎ রহস্যময় হাসি হেসে বলে, ‘ধীরে বন্ধু ধীরে। দেখাবো। আয় গাড়িতে উঠে আয়।’
‘থাক থাক পরে দেখলেই হবে।’
‘আরে বাবা আয় না। এক্ষুণি তো বাড়ি ফিরছিলাম না।’
‘তবে?’
‘একটা জিনিষ ফেলে গিয়েছিলাম তাই। ঠিক আছে পরে নিলেও চলবে। আয় চলে আয়।’
তখনও দেখা যাচ্ছিল না তাকে।
কোন চেপে বসেছিল।
উঠতে গিয়ে দেখতে পেল।
কিন্তু তখন কি বলে উঠবে অভীক, ‘অলকা তুমি এখানে? আর আমি তোমায় খুঁজে খুঁজে—তোমার জন্যে আমার লেখা বন্ধ হয়ে গেছে। তোমার সেই স্বামীটা তোমায় কী যন্ত্রণা দিচ্ছে ভেবে আমার রাতের ঘুম চলে গেছে।’
না এসব বলা যায় না।
যা বলা যায় তাই বলে ওঠে।
বলে, ‘বাঃ এবার তা হলে বড় গাছে নৌকো বেঁধেছো।’
স্মরজিৎ বলে, ‘বিদ্রূপ কোরোনা বন্ধু, ওর কী যন্ত্রণাময় জীবন ছিল, তা তুই একবাড়িতে থেকেও কোনদিন সন্ধান করিস নি। সেই পাজী রাস্কেলটা ওকে মেরেছে পর্যন্ত!’
অলকা বলে ওঠে, ‘থাক স্মরজিৎ, ওসব কথা তুলে যন্ত্রণাটা নতুন করে মনে পড়িয়ে দিও না। আমায় ভুলে থাকতে দাও। সেই সেদিন যেদিন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হ’ল? আমার জীবনের সেটা এক পরম শুভদিন।’
অভীকের মুখটা পেশী পেশী দেখায়, অভীকের ঠোঁটের রেখাটা বাঁকা দেখায়।
অভীক ভেবে পায় না ওই অর্দ্ধসমাপ্তের মত বেশবাস পরা অসভ্য মেয়েটার জন্যে এতোদিন ধরে এমন অস্থির হয়ে বেড়াচ্ছিল কেন? ওর সম্মানে ঘা লাগার আশঙ্কায় অভীক অবনী সেন নামের একটা মানী লোকের সম্মানে আঘাত হেনেছিল না? একটা সুখী সুখী মুখ মানুষের মুখের সেই ‘সুখ সুখ’ ছাপটা মুছে দিয়েছি।
তারপর?
তারপর তো অভীক সেন স্মরজিতের গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল ‘কাজ আছে’ বলে।
তারপর?
তারপর এই সেদিন গিয়ে দেখি একটা আজে বাজে মেস বাড়ির ভাঙা তক্তপোষের ওপর রাজ্যের কাগজ পত্র ছড়িয়ে বসে আছে অভীক সেন। চোখে আগুনের জ্বালা।
হাতের কাছে পানপাত্র।
হয়তো এইবার তার সেই আসল লেখার জন্ম লগ্নটি আসছে।
যার থেকে অভীক সেন পৃথিবীর লেখকদের একজন হয়ে যাবে।
কিন্তু এখন কিছু হচ্ছে না।
এখন লেখা নিতে এসে হতাশ হয়ে ফিরছে সম্পাদকের লোক। এখন লেখা চেয়ে চেয়ে যাওয়া বন্ধ করছে ‘লেখা’ নিয়ে যাদের কারবার।
পাঠক পাঠিকারা হতাশ হয়ে অন্য ডালের ফুল তুলতে চলে যাচ্ছে।
অভীক যেন তার ‘সিদ্ধপাত্র’ হাতে নিয়ে তার ‘আসল’ লেখার আবির্ভাবের পদধ্বনির আশায় কান পেতে বসে আছে।
আর লোকে বলছে ‘অভীক সেন? ওর বারোটা বেজে গেছে।’
ওদিকে এক নিঃসন্তান প্রৌঢ় দম্পতি স্তব্ধ হয়ে বসে বসে অতীতের দিকে পিছু হেঁটে হেঁটে চলে যায়। ভাবে যদি সেদিন ওই নতুন ভাড়াটেরা না আসতো। যদি ওদের ওই বৌটা অমন জাদুকরী না হতো।…যদি আমরা গোড়ায় খুব সাবধান হতাম।’