Accessibility Tools

দশন – অভিষেক সেনগুপ্ত

দ্য লন্ডন ক্যাফে

নিঃস্তব্ধতারও একরকম ভাষা হয়। খুব গম্ভীর শব্দজালে ঘেরা। চোখ অনুধাবন করতে পারে না। পড়তে পারে না। একমাত্র অনুভূতি দিয়ে বোঝা যায় ওই শব্দগুচ্ছের মানে। ডায়মন্ড প্রেস্টিজ বিল্ডিংয়ের দশতলা থেকে নেমে ইলিয়েট রোডে পা দিতেই নিঃস্তব্ধতা ঘিরে ধরল কৃশকে। দিনের বেলায় অটো-বাসের হর্নে, ট্রাম চলার আওয়াজে, দোকানপাট, পথচলতি লোকের ভিড়ে জায়গাটা গমগম করে। নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো ক্রসিংটা এখন অখণ্ড শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। সোডিয়াম ভেপারের হলদেটে আলো ধুয়ে দিচ্ছে জায়গাটা। ডানহাতে ইলিয়ট রোড। সর্পিল রাস্তার গায়ে ছোপ ছোপ আলো আঁধারির কোলাজ। নীরবতার খোলস হয়ে উঠেছে অর্থপূর্ণ রাত। যেন উপলব্ধির জানলা খুলে দিলেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে এই রাতের মানে।

ইলিয়ট রোড ধরে কৃশ হাঁটা লাগাল বাটা মোড়ের দিকে। ওখান থেকে বাঁদিকে টার্ন নিলেই পার্ক স্ট্রিট। একটি নামী বাংলা দৈনিকের ওয়েবসাইটে একমাস হল চাকরি করছে কৃশ। ওর রোজই নাইট ডিউটি। রাত বারোটা থেকে সকাল সাতটা। ক্লাসিকাল মিউজিক নিয়ে সে পিএইচডি করছে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। মাসে একটা নির্দিষ্ট স্টাইপেন পায়। তাতে ওর চলে না। আসানসোলের কুলটিতে রয়েছে তার পরিবার। চাপ হলেও বাবা, মা আর দুটো ছোট ভাইবোনের জন্য বাড়তি রোজগারের এই রাস্তাটা বাছতে হয়েছে কৃশকে। যদিও নিউজপেপার ওয়ার্ল্ড তাকে টানে। চ্যালেঞ্জিং জব। গ্ল্যামার আছে। সে জার্নালিস্টই হতে চায়। তবে ওয়েবসাইটের কাজের পদ্ধতি অন্যরকম। ফিল্ড ওয়ার্কের সুযোগ নেই। মূলত ডেস্ক ওরিয়েন্টেড কাজ। দেশ-বিদেশের খবর বাংলায় অনুবাদ করা। পিএইচডিটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এটা তার পক্ষে ভালোই। পুরোমাত্রায় সাংবাদিকতা করলে পড়াশোনা ডকে উঠবে।

নাইট শিফটে সাধারণত দু’জন থাকে। কৃশের সঙ্গে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একজন সিনিয়র। আজ যেমন অনুরূপদা রয়েছেন। মানুষটা ভারী মজার। কুড়িবছরেরও বেশি এই ফিল্ডে রয়েছেন। সমস্ত কাগজ ও কর্মরত সাংবাদিকদের নাড়ি-নক্ষত্র জানেন। কলকাতা শহরের ইতিহাস নিয়ে অগাধ জ্ঞান। ওঁর দুটো বইও আছে। অনুরূপদা থাকলে গল্পে-গল্পে রাতটা কেটে যায়। তাকে বেশ পছন্দ করেন উনি।

অফিসে আসার আগে রাতের খাবারটা মেসে খেয়ে আসে। প্যান্ট্রি থেকে চা-কফি খেয়ে নেয় কয়েকবার। না হলে ঘুম পেয়ে যায়। কলকাতায় আসার পর চায়ের নেশাটা হয়েছে। আজ প্যান্ট্রির কফি মেশিনটা বিগড়েছে। কিছুক্ষণ পর থেকেই ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল কৃশের। রাশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের ওপর দুটো ফলোআপ কপি লেখার পর হাত জমে গেছে। অনুরূপদা তাকে ঢুলতে দেখে বলেছিলেন, ‘বাবা কৃশ, রাশিয়ার রাজনীতি যে তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে! যা একটু চক্কর দিয়ে আয়। চা-কফি খেয়ে আয়। আর পারলে আমার জন্যও নিয়ে আয়। ততক্ষণ তোর ম্যাচটা ততক্ষণ আমি খেলে দিচ্ছি।’

বাটা মোড় থেকে বাঁদিকে টার্ন নিলেই একটা চায়ের দোকান রাতভোর খোলা থাকে। ছোট ফ্লাস্ক হাতে ধরিয়ে অনুরূপদাই সন্ধান দিয়েছিলেন। কৃশ এসে দেখল দোকানটা বন্ধ। প্রায় পনেরো মিনিট হেঁটে তার ঘুম উড়ে গেছে। কিন্তু চা-তেষ্টাটা বেড়েছে। বন্ধ চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তি লাগল তার। এবার কী করবে? যে সব বন্ধুদের কলকাতায় বাড়ি, তারা বলে, যতদিন যাচ্ছে কলকাতা নাকি মুম্বইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে। রাত জাগার প্রবণতা বাড়ছে। এই তার নমুনা? পার্ক লেন ধরে দু’পা হেঁটে গেলে পার্ক স্ট্রিট। ওদিকে কি কোনও দোকান পাওয়া যাবে?

রাত দুটো বাজে। বাঁদিকে, অ্যাসম্বলি অফ গড চার্চ পেরিয়ে মল্লিক বাজার। ওদিকটায় কিছু নেই। কৃশ পার্ক হোটেলের দিকে হাঁটা লাগাল। পার্ক স্ট্রিটটা এখন শুনশান। স্ট্রিট লাইটের হলদেটে আলো গাছের পাতায় পড়ে গুড়োগুড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। একটা সন্ধে-সন্ধে ভাব। কৃশের হাঁটতে ভালো লাগছে। আবহ সঙ্গীতের মতো তাকে ঘিরে চলেছে কিছু শব্দ। পাতা ওড়ার খসখসে আওয়াজ। বাতাসের ফিসফিসানি। তার পদধ্বণি। ফুটপাথের দু’ধারে দঁড়িয়ে থাকা কয়েক’শো বছরের পুরোনো বাড়িগুলো নীরব, নিথর। গভীর ঘুমে তলিয়ে।

কৃশ রাতে কখনও পার্ক স্ট্রিটে না এলেও জানে, এই রাস্তাটা আসলে শহরের প্রাণ। এখানকার পাবগুলোয় অনেক রাত পর্যন্ত হুল্লোড় হয়। গান-বাজনা-খানাপিনা চলে। মোকাম্বো, ট্রিঙ্কাস নিশ্চয় খোলা। কিন্তু এই রাতে ওখানে গেলে চা-কফি কেউ দেবে না। পেলেও বেশ খরচাসাপেক্ষ। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ছাড়িয়ে একটু হাঁটলে পার্ক স্ট্রিট থানা। এই পথটুকু হেঁটে আসার পর কৃশের মনে হল, আজ পার্ক স্ট্রিট কোনও কারণে জনবিরল। রাস্তার ধারে কয়েকটা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। সাওয়ারি পাওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই বলে গাড়ির বনেটের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে ড্রাইভার। চোখ সোজা গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে চৌরঙ্গি রোডে। নাহ্, সব ফাঁকা। কৃশ বুঝতে পারল, সোজা হেঁটে কোনও লাভ হবে না। সে ক্যামাক স্ট্রিটে ঢুকে পড়ল। এই রাস্তাটাকে কলকাতার ফ্যাশন স্ট্রিট বলা যেতে পারে। নামী ব্র্যান্ডের ফ্যাশন স্টোরের পরপর দোকান। সামনে বর্ধন মার্কেট। কৃশ ভাবল, আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখবে। যদি না পায়, ফিরে যাবে অফিস।

চাওয়া আর পাওয়া একসঙ্গে মিলে যায় অনেক সময়। ইলিয়ট রোড থেকে এতখানি পথ হেঁটে আসার পর যে বিরক্তিটা ক্রমশ ফুটে উঠছিল, সেটা মিলিয়ে গিয়ে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল কৃশের মুখে। ক্যামাক স্ট্রিট ধরে একটু হেঁটে এগোলেই ডানহাতে স্যার উইলিয়াম জোন্স সরণি। তারই এককোণে একটা ক্যাফে! সামনের রাস্তা ভিজিয়ে দেওয়া আলো দেখে মনে হচ্ছে, ক্যাফেটা খোলা!

‘দ্য লন্ডন ক্যাফে’! কফি শপটার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে পড়ল কৃশ। এমন নাম সে আগে কখনও শোনেনি। যদিও শহরের নানা কফি ঠেকে ঘুরে বেড়ানোর নেশা বা পকেটের জোর কোনওটাই তার নেই। তবু তার শোনা উচিত ছিল বলে মনে হচ্ছে। কারণ ক্যাফেটেরিয়ার সাইনবোর্ডে লেখা ‘সিন্স ১৮৯৩!’ মানে এই ক্যাফেটার বয়স একশো পঁচিশ বছর! ঠিক দেখছে তো সে? উইলিয়াম জোন্স সরণিতে একটাও দোকান নেই। কিছু পুরোনো বাড়ির ভিড়। তেমনই একটা প্রাচীন বাড়ির তলায় এই ক্যাফেটা। সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে কাঠের পাল্লা, বাইরে সরু, লম্বাটে পদ্মফুলের মতো কাজ করা তারের হোল্ডারের ওপর নিভু বাল্ব। সবই যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের। একটু ইতস্তত করলেও নেশার তাড়নায় সুইং ডোরটা ঠেলে ক্যাফেটাতে ঢুকে পড়ল কৃশ। সে ঠিকই ভেবেছিল, ক্যাফেটা খোলাই। ভেতরটা বেশ বড়। ঘরটার এককোণে স্যুটহোল্ডার। পুরোনো দিনের ক্যাফেতে এমন থাকত। কাস্টোমাররা এসে তাঁদের স্যুট, টুপি খুলে রাখতেন হ্যাঙ্গারে। এখন দুটো টুপি ঝুলছে সেখানে। ঘরের অন্য কোণে বার কাউন্টার। একসময় ক্যাফেতে কফি-চা-স্ন্যাকসের সঙ্গে ওয়াইন বা হার্ড ড্রিঙ্কসও পাওয়া যেত। এখন অবশ্য তা হয় না। এরা তাহলে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সামনের ফ্লোরে তিন-চারটে চেয়ারে ঘেরা ছোট-ছোট টি-টেবল। অধিকাংশ ফাঁকা হলেও একটা টেবলে দু’জন বসে রয়েছেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত হল সে। দোকানের মালিক যদি প্রাচীনত্বের সামঞ্জস্য রাখেন, তাহলে চা বা কফির দামও খুব বেশি হবে না নিশ্চয়। সে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল কাউন্টারে।

‘ইয়েস জেন্টলম্যান? মাই নেম ইজ অ্যালবার্ট। হাও ক্যান আই হেল্প ইউ?’

এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছে কৃশের সামনে। লোকটার পোশাকও ক্যাফের সঙ্গে মানানসই। ডগকলার শার্ট, পুরোনো টাইপের বো, প্যান্টের সঙ্গে গ্যালিস পরা। এমনকি চুলের স্টাইলটাও মান্ধাতা আমলের। মোটা জুলপি কানের লতি ছাড়িয়ে নেমেছে অনেকটা। কৃশ মুগ্ধ হল। মোবাইল, কম্পিউটার, ফোর-জির যুগে এই ক্যাফে ওল্ড ফ্যাশনের প্রদর্শনী।

এদের কাউন্টারবয় বলে। অ্যালবার্টকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘কফি বা চা পাওয়া যেতে পারে?’

‘পাইবে বাবু! টবে, টি অর কফি?’

লোকটার বাংলায় পরিষ্কার ইংরেজি টান। অ্যাকসেন্ট শুনে ব্রিটিশ মনে হচ্ছে। এখানে এসে বাংলাটা শিখেছে। আর সেটা সাধুভাষায়। কৃশের মজা লাগল।

‘চা বা কফির কী দাম?

‘এক পেয়ালা টি-র জন্য লাগিবে ফাইভ সেন্ট। ওয়ান শট স্ট্রং ব্ল্যাক কফি টেন সেন্ট।’

‘সেন্ট!’ নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল কৃশ। এই কলকাতায় সেন্ট চলে এখনও। ইংল্যান্ডের টাকাকে বলা হয় পাউন্ড, আর পয়সাকে সেন্ট। কলকাতার কোনও ক্যাফেতে পাউন্ড, সেন্ট চলতে পারে, তার ধারণাই ছিল না। কৃশ ঘাবড়ে গেল।

‘কিন্তু আমার কাছে তো পাউন্ড বা সেন্ট নেই। টাকা আছে। চলবে না!’

‘চলিবে। টুমি আমাকে টাকাই দিবে, বাবু! এক পেয়ালা টি পাঁচটাকা, ব্ল্যাক কফি দশটাকা।’ হেসে বললেন ভদ্রলোক।

আজকাল রাস্তার চায়ের দোকানেই মাটির ভাঁড়ে চা খেতে গেলে কড়কড়ে দশটা টাকা দিতে হয়। কৃশ খুশি হল। নিজের জন্য এককাপ চা অর্ডার করল। আর ফ্লাস্কটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এতে এককাপ স্ট্রং ব্ল্যাক কফি দিয়ে দেবেন, নিয়ে যাব।’

‘টুমি আসন গ্রহণ করিও, বাবু!’ বলে লোকটা কিচেনে মিলিয়ে গেল।

ক্যাফেতে ঢোকার সময় কোণের একটা টেবলে দু’জন লোককে দেখেছিল কৃশ। টেবলের দিকে মনোযোগ দিয়ে তারা একইরকম ভাবে বসে আছে। যেন তাকে দেখতেই পায়নি।

কিছুটা দূরে একটা টেবলে বসল কৃশ। একটা সোঁদা গন্ধ রয়েছে ক্যাফেটায়। যেন অনেকদিন বন্ধ ছিল। এই কিছুক্ষণ আগে খোলা হয়েছে। কৃশ যে দিকটাতে বসেছে, সেখানে একটা ফায়ারপ্লেস রয়েছে। তার ওপর এক সাহেবের ওয়েল পেন্টিং। সাইড ফেসের ছবি। হান্টার টুপির পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে পনিটেল। মুখে একটা মোটা চুরুট। ছবিটা গম্ভীর হলেও সাহেবের মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে রয়েছে। শিল্পীর তুলিতে সুখের মুহূর্ত ফুটে উঠেছে। ক্যাফের দেওয়ালে রঙিন পেপার চেন ঝুলছে। বেলুনও। ক্যাফেটার প্রতিষ্ঠা দিবস নাকি, কে জানে!

‘বাবু, টুমি ঠিক অনুমান করিয়াছো। অদ্য রজনীতে দ্য লন্ডন ক্যাফের একশত পঁচিশ বৎসর বয়স হইল।’ টেবলে ধূমায়িত চায়ের সুদৃশ্য কাপ রাখতে রাখতে বলল অ্যালবার্ট।

‘বার্থডে বলিয়া, টোমায় ছোট্ট গিফট।’ কাঠের একটা ট্রে টেবলে নামিয়ে রাখল লোকটা। তাতে চারপিস স্যান্ডুইচ। এক তো একটা ভিন্টেজ ক্যাফে, তার ওপর একপ্লেট গরমাগরম স্যান্ডুইচ। কৃশেরর খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

‘বাবু, টুমি এখানে একলা বসিয়া আছো। চাহিলে ওই দুই জেন্টলম্যানের সহিত বসিতে পারো।’ হাসি মুখে জানাল অ্যালবার্ট।

কৃশের ইচ্ছে নেই। বিশেষ করে ওই দু’জন অচেনাই শুধু নয়, তারা নিজেরা কিছু একটা নিয়ে মগ্ন।

পেছন থেকে একটা ঘষা গম্ভীরগলা ভেসে এল। ‘লজ্জা পাইও না, বাবু। উভয়ে শতরঞ্জ খেলিতেছি। প্লিজ জয়েন আস!’

কৃশ এবার বেশ অবাকই হল। এরাও সাধুভাষায় বাংলা বলে! ঢোকার সময় লোক দুটোর ওপর একবার চোখ বুলিয়েছিল সে। ইংরেজ বলেই মনে হয়েছে। এতরাতে নিশ্চয় তারই মতো কফি খেতে এসেছে। কৃশ একটু ইতঃস্তত করছিল। কেউ এভাবে আমন্ত্রণ জানালে তারপরও না যাওয়াটা অভদ্রতা। ইচ্ছে না থাকলেও সে উঠে এসে বসল দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে একই টেবলে। একজনের বয়স হয়েছে। অন্যজনের অল্পবয়স। কৃশের থেকে সামান্যই বড় হবে।

বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, ‘মাই নেম ইজ অ্যালান হ্যাক্নে। অ্যান্ড হি ইজ ফেড্রিক অ্যালার্টন। মাই নেফিউ। টোমাডিগের বাংগালিতে, ভাটুসপুট্রো!’

কৃশের হাসি পেয়ে গেল। সে বলল, ‘বাহ, আপনি চমৎকার বাংলা বলেন তো?’

হ্যাক্নেসাহেবও মজা পেয়েছেন। হোহো করে হেসে উঠলেন তিনি। ফেড্রিকও নীচুসুরে হাসছে। ‘আমাগিদের খাবার খাওয়া ও চা পান হইয়া গিয়াছে। বাবু, টুমি খাইতে পারো।’

হ্যাক্নেসাহেব এমন ভাবে ‘বাবু’ শব্দটা বললেন, যেন নিজের ছেলেকে আদর করে খেতে বলছেন। কৃশ বলল, ‘বাড়িতে বাচ্চা ছেলেদের আদর করে বাবু বলা হয়। আপনারাও সেটা জানেন দেখছি?’

‘বাচ্চা ছেলেদিগের? কি কহিতেছো টুমি? বাংগালিডের আমরা বাবুই বলে ডাকিয়া ঠাকি। ইহাই তো চলিয়া আসিতেছে ডির্ঘ ডিবস!’ হ্যাক্নেসাহেব অবাক হয়েই বললেন।

কৃশ একটু থমকে গেল। সম্ভ্রান্ত, অভিজাত পরিবারের বাঙালিদের একসময় বাবু বলা হত। পরবর্তীকালে অফিসকাছারিতে যারা কাজ করত, তাদেরও বাবু বলা হত। ক্রমে যে সব ইংরেজ কলকাতা বা বাংলার নানা জায়গায় থাকত, তারাও বাঙালিদের বাবু বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে ইতিহাস তো অনেক আগের। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তো বটেই। এখনও সে রেওয়াজ থেকে যাওয়ার কোনও যুক্তি খুঁজে পেল না।

প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য ভেজ স্যান্ডুইচে একটা পেল্লাই কামড় দিয়ে কৃশ বলল, ‘কতদিন এসেছেন কলকাতায়? কেমন লাগছে শহরটা?’

‘কটোডিন?’ হ্যাক্নেসাহেব একটু থামলেন। তারপর আবার বললেন, ‘কটো বৎসর বলো?’ ফেড্রিকের দিকে একঝলক চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘ফেড্রিক আসিয়াছে একহপ্তা হইবে। কিন্টু আমি, কুড়ি বৎসর এই খ্যালখাটায় রহিয়াছি।’

আজব পাগল তো? কুড়িবছর নাকি এই শহরে রয়েছে অ্যালান হ্যাক্নে? ইয়ার্কি হচ্ছে! সাধুভাষায় বাংলা লেখার চল সত্তর পর্যন্ত ছিল। কথ্যভাষায় তার প্রভাব অনেক আগেই শেষ। আর লোকটা বলে কিনা!

‘ওই অয়েল পেন্টিংটা দেখিতে পাইতেছো, হি ইজ মাই ফাদার। অ্যালডেন হ্যাক্নে। এই ক্যাফেটা আমার পিতাই খুলেছিলেন। দ্য লন্ডন ক্যাফে এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন। উনি প্রয়াত হইয়াছেন। গত কুড়িবৎসর আমিই চালাইতেছি।’ বললেন হ্যাকনেসাহেব।

চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থমকে গেল কৃশ। লোকটা বলে কী? কলকাতা শহরের সবচেয়ে পুরোনো ক্যাফে যদি এটা হয়, তবে হ্যাকনেসাহেব যে সময়সীমা তুলে ধরছেন, সেটা তো বিস্তর আগে। রাতে তাকে একা পেয়ে মজা করতে শুরু করলেন নাকি?

‘বাবু একটা কথা বলো তো? জাপান কি সত্যি এই শহর আক্রমণ করবে?’

হ্যাকনেসাহেবের গলায় পরিষ্কার উদ্বেগ। তাঁর কথা শুনে ঘাবড়ে গেল কৃশ। জাপান কলকাতা আক্রমণ করবে? কই সে তো কিছু জানে না। গত একমাস ধরে সে একটা নামী দৈনিকের ওয়েবসাইটে কাজ করছে। কিন্তু তার তো জানা নেই এমন কিছু। লোকটার মাথা খারাপ নাকি?

অ্যালবার্ট কখন এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে খেয়াল করেনি কৃশ। সে পিছন থেকে বলে উঠল, ‘আমি শুনিয়াছি, জার্মানি সবদিক থেকে আটক করিতে চায় ইংল্যান্ডকে। জাপানি ফাইটার প্লেন এই শহর বোম্বার্ড করিবে। টুমি কিছু শুনো নাই, বাবু?’

ফেড্রিক কথা না বললেও সে ভয় পাওয়া মুখ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে কৃশের দিকে। তিনটে পাগল যেন ঘিরে রয়েছে তাকে। অস্বস্তি হচ্ছে। জাপানি ফাইটার প্লেন কলকাতা আক্রমণ করেছিল একবার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯৪২ সাল নাগাদ। ইংরেজ শক্তিকে যাতে ভেঙেচুরে দেওয়া যায়। বোম পড়েছিল কলকাতায়। সে তো অনেক আগের কথা। কৃশ তো বটেই, তার বাবাও এসব দেখেননি। এরা কোন সময়ের কথা বলতে চাইছে?

কানের পাশ দিয়ে একঝাঁক মশা উড়ে গেলে যেমন আওয়াজ হয়, হঠাৎ তেমনই টানা শব্দ শুনতে পেল কৃশ। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। বিকট হচ্ছে। কীসের আওয়াজ ওটা? কৃশ ঘেমে গেল। তার গলা শুকিয়ে এল। খুব নীচ দিয়ে প্লেন উড়ে গেলে এমন আওয়াজ হয়। এটা একটা নয়, অনেকগুলো প্লেন তীব্র শব্দে বাতাস কেটে উড়ে যাচ্ছে যেন। সত্যিই জাপানি ফাইটার প্লেন ধেয়ে আসছে শহর লক্ষ্য করে?

হ্যাক্নেসাহেবের চাপা আওয়াজ শুনতে পেল সে, ‘ওই যে, শুনিতে পাইতেছো? ওরা আসিতেছে! দে আর কামিং! সুইচ অফ দ্য লাইটস!’

ঝুপ করে ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল দ্য লন্ডন ক্যাফে, হ্যাক্নেসাহেব, ফ্রেডরিক, অ্যালবার্ট। অন্ধকার যেন গিলে নিল কৃশকে।

ওই অবস্থায় খসখসে গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘গেট ডাউন!’ দু’হাতে নিজের মাথা ঢেকে টেবলের তলায় ঢোকার চেষ্টা করল কৃশ। টেবলটা উল্টে গেল। ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল কাপ, ডিশ, স্যান্ডুইচের প্লেট। বিকট শব্দটা ঠিক মাথার ওপর। ফাইটার প্লেন এবার বোম ফেলবে কলকাতা শহরে! তার সাধের শহর। বাবা-মার মুখ ভেসে উঠল কৃশের। এই কলকাতা শহরে কী হচ্ছে, কুলটিতে বসে ওঁরা হয়তো কিছুই জানেন না। হয়তো খবরের কাগজে দেখতে পাবেন, তাঁদের ছেলে মারা গেছে জাপানি ফাইটার বিমানের বোমাবর্ষণে।

আওয়াজটা ক্রমশ বিকট হচ্ছে। তীক্ষ্ণ শিসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। যেন অসংখ্য গাড়ি সেভেন পয়েন্টসে দাঁড়িয়ে হর্ন দিচ্ছে একসঙ্গে। তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল কৃশের। মুখের হাত রেখে চোখ খোলার চেষ্টা করল সে। দুটো সাদা ছায়ামূর্তি দেখতে পাচ্ছে সে। কী যেন বলাবলি করছে তারা। সে কি বেঁচে আছে?

কাঁধ ধরে কেউ একজন ঝাঁকাতে হঠাৎ যেন বাস্তবে ফিরল কৃশ। দু’জন সার্জেন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। এতক্ষণ যে আলোটা তার চোখে পড়েছিল, সেটা তাদের মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলো।

‘শুনতে পাচ্ছেন? ও ভাই? শুনতে পাচ্ছেন কি?’

কৃশের ইন্দ্রিয়গুলো আস্তে আস্তে সাড়া দিতে শুরু করেছে। সে তবু ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখল তার চারপাশে। স্যার উইলিয়াম জোন্স সরণিটা নিঃস্তব্ধ। যেমন ক্যাফেটাতে ঢোকার সময় দেখেছিল। সে এখন রাস্তাতে দাঁড়িয়ে। যতদূর মনে পড়ছে, ক্যাফের ভেতরে ছিল। বাইরে এল কী করে? হ্যাক্নেসাহেব, অ্যালবার্ট, ফেড্রিক কোথায়? ওই বাড়িটার তলাতেই দেখেছিল না ক্যাফেটা? সে সব কিছু নজরে পড়ছে না তার।

কৃশ বিড়বিড় করে বলল, ‘দ্য লন্ডন ক্যাফেটা কোথায়?’

‘ও মশাই, কিছু বললেন নাকি? কোন ক্যাফে?’ জিজ্ঞেস করলেন পুলিশ অফিসার।

কৃশ একইরকম ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকল। তার মাথা এখনও পরিষ্কার কাজ করছে না। বেশ কিছু মুহূর্ত একসঙ্গে দলা পাকিয়ে গেছে তার মাথায়। কৃশ আবার পুরোনো বাড়িটার দিকে তাকাল। এখানেই তো সে দেখেছে ক্যাফেটা। গেল কোথায়?

‘কী হল, নেশাভাঙ করেছেন নাকি? চলুন থানায় চলুন। ওখানে গেলেই সব মনে পড়ে যাবে।’

থানায় যাওয়ার কথা শুনে কৃশের সব বোধবুদ্ধি ফিরে এল। ঠিক তখনই রাস্তার মোড়ে দেখতে পেল অনুরূপদাকে। মোটাসোটা চেহারার লোকটা হন্তদন্ত হয়ে আসছে এদিকেই। কৃশ ভরসা পেল।

‘আমার নাম অনুরূপ ভৌমিক। ও কৃশ। আমার অফিসের নাইট রিপোর্টার। কী হয়েছে অফিসার?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে পকেট থেকে প্রেস কার্ডটা বের করে দেখাল অনুরূপদা।

কার্ডটা দেখে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আমরাই তো বুঝতে পারছি না, কী হয়েছে? উনি এই বাড়ির সিঁড়িতে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছিলেন। খুব ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছিল। কী সব বিড়বিড় করছিলেন। এখন জিজ্ঞেস করছি, বলতে পারছেন না!’

অনুরূপদা কৃশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পিঠে স্নেহের হাত রেখে বললেন, ‘তুই তো চা খেতে বেরলি কত আগে। ফোন করে যাচ্ছি, আনরিচেবল বলছে। কী হয়েছে তোর?’

কৃশ এই প্রথম কথা বলল, ‘আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। এখানে দ্য লন্ডন ক্যাফেটা দেখেছিলাম। এখন দেখছি শুধু বাড়িটাই আছে!’

অফিসারটি আর থাকতে চাইলেন না। বললেন, ‘অনুরূপবাবু, ছেলেটি যখন আপনার অফিসে চাকরি করেন, তাহলে আপনিই ব্যাপারটা দেখে নিন। আমাকে আবার রাউন্ডে বেরোতে হবে।’

অফিসার দু’জন চলে যেতে পার্কস্ট্রিটটা আবার একইরকম নিঃঝুম। অনুরূপদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপারটা কী বল তো?’

‘দ্য লন্ডন ক্যাফে?’ বিড়বিড় করল অনুরূপদা। তারা দু’জন একসঙ্গে অফিসের দিকে হাঁটছে। কৃশ এখনও শুনতে পাচ্ছে হ্যাক্নেসাহেবের কথা, ফাইটার বিমানের বিকট আওয়াজ।

‘এইরকম একটা ক্যাফের নাম শুনেছি। কলকাতার প্রথম কফিশপ।’ বললেন অনুরূপদা।

পুরোনো কলকাতা নিয়ে ওঁর চর্চা আছে। অনুরূপদা বললেন, ‘১৮৯৩ সালে খুলেছিল ক্যাফেটা। তার মানে ১২৫ বছর আগে। ওপেনিং ডেট ২২ নভেম্বর। কৃশ আজ কত তারিখ?’

‘২১ নভেম্বর!’

‘না-না, রাত বারোটা তো পেরিয়ে গেছে। তার মানে ২২ নভেম্বর। ১২৫ বছর আগে আজকের দিনেই… !

অনুরূপদা ফের বললেন, ‘দ্য লন্ডন ক্যাফে পুরোনো কলকাতার অত্যন্ত অভিজাত একটা ক্যাফে ছিল। ১৯৪২ সালে জাপানিদের বোমায় ক্যাফেটা উড়ে যায়। অনেকে বলে, এই ক্যাফেটা নাকি জন্মদিনের রাতে আবার জেগে ওঠে। কেউ কেউ সেটা দেখেওছে। তুই ওটা দেখতে পেয়েছিস! তাজ্জব ব্যাপার।’

কৃশ ভয় পেয়ে গেল। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে একটা ভৌতিক ক্যাফেতে স্যান্ডুইচ, চা খেয়েছে?

কাঁপা কাঁপা গলায় কৃশ বলল, ‘আমি ক্যাফেটাতে স্যান্ডুইচ, চা খেয়েছি। এখনও স্বাদ লেগে রয়েছে মুখে।‘ একটু থেমে ফের বলল, ‘ফ্লাস্কে তোমার জন্য কফিও নিয়েছিলাম।’

এতকিছুর মধ্যেও ফ্লাস্কটা কৃশের হাতেই রয়েছে। ছোঁ মেরে ফ্লাস্কটা ছিনিয়ে নিলেন অনুরূপদা। দ্রুত হাতে খুলে ফেললেন ফ্লাস্কটার মুখটা। স্ট্রিট লাইটের আলোয় দেখা গেল ফ্লাস্কের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়ার কুণ্ডলি। নাম না জানা ব্ল্যাক কফির মৌতাত ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।