Accessibility Tools

দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

৪৬. অস্ত্রধারী লোকটা

৪৬.

অস্ত্রধারী লোকটার পেছনে আরও তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের হাতে ম্যাচেটি।

 ‘ভাবছিলাম আরও তাড়াতাড়ি আইবি তরা। কিন্তু বহুত টাইম লইছস! নিজের হাতে থাকা অস্ত্রের উপর একটা চাপড় মারল অস্ত্রধারী। গুহার ভেতরে শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়ে অনেক বিকট শোনাল। ল্যাজলো একটু নড়াচড়া করছে দেখে সেদিকে অস্ত্র তাক করল সে। ওই হালারা, কেউ নড়বি না কইলাম!”

‘আমরা এখানে আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। আমাদের এক বন্ধু পা ফসকে নিচে পড়ে গেছে। ওকে উদ্ধার করতে হবে। খুব আঘাত পেয়েছে বোধহয়।

‘ভালা হইছে। আমার একটা গুলি বাইচ্যা গেল। এহন তরা কেউ যদি বেহুদা নড়ছস তো মরছস! ওই সার্চ কর তো। দেখ কিছু মালপাতি পাছ কিনা!’

ওদের সবাইকে সার্চ করে ব্যাকপ্যাক সহ যা যা পাওয়া গেল নিয়ে নিল স্থানীয় গুণ্ডাবাহিনি। কিছুটা সামনে হালকা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। বেশ বড় জায়গায় আছে বোধহয়। সেদিকে নিয়ে চলল ওদেরকে।

‘আপনারা কারা? অস্ত্রধারীর পাশ দিয়ে এগোনোর সময় স্যাম প্রশ্ন করল।

‘তর বাপ! শালারা খাইয়া দাইয়া কাম পাও না আমাগো কাজে নাক গলাও! বহুত দিন ধইরা দেখতাছি তগো লটরপটর। তগো শরীলে খুব ত্যাল না? আইজ তগো ত্যাল বাইর করমু।’

‘কী নিয়ে কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। এটা কোন জায়গা?

 ‘চুপ কইরা থাক! স্যামের পাশে এক চ্যালা ছির সে হুকুম করল।

ওদের সবার হাত ধরে পিঠে মুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিজেদের ভারসাম্য রক্ষা করতে বেগ পেতে হলো অভিযাত্রী দলকে।

স্যাম খেয়াল করে দেখল রেমি বেশ আতঙ্কিত। ওর বুক দ্রুত উঠছে নামছে।

‘চিন্তা করো না। স্ত্রীকে সান্তনা দেয়ার জন্য বলল স্যাম।

কইছি না চুপ কইরা থাকতে?’ বলতে বলতে চ্যালাটা স্যামের হাঁটুতে লাথি মেরে ভূপাতিত করে ফেলল। চুপ কইরা থাকতে কইলে এক্কেরে চুপ কইরা থাকবি। ওঠ!’ স্যামের বুকে টানা কয়েকটা লাথি মারতে মারতে বলল চ্যালা। একদম বাগে পেয়েছে।

স্যাম অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। পা ফেলতে পারছে না।

 ‘মাদারি! তাড়তাড়ি আগা। নইলে এক কোপ দিয়া কল্লা নামায়া দিমু!’

ওদের সবাইকে যে জায়গায়টায় আনা হয়েছে সেখানে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আছে। লাইট জ্বলছে অল্প ওয়াটের। আরেকজন অস্ত্রধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে ওদেরকে।

 ‘এইহানে বয়া পড় সবাই। কয়েকটা বিছানা পাতা আছে। সেগুলোর পাশে থাকা ফাঁকা জায়গাটার দিকে নির্দেশ করে বলল লোকটা।

 বসার পর স্যাম মাথায় হাত দিলে দেখল রক্ত চোয়াচ্ছে। লাথি খাওয়ার সময় ওর মাথায় আঘাত লেগেছিল। রেমি বিষয়টা খেয়াল করে পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে স্যামের মাথায় ধরল।

‘আমরা যে এখানে এসেছি এটা কিন্তু অনেক মানুষ জানে। যদি সময়মতো আমরা না ফিরি তাহলে ওরা এখানে খুঁজতে চলে আসবে। শান্ত স্বরে বলল রেমি।

‘মিছা কথা!’ মুখে বললেও অস্ত্রধারীর চোখে সন্দেহ।

 ‘আপনারা কেন…’

 ‘চোপ! আমি পশ্ন জিগামু তুই উত্তর দিবি। আজাইরা কোনো কথা কৰি না।’

উনি যা বলে তাই করো।’ স্ত্রীকে সতর্ক করল স্যাম।

 ‘তরা এইহানে ক্যান আইছস?

‘দ্বীপে কেন এসেছি? নাকি এই গুহায় কেন এসেছি? কোনটার জবাব দেব?’ রেমি পাল্টা প্রশ্ন করল।

‘আমারে বোকাচোদা মনেহয়?

মাথা নাড়ল রেমি। না। আমি আসলে প্রশ্নটা বুঝতে পারিনি।

 ‘তরা কী খুঁজতাছস?

স্যাম খাকরি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। আমরা এখানকার গুহাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছি। কোনটার সাথে কোনটা সংযোগ আছে। এগুলোর কোনো ম্যাপ এখনও তৈরি করা হয়নি।’

মিছা কথা!

না, সত্যি বলছি। তাছাড়া আমরা এই গুহায় ঢুকে কী করব? এরকম জায়গায় অভিযান চালানোর আমাদের শখ।

বহুত বড় ভুল কইরা লাইছোস!

‘আপনারা এমন করছেন কেন? আপনারা কী সেই বিদ্রোহী?’ প্রশ্ন করল ল্যাজলো।

হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। হাসিটা কৃত্রিম বলে মনে হলো না। ‘বিদ্রহী? হ, আমরা বিদ্রহী! আমি বিদ্রুহী!

‘আমরা কিন্তু আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে চাইনি।’ রেমি বলল।

‘আইয়া তো পড়ছস? এহন আর কুনো কথা নাই।’ রেমির উপর ভাল করে নজর বোলাল লোকটা।

‘আমাদের কিছু হয়ে গেলে আপনাদেরই ক্ষতি হবে। আমরা এখানে আছি এটা অনেক লোক জানে। বলল স্যাম।

‘তরা কই আছস?’ হাসতে হাসতে লোকটা প্রশ্ন করল।

‘জায়গার নাম জানি না। তবে দ্রাঘিমাংশ আর অক্ষাংশ জানিয়ে দিয়েছি এই গুহায় ঢোকার আগে। আমরা যদি আর না ফিরি এই গুহায় তল্লাশি হবে। এবার রেমি বলল। আমরা অনেক পরিচিত অভিযাত্রী। আমাদেরকে অনেকেই চেনে।

তাইলে তো টাকা-পয়সাও দিব হ্যারা নাকি?

‘মুক্তিপণ চাচ্ছেন? ঠিক আছে। ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে।’ আশ্বস্ত করল স্যাম।

সঙ্গীদের সাথে একবার দৃষ্টি বিনিময় করল অস্ত্রধারী। তরা কার লোক?

কার লোক মানে?’ রেমি একটু অবাক হয়েছে। আমরা কারও লোক নই। এরকম জায়গাগুলো ঘুরে দেখে আমাদের কাজ। আমরা আর্কিওলজিস্ট।

 ‘অত ইংলিশ বুইঝা কাম নাই। তগোরে কেড়া পাঠাইছে তাড়তাড়ি ক… ট্যাকা দিব কেডা?’

‘আমরা একটা ফাউণ্ডেশন চালাই। আমাদেরকে কেউ পাঠায়নি। ফাউণ্ডেশন থেকে টাকার ব্যবস্থা করা যাবে।’

সবটিরে দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখ!’ হাতে থাকা সস্তা প্লাস্টিকের ঘড়িতে সময় দেখে বলল অস্ত্রধারী।

‘খুব বড় ভুল করছেন। আমাদের যে বন্ধুটা হারিয়ে গেছে সে-ও অনেক বিখ্যাত লোক। ওকে বাঁচাতে হবে।’ বলল রেমি।

কেউ কোনো কথা কানে নিল না। রশি দিয়ে ওর হাত পিছমোড়া করে বাধা হলো। পায়ের গোড়ালিও বাধা হলো যাতে কেউ নড়তে না পারে। বাধা শেষ হলে চ্যালাদের সাথে স্থানীয় ভাষায় আলোচনা করল লোকটা। তারপর ওদেরকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল এগোলো সেদিকে। হঠাৎ কীভাবে থেমে রেমি’র কাছ ফিরে এলো অস্ত্রধারী লোকটা। রেমি’র চুল ধরে ওর মুখটা উঁচু করল। দাঁত বের করে বলল। “আহ, চরম মাল!

বাঁধন থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল স্যাম। ওর গায়ে হাত দিলে মেরে ফেলব!”

রেমিকে ছেড়ে সাথে সাথে স্যামে’র কাছে গেল লোকটা। ম্যাচেটি তুলে কোপ দেয়ার ভঙ্গি করতেই চিৎকার করে উঠল রেমি। না!’

‘আইচ্ছা! এত দরদ। ভালাই। দাঁড়া…’ স্যামকে বাদ দিয়ে আবার রেমি’র কাছে গেল অস্ত্রধারী।

 রেমি’র চুল ধরে টান দিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এলো সে। তর লগে খেইল্যা মজা লাগব মনে হইতাছে। পরে আইতাছি…’

নিজেদের একজন লোককে পাহারার কাজে রেখে সে দলবল চলে গেল।

সবাই চুপ। একটু পর পাহারাদার জগ থেকে কফি বের করে খেতে শুরু করল। একপাশে একটা ফ্রিজ আছে। ওটার গুঞ্জন ছাড়া এখন আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না।

‘তুমি ঠিক আছো? একদম ফিসফিস করে বলল স্যাম।

 ‘হা। তুমি?

 ‘অ্যাসপিরিন খাওয়া দরকার।

কী হচ্ছে এসব?

 ‘জানি না। কিন্তু খুব খারাপ হচ্ছে। বাধন খোলা দরকার।

কতটা টাইট করে বাধা?’

‘খুব টাইট।’ বলল স্যাম। তবে এখানকার দেয়ালে আমি একটা জায়গা দেখেছি। ওর সাথে ঘষলে রশিটা কাটা যাবে। তুমি আমার সামনে আড়াল তৈরি করো। তাহলে আমি কাজটা করতে পারব।’

ল্যাজলোর দিকে ঝুঁকল স্যাম। শুনেছেন? রেমিকে কী বললাম?

কীভাবে শুনব? এত আস্তে বললে শোনা যায়? আমি আপনার বামদিক আড়াল করছি। ওরা কেউ ফিরে আসলেও যাতে সহসা দেখতে না পায়। এখন যা করার করুন। ল্যাজলো জবাব দিল।

 ‘আমি আগে নিজের পায়ের বাঁধনটা খুলব। তারপর ওই ব্যাটাকে সাইজ করছি। তারপর যতদ্রুত সম্ভব আমি তোমাদেরকে মুক্ত করব। ওরা যেকোনো মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে।

‘সাইজটা কীভাবে করবে শুনি?’ রেমি প্রশ্ন করল।

 ‘দেখো, কীভাবে করি।’

 কাজে লেগে পড়ল স্যাম।

‘এই যে, মিস্টার! শুনছেন? আমাকে একটু বাথরুমে যেতে হবে।’ স্যাম বলল।

চ্যালা কোনো পাত্তাই দিল না। জাস্ট হাসল।

“প্লিজ!

এবারও কোনো পাত্তা নেই। তাই ভিন্ন পথ অবলম্বন করল স্যাম।

কীরে কথা কানে যায় না? আমাদের লোক যখন আসবে তখন তোকে পিটিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাবে, দেখিস!’

‘চোপ! অবশেষে সাড়া পাওয়া গেল।

 ‘শালা, মদন আলী! গাধা কোথাকার!”

 ‘তরা গরু। এইজন্য তগোরে বাইন্ধা রাখা হইছে।’

কথা কম বল, অশিক্ষিত, গেঁয়ো ভূত কোথাকার! তোকে হাজারবার বিক্রি করার মতো সামর্থ্য আছে আমার। মুখ সামলে কথা বলবি। পায়খানার কীট!”

‘চুপ কর! চুপ করতে কইছি!’

লোকটার দিকে থুথু মারল স্যাম। শালা, মূর্খ, ভুলভাল ইংলিশ উচ্চারণ করে ধমক দিস? বর্বরের জাত সব! যা আগে ইংলিশ শিখে আয় তারপর কথা বলতে আসিস!’

এবার পাহাদারের ধৈর্যচ্যুতি হলো। এগিয়ে এলো স্যামের দিকে এবং ভুল করল।

আচমকা জোড়া পায়ের লাথি দিয়ে তাকে ভূপাতিত করল স্যাম। সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি নিজের শরীরটা গড়িয়ে দিল পাহাদারের উপর। কনুই দিয়ে পাজরের হাড়ে কষে গুতো দিল। দুই কব্জি দিয়ে আঘাত করল মুখে। কয়েকটা দশাসই আঘাত খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল লোকটা।

ল্যাজলো আর রেমি’র বাঁধন খুলে দিল ও।

এবার বের হব কোনদিক দিয়ে ফিসফিস করে বলল রেমি।

“যেদিক দিয়ে এসেছি ওদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। ওদের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’ স্যাম জবাব দিল। ওদিকে একটা প্যাসেজ দেখা যাচ্ছে। ওটা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না।’

পাহারাদারের কাছে একটা ম্যাচেটি ছিল। একটু খুঁজে এক কয়েল রশিও পাওয়া গেল, সাথে একটা টর্চ লাইট।

‘এগুলো কাজে দেবে। চলো, যাওয়া যাক।

‘এই মহাশয়ের কোনো গতি করে গেলে ভাল হতো না?’ ল্যাজলো মনে করিয়ে দিল।

‘ঠিক বলেছেন।’ স্যাম আরেক কয়েল রশি এনে পাহারাদারকে আচ্ছা করে বাঁধলো। ব্যাটা কারও সাহায্য ছাড়া কোনোভাবেই এই বাধন খুলতে পারবে না।

‘চলো সবাই। তবে আওয়াজ কোরো না। সামনে কেউ থাকলেও থাকতে পারে।’ বলল স্যাম।

যদি কেউ থাকে আর তার কাছে যদি পিস্তল থাকে তাহলে কিন্তু এই ম্যাচেটি আর রশি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। রেমি সতর্ক করে দিল।

পিস্তলটা যদি দক্ষ কারো হাতে থাকে তাহলে তোমার কথার সাথে আমি একমত। নইলে নয়।

 চুপচাপ এগোল ওরা। অনেকখানি এগোনোর পর গুহার গুমোট বাতাসটা একটু হালকা অনুভূত হলো।

‘এদিকটা বেশ ফ্রেশ। আর্দ্রতা আছে।’ বলল স্যাম।

 ‘সামনে যদি পথ বন্ধ থাকে?’ ল্যাজলো প্রশ্ন করল।

 ‘খুব খারাপ হবে সেটা। চলুন, দেখি কী আছে?

এগোতে এগোতে একটা হিস হিস শব্দ শুনতে পেল ওরা। কয়েক মিনিট এগোনোর পর একটা জলধারার সামনে এসে পৌঁছুল সবাই। বেশ দ্রুতগতিতে বয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। পানির ওপাশে গুহার বাকি অংশ।

‘পানি পার হতে হবে। কিন্তু স্রোতের গতি অনেক বেশি।

 ‘গতি বেশি হলেও চওড়ায় কিন্তু এটা খুব একটা বেশি নয়।’ রেমি বলল।

‘আমি শেষ সাঁতার কেটেছি সেই ছোটবেলায়। আমার খবর আছে। বলল ল্যাজলো।

‘কোনো খবর হবে না। বুদ্ধি এসেছে মাথায়। পানির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর স্যাম বলল। রেমি… রশিটা দাও।

কী করবে? এখানকার পানি কতটা গভীর জানো?

 ‘এসব জায়গা খুব একটা গম্ভীর হয় না। চিন্তার কিছু নেই। স্যাম আশ্বস্ত করল। তুমি আর ল্যাজলো রশির এমাথা ধরে রাখবে। রশির আরেক মাথা আমি আমার কোমরে বেঁধে নিচ্ছি। স্রোত যাতে আমাকে টেনে নিয়ে না যেতে পারে তারজন্য এই ব্যবস্থা।

সাবধান।

স্যাম পানিতে নেমে বুঝল পানি ভয়াবহ রকমের ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা পানি যেন ওর পায়ে কামড় বসাচ্ছে। পা পিছলে যেতে চাইছে। হাজার হাজার বছর ধরে পানি গড়িয়ে মসৃণ হয়ে গেছে তলাটা। স্যামের কোমর পর্যন্ত পানি। কিন্তু এতেই ওর এগোনো কঠিন হয়ে গেছে। একটু পর হঠাৎ স্রোত ওকে টান দিয়ে ভারসাম্যহীন করে ফেলল। রশি নিয়ে লড়তে শুরু করল রেমি আর ল্যাজলো। স্যামের নাকে-মুখে পানি ঢুকছে। তিনজনের মিলিত শক্তিও এই স্রোতের কাছে সেভাবে পাত্তা পাচ্ছে না।

অবশেষে পায়ের জোরে, আর রেমি ও ল্যাজলোর সহায়তায় অনেক সংগ্রাম করে ওপাশে পৌঁছুল স্যাম।

এপার থেকে টর্চ লাইট ধরল রেমি। স্যাম পানি থেকে উঠে খেয়াল করল ওর এক পা কোনো সাড়া দিচ্ছে না। কোনো এক পাথরের সাথে বাড়ি খেয়ে অসাড় হয়ে গেছে। হাতের আঙুলগুলো জমে গেছে ঠাণ্ডায়। চিত হয়ে শুয়ে হাত আর পা ঘষল স্যাম। ওগুলোর সাড়া ফিরিয়ে আনতে হবে।

এরপর স্যাম দেখল ও সম্ভাব্য স্থান থেকে প্রায় ১০ ফুট সরে এসেছে। অর্থাৎ, স্রোত ১০ ফুট টেনে এনেছে ওকে। পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ লাইট বের করল স্যাম। কপাল ভাল এত ধস্তাধস্তির পরেও জিনিসটা নষ্ট হয়নি।

এবার রেমি ও ল্যাজলো’র পালা।

রেমি স্যামের চেয়েও কম ভুগে পার পেয়ে গেলেও ল্যাজলো’র সত্যি সত্যি খবর হয়ে গেল। নাকানিচুবানি খেয়ে কঠিন অবস্থা।

অবশেষে কঠিন স্রোত পার হলো ওরা তিনজন। ল্যাজলো কাশছে।

হঠাৎ ওপারের প্যাসেজ থেকে বুটের আওয়াজ ভেসে এলো। ওরা ফিরে আসছে।

টর্চ বন্ধ করল স্যাম। সরে গেল পারের উন্মুক্ত স্থান থেকে। গুহার গায়ের পাশে আড়াল নিল। ওরা জানতে চায় গুণ্ডাগুলো এই স্রোত পেরিয়ে ওদের পিছু নেয় কিনা।

শব্দ শুনে বুঝল ৪-৫ জন হাজির হয়েছে। উত্তেজিতভঙ্গিতে কথা বলছে। দলনেতা। হয়তো স্রোত পার হয়ে আসার পরিকল্পনা করছে। টর্চ জ্বেলে ওদের ভেজা পায়ের ছাপ দেখতে পেল গুণ্ডারা।

রেমি বিষয়টা টের পেল। ওরা টের পেয়েছে আমরা এপাশে এসেছি।’

‘কিন্তু আমরা যেভাবে এসেছি ওরা যদি সেভাবে না আসে তাহলে কিন্তু কাজ হবে না।’ বলল স্যাম।

 ‘আমার মনে হয় না এদের মাথায় এত বুদ্ধি আছে। ল্যাজলো মন্তব্য করল।

‘আপনার কথাই যেন সত্যি হয়।’

দলনেতা এক চালাকে পানিতে নামার আদেশ দিল। কিছুটা আমতা আমতা করলেও নির্দেশ পালন করল চ্যালা। বুট খুলে নামল পানিতে। কিছুটা এগোনোর পর আচমকা স্রোতের ধাক্কা খেয়ে ভারসাম্য হারিয়ে তলিয়ে গেল সে। স্রোত টেনে নিয়ে গেল তাকে। বেশ কিছুক্ষণ পার হওয়ার পরও তার আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। চ্যালা পানিতে পটল তুলেছে।

‘আমার মনে হয় না, আর কেউ খুব শীঘ্রই এই স্রোতে নামার সাহস করবে। স্যাম বলল। তবে আগে বা পরে ওরা এই স্রোত পার হওয়ার একটা উপায় বের করে ফেলবেই।

একটু পর গুণ্ডাদের আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

 ‘ওরা বোধহয় সব চলে গেছে। রেমি বলল।

 ‘প্রস্তুত হতে গেছে বোধহয়। ল্যাজলো বলল।

‘চলো সবাই, আমরা এগোই। ওদের সাথে দূরত্ব বাড়ানো দরকার। বলল স্যাম।

“কিন্তু ওরা আমাদেরকে ধরার জন্য এত উঠে-পড়ে লেগেছে কেন বুঝলাম না। ল্যাজলো বলল।

‘আমরা হয়তো ওদের গোপন আস্তানা জেনে ফেলেছি তাই বাঁচিয়ে রাখতে চাচ্ছে না। তাছাড়া কতগুলো বাচ্চাকে খুন করেছে সেটাও তত মাথা রাখতে হবে।’ বলল স্যাম।

 ‘আমার চিন্তা হচ্ছে লিও-কে নিয়ে। বেচারা কোথায় আছে কে জানে? পুলিশকে নিয়ে উদ্ধার করতে হবে ওকে।’ রেমি বলল।

‘প্রার্থনা করি, বেচারা যেন গুরুত্বরভাবে আহত না হয়ে থাকে।

সামনে এগোতে শুরু করল সবাই। ওরা এখন যে অংশ পার হচ্ছে এটার ছাদের উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। বিশাল গুহা। কিছুদূর এগোনোর পর স্যামের টর্চ লাইটের আলো কমতে শুরু করল।

‘দেখি তোমাদের লাইটগুলো বের করো। দেখো, জ্বলে কিনা। রেমি ও ল্যাজলোকে বলল স্যাম।

না, জ্বলছে না। স্যামের মতো ওদের ভাগ্য অত ভাল নয়।

 ‘এহ হে! লাইট নেই। এবার তো পথ হারিয়ে ফেলব।’ ল্যাজলো বলল।

স্যাম ওর নিভু নিভু টর্চ লাইট দিয়ে দেখল পাশে একটা প্যাসেজ আছে। ‘চলো সবাই, আমরা এই প্যাসেজ ধরে এগোই। হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে।

সামনে এগোতে এগোতে একটা জলাধারের সামনে গিয়ে পৌঁছুল ওরা। প্রদি পদক্ষেপে টর্চের আলো কমে আসছে। জলাধারের কাছে যেতে যেতে টর্চ নিভেই গেল।

এবার সব অন্ধকার। জলাধারের কাছে গিয়ে অন্ধকার হাতড়ে রেমি হাত দিল পানিতে। পানি বেশ ঠাণ্ডা।

‘এবার?’ রেমি প্রশ্ন করল।

 ‘পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক না করা পর্যন্ত আমরা এখানে বিশ্রাম করব।’ বলল স্যাম।

‘এখানকার পানিটা বেশ তাজা। নিশ্চয়ই কোনো উৎস আছে।’ রেমি জানাল।

যাক বাঁচা গেল। আমরা অন্তত পিপাসায় মারা যাব না।’ বিড়বিড় করে বলল ল্যাজলো।

‘আমরা কোনোভাবেই মারা যাব না। উপায় একটা বের হবেই।’ জোর দিয়ে বলল স্যাম।

অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর হঠাৎ স্যাম বলল, “আচ্ছা, রেমি, ওটা কি আমার চোখের ভুল নাকি সত্যি একটু আলো দেখতে পাচ্ছি?

রেমি বলল, কই আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

‘কিন্তু আমি পাচ্ছি। আমি নিশ্চিত। বেশ উঁচুতে অবশ্য তবে দেখতে হবে বিষয়টা।

‘তুমি এখন এই অন্ধকারের মধ্যে পাথর বেয়ে উঠবে?’ রেমি আস্তে করে প্রশ্ন করল।

তাছাড়া আর কোনো উপায় আছে?

আলোর উৎসের দিকে পা বাড়াল স্যাম। জলাধারের পাশ দিয়ে এগোল গুহার দেয়ালের কাছে। দেয়ালটা এবড়োথেবড়ো। হাতের দিকে তাকাল স্যাম। ওখানে ওর হাতঘড়ির থাকার কথা ছিল। কিন্তু গুণ্ডারা সেটা নিয়ে নিয়েছে। ও এখন বুঝতেও পারছে না কত ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। এখন দিন নাকি রাত।

গুহার দেয়ালে থাকা পাথরের গায়ে পা দিয়ে ওজন পরীক্ষা করল স্যাম। দেখে নিল ওর ভার সইতে পারবে কিনা। নাকি আলগা পাথর রয়েছে। সন্তুষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করল উপরে। কিছুদূর ওঠার পর হঠাৎ ওর পায়ের কাছে থাকা একটা পাথর আলগা হয়ে সরে গেল। আছড়ে পড়ল স্যাম।

গোঁয়ারের মতো আবার উঠতে শুরু করল ইঞ্চি ইঞ্চি করে। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেল জায়গামতো। একটা ফুটবল সাইজের পাথরের পাশ দিয়ে কিছুটা আলো-বাতাস আসছে। স্বস্তিবোধ করল স্যাম।

তিন হাত-পায়ে ভর রেখে এক হাত দিয়ে পাথরটা সরানোর চেষ্টা করল। কয়েক মিনিট টানা চেষ্টা করে পাথরটা সরাতে পারল বেচারা। এখান দিয়ে একজন মানুষ কোনমতে বাইরে বেরোতে পারবে।

এবার স্যাম তাকাল নিচের দিকে। রেমি ও ল্যাজলোকে এত উঁচু থেকে বেশ ছোট দেখাচ্ছে।

‘ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে উঠে এসো। কাজ হয়েছে।

‘একটু আগে সাঁতার দিয়ে অবস্থা টাইট। এখন আবার দেয়াল বাইতে হবে?’ বলল ল্যাজলো।

‘হ্যাঁ, তবে সাবধানে।

আগেরবারের মতো এবারও রেমি আগে উঠতে শুরু করল এবং স্যামের মতো একবারও আছাড় না খেয়ে পৌঁছে গেল উপরে।

ল্যাজলোর বাড়তি তিনগুণ বেশি সময় লাগল। বেচারার হাত টনটন করছে। অবশেষে পৌঁছে গেল উপরে।

ওদেরকে নিয়ে সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে বাইরে বেরোল স্যাম। বাইরের আবহাওয়া বেশ গরম। প্রায় ত্রিশ ডিগ্রি।

এবার এখান থেকে রাস্তা কোথায় পাব?’ বলল রেমি।

‘ওদিকটায় হতে পারে। স্যাম বলল। ওদিকে সাগরের একাংশ দেখা যাচ্ছে।

 ‘চলো তাহলে যাওয়া যাক। তবে একটা কথা, আমাদেরকে যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে এর প্রতিশোধ আমি নেব। যাতা আচারণ করেছে, যা-তা বলেছে। কথায় বলে প্রতিশোধ যত দেরিতে নেয়া হয় তত নাকি মজা। কিন্তু আমি এবার সেটা মানতে নারাজ। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আমার হাত নিশপিশ করছে।’ বলল রেমি।

‘আমারও। মাথা নেড়ে স্যাম সায় দিল।

.

 ৪৭.

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় বসে আয়েশ করে সিগার টানছে জেফরি গ্রিমস। সামনে সিডনি হারবারের মনোরম দৃশ্য। কিছুক্ষণ আগে একটা ফোন এসেছিল। ফোনটা পেয়ে বেশ খোঁজ মেজাজে আছে জেফরি। গোয়াড্যালক্যানেলে ফাইনাল খেলা শুরু হয়ে গেছে। দ্বীপকে জাতীয়করণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংসদ সদস্যরা। সব বিদেশিদের কোম্পানীকে দ্বীপ থেকে হটানো হবে।

 জেফরি হচ্ছে পাকা ব্যবসায়ী। নিজের ব্যবসায়ী স্বার্থ হাসিল করার জন্য যেকোন পথে সে চলতে প্রস্তুত। তবে খারাপ কোনোকিছুর সামনে সে যায় না। পর্দার আড়ালে থাকে। এটাই তার চরিত্র, এটাই ব্যবসার কৌশল।

 ‘জেফরি? একটি নারীকণ্ঠ ডাকল ওকে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল জেফরি। এক সুন্দরী তরুণীর গায়ে শুধু জেফরির একটা টি-শার্ট শোভা যাচ্ছে। তাছাড়া বাকি সব নগ্ন। জেফরির কোলে এসে বসল সে। আয়েশ করে সিগারে আরেকটা টান দিল জেফরি গ্রিমস। জীবন উপভোগ করার এই তো সময়।

***

গোয়াডালক্যানেলসলোমন আইল্যাণ্ড

স্যাম যতটা সহজ ভেবেছিল ঢালু পথ ততটা সহজ নয়। রেমি ও ল্যাজলোকে নিয়ে এগোচ্ছে ও। বিদ্রোহীরা ওদেরকে হয়তো খুঁজে চলেছে বন-জঙ্গল দিয়ে, সেদিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। এগোতে হচ্ছে সাবধানে।

 ‘এখন হাতে ম্যাচেটি থাকলে ভাল হতো।’ স্রোত পার হওয়ার সময় হারিয়ে ফেলেছে ল্যাজলো।

‘আমার তো মনে হচ্ছে একে-৪৭ রাইফেল থাকলে ভাল হতো। ম্যাচেটি দিয়ে আর কী হবে? রাইফেল আর কিছু গ্রেনেড় থাকলে জমত বিষয়টা।’ স্যাম বলল।

‘আমার চাই হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারে চড়, কেল্লাফতে।’ বলল রেমি।

ভোর হচ্ছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে একসময় সামনে কংক্রিটের রাস্তা দেখতে পেল রেমি। “ওই যে, ওখানে রাস্তা দেখা যাচ্ছে।

‘আহ, বাঁচা গেল। ল্যাজলো যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আচ্ছা, আপনার কাছে স্যাটেলাইট ফোনটা আছে?

নেই, তবে আশা হত হবেন না। জবাব দিল স্যাম।

ঘাড় কাত করল রেমি। মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে। স্যাম ভ্রু উঁচু করল। কী?

‘আমি ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। খুব হালকা। কিন্তু শুনতে পাচ্ছি। ওদিকে।

রাস্তার দিকে দৌড় দিল রেমি। ওর পিছু পিছু স্যাম ও ল্যাজলোও ছুটল। রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে থামাল স্যাম। “আগেই সামনে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার ওখানে বিদ্রোহীরা আছে কিনা।

একটা বট গাছের আড়ালে থেকে রাস্তায় নজর দিল ওরা। আওয়াজটা ধীরে ধীরে কাছে আসছে।

‘ওটা একটা অ্যাম্বুলেন্স! শহর থেকে আসছে।’ স্বস্তি নিয়ে বলল রেমি।

স্যাম গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে অ্যাম্বুলেন্সের উদ্দেশে হাত নাড়ল। গতি কমাল অ্যাম্বুলেন্স। এরকম জায়গায় তিনজন বিদেশিকে দেখে অবাক হয়েছে বোধহয়। ওদের কাছাকাছি এসে থামল।

‘ভেতরে রেডিও থাকতে পারে। আমরা দ্রুত কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারব। তাছাড়া…’ স্যাম কথাটা শেষ করতে পারল না। কারণ অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলতেই অস্ত্রধারী একটা হাত দেখা গেল। এই হাত এরআগেও ওরা দেখেছে।

‘ওহ না…’ বলেই দৌড় দেয়ার চেষ্টা করল রেমি। কিন্তু পারল না। পুরানো রাইফেলধারী এক লোক অস্ত্রটা তাক করল ওর দিকে। রেমি আর দৌড় দিল না। পিস্তলের গুলি হয়তো অ্যাম্বুলেন্স থেকে এই বটগাছ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করতে পারবে না। কিন্তু রাইফেল অবশ্যই পারবে।

‘আরি শালা! দ্যাগ কাগো পাইছি!’ অস্ত্র নিয়ে সামনে এগোলো একজন। দুনিয়া ম্যালা ছোড না? স্যামের কাছে গিয়ে মাথায় পিস্তলের বাট দিয়ে কষে আঘাত করল। ঘটনাটা এত আচমকা হলো যে স্যাম হাত উঁচু করে কোনো প্রতিরোধ করার সুযোগই পেল না।

না! চিৎকার করে উঠল রেমি।

 কিন্তু ইতিমধ্যে দেরি হয়ে গেছে। স্যামের সামনে পুরো দুনিয়া টলে উঠল। আকাশে ঢুকে গেল মাটিতে। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল স্যাম।

.

 ৪৮.

পাথুরে মেঝেতে থাকা অবস্থায় স্যামের জ্ঞান ফিরল। সবকিছু কেমন ঝাপসা মনে হচ্ছে। বার কয়েক চোখ পিটপিট করল ও। দেখল, রেমি ওর দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশে ল্যাজলো।

স্যাম উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ওর সামনে থাকা পুরো পৃথিবী যেন দুলে উঠল হঠাৎ। কানের ভেতরে শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। রেমি ওকে কিছু বলছে, কিন্তু শব্দগুলো বুঝতে বাড়তি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে ওকে।

 আমাদেরকে আবার গুহায় নিয়ে আসা হয়েছে। তবে এটা অন্য গুহা।’ বলল রেমি।

স্যাম এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। “তোমরা সবাই ঠিক আছে তো?’ ও গলা কিছুটা ভেঙে গেছে।

হুম। আমাদের সবার সাথেই খারাপ ব্যবহার করেছে ওরা। কিন্তু তুমি সবচেয়ে বেশি ভুগেছ।

 ‘আমার মতো মনে হচ্ছে আমি কোনো ভাল্লুকের সাথে কুস্তি লড়েছিলাম। কিন্তু কুস্তিতে ভালুকের জয় হয়েছে।’

‘প্রায় কাছাকাছি।’ বলল ল্যাজলো।

 স্যাম সোজা হয়ে বসল। এবার আর পৃথিবী দুলে উঠল না। আচ্ছা, রেমি তুমি কী যেন বললে, এটা অন্য গুহা?

‘হ্যাঁ, এই গুহাটা বেশ পরিষ্কার। অনেকগুলো চেম্বার আছে। তার মধ্যে একটাতে হাসপাতালের বিছানার সাথে বিভিন্ন মেডিক্যাল সরঞ্জামও আছে। দেখলাম।

‘মেডিক্যালের সরঞ্জাম? কীরকম সেগুলো? স্যাম প্রশ্ন করল। গুহাতে কেন মেডিক্যালের বেড থাকবে বুঝতে পারল না।

হঠাৎ ওর চেম্বারের লোহার দরজাটা খুলে গেল। দুইজন লোক ঢুকল, হাতে অস্ত্র। দু’জনের চেহারায় মারমার কাটকাট ভাব। তাদের সাথে আরেকজন ঢুকেছে। তার হাতে অবশ্য কোনো অস্ত্র নেই।

‘উত্তরটা আমি দিচ্ছি। কিছু মনিটর আছে, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ইত্যাদি। তবে কাজ চালানোর জন্য সৌরবিদ্যুৎ, জেনারেটর সহ পানিবিদ্যুৎ জেনারেটরও আছে। ওটা বেশ শক্তিশালী। ভাল কাজ করে।

বক্তার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ধাক্কা খেল সবাই। মুখ খুলল রেমি।

‘ভ্যানা! আপনি? আপনি আমাদেরকে ধরে এনেছেন?’

কাঁধ ঝাঁকাল ভ্যানা। আমি কিন্তু আপনাদেরকে অনেকবার সর্তক করেছিলাম। কিন্তু আপনারা আমার কথা কানেই নেননি। কোনভাবেই দ্বীপ ছাড়লেন না। আপনারা তো নিজেদেরকে মহাপণ্ডিত ভাবেন! কেউ বন্ধু হিসেবে ভাল কোনো পরামর্শ দিলে পাত্তাই দেন না।’

‘এটা উত্তর হলো না। স্যাম বলল।

আবার কাধ ঝাঁকাল ভ্যানা। আপনারা অকারণে নাক গলাতে পছন্দ করেন। যেটার সাথে আপনাদের কোনো লেনদেন নেই সেখানেও নাক গলাতে ছাড়েন না। নাক গলিয়ে অন্যের কাজে বাগড়া দেন। তারপরও বারবার বিভিন্ন উপায়ে প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে আপনাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল।

কী বলছেন?’ জানতে চাইল রেমি।

‘বাহ! প্রশ্ন করছেন? এখানে তো আমি প্রশ্ন করব আপনারা উত্তর দেবেন। চলুন, শুরু করি… গুহায় ঘোরাঘুরি করছেন কেন বলে ফেলুন। কী খুঁজছেন?

 ‘কিছু খুঁজছি না। আমরা তো এমনি ঘুরছি।’ অকপটে ডাহা মিথ্যেকথা বলল ল্যাজলো।

 ভ্যানা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দেখুন, আমার লোকজন আপনাদেরকে টুকরো টুকরো করার জন্য মুখিয়ে আছে। আমি শিক্ষিত, আপনারাও শিক্ষিত, তাই চাচ্ছি একটা সভ্য উপায়ে আলোচনা হোক। এখন আপনারা যদি এরকম…’।

মাথা নাড়ল রেমি। আমরা প্রাচীন নিদর্শন খুঁজছি। সাগরের নিচের ওই ইমারতগুলো থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলো গুহার দিকে ইঙ্গিত করে।’ কথাটা পুরোপুরি সত্য না হলও আংশিক সত্য।

‘ও, হ্যাঁ, আপনাদের সেই বিখ্যাত শহর। যেটা সাগরের নিচে আছে। আচ্ছা, তো প্রাচীন নিদর্শনটা কীরকম, শুনি?

‘প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু। যেটাকে প্রাচীন যুগের পরিচয় পাওয়া যাবে।

‘আচ্ছা যা-ই হোক, সেটা নিশ্চয়ই অনেক মূল্যবান। নইলে আপনারা জীবন বাজি রেখে এখানে আসতেন না।’

 ভ্যানার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল স্যাম। আপনি কিন্তু এসব করে পার পাবেন না। আমরা এখানে এসেছি এটা অনেকেই জানে।

ভ্যানা হেসে উঠল। আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন দ্বীপে বিদ্রোহীদের দাপট চলছে। বিদেশিরা ইতিমধ্যে পালিয়েছে। রাজনীতিবিদরাও যে যার পিঠ বাঁচাতে ব্যস্ত। এখন আপনাদের মতো বিদেশিকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই।’

‘এসব কেন করছেন? জানতে চাইল রেমি।

এসবে আপনাদের কী দরকার? কেন নাক গলাচ্ছেন? আপনাদের সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই কিন্তু যেহেতু গোপন জিনিস দেখে ফেলেছেন এখন তো ছেড়ে দেয়া সম্ভব না। আপনারা চুপ করে থাকার লোক নন।’

স্যামের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আপনি ওই বাচ্চাদের কঙ্কালগুলোর সাথে জড়িত?

 দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি, হ্যাঁ, জড়িত। দেখুন, কোনো নতুন রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে হলে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতেই হয়। মানবজাতির উন্নতির জন্য করতে হয় বিষয়টা। যেমন দূরারোগ্য ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক তৈরি করতে মানুষের উপর এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল। আমি সেরকমটাই করেছি।’

‘আপনি আপনার রোগীদের মেরে ফেলছেন। প্রায় আর্তচিৎকার করে বলল ল্যাজলো। গ্রাম থেকে বাচ্চাদেরকে গায়েব করে…’

‘আমি সৌভাগ্যবতী, আনঅফিসিয়ালি এক ওষুধ কোম্পানীর হয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছি। ওরা চাইলেও এরকম গবেষণা করতে পারতো না। অনেক নিয়মকানুনের ব্যাপার আছে, মানবতা লঙ্ঘন হয় ইত্যাদি। তাই ওদের এমন একটা সুযোগ দরকার ছিল যেখানে নিশ্চিন্তে এসব নিয়ে গবেষণা ও এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে। কোনো আইন বাধা দিতে আসবে না। তার সাথে দরকার ছিল মেডিক্যাল জ্ঞানের অধিকারী একজন যোগ্য লোক। ব্যস, সলোমন আইল্যাণ্ড আর আমাকে পেয়ে ওরা গবেষণা চালানোর জন্য অনুমতি দিয়ে দিল। আমার দিক চোখ গরম করে তাকিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি এসব করছি মানুষের মঙ্গলের জন্য। আজ হয়তো কিছু মানুষের প্রাণ উৎসর্গ করতে হচ্ছে কিন্তু তারপর বছরের পর বছর আমার এই উৎসর্গের কারণে অগণিত মানুষের জীবন বাঁচবে। তাছাড়া পৃথিবীতে এরকম ঘটনা তো নতুন নয়। আফ্রিকাকে সবাই বিগত কয়েক শতক ধরে এই কাজে ব্যবহার করে আসছে। কারণ ওখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের উপর এক্সপেরিমেন্ট চালানোর কারণেই কিন্তু আজ পৃথিবী প্লেগ মুক্ত।

‘এসবই আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।’ বলল রেমি।

‘এসব নীতিকথা আপনার মতো আমেরিকানদের মুখে মোটেও শোভা পায় না। আপনাদের সরকার সারা পৃথিবীজুড়ে আন্তর্জাতিক ভঙ্গ করে যাচ্ছে। আর সেই আপনারাই আমাকে আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিচ্ছেন?

‘আপনি উন্মাদ! স্যাম বলল।

‘ঠিক বলেছেন। অবশ্যই আমি উন্মাদ। আর আমার মতো উন্মাদের জন্যই দুনিয়ার বিভিন্ন সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। আপনাদের সরকার পুরো দুনিয়া যা যা করে বেড়াচ্ছে আমি তারচেয়ে শতগুণে ভাল ও সৎ।’

‘কিন্তু আপনি এখানে বাচ্চাদের খুন করছেন! গর্জে উঠল রেমি।

কথা শুনতে পাননি? বললাম না, আফ্রিকাতেও এতকাল ধরে এরকম এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে আসা হয়েছে?

 ‘আপনি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেয়ার জন্য এসব করছেন। এখানে মানুষের মঙ্গল বলতে কিছু নেই। মানবতার নাম ভাঙিয়ে টাকার পেছনে ছুটছেন আপনি। স্যাম বলল।

 ‘আপনারা কি অন্ধ? পুরো বিশ্ব এভাবেই চলে। তাছাড়া নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হতো না। এক্সপেরিমেন্টের ফলে অনেক মূল্যবান বছর বেঁচে যায়। দ্রুত মানুষের কাছে ওষুধগুলো পৌঁছে দেয়া। আপনারা কি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন? আপনার দেশের সরকার আর কোম্পানীগুলো হচ্ছে অপরাধের ডেপু। তাদের চেয়ে আমি কোনদিক দিয়েই খারাপ নই। আপনারা শুধু নিজের দেশের বাইরের চাকচিক্য আর ফিটফাট ভাঙিয়ে দাপট দেখান অথচ ভেতরে সদরঘাট, সেটা স্বীকার করতে চান না।’

 ‘আপনি ডাক্তার হিসেবে যাত্রা শুরু করার সময় একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। পৃথিবীর সব ডাক্তারকেই সেটা করতে হয়। অথচ সেই প্রতিজ্ঞা প্রতিদিন ভেঙে চলেছেন।’ ল্যাজলো বলল।

 ‘ওসব ম্যানেজ করে চলতে হয়। আমার মনোযোগ থাকে ফলাফলের দিকে। ফলাফল ভাল তো সব ভাল। আপনারা গোঁয়ারের মতো অযথা তর্ক করছেন। আপনাদের সাথে তর্ক করতে করতে আমি ক্লান্ত। ‘ আঙুল দিয়ে ইশারা করল ভ্যানা। যাক গে, তোমরা এদেরকে ধরে এনে কাজের কাজ করেছ। এখন মুখ থেকে কথা বের করানোর জন্য যা ইচ্ছে করতে পারো এদের। আমার আপত্তি নেই। আমি সভ্য পথে চেষ্টা করে ব্যর্থ।’ স্যামের দিকে তাকাল সে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজছেন, তাই না? যদি নিজেরাও কঙ্কাল না হতে চান তাহলে ভদ্রলোকের মতো যা সত্যি বলে ফেলুন।

‘আমরা সত্যিই বলেছি।

 ‘আমাকে রূপকথার গল্প শোনাবেন আর আমি বুঝব না? এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য বলুন…’

‘যদি না বলি, তাহলে আপনি আপনার সহযোগী বিদ্রোহীদের দিয়ে আমাদের উপর নির্যাতন করবেন? এই নির্যাতনটাও কি আপনার “মানুষের মঙ্গল”-এর জন্য?’ ল্যাজলো প্রশ্ন করল।

হা হা, সহযোগী নয়। আমাকে তথাকথিত বিদ্রোহীদের নেত্রী বলতে পারেন।

বিস্ময়ে হা হয়ে গেল রেমি। তারমানে এসবের পেছনে আপনিই মূল হোতা? কিন্তু ম্যানচেস্টার আপনার বন্ধু ছিল…’

“হুম, ছিল তো? একটা মদখোর মগজবিহীন রাজনীতিবিদ ছিল সে। তার মৃত্যু একটা ভাল কাজে ব্যয় হয়েছে এটাই তো বিরাট সৌভাগ্য।

 ‘আপনি তার সাথে ওঠা-বসা করেছিলেন, খেয়েছিলেন একসাথে, হাসি ঠাট্টা করেছিলেন…’

‘নিজেকে উপভোগ করেছি। কিন্তু ম্যানচেস্টার সামনে আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত। সেটা তো আর হতে দেয়া যায় না।

‘আপনি একটা আস্ত বেঈমান। ঘৃণাভরে বলল স্যাম।

হয়তো ঠিকই বলেছেন। অবশ্য আপনাদের এসব মতামতকে আমি কোনো পাত্তা দেই না। কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের ইহলীলা সাঙ্গ হবে।’

‘তাহলে আপনি আর দশটা খুনীর মতোই। নিজেকে বাঁচাতে খুন করছেন। নিজের শয়তানিকে বজায় রাখার জন্য।’ রেমি বলল।

 ‘সব হচ্ছে টাকার লোভ।’ বলল স্যাম। এই মহিলা পুরো দ্বীপকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়েছে তার তথাকথিত মানুষের মঙ্গলের জন্য। আসল কথা হলো সে টাকার লোভে ছুটছে। মানুষের মঙ্গলের কথা বলে স্রেফ ভাওতা দিচ্ছে।’

যা খুশি বলুন, কিছুই যায় আসে না। তবে আপনাদের সাথে দেখা হয়ে ভাল লেগেছিল। আপনাদের কাছ থেকে অনুদানটা বাগাতে পারলে খুব খুশি হতাম। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব হচ্ছে না।’

আপনার এই কুকীর্তি চাপা থাকবে না।’ হুঁশিয়ার করল স্যাম। আমরা গোয়ালক্যানেলে এমন জিনিস খুঁজে পেয়েছি যেটা এই এলাকাকে আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত করবে। পুরো দ্বীপ ভরে যাবে লোকজনে। আপনার এসব কুকাজ ফাঁস হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

হুম, হুম। আর সলোমন আইল্যাণ্ডের সরকার সব লোকজনকে স্বাগতম স্বাগতম জানিয়ে ঢুকতে দেবে, তাই না? এখানে ইতিমধ্যে বিদেশিদের প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আইন চালু করা হচ্ছে। তাছাড়া দ্বীপের বাসিন্দারা বিদেশির পছন্দ করবে না। বিদ্রোহীদের কার্যকলাপগুলো যে বিদেশিদের জন্যই হয়েছে সেটা খুব ভালভাবে জনগণের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই জনতা আর বিদেশিদের জন্য ঝামেলা পোহাতে চাইবে না। তাছাড়া, আমি এখানকার বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক সেট করে দিয়েছি। সব প্রমাণ ঢাকা পড়ে যাবে। এখানে আমার কাজও প্রায় গুছিয়ে নিয়েছি। আমার বড়লোক হতে খুব বেশি দিন লাগবে না। গবেষণার ফলাফল বের হলে তখন আর আমাকে ওষুধ কোম্পানীর পেছনে ঘুরতে হবে না কুকুরের মতো। আমি কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়ে যাব।’

 ‘আপনি আমাদের সাথে কেন করছেন এসব? এসব না করলেও তো চলতো। আপনিই তো বললেন, বিস্ফোরণ হলে সব প্রমাণ ঢাকা পড়ে যাবে। তাহলে আমাদেরকে কেন… নিজের মনের কথা আড়াল করে বলল স্যাম।

 ‘তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আপনারাও তো বেশ পয়সাঅলা। আপনাদেরকে বাঁচিয়ে রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া আপনারা পুরানো জিনিস ঘেটে প্রমাণ বের করতে ওস্তাদ। তাই ঝুঁকি নিয়ে বোকামি করতে চাই না। তারচে বরং আপনারা মারা গেলেই সবদিক দিয়ে ভাল হবে।’ হাতঘড়ি দেখল ভ্যানা। ‘হাসপাতালে যেতে হবে, তারপর আবার রাজনীতিবিদদের সাথে মিটিং আছে। বিদায়, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফারগো। আর আপনি … আপনার নাম তো জানি না। আপনাকেও বিদায়!’ ভ্যানা ল্যাজলোর দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা।

 আর কোনো কথা না বলে ভ্যানা বেরিয়ে গেল। তারসাথে সাঙ্গপাঙ্গরাও চলে গেল তারসাথে। বাইরে থেকে লোহার দরজার খিল লাগিয়ে দিল।

মুখ খুলল স্যাম। এখানে যখন তোমাদেরকে আনা হচ্ছিল তখন কী কী দেখেছ সব বলল।

মনে করার চেষ্টা করল রেমি। আমরা এপর্যন্ত যতগুলো গুহা দেখেছি এটা ওগুলোর চেয়ে আরও গভীরে। হয়তো সবগুলোর ভেতরে আন্তঃসংযোগ আছে। এমনও হতে পারে অন্ধকারে পালানোর সময় আমরা গুহার ভেতরে যে পথ এড়িয়ে গিয়েছিলাম সেটা দিয়ে এখানে আসা যায়।

কতটুকু গভীরে আছি আমরা?

‘পাহাড়ের ভেতরে ঢোকার পর ছোট ছোট দুটো গুহা পার হয়ে তারপর এখানে আনা হয়েছে। ওগুলোর একটায় ছিল মেডিক্যাল সরঞ্জাম আর বিছানা। আর আরেকটায় বিষম দূর্গন্ধ।

স্যাম মাথা নাড়ল। আচ্ছা, ভাল করে মনে করে দেখো…. এমনকিছু দেখেছ? যেটা আমাদের কাজে আসতে পারে?

কয়েক মিনিট চুপচাপ ভাবল রেমি ও ল্যাজলো।

নাহ, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। ল্যাজলো জানাল।

রেমি’র দিকে তাকাল স্যাম। “তুমি?’

‘আমরা যদি পাশের রুমে যেতে পারি তাহলে হয়তো কিছু মেডিক্যাল সরঞ্জামকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারব। অক্সিজেন ট্যাঙ্ক আছে…’

‘তাহলে চলো, দেখি কিছু করা যায় কিনা…’

 তিনজন মিলে লোহার ভারি দরজা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু এক বিন্দুও নড়াতে পারল না। খুব ভারী দরজা।

‘আমরা তো মনে হয় এই সলিড দরজা জাপানিদের বানানো। জাপানিরা বরাবরই এরকম মজবুত জিনিস তৈরি করে।’ মন্তব্য করল ল্যাজলো।

 স্যাম ভাল করে দরজাটাকে পর্যবেক্ষণ করল। হুম, হতে পারে জাপানিরা ল্যাবটা বানিয়েছিল। ভা, ভ্যানা এখন এটাকে দখল করে একটু মেরামত করে ভোগ করছে। অবশ্য ঠিক কী অবস্থায় ভ্যানা এটাকে পেয়েছে…’।

স্যাম আর বলতে পারল না। দুম করে ওদের রুমের লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। চেম্বারে এখন কালিগোলা অন্ধকার।

.

 ৪৯.

 সবাই দাঁড়িয়ে আছে। নড়ার সাহস পাচ্ছে না। দরজার ওপাশ থেকে একটু চাপা আওয়াজ ভেসে এলো। তারপর আবার সব চুপ।

কী হচ্ছে? আমাদেরকে অজ্ঞান করতে চাচ্ছে নাকি? তাই লাইট বন্ধ করে দিল?’ রেমিকে বলল স্যাম।

 ‘এমনও হতে পারে বিদ্যুৎ অপচয় কমানোর জন্য লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।’ বলল রেমি।

‘একমত হতে পারলাম না। ল্যাজলো আপত্তি জানাল।

হঠাৎ লোহার ভারি দরজার খিল খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল পিছু হটল ওরা। দরজা খুলে একজন ভেতরে ঢুকল।

‘তোমাদের মধ্যে কে ভাল অস্ত্র চালাতে পারো?’ জিজ্ঞেস করল আগন্তুক। কণ্ঠটা পরিচিত। এক গুণ্ডার কাছ থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিয়েছি। অস্ত্রটাকে ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

‘মিস্টার লিও! আপনি বেঁচে আছেন!’ ল্যাজলো বিস্ময়ে হতবাক।

‘আছি আরকী। তো পিস্তলটা কে নেবে বলো তাড়াতাড়ি। গুণ্ডারা যেকোনো মুহূর্তে হাজির হয়ে যাবে।

‘রেমি নিক। বলল স্যাম।

 ‘কোথায় সে?

আমি এখানে।’ অন্ধকারে স্যামের বাঁ পাশ থেকে বলল রেমি।

লিও রেমি’র হাতে অস্ত্রটা তুলে দিল।

 ‘বন্ধু, তোমার কী অবস্থা? আঘাত পেয়েছ? জানতে চাইল স্যাম।

 “হুম, কিন্তু ভাঙেনি কিছু।

 ‘লাইট তাহলে আপনিই বন্ধ করে দিয়েছে?’ ল্যাজলো জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ, ম্যাচেটি দিয়ে কারেন্টের মেইন লাইনে তিনবার কোপ দিয়েছি। ব্যস, হয়ে গেল।

ম্যাচেটিটা কোথায়?’ প্রশ্ন করল স্যাম।

‘এক গুণ্ডার বুকে খুঁজে দিয়েছি। লিও একটু থামল। আমার কাছে ফ্ল্যাশলাইট আছে। কিন্তু জ্বালানো যাবে না। কেউ আসুক। তখন ওদের হাতে থাকা আলো দেখে গুলি করা যাবে।

‘স্মার্ট বুদ্ধি! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি একসময় রাশিয়ান আর্মিতে ছিলে। বলল স্যাম।

‘এবং আমি তিনটা বিয়েও করেছিলাম। অতএব বুদ্ধি ঘাটতি নেই বললেই চলে। লিও রসিকতা করল।

দূরে থাকা একটা গুহায় আলোর নড়াচড়া হওয়ায় ওরা দেখতে পেল কিছু মেডিক্যাল বেড আর অক্সিজেন পাশের গুহায়।

 ‘আমি ওই গুহায় ঢুকে বন্ধ করে দেব। তাহলে ওরা আর আমাদেরকে দেখতে পাবে না। এতে বাড়তি সময়ও পাওয়া যাবে।

‘আমিও আসছি তোমার সাথে। বলল স্যাম।

ফারগো দম্পতি চুপিচুপি গিয়ে ঢুকল গুহায়। দরজা বন্ধ করে দিল। আড়াল নিল একটা বাক্সের পেছনে।

একটু পর গুহার অন্য মাথায় আলো উদয় হলো। তিন গুণ্ডাকে দেখা যাচ্ছে। হাতে টর্চলাইট। দরজার দিকে এগিয়ে এসে টর্চের আলো ফেলল খিলের উপর। হয়তো ভাবছে, আজব! দরজায় খিল দিল কে?

আচমকা গুলি করল রেমি। বদ্ধ গুহায় গুলির শব্দ শুনে মনে হলো কামান দাগা হচ্ছে। প্রথম গুলিটা গিয়ে লাগল টর্চধারীর বুকে। পরেরটা লাগল পাশের জনের গায়ে, আর একটু হলে সে রেমি’র দিকে গুলি ছুঁড়ে দিত! তিন নম্বর গুলিটা লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। দুই সঙ্গীর হাল দেখে তিন নম্বর গুণ্ডা তড়িৎগতিতে আরেকটা বাক্সের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে।

মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে টর্চটা। সেটার আলো সহায়তা রেমি এবার চতুর্থ গুলিটা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পিস্তল তাক করল বাক্সের দিকে। কিন্তু শিকার খুব সেয়ানা। বাক্সের আড়ালে থাকা সত্ত্বেও পা দিয়ে লাথি মারল টর্চলাইটের গায়ে। পাথুরে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে লাইটের বাল্ব চূর্ণ হয়ে গেল।

হঠাৎ করে আলো নিভে যাওয়া রেমি একটু হকচকিয়ে গেছে। এই সুযোগে বাক্সের আড়ালে থাকা গুণ্ডা বেরিয়ে আসতে চাইল, হাতে পিস্তল।

এদিকে স্যাম চুপিচুপি পৌঁছে গেছে বাক্সের পাশে। আচমকা একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল বাক্সটা। গুণ্ডা এবার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। হতভম্ব।

রেমি’র ঠিক এরকম সুযোগেরই প্রয়োজন ছিল। পরপর দুটো গুলি ছুড়ল ও। ভবলীলা সাঙ্গ করে দিল সেয়ানা গুণ্ডার।

স্যাম একটা লাশের কাছ থেকে রিভলবার তুলে নিল। দেখ, তুমিও ওদের একটা অস্ত্র নিতে পার কিনা। আমি দরজা খুলে দেই। লিও’র কাছ থেকে ফ্ল্যাশলাইটটা আনতে হবে।

“ঠিক আছে।

দরজার খিল খুলে দিল স্যাম। ল্যাজলো আর লিও কাছেই ছিল। ফ্ল্যাশলাইট লাগবে।’ স্যাম জানাল।

এদিকে রেমি একটা বেরেটা নয় এমএম সেমিঅটোমেটিক খুঁজে পেয়েছে। চেক করে দেখল ম্যাগাজিন ভর্তি আছে। আলো নিয়ে ভেতরে ঢুকল স্যাম। দেখল এখানে যে তিনজন মারা গেছে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে স্থানীয় গুণ্ডাদের নেতা। যে এরআগে স্যামের মাথায় আঘাত করেছিল। মজার ব্যাপার, তার সেই অস্ত্র এখন রেমি’র হাতে শোভা পাচ্ছে।

তৃতীয় গুণ্ডার কাছে গেল স্যাম। ওর সাথে বাকিরাও আছে। এর অস্ত্রটা তুলে নিল লিও। সিলিণ্ডার চেক করল। মাত্র দুই রাউণ্ড। যাক গে, এবার আমাদেরকে পথ দেখাবে কে?

‘আমি।’ বলল স্যাম।

কিন্তু রেমি মাথা নেড়ে আপত্তি জানাল। তুমি আহত হয়েছ। দরকার নেই। আমি যাব এবার। ল্যাজলল, চলুন, আমার সাথে।

চেম্বারের ভেতরে লাইট ফেলল রেমি। আরেকটা দরজার ওপাশ থেকে গোঙানি শুনতে পেয়ে থমকে গেল ও। দরজাটায় খিল দেয়া। ওরা দ্রুত এগিয়ে গেল দরজার দিকে। রেমি দরজার পাশে হাতে পিস্তল নিয়ে তৈরি। স্যাম দরজাটার খিল খুলল। ইশারা করল রেমিকে।

স্যাম দরজার ভারি পাল্লা খোলা মাত্র সেদিকে অস্ত্র তাক করল রেমি। ভেতরে অন্ধকার। কেউ ওদের আক্রমণ করল না। সাবধানে এগোল ওরা। গোঙানিটা আবার ভেসে এলো। কোনো মেয়ের আওয়াজ।

ওরা দেখল চেম্বারের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত মেডিক্যাল বিছানা পাতা আছে। প্রায় এক ডজন তো হবেই। তবে মাত্র একটা বিছানায় মানুষ আছে। একটা ছোট মেয়ে, শুকিয়ে কঙ্কালের মতো হয়ে গেছে। লোহার শিকল দিয়ে তার হাত বাধা।

‘এটা তো মনে হচ্ছে কোনো মেডিক্যাল টর্চার চেম্বার!’ বিড়বিড় করে বলল রেমি। চেম্বারের একপাশে শুকনো রক্তের দাগ দেখতে পেল ও। বিভিন্ন ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, ওষুধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে।

 ‘আমার মনে হয় এখানেই জাপানিরা কুকাজগুলো করত। স্যাম বলল। ঝুকল শুকনো মেয়েটার দিকে। কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। ‘রেমি, এই মেয়ে তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

‘ওকে আমাদের সাথে নিতে হবে।’

মেয়েটার কাধ ধরে নাড়া দিল স্যাম। খুকি, শুনতে পাচ্ছো?

দূর্বলভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেয়েটা।

‘আমরা তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব। তোমার নাম কী?

লি…লি…’ মেয়েটা খুব কষ্ট করে বলল।

‘এই মেয়ে খুবই দূর্বল। হাঁটতে পারবে না। ওকে কোলে তুলে নিতে হবে। তাই, আমাদেরকে পরে এসে নিতে হবে ওকে।

 না, স্যাম। আমি ওকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে পারব না।’ পরিষ্কার জানিয়ে দিল রেমি। যদি তুমি ওকে নিতে না চাও তাহলে আমি মিস্টার ল্যাজলোকে অনুরোধ করব।

স্যাম মাথা নাড়ল। “আমিই নিচ্ছি। কিন্তু এই লোহার শিকলটা খুলতে হবে।

 ‘ওই গুপ্তাদের কাছে চাবি থাকতে পারে। দাঁড়াও, দেখে আসি।’

কিছুক্ষণ পর রেমি এক গোছা চাবি নিয়ে ফিরে এলো। দুটো চাবি দিয়ে চেষ্টা করার পর শিকলের তালা খুলে গেল তিন নম্বার চাবি দিয়ে।

এগিয়ে এলে ল্যাজলো। নিজ ইচ্ছায় মেয়েটা কোলে তুলে নিচ্ছে।

 ‘আপনি নিতে পারবেন?’ জিজ্ঞেস করল স্যাম।

‘অনায়াসে। এই মেয়ের শরীরে কিছুই নেই। একদম পাখির পালকের মতো হালকা; কোনো ব্যাপার না। আত্মবিশ্বাসের সাথে ল্যাজলো জবাব দিল।

ভেতরের চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরের গুহায় আসছে সবাই এমন সময় ছায়া দেখতে পেল ওরা। টার্গেট এরিয়ায় পেয়ে যেতেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে গুলি ছুড়ল স্যাম ও রেমি। পরপারে পাঠিয়ে দিল চার গুণ্ডাকে। ওদের হাতে ম্যাচেটি ছিল। কিন্তু ম্যাচেটি দিয়ে তো আর পিস্তলের সাথে লড়াই করা যায় না।

এবার ওরা খুব সাবধানে এগোল। বলা যায় না, সামনে হয়তো আক্রমণ করার জন্য প্রতিপক্ষ ওঁত পেতে বসে আছে।

‘আমরা এক কাজ করি একদম নিচু হয়ে এগোই। তাহলে হয়তো সেটা নিরাপদ হবে। স্যাম প্রস্তাব রাখল।

না। ওদেরকেই বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা অপেক্ষা করব।’ বলল রেমি।

 ‘তাহলে তো এখানে পুরোদিন বসে থাকতে হবে। লিও আপত্তি জানাল।

‘তো সমস্যা কী? চুপচাপ অপেক্ষা করাই ভাল। দেখি ওরা কখন বের হয়। আমার তো সন্দেহ আছে এখনও ওদের কেউ বেঁচে আছে কি না।’

এক জোড়া পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে এদিকে গুলি করার জন্য প্রস্তুত হলো রেমি ফারগো। বাকিরা লুকাল একটা পাথরের আড়ালে।

 রেমি একটু আড়ালে থেকে পথ চেয়ে আছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে শব্দটা। আগন্তুকের মাথা দেখা গেল। হাতের পেশিতে ঢিল দিল রেমি। গ্রেগ এসেছে।

কিন্তু পরক্ষণে দেখল ওর পেছন পেছন এক গুণ্ডাও আছে। গ্রেগের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে এগোচ্ছে সে। হঠাৎ একটা গুলি এসে পিস্তলধারীর কপাল ফুটো করে দিল। সবাইকে চমকে দিয়ে লিও গুলি করেছে।

‘তাহলে সব শেষ হলো?’ গ্রেগকে প্রশ্ন করল রেমি।

না। গাড়ির কাছে আরও একজন আছে। অবশ্য তার কাছে কোনো পিস্তল নেই। স্রেফ ম্যাচেটি।’ গ্রেগ জবাব দিল। বেচারার কাঁপছে। গুণ্ডার কপাল থেকে রক্ত ছিটে এসে লেগেছে ওর চোখ-মুখে। এখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি।

লিও’র দিকে তাকাল রেমি। দারুণ গুলি চালিয়েছ।

‘আমার পিস্তলে এখন আর মাত্র একটা গুলি আছে। নালিশের সুরে বলল লিও।

‘প্রার্থনা করি, ওটা যেন আর খরচ করতে না হয়। স্যাম বলল।

 ‘কোনো মহিলাকে দেখেছেন?’ গ্রেগের কাছে জানতে চাইল রেমি।

গ্রেগ মাথা নাড়ল। হ্যাঁ। সে গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই চলে গেছে।

 ‘ধ্যাত! স্যাম হতাশ।

‘চিন্তা কোরো না। খেলা এখনও শেষ হয়নি। ওই মহিলা পালিয়ে যেতে পারবে না।’

স্ত্রীর দিকে তাকাল স্যাম। তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।

.

 ৫০.

অফিস রুমে সহকারীকে ঢুকতে দেখে মাথা তুলল ডা. ক্যারল ভ্যানা।

‘কী ব্যাপার, ম্যাগি? তোমাকে তো আমি সব দেখিয়ে দিয়েছি। এখন বিরক্ত করতে এসেছ কেন?

‘দুঃখিত, ডাক্তার। কিন্তু পুলিশ এসেছে, আপনার সাথে কথা বলতে চায়।

‘তো? নিজে গিয়ে একটু কথা বলতে পারছ না? তোমাদেরকে বেতন দিয়ে পোষা হয় কেন? ফাইল-কলম রেখে বিরক্তির সাথে উঠল ভ্যানা।

ম্যানচেস্টারের মৃত্যুর পর দ্বীপে নতুন করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। ভাঙচুর থেকে হাসপাতালকে রক্ষা করতে আধডজন পুলিশ অফিসার নিয়োজিত আছে এখানে।

ভ্যানা’র পরিকল্পনা এখন পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবে এগোচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে পরিস্থিতিও তত অস্থির হয়ে উঠেছে দ্বীপের। আজ গভীর রাতে ঘোষণা আসবে জনগণ আর এই সরকারকে ভরসা করছে না। তারা নতুন সরকার চায়। গণভোট নেয়া হবে… এগুলো সব ভ্যানার রাজনৈতিক নীলনক্সা। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ভ্যানা রুম থেকে বেরোবে এমনসময় দরজার সামনে চিফ অফিসার ফ্লেমিং উদয় হলো।

বলুন, সেবাস্টিয়ান? জরুরী কিছু?’ পুলিশ চিফের সাথে ভ্যানা’র সখ্যতা অনেক পুরানো। কিন্তু এবার সেবাস্টিয়ান কোনো জবাব দিল না। কড়া চোখে তাকিয়ে রইল। কী হয়েছে?

 ‘আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। উল্টোদিকে ঘুরুন। কোনো কথা বলবেন না। একদম চুপ।

‘কী? পাগল হয়ে গেছেন নাকি? এসবের মানে কী?

 ‘ঘুরুন। এককথা বারবার বলতে ভাল লাগে না।

ভ্যানা আর কিছু বলল না। হাড়কড়া পরানো হলো কব্জিতে। ভ্যানার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। বুঝতে পারছে না এসব কেন হচ্ছে। নিশ্চয়ই বড় কোনো গড়বড় হয়েছে কোথাও। দ্বীপের একজন সম্মানিত ডাক্তারকে এমনি এমনি পুলিশ গ্রেফতার করবে না।

ভ্যানাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে গেল পুলিশ চিফ। হলওয়েতে গিয়ে ভ্যানা দেখতে পেল আরও চারজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ফাগো দম্পতি ও ল্যাজলো। রাগে, বিস্ময়ে ভ্যানা’র মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দ বের হলো…

 ‘আপনারা?

‘আমার নাম ল্যাজলো। আপনার সাথে দেখা হলেও ভাল করে পরিচয় হয়নি অবশ্য। আপনি তো তখন আমাদেরকে খুন করার নির্দেশ দিতে ব্যস্ত ছিলেন…’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ল্যাজলো।

পুলিশ অফিসাররা আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে গেল ভ্যানাকে।

ওদের কাছে এগিয়ে এলো পুলিশ চিফ। আমি আবারও দুঃখিত। আপনাদের সাথে তখন অনেক বাজে আচরণ করেছিলাম…’

কাধ ঝাঁকাল রেমি। আপনার উপর দিয়ে অনেক ধকল যায়। হতেই পারে ওরকম। আমরা কিছু মনে করিনি।’

স্যাম ডা, বেরিকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করল। রেডিও-তে কোনো খবর শুনেছেন?

‘হ্যাঁ, এইমাত্র শুনলাম। প্রধানমন্ত্রী একটি ভাষণ দিয়ে ডা. ভ্যানার চক্রান্ত সম্পর্কে সাধারণ জনতার সামনে তুলে ধরেছেন। আশা করি, খুব শীঘ্রই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে।

“আচ্ছা, কঙ্কালগুলোর কোনো গতি হলো?

‘গুহায় দুটো ফরেনসিক টিম কাজ করছে। ওদের সাথে কথা বলে এসেছি। পরিচয় বের করার চেষ্টা চলছে কঙ্কালগুলোর। আমি ভাবতেও পারছি না একটা মানুষ কতটা নীচে নামলে এরকম কাজ করতে পারে।’

উনি আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষ নন। পুরোপুরি সাইকো। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য জানেন না। কীভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা যাবে সেটা বোঝেন। এরকম মানুষ হয়তো এরআগে কখনও দেখেননি। বলল রেমি।

 ‘আর দেখতে চাইও না।’

স্যাম বলল, “উনি কিন্তু সিরিয়াল কিলার। কতগুলো মানুষকে খুন করেছেন। দ্বীপের শাসন ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য কী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছিলেন, ভাবতেও ভয় হয়।

তার জন্য আমিও খানিকটা দায়ী।’ বলল পুলিম চিফ। “আমার নাকের ডগায় এসব করছিল এতদিন। আপনারা না থাকলে পারও পেয়ে যেত। আমি নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না।

ফারগো দম্পতি পুলিশ চিফকে সান্ত্বনা দিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকল। স্যামের মাথার সিটি স্ক্যান করাতে হবে।

স্ক্যান শেষে জানা গেল, স্যামের মাথায় গুরুত্বর কোনো ক্ষতি হয়নি। সামনে আরও কয়েকদিন ঝিমুনি ভাবটা থাকতে পারে, শরীর দূর্বল লাগবে হয়তো তবে দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।

 ডা, বেরি’র কাছে নিজের ব্যাপারে জানার পর লিও’র খবর জানতে চাইল স্যাম। আমাদের রাশিয়ান বন্ধুর কী অবস্থা?

‘গুরুতর না হলেও আপনার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আপাতত পেইনকিলার আর অ্যান্টিবাটিক দিয়েছি। বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে।’

‘আর ওই মেয়েটা?’ ল্যাজলো প্রশ্ন করল।

‘ওর অবস্থা করুণ। তবে আমার মনে হয় ও লড়তে পারবে। ওকে আমরা নিয়মিত স্যালাইন দিচ্ছি। ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি কোনধরনের পয়জন ওর শরীরে দেয়া হচ্ছিল। ও একটু শক্ত হলে সেই মোতাবেক চিকিৎসা শুরু হবে। এবার মিস্টার ফারেগা, এখানে বসুন। আপনার মাথায় একটু ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে।’

‘আচ্ছা, ডাক্তার, আপনার ফোনটা একটু দেয়া যাবে। একটা কল করব। বলল রেমি।

ডাক্তার বেরি পকেট থেকে রেমিকে তার ফোনটা দিয়ে দিল।

রেমি ফোন নিয়ে লবিতে বেরিয়েছে এমন সময় লিলির মা ছুটে এলো ওর দিকে।

“আফা গো, আফনেরে বহুত ধন্নবাদ। আমার মাইয়াডারে বাঁচাইছেন। রেমিকে জড়িয়ে ধরল মহিলা, চোখে পানি। আমি জাইনতাম, আমার মাইয়া কারও লগে ভাইগা যায় নাই কিন্তুক ওই ডাইনি ডাক্তর…’।

 ‘আপনি আর চাপ নেবেন না। আপনার মেয়ে সুস্থ্য হয়ে যাবে।’ রেমি কোনমতে নিজেকে মহিলার শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত করল।

 ‘ভগবান বাঁচাইছে। আমার মাইয়াডারে বাচনের লাইগ্যা আপনেগো পাঠাইছিল… নইলে আমার মাইয়া বাচত না।

হাসল রেমি। আপনার মেয়েটা অনেক সুন্দরী। আপনার কপাল ভাল এরকম মেয়ে জন্ম দিয়েছেন।’

‘ঠিহিই কইছেন। মাইয়াডা সুন্দর আছে। এহন আমার দাবি ওই ডাক্তর ডাইনিরে যেন আগুনে পুড়াইয়া মারা হয়। তাইলে সগুগলের আত্তা শান্তি পাইব।

রেমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল। সরে গেল একপাশে। ফোন করল সেলমা’র প্রাইভেট নাম্বারে।

‘হ্যালো! কেমন আছো তোমরা? দ্বীপের কী অবস্থা?’ ফোন ধরেই সেলমা প্রশ্ন করল।

‘চলছে। একটু আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে ভ্যানাকে। স্যাম আর লিওকে হাসপাতালে আনা হয়েছে ডাক্তার দেখানো জন্য।’

‘আর ল্যাজলো? তার কিছু হয়নি?

নাহ। একদম অক্ষত আছে। এই লোকের কপাল অত্যন্ত ভাল।

সেলমা হেসে ফেলল। হুম, তার কপালই এরকম। আচ্ছা, তুমি এরআগে ফোন করে বলেছিলে ড. ভ্যানার ব্যাপারে রিসার্চ করতে। করে দেখি অনেক চমক আছে।’

 ‘তার চরিত্রের যে রূপ দেখেছি, আমার কাছে আর কোনো বলে চমক মনে হবে না।

 ‘এটা মনে হতে পারে। বিষয়টা তার দাদাকে নিয়ে। তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর তাকে অব্যহতি দেয়া হয়। তার ব্যাপারে যদিও খুব বেশি রেকর্ড নেই তবে জাপানিরা তার সাথে যোগসাজশ করেই দ্বীপে মেডিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছিল। এবং সবচেয়ে বড় কথা তিনিও ডাক্তার ছিলেন।’

‘ও ঈশ্বর.. তারমানে শত শত পুরানো কঙ্কালগুলো সব ভ্যানা’র দাদার কুকীর্তি!

‘তেমনটাই ধারণা করা যাচ্ছে। হতে পারে দাদার কাছ থেকেই সাইকো হওয়ার জেনেটিক শক্তি পেয়েছিল ভ্যা।’

‘আচ্ছা, ভ্যানা’র বাবার কোনো খবর পাওনি?

‘পেয়েছি। অনেক আগেই মারা গেছে। তার উপর রিসার্চ করে দেখলাম, সারাজীবন বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার চেষ্টা করে গেছে বেচারা। দ্বীপের লোকদের কল্যাণে সারাজীবন বিনে পয়সায় কাজ করেছে।’

আর দাদা?

‘তার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। যুদ্ধের পর সে গায়েব হয়ে গিয়েছিল।

‘তুমি কি ভাবছ, সে এখনও বেঁচে আছে?

‘থাকার কথা না। তবে থাকলে তার বয়স মূসা (আ)-এর চেয়ে বেশি হওয়ার কথা। হা হা।

‘খোঁজ নিয়ে দেখো, সেলমা।’

“ঠিক আছে। দেখছি। কিন্তু আমি দুঃখিত, তোমাদেরকে এখনও গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে সেভাবে সহায়তা করতে পারিনি। তাই গুপ্তধনটাও এখনও উদ্ধার হলো না।

‘এভাবে বোলো না, সেলমা। আমরা ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর একটা অংশ আবিষ্কার করেছি। আর সেটার পেছনে তোমার অনেক অবদান আছে।’

‘তা অবশ্য ঠিক। আমি ল্যাজলো’র কথা ভাবছি। বেচারা বোধহয় অনেক আশাহত হয়েছে।’

নাহ, সে যথেষ্ট রসিক মানুষ। সামলে নিতে পারবে।

 ‘গুপ্তধন কিন্তু এখনও ওখানকার কোথাও আছে।

‘হা, সেলমা। কিন্তু চাইলেই তো আর সব সম্ভব হয় না, তাই না?

হুম। আচ্ছা, সাবধানে থেকো। কখন আবার দাঙ্গা শুরু হয় ঠিক নেই।’

“ঠিক আছে, সাবধানে থাকব।’ হাসল রেমি। সবকিছুর জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

‘এখন আবার ধন্যবাদ দেয়ার কী হলো?

কারণ তুমি তোমার মতো।