প্রেম এসেছিল
প্রীতির চোখটা বাঁধা। ওরই গায়ের চা পাতা রঙের ওড়না দিয়ে চোখদুটো বেঁধে দিয়েছে সুজন। প্রীতি বেশ অনুভব করছে প্রথমে একটা লিফটের মধ্যে চাপলো ও। মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করল কত তলায় উঠছে। সম্ভবত তিনতলায় গিয়ে সুজন কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, হাতটা ধরো, চলো।
প্রীতি বিরক্ত হয়ে বলল, উফ, তোমার এই ছেলেমানুষিগুলোর কোনো মানেই হয় না। নিশ্চয়ই লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এরা পাগল। সুজন বলল, না বরং ভাবছে, এরা প্রেমে পাগল। ফিক করে হেসে ফেলল প্রীতি। মাত্র পনেরো দিন বিয়ে হয়েছে ওর। দিন পনেরো শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে সুজনের সাথে চলে এসেছে কলকাতায়। কর্মসূত্রে সুজন কলকাতার বাসিন্দা। বিয়ের আগেই প্রীতিদের বাড়িতে দেখতে গিয়ে ওর মা বলেছিল, মেয়ে কাজ চালানোর মতো রান্না জানে তো? আমাদের রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে হবে না, শুধু আমার ছেলেটা কলকাতার ফ্ল্যাটে একা একা পড়ে থাকে, বাইরের হাবিজাবি খায়…ওকে একটু ডাল,ভাত ফুটিয়ে দিতে পারলেই হবে। সেদিন থেকেই প্রীতি জানত, ওদের দুজনের একটা পুতুল পুতুল সংসার হবে। যেখানে প্রীতির হাতের নুন বেশি, ঝাল কম রান্না খেয়েই সুজনকে হাসি মুখে অফিস বেরোতে হবে।
ফুলশয্যার রাতেই সুজন বলেছিল, আসল ফুলশয্যা তো হবে আমাদের নিজেদের ফ্ল্যাটে, এখানে এত জনের মাঝে প্রেম করা যায় নাকি!
প্রীতিরও খুব ইচ্ছে করছিল, বর্ধমানের শহরতলী থেকে সোজা কলকাতায় নিজের সংসারে এসে পৌঁছাতে। তাই হাঁসফাঁস করতে করতে প্রীতি বলল, এবারে তো চোখটা খোলো! সুজন বলল, আর কয়েক কদম, তারপরেই তোমার ফ্ল্যাট। হাওড়া স্টেশন থেকে উবেরে করে এসে নেমেছিল একটা বড় কমপ্লেক্সে, তারপরই হঠাৎ ওর ওড়নাটা কেড়ে নিয়ে ওর চোখ দুটো বেঁধে দিয়েছে সুজন। একেবারে নিজের ফ্ল্যাটের অন্দরে গিয়ে খোলা হবে।
সুজনের সাথে প্রীতির পরিচয় হয়েছিল প্রীতির মামাতো দিদির বিয়ের দিনে। বরযাত্রীর মধ্যে সুজনও ছিল। বাসর ঘরে জিজুর বন্ধুদের সাথে অল্প-বিস্তর আড্ডাও হয়েছিল। কিন্তু প্রীতি একবারের জন্যও কল্পনা করেনি, তার এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রীতির সম্বন্ধ আসবে বর্ধমান থেকে।
বি. এড কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ সন্ধে হয়ে গিয়েছিল সেদিন। একটা বাস মিস করে সন্ধেবেলা যখন বাড়িতে ঢুকল তখন মা মামীকে ফোনে বলছে, বিয়ে বাড়িতে দেখেছি হয়তো, কিন্তু অত ভিড়ের মধ্যে আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আমি বরং প্রীতি ফিরলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি, সুজন ব্যানার্জীকে ওর মনে আছে কিনা? কি বলছো? ওহ বাসরে প্রীতিকে দেখেই পছন্দ হয়েছিল? না না, ছেলে ভালো হলে আমাদের আপত্তি কিসের!
ড্রয়িংরুমে থমকে দাঁড়িয়েছিল প্রীতি। মনের মধ্যে হালকাভাবে উঁকি দিচ্ছিল একটা মুখ, নীলচে পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা বিয়ে বাড়িতে শুধু বলেছিল, এই বিয়ের লগ্নে দাঁড়িয়ে আরেকটা বিয়ের ভূমিকা লেখা হল বোধহয়। প্রীতির দিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছিল ছেলেটা। প্রীতি চোখটা নিচু করে নিয়েছিল। প্রীতি মনে করার চেষ্টা করল, ওই ছেলেটার নামই কি সুজন?
সুজনের আবছা মুখকে ছাপিয়ে আরেকটা অবয়বও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল প্রীতির দৃষ্টিপথে। যে একদিন বলেছিল, অনেক বড় হয়ে, তোমার যোগ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করব। পাড়ার মেয়েরা হাসাহাসি করে বলেছিল, আগে বড় হয়ে দেখা। তোর বাবা তো সবজি বিক্রি করে, মা সেলাই করে, তুই কোথা থেকে বড়লোক হবি রে? নন্দিতার এহেন ব্যঙ্গের কথায় বুকটা কেঁপে উঠেছিল প্রীতির। ছেলেটার ছলছল চোখ, রোগাটে গড়ন কিন্তু মুখটা বড্ড মায়াবী। ক্লাস টেনের প্রীতি আলতো করে বলেছিল, ভালো করে পাড়াশোনা কর নীলাভ। সামনেই তোমার উচ্চমাধ্যমিক তো!
নীলাভ কাঁদো কাঁদো গলায় প্রীতির চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ভালোবাসতে গেলে বুঝি বড়লোক হতে হয়? আমি তো তোমাকে এখনই কত ভালোবাসি, তাহলে এটা কি ভালবাসা নয়? প্রীতি কিছু বলার আগেই বান্ধবীরা বলেছিল, বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াতে নেই।
নীলাভ ওর বোকা বোকা হাসিটা আরেকবার হেসে বলেছিল, হাত তো বাড়াইনি, মন বাড়িয়েছি শুধু। প্রীতিকে তো বলিনি আমায় ভালোবাসতে, আমি বেসেছি শুধু। প্রীতি দেখেছিল, শেষ বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ছেলেটার চোখের কোনো এক বিন্দু জলের রেখা। বান্ধবীদের ইশারায় একটু সরে যেতে বলে, প্রীতি বলেছিল, ভালোবাসতেই পারো, কিন্তু একতরফা ভাবে। আর যদি সত্যি কোনোদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসো সেদিন রাস্তায় নয়, বাড়িতে এসো। নীলাভ মৃদু হেসে বলেছিল, তার আগে অনেকগুলো কাজ আছে যে, তোমার মতো স্মার্ট হতে হবে, ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ভালো চাকরি পেতে হবে…..নিজের ভালোবাসায় স্থির থাকতে হবে। এগুলো যদি সবগুলো ঠিক ঠিক পারি, তাহলে কোনো একদিন নিশ্চয়ই যাব তোমার বাড়ির দরজায়। তার আগে একতরফাই হোক। তবে কি জানো তো প্রীতি, ভালোবাসা মানে কিন্তু সব সময় জয় করা নয়, হেরে গিয়েও ভালোবাসা যায়। প্রীতি ফিরে আসতে আসতে একবার পিছন ফিরে দেখেছিল নীলাভকে। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওর দিকে। প্রীতির চলে যাওয়াটাই যেন কোনো দেখাবার জিনিস। বান্ধবীরা বলেছিল, তুই তো দুদিনের জন্য মামার বাড়ি আসিস, ভালো করে তো চিনিসই না নীলাভকে, আগে ওর হিস্ট্রি শোন, তারপর ওর বড় বড় কথা শুনবি।
বছরে দুবার মামার বাড়ি এলেও প্রীতির সমবয়েসি বেশ কয়েকজন বান্ধবী জুটেছিল সেই ফাইভ-সিক্স থেকেই।
এই নীলাভ বলে ছেলেটাকে কখনো সেভাবে লক্ষ্য করেনি প্রীতি। আসলে লক্ষ্য করার মতো তেমন কিছু নেইও ছেলেটার মধ্যে। বড্ড সাদামাটা, আনস্মার্ট, ক্যাবলা টাইপ ছেলে। সে যে এভাবে এসে একেবারে বিয়ে করবে বলে প্রপোজ করতে পারে, এটা প্রীতি অন্তত ভাবেনি। বান্ধবীদের কথাবার্তায় বেশ বুঝেছিল, শুধু প্রীতি নয়, ওরাও ভাবতে পারেনি নীলাভর মতো মুখচোরা ছেলে এসব বলতে পারে! পারমিতা তো রীতিমতো রেগে গিয়ে বলল, একবার ভেবে দেখ, ক্যাবলাকান্তর কি সাহস, ডিরেক্ট এসে প্রীতিকে বলে কিনা বিয়ে করবে!
ওর সাথে প্রীতির পরিচয়ই তো হলো পঞ্চমীর দিনে, আর নবমীতে কিনা ….
নন্দিতা বলেছিল, চল কোথাও একটা বসি, পুজো প্যান্ডেলে নয়, ঢাকের আওয়াজে কথা শোনা যাবে না। আগে শুনবি নীলাভর সব কীর্তির কথা, তারপর বুঝবি ও কেমন জিনিস। প্রীতির ইচ্ছে করছিল না নীলাভর নামে একটা খারাপ কথাও শুনতে।
জীবনে প্রথম প্রেম নিবেদক মানুষটার নামে বাজে বাজে কথা শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তাই প্রীতি বলল, ওসব থাক না নন্দিতা। ও তো জোর করেনি, কোনো অসভ্যতামিও করেনি….থাক না প্লিজ।
তখনও নীলাভর একটা কথা মনের মধ্যে আলোড়ন করে চলেছিল, হেরে গিয়েও ভালোবাসা যায়।
তার মানে নীলাভ ধরেই নিয়েছিল, প্রীতির সাথে ওর কোনোদিনই বিয়ে হবে না। তারপরেও বলল, ভালোবাসতে তো দোষ নেই। থাক না লোকচক্ষুর আড়ালে কিছু আবেগ, তাকে ফুটপথে নামিয়ে এনে অপমান করতে মন চাইছিল না প্রীতির। তাই নীলাভ প্রসঙ্গকে আড়াল করতে চাইছিল বারবার।
তবুও নন্দিতা বলল, এই প্রীতি তোর সাথে ওর পরিচয় হল কি করে রে?
প্রীতি নরম গলায় বলেছিল, পঞ্চমীর দিন, অঞ্জলি দেবার জন্য যে শাড়িটা এনে ছিলাম, হঠাৎ খেয়াল হল ওটা পিকো, ফলস কিছু করা হয়নি। বড় মামী বললো, নীলের মাকে দিয়ে আয় ও করে দেবে।
এত কম সময়ে কেউ অর্ডার নেবে এটাই তো ভাবা যায় না। বড় মামার মেয়ে রিন্তি নিয়ে গিয়েছিল নীলাভদের বাড়িতে। পারমিতা বলল, তুই তো এমন ভাবে বাড়ি বলছিস যেন মনে হচ্ছে রাজপ্রাসাদ! বল ওদের কুঁড়ে ঘরে গিয়েছিলি।
প্রীতি পারমিতার কথাটা না শোনার ভান করেই বলল, নীলাভর মা বাড়িতে ছিলেন না। রিন্তি বলল, নীলাভদা, আমার দিদিভাইয়ের একটা শাড়িতে সেলাই করতে হবে, কাকীমা বাড়িতে নেই?
নীলাভ বলল, পিকো করতে হবে, আমায় দে আমি করে দিচ্ছি।
প্রীতি ভয় পেয়ে বলেছিল, এটা আমার খুব দামি শাড়ি, নষ্ট হয়ে গেলে মা বকবে।
নীলাভ এক মুখ হেসে বলেছিল, মূল্যবান জিনিসের মূল্য বুঝি। রিন্তি চলে এসেছিল, কিন্তু নীলাভর ভরসায় শাড়ি ফেলে দিয়ে আসতে পারেনি প্রীতি। তাই সেলাই মেশিনের পাশের চেয়ারে চুপটি করে বসে প্রীতি বলেছিল, আমি বসছি তুমি করো।
নীলাভ আড়চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ভরসা করতে পারছ না তো? বেশ বসো, একটু সময় লাগবে কিন্তু।
মেশিনে সুতো পরিয়ে খুটখাট করার ফাঁকেই নীলাভ বলেছিল, তুমিই রিন্তির প্রীতিদিদি তাই তো?
খুব ভালো গান করো, তাই না? গত বছর তোমার গান শুনেছি স্টেজে।
আমিই তখন রিন্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা কে রে? ওই বলল, তোমার নাম প্রীতি। তুমি ওর ছোটপিসির মেয়ে।
নীলাভ শাড়িটা সেলাই করতে করতেই বলেছিল, ছোট থেকে মায়ের কাছে দেখে দেখে আমিও শিখে গেছি এসব কাজ। কিন্তু মা বলেছে, এই মেশিনে না বসতে। তাই তেমন অভ্যেস নেই। আমাকে অনেক বড় হতে হবে। প্রীতিও জেনেছিল নীলাভ টুয়েলভে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ ভালো, সেটা ওর কথা শুনেই বুঝেছিল। শাড়িটা সেলাই করতে করতেই নীলাভ বলেছিল, পিঙ্ক বুঝি তোমার ফেভারিট কালার?
প্রীতি ঘাড় নেড়ে বলেছিল, কি করে বুঝলে?
নীলাভ মুচকি হেসে বলেছিল, পুজোয় জিন্স, চুড়িদার ছেড়ে শাড়ি যখন কিনেছো তখন নিশ্চয়ই প্রিয় রঙেরই কিনবে, তাই বললাম।
প্রীতি চুপ করে বসে দেখছিল নীলাভর কাজ। খুব যত্ন করে নীলাভ ওর শাড়িতে ফলস বসাচ্ছিলো।
তবে ওর যে অভ্যেস নেই সেটা বুঝতে সময় লাগেনি প্রীতির। ফলস বসানোর শেষের মুখেই ছুঁচটা আঙুলে ফুটিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছিল নীলাভ। প্রীতি কোনো কিছু না ভেবেই নীলাভর আঙুলটা মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। নীলাভ অপলক তাকিয়ে বলেছিল, তুমি কি সুন্দর। সম্বিৎ ফিরে পেয়েই ওর হাতটা ছেড়ে দিয়েছিল প্রীতি। লজ্জা পেয়ে বলেছিল, আমার জন্যই এমন হল!
নীলাভ হাতে একটা ব্যান্ডেড লাগিয়ে আবার ছুঁচটা ধরে বলেছিল, কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে গেছে।
প্রীতির হাতে শাড়িটা দিতেই প্রীতি পার্স বের করেছিল। নীলাভ সংকুচিতভাবে বলেছিল, আমি এই কাজের জন্য পারিশ্রমিক নিতে পারব না। এটা আমার মায়ের প্রফেশন, মা থাকলে হয়তো নিত। কিন্তু আমি নেব না। বরং অষ্টমীর অঞ্জলির দিনে, তোমাকে এই শাড়িটা পরে দেখলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।
প্রীতি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে এসেছিল।
নীলাভ ছেলেটাকে ওর খারাপ মনে হয়নি একবারের জন্যও। সেই নীলাভর নামে নন্দিতা ভুলভাল বলুক, এটা কিছুতেই চাইছে না প্রীতি। তাই আলগোছে বলল, নীলাভ আমায় প্রোপোজ কিন্তু করেনি, ওর একটা ইচ্ছের কথা জানিয়েছে মাত্র। তাই প্লিজ, ওকে নিয়ে আলোচনাটা থাক।
বাড়ি ফিরে এসেছিল প্রীতি। দূর থেকেই দেখেছিল একজোড়া চোখ ওকে দেখছে। তার চোখের দৃষ্টিতে আবেগ ছিল, কিন্তু লালসা নয়।
যখনই মামারবাড়ি যেত, রিন্তিকে জিজ্ঞেস করত নীলাভর কথা। হঠাৎই একবার রিন্তি অবাক হয়ে বলেছিল, নীলাভদা তো আর এখানে থাকে না, তুমি জানো না দিদিভাই?
চমকে উঠেছিল প্রীতি। মুহূর্তের মধ্যে মামাবাড়ির গ্রামটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল প্রীতির কাছে। যদিও তখন প্রীতি বেশ পরিণত। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে এসে বেশ বুঝেছিল, নীলাভ আর ওর বিয়ে কোনোদিন হতেই পারে না। অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। নীলাভদের বাড়ির সাথে ওদের পরিবারের আকাশ-পাতাল পার্থক্য তাই বন্ধুত্ব হলেও বিয়ে কোনোদিনই নয়।
নীলাভও হয়তো বুঝেছিল বিষয়টা। তাই আড়াল থেকে প্রীতিকে দেখলেও আর সামনে আসেনি কোনোদিন।
প্রীতিই বরং একবার যেচে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট কেমন হয়েছিল?
নীলাভ মুখ নিচু করেই বলেছিল, ভালো হয়েছে। তবে মেডিকেল পড়ার ইচ্ছে ছিল, সেটা হল না।
প্রীতি বুঝতে পারেনি কেন হল না! তাই অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কেন হল না?
নীলাভ আলগা হেসে বলেছিল, কিছু স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন হিসাবেই রঙিন, বাস্তবের মাটিতে এলেই ধূসর রঙের হয়ে যায়। অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়ে প্রীতির ধারণাই ছিল না, টাকার জন্য কেউ পড়তে পারে না!
পারমিতাই বলেছিল, বাবার সবজির দোকান তো লাটে উঠে গেছে। মায়ের সেলাইয়ের টাকায় আর ডাক্তারি পড়ে না, টিউশনি করে জেনারেল লাইনেই পড়তে হবে নীলাভকে। তাই বুঝলি প্রীতি, ওর আর বড়লোক হওয়া হল না, তাই তোকেও বিয়ে করতে পারল না।
পারমিতার বলার ভঙ্গিমায় খুব কষ্ট পেয়েছিল প্রীতি। মুখে বলেছিল, ওসব ছেলেমানুষি কথা বাদ দে তো।
রিন্তি বলেছিল, জানো দিদিভাই এই পাঁচ মাস মতো আগে নীলাভদার বাবা এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। ও আর ওর মা এখানের বাড়ি বেচে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে।
দিদিভাই, যাওয়ার আগেরদিন নীলাভদা তোমার একটা ছবি চেয়েছিল। আমি তোমার বার্থডের একটা ছবি দিয়েছি।
নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল প্রীতি। ক্লাস সেভেনের রিন্তি কিছু না বুঝেই বলেছিল, তোমার কি মনখারাপ করছে? আমারও মনখারাপ করছে দিদিভাই, নীলাভদাকে আমিও খুব ভালোবাসতাম। আমায় টিয়া পাখি ধরে দেবে বলেছিল। প্রীতি চমকে উঠেছিল, রিন্তির ভালোবাসতাম কথাটা শুনে। রিন্তি নীলাভকে দাদার মতো ভালোবাসতো, কিন্তু প্রীতি! প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে বারবার এসে হাজির হচ্ছে মনের দুয়ারে, প্রীতি কি ওকে ভালোবাসতো? তাই কি নীলাভ চলে গেছে শুনে মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো রজনীপুরের আকাশ, এখানের বাতাস এতটাই ভারী হয়ে গিয়েছিল যে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল প্রীতির।
প্রীতি সাবধানে বলেছিল, নীলাভর কোনো ছবি আছে তোর কাছে?
রিন্তি একমুখ হেসে বলেছিল, আছে তো, ওই যে আমার গতবছরের জন্মদিনে মা আমার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিল, আর আমি তখন কণিকাদি আর নীলাভদাকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। ওই ছবিতে নীলাভদাও আছে।
কৌতূহল দমন না করতে পেরে প্রীতি বলেছিল, একবার ওই অ্যালবামটা নিয়ে আয় তো।
রিন্তি দ্বিগুণ উৎসাহে অ্যালবাম নিয়ে হাজির হয়েছিল।
প্রীতি আবিষ্কার করেছিল, অনেকের ভিড়ে ম্রিয়মাণ নীলাভকে। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। মুখে সেই সরল হাসিটা। পাশের মেয়েটা নীলাভর ঘাড়ের ওপরে উঠে পড়ার চেষ্টা করছে দেখেই বিরক্ত লাগছিল প্রীতির। রিন্তি বলল, এটা কণিকাদি। খুব ভালো। নীলাভদার বাড়ির পাশেই বাড়ি।
প্রীতির মনে প্রশ্ন জাগছিল তবে কি নীলাভর খুব ভালো বন্ধু ছিল এই কণিকা? ছবিটা অ্যালবাম থেকে খুলে নিতে নিতে প্রীতি বলেছিল, এটা আমি নিলাম রিন্তি। মামীকে কিছু বলার দরকার নেই। রিন্তি ঘাড় নেড়ে বলেছিল, বেশ বলব না।
প্রীতির ব্যস্ত জীবনের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল নীলাভর স্মৃতি। মামাবাড়ি যাওয়াও কমে গিয়েছিল। নন্দিতা, পারমিতার সাথে যোগাযোগও কমে গিয়েছিল। নন্দিতা বলেছিল, তুই তো জানিস না প্রীতি, ওই ইনোসেন্ট দেখতে নীলাভর তলে তলে কত গল্প আছে!
প্রীতি শুনতে না চাইলেও শুনতে হয়েছিল, কণিকার সাথে নীলাভর প্রেম পর্ব। সবটা শুনেও নীলাভকে কখনো ঘৃণা করতে পারেনি। বরং মন বলেছে, না না, নীলাভ শুধু প্রীতিকেই ভালোবাসতো। তবুও ধুলো পড়েছিল রজনীপুরের সব স্মৃতির পাতায়।
জীবন চলেছিল নিজের ছন্দে।
হঠাৎই সুজনের বিয়ের প্রস্তাবে পুরোনো ধুলো ঝেড়ে অতীত জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল প্রীতির সামনে।
বিয়ে বাড়িতে দেখা ছেলেটার মুখের আড়ালে নীলাভর সরল চোখ দুটো তাড়া করে বলে উঠেছিল, একদিন অনেক বড় হব, দিয়ে তোমায় বিয়ে করব। ওই একটা কথা বিয়ে শব্দটা উচ্চারিত হলেই মনে পড়ে প্রীতির।
রজনীপুর থেকে চলে গেছে নীলাভরা। না আছে কোনো অ্যাড্রেস, না আছে কোনো ফোন নম্বর। তাই প্রীতিও কিছুতেই নীলাভকে বলতে পারেনি, তুমি কি এখনো বড় হওনি? এখনও কি বিয়ের উপযুক্ত হওনি? এদিকে আমার বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেল নীলাভ! মামা, মামী বড়দের কাউকে জিজ্ঞেসাও করতে পারেনি, নীলাভরা কোথায় গেল! রিন্তি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে একমাত্র মেয়ের নিমন্ত্রণে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়ানোর অধিকার নীলাভর থাকলেও, প্রীতিকে বিয়ে করার অধিকার যে নীলাভর নেই সেটা হয়তো এতদিনে বুঝে গেছে ও, তাই আর যোগাযোগটুকুও করেনি।
অষ্টমীর দিনে পিঙ্ক শাড়িটা পড়তে পড়তেই অকারণে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল প্রীতি। বারবার মনে হচ্ছিল, ওই শাড়ির গোটা গায়ে নীলাভর ছোঁয়া। শাড়িটা এত বছরেও কাচতে দেয়নি প্রীতি। কেন দেয়নি! অনেক কেনর উত্তর ওর নিজের কাছেই নেই।
বাড়িতে কথা এগোচ্ছিলো সুজনের সাথে বিয়ের।
মা এসে যখন জানতে চেয়েছিল, প্রীতি সুজনকে চেনে কিনা, তখন প্রীতির একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করছিল, আরেকজন তো অনেক আগেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, তারপর নিজেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। দেখো এও সেরকমই করে কিনা!
নীলাভর ওপরে অদ্ভুত একটা অভিমানে কেঁপে উঠছিল প্রীতির ঠোঁট দুটো। সামলে নিয়ে বলেছিল, বিয়ে বাড়িতে দেখেছি, তবে সঠিক মনে নেই।
মা চোখের সামনে স্যুট পরা ছেলেটার ছবি রেখে বলেছিল, দেখ মনে পড়ে কিনা। ওরা দেখতে আসবে সামনের রবিবার।
বড্ড তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে দিনগুলো। নিজের ডায়রির ফাঁকে ওই ছেলেটার ছবিতে হাত বুলিয়ে প্রীতি বলেছিল, তুমি বোধহয় ডায়রির পাতার মধ্যে লুকিয়ে থেকেই আমার অস্তিত্বে মিশে থাকতে চাও, বেশ আমি অন্যের হয়ে যাচ্ছি….আমায় বিয়ে করা তোমার আর হল না নীলাভ।
সুজন, এবারে তো চোখটা খোলো। নিজেকে কেমন গান্ধারীর মতো লাগছে।
সুজন কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, একদিন সারাদিন তোমার চোখ বন্ধ করে রাখব, দিয়ে তোমার সামনে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখবো তোমায়। তুমি বুঝতে পারবে কেউ তোমার সৌন্দর্য পান করছে কিন্তু তুমি নিরুপায় হয়ে বসে থাকবে।
প্রীতি হেসে বলল, অনেক ছেলেমানুষি হয়েছে। এবার চোখ খোলো। হাতে একটু চাপ দিয়ে সুজন বলল, আর গুনে গুনে পাঁচ পা চলার পরে তোমার চোখের মুক্তি ঘটবে, আর তুমি বন্দি হবে আমার বুকের মধ্যে।
যেদিন সুজন দেখতে এসেছিল প্রীতিকে, সেদিনই ওর পাগলামির কয়েকটা নমুনা পেয়েছিল প্রীতি। সুজন নিজেও বলেছিল, আমি একটু মুডি, অল্প রাগী, বাকিটা পাগল…তবে তোমাকে ভালো রাখার সব চেষ্টা আমি করব প্রীতি। সারাজীবনের জন্য কি আমার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হবে তোমার পক্ষে?
প্রীতি জোর করে আরেকটা আবছা হয়ে যাওয়া ছবিকে মন থেকে মুছে ফেলে, আলতো হেসে বলেছিল, আমিও অনেকটা মুডি, একটু অগোছালো, অনেকটা আবেগী, আর এতটা বোকা….চলবে?
সুজন হেসে বলেছিল, দৌড়াবে না হয়তো, কিন্তু গড়িয়ে গড়িয়ে ঠিক চলবে।
কখনো মনখারাপি বাতাস এসে তোমাকে আরো এলোমেলো করে দেবে হয়তো, তখন আমার পাগলামিগুলোই নিমেষে সরিয়ে দেবে ওই ভারী বাতাসটাকে। সত্যিই তাই, সুজনের সাথে বিয়ে হবার পর থেকেই ওর ছেলেমানুষির অত্যাচারে মনখারাপ নামক বস্তুটা কিছুটা ভয় পেয়েই প্রীতির পিছন ছেড়েছে।
দুই বাড়িতেই রাজি ছিল। প্রীতির মা তো জামাইকে নিয়ে বেশ গর্বই করেছিল সকলের কাছে। এত কম বয়সে এত বড় চাকরি, নিজের ফ্ল্যাট….এসবের গল্প করতেও ছাড়েনি আত্মীয়দের কাছে। বাবার মুখের পরিতৃপ্তির হাসিটাই প্রীতিকে খুশি করেছে। সুজন সাবধানে বাবাকে গিয়ে বলেছিল, যেদিন আপনার মেয়ে আমার নামে একটাও কমপ্লেন করবে, সেদিন ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পর মারবেন। বাবা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ছি ছি, কোনোদিনই নয়। তোমরা খুব ভালো থাকবে।
বিয়ের রাতে পারমিতা আর নন্দিতা বলেছিল, কোথায় ওই হাঘরের ছেলে, আর কোথায় সুজনদা! সুজনদাই তোর জন্য পারফেক্ট চয়েস প্রীতি। বলব না বলব না করেও প্রীতি বলেছিল, তোদের সাথে কখনো তার দেখা হলে বলিস, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।
নন্দিতা হেসে বলেছিল, ওদিকে কণিকারও বিয়ে হয়ে গেছে কয়েকমাস আগেই। বেচারা!
এত কিছুর মধ্যেও কণিকা নামটা শুনেই বিরক্ত লাগছিল প্রীতির। মনে মনে আবার বলেছিল, না, না, নীলাভ শুধু ওকেই ভালোবেসেছিল, কণিকাকে নয়।
নন্দিতা বলেছিল, এই সুজনদা কি হ্যান্ডসাম রে!
বিয়ের রাতে কথার মোড় ঘুরে গিয়েছিল। প্রীতিও সুজনের দেওয়া লাল সিঁদুরের সাথেই একাত্ম হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। নতুন সংসার আর সুজনের উজাড় করা ভালোবাসা ক্রমশ সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিচ্ছিল প্রীতিকে। সুজনের চোখে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করছিল প্রীতি।
এই নাও তোমার বাড়ি। সরি বাড়ি নয়, ফ্ল্যাট, আবার সরি, এটা শুধু তোমার সংসার…. প্রীতির চোখটা খুলতে খুলতে সুজন বলল, আমি তোমার আশ্রিত মাত্র।
চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ পেয়েছিল প্রীতি।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল ওরা। এখনো কিছুটা আবছা দেখছে প্রীতি। তারমধ্যেই দেখল, একলা পুরুষের এলোমেলো সংসার। সুজন ধপ করে সোফায় বসে বলল, আমার এখন অনেক কাজ প্রীতি। ভালো দেখে একটা হোমসার্ভিস জোগাড় করতে হবে। আমায় যে খাবার দেয় সেই খাবার তুমি খেতে পারবে না। জলের মতো ডাল, সুক্ত না কুমড়ো বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে হয়। ইলিশের পিস এমন নিখুঁত করে কাটে যে, কাঁটা বেছে দুবার মুখে পুরলেই শেষ।
প্রীতি টু বেডরুম ফ্ল্যাটকে ঘুরে দেখতে দেখতে বলল, তোমার মা যে বলছিলেন, তুমি নাকি রান্না করে খাও!
সুজন বেশ স্মার্টলি বললো, একশো বার রান্না করতে পারি। চা, ডিম টোস্ট, ডিম সেদ্ধ, ডিম ভাজা, ম্যাগি…
একা ডিমেরই কত আইটেম পারি।
প্রীতি হালকা হেসে চোখ বড় করে বলেছিল, সুজন তোমার মা কিন্তু তোমার নামে একটু বেশিই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন, ছেলে আমার একা থাকতে থাকতে সব কাজ শিখে গেছে।
ওয়াসিং মেশিনের ওপরে এত জামা জমে আছে কেন?
সুজন ফিচেল হেসে বলল, কাচব বলেই রেখেছিলাম, কিন্তু হঠাৎই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, ভাবলাম কটা দিনতো শুধু পাঞ্জাবি পাজামা পরেই কাটবে তাই আর কাচা হল না।
প্রীতি গম্ভীর গলায় বলল, হোম ডেলিভারির দরকার নেই, তুমি বরং বাজারে যাও। আর ফিরে এসে ভ্যারাইটি অফ এগ বানাও। ওই দিয়েই ম্যানেজ করে নেব।
সুজন চিন্তিত গলায় বলল, পারবে?
গুটি গুটি পায়ে শুরু হল ওদের খুনসুটির সংসার।
সুজনের জোরাজুরিতেই আবার গানের স্কুলে ভর্তি হল প্রীতি। সুজন বলেছিল, গানটা তোমার গলায় আছে প্রীতি, ওটাকে অবহেলা করলে অন্যায় হবে সৃষ্টিকর্তার ওপরে। সুজনটা বড্ড পাগল, একটু বোধহয় বেশিই ভালোবাসে প্রীতিকে। প্রীতি যখন হারমোনিয়াম নিয়ে গানে বসে তখন চুপটি করে বসে থাকে ওর পাশে। আলতো করে প্রীতির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, প্রীতি, আমার ছুটির দিনে একটা গান যেন সারাজীবন থাকে শুধু আমার জন্য।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির হালকা ছাটে ভিজছিলো দুজনে। সুজন বলল, আগে বলো পাহাড় না জঙ্গল, নাকি সমুদ্র… কোনটা তোমার পছন্দ। প্রীতি সুজনের কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে বলল, তুমি আমি আলাদা নাকি! তোমার সাথে যেখানে যাবো সেটাই আমার পছন্দের।
মুখে একটা হালুম…আওয়াজ তুলে সুজন বলল, তাহলে চলো, গভীর জঙ্গলে।
প্রীতি বলল, তাহলে আজ থেকেই প্যাকিং শুরু করি?
কিন্তু প্রীতি একটা সমস্যা আছে তো জঙ্গলে!
প্রীতি চিন্তিত মুখে বলল, কি সমস্যা, বন্য প্রাণী?
সুজন ভ্রুতে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল, আমি সেরকম জঙ্গলে যেতে চাই যেখানে, ট্রি হাউজের ওপরে গাছের ছালপাতা পরে আমরা দিন কাটাবো। তোমার এই দামি দামি শাড়ি কুর্তি সেখানে লাগবে না। তোমার গোটা শরীরটা ঢাকা থাকবে সবুজ-হলুদ পাতায়। তোমায় প্যাকিং করতে হবে না, পাতা তো ওখানেই পাওয়া যাবে।
সুজনের পিঠে দুমদাম কিল মারতে লাগল প্রীতি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, অসভ্য।
হঠাৎই বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়লো, সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দিকে। সামনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কেউ যেন নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করছে ওদের। ভিজে গায়ে কেমন একটা শিরশির করে উঠল প্রীতির।
ফিসফিস করে বলল, সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে কেউ একজন আছেন। বিদ্যুতের আলোয় আমি দেখলাম। সুজন বলল, সে আর কি করবে, গোটা কমপ্লেক্স অন্ধকার। পাওয়ার অফ। আধঘণ্টা হয়ে গেল কেন যে এখনো জেনারেটর চালাল না সেটাও তো বুঝলাম না।
সকলেই হয়তো ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে, যা গরম পড়েছে! প্রীতি বলল, না গো, মানুষটা আমাদের দেখছে।
সুজন আলতো করে বলল, সে দেখতেই পারে, আমার সঙ্গের মানুষটিকে তো দেখার মতোই, তাই হয়তো দেখছে। আচ্ছা প্রীতি, এই পাশের ফ্ল্যাটের তোমার নতুন বান্ধবী রঞ্জনার হাজবেন্ড তো পাওয়ার চলে গেলে বেশ হম্বিতম্বি করে। কমিটিতে লিখিত চিঠি দেবে টেবে বলে। তো আজ ওই আয়ুসবাবু এত চুপচাপ কেন?
প্রীতি তখনও চিন্তিত মুখে সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে আছে। তারমধ্যেই অন্যমনস্কভাবে বলল, রঞ্জনারা আজ সকালে দেশের বাড়ি গেছে। কি একটা পুজো আছে বলল।
সুজন মুখে আওয়াজ করে বলল, এই দেখ, ওই করিৎকর্মা আয়ুসবাবু নেই বলেই এখনো জেনারেটর চলল না। সুজনের কথাটা শেষ হবার আগেই ডাইনিংয়ে আলো জ্বলে উঠল। সুজন বলল, আয়ুসবাবুকে দেখছি পাবলিক বেশ ভয় খায়। ওর নাম নিলাম আর জেনারেটর চলল। ডাইনিংয়ের যেটুকু আলো ব্যালকনিতে এসে পড়ল, তাতেই প্রীতি দেখলো সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে কেউ একজন চট করে ঢুকে গেল। কে বোঝার আগেই হাওয়া।
কাল মালতি এলে জিজ্ঞেস করতে হবে, ওদের ঠিক সামনের ফ্ল্যাটে কারা থাকে। মালতির কাছে গোটা কমপ্লেক্সের খবর আছে।
এমনকি মালতি নিজেও বোধহয় সাত-আট বাড়িতে কাজ করে।
প্রীতি বলেছিল, মালতি তুমি রেসে নাম দাও, যেভাবে সকাল থেকে এবাড়ি ওবাড়ি ছুটে চলেছ, তাতে ফার্স্ট প্রাইজ তোমার আটকায় কে!
মালতি এক মুখ হেসে বলেছে, দাদাবাবু যখন একা ছিল, তখন তো বেশি কাজই ছিল না গো বৌদি।
প্রীতি বিরক্ত হয়ে বলেছে, সেই জন্যই মানুষটার ঘরদোর একটু গুছিয়েও রাখতে না! মাস গেলে মাইনে নিতে অথচ, একলা পেয়ে কাজ তো ভালো করে করতেই না!
মালতি জিভ কেটে বলেছে, না বৌদি, আমি সব করে দিতাম।
হ্যাঁ তোমার পরিষ্কার কাজের বহর আমি ফ্ল্যাটে পা দিয়েই দেখেছিলাম। তবে কিনা মালতিকে কিছু বললে সে করে দেয়, আর খুব বিশ্বাসী। তাই প্রীতি ওকে বলে বলে কাজগুলো করিয়ে নেয়।
সুজন ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলে, আমার পাকা গিন্নী। প্রীতি রোজ সকালে হলেই মাকে একটা ফোন করে। আর রান্নার রেসিপি জেনে নিয়ে শুরু করে এক্সপেরিমেন্ট। সুজন বেশ খুশি খুশি হয়েই বলে, গিনিপিগ হতে আমি রাজি। আজ তড়কাতে একটুও নুন হয়নি, তাও আমি খেয়ে নিলাম, কেন জানো?
প্রীতি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, আজও ভুলেছি…
আমি আমার বউকে সব থেকে বেশি ভালোবাসি, আর আমার বউ আমাকে ভালোবেসে যা রান্না করে দেবে, আমি সবটা খেয়ে নেব। বেশ চলছিল ওদের সংসার। সংসারের প্রতিটা ইট প্রীতি ওর ভালোবাসা দিয়েই গড়ে নিচ্ছিল। শক্ত মজবুত একটা ঘর বানাবে প্রীতি। অনেক কালবৈশাখী পেরোলেও সেই ঘরে সামান্য ছিদ্র অবধি হবে না। সুজন বেশ এক্সাইটেড হয়ে আছে ওদের হানিমুন নিয়ে।
প্রীতির কিসে সুবিধা হবে সেই ভেবে ভেবেই পাগল ছেলেটা। প্রীতি ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা সুজনের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সুখের আবেশে শিউরে ওঠে। একজন নিজস্ব পুরুষ আছে, যে সবসময় আগলে রাখে প্রীতিকে, আদরে ভালোবাসায় অস্থির করে তোলে ওকে।
এই ভাবনাটাই আরো আদুরে করে তোলে প্রীতিকে।
ভোরে ওঠা প্রীতির দীর্ঘদিনের অভ্যেস। এদিকে সুজন বেশ রাত করে ঘুমায়। রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করে। প্রীতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, তোমায় ঘুম পারিয়ে দিয়ে তারপর আমি অফিসের কাজে হাত দেব। যতক্ষণ আমার মহারানী জেগে থাকবে ততক্ষণ তার সেনাপতি তাকে পাহারা দেবে। কপালে আলতো চুমু খেয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে প্রীতিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সুজন।
যেহেতু বেশ রাত করে ঘুমায় সুজন, তাই সকালে প্রায় নটার আগে উঠতেই পারেনা ও। আর এদিকে রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া প্রীতির ঘুম ভেঙে যায় পাঁচটার মধ্যে। ঘুম থেকে উঠে অল্প উষ্ণ জলে একটা পাতিলেবুর রস আর একচামচ মধু খেয়ে কিছুক্ষণ ফ্রিহ্যান্ড এক্সসারসাইজ করা ওর সেই স্কুল লাইফের অভ্যেস। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে কদিন রুটিন এলোমেলো হলেও নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে আবার সেটা চালু করবে ভেবেই রেখেছিল। কদিন তো শুধু সুজনের অগোছালো ফ্ল্যাট, আলমারি, জামাকাপড় রান্নাঘর গোছাতেই কেটে গেছে প্রীতির। তারপর দুদিন সুজনের সাথে কাছের মার্কেটটাও ঘুরে এসেছে। পাশের ফ্ল্যাটের রঞ্জনা বলে মেয়েটা ভীষণ মিশুকে। ওর অবশ্য বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হল। ফ্ল্যাটে ঢোকার দ্বিতীয় দিনই রঞ্জনা নিজে এসে আলাপ করেছিল প্রীতির সাথে। রঞ্জনাই বলেছিল, আমরা একসাথে শপিংয়ে যাবো প্রীতি। প্রীতিও খুবই খুশি হয়েছিল প্রায় সমবয়সি বান্ধবী পেয়ে।
সুজন অফিসে বেরিয়ে গেলে রঞ্জনার সাথে আরেকদিন কাছের মার্কেটে গিয়ে বেশ কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনে এনেছে প্রীতি। সেদিনই দোকানে পাতিলেবু দেখে মনে হয়েছিল, আবার শুরু করবে। ওকে হানি আর পাতিলেবু কিনতে দেখে রঞ্জনা বলেছিল, ফিগার কনসাস? প্রীতি হালকা হেসে বলেছিল, অভ্যেস। না খেলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। রঞ্জনা বলেছিল, আমার এক চামচ চিনি দিয়ে মোটা করে দুধ চা দিয়ে দিন শুরু হয়। ওইজন্যই মোটকু হয়ে যাচ্ছি।
লেবু, মধুর জলটা খেতে খেতেই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল প্রীতি। শহর কলকাতা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভোরের সূর্য কিন্তু আলসেমি না করে উঠে পড়েছে। গরমের দিনে এই ভোরটাই যা শান্তি দেয়।
প্রীতির সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে এক ভদ্রলোক বেতের চেয়ারে বসে একমনে ওকে দেখছে। চোখাচোখি হতেই মুখটা ঘুরিয়ে নিল ভদ্রলোক।
প্রীতি বেশ বিরক্ত হয়েই ড্রয়িংয়ে চলে এল।
এই মানুষটাকেই কাল বৃষ্টির মধ্যে দেখেছিল প্রীতি। মুখটা পরিষ্কার না দেখতে পেলেও লোকটা যে ওকেই দেখছে বেশ বুঝতে পারছিল প্রীতি। এক চিলতে ব্যালকনির সামনে নতুন উৎপাত তৈরি হল। সুজনকে এ নিয়ে কিছু বললেই, বদমাশটা বলবে, ভদ্রলোকের আর দোষ কি, আমিই এত দেখে দেখেও চোখ ফেরাতে পারি না, সে বেচারা তো ওই এক সেকেন্ড দেখছে! তুমি এক কাজ করো প্রীতি, ওই ভদ্রলোককে দোষ না দিয়ে বরং ভগবানের কাছে কৈফিয়ত চাও, কেন তোমাকে এত নিখুঁত করে গড়েছেন। তাই সুজনকে বলা বেকার। আর দুদিন দেখবে, তারপর দরকার পড়লে রঞ্জনাকে সঙ্গে নিয়ে কমিটিতে জানাবে। কিন্তু কমিটিতেই বা কি বলবে?
সামনের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক ওনার নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাওয়া খান!! ধুর!
ট্রাকস্যুট পরে মেঝেয় ম্যাট পেতে নিল প্রীতি।
ব্যালকনির দিকের গ্লাসডোরটা বন্ধ করে দিয়েছে। এই এক সুবিধা এই ফ্ল্যাটটাতে। সমস্ত জানালার গ্লাসগুলো থেকে বাইরেটা দেখা গেলেও ভিতরটা দেখা যাবে না।
লেগ রাইজ করতে করতে আরেকবার চোখ চলে গেল ব্যালকনির বাইরের দিকে। হ্যাঁ ভদ্রলোক এদিকেই তাকিয়ে আছেন আনমনে। প্রীতিদের ফ্ল্যাটের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছেন না, তবুও তাকিয়ে আছেন।
আচমকা থমকে গেল প্রীতি, ম্যাটের ওপরে উঠে বসলো। ওই ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকের এই চাউনিটা ওর ভীষণ চেনা। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো প্রীতির। ব্যালকনির বন্ধ গ্লাসডোরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখে একটা রিমলেস চশমা আর পুরু গোঁফ, এছাড়া চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন কিছু ঘটে নি। এমনকি দৃষ্টিটা পর্যন্ত একইরকম আছে। দুটো মানুষের মধ্যে এতটা মিল কখনো হয় নাকি!
কিন্তু প্রীতি যাকে ভাবছে সে এখানে কোনোভাবেই আসতে পারে না। রিন্তি বলেছিল, ওরা কোথায় যেন চলে গেছে। এখনো পর্যন্ত ওই ফ্ল্যাটে কোনো মহিলাকে দেখেনি প্রীতি। মিল আছে ঠিক কথাই, কিন্তু এ যে সে নয় সেটা কনফার্ম হবার জন্য নিজের পুরোনো ডায়রিটা বের করে আনলো প্রীতি।
রিন্তির জন্মদিনে সকলের পিছনে বুদ্ধুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা ক্লাস টুয়েলভের ছেলেটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো প্রীতি। গ্লাসের ওপ্রান্তের মানুষটা ছবির মানুষের থেকে অনেক পরিণত…চেহারায়, আচার ব্যবহারে। কিন্তু চাউনিটা একই রকম। সুজন ঘুম থেকে যদি উঠে পড়ে ভেবেই পুরোনো ছবিটা যথাস্থানে রেখে দিল প্রীতি। না, কিছুতেই আর নীলাভকে ঢুকতে দেবে না ওর মনের কোনো প্রকোষ্ঠে। সুজন ওকে সবটা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। কোনোভাবেই সুজনকে ঠকাতে পারবে না প্রীতি। তাছাড়া নীলাভ অল্প বয়সে ওকে প্রোপোজ করেছিল, এর বেশি কিছু তো এগোয়ওনি ওদের সম্পর্ক। তাই ওই অল্পবয়সের পাগলামিকে গুরুত্ব দেবার কোনো কারণ নেই। জোর করে নিজের মন থেকে নীলাভ বা সামনের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোককে তাড়িয়ে দিয়ে ঘুমন্ত সুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রীতি। আলতো করে কপালে একটা চুমু খেয়ে সোফায় গিয়ে বসল।
মালতির আসার সময় হয়ে গেছে। তার আগেই সবজিগুলো কেটে ফেলতে হবে প্রীতিকে।
তাহলে মালতি রান্নাঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে।
ভাবতে ভাবতেই মালতি বেল বাজাল।
দরজাটা খুলতেই ঝড়ের বেগে ঢুকল মালতি। বাপরে এখনো সব বাড়িতে যেতে হবে, বলে ঘড়ির দিকে একবার তাকাল মালতি।
প্রীতি সবজি কাটতে কাটতে বলল, মালতি, আমাদের ঠিক সামনের ফ্ল্যাটটাতে কারা থাকে গো। এই কমপ্লেক্সে মোট চারটে ফ্ল্যাট বাড়ি। তাই মেম্বার নেহাত কম নয়।
সব খবর যে মালতি জানবে এমনও কথা নয়।
মালতি ঝাঁটা হাতে নিয়ে সোফার নীচেটা ঝাঁট দিচ্ছিলো।
ঝাঁটা হাতেই বলল, ফ্যামিলি নয় গো বৌদি। দুজন থাকে। দুটোই পুরুষ মানুষ। দুজনে একই অফিসে চাকরি করে, তাই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে আছে।
প্রীতি বলল, তুমি কি ওই বাড়িতে কাজ করো নাকি?
মালতি দ্বিগুণ উৎসাহে বলল, ওরা ফ্ল্যাটে এসেছে এই মাস পাঁচেক হল। দুই বন্ধু যখন আসছিল তখনই আমি রেবতী বৌদির কাজ সেরে নামছিলাম। আমায় দেখেই দুজনে একসাথে বলল, আমাদের ফ্ল্যাটটা ঝাঁট দেওয়া আর মোছা করে দেবে?
তুমি তো জানো বৌদি, আমি না বলতে পারি না, তাই রাজি হয়ে গেলাম। ব্যাচেলর ছেলেদের যা হয় গো বৌদি। বড্ড অগোছালো!
বিশেষ করে ওই নীল দাদাবাবু। দিনরাত কি যেন ভাবছে।
উফঃ, আওয়াজটা শুনেই মালতি ঝাঁটা ফেলে ছুটে এলো রান্নাঘরে। হাতটা কাটলে নাকি গো!
প্রীতি বেসিনের জলের তলায় বুড়ো আঙুলটা ধরে বলল, ও কিছু না।
একটু মাজন লাগাও বৌদি ঠিক হয়ে যাবে।
প্রীতি বলল, আস্তে বলো, দাদাবাবু জানতে পারলেই রাঁধুনি ঠিক করতে বেরোবে।
মালতি মুচকি হেসে বলল, দাদাবাবু তোমায় বড্ড ভালোবাসে গো। তুমি কপাল করে স্বামী পেয়েছো।
ওই নীলদাদাবাবু না কি বলছ, ওর পুরো নাম কি?
মালতি একটু মাথা চুলকে বলল, একজনের নাম শ্রীকান্ত, আরেকজনের নীলাভ। এমনি মানুষ খুব ভালো।
বিয়ে হয়নি বলে যে চরিত্রের দোষ আছে তা কিন্তু নয়। এই আমি কাজ করি যখন, দুজনেই কম্পিউটারের দিকে এক মনে তাকিয়ে বিজবিজ করে। এত বাড়ি কাজ করছি, মানুষতো কম দেখলাম না! নীলদাদাবাবু তো আনমনেই থাকে সর্বক্ষণ।
বুকের ভিতরে কালবৈশাখী শুরু হয়েছে প্রীতির।
বুড়ো আঙুলের রক্তটা পেস্ট লাগাতে থেমে গেছে। কিন্তু বুকের মধ্যে তোলপাড় চলছে। নীলাভ এখানে!
দুটো মানুষের চেহারায় চাউনিতে শুধু মিল নয় তার মানে, মানুষদুটোই এক।
নীলাভ বোধহয় প্রীতিকে চিনতে পেরেছে, তাই ওভাবে দেখার চেষ্টা করছে।
চাপা কষ্টটা যাতে মুখে না ফুটে ওঠে তাই কড়াইটা গ্যাসে চাপিয়ে দিয়ে তেল গরম করতে দিল প্রীতি।
পটলটা তেলে দিয়ে নুন দিতে গিয়েই জ্বলে উঠলো আঙুলটা।
চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। চেটোর উল্টো দিকে দিয়ে জলটা মুছে নিয়ে রান্নায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল প্রীতি। সুজন এখুনি উঠবে, চা করতে হবে।
মাথাটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল প্রীতির। রজনীপুরের সেই নীলাভ এখন ওর সামনের ফ্ল্যাটে! যতই ভুলতে চেষ্টা করুক, ঝড়ের দাপটে পুরোনো ডায়রির পাতাগুলো ফিরে যেতে চাইছে রজনীপুরের সেই ফুটবল খেলার মাঠে। যেখানে দুটো পায়ে কাদা মেখে একটা ছেলে বলের পিছনে ছুটতে ছুটতেই আড়চোখে তাকাচ্ছে প্রীতির দিকে। ক্লান্ত মুখে একটু মুচকি হাসি, ব্যাস, অনেক কথা যেন বলে ফেলতে পেরেছে ছেলেটা।
ও বৌদি, পটলগুলো পোড়াবে নাকি? কড়াইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কি এত ভাবছ বলত!
আরে আদা, আর টমেটো দিয়ে তরকারি করো, খেতে ভালো লাগবে ডাল দিয়ে।
অন্যমনস্কভাবে হুঁ বলেই প্রীতি বলল, আচ্ছা মালতি, নীলাভ দাদাবাবুর মা, বাবা কোথায় থাকে?
মালতি একটু থমকে বলল, তোমার চেনা নাকি গো?
প্রীতি সামলে নিয়ে বলল, মনে হচ্ছে যেন চিনি চিনি।
মালতি বলল, চেনো আর এটা জান না, নীলদাদার বাবা তো সেই কত বছর আগে মারা গেছে। আর ওর মা তো মামাবাড়িতে থাকে।
নীলদাদা এখানে অফিসে চাকরি করে।
আসলে কি বলত বৌদি, মালতি লোকের এত হাঁড়ির খবর নেয় না, লোকেই মালতিকে যেচে বলে। অবশ্য নীলদাদা আমায় কিছুই বলেনি, মানুষটা বড্ড কম কথা বলে, সে তুলনায় শ্রীকান্তদাদা অনেক গল্প করে। ওর কাছ থেকেই নীলদাদার কথা জেনেছি।
মালতিকে চায়ের কাপটা দিয়ে নিজেদের চায়ের ট্রেটা নিয়ে বেডরুমে ঢুকল প্রীতি।
সুজন তখনো ঘুমোচ্ছে। নিজেকে একবার ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় ভালো করে দেখে নিলো। মুখে চোখে কোথাও নীলাভর ছাপ পড়েনি তো?
না না, প্রীতির সাজানো সংসারে কোথাও কোনো ছিদ্র রাখবে না প্রীতি, যেখান দিয়ে নীলাভ নামক আবেগ ঢুকতে পারে।
ঘুমন্ত সুজনের কানের লতিতে একটা চুমু খেয়ে, কানে কানে প্রীতি বললো, চা রেডি।
সুজন আড়মোড়া ভেঙেই বুকের মধ্যে টেনে নিল প্রীতিকে।
প্রীতি বলল, মালতি এসে গেছে। এই ঘর মুছতে ঢুকবে এখুনি।
সুজন ভাঙা গলায় বলল, আরে আমার ফ্ল্যাট, আমায় বউ, আমার বউয়ের ঠোঁটে আমি চুমু খাব, তাতে মালতিরই বা কি ? আর সামনের ফ্ল্যাটের অমুক বাবুরই বা কি!
চমকে উঠল প্রীতি।
সুজন এই কথাটা প্রায়ই বলে দুষ্টুমি করে। প্রীতি উত্তরে বলে, হ্যাঁ তোমার বউকে তুমি গড়িয়াহাটের মোড়ে চুমু খেও এবার থেকে। কিন্তু আজকের কথাটা এসে সজোরে লাগল মনের কোনো এক গোপন প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে রাখা একটা বিশেষ নামে।
একদিন সেও বলেছিল, প্রীতির যোগ্য হয়ে ওর বাড়ির দরজায় আসবে। মালতির কথা মত এখন সে ভালো চাকরি করে। এই মুহূর্তে যদি সে এসে বলে, প্রীতি আমি তোমার যোগ্য হয়েছি, কিন্তু তুমিই আমার জন্য অপেক্ষা করোনি, তাহলে ঠিক কি বলবে প্রীতি!
সুজন চা খেতে খেতেই বললো, এই যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দার.. মাঝে মাত্র দশ দিন। তারপরেই আমরা আদিম মানুষের মতো জঙ্গলে বাস করব টানা পাঁচদিন। তখন আমিও আর ভদ্রমানুষ থাকব না, রীতিমতো বন্য হয়ে যাব। প্রীতি ভ্রু কুঁচকে বলল, এখন বুঝি তুমি সিভিলাইজড ম্যান?
নই বলছ? সে আমি আমার বউয়ের কাছে চিরটা কাল অভদ্র, অসভ্য, বন্য থাকতে চাই। বুঝলে!
মনের ওঠাপড়া যাতে টের না পায় সুজন, তার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে ও। তবুও সুজন বলল, কি গো, মুখটা অমন কেন? বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে? তাহলে দুদিনের জন্য ঘুরে এসো।
প্রীতি কথাটাকে বাড়তে না দিয়েই বলল, অফিসের দেরি হচ্ছে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।
সুজন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে। এরকম ভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল প্রীতির। তবে সুর যে কেটেছে সেটা সুজন বুঝতে না পারলেও প্রীতি বেশ টের পাচ্ছিল।
আজও প্রায় আধঘণ্টা হল সুজন বেরিয়ে গেছে অফিসে।
প্রীতি এতক্ষণে ব্যালকনির দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি ফাঁকা, হয়তো সে অফিস বেরিয়ে গেছে। বেশ কয়েকদিন আড়চোখেই খেয়াল রেখেছিল সামনের ফ্ল্যাটের মালিকের দিকে। আর মালতির কাছেও টুকটাক খবর পেয়েছিল। ওর ভাবনায় এ কদিন শুধুই নীলাভ বিরাজ করছে।
অনেকক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে প্রীতি ঠিক করল, একবার অন্তত দাঁড়াবে নীলাভর সামনে। এভাবে রোজ রোজ অন্তর্দন্দ্ব নিয়ে চলতে পারবে না ও। সুজন আর ওর সুখের সংসার ছুঁচের মতো নীলাভর উপস্থিতি কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না প্রীতির। কিছু না করেও নীলাভ যেন সর্বক্ষণ আড়াল থেকে নজর রেখে চলেছে প্রীতির ওপরে। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে এই কয়েকটা দিন।
প্রীতিকে অবাক করে দিয়েই এই অফিস টাইমে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল নীলাভ।
ওর দিকে তাকিয়ে সেই আগের মতোই হালকা হাসল।
প্রীতি ছিটকে ঢুকে এল ঘরে।
আর একমুহূর্তও দেরি না করে বাইরে যাওয়ার কুর্তি লেগিংসটা পরে নিয়ে রেডি হয়ে গেল প্রীতি।
ফ্ল্যাটের ডোরটা লক করে কাঁপা পায়ে এগোলো সামনের ফ্ল্যাটের দিকে। প্রতিটা নিঃশ্বাসের শব্দ ঘুরে এসে প্রশ্ন করছে, এতগুলো বছর পরে কি বলবে নীলাভকে?
দোলাচলে দুলছে প্রীতির মন। যাবে না যাবে না ভাবতে ভাবতেই ডি ব্লকের লিফটে গিয়ে থ্রি প্রেস করল।
বুকের ভিতর কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
কাঁপা হাতে বেলটা বাজালো প্রীতি। মালতি বলেছিল, শ্রীকান্ত নামের এক ভদ্রলোকও থাকেন ওর সাথে। ফিরে যাবে কি!
ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে গেল।
সামনেই দাঁড়িয়ে নীলাভ। সেই পঞ্চমীর সকালে দেখা নীলাভ, সেই নবমী সন্ধেতে ওকে ভালোবাসার কথা জানানো মানুষটা এখন দাঁড়িয়ে আছে এক হাতের কম ব্যবধানে। প্রীতির একার নয় নীলাভর হৃৎপিণ্ডও বোধহয় থমকে গেছে, ওর মধ্যেও কোনো নড়াচড়া লক্ষ্য করল না প্রীতি।
ভিতরে এস প্রীতি। গলাটা কেঁপে উঠলো নীলাভর।
পায়ে পায়ে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকল প্রীতি।
অনেক কথা বলবে ভেবে এসেছিল ও, কিন্তু এই মুহূর্তে গলাটা শুকিয়ে গেছে, আর কথারা পথ হারিয়েছে আবেগের বাঁকে।
সোফায় বসে বলল, কেমন আছো নীলাভ?
নীলাভ জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, একই রকম লাগছে তোমায় সিঁদুর পরে, ঠিক যেমন আমি রোজ রাতে তোমায় কল্পনা করতাম। আমি ঠিক জানতাম তুমি বিয়ের পর সিঁদুর পরবেই, যদিও এখনকার মেয়েরা অনেকে পরে না। আমি জানতাম জানো প্রীতি, তুমি এমনি করে লালচে সিঁদুর আঁকবে সিঁথিতে, কপালে থাকবে ছোট্ট লালচে টিপ, আর পরনে গোলাপি শাড়ি। সবই মিলল, শুধু গোলাপি শাড়ির বদলে গোলাপি ওড়না। নীলাভ অপলক তাকিয়ে আছে প্রীতির দিকে।
নিজের কপালে বিজবিজে ঘামের উপস্থিতি টের পাচ্ছে প্রীতি। অনেক কষ্টে বলল, কণিকাকে বিয়ে করোনি?
নীলাভ কিছুটা চমকে গিয়েই বলল, হঠাৎ কণিকাকে কেন? ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমি ওর বিয়েতে কন্যাযাত্রী গিয়েছিলাম। এই কলকাতাতেই বিয়ে হয়েছে ওর।
প্রীতি বলল, নন্দিতা যে বলেছিল, তুমি কণিকাকে ভালোবাসো!!
নীলাভ সোফাতে হেলান দিয়ে বললো, কণিকা আমার ছোটবেলার বান্ধবী, কিছুটা ভাইবোনের মতো। ভালো তো অবশ্যই বাসি ওকে, কিন্তু বিয়ে কেন করব!
প্রীতি জানে নীলাভ কোনোদিন কণিকাকে ভালোবাসেনি, তবুও নিজের বিয়ে করে নেবার কারণ হিসাবে এই মুহূর্তে কণিকা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছে না।
কোথায় চাকরি করো?
নীলাভ বলল, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে।
দিন দুই ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তাই ছুটিতে আছি।
প্রীতি মনের সাথে যুদ্ধ করে কথা খুঁজে চলেছে বলার মতো।
হঠাৎ করে খোঁজখবর ছাড়া রজনীপুর ছেড়ে দিলে যে?
নীলাভ বলল, আসলে মামাদের সম্পত্তি ভাগ হচ্ছিল। মায়ের ভাগে বাড়ির দোতলা আর কিছু জমি পড়েছিল। তাই মা-ই বলেছিলো, মামাবাড়িতে গিয়ে থাকতে।
রিন্তি বলছিল, তোমার বাবা নাকি…
কথাটা প্রীতিকে শেষ না করতে দিয়েই নীলাভ বলল, হ্যাঁ রোড অ্যাক্সিডেন্ট। মা এখনো মামা বাড়িতে, কিছুতেই কলকাতায় আনতে পারিনি।
প্রীতি ঢোক গিলে বললো, বিয়ে করোনি ?
নীলাভ বললো, চা খাবে?
প্রীতি ঘাড় নেড়ে জানালো, খাবে না।
নীলাভ গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, তা তোমার সংসার কত দিনের?
প্রীতি অস্বস্তি মেশানো গলায় বলল, এই একমাস মতো হল।
তোমার চাকরি কতদিনের?
নীলাভ টেবলের পেপারওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তা একবছর হল।
বেশ কিছুক্ষণের বিরতি। শুধু দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কে আগে কথা বলবে সেটাও জানা নেই যেন।
প্রীতি বলল, আমার হাজবেন্ড সুজন খুব ভালো ছেলে।
ও আমাকে সত্যিই খুব সুখে রেখেছে।
নীলাভ হেসে বলল, সেটাই তো স্বাভাবিক।
চাকরি পাওয়ার পরে যখন তোমার বড়মামার কাছ থেকে তোমাদের ফোন নম্বর চেয়েছিলাম, তখনই তোমার মামা বলেছিলেন, একটা চাকরি জোগাড় করলেই ভিখিরির ছেলের ব্লু ব্লাড হয়ে যায় না। প্রীতির আমরা খুব বনেদি বাড়ির বিয়ে দেব।
জানো প্রীতি, তোমার বড়মামার কথাতেই আমার প্রথম সম্বিৎ ফিরে এসেছিল। মনে হয়েছিল, সত্যিই তো তাই। আমি বোকার মতো মরীচিকার পিছনে ছুটছি। তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়, তোমাকে আড়াল থেকে ভালোও বাসা যায়, কিন্তু বিয়ে করে সংসার করা যায় না।
প্রীতি চমকে উঠে বললো, তুমি এসেছিলে? কই রিন্তি কিছু বলেনি তো?
নীলাভ হেসে বলেছে, রিন্তি কি আর ছোট আছে, যে সব বলে দেবে!
প্রীতি সাবধানে বলল, সেই কবেকার ছোটবেলার কথা এতদিন মনে রেখেছো তুমি?
নীলাভ স্মিত হেসে বলল, তুমি বুঝি একটুও রাখোনি?
যদি নাই রাখো প্রীতি, তবে আমাকে দেখার পর থেকে তুমি কেন এত অস্থির হয়ে আছো?
কেন চোখের ভিতরে জোর করে আটকে রেখেছো নোনতা জলের ধারাকে?
প্রীতি মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তোমরা আর কতদিন এই ফ্ল্যাটে থাকবে নীলাভ?
কেন, চোখের সামনে আমাকে দেখলে নিজেকে বিশ্বাস ভঙ্গের দোষে দোষী করে ফেলছ বুঝি? না, প্রীতি, তোমার তো কোনো দোষ নেই, ভালো তো আমি তোমায় বেসেছিলাম পাগলের মতো। তুমি তো কোনোদিন বলোনি যে, তুমি আমায় ভালোবাসো! তবে কি জানো প্রীতি, আমি একটু ভুল বুঝেছিলাম। আসলে আগে যতবারই তোমার সাথে চোখাচোখি হয়েছে, ততবারই মুখে না বললেও, তোমার চোখের পাতায় আমার জন্য একটু হলেও অনুভূতি দেখেছি। তাকেই আমি ভালোবাসা বলে ভুল করেছি।
প্রীতি হতাশার সুরে বললো, এখন আর এসব আলোচনা করে লাভ কি?
একদিন না হয়, লাভ-ক্ষতির হিসেব বাদ দিলে প্রীতি।
না হয় দশটা মিনিট আমরা ফিরে গেলাম রজনীপুরের পুজোর নবমী সন্ধেতে, না হয় ফিরলাম ফুটবল খেলার মাঠে….খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে তোমার সুখের সংসারের!
প্রীতি খুব আস্তে আস্তে বলল, ভালো আমিও তোমায় বেসেছিলাম নীলাভ, আজ আর স্বীকার করতে বাধা নেই। তবে তোমরা যখন কোনো খবর না দিয়ে রজনীপুর ছাড়লে তখন বুঝেছিলাম, এ ভালোবাসার জোর নেই। বড্ড পলকা!
নীলাভ চোখটা বন্ধ করে বলল, জোর তো আছেই প্রীতি। নাহলে এই জীবনে আবার তোমায় দেখতে পেলাম কি করে! আমি তো আমার প্রথম প্রেমের কাছে শুধু এটুকুই চেয়েছিলাম, একবার অন্তত দেখা হোক তোমার সাথে। আমার প্রথম প্রেম আমায় বিট্রে করেনি প্রীতি।
প্রীতি বলল, এবারে উঠব। আমাদের স্কুলবেলার সেই পরিচয় সুজন কিন্তু জানে না নীলাভ।
প্রীতির কথার রেশ ধরেই নীলাভ বলল, জানবেও না। কথা দিলাম।
একটা কথা বলতো প্রীতি, মেয়েরা কি বিয়ে হয়ে গেলে আবেগশূন্য হয়ে যায়। এই তুমিই একদিন আমার জ্বর শুনে রিন্তিকে দিয়ে ওষুধ পাঠিয়েছিলে, আর আজ শরীর খারাপ শুনে একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করলে না, কি হয়েছে আমার!
প্রীতি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি জানি তোমার শরীর খারাপ। তিনদিন ধরে মাইগ্রেনের প্রবলেম হচ্ছে।
মালতি বলল, তোমার নাকি খুব মাথার যন্ত্রনা হচ্ছে দুদিন ধরে।
আমি জানি তোমার মাইগ্রেনের প্রবলেম আছে। চশমাটা কি ঐজন্যই নিয়েছ?
নীলাভ আড়চোখে তাকিয়ে বলল, না, হ্যান্ডসাম লাগবে বলে নিয়েছি। চোখে পাওয়ার এসেছে আমার।
প্রীতি একটা টিফিন কৌটো নামিয়ে রেখে বলল, খেয়ে দেখো, নুন বেশি, ঝাল কম রান্না।
তুমি নিজে রান্না করেছো? বলো কি? পারলে?
প্রীতি নীলাভর ছেলেমানুষি দেখে হেসে বলল, তোমার আমায় কি মনে হয়, ননীর পুতুল, পারব না কেন?
আসলে আমার কল্পনার অপ্সরীর হাতে হয় হারমোনিয়াম নয় বই দেখেছি, তাই খুন্তিটা ভাবতে একটু কষ্ট হচ্ছে আরকি!
সামনের সপ্তাহে আমাদের হানিমুন। ওর আমার দুজনেরই জঙ্গল পছন্দ।
প্রীতি স্পষ্ট দেখল নীলাভর চোখে জল।
নীলাভ সামলে নিয়ে বলল, প্যাকিং কমপ্লিট?
প্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু বাকি।
ভালো থেকো নীলাভ, চললাম।
নীলাভ বলল, তোমাকে দেখতে পেলাম, এবার থেকে আমি সত্যিই খুব ভালো থাকব।
প্রীতি ফিরে এসেছে নিজের ফ্ল্যাটে।
বুকের ওপর থেকে একটা ভারী বোঝা নেমে গেল যেন। খুব দরকার ছিল নীলাভর সম্মুখীন হওয়া।
কিন্তু নীলাভকে সামনে থেকে দেখার পর থেকেই অকারণে চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ে চলেছে প্রীতির।
সুজন আসার আগেই স্বাভাবিক হতে হবে ওকে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না ওই মুখটা ভুলতে।
প্রীতি আর ব্যালকনিতে যাবে না এ কদিন। হানিমুনটা সুজনের সাথে এনজয় করতে হবে। সুজন ওকে ভালোবাসে। ওরা এখন স্বামী, স্ত্রী। তাই সামনের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকের সাথে কিছুতেই মুখোমুখি হতে চায় না প্রীতি।
সুজনের সামনে নিখুঁত অভিনয়টা চালিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরের ঝড়ের সামান্য আঁচও আসতে দেয়নি বাইরে। প্রীতির বারবার মনে হচ্ছে, আরেকবার ছুটে যায় নীলাভর ফ্ল্যাটে, দিয়ে নীলাভকে গিয়ে বলে, আমি তোমায় ভুলতে চাই।
দিন চারেক পরে মালতি এসে ঠকাস করে টিফিন কৌটোটা রাখল টেবিলের ওপর।
বিজবিজ করে বললো, ও বৌদি, নীলদাদা এটা ফেরত দিল।
প্রীতি কিছু বলার আগেই বলল, নীলদাদা এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে চলে গেল গো আজ সকালে। বলল, মালতিদি, তোমার বৌদিকে বলো, তরকারিতে নুন বেশি দেওয়াই ভালো, নুন কমে বিস্বাদ হয়ে যায়। বেশি থাকুক, কিন্তু বিনা নুন যেন না হয়!
নীলাভ চলে গেছে শুনেই থমকে গেল প্রীতি।
বলে ফেলল, কোথায় গেল মালতি?
তা আমি কি করে জানব, আমি কাজের লোক, আমায় কি এত বলবে?
তোমরা তো ওর আত্মীয় হয় বলছিলে, তো তোমায় বলেনি?
প্রীতি সামলে নিয়ে বলল, চলে যাবে বলছিল বটে।
অনেকক্ষণ নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদছে প্রীতি। বালিশটা ভিজে গেছে নোনতা জলে।
অস্ফুটে বলল, ক্ষমা করো নীলাভ, আমায় ক্ষমা করো। সেই পঞ্চমীর সকালকে ক্ষমা করো, সেই নবমীর সন্ধেকে তুমি ক্ষমা করো। ওই শরৎকে তুমি ভুলে যাও নীলাভ। আলমারি থেকে কবেকার পুরোনো গোলাপি শাড়িটা বের করে ফলসের সেলাইয়ে হাত বুলিয়ে বললো, একটা পরজন্ম চাই আমার নীলাভ। এবারের কথা ভঙ্গের দায় মেটাব পরজন্মে গিয়ে।
সুজন এসে বেল বাজাল। প্রীতি চোখের জল মুছে, ভাঙা গলায় বলল, আসছি….
সমাপ্ত