একটি অসুরের কাহিনী – রণজিৎ গুহ
১
যেসব তথ্যের সূত্র ধরে ইতিহাস রচনা সম্ভব, আমাদের এই উপমহাদেশে তার প্রাচীনতম সংকলন রয়েছে ধর্মে। প্রভু আর অধীনের সনাতন সম্পর্কের সব বিশিষ্ট মুহূর্ত ধর্মেই গ্রথিত রয়েছে কর্তৃত্ব, সহযোগিতা আর প্রতিরোধের নিয়মে। এমন নিয়মের মূলে আছে কিছ ক্ষমতার বিধান; ইতিহাসে তার উচ্চারণ স্পষ্ট। দীর্ঘ দিন ধরে ফিরে ফিরে আসে এসব নিয়ম, শক্ত হয় তাদের ভিত, সার্বজনীন চেহারা পায় তারা; নিজেদের প্রারম্ভিক কর্মকে ছাপিয়ে উত্তরকালের সাংস্কৃতিক পর্যায়ে তারা আর শুধু স্মৃতিচিহ্নমাত্র নয়, বিশেষ ভাবে কার্যকর উপাদানও বটে। ফলে ক্ষমতার প্রতি উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গের যে মনোভাব, তার এক পুঞ্জীভূত তথ্যসমগ্র গড়ে ওঠে। তার প্রকাশ আমরা দেখি কখনও পৌরাণিক কাহিনীতে, কখনও বা আচার-অনুষ্ঠানে, আবার কখনও রীতিনীতিতে, অথবা বিশ্বাসের জগতে পূর্বোক্ত উপকরণসমূহের বিচিত্র যোগাযোগের বিভিন্ন বিন্যাসে। যে আকারে এই তথ্যসমগ্র আমাদের নাগালে আসে, তাতে এর অধ্যয়ন সহজ থাকে না। কারণ লিখিত ভাষ্যের স্বচ্ছতা এই সমগ্রে অনুপস্থিত, মৌখিক লোককথার পরম্পরাতেই তার প্রধান অবলম্বন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতীন্দ্রিয় ভাবপ্রবণতা এবং অজ্ঞাত প্রতীকে তা আচ্ছন্ন; তার যুক্তি ভাষ্যকারদের যুক্তিবাদী ধারণাকে অস্বীকার করে। নানান যোগবিয়োগে পরিমার্জিত হতে হতে এই তথ্যসমগ্র আইনের সংগতিপূর্ণ চেহারা কখনওই পায় না। এর প্রকাশ অতি সংক্ষিপ্ত, একে বোঝা কঠিন, কারণ যে বার্তা সে রেখে যায়, তার প্রকৃতি দ্ব্যর্থবোধক; একাধারে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সেই প্রকৃতি।
এই তথ্যসমগ্রের অস্তিত্ব এবং তার গুরুত্ব বিষয়ে আমরা যে সচেতন, তার জন্য ঐতিহাসিক দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বির কাছে আমাদের ঋণ সব থেকে বেশি। অতীতের আদিবাসী ইতিহাস ছাপিয়ে পরবর্তী উন্নয়নের পর্যায় এসে পড়ে; পুরনো যা-কিছু উপাদান অবশিষ্ট থাকে, তা নতুন সামাজিক স্তরের সঙ্গে মিলে মিশে যায়; এই সংমিশ্রণেই প্রাত্যহিক জীবন আর চিন্তাশীল মননের সংস্কৃতি প্রকাশ পেয়েছে। কোশাম্বি তাঁর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ দুটিতে একথারই বিশ্লেষণ করেন।১ ভাবজগতের স্তরে এই বিন্যাস সব চেয়ে স্পষ্ট সেই-সব জাতির ধর্মে, হিন্দু বর্ণভেদ অনুসারে সকলের নিচু ধাপে যাদের জায়গা। বর্তমানে এবং অতীতে খাদ্যোৎপাদন আর হালচাষকে এরা বর্জন করেছে; এদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের মূল কারণ সেটাই। এই সব নিম্নতম জাতি ঔপনিবেশিক শাসকদের বর্ণনায় অপরাধপ্রবণ উপজাতি বা ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’; অনেক সময়েই উপজাতীয় আচার-ব্যবহার এবং পৌরাণিক কাহিনীকে তারা বাঁচিয়ে রাখে।২ কিন্তু সেই আচার অথবা পুরাণ, কোনও কিছুই এই সংরক্ষণে অপরিবর্তিত থাকা সম্ভব নয়। ‘সমান্তরাল ঐতিহ্যের’ আকর্ষণ, উচ্চজাতির প্রধানত ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির ভার তাকে বদলায়, আত্মসাৎ করে। এতখানিই বদলায় যে মনে হয় আচার-ব্যবহার হিন্দুদের প্রতিষ্ঠিত প্রকাশভঙ্গিমার অভ্যন্তরীণ চিহ্নমাত্র; যেটুকু ফারাক, সে যেন কেবল তারা বহুল প্রচলিত নয় বলেই। কোশম্বি বলেছেন, ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল কাজই হল পৌরাণিক কাহিনীকে একত্র করা, যে আলেখ্য নানান চেহারায় বার বার ফিরে আসে, তাকে একতায় চিহ্নিত করা আর তাকে স্থাপন করা কোনও উন্নত সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে।৩ একবার বহুমিশ্রিত সামঞ্জস্যের এই আবরণ সরিয়ে নিলে, অনেক পৌরাণিক কাহিনীর বিষয়ই মূর্ত হয়ে ওঠে অমীমাংসিত কোনও এক প্রাচীন বিরোধের রূপকে। বস্তুত সেই বিরোধের মূর্তিতেই পৌরাণিক কাহিনীর স্বরূপ।
২
রাহুকে নিয়ে যে পৌরাণিক আলেখ্য,৪ তাকে এমন এক বিরোধের স্মারক বলা চলে। মহাভারত-এর সমুদ্রমন্থনে এই আখ্যানের প্রথম বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রথম উপাখ্যান।
তার পর মথ্যমান সাগর থেকে…ধন্বন্তরিদেব অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু নিয়ে উঠলেন, তা দেখে দানবগণ ‘আমার’ ‘আমার’ বলে কোলাহল করতে লাগল। নারায়ণ মোহিনীমায়ায় স্ত্রীরূপ ধারণ করে দানবগণের কাছে গেলেন, তারা মোহিত হয়ে তাঁকে অমৃত সমর্পণ করলে। তিনি দানবগণকে শ্ৰেণীবদ্ধ করে বসিয়ে কমণ্ডলু থেকে কেবল দেবগণকে অমৃত পান করালেন। দানবগণ ক্রুদ্ধ হয়ে দেবগণের দিকে ধাবিত হল, তখন বিষ্ণু অমৃত হরণ করলেন। দেবতারা বিষ্ণুর কাছ থেকে অমৃত নিয়ে পান করছিলেন সেই অবসরে রাহু নামক এক দানব দেবতার রূপ ধরে অমৃত পান করলে। অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশে যাবার আগেই চন্দ্র ও সূর্য বিষ্ণুকে বলে দিলেন, বিষ্ণু তখনই তাঁর চক্র দিয়ে সেই দানবের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। রাহুর মুণ্ড ভূমিতে পড়ল এবং ভয়ঙ্কর গর্জন করতে লাগল। সেই অবধি চন্দ্র-সূর্যের সঙ্গে রাহুর চিরস্থায়ী শত্রুতা হল। আজও সে চন্দ্র-সূর্যকে গ্রাস করে।
স্বর্গীয় এই লড়াইয়ের প্রতীকে নৈতিকতা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না। সৃষ্টির সেই দ্বন্দ্বময়তায় দেবতা-দানব, অমৃত কালকূট, এমন-সব পরস্পরবিরোধী ধারণার ঘাতপ্রতিঘাত প্রয়োজন ছিল।৫ অমৃত নিয়ে দেবদানবের যুদ্ধে দেবতাদের অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে দিতে মোহিনীমায়ার ছলনাই দেখি বিষ্ণুর একমাত্র আশ্রয়; আর সেই নীচ উপায়েই দানবদের বঞ্চিত করা হলো অমৃতের ভাগ থেকে। যদি কোনও দানব সবার অলক্ষ্যে স্বর্গীয় ভোজ সভায় ঢুকে পড়ার সাহস রাখে, তার শাস্তির মূলে থাকে দ্বৈত অপরাধ—দেবতার জন্য নির্দিষ্ট আহার্য অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা এবং অশুচি করা সেই আনুষ্ঠানিক ভোজকে। অমৃত পানের এই অনুষ্ঠান তাই মিলে যায় নিশ্চিত এক হত্যার কারণে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যপ্রথায় দণ্ডের সর্বোচ্চ ধারণা রাহুর মুণ্ডচ্ছেদে সঙ্গতি পায়।
গ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্কৃতির পৌরাণিক কাহিনীর আর আচার-অনুষ্ঠানের বিকৃতি কি বিচ্ছিন্নতার ধারণা এই প্রতীকে সামঞ্জস্য খুঁজে পায়। সূর্য থেকে চন্দ্র, দিন থেকে রাত্রি, আলো থেকে অন্ধকার, উষ্ণতা থেকে শৈত্যের পালাবদল৬ যে নিয়মে গ্রথিত, গ্রহণ তার ব্যতিক্রমের প্রতিনিধি। লেভি-স্ত্রোস বলেছেন ‘প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতার এই ভাঙন আসলে এক বিকৃতি; প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বাইরের কোনও এক উপাদান এসে পড়লে এমন বিকৃতির সূত্রপাত ঘটে’। পাশ্চাত্য সমাজের বাইরে গ্রহণের মতো মহাজাগতিক ঘটনা নিয়ে যে লোকায়ত বিশ্বাস প্রচলিত, সমাজতাত্ত্বিক স্তরে কোনও কোনও ইউরোপীয় মনোভাবে তার প্রতিতুলনা মেলে। লেভি-স্ত্রোস দেখান, বেনিয়মের বিয়ে নিয়ে মশকরা এমনই এক নিদর্শন। গ্ৰহণ যেভাবে গ্রহসমূহের গতিকে ব্যাহত করে, ঠিক তেমনি বিরূপ সম্বন্ধের উদবাহ বন্ধন ভেঙে দেয় বৈবাহিক সম্পর্কের আদর্শ পরম্পরাকে।৭
ভারতবর্ষেও লোকায়ত কল্পনায় সামাজিক বিচ্যুতির আশঙ্কা জড়িয়ে গেছে গ্রহণসৃষ্ট ভ্রষ্টতার সঙ্গে; সে ভ্রষ্টতা প্রকৃতির স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতিকে ব্যাহত করে। এমন বিশ্বাস ছিল যে গ্রহণ প্রজননের আবর্তনে বাধা দিতে পারে, জন্মকে রোধ করে অথবা তাকে সম্পূর্ণ বিকৃত করে ভাঙতে পারে সে জন্মমৃত্যুর ধারাবাহিকতা। গ্ৰহণ সন্তান প্রসবের পক্ষে প্রতিকূল সময়, এই শঙ্কা তাই লোকগাথায় ফিরে ফিরে আসে। বহু স্থানে গর্ভবতী নারী এমন কী তার স্বামীরও গ্রহণ দেখা নিষিদ্ধ, অন্যথায় তাদের সন্তান নাকি হবে বিকলাঙ্গ। গ্রহণ দেখাই শুধু নয়, গ্রহণ-লগ্নে অন্য যে কোনও কাজের ফলেই ভ্রূণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেইসব কাজ সন্তানের শরীরে নিজের ছাপ রেখে যায়; যেমন সন্তানের দ্বিধাবিভক্ত ওষ্ঠ গ্রহণকালে পূর্বপুরুষের কর্তনকর্মের সাক্ষী, কাঠ কি আর কিছু চেরার শ্রম দাগ ফেলে সন্তানের আঙুলে, তার বাঁকানো আঙুল হয়ে থাকে মা-বাবার তালা নিয়ে কাজ করবার চিহ্ন, আর তিল জড়ুল ইত্যাদি বিভিন্ন জন্মচিহ্ন মায়ের চোখে সুর্মাটানা অথবা বাবার কপালে তিলক-কাটার পরিণাম।৮ ধর্মশাস্ত্রের দণ্ডবিধিতে এ সবই সঙ্গত; সেখানে পাতকের শাস্তি প্রায়ই নির্দিষ্ট হয় তার দেহের সেই অঙ্গে, যা বিশেষ অপরাধে প্রত্যক্ষ লিপ্ত ছিল। গ্রহণ-লগ্নে জন্মগ্রহণের ক্ষতি তার শারীরিক অক্ষমতাকে ছাপিয়ে মানুষকে জীবনভর নানাভাবে অতিষ্ঠ করতে পারে। রাহুর দশায় যার জন্ম, তার ধনসম্পদ, বিদ্যাবুদ্ধি, সন্তানসন্ততি ধ্বংস হয়, দুঃখজৰ্জর হয় তার জীবন, একাধিক শত্রুর সম্মুখীন হতে হয় তাকে।৯
মরণে যেমন অশুদ্ধতার সংক্রমণ, গ্রহণ তেমনি ত্রাসে সমাজকে নিমজ্জিত করে। হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের শুদ্ধতার সঙ্গে রাহুর পৌরাণিক আখ্যানকে মিলিয়ে তার ব্যাখ্যা: ‘…যখন গ্রহণ লাগে, সেই বিশাল সর্প রাহু গ্রাস করে সূর্য অথবা চন্দ্রকে; অর্থাৎ হল সূর্য কি চন্দ্রের মৃত্যু; গ্রহণকাল ব্যেপে মানুষকে তাই অশৌচ পালন করতে হয়।’১০
এই বিশ্লেষণের অন্য পাঠে চন্দ্র বা সূর্যের মৃত্যু নয়, রাহুর আগমনই১১ অশুদ্ধতার হেতু, ঠিক যেমন নিম্নজাত ব্যক্তির ছায়া গায়ে পড়লে শুদ্ধতা হারায় ব্রাহ্মণ। অশুদ্ধতা সংক্রামক, তাই চন্দ্র বা সূর্য যতক্ষণ রাহুর কবলে, সমগ্র পৃথিবীও ততক্ষণ শুদ্ধতা থেকে বঞ্চিত। গুজরাট অঞ্চলে উচ্চজাতির ঐতিহ্যের ব্যাখ্যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এক পর্যবেক্ষক লেখেন ‘দানবের ছায়া আর ভাঙ্গির ছোঁয়া অশুদ্ধতায় সমতুল্য, যাতেই এ-ছায়া পড়ে, তাকেই সে অশুদ্ধ করে। যেহেতু গ্রহণকালে সূর্য অথবা চন্দ্র অশুদ্ধ, তখন তাদের আলো যেখানে পড়ে, সেখানকার শুদ্ধতা অবশিষ্ট থাকে না।’১২ সুতরাং যে রন্ধিত আহার্য বা পানীয় জল মজুত ছিল গ্রহণের সময়, অশুচি বলে গৃহস্থকে তা ফেলে দিতে হয়; গ্রহণ ছেড়ে যাওয়ার আগে নতুন করে রান্না করা, এমন কী রান্নার উদ্যোগ নেওয়াও ঠিক নয়।১৩ এমনই প্রকট গ্রহণের অশুদ্ধতা যে সে সময় পরিবারে কোনও মৃত্যু বিশেষ অমঙ্গলের ইঙ্গিত।১৪ মনুর বিধান হল, ‘রাহু যখন গ্রহণকালে চন্দ্রের শুদ্ধতা হরণ করেছে, বিদগ্ধ ব্রাহ্মণের তখন উচিত নয় বেদপাঠ করা।’১৫ গ্রহণ সম্বন্ধে লোকায়ত ধ্যানধারণা যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যবাদের সংস্কার থেকেই উদ্ভূত, এই আদেশ তারই প্রমাণ।
গ্রহণের সময় প্রতিষেধক হিসাবে কিছু আচার-অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট আছে। রাহুর অমঙ্গলসূচক মূর্তিটিকে সেগুলি আরও জোরদার করে। এমন অনেক অনুষ্ঠানে গন্ধের একটি বিশেষ জায়গা আছে; যেমন থারস্টান-এর লেখায় পাই, দক্ষিণ ভারতে পশুর শিং আর খুর পোড়ানোর প্রথা, ‘যার গন্ধ নাকি অশুভ অশরীরীকে দূরে রাখবে।’১৬ এই উপমহাদেশের বহু স্থানেই ভূত ছাড়ানোর এমন উপায় বর্তমান। আরও বেশি প্রচলিত কোলাহলের ব্যবহার; যেন সেই কোলাহলে ‘ভেকধারী দৈত্য বাধ্য হবে খাদ্যের গ্রাস উদ্গীরণ করতে।’ যেমন লিখেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক জেসুইট তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে।১৭ এমন কোলাহলের কথা গোটা বিশ্ব জুড়ে, পেরু থেকে পিকিং পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই পাওয়া যায়।১৮ আমাদের দেশে এই কোলাহল শোনা যায় আসামের ঘণ্টাধ্বনিতে, নীলগিরি পাহাড়ে টোডাদের কণ্ঠনাদে এবং আকাশ লক্ষ্য করে কুৰ্গদের বন্দুক-চালনায়।১৯ লেভি-স্ত্রোস বলেছেন, ‘একটি অণুক্রমের সুষম বিন্যাসের অসংগতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণেই কোলাহলের সক্রিয়তা। এই অণুক্রমের দুটি রাশি এখন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নতার অবস্থায়; এবং তার একটি রাশি তৃতীয় রাশির সঙ্গে সংযোগ ঘটায়, যদিও এই তৃতীয় রাশিটি অণুক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয়।’২০ লোকায়ত কল্পনায় বহিরাগত রাশিটিকে যে চেহারায় দেখি তাতে এক সাপ একটি খরগোশকে ভক্ষণ করছে এবং সংস্কৃত পাঠে এক দানব স্বর্গীয় অস্তিত্বকে গ্রাস করছে। আমাদের আলোচনার পক্ষে এটাই গুরুত্বপূর্ণ। দানব এবং গ্রহের মূর্তিটি মনে রেখেই গ্রহণে শুদ্ধতাহানির প্রতিষেধক আচারে দূর্বা এবং কুশের প্রয়োজন হয়।২১ আশীর্বাদের সামগ্রীরূপে দূর্বা এবং কুশ উভয়ই পবিত্র; এই পবিত্রতার মূলে আছে দানবগণের সঙ্গে যুদ্ধে তাদের বিশিষ্ট ভূমিকা। এক দানব বিশ্বকে যখন সাগরের অতলে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল, বরাহ অবতার বিষ্ণু তাকে ধ্বংস করেন। তখন তাঁর মাথা থেকে কেশকণা পড়েছিল ভূমিতে; সেই কেশকণা ধর্মীয় কাহিনীর আশ্রয়ে পরিবর্তিত হয়ে পৃথিবীতে দূর্বা (সংস্কৃত দর্ভ শব্দ থেকে) রূপে বিরাজমান। আবার পৌরাণিক কাহিনীর সৃজনশীলতায় তৃণ হয়ে ওঠে অস্ত্র; তাই কুশ নিয়ে দেখি বিভিন্ন আখ্যান, সেখানে কুশ মুণ্ডচ্ছেদের এক হাতিয়ার; দেবতা এবং ঋষিগণ তাকে ব্যবহার করেন তাদের শক্তিশালী শত্রুদের বিরুদ্ধে।২২ তাই কার্যকারিতায় বিষ্ণুর চক্রের সঙ্গে কুশের তুলনা চলে। বিষ্ণুর চক্রে ধ্বংস হয়েছিল সেই দানব যে সমুদ্রমন্থনের (প্রথম উপাখ্যান) সময় অমৃত আত্মসাৎ করতে চায়। ঠিক একই উপায়ে কুশ শাস্তি দিয়েছিল নাগদের, জিহ্বা বিভক্ত করে; নাগগণ তখন গরুড়ের কাছ থেকে বলপূর্বক অমৃত হরণের প্রয়াস পেয়েছিল।২৩ পৌরাণিক কাহিনী এবং আচার-অনুষ্ঠান একই সঙ্গে সমর্থন করে রাহুর সাবেকি হিন্দু মূর্তিটি। সমাজতত্ত্ব এবং বিশ্বতত্ত্বের স্তরে রাহু তেমনি এক শক্তি, যে কেবল ভাঙে, ধ্বংস করে। তাই আকাশে তার আবির্ভাবে ব্রাহ্মণের এমন আশঙ্কার কারণ থাকে যে বিশ্ব আজ আসন্ন প্রলয়ের পথে এসে দাঁড়িয়েছে।২৪
৩
ব্রাহ্মণদের বিশ্লেষণই শেষ কথা নয়। ব্রাহ্মণদের নিন্দায় দূষণ আর লুণ্ঠনের অপরাধে চিহ্নিত রাহু বহু অনুগামী খুঁজে পায় তাদের মধ্যে, হিন্দুধর্মের স্তরবিন্যাসে যাদের স্থান নিম্নতম ধাপে। এ-বিষয়ে ঔপনিবেশিক পর্যায় থেকে আমরা কিছু তথ্য পাই; তা একাধারে প্রভূত এবং অভ্রান্ত। উনিশ শতকের শুরুতে বিউক্যানান হ্যামিলটন-এর পর্যবেক্ষণ থেকে ব্রিটিশ রাজের শেষ পাঁচ দশকে বহু আমলা এবং নৃতত্ত্ববিদের বর্ণনায় এইসব তথ্য ছড়িয়ে আছে।২৫ সেই তথ্য প্রমাণ করে যে গ্রহণপূজার অস্তিত্ব একান্ত প্রাচীন এবং ডোম, দোসাদ, ভাঙ্গি আর মাঙ্গ প্রভৃতি জাতির বিশ্বাসের জগতে আজও তা এক কার্যকরী উপাদান।
অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং জীবনযাত্রার বিন্যাসে এই জাতিগুলি নানাভাবেই পৃথক এবং বিভক্ত। কিন্তু সকলে মিলে তারা যে গোষ্ঠী গড়ে তোলে, ব্রিগস-এর প্রামাণ্য পুস্তিকায় তাকে বলা হয়েছে ডোম। এরা এক গোষ্ঠী, কারণ অর্থনৈতিক অবনতি, সামাজিক কলঙ্কচিহ্ন এবং আচার-অনুষ্ঠানের অশুচিতে এদের প্রত্যেকেরই এক দশা। পঁচাত্তর বছর আগে এক পর্যবেক্ষক তাদের অবস্থান বর্ণনায় লিখেছিলেন:
ডোম জন্মায় অড়হর খেতে, ছোটবেলা থেকেই সে চুরি করতে শেখে। জীবনের প্রথম থেকেই সে পতিতের মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার উপর ছাদ ছাড়াই সে বাঁচে, থাকে না পরের দিনের অন্নের কোনও সংস্থান। পুলিশের তাড়নায় জীবনভর সে পালিয়ে বেড়ায় এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে। গ্রাম থেকে সে সদাই বহিষ্কৃত।…সে আছে হিন্দুধর্মের নাগালের বাইরে।… সভ্যতার অগ্রগতি তাকে শুধু আরও অবনমনের দিকেই ঠেলে দিয়েছে।২৬
এই সূত্রের সারকথা মিলে যায় চণ্ডাল এবং শ্বপচদের সম্পর্কে মনুর বচনে। অনেক পণ্ডিতের২৭ মতে ইতিহাসে চণ্ডাল এবং শ্বপচরাই ডোম সম্প্রদায়ের পূর্বসুরী। অতএব:
‘চণ্ডাল এবং শ্বপচ জাতি গ্রামের বাইরে বাস করবে…কুকুর আর গাধা এদের ধনসম্পদ হবে। এরা শববস্ত্র পরিধান করবে, এরা ভগ্নপাত্রে ভোজন করবে, লৌহ অলঙ্কার ধারণ করবে এবং এরা সর্বদা ভ্রমণ করবে।… রাত্রে এরা গ্রামে কি নগরে কদাচ গমনাগমন করবে না।’২৮
এ কথা স্পষ্ট যে কালের ধারায় ডোমেদের অবস্থা বদলায়নি। তারা সমাজের প্রান্তে ভবঘুরের জীবনেই দণ্ডিত। প্রাচীন আইন-প্রণেতার বিধান ছিল, ‘এরা সর্বদা ভ্রমণ করবে’; আজ বিশ শতকেও তাদের একই দশা। ঘুরে বেড়ানোর এই স্পৃহা যেন শাস্ত্রের নির্দেশের মতো; ইংরেজ আমলের সরকারি লেখাপত্রে এই স্পৃহাকেই মনে হয় স্বভাবের অঙ্গ। পবিত্র জ্ঞান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞান, এই অগ্রগতি দেড় হাজার বছরে নৃতত্ত্ব বর্ণনার পরিবর্তনকেই নির্দেশ করে। ধর্মীয় প্রাচীন থেকে সমাজতাত্ত্বিক আধুনিকে এই বিবর্তন এবং দীর্ঘকালীন ইতিহাসের ধারায় রক্ষণশীল শক্তি, এরা বৈপরীত্যের সম্পর্কেই যুক্ত। কৃষি সমাজে অথবা তার ভাবজগতে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্য; এই প্রাধান্যের অভ্যন্তরে বিলীন হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল আর্যপূর্ব দেশজ আদিবাসী সম্প্রদায়। সে বিষয়ে কোশাম্বির বিশ্লেষণ:
সামাজিক স্তরবিন্যাসের একেবারে নিচু ধাপে এখনও দেখি সেই-সব আদিবাসী গোষ্ঠীকে, যারা খাদ্য সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। পারিপার্শ্বিক সমাজে খাদ্য উৎপাদনই বর্তমানে স্বাভাবিক পর্যায়। সুতরাং এমন সব নিম্নতম জাতির খাদ্য সংগ্রহ সাধারণত ভিক্ষাবৃত্তি অথবা চৌর্যবৃত্তির চেহারা নেয়। নিম্নতম এই গোষ্ঠীদের যথার্থ নামকরণ করেছিলেন ইংরেজরা ‘অপরাধপ্রবণ উপজাতি’ বলে, কারণ গোষ্ঠীর বাইরে কোনওরকম আইন-শৃঙ্খলা মানতে এরা অস্বীকার করত।
ভারত ইতিহাসের অনেকখানি ব্যাখ্যা করে বলেই ভারতীয় সমাজের এই স্তরবিন্যাস ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।…অতীতে অথবা বর্তমানে কৃষিকাজ কি খাদ্যোৎপাদনের জীবিকা গ্রহণে তারা অনিচ্ছুক; সেই কারণেই যে তারা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মর্যাদায় হীন, তা সহজেই ধরা পড়ে। এই সব নিচু জাতি অনেক সময়েই উপজাতীয় আচার-ব্যবহার এবং পৌরাণিক কাহিনীকে বাঁচিয়ে রাখে।২৯২৯
প্রামাণ্য সূত্রে বলা হয়েছে যে উপরোক্ত জাতিগোষ্ঠীগুলি মূলত ডোম আর মাঙ্গদের মতো সম্পূর্ণ আদিবাসী।৩০ অথবা দোসাদ আর ভাঙ্গিদের মতো ‘আদিবাসীভিত্তি থেকে গড়ে উঠে’ আদিবাসী নয় এমন মানুষের অন্তর্ভুক্তিতে তাদের পুনর্বিন্যাস।৩১ উভয় ক্ষেত্রেই যা অভিন্ন, তা হল এদের জমিতে কাজ করার উল্লেখযোগ্য অক্ষমতা— ইতিহাসে খাদ্যোৎপাদন বা কৃষিকাজে তাদের যে অনীহা দেখি, এই বৈশিষ্ট্য নিঃসন্দেহে তারই জের। ফলত, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দেও রিসলি লেখেন, ডোম আর দোসাদ হল দরিদ্র কৃষক; যে রায়তকে যদৃচ্ছ উৎখাত করা যায়, অথবা বড়জোর দখলী স্বত্ববান রায়ত— তাদের থেকে উন্নত অবস্থা এদের কোনওকালেই হয়নি। মাঙ্গদের মতো এদের বেশির ভাগই জীবিকায় যাযাবর চাষি, নয়তো ভূমিহীন দিনমজুর।৩২ দরিদ্রতম এবং দুর্বলতম গ্রামবাসী তারা, তাই জমিদার কি সরকারের বেগার দেওয়া এদেরই কাজ; ‘যে কোনওরকম অস্পৃশ্য কর্মপালনে তারা বাধ্য’; যুগ যুগ ধরে এরাই আছে ‘সমগ্র হিন্দুসমাজের ক্রীতদাসের ভূমিকায়।’৩৩ অন্যথায় তার জন্য পড়ে থাকত ভবঘুরের অপদার্থ জীবন এবং আনুষঙ্গিক জীবিকায় ভিক্ষা কিংবা ডাকাতি। যে সমাজ কৃষি ব্যবস্থায় নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাচ্ছে, সেখানে এমন মানুষকে ভাবা হত প্রান্তিক; তাদের বাস সমাজের প্রান্তে, তাই সমাজের অন্যান্য অধিবাসীদের কাছে তারা ঘৃণ্য। কর্তৃপক্ষ অত্যাচার করত এদের উপরে, এমন কী মনুর সময়েও এরা সমাজের আইন-শৃঙ্খলার পক্ষে বিপদের আশঙ্কা বলে গণ্য হত। যে অরণ্য ছিল তাদের খাদ্য সংগ্রহের উৎস, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার চাপে সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার বন্ধ হল, বাড়ল তাদের জীবিকার অনিশ্চিতি। ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষায় তারা ‘অপরাধপ্রবণ উপজাতি’; এই নামকরণ তাদের পতিত দশাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তাদের জীবন বন্দি শিবিরে নির্দিষ্ট, সেখানকার নিয়ম চলে কার্ফু-র ঘণ্টায় আর ফৌজদারি ব্যবস্থায়।৩৪
এমন সব গোষ্ঠী সমাজে যেমন দরিদ্র এবং বিপর্যস্ত, কোনও আচার-অনুষ্ঠানের পক্ষে তাদের উপস্থিতি তেমনি চরম অশুচি। ধর্মশাস্ত্রে আক্ষরিক অর্থেই তাদের অশুদ্ধতার প্রতিভূ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ অশুচি এমন মারাত্মক যে যদি কোনও উচ্চবর্ণজাত ব্যক্তি তাদের দৈহিক সংস্পর্শে আসে, এমনকী তাদের ছায়া পড়ে সেই ব্যক্তির গায়ে, অথবা তাদের চোখে পড়ে যায় তেমন এক উচ্চবর্ণ, কঠিন শাস্তি আর কঠোর শুদ্ধাচারের প্রায়শ্চিত্ত মেনে তবেই সে ফিরে পাবে তার উচ্চবর্ণের গৌরব। এই রীতি ব্রাহ্মণধর্মের শূন্যগর্ভ আদেশমাত্র নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর উপান্তেও সামাজিক প্রথা এমন রীতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, ‘এমন তথ্য লিপিবদ্ধ আছে যে স্থানীয় শাসকদের আমলে পুনার ফটকের ভিতরে দুপুর তিনটে থেকে সকাল ন-টা পর্যন্ত মাহার এবং মাঙ্গদের প্রবেশাধিকার ছিল না, কারণ সেই সময়ে তাদের দেহ নাকি একান্ত দীর্ঘ ছায়া ফেলে।’৩৫ এই সংস্কারের বিলোপসাধনে ঔপনিবেশিক ‘আধুনিকীকরণের’ কার্যকারিতা সামান্যই ছিল; ইংরেজ শাসনের শেষ দশকের একটি পর্যবেক্ষণে তারই স্বচ্ছ পরিচয় আমরা পাই: ‘যখন কোনও ডোমকে সাক্ষ্য দিতে আদালতে ডাকা হয়, দর্শকবৃন্দ তার স্পর্শ থেকে নিজেদের বাঁচাতে আপন আপন পরিচ্ছদ সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হয়ে ওঠে [এই প্রথা ভাঙ্গি এবং ওই শ্রেণীভুক্ত যে কোনও মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য]।’৩৬
যেসব মানুষ ঘৃণার লক্ষ্য, ঐতিহ্যের ভারে অশুচির বোধকে তারা আত্মস্থ করে নিয়েছে; বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনা এখানেই। তারা সকলেই এমন পুরাণের অনুগামী, যে কাহিনীতে কোনও এক আদি পাপ তাদের অশুদ্ধ পরিণামের হেতু; আর সেই পাপ সব ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যের শুদ্ধতাবিধি থেকে তাদের কোনও-না-কোনও পূর্বপুরুষের বিচ্যুতিতে প্রকাশ পায়। শিব পার্বতী এক ভোজসভায় বর্ণনির্বিশেষে সকলকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সর্বপ্রথম ডোম সুপাচ ভগৎ সেখানে পৌঁছেছিল বিলম্বে এবং ভক্ষণ করেছিল উচ্ছিষ্ট। সেদিন থেকে তার উত্তর-পুরুষেরা অন্য বর্ণের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণে বাধ্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উচ্ছিষ্টভোজী জাতির সঙ্গে তারা সহজেই নিজেদের মিলিয়ে নিতে পারে, রিসলির এই ধারণার উৎস পূর্বোক্ত উপাখ্যান।৩৭ এই আখ্যানেরই এক পরিবর্তিত পাঠে (যেখানে আতিথেয়তায় রয়েছেন রাম সীতা) ভাঙ্গিরা খুঁজে পায় জীবনের প্রসাদ থেকে নিজেদের বিচ্যুতির কারণ।৩৮ ডোম, ভাঙ্গি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন অনেক আখ্যান প্রচলিত আছে যেখানে তাদের পূর্বপুরুষ মৃত পশু স্পর্শ করার অশুচি অপরাধে দুষ্ট। নিজেদের জন্মগত অশুদ্ধতার সূত্রনির্দেশে মাঙ্গরা বলে, সে বংশের প্রথম মানুষকে লেগেছিল শিবের বাহন ষাঁড়কে খোজা করার অভিশাপ। এমন আরও বহু কাহিনীর প্রচলন আছে। আখ্যানগুলিতে দেখি, কী ভাবে বিশ্বের হতভাগ্যরা নিজেদের ভাগ্যহীনতাকে আধ্যাত্মিক উপায়ে যৌক্তিক আর বুদ্ধিগ্রাহ্য করে তুলতে চায়।
মনে হতে পারে, হিন্দু সমাজের পতিতদের কাছে এই ধর্মীয় চেতনা শুধু নিজেদের অবস্থাকে ভাগ্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উপায়; এমন চিন্তা একপেশে আর সেই কারণেই বেঠিক। একই চৈতন্যের ভিন্ন উপাদানসমূহ প্রকাশ পেয়েছে সমান্তরাল অন্যান্য কাহিনীতে। ওই একই নিম্নবর্গের কল্পনায় সেই সব আখ্যানের নির্মাণ, কিন্তু বিষয়ে তা বিষাদের আখ্যান তো বটেই, কখনও বা বিদ্রোহের ইস্তাহারও। এই চেতনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থই এক গণ্ডিকে নির্দেশ করা; সে গণ্ডির বাইরে মানুষ নিজের হীনতাকে মেনে নিতে অক্ষম। সে গণ্ডি মানুষের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের অঙ্গীভূত। অবশ্য উচ্চবর্গের ধারণা এর বিপরীত; তারা ভাবে, সাধারণ মানুষ নিজের নিয়তিকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেয়।
৪
বিরুদ্ধতার উপাদানে এসব জাতির বিশ্বাসের জগৎ স্পষ্টই চিহ্নিত। যে শাসনব্যবস্থা তাদের উপরে আরোপ করা হয়েছে, তার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের কাছে নতি স্বীকার নয়, বরং তাকে অস্বীকার করাই এই বিরোধের প্রবণতা। তবু এই বিরুদ্ধতা এমন কোনও সুস্পষ্ট কর্ম খুঁজে পায় না, যার জোরে দুনিয়াটাকে উলটে দেওয়া যায়। বরং, এই যে বিরোধের সম্ভাবনা ব্যর্থ হয়, সেখানেই শুরু হয় নানান আচার-অনুষ্ঠানের অবক্ষেপ; ফলে শেষ পর্যন্ত বিরুদ্ধতার উপাদান প্রভুর জন্যেই অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে দিয়ে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিরুদ্ধতা থেকে যায় সেই চেতনার পর্যায়ে, যার অস্তিত্ব শুধুই তত্ত্বে, জীবনে নয়; বিরুদ্ধতার এই চৈতন্যে প্রকৃত যন্ত্রণা থাকে নিশ্চয়, কিন্তু তার তত্ত্বের অনুষঙ্গে কোনও উপযুক্ত কর্ম অনুপস্থিত। এমন অবস্থায় চেতনাই হয়ে পড়ে নিছক এক নেশার আচ্ছন্নতা, তার পরিণাম নিষ্ক্রিয়তায় আবিষ্ট। নিচু জাতির ধর্মবিশ্বাসের একেবারে মূলে রয়েছে এই স্ববিরোধ। সুতরাং শাসক সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্যের এই ঝোঁককে বিপরীত প্রবণতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার—বিপরীত প্রবণতার আকর্ষণ উলটোপথে—প্রতিবাদের দিকে।
একাধারে স্ববিরোধী এবং পরিপূরক এই প্রবণতার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে ডোম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত বেশ কিছু উপাখ্যানে এবং পূজাপার্বণে। তার প্রকাশ আধ্যাত্মিক দুঃসাহসে। কর্তৃত্বকারী সংস্কৃতির কাছে যারা কোনও স্বীকৃতি পায় না, সেই সব বাস্তব চরিত্র এবং পৌরাণিক মূর্তিকে এমন সাহস ঐশ্বরিক মর্যাদায় ভূষিত করে। বাস্তবের চোর ডাকাত যেমন মরণোত্তর দেবত্ব লাভ করে, তেমনি দেশের অক্ষম দরিদ্র মানুষের উপর প্রভাব ফেলে পৌরাণিক বীরের অসাধারণ কীর্তি, তাদের অতিমানবিক ক্ষমতার রূপক। সেই ক্ষমতা একাধারে দৈহিক এবং আধ্যাত্মিক। ইতিহাসের যে দুই রদবদলের মূলে ছিল আর্য সভ্যতা এবং উপনিবেশের সংস্থাপন, পূর্বোক্ত দৃষ্টান্তগুলিতে একসঙ্গে তারই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার প্রকাশ পায়। জনসংখ্যার এক বিপুল অংশ কৃষিজীবিকার সংস্কৃতিতে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের আধ্যাত্মিকতায় পুরোপুরি মিশে যেতে পারেনি; ইংরেজ শাসনেও তাদের অবস্থা অনেকাংশেই অপরিবর্তিত থাকে, তারা বিকল্প জীবিকার পথ খুঁজে পায় অসৎ কর্মে; এর অনুষঙ্গে তাদের ধর্মে আসে এক ভিন্ন প্রবণতা, যা অপরাধীকে বানিয়ে তোলে উপদেবতা।
হিন্দুসমাজে যে-সব মূল্যবোধ মুখ্য, এই পরিবর্তন প্রণালী তার প্রতিবিধানেরই সামিল; এই প্রণালী আধ্যাত্মিক চেহারা দিল কিছু উপাদানকে; সমাজের তত্ত্বাবধায়কদের বিচারে সেই উপাদানগুলি এতদিন ছিল অসামাজিক। এই প্রণালীর কর্মকাল এতই দীর্ঘ যে তাকে আমরা বিপরীত ঐতিহ্যের চেহারায় দেখি। কোশাম্বি লিখেছেন পশ্চিমাঞ্চলের সেই বোলহাই দেবীর কথা; এই দেবী ‘নাকি গিয়েছিলেন কতিপয় তস্করের সঙ্গে।’ কোশাম্বির মতে, তাঁর এই যাত্রা সেই তথ্যেরই নিশ্চিত ইঙ্গিত যে, ‘দেবী তেমনি এক উপজাতির রক্ষাকত্রী, যারা কখনও বশ্যতা স্বীকার করেনি।’৩৯ একইভাবে দোসদরা ডাকাত দেবতা গোড়াইয়া আর সালেশকে পূজা করে; সেই যে চোর গণ্ডক, যার ফাঁসি হয়েছিল আর তার বন্ধু সামাইয়া, দুজনকেই মঘইয়া ডোমরা দেবতা বলে মানে; ডাকাত সর্দার শ্যাম সিংকে সব ডোমই ভাবে রক্ষাকর্তা ভগবান এবং নিজেদের পূর্বসূরী। এমন করে বার বার জাতিগুলির দেশজ পূর্ব ইতিহাস প্রমাণ হয়।৪০ যেসব আদিবাসী বশ্যতা মানেনি, তাদের নিয়ে কোশাম্বির ইঙ্গিত আরও জোরদার হয় যখন দেখি তাদের দেবতার প্রতিনিধি কখনওই হিন্দু প্রথানুরূপ মূর্তি নয়, বরং পাথর অথবা ঢেলা। আচার-অনুষ্ঠানে তাদের নৈবেদ্যও ব্রাহ্মণ্য প্রথানুরূপ নয়, এদের নিবেদন শুয়োর, মোরগ আর কারণ।
একজন দস্যুদেবতার আরাধনা অন্যান্য অনুরূপ দেবতার মতো কোনও এক বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর নাম বাল্মীকি। ব্রিগ্স বলেছেন,৪১ বাল্মীকি ‘মধ্য ভারতের দেশজ আদিবাসীদের একজন।’ এই মত সন্দেহাতীত নয়। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে, দক্ষিণ ভারতের নিম্নজাতির মানুষও তাকে ঈশ্বর বলে মানে। হিংসাত্মক জীবনে লিপ্ত বাল্মীকি প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন। এই কাহিনী সব শ্রেণীর হিন্দুরাই মেনে নেয়। কিন্তু পতিতরা তাঁর উপাখ্যানকে নিজেদের বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে বাল্মীকিকে একান্তই নিজের করে নিয়েছে। একটি আখ্যানে বাল্মীকি কালু আর জীবনের জনক। সেই কালু আর জীবন থেকে আবার ডোম আর ভাঙ্গিরা তাদের উৎপত্তি নির্দেশ করে। ভিন্ন কিছু গল্পে কখনও ভাঙ্গিদের পূর্বপুরুষ লাল বেগ স্বয়ং অথবা তাঁর পুত্র বলে, কখনও বা ডোম সম্প্রদায়ের কাল্পনিক প্রতিষ্ঠাতা সুপাচ ভগৎ বলে অথবা পঞ্চপাণ্ডবের একজন নকুল বলে বাল্মীকিকে সনাক্ত করা হয়। শব্দের খেলায় নকুল কথাটির অর্থ হতে পারে কুল নেই যার; আর এই ভাবে নকুল পেয়ে যায় প্রথম ভাঙ্গির পদমর্যাদা।
বাল্মীকির দৃষ্টান্তে আরও কিছু মন্তব্য সম্ভব। ভাষাগত রীতির জোরে এই বিশেষ উপাখ্যানটির বৃত্তে আরও পরিবর্তন আসতেই পারে। শ্লোকচ্ছন্দের কাঠামো নিয়ে কাহিনীর প্রচলন আছে; রামায়ণের শুরুতে ব্যাধের নিষ্ঠুর হত্যার প্রতিবাদে বাল্মীকি ব্যাধকে অভিশাপ দেন; সেই অভিশাপের বচন আরম্ভ হয় ‘মা নিষাদ’ বলে। অভিশাপের সেই স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দেই শ্লোকের ছন্দ।৪২ আবার এমন লোকগাথারও চল আছে, যার নানান পাঠে৪৩ জানি, বাল্মীকি পাপমুক্ত হয়েছিলেন বার বার সেই ইতর আর অশুচি শব্দ ‘মরা’ উচ্চারণ করে। নিরবচ্ছিন্ন উচ্চারণে শব্দ গেল উলটে, অর্থাৎ রাম, যে নাম ঐশ্বরিক বীরের, যে নাম পবিত্র।
ভাঙ্গিদের পৌরাণিক আখ্যান অন্যান্য অনুরূপ আখ্যান থেকে বিশিষ্ট; সেখানে এক মহাকাব্যের উপাদান আর এক মহাকাব্যের উপাদানে জড়িয়ে গেছে, মিলে গেছে বাল্মীকি আর নকুল। ব্রিগ্স মনে করেন, এই যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে ‘বাল্মীক’ শব্দটির নিপুণ ব্যবহারে। বাল্মীক, অর্থাৎ ভাল ছেলে। আখ্যানমতে, কথাটি ব্যবহার করে ভাইরা নকুলকে ভুলিয়েছিল, একটি মৃত পশুকে স্থানান্তরে নিয়ে যেতে নকুল সম্মত হয়েছিল। আর যখন সে কাজটা করছে, ভাইরা পালাল তাকে ফেলে। তার পর, অপর এক বাক্চাতুর্যে, নকুল, যার নতুন পরিচয় এখন বাল্মীক, অর্থাৎ আখ্যানের সৃজনশীলতায় বাল্মীকি, হয়ে গেল সুপাচ ভগৎ। সেই সব মানুষের জন্মদাতা এই সুপাচ ভগৎ, যারা রুটি বানাতে আটায় যে ছাঁকুনি দরকার, তাই বানিয়ে আর বেচে জীবিকা নির্বাহ করে।৪৪ রামায়ণে বাল্মীকি আগে দস্যু, পরে পাপমুক্ত কবি। সাত্ত্বিক শূদ্রের নিধনকে তাঁর মনে হয়েছিল ন্যায়ের প্রতিভূ, সেই হত্যার গুণগান করেছিলেন তিনি। কারণ সেই শূদ্র ব্রাহ্মণ্যের উৎকর্ষ এবং তার পুরস্কার পেতে চেয়েছিল; সে উৎকর্ষ অথবা পুরস্কার শুধুমাত্র উচ্চজাতেরই যোগ্য, তাই শূদ্রের এই কামনা ব্রাহ্মণদের অপমানের সামিল। উচ্চবর্ণদের যথার্থ জবাব দিয়েছিল ভাঙ্গিরা। সংস্কৃত কৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে নিজেদের কথায়, কল্পনায় পাপভ্রষ্ট দস্যুকেই তারা বানিয়ে নেয় নিজেদের পূর্বপুরুষ এবং রক্ষাকর্তা। নিম্নবর্গের এক ধরনের কার্যকলাপ নির্বিচারে অপরাধ বলে চিহ্নিত হয়। তার মধ্যে যদি সেই দ্ব্যর্থ নীতিবোধের পরিচয় মেলে, যা ‘সামাজিক দস্যুবৃত্তি’ বা সোশ্যাল ব্যান্ডিট্রির ধারণায় স্বীকৃত, তবে বাল্মীকিতে দেবত্ব আরোপ এবং অপরাধে দুষ্ট আরও বহু দেবদেবীর অস্তিত্ব পূর্বোক্ত নীতিবোধ এবং তার সঙ্গে প্রচলিত ধারণাকে গৌরবান্বিত করে।
বিকল্প ন্যায়বোধ আর সেখানে নিহিত সমালোচনার নিদর্শন কেবল দস্যুবৃত্তির আধ্যাত্মিক মূল্যায়নেই নয়; হিন্দু পুরাণের সেই কুখ্যাত বিদ্রোহী রাজা বেণ-এর৪৫৪৫ প্রতি সুস্পষ্ট অনুমোদনও তেমন প্রতিবিধানের প্রবণতাই প্রমাণ করে। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তো রাজার কুকীর্তি নিয়ে কাহিনীর ছড়াছড়ি। মনুসংহিতায় (৯, ৬৬) বিধবাবিবাহ প্রচলনের, অন্তত তাকে মেনে নেওয়ার অপরাধে রাজাকে দোষারোপ করা হয়। মনুর মতে, দ্বিজজাতির বিদগ্ধগণ এমন বিবাহকে একমাত্র পশুরই উপযুক্ত মনে করেন। পদ্মপুরাণ বলে, শাসক হিসাবে রাজা বেণ-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ যথেষ্ট ভাল, কিন্তু পরবর্তীকালে জৈন ধর্মে তাঁর মতি হল। শাস্ত্রমতে তাঁর চরমতম অপরাধ ছিল সর্বপ্রকার বলি, দান এবং নৈবেদ্য বন্ধ করা, ব্যতিক্রম কেবল সেই সব ক্ষেত্রে, যেখানে রাজা নিজেই উৎসর্গের লক্ষ। রাজা ঘোষণা করেছিলেন, ‘সকল নৈবেদ্যের উপরে একচ্ছত্র অধিকার আমার।’ যে ঋষিরা ওই সব অনুষ্ঠান পরিচালনা করত এবং দেবতাকে উৎসর্গীকৃত দানসামগ্রী আত্মসাৎ করত, তারা রাজার আদেশে আপত্তি জানায়। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে রাজা বলেন, ‘কে তোমাদের এই হরি যাকে তোমরা বর্ণনা কর তোমাদের নৈবেদ্যের অধিকারী বলে? ব্ৰহ্মা…এবং অন্য সব দেবতাই…রাজার ব্যক্তিত্বে বিরাজ করেন…।’ ঋষি এবং পুরোহিতগণ এতদূর সহ্য করতে পারেননি। কুশতৃণ দিয়ে রাজাকে তাঁরা বধ করেন; এই কুশতৃণ পৌরাণিক আখ্যানে দেবতাদের শত্রুনিধনের হাতিয়ার। কাহিনীতে আছে বিন্ধ্য অঞ্চলের বন্য উপজাতি নিষাদ এবং ম্লেচ্ছরা এই রাজার শরীর থেকে উদ্ভূত। ডোমেরাও বলে যে তারা রাজা বেণ-এরই বংশধর। এ হয়তো তাদের আদিবাসী জন্মের স্মৃতি। কথাটির ঐতিহাসিক ভিত্তি যাই হোক, এর নিশ্চিত সাদৃশ্য আছে ডোমেদের ঐতিহ্যের কিছু উপাদানের সঙ্গে; বিদ্রোহের মানসিকতা তেমন উপাদানের অবলম্বন। যেমন বস্তি-গোরখপুরে ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত শাসকেরা ব্রাহ্মণ কন্যাদের বিবাহ করতে চেয়ে সেখানকার ব্রাহ্মণদের বিপদে ফেলেছিল।
৫
রাহুও ব্রাহ্মণদের শত্রু, তাদের ঘৃণার পাত্র। রাহু যে ডোম সম্প্রদায়ের আরাধ্য, তা বর্ণহিন্দু সংস্কৃতির প্রতি নিম্নবর্ণের বিরোধিতার আর এক নিদর্শন। আমরা রাহু পূজার প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত বিবরণ পাই বিউক্যানান-হ্যামিলটন-এর লেখায়। উনিশ শতকের গোড়ার বছরগুলিতে পূর্ণিয়া অঞ্চলে তিনি দেখেন৪৬, নাথপুরের দোসাদরা ব্রাহ্মণধর্মের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে কী ভাবে নিজেদের আচার-অনুষ্ঠানগুলিকে জাহির করত, রাহু-আরাধনার উপলক্ষে। সেখানে রাহু পূজা এক বলির চেহারা পেত; তার কেন্দ্রে ছিল মুখ্যভক্তের অগ্নিপরিক্রমা; সে নিজে একজন দোসাদ, আবার অশরীরীর সঙ্গে সংযোগস্থাপনের মাধ্যমও বটে।৪৭ সেই ভক্ত ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দিত নিজের হাত; খালি পায়ে হেঁটে যেত সাড়ে তিন মিটার দীর্ঘ জ্বলন্ত কয়লার জাজিমের উপর দিয়ে, তবু তার দেহ পুড়ত না, কোনও ফোসকাও পড়ত না তার শরীরে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে জনতার যে মানসিক প্রতিক্রিয়া হত তার বর্ণনায় বিউক্যানান-হ্যামিলটন লিখছেন, ‘এটা স্পষ্ট…যে সমগ্র দর্শক, সংখ্যায় যারা অগণিত, তারা সকলেই রাহুর প্রভাবে বিশ্বাস করত; দোসাদরা তো বটেই, সম্ভবত অন্য সকলেও বিশ্বাস করত যে রাহুর প্রভাবেই মানুষটি আগুনের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। আমার সঙ্গে যেসব ব্রাহ্মণ ছিল তাদের মহোল্লাসে চ্যালেঞ্জ জানাল মুখ্যভক্তের অনুগামীরা, সেই উপাসককে অনুকরণ করতে।’৪৮ সাহেবের দলে যে পণ্ডিত ছিল, এই দ্বন্দ্বের পরিণাম তার অনুকূল হয়নি।
আচার-অনুষ্ঠানে এ রকম ক্ষমতার যে স্বীকৃতি, তার চেয়ে নিম্নজাতির মধ্যে প্রচলিত গ্রহণ বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনী বেশি আলোকিত করত উচ্চবর্গ আর নিম্নবর্গের মধ্যে ধর্মীয় বচনের বিরোধকে। নিম্নজাতির এই পুরাণ সমুদ্রমন্থনের কাহিনীর (প্রথম উপাখ্যান) সমান্তরালে থাকে; এবং তারা দুয়ে মিলে একত্রে এক পরম্পরা নির্মাণ করে, ভাবের জগতে সে পরম্পরার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। পৌরাণিক কাহিনীর এই পরম্পরা কখনওই বিচ্ছিন্নভাবে কার্যকরী হয় না। বরং সাবেকি হিন্দু পুরাণের কাহিনীতে নিজেদের বিষয়বস্তু মিশিয়ে তাকে বদলে দেয়। প্রথমত রাহু এবং তার অনুগামীদের মধ্যে একটি সম্পর্কের অস্তিত্ব নির্দেশ করে; দ্বিতীয়ত নিম্নবর্গের বাস্তব এবং সামাজিক অবস্থার উপরে সেই সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে, আরও খুলে বলতে গেলে, সম্পর্কটি যেন গ্রথিত হয় পৃথিবীর মাটিতে। দ্বৈত প্রক্রিয়ায় সংঘটিত কাঠামোগত পরিবর্তনের সমগ্রতা থেকেই গড়ে ওঠে নিম্নজাতির ভাবাদর্শের বৈশিষ্ট্য। পুরাণের উপাদানকে নিম্নবর্গের গোষ্ঠীগুলি কেমনভাবে আপন করে নেয়, নিম্নোক্ত আখ্যান তারই দৃষ্টান্ত।
দ্বিতীয় উপাখ্যান
রাবণ বিজয়ের পরে লঙ্কা থেকে ফিরে রাম তার সেনাবাহিনীর জন্য এক ভোজের আয়োজন করেন। মহাদেব (শিব) পার্বতীর উপরে ছিল পরিবেশনের ভার। এমন সময় নিম্নজাতির এক মাঙ্গ বালকের উপস্থিতির প্রতি মহাদেব পার্বতীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন,…এবং পার্বতীকে সতর্ক করে দেন, পরিবেশনের সময় তিনি যেন ছেলেটির থেকে যথোচিত দূরত্ব রাখেন। কিন্তু রাম যখন সেই মাঙ্গকে দেখতে পেলেন, তার দুঃসাহসিক অপরাধের জন্য রাম তাকে বধ করলেন; কারণ সেই বালক নিজের অশুদ্ধ উপস্থিতিতে ভোজসভার পবিত্রতা খর্ব করতে চেয়েছিল। মৃত ছেলেটির মাতা তখন সন্তানের মস্তক একটি ডালায় স্থাপনপূর্বক বিশুদ্ধ জলের ছিটায় প্রাণসঞ্চারের বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। হারানো পুত্রের মস্তকবাহী সেই ডালা নিয়ে সে গেল দেবদেবীদের কাছে, নিজের খাদ্য ভিক্ষা চাইতে। পর্যায়ক্রমে গেল সে সূর্য এবং চন্দ্রের কাছে, ভয় দেখাল তাঁদের, বলল যদি তার অনুরোধ রক্ষা না হয়, সে চন্দ্র সূর্যকে স্পর্শ করবে, নষ্ট হবে তাঁদের শুদ্ধ চরিত্র। সেই ডালার ছায়াই গ্রহণের কারণ। এই মাঙ্গনারী, অর্থাৎ সেই উত্যক্তকারী পাওনাদারের হাত থেকে রেহাই পেতে চন্দ্র সূর্যকে নৈবেদ্য দান এবং মাঙ্গদের ভিক্ষাদানের প্রথা চালু হলো।৪৯
পরিবর্তনের উপাদানগুলি এক নজরেই স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথম উপাখ্যান মহাভারতের অংশবিশেষ, কিন্তু দ্বিতীয় উপাখ্যান রামায়ণের পাঠ। প্রথম কাহিনীতে নিমন্ত্রণকর্তা এবং হত্যাকারী ছিলেন বিষ্ণু, কিন্তু এখানে সেই একই ভূমিকায় দেখি রামকে। তবে এই আখ্যানে দোষী এবং শিকার কোনও দানব নয়, শম্বুকের মতো একজন অস্পৃশ্য, অধিকারের নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবার জন্য যে প্রাণ দিল। এই কাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধানেই দেখি, এখানে তার অপরাধ দেবতাদের আহার্য অপসারণে নয়, কিন্তু নিজের অশুদ্ধ উপস্থিতিতে ভোজসভাকে অপবিত্র করায়। মুণ্ডচ্ছেদের পরবর্তী ঘটনাবলী প্রথম কাহিনী থেকে দ্বিতীয় কাহিনীতে আলাদা। প্রথম আখ্যানে ছিল প্রতিশোধস্পৃহা, কিন্তু দ্বিতীয় উপাখ্যানে প্রতিশোধ-প্রবণতার থেকে বড় হয়ে ওঠে বিচারের অন্বেষণ; বিচার খুঁজে ফেরে এক মা, যে হারিয়েছে তার সন্তানকে হারিয়েছে নিজের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। প্রথম পুরাণে ছিল বিষ্ণুর দুই বার্তাবহ চন্দ্র-সূর্যের বিরুদ্ধে ফিরে ফিরে আক্রমণ, দ্বিতীয় কাহিনীতে দেখি দেবতাদের কাছে ভিক্ষাপ্রার্থনা অর্থাৎ ধরনা দেওয়ার চিরাচরিত চেহারা।
পরিবর্তনের এই পরম্পরায় রাহু মিলে যায় মাঙ্গ-এর সঙ্গে, মাঙ্গ-এর সামাজিক অস্তিত্বই আরোপিত হয় রাহুতে। বাস্তবজীবনের এই প্রক্রিয়া ভারতের বহু পৌরাণিক কাহিনীতে উপস্থিত, যেখানে ঈশ্বর আর মানুষ একাত্ম এবং একে অপরের পরিপূরক। এই উদ্দেশ্যে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়—ব্যাকরণের পদ্ধতি, কুলুজির পদ্ধতি এবং পূজার পদ্ধতি। ব্যাকরণ-পদ্ধতি যে কোনও দুটি রাশির মধ্যে সংযোগকে একটা সাধারণ রূপ দেয়, যেমন ক হচ্ছে খ। দ্বিতীয় উপাখ্যানে দেখি রাহু হচ্ছে একজন মাঙ্গ। আবার মধ্যপ্রদেশ অঞ্চলের যেসব লোকগাথা রাসেল এবং লাল একত্র করেছেন সেখানে রাহু হচ্ছে একজন মেথর বা ভাঙ্গি।৫০ কুলুজি পদ্ধতি আসে নিম্নোক্ত আকারে, ক হচ্ছে খ-এর একজন পূর্বপুরুষ। বিহারের তিরহুত অঞ্চলের দোসাদরা বলে রাহু (আঞ্চলিক ভাষায় রাহ অথবা রাহ্) তাদের একজন পূর্বপুরুষ, যুদ্ধে যার মৃত্যু হয়েছিল।৫১ মির্জাপুরের দোসাদদেরও গর্ব আছে, রাহু তাদের পূর্বপুরুষ বলে; আখ্যান অনুযায়ী (যে আখ্যানে আজও পাই সেই পৌরাণিক যুদ্ধের স্মৃতি) তাদের রাহু বাংলাদেশ থেকে উত্তরপ্রদেশ যাত্রাপথে বন্দি হল জগন্নাথের (বিষ্ণু) মন্দিরে।৫২ কথিত হয় পশ্চিমাঞ্চলের মাঙ্গরাও সেই দানব কুলজাত, যে দানব গ্রহণকালে চন্দ্রকে গ্রাস করে।৫৩ পূজা-পদ্ধতির (খ ক-কে পূজা করে) প্রক্রিয়ায় যে কোনও বিগ্রহ আরাধনার নিয়মাবলী নির্দিষ্ট হয়। সেখানেও পার্থিব বিশ্বের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখি; পূজারী এবং তার আরাধ্য দেবতার সম্পর্ক পুত্র এবং পিতার বন্ধনের মতো। সুতরাং কুলুজি-পদ্ধতির প্রক্রিয়া হয়ে যেতে পারে পূজা-পদ্ধতির প্রক্রিয়া; পূজা-পদ্ধতি হতে পারে কুলুজি পদ্ধতি। রাহুর সব পূজারীই তাই নিজেকে রাহুর উত্তরপুরুষ ভাবতে পারে; এমন কী তারাও, দোসাদ বা মাঙ্গদের মতো যাদের পুরাণে রাহু পূর্বপুরুষ বলে বর্ণিত নেই।
ভাবজগতের যে কাঠামো আমাদের আলোচনার বিষয়, বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই বন্ধন তার পক্ষে একান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই বন্ধনের পরিণামে এক দিকে গ্রহণ, অন্য দিকে তার অশুদ্ধ আর অশুভ ইঙ্গিতে গ্রহণ যাদের ভয় দেখায়, এই দুয়ের ভিতরে এক মধ্যস্থতার ভূমিকা পেয়ে যায় পতিত মানুষেরা। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে একমাত্র তাদেরই ক্ষমতা আছে রাহুকে ভুলিয়ে তার প্রকোপ থেকে চন্দ্র-সূর্যকে উদ্ধার করবার, কারণ তারা রাহুর অনুগামী। অর্থাৎ হিন্দুসমাজে যারা সবচেয়ে অক্ষম এবং ঘৃণ্য, তারাই পারে অশুদ্ধতা আর ধ্বংসের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে। বিপরীত অর্থের ব্যঞ্জনায় এর মধ্যে যেন এক রসিকতার আমেজ এসে যায়। এ যেন নিম্নজাতিদের দেয় এক কৃত্রিম প্রভুত্ব, যার উৎপত্তি ওই ‘মধ্যবর্তী অবস্থায়’ জড়িয়ে আছে। কারণ ‘দুই বিপরীত মেরুকে অঙ্গীভূত করে এই মধ্যস্থতা; ফলে শেষ পর্যন্ত দুই প্রান্তের তুলনায় মধ্যবর্তীকেই মনে হয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ বিত্তের জগতে বিনিময়মূল্যের মধ্যস্থতা এবং আধ্যাত্মিক জগতে মধ্যবর্তীদের ভূমিকা মার্কস-এর উক্তিতেও৫৪ সমানভাবে সত্য।
‘ধর্মের জগতে তাই দেখি খ্রিস্ট দেবতা আর মানুষের মধ্যবর্তী সেতু—তাদের পরস্পরের মধ্যে বহতার এক উপায়মাত্র, আবার সেই খ্রিস্টেই মিলে যায় দেবতা আর মানুষ, খ্রিস্ট হয়ে যান মানুষদেবতা, যাঁর তাৎপর্য দেবতার থেকে বেশি। সন্তরা খ্রিস্টের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আবার পোপদের গুরুত্ব সন্তদের থেকে বেশি।’
ঠিক তেমনি রাহু এবং এক জ্যোতিষ্কের পারস্পরিক বিরোধের চরম মুহূর্তে পতিতকে দেখি দুজনের মধ্যবর্তী অবস্থায়। মনে হয়, রাহু এবং জ্যোতিষ্ক, উভয়ের উপরেই এখন পতিতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত; রাহু তার অধীন, কারণ সেই পতিতই একমাত্র চন্দ্র-সূর্য উদগীরণে দানবকে বাধ্য করতে পারে; অন্য দিকে চন্দ্র-সূর্য এবং চন্দ্র-সূর্যের উপরে যাদের জীবন নির্ভর, তারা সকলেই পতিতের অধীন, কারণ পতিতই একমাত্র পারে এই পরিস্থিতিতে তাদের রক্ষা করতে।
ভাষার ব্যবহারে, পূজাপার্বণের সূত্রে এবং পবিত্র বংশানুক্রমের কাহিনীতে রাহুর সঙ্গে একাত্ম সব নিম্নজাতির মানুষের মধ্যবর্তীর ভূমিকা স্বীকৃতি পায় গ্রহণের লগ্নে, যখন আনুষ্ঠানিক সমারোহে তাদের উপর বর্ষিত হয় দান। ‘দানবগণের পূজা করে ডোম, তাই চন্দ্রকে দানবের গ্রাস থেকে মুক্ত করতে তারাই সক্ষম। সেই কারণেই ধার্মিক মানুষ গ্রহণকালে ডোমকে ভিক্ষা দেয়, যাতে ডোম তার ক্ষমতা ব্যবহার করে চন্দ্রের মুক্তির শুভসাধনে।’৫৫ উত্তরপ্রদেশে ভিক্ষাদান প্রথার এই বর্ণনার মিল আছে বাংলা এবং বিহার অঞ্চলে রিসলির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে। পার্থক্য একটাই যে বাংলা অথবা বিহারে প্রথাটা ঠিক দানের নয়; সেখানে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তামার পয়সা বাড়ির বাইরে রেখে দিত, ডোমেরা যেন তা সংগ্রহ করতে পারে।৫৬ রাহু ‘একজন মেথর অথবা মেথরদের দেবতা’, এই বিশ্বাসে মধ্যপ্রদেশের মানুষ গ্রহণলগ্নে মেথরদের ভিক্ষা দেয়, যদি রাহু ‘সন্তুষ্ট হয়ে জ্যোতিষ্কদের মুক্তি দেয়।’৫৭ আরও পশ্চিমে গুজরাটে ‘গ্রহণ লাগলেই ভাঙ্গিরা ঘুরে বেড়ায় “গ্রহণদান”, “বস্ত্রদান”, “রূপাদান” কলরবে।’৫৮
৬
উচ্চবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব দানকে বলা যায় স্বর্গে শান্তি এবং মর্ত্যে পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার মূল্য। ধ্বংসাত্মক দানবকে শান্ত করবার উদ্দেশ্যে যে আচার নির্দিষ্ট, তারই নাম শান্তি; এই নামেই আছে ওই দানের যথার্থ তাৎপর্যের ইঙ্গিত।৫৯ প্রথম উপাখ্যানের যে ব্রাহ্মণ্য বৈশিষ্ট্য, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই দানের দ্বিতীয় কোনও ব্যাখ্যা অসম্ভব।
কিন্তু যে পতিত দান গ্রহণ করে, তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই দানের এক ভিন্ন বিশ্লেষণ হতেই পারে। সেই সূত্র নিহিত আছে অপর পৌরাণিক আখ্যানে, যাকে অভিহিত করেছি দ্বিতীয় উপাখ্যান নামে। সেই আখ্যানে মাঙ্গনারী ভিক্ষার জন্য উত্ত্যক্ত করে দেবতাদের; ভিক্ষালাভে সেই নারীর অধিকার আছে; কারণ সেই নারী এমন এক মাতা, সন্তানের প্রাণনাশের পরে জীবনধারণের আর কোনও অবলম্বন যার অবশিষ্ট নেই। ভিক্ষাবৃত্তিতে ওই নারীর অর্থোপার্জন দেবতাদের বিবেককে সন্তুষ্ট রাখবারই সমতুল, কারণ দেবতাদের নায়ক রাম (বিষ্ণু) এবং শিব ছিলেন নিধনের কারক এবং প্ররোচক। বিপর্যস্ত মাতা জীবনধারণের ন্যূনতম দাবি করছেন, এ ঘটনা গভীর নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ—যেন এক ন্যায্য ক্ষতিপূরণেরই অন্বেষণ। একই ভাবে ভিক্ষাদান প্রথাকেও বলা চলে নৈতিকতার প্রতিনিধি। তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে মাঙ্গনারীকে বঞ্চিত করলে, তা হবে নীতিগত ভ্রষ্টতা। কারণ হিন্দুদের আদর্শ ধারণায়, যে কোনও দানেই, দাতা এবং গ্রহীতা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এক সম্পর্কে যুক্ত; সে সম্পর্ক যতখানি আধ্যাত্মিক, ততটাই জাগতিক। মার্সেল মাউস যাকে বলেছেন ‘আর্থনীতিক ধর্মতত্ত্ব’ তার নিয়ম এই দেওয়া নেওয়ার পরিচালক। সেখানে স্তরবিন্যাস অনুযায়ী সম্পত্তিতে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর অধিকার নির্দিষ্ট থাকবে; আর সেই অধিকার, যা তাদের আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক চাহিদাকে পূর্ণ করবে, তা হবে এক নৈতিক অধিকার। তাই যাদের সম্পদ আছে, সম্পদ ভাগ করে নেওয়া তাদের কর্তব্য। কিন্তু কোনও ক্ষতির প্রশ্ন এখানে নেই। বরং এ কেবল তাদের আধ্যাত্মিক উৎকর্যের উপায়ই নয়, তাদের ধনসম্পদও এভাবে বৃদ্ধি পায়। কারণ দান ‘সততই দাতাকে সমান প্রতিদান এনে দিতে পারে—কখনওই তা দাতার কাছ থেকে হারিয়ে যায় না, উপরন্তু এনে দেয় আরও কিছু, যা ছিল না আগে; আথবা দাতা তার দান লাভসমেত সম্পূর্ণ ফিরে পায়।’৬০ বলা যায়, পতিত ভিক্ষুকের প্রতি দাতার আচরণে পৃষ্ঠপোষকরা নিজেদেরই উপকার করেছিল: তারা যে কেবল সমতুল্য প্রতিদান এবং সম্পদবৃদ্ধির নিশ্চিতি পেল তাই নয়, চাওয়া-পাওয়ার যে প্রবাহে দানের স্থান, সেই প্রবাহে বাধাসৃষ্টির পাপও তাদের স্পর্শ করতে পারল না।
স্বকীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনও দাতা এই প্রবাহে বাধাসৃষ্টির পাপ নাও এড়াতে পারেন, হরিশ্চন্দ্রের নিয়তিই তার দৃষ্টান্ত। আখ্যানের সেই রাজা ব্রাহ্মণের দাবিতে সাড়া দিয়েছিলেন নিজের ‘স্বর্ণ, স্ত্রীপুত্র, দেহ, রাজ্য, জীবন এবং সৌভাগ্য’ উৎসর্গ করে। কথামতো সবই গ্রহণ করেন ব্রাহ্মণ, এবং প্রতিশ্রুতি পালনার্থে রাজাকে প্রথমে স্ত্রী, তার পর পুত্র, শেষ পর্যন্ত নিজেকেও বিক্রয় করতে হয়। চরমতম বিপর্যয় আসে, যখন নিজেকে তিনি বিক্রয় করেন এক চণ্ডালের কাছে। এই পুরাণ অবলম্বনে যে কাহিনী গড়ে ওঠে, সেখানে দেখি, ডোমদের পূর্বপুরুষ কলুবীর সেই দুর্ভাগা রাজাকে কিনেছিল, আর এতই সৎ ব্যবহার করেছিল রাজার সঙ্গে যে ‘রাজা সমগ্র উপজাতিকে নিজের ধর্মে দীক্ষা দিলেন।’৬১ এই কারণেই ডোমেরা বলে, তারা রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রতিনিধিরূপে গ্রহণকালে দান গ্রহণ করে। তাদের মতে, ‘রাজা যখন ভিক্ষাচরণের উদ্দেশ্যে স্বর্গ থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, ভগবান বললেন, কেউ যদি তাঁকে খাওয়াতে স্বীকৃত না হয়, চন্দ্র-সূর্য তবে অদৃশ্য হবে। গ্রহণলগ্নে ডোমেরা তাই দান গ্রহণ করে, কারণ রাজার আত্মা তখন ক্ষুধার্ত।’৬২ হরিশ্চন্দ্রের ভূমিকা সম্পূর্ণ উলটে গেছে; আদি পুরাণে তিনি ছিলেন দাতা, এখানে তিনি দানগ্রহণকারী। কিন্তু একজনের চাওয়া এবং আর একজনের দেওয়ায় মিলে দানের যে তাৎপর্য, তা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত আছে। দানের কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতিতে চাওয়া-দেওয়ার পরম্পরা যদি ব্যাহত হয়, তবে শুধু এক গৃহস্থ নয়, সমগ্র বিশ্বই ধ্বংস হতে পারে গ্রহের প্রবর্তনে কোনও এক অসঙ্গতির আক্রমণে।
গ্রহণ-বিষয়ক আর এক উপাখ্যানেও দানের রূপকল্প পুনরায় ফিরে আসে। তবে এ কাহিনীতে পুরো বিন্যাসের তাৎপর্য অনেক কম।
তৃতীয় উপাখ্যান
চন্দ্র-সূর্য দুই ভাই। এক ক্ষুধার্ত পূজারী একদিন তাদের কাছে এসে বললে, ‘আমি দরিদ্র, ক্ষুধার্ত। আমাকে কিছু খেতে দাও।’ ভ্রাতৃদ্বয় তাই এক মেথরানির কাছে গিয়ে বলে ‘এই লোকটিকে কিছু শস্য দাও।’ মেথরানি এক বছরের জন্য কিছু শস্য ভিক্ষুককে দিতে সম্মত হল। ভ্রাতৃদ্বয় মেথরানিকে আদেশ করল, পাত্রের নীচের থেকে শস্য বের করে ভিক্ষুককে দিতে। এই ক্ষতি তারা পূরণ করে দেবে পাত্রের উপর থেকে শস্য ঢেলে ঢেলে। বছর চলাকালীন সূর্য-চন্দ্র পাত্র ভরে দিতে পারল না। বছর অতিক্রান্ত হলে মেথরানি বললে, ‘আমাকে ক্ষতিপূরণ দাও, কারণ পাত্র এখনও ভরেনি।’ ক্ষতিপূরণে অক্ষম চন্দ্র-সূর্য নিজেদের গোপন করে রাখল। আজও যখন গ্রহণ লাগে, চন্দ্র-সূর্যের পূজারীরা বিভিন্ন শস্য সংগ্রহপূর্বক, তা একসঙ্গে মিশিয়ে ভিক্ষুকদের মধ্যে বিতরণ করে—চন্দ্র-সূর্যকে লজ্জা থেকে মুক্তি দেওয়াই তাদের লক্ষ্য।৬৩
পৌরাণিক প্রকাশভঙ্গি বাদ দিয়েই এ কাহিনী সম্পূর্ণ, সেখানেই আখ্যানটি অসাধারণ। গল্পে রাহুর কোনও উল্লেখ নেই, নেই এক প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যাকল্পে জীবজন্তু সম্বন্ধে হিন্দুরূপকের ব্যবহার। আমরা এখনও কল্পনার জগতেই আছি ঠিকই, তবু তার ভিতরে বাস্তব-বিশ্বের অংশবিশেষকে চিহ্নিত করতে অসুবিধা হয় না। স্বর্গে শান্তিভঙ্গের বিশ্লেষণ উপাখ্যানে পাই, কিন্তু অশান্তির উপাদান আমাদের অতি পরিচিত গ্রামীণ পরিপার্শ্ব থেকেই গৃহীত। ফসলের যখন মন্দা, এমন বছরের ক্ষুধা এবং অভাব, খাদ্যের জন্য ভিক্ষা, দরিদ্রের প্রতি সামাজিক কর্তব্য পালনে প্রতিবেশীর কাছে ঋণ চাওয়া, সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পারার লজ্জা, এই সবই সেই উপাদান। স্বর্গের চিত্রনাট্যকে পার্থিব বাস্তবে মেলাতেই এমন উপাদানসমূহ গল্পে একত্র হয়। আখ্যানটিতে দেখি, নিম্নবর্গের অলংকারবিহীন শিল্পের উদ্দেশ্যই হল, যা যথার্থই অভাবনীয়, তার সম্পর্কে অবিশ্বাস কাটাতে চাওয়া। সূর্য-চন্দ্রের উচ্চবর্ণ পূজারী অভুক্ত, শস্যপূর্ণ পাত্র আছে ভাঙ্গি বা মেথরের কাছে, উচ্চবর্ণের মানুষ ভিক্ষা চাইছে, তাদের দৈব পৃষ্ঠপোষক ধার চাইছে, আর নিম্নবর্ণের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনের অধিক শস্যের মালিক, এর থেকে অবিশ্বাস্য আর কীই বা হতে পারে? মনে হয়, গ্রামীণ সমাজ যেন সম্পূর্ণ উলটে গেছে, শুধু দুর্ভাগ্য এই যে এমন প্রতিবিধান ধর্মীয় চিন্তার সীমাকে পেরিয়ে যেতে পারছে না।
তবু এই প্রতিবিধানকে তাৎপর্যবিহীন বলে অস্বীকার করা ভুল হবে। কারণ সমাজের দরিদ্র এবং ঘৃণ্যরা নিজেদের দুর্দশা সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে, বুঝছে এই দুর্দশাকে অতিক্রম করবার প্রয়োজন, সেই দ্বৈত চেতনার প্রকাশ এমন প্রতিবিধান। বাস্তবে কোনও প্রতিকার খুঁজে না পেয়ে ইচ্ছা পূরণের স্বপ্নকেই তারা সত্যি বলে ভাবতে চায়। মৌলিক কোনও তাড়নায় স্বপ্ন এক বাস্তব পরিণতি পাবে, এমন ইচ্ছা আজও বড় দুর্বল। তবুও নিম্নবর্গের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান, তার বিরুদ্ধতাই এই ইচ্ছার ভিত্তি।
একদিকে এই বিরুদ্ধতা শিশুর মতো অসহায়, তবু এক পরিণতির আভাস তার ভিতরে নিহিত আছে। আমাদের আলোচনার পক্ষে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশের আদিপর্বে সংশয়ে আকুল এই বিরোধ উচ্চবর্গের কাছে ধার করা ভাষাতেই সবাক হয়ে ওঠে উচ্চবর্গের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে; তখনই আমরা দেখি পরিণতির প্রথম মুহূর্ত। কিন্তু এই সমালোচনা পৌরাণিক উপাদানসমূহকে ঢেলে সাজাতে পারে, যাতে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত রূপকল্পে এই নতুন মূর্তি সংগতি খুঁজে পায়; দ্বিতীয় উপাখ্যানেই এমন ইঙ্গিত আছে। তার পর তৃতীয় উপাখ্যানে নিম্নবর্গের ধর্মচেতনাকে দেখি তার নিজের স্বরূপে। ব্রাহ্মণ্য পুরাণতত্ত্বের জটিল অলংকৃতভারের জায়গায় এই বিরুদ্ধতা নিয়ে এল এক কল্পনার জগৎ, যার সূত্র মিলবে নিম্নবর্গের প্রাত্যহিক জীবনে। পরিবর্তনের এই ধারায় দানের সনাতন রূপকল্প অন্তরালে সরে যায়, আখ্যানের কেন্দ্রে আসে সেইসব ঋণের প্রসঙ্গ যা শোধ হয়নি আজও। সব মিলে আর্থনীতিক ধর্মতত্ত্ব থেকে পলিটিকাল ইকনমির দিকে এ এক সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
৭
রাহু বনাম চন্দ্র-সূর্যের আখ্যান বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শেষে তার নতুন চেহারা পেল আমাদের সমাজের প্রকৃত এক বিরোধের প্রসঙ্গে। ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার পারস্পরিক বিরোধ বাস্তবিক একান্তই যন্ত্রণাদায়ক। মধ্যপ্রদেশ অঞ্চল থেকে দেওয়া যায় একটি প্রতিভূ দৃষ্টান্ত:
চতুর্থ উপাখ্যান
চন্দ্র এবং সূর্য রাহুর কাছে ঋণী; রাহু এসে ঋণ শোধের দাবি জানায়; একেই বলে গ্রহণ। ভিক্ষার যে দান মেথররা পায়, তা ওই ঋণ শোধের এক উপায়।৬৪
একই কাহিনীর বহু পাঠান্তরের মধ্যে কয়েকটি বাস্তবের বিন্যাসে বিশিষ্ট, যেমন,
পঞ্চম উপাখ্যান।
সূর্য মেথরের কাছে ঋণী, কিন্তু অর্থ ফেরত দিতে সে অস্বীকার করে। মেথরও নাছোড়বান্দা, সূর্যের দুয়ারে সে ধরনা দেয়। তার কালো ছায়া খুব স্পষ্ট চোখে পড়ে। কালক্রমে সেই ঋণ শোধ হয় এবং মেথর চলে যায়।৬৫
ষষ্ঠ উপাখ্যান।
কোনও এক সময় সূর্য চন্দ্র উভয়েই ধ্রুভ অর্থাৎ রাহুর কাছে কিছু ঋণ করেছিল।… ঋণ শোধ দেওয়া প্রয়োজন; যদি কখনও সূর্য বা চন্দ্র ঋণ পরিশোধে সক্ষম না হয়, তবে রাহু তাকে আক্রমণপূর্বক গ্রাস করতে থাকবে। কিন্তু কখনওই রাহু তাকে পূর্ণগ্রাস করতে পারে না, উদ্গীরণ করে দেয়। যেহেতু ঋণ শোধ এখনও শেষ হয়নি, অর্থ দিয়ে যেতেই হবে।৬৬
এমন-সব কাহিনীসূত্রে রাহু তার আদি নিবাস পুরাণের সেই স্বর্গ ত্যাগ করে। যেখানে তার ভক্তদের জীবন, সেই পার্থিব জগতে রাহু খুঁজে পায় তার বাসভূমি। স্বর্গীয় হিংস্রতায় যে কাহিনী শুরু হয়েছিল, সে উপাখ্যান তাই সামাজিক হিংস্রতায় পরিণাম পায়। বাস্তব জগৎ পৌরাণিক বিশ্ব থেকে আলাদা; বাস্তবে এই হিংস্রতা দীর্ঘস্থায়ী ঋণানুবদ্ধতা অথবা ক্রীতদাস প্রথার মারাত্মক চেহারা নেয়; ডোম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষই হয় এই হিংস্রতার চরম শিকার। ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষভাগে ব্রিগ্স ডোম নামে পরিচিত এই জাতির বিষয়ে যা বলেছিলেন, তা ওই সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই সত্যি, যথা ‘যেসব আর্থিক বোঝায় তারা ভারাক্রান্ত, তার মধ্যে ঋণের ভারই সর্বাধিক।… প্রতি মাসে টাকায় চার আনা সুদ, অর্থাৎ বার্ষিক সুদের হার শতকরা তিনশো ভাগ ছিল একান্ত স্বাভাবিক ঘটনা। সাত পুরুষ ধরে পূর্বপুরুষের ঋণ উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তায়, আর সেই ঋণ তারা শোধ করে চলে।’৬৭ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশ অঞ্চলের এক পর্যবেক্ষক বলেছিলেন, ডোম হল ‘ক্রীতদাসদের মতো, বংশানুক্রমে কোনও ঠকদারি পরিবারের কাছে তার চিরাচরিত বশ্যতা’, অথবা ‘সে জীবনভর কোনও মহাজনের দাসত্ব করে।’৬৮ তাদের দারিদ্র্য, সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা এবং জীবিকার প্রয়োজনে প্রায়শই অসৎ কর্মপ্রবণতা, এসবেরই ব্যাখ্যা মেলে সেই ঋণের সূত্রে, যে ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত তাদের পরিশ্রম।
ডোম সদাই ঋণানুবদ্ধ, তাই শক্তির ধারণায় সে স্বভাবতই ভাবত নিজের পরিপ্রেক্ষিতে তার ঋণদাতার ক্ষমতার কথা। কারণ, সর্বত্রই নিপীড়িত মানুষ কর্তৃত্বের মূর্তি গড়ে প্রত্যক্ষ অত্যাচারীর প্রতিরূপ সামনে রেখে। তাই যেসব জাতি বা গোষ্ঠী কখনও দীর্ঘমেয়াদী, কখনও বা বংশানুক্রমিক ঋণ বহন করে জীবন্ত ঐতিহ্যের মতো, তাদের লোকগাথায় মহাজন ফিরে ফিরে আসে আদর্শ কল্পনার ছবিতে। তাই বাস্তারে ধুরুয়াদের মধ্যে অনাথ শিশুর সাফল্য নিয়ে যেসব প্রবাদকাহিনী প্রচলিত, সেখানে শিশুটি সাহুকার হতে পারলেই তার জীবনের চরম কীর্তি।৬৯ বোম্বাই এবং রাজস্থান অঞ্চলের গ্রাসিয়ারা বানিয়ার হাতে নিষ্ঠুরভাবে শোষিত; গ্রাসিয়ারা বিশ্বাস করে যে, বানিয়া পারে বৃষ্টিপাত কমিয়ে খরা নিয়ে আসতে; তখন শস্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের অধিক মুনাফালাভে সহায় হয়।৭০ মহাজনের পক্ষে এমন আদর্শ কল্পনার ভূষণ সীমায় পৌঁছিয়ে যায়, রাহু-বিষয়ক উপাখ্যানেই। মহাজনের আচরণে যারা প্রায় দাসে পরিণত হয়েছিল, মহাজনকে নিজেদের আরাধ্য দেবতা বানিয়ে তারা চূড়ান্ত নতিস্বীকার করে। সুদখোরকে ভগবান বানানোর এই বোধ হয় চরম নিদর্শন।
ডোম, দোসাদ, ভাঙ্গি আর মাঙ্গরা ঋণদাতার ক্ষমতাকে যেমন স্বীকার করে নেয়, একই উপায়ে তারা ওই শক্তি থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। কারণ তারা রাহুর সঙ্গে একাত্ম, তা সে সন্তানরূপেই হোক, পূজারীরূপেই হোক অথবা রাহুর থেকে উদ্ভূত বলেই হোক; ভাবজগতের ওই একই প্রক্রিয়ায় তারা নিজেদের দেয় উত্তমর্ণের চেহারা; বাস্তবে যার সীমা লঙ্ঘন করতে পারে না, নিজেদের সেই বন্দিদশাকে ভেঙে দেয় তারা তাদের কল্পনার আদর্শ জগতে। নিজেদের সমাজে তারা খাতক (খাদক)৭১ , অর্থাৎ ঋণের ভোগী, কিন্তু রাহুর সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বর্গীয় অধমর্ণদের গ্রাস করবার অধিকার পেয়ে যায়। এতদিন যারা ছিল নিপীড়িত, তারা আজ নিজেদের অত্যাচারীর ভূমিকায় সাজাচ্ছে; সেখানে রয়েছে অর্থে প্রত্যর্থে এক বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনা। বাস্তব জগৎকে উলটে দেওয়ার বহু প্রয়াসেই নেতিবাচক চৈতন্যের সেই ছাপ থেকে যায়। ধর্মের জগতেও প্রতিবিধান এমন বিপরীতের ব্যঞ্জনায় চিহ্নিত। চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ উপাখ্যানে তেমন ব্যঞ্জনারই দৃষ্টান্ত।
৮
এ কথা সন্দেহাতীত যে রাহুর স্বর্গ থেকে মর্ত্যে গমন অলীক এক মুক্তি ছাড়া কিছুই অর্জন করে না। তা সত্ত্বেও এমন সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে যে আমরা এখনও সেই আরম্ভেই দাঁড়িয়ে আছি। বরং এখন আমরা ধারাবাহিক এক ক্রমের শেষ প্রান্তে, প্রথম উপাখ্যান থেকে যার দূরত্ব অনেক। যেদিন অমৃতের ভাগ নিয়ে দেবতা আর দানব লড়াই করেছিল, সেই সমুদ্রমন্থন আজ থেকে কত যুগ আগে? অমৃতের ভোজসভায় সেই মুণ্ডচ্ছেদই বা কবেকার কথা? আজ আমরা দাঁড়িয়েছি আমাদের সময়ের সঙ্গে, আমাদের পদক্ষেপ হয়তো ততখানি নিশ্চিত নয়, যতখানি নিশ্চিতি আছে আমাদের আকাঙ্ক্ষায়, তবু সেই পদক্ষেপ আজ নিজেদের অভিজ্ঞতার ভূমিতে। অস্বীকার করব না যে গ্রহণের মতো প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা আজও খোঁজা হয় পুরাণে, বিজ্ঞানে নয়। কিন্তু আজকের পুরাণে মূল চরিত্র আর দেবতা দানব নয়, মুখ্য ভূমিকা আজ জনগণের। পৌরাণিক কাহিনীর কেন্দ্রে ছিল অমৃতের প্রতিযোগিতা; সে লড়াইয়ের চেহারা বদলে গেছে; আজকের প্রতিযোগিতা মানুষের জীবনধারণের উপযোগী সব পার্থিব সম্পদের মালিকানা নিয়ে। ব্রাহ্মণ্যের আজব কল্পনায় যার উদ্ভব, দরিদ্র আর নিপীড়িতের সরল কল্পনা তাকে আমাদের কালের উপকথায় গ্রথিত করে। কাহিনীর যে পাঠ আমরা মৎস্যপুরাণে পাই, তাতে দেখি, রাহুর সঙ্গে চন্দ্র-সূর্যের শত্রুতা হয়েছিল এবং আজও গ্রহণের সময় রাহু দুজনের উপরেই প্রতিশোধ নেয়।৭২ এখনও সে তার আশানুরূপ পুরোপুরি প্রতিশোধ নিতে পারেনি, অবিরাম চলছে তার অন্বেষণ। সে যে নিজের শত্রুকে মর্ত্যেই খুঁজে পেয়েছে, এটা রাহুর পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি। উপরোক্ত কাহিনীসমূহের বিচারে এই সংগ্রাম এখনও ভাবজগতেই সীমিত; কিন্তু সেই সামাজিক সংগ্রামে পরিণতির সম্ভাবনা আজ অনেক বেশি; সেই সংগ্রামেরই রূপক শেষ তিনটি উপাখ্যান।