Accessibility Tools

নীরবে তোমায় দেখি – অর্পিতা সরকার

স্বীকারোক্তি

তিনটে বছর অনেক সময় তাই না নীলাঞ্জন?

নীল অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ অনেক সময়। একটা যুগ বলতে পারিস।

আমি তোকে কিন্তু প্রোপোজ করতে দেরি করিনি, বলতে পারিস কলেজের দ্বিতীয় দিনেই তোকে জানিয়েছিলাম আমার ভালোলাগার কথা। ছলছল চোখে অভিমানী গলায় কথাটা বলল শ্রীজা।

নীল আলতো করে বলল, তুই এখনো পাগলীই থেকে গেলি।

শোন নীল, পাগলী না হলে আজ অবধি শুনেছিস, ফার্স্ট ইয়ারের কোনো মেয়ে তার থেকে দু ইয়ারের সিনিয়র ছেলেকে ডিরেক্ট গিয়ে প্রোপোজ করে?

দাদা, আপনিও আছেন বটে, এতকাল ধরে আপনার কাছে ফুচকা খাচ্ছি, আপনি জানেন আমি কাঠ বাঙাল, তারপরেও আপনি এমন মিষ্টি মিষ্টি ফুচকা বানান কি করে? আরেকটু ঝাল দিন আগে। মুখে দ্বিতীয় ফুচকাটা ভরে দিয়ে আবার বলতে লাগল শ্রীজা।

তো যেটা বলছিলাম, তুই ক্যাম্পাসিং-এ জব পেয়ে গেছিস, আমিও আশা করছি পেয়ে যাব। তাহলে আমাদের দুই বাচ্চার বাবা-মা হয়ে সংসার করাটা কে আটকাচ্ছে, সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না রে! ওরে বিয়ে অমন হুট করে হয় না, প্ল্যানিং দরকার বুঝলি? এখন থেকে প্ল্যান করতে শুরু করলে দেখবি বছর দুয়েক পরে আশীর্বাদ হল।

নীলাঞ্জন বলল, দাদা, আমি ঘটির ছেলে। আমার দিকটা কি আপনিও ভাববেন না?

ফুচকাওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল, তিনবছর ধরে দেখলাম তো ভাই। যেদিনই তোমরা একসাথে আসো, সেদিনই বাঙাল-ঘটির ঝগড়া লাগে।

শ্রীজা মুখের মধ্যে বেদম ঝাল ফুচকাটাকে কোনোরকমে ম্যানেজ করতে করতে বলল, ভুল বোঝেন দাদা, আমাদের ঝগড়া ঐজন্য লাগে না।

আরে ঘটি, বাটি, গামলা, থালা এসবে আমার জাস্ট কোনো প্রবলেম নেই। আমার প্রবলেম হল, আমি ওকে ভালোবাসি কিন্তু ও আমায় বাসে না।

নীল চোখ পাকিয়ে বলল, কি হচ্ছে! রাস্তার লোকের সামনে সিন করবি না বলে দিচ্ছি।

শ্রীজা বললো, লোকে জানুক। তুই আমার মতো সুন্দরী, শিক্ষিতা মেয়েকে বাতিল করছিস। জাস্ট রিজেক্ট করছিস কোনো কারণ ছাড়া।

হ্যাঁ, নুনটা আরেকটু বেশি দিন, আর সামান্য টক…

কখনো আয়নায় নিজেকে দেখেছিস তুই?

ছয় ফিট হাইট, শালা জীবনে কলকাতার মিনিতে উঠতে পারব না তোর জন্য। জীবনে ফ্ল্যাট স্টাইলিশ জুতো পরতে পারব না তোর জন্য।

আমার বাবা বলে, আমি নাকি দোতলা সমান ঘোড়ার খুড়ের মতো জুতো পরি। কেউ বোঝে না আমার কষ্টের কথা।

শালা, সামনে টুল এনে তোকে কিস করতে হবে।

এখন থেকেই আমি স্পন্ডেলাইটিসের ব্যায়াম করি। ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকতে হয়, ওসব পচা রোগ হতে কতক্ষণ? এত কিছু সমস্যার পরেও তুই কি করে বলিস রে, তুই আমায় ভালোবাসিস না?

হ্যাঁরে তোর কি মায়া-দয়া নেই?

নীলাঞ্জন ফুচকার টাকা মেটাতে যেতেই শ্রীজা বলল, আমি দিচ্ছি। তোর টাকায় আমি তখনই খাব, যখন তুই বলবি, তুই আমায় ভালোবাসিস।

নীলাঞ্জন কথা না বলে ওয়ালেটটা পকেটে চালান করে দিল।

শ্রীজা বলল, লজ্জা করে না তোর, কি কিপ্টে রে তুই?

নতুন জব পেয়েছিস, কোথায় ফিঁয়াসেকে নিয়ে গিয়ে পার্কস্ট্রিটে খাওয়াবি তা নয়, ফুচকা খাইয়েও টাকাটা আমায় দিতে হচ্ছে?

পার্স থেকে টাকা বের করে দিতে দিতে শ্রীজা বলল, এই নকল ফুচকা বেচবেন না বুঝলেন দাদা? তিনবছর আপনার ফুচকা খাচ্ছি, তবুও এ ছেলে কিছুতেই স্বীকার করল না আমায় ভালোবাসে!

ফুচকাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল, ওহ, এখন আমার ফুচকার দোষ হলো?

নীলাঞ্জন নরম গলায় বলল, দাদা, পাগলীর কথায় কিছু মনে করবেন না। আমায় দেখুন, এত কথা শুনছি, আমি কিন্তু চুপ। আপনিও ….

শ্রীজা গটগট করে এগিয়ে যাচ্ছিল, নীল বলল, বাইকে যাবি না? মিনিতে ফিরবি?

না রে ছোটলোক, আমি জানি আমি তোর বাইকে না চাপলে তুই বড্ড খুশি হোস। কিন্তু তোকে এই মুহূর্তে অতটা খুশি আমি করতে পারলাম না।

ঝগড়া করছিলিস বলে ফুচকাটা তো ভালো করে খাওয়াই হল না। তাই ওদিকটায় পাপড়ি চাট আছে কিনা খুঁজছি।

নীল বলল, শ্রীজা তুই আর কবে ম্যাচিউরড হবি রে?

শ্রীজা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কোনটা ম্যাচিউরিটি!

তোর মতো যাকে ভালোবাসি তাকে অস্বীকার করাটা?

নীলাঞ্জন ঢোক গিলে বলল, অস্বীকার কবে করতে দিলি? গলায় পা দিয়ে তো বলিয়েছিস। আমিও স্বীকার করেছি, আমি তোকে ভালোবাসি।

ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু বিয়ে-সংসার এসবে আমি রাজি নই, বন্ধুর মতো দেখি তোকে।

শ্রীজা বলল, তুই কেন বুঝতে পারছিস না, আমি মেয়ে, আমার বাড়িতে প্রায়ই সম্বন্ধ নিয়ে আসে লোকে। আমি একটা জব পেলেই বাবা বিয়ে দিয়ে দেবে রে। তাছাড়া দেখ, আমি একটা যুবতী মেয়ে, এই কলকাতা শহরে একা একা ঘুরে বেড়াই, তোর তো ভয় পাওয়া উচিত রে। কখন কার সাথে প্রেমে পড়ে যাব, কি ভরসা বলত!

নীলাঞ্জন হালকা হেসে বলল, পার্পেল কালারের বেনারসীটা তোকে আমিই দেব। বিয়ে করে নে।

শ্রীজা প্রায় চিৎকার করে বলল, দেখ, দেখ আমার যে পার্পেল পছন্দ, সেটা একমাত্র তুইই জানিস। আমি যে বিয়েতে ওই রঙের বেনারসী পরতে চাই এটাও তুইই জানিস, তাহলে?

কেন রে নীল, কিসের প্রবলেম তোর?

তুই একবার তোর ফ্যামিলিতে আমাকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দে, দেখ আমি ম্যানেজ করে নেব তোর বাবা-মাকে।

নীলাঞ্জন বলল, ওই দেখ তোর পাঁপড়ি চাট, চল খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।

শ্রীজা রাগী গলায় বলল, তোর প্রবলেমটা কি রে?

তোর ফিজিক্যাল কোনো প্রবলেম?

বাবা হতে পারবি না বলে কষ্ট পাচ্ছিস?

শোন আমরা দত্তক নিয়ে নেব।

নীলাঞ্জন হেসে বলল, আমার সব ঠিক আছে। বরং আমি বাবা হতে চাই না।

শ্রীজা বলল, কি করে জানলি ঠিক আছে? কোনো মেয়ের সাথে টেস্ট করেছিস? আমাকে তো এখনো একটা কিস অবধি করিসনি, কি করে বুঝলি তোর সব পারফেক্ট?

নীল কয়েক পা এগিয়ে বলল, ব্লু দেখে টেস্ট করেছি, এখন তুই যাবি? নাকি রাস্তায় প্যান্ট খুলে দেখাতে হবে?

শ্রীজা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ধুর, আমি পাগলী বলে কি মেয়ে নই। আমার কি লজ্জা করে না?

ওসব বিয়ের পরে দেখব।

নীল হাল ছাড়া গলায় বলল, সেই বিয়ে?

আর কতবার বলব, আমি বিয়ে করব না। এভাবে বিয়ে বিয়ে করে বিরক্ত করবি না আমায়। এটা রিকোয়েস্ট তোর কাছে।

বাইকটা ছুটছে সন্ধের তিলোত্তমার ভিড় কাটিয়ে।

শ্রীজা একটা হাত দিয়ে ধরে আছে নীলাঞ্জনের কাঁধটা।

অন্যদিন বকবক করে করে পাগল করে দেয় নীলকে। নেহাত হেলমেট থাকে বলে, সব কথা এসে পৌঁছায় না ওর কানে, তাই এখনও কান দুটো জীবিত আছে।

কিন্তু আজ শ্রীজা একদম চুপ।

পাঁপড়ি চাট খায়নি, গম্ভীর গলায় শুধু বলেছে, তুই কি আমায় বাড়ি পৌঁছে দিবি? না হলে বাস ধরে নেব।

নীল বার দুয়েক কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু শ্রীজা জাস্ট চুপ। অভিমান ভাঙাতে নীল কোনোদিনই পারে না। সত্যি বলতে কি গত তিনবছরে শ্রীজার অভিমান হয়ইনি। এ মেয়ে বেশিক্ষণ রাগ করেও থাকতে পারে না। নিজেই বলে, রাগ করলে শরীরের ক্ষতি। আমার চাঁদপানা মুখের ক্ষতি। বেশি রাগলে কপালে ভাঁজ পড়বে, তাই আজ রাগতে রাগতেও রাগলাম না।

নীলের হাসি পায়, রাগ না করার কারণগুলো শুনে।

আসলে শ্রীজা জীবনটাকে খুব সহজ করে দেখতে চায়। হয়তো বাবা, মা নিয়ে খুব সুখের জীবন ওর। তাই দুঃখ শব্দটা ওর ডিকশনারিতে নেই। পোশাক-আশাক দেখেই বোঝা যায় বড়লোকের মেয়ে। কষ্ট কাকে বলে দেখেনি। তাছাড়া মানসিক ভাবে যে শ্রীজা খুব শান্তিতে আছে সেটা ওকে দেখেই বোঝা যায়। দিনরাত কারণে-অকারণে হেসেই যাচ্ছে।

শ্রীজা প্রথম প্রথম দু-একবার নীলের বাবা-মায়ের কথা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু নীল পরিষ্কার বলেছিল, বন্ধুত্ব রাখতে গেলে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাইলে হবে না।

কেউ কারোর পরিবার নিয়ে কিছু জানতে চাইবে না এই শর্তেই ওদের বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়েছিল।

শ্রীজা অবশ্য এটাকে বিশুদ্ধ প্রেম বলে।

ওর ভাষায় বন্ধুত্বের সীমা ক্রস করলেই সেটাকে প্রেম বলা চলে।

 নীল ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের ছেলে, তাই বেশিরভাগ কথা শ্রীজাই বলে। সেই পরিচয়লগ্ন থেকেই এই অলিখিত চুক্তি চলে আসছে, যে শ্রীজা ভুলভাল বকবে আর নীল মুখ বন্ধ করে শুনবে।

আমার বাড়ি এসে গেছে, বাইক থামা….

অন্যমনস্ক নীল খেয়ালই করেনি শ্রীজার গন্তব্য এসে গেছে। দূর থেকে শ্রীজাদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। এইখানেই নামে শ্রীজা। বাড়ির একেবারে সামনে নামলে যদি ওর বাবা-মা দেখতে পেয়ে যায়, তাই বাড়ির একটু আগেই নামে। ব্রেক কষতেই নেমে পড়ল শ্রীজা।

আচমকা বলল, ভালো থাকিস নীল। প্রাণ ভরে বাঁচিস। আর বোধহয় বিরক্ত করব না তোকে।

নীলকে অবাক করে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল শ্রীজা।

নীল পিছন থেকে ডেকে বলল, এর মানে?

আমাদের আর দেখা হবে না? ফোনে কথা?

শ্রীজা একটু ভাঙা গলায় বলল, যদি বলি মুক্তি দিলাম তোকে!

ধুর, কি হচ্ছে এসব, তোর মুখে এত কঠিন শব্দ মানায় না শ্রীজা।

অল্প হেসে ও বলল, না রে গত তিনবছর ধরে অপেক্ষা করে করে আমি বুঝে গেছি, ভালোবাসা জোর করে আদায় করার জিনিস নয়।

আসলে কি বলত নীল, তুই এমন একটা ছেলে যাকে সবাই ভালোবাসতে চাইবে, কিন্তু তাই বলে তোকে জোর করে ভালোবাসতে হবে এমন কথা নেই রে। তুই তো জানিস বল, আমি বদ্ধ পাগলী। বোকার মতো তোকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। তুই তো প্রথম থেকেই বলেছিলি, বন্ধুত্বে রাজি, প্রেমে নয়। তারপরেও আমি তিনবছর ধরে তোকে কত যে বিরক্ত করেছি, তুই বলেই সহ্য করেছিস আমায়।

নীল গলার কাছের জমে থাকা কষ্টটাকে বুকের ভিতর ঠেলে পাঠিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু বিয়ে, ভালোবাসা বাদ দিয়েও তো আমাদের বন্ধুত্বটা খাঁটি রে। সেটাকে এভাবে শেষ করবি তুই শ্রীজা?

নিজের চুলে একবার আঙুল চালিয়ে শ্রীজা বলল, তোর কাছে হয়তো শুধু বন্ধুত্ব, আমার কাছে সেটাই যে ভালোবাসা, ভবিষ্যতের হাতছানি রে।

তাই তোর সমস্ত অস্তিত্বকে ভুলে থাকতে গেলে আমাদের দূরত্ব দরকার। না ফোন, না দেখা…

দেখবি সময় আমাদের দুজনকে ঠিক ভুলিয়ে দেবে এই তিন বছরের সব স্মৃতি।

নীল অপলক তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। এটা শ্রীজাই তো! এত সিরিয়াস কথা বলা মেয়েটা কি করে শ্রীজা হয়?

রাস্তায় পা মচকে পড়ে গিয়ে যে মেয়ে একগাদা লোকের মাঝে রাস্তায় বসেই হি হি করে হাসে, সে কি করে এত কঠিন কঠিন কথা বলছে।

ঘুম থেকে উঠেই নীলকে মেসেজ করা যার নিত্যদিনের অভ্যেস, সে কি করে নীলকে ভুলে থাকবে বলছে?

কলেজে কি সালোয়ার পরে যাবে, কোন রঙের টপ পরবে…সেটাও যে নীলকে জিজ্ঞেস করে সে কি করে ভুলবে ওকে!!

নীলের অবাক হওয়া চাহনির দিকে তাকিয়ে শ্রীজা বলল, চাপ নিস না রে, আমি ঠিক পারব।

শুধু তুই আর কোনো যোগাযোগ করিস না আমার সাথে। প্লিজ, এটুকু উপকার কর। আমাকে সবটুকু ভুলে নতুন জীবনে পা রাখতে সাহায্য কর নীল, প্লিজ। বন্ধু হিসাবে এটুকু তো করবি বল!

নীল মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘাড় নেড়ে বলল, বেশ তুই যা চাইছিস তাই হবে। শ্রীজা আলতো করে নীলের হাতটা ধরে বলল, ভালো থাকিস।

সময়মত খেয়ে নিবি, রাত জেগে কাজ করলে বেশি কফি খাবি না। আর শোন, রিজার্ভে যাওয়ার আগেই বাইকে তেল ভরবি। নাহলে কিন্তু কেউ মনে করিয়ে দেবে না, রাস্তায় ঠেলে ঠেলে যেতে হবে।

সাদা টি-শার্ট পরবি না একদম। সাদা রঙেতে তোকে বড্ড হ্যান্ডু লাগে রে। শেষের দিকে গলাটা ধরে এসেছিল শ্রীজার।

নীলের বুকের ভিতরে একটা অব্যক্ত কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ও দেখছে…… ওর বাড়ি ফেরার লাস্ট ট্রেনটা ছেড়ে যাচ্ছে স্টেশন থেকে। অথচ ওর অসার পা দুটো কিছুতেই ছুটতে চাইছে না ট্রেনটা ধরার জন্য। চোখের সামনে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শেষ আশ্রয়টুকু।

শ্রীজা বলল, তিনদিনের দাড়ি জমিয়ে অফিস যাবি না যেন। রোমিও রোমিও লাগে তোকে। ক্লিন সেভ করবি…. আর আর…

ও হ্যাঁ, রাতে ভূতের সিনেমা দেখবি না কিন্তু। মনে রাখিস মাঝরাতে ভয় পেয়ে আমাকে আর ফোন করতে পারবি না। সারারাত তোর সাথে ফোন ধরে বসেও কেউ থাকবে না নীল।

ভালো থাকিস, মন দিয়ে জবটা কর।

চলে যাচ্ছে শ্রীজা….

গলা ছেড়ে ডাকতে ইচ্ছে করছে নীলের। বলতে ইচ্ছে করছে শ্রীজা, কেন বিয়ে করতে চাইনা সেটা তো শুনে যা। বলতে ইচ্ছে করছে, তুই ছাড়া কেউ নেই রে আমার। আমায় ছেড়ে যাস না শ্রীজা…

ডাকা হল না শ্রীজাকে। যতক্ষণ ওকে দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত দেখে বাইকে স্টার্ট দিল নীল। ভেবেছিলো, শ্রীজা অন্তত একবার পিছন ফিরে তাকাবে। কিন্তু না, একবারও না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলে গেল শ্রীজা।

বাড়ি ফিরতেই মা বলল, ডিনার করবি তো? নীলের আজ মাকে দেখে কেমন একটা রাগ হচ্ছিল। এতদিন পর্যন্ত মাকে দেখে ওর কষ্ট হয়েছে। সিঙ্গেল মাদার, কত কষ্ট করে মানুষ করেছে সন্তানকে, এসব ভেবে সেই ছোট্ট থেকে কখনো মায়ের বিরোধিতা করেনি। এমনকি মায়ের মুখের ওপর কথাও কোনোদিন বলেনি। মা একটা বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা। আয় খুব বেশি নয়। স্কুলের আয় আর গানের টিউশনির টাকায় বেশ কষ্ট করেই মানুষ করেছে নীলকে। সুমিত্রাদেবীর একটাই স্বপ্ন ছিল, ছেলে মানুষের মতো মানুষ হবে। নীল জানে না মায়ের আশা কতটা পূরণ করতে পেরেছে, তবে এখনো পর্যন্ত নীলকে কেউ খারাপ ছেলে বলেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার সাথে সাথেই জব পেয়ে গেছে, ভালো রেজাল্টের জন্য। মায়ের দিকে তাকিয়ে নীল আচমকা বলে বসল, মা তোমার কি কোনো ক্ষমতাই নেই?

একটা পুরুষমানুষকে তুমি বশে রাখতে পারলে না?

কেন বাবা তোমাকে ছেড়ে চলে গেল গো? রিতা আন্টির মধ্যে কি আছে, যা সুমিত্রা ব্যানার্জীর মধ্যে নেই?

আজ যদি তুমি আরেকটু কেয়ার নিতে নিজের সংসারের প্রতি, তাহলে আমাকে সকলের কাছ থেকে নিজের পরিচয়টা লুকিয়ে বেড়াতে হতো না। বাবার নামটা আড়াল করতে হত না। আমি লোকের কাছে গর্ব করে বলতে পারতাম, নামী ডক্টর শ্রী নীলাভ ব্যানার্জী আমার বাবা। সে সব তো কোনোদিন পারলামই না, বাবার আদরটাও পেলাম না?

তোমার কিসের এত অহংকার গো মা? কেন তুমি বাবাকে জোর করে আটকে রাখলে না? কেন যেতে দিলে রিতা আন্টির কাছে?

নীলের মুখের কথা আজ লাগাম ছাড়া। ক্লাস সিক্সে যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখেছিল বাবার প্যাকিং কমপ্লিট, তখন নীল বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিল, আমরা কি কোনো ট্যুরে যাচ্ছি বাবা? কোথায় যাব? সামার ভ্যাকেশনে বেড়াতে যেত ওরা, এই অসময়ে লাগেজ প্যাকিং দেখেই অবাক হয়েছিল নীল।

মা নীলকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তোমার বাবা আর এ বাড়িতে থাকবে না। বাবা নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে, ওখানে থাকবে। নীল অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বাবার মুখের দিকে। সেখানে সংকোচ আর লজ্জা মিশে ছিল। নীলের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বলেছিল, বড় হলে বুঝবি, সব সম্পর্ক সহজ হয় না। সারাজীবন মানিয়ে নিয়ে থাকতে তোর মায়েরও কষ্ট, আমারও কষ্ট। তুই কিন্তু আমারই ছেলে, তাই তোর পড়াশোনার সব ভার আমার। তোকে আমি ডাক্তার করব।

মা দৃঢ় গলায় বলেছিল, নীল শুধু আমার ছেলে। তাই ওকে আমি মানুষ করবো যে ভাবে পারব।

বাবা আর দাঁড়ায়নি। মাথাটা নিচু করে বেরিয়ে গিয়েছিল।

এতদিন ধরে মায়ের কাছে শুনে আসছে, বাবা ভীষণ খারাপ। রিতা আন্টিকে বিয়ে করে সংসার করছে। কোনো দায় নিতে হয়নি।

একদিন স্কুলের সামনে একজন ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা এসেছিল। ভদ্রমহিলা নীলের হাতে দুটো চকলেট দিয়ে বলেছিল, আমি তোমার আন্টি। তোমার বাবা তোমাকে ভীষণ মিস করে, মাঝে মাঝে তুমি তো যেতে পারো বাবার কাছে। নীলের তখন ক্লাস এইট। মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে এই মহিলাকে ও চিনে গেছে। তাই বিরক্ত হয়ে বলেছিল, আপনার জন্যই আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আপনি চলে যান এখান থেকে। বাবা মুখ কালো করে বলেছিল, নীল ভালো থাকিস। বড্ড মনখারাপ করে তোর জন্য। তোর মাকে ভালো রাখিস, আমি তো পারলাম না, তুই ভালো রাখিস মাকে।

মাকে বাড়ি ফিরে বলতেই মা বলেছিল, তোকে কেড়ে নিতে এসেছিল। জানি, জানি, সব চক্রান্ত।

আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে তবে আনন্দ পাবে ডাঃ নীলাভ ব্যানার্জি।

ছোটবেলায় মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে প্রায় শুনতে পেত বাবা-মায়ের ঝগড়া। মা বলছে, তোমার সব কিছুতে নাক উঁচু কেন? আমার সত্যিই আর ভালো লাগে না তোমায়!

বাবা বলছে, তোমার এই রোমান্টিক ভাবনাচিন্তা বাস্তবের মাটিতে জাস্ট নেওয়া যায় না।

বেড়াতে গিয়ে মাটির বাড়িতে কেন থাকব বলতে পারো সুমিত্রা?

কারণ ওখান থেকে জীবনটা দেখা যায় নীলাভ।

এসব ঝগড়া শুনতে শুনতে নীলের দৃঢ় ধারণা জন্মেছিল এদের মধ্যে ভাব একদমই নেই। মতের বড্ড অমিল। তবে বাবাকেও নীলের খারাপ লাগত না। বাবা একটু ভালোভাবে বাঁচতে চায়, কিন্তু মা মাটির গন্ধ নিতে চায় প্রতি মুহূর্তে।

ঝগড়া হত ঠিকই কিন্তু বাবা যে ডিভোর্স নিতে পারে এটা বুঝতে পারেনি নীল। সেই ছোট্ট থেকেই বুঝেছিল নীল, মাবাবার পাঠানো টাকা প্রতিবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়। নিজের রোজগারের অল্প টাকাটাতেই নীলকে মানুষ করেছে, আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ওকে সবরকমভাবে ভালো রাখতে।

মাকে আঁকড়ে ধরে বড় হচ্ছিল নীল, বাবার জন্য একরাশ ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না ওর মনে।

আজ হঠাৎ শ্রীজা চলে যাওয়ার পর থেকেই মাথাটা গেল ওলোটপালোট হয়ে।

মাকে বেশ কিছু আক্রমণাত্মক কথা বলে তবে নিশ্বাস নিল নীল।

মা অস্ফুটে একটাই কথা বলল, অহংকার আর আত্মসম্মান শব্দ দুটোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে নীল। তোমার বাবা রিতাকে বিয়ে করে আমাকে অসম্মান করেছে। তাই আমি তার টাকা নিতে পারি না। এটা আমার অহংকার নয়, আত্মসম্মান। দিনের পর দিন তোমার বাবা আর আমার মধ্যে মতের অমিলের কারণেই অশান্তি হচ্ছিল, সেই অবস্থায় তাকে জোর করে আটকে রাখাটাকে আমি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়া ভাবি নীল।

সম্বিত ফিরতে নীল বলল, সরি মা। সারাজীবন বাবার পরিচয় না দিতে দিতে আর নিজেকে গুটিয়ে রাখতে রাখতে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। তোমাদের সম্পর্কটা কাছ থেকে দেখে বিয়ে নামক জিনিসটাতেই আমার ঘেন্না ধরে গেছে।

সুমিত্রাদেবী, ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোর কষ্টটা আমি বুঝি। কিন্তু আমারও কিছু করার নেই। সবাই বিয়ে করে অখুশি নেই রে।

দেখ না, তোর বাবা আর রিতা তো বেশ ভালোই আছে। সুন্দর সংসার।

নীল বিরক্ত স্বরে বলল, আর তুমি কেমন আছো মা?

আমিও ভালো আছি রে, স্কুল আর তোকে নিয়ে সত্যি ভালো আছি।

ঘুরে ফিরে মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্রীজার কথাগুলো। শ্রীজাকে বলা হলো না, আমি তোর মতো সুখী নই রে। তোর মত বাবা-মায়ের আদরের দুলালী নই। তোর মতো সুখের সংসারে বড় হইনি। আমি রাস্তায় বেরোলে লোকে আঙুল দেখিয়ে বলত, এর বাবা এদের ছেড়ে চলে গেছে। আমি স্কুলে গেলেই বন্ধুরা বলত, এই তোর নতুন মা তোদের বাড়িতে আসে বেড়াতে?

শ্রীজাকে এগুলো বলার দরকার ছিল।

ভালোবাসা শব্দটা নীলের কাছে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে আসে, বিয়ে শব্দটা ওর কাছে অনেকটা ঘৃণা নিয়ে আসে। বলার দরকার ছিল শ্রীজাকে।

আজও ভাবতে অবাক লাগে নীলাঞ্জনের, ওর মতো মুখচোরা ছেলেকে যেকোনো মেয়ে এসে প্রোপজ করতে পারে এটাই অবাক করা ঘটনা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যান্টিনে বসে ছিল নীলাঞ্জন। একা, হ্যাঁ একা থাকতেই ও বেশি পছন্দ করত। বন্ধু মানেই অনেক প্রশ্ন, অনেক জটিলতা, বাড়িতে আসা…

এসবের থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখত নীল। নীল জানে ওর বাবা বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট নীলাভ ব্যানার্জী.. এটা জানলে একদিকে বাড়বে ওর সম্মান, অন্য দিকে ওর আড়ালে চলবে ওকে নিয়ে ঠাট্টা। তাই একা থাকাই বেস্ট। এসব ভেবেই অকারণ বন্ধুত্বে জড়ায়নি নিজেকে। চুপচাপ মোবাইল ঘাঁটছিল নীল। আচমকা একটা মেয়ে এসে বলল, বসতে পারি?

সামনের সিটে বসতে বসতেই বলল মেয়েটা। নীল চোখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিল।

মেয়েটা বলল, আমার নাম শ্রীজা দত্ত।

আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কলেজে এলাম, একটা প্রেম করা দরকার। সব বন্ধুদের লাভার আছে। ভ্যালেন্টাইন ডে বেশ ঘটা করে পালন করে। তাই আমিও ভাবলাম, একটা প্রেম করি। বয়েস তো কম হল না।

একটু খুঁজতেই তোর দিকে চোখটা আটকে গেল। সেই যে আটকাল কিছুতেই আর সরছে না।

নীল বিরক্ত হবে, না অবাক হবে ভেবে অপলক তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে।

শ্রীজা বলল, শোন বাপু, আমি তোকে ভালোবাসব কিনা সেটা নির্ভর করছে তুই কতটা ফ্রেন্ডলি সেটা দেখার পরে। কদিন মিশি তোর সাথে, তারপর ফাইনালি প্রোপোজ করবো বুঝলি, এখনই স্বপ্ন দেখার দরকার নেই।

নীলাঞ্জন হেসে বলেছিল, তুই কি পাগল?

শোন, আমি তোর থেকে দু বছরের সিনিয়র, তাই ….

শ্রীজা বলল, দেখ বস, তুমি, আপনি এসব আমার মুখে বড্ড বেমানান। আপনি বললে তোকে জেঠু বলতে হয়। আর তুমি বললে, ওগো, হ্যাঁগো শুরু করতে হয়।

তার থেকে তুই-ই বেস্ট।

নীলাঞ্জন ঘাড় নেড়ে বলেছিল, আমি প্রেমে ইন্টারেস্টেড নই।

শ্রীজা আলতো হেসে বলেছিল, প্রেমে কেউ জন্ম থেকেই ইন্টারেস্টেড থাকে না, প্রেম করতে করতে ইন্টারেস্ট বাড়ে বুঝলি?

যাকগে প্রেম নিয়ে পরে ভাববি, আপাতত বন্ধুত্বটা হোক।

মেয়েটার সাবলীল ব্যবহারের জন্যই নীলের মতো রামগরুড়ের ছানা, অসামাজিক মানুষেরও বন্ধু জুটেছিল। তারপর থেকে কি করে যেন একে অপরের কাছাকাছি এসেছিল।

শ্রীজা নীলকে প্রায়ই বলত, ভালোবাসি।

নীল বলত, বন্ধু ভাবি তোকে।

শ্রীজা বলত, বেশ হই বন্ধু, তবুও বল, ভালোবাসিস আমায়।

শ্রীজা জানে না নীল ওকে ঠিক কতটা ভালোবেসে ফেলেছিল। নীল নিজেও জানত না ওর মধ্যে এখনো একটা নরম মন ছিল। বাবা-মায়ের ঘাত-প্রতিঘাত দেখেও সেই মনটা লুকিয়ে ছিল কোথাও একটা। শ্রীজার চেষ্টাতেই হয়তো সেই অচেনা মনটা আবার বাঁচতে শুরু করেছিল।

কিন্তু গন্ডগোল বাধল শ্রীজার বিয়ের কথাতেই।

ওই একটা শব্দে ওর বড্ড আতঙ্ক। সেই ক্লাস সিক্স থেকে আতঙ্কটা চেপে বসে আছে মনে।

শুধু বাবার কারণেই শ্রীজার কাছে নিজের পরিবারের সবটা বলতে পারেনি নীল। নীল জানে, ওর বাবার কীর্তি জানলে শ্রীজার পরিবারও হয়তো ওকে মেনে নেবে না। শুধু পরিবার কেন, হয়তো শ্রীজা নিজেও মেনে নেবে না।

তাই বন্ধুত্বের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিল ওদের সম্পর্কটাকে। কিন্তু শ্রীজা কিছুতেই রাজি হল না।

দুঃসহ কষ্টের মধ্যেই কাটছে নীলের দিনগুলো। অফিস, বাড়ি, গান শোনা…নির্বান্ধব একটা জীবন।

খুব খুব ইচ্ছে করে নীলের আবার শ্রীজার সাথে রাত ভোর গল্প করতে। শ্রীজার পাগলামি দেখতে ইচ্ছে করে, ওর আগডুম বাগডুম গল্প শুনতে ইচ্ছে করে। খুব মিস করে ওর হাসিটাকে।

আজ প্রায় দুমাস হয়ে গেল ওরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

দুজনেই একই সাথে হোয়াটস অ্যাপে অনলাইন থেকেছে… কিন্তু কেউ কাউকে মেসেজ করেনি একটাও। বিশেষ ওই ফুচকার দোকানের সামনে দিয়ে বহুবার গেছে নীল, কিন্তু ইচ্ছে করেনি বাইক থামিয়ে ফুচকা খেতে।

ও জানে, এখন আর কেউ বলবে না, পকেটে করে চিনি আনিস বুঝলি নীল। ঘটিরা তো ফুচকাতেও মিষ্টি খায় রে।

নীলও রেগে গিয়ে বলত, পচা মাছ খেয়ে বড় হলি, তোরা কি বুঝবি রে।

কোমরে হাত দিয়ে শ্রীজা বলত, শুটকি মাছ ওটা। জানিস প্রতিদিন কত কিলো করে বিদেশে যায়?

নীল বলত জানি না, আর জানতেও চাই না।

তোরা অন্যদেশ থেকে এসে আমাদের জীবনটা জাস্ট জ্বালিয়ে দিলি।

শ্রীজা আলতো করে নীলের হাতটা ধরে বলত, আমি এসে তোর জীবনটা পাল্টে দিতে চাই রে।

নীলেরও ইচ্ছে করত ওই নরম হাতটায় একটু চাপ দিয়ে বলতে, ভালোবাসি। তোর এই ঝগড়াগুলো ভালোবাসি, তোর ঝাল খাওয়া ভালোবাসি, তোর রেগে গিয়ে বলা বাঙাল কথাও ভালোবাসি।

না, বলতে পারেনি কোনোদিন ও। বলতে পারেনি বলেই হারিয়ে ফেলল শ্রীজাকে।

অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই মনটা ভীষণ খারাপ করছিল শ্রীজার জন্য। আজ ওর জন্মদিন। প্রতিবার জন্মদিনে কি গিফট দিবি, কি গিফট দিবি করে ক্ষেপিয়ে দেয় মেয়েটা।

নীল বলতো, সারপ্রাইজ থাক।

শ্রীজা আদুরে গলায় বলত, কি সারপ্রাইজ রে, বলেই ফেল। রাতে তোর পেটে গ্যাস হবে, ঘুম হবে না।

নীল বলত, এগুলোর কোনোটাই আমার হবে না, বরং জানতে না পারলে তোর হবে। আজ ওর জন্মদিন, তাও একটা উইশ করেনি নীল। রাত বারোটায় উইশ না করলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করত শ্রীজা। সেখানে সন্ধ্যে ছয়টা বাজে, এখনো একটাও ফোন করল না শ্রীজা।

বাইকের মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে শ্রীজার বাড়ির দিকে এগোলো নীল। ঠিক যেখানে নামত শ্রীজা ওখানে দাঁড়িয়ে ফোনটা করবে ওকে। বলবে একবার বেরিয়ে আসতে। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ফোনটা করতেই সুইচ অফ বলল। বার দুই চেষ্টা করেও পেলো না ফোনে।

মনটা ভেঙে গেল নীলের। ইগোর পাহাড় ডিঙিয়ে যদিও বা এসে পৌঁছালো, তাতেও পেলো না শ্রীজার দেখা!

একটা ক্লাস টেন-ইলেভেনের ছেলে আসছিল শ্রীজাদের বাড়ির দিক থেকে। তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে নীলাঞ্জন বলল ভাই, শ্রীজা দত্তকে চেনো?

রমেন দত্তর মেয়ে, ওই যে গোলাপিটা ওদের।

ছেলেটা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, গোলাপি বাড়িতে শ্রীজাদি ভাড়া থাকে। চারজন মিলে একটা মেস বানিয়ে থাকে। ওদের বাড়ি তো কবেই বিক্রি হয়ে গেছে। নীলাঞ্জন একটু চমকে উঠে বলল, আর ওর বাবা, মা?

ছেলেটা বলল, আপনি শ্রীজাদিকে কিভাবে চেনেন?

নীল বললো, আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড।

ছেলেটা একটু হেসে বলল, ওহ, বেস্টফ্রেন্ড অথচ এটাও জানেন না, যে রমেন আঙ্কেল আর আন্টি কার অ্যাকসিডেন্টে একসাথেই মারা গেছেন প্রায় বছর চারেক হল!

শ্রীজাদি তো টিউশানি করে আর বাবার জমানো টাকায় পড়াশোনা করছে। বাড়িটা বিক্রি করে অবশ্য বেশ কিছু পেয়েছে। এখন তো এই পাড়াতেই মেসে থাকে। ছেলেটা আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই যে হলদে রঙের তিনতলা বাড়িটা দেখছেন, ওটা ছিল শ্রীজাদিদের বাড়ি। এখন মুখার্জী আঙ্কেল কিনে নিয়েছে।

 নীল থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটা চলে গেল পাশ দিয়ে।

আর ভাবতে পারছে না নীল। তারমানে শ্রীজার সাথে ওর যবে থেকে পরিচয়, তখন থেকেই শ্রীজা একা, একদম একা! নীলের তো তবু মা আছে। কিন্তু শ্রীজা একেবারেই একা। বাবা, মাকে অমন আচমকা হারিয়েও কি করে একটা মেয়ে ওভাবে হেসে খেলে থাকতে পারে! ওর মুখ দেখে কোনোদিন বুঝতেও পারেনি নীল ওর মনে কোনো কষ্ট আছে! এমন কি প্রায়ই বলত, বড় হচ্ছি তো, বাবা বলেছে বিয়ে দিয়ে দেবে।

আমাকে এখানেই নামিয়ে দে, মা দেখতে পেলে বকবে। এসব কেন বলত শ্রীজা? ও খুব সুখী প্রমাণ করার জন্য? নাকি নীল বলেছিল পরিবারের কারোর সম্পর্কে কিছু জানতে চায় না তাই বলেনি এসব কিছু।

এত মনের জোর ওই মেয়েটার? একেবারে একা বেঁচে আছে পৃথিবীতে।

আজ দেখা করতেই হবে শ্রীজার সাথে। ওর মেসে গিয়েই দেখা করবে নীল। দেরি হলেও উইশ করবে ওকে।

বাইকটা স্টার্ট দিতে যাবে ঠিক সেই সময় ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল পকেটে।

আপনি নীলাঞ্জন ব্যানার্জী? শ্রীজা দত্ত আপনার কেউ হয়?

গলার স্বরটা কেঁপে গেল নীলের।

হ্যাঁ বলুন কি হয়েছে?

আপনি এখুনি একবার ড্রিমলাইট নার্সিংহোমে আসুন। শ্রীজা দত্তর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, অবস্থা ভালো নয়।

নীল জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, বেঁচে আছে তো?

ড্রিমলাইট এখান থেকে খুব দূরে নয়।

তবুও যেন কিছুতেই পৌঁছাতে পারছিল না নীল। শেষে কি একেবারেই হারিয়ে ফেলল ও শ্রীজাকে! ওর যে অনেক কথা বলার ছিল ওকে। বলার ছিল ভালোবাসি, সারাজীবন হাঁটতে চাই একসাথে।

নীল যখন বেড নম্বর ১১৫-তে পৌঁছাল তখন একটা সাদা কাপড় ঢাকা বডি রয়েছে বেডে।

একজন অল্পবয়সি নার্স বললেন, আপনি নীলাঞ্জন ব্যানার্জী?

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই নার্স মুখস্থ বিদ্যার মতো করে বলল, শ্রীজা দত্ত আপনার পরিচিত? ওনার ফোনে আপনার নামটা পেলাম, যেটাতে স্টার মার্ক করা আছে। তাই আপনাকেই জানানো হল। সি ইজ নো মোর।

কেঁপে গেল নীলের সামনে গোটা পৃথিবীটা।

বেডের পাশে ধপ করে বসে বলল, তোকে যে অনেক কিছু বলার ছিল শ্রীজা। বলার ছিল, আমি তোকে বড্ড ভালোবাসি। তোকে ছাড়া বাঁচব না, বিয়ে করতে চাই, তোকে পার্পেল কালারের বেনারসী পরে কনের সাজে দেখতে চাই।

সাদা ঢাকাটা ফেলে বডিটা উঠে বসতেই সামনের নার্স ছুটে পালাল বাইরে।

সত্যি বলছিস বিয়ে করবি? সত্যি বলছিস ভালোবাসিস?

নীল ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, এসব কি শ্রীজা?

মৃত্যু নিয়ে কেউ মজা করে? নীলের দুচোখে জল। তখনও কাঁপছে থরথর করে।

শ্রীজা বলল, না রে করে না। কিন্তু কিছু কিছু বিটকেল পাবলিক আছে, যারা ভালোবাসা শব্দের অর্থ বোঝে না। তাদের সাথে এভাবেই করতে হয়। তাছাড়া আজ আমার জন্মদিন, তুই উইশ করিসনি, তাই লাস্ট প্ল্যানটা ভেবে ফেললাম। বাবা-মা তো ছেড়ে চলেই গেছে, আমিও তাদের কাছে চলেই না হয় যেতাম। নীল ওকে বুকে আঁকড়ে ধরে বলল, তুই কোনোদিন বলিসনি কেন? মিথ্যে বলেছিলি কেন?

শ্রীজা কাঁদতে কাঁদতে বলল, সকলের কাছে নিজেকে সুখী দেখানোর জন্য। করুণা আমি মোটেও সহ্য করতে পারি না। বাবা-মা নেই বলে সবাই দয়া করবে, ও আমার পোষাবে না রে।

নীল ফিসফিস করে বলল, নার্সিংহোমের ডাক্তারকে ম্যানেজ করলি কি করে? তুই এখানে এমন ভাবে বেডে….ওই নার্সই বা মিথ্যে….

নীলকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল, তোর আধার কার্ডে লেখা ছিল নীলাভ ব্যানার্জীর নামটা।

এটা ওনার নার্সিংহোম।

তুই জানিস নীল, উনি কত কষ্ট পান তুই ওনার ফোন রিসিভ করিস না বলে, জানিস উনি তোকে আড়াল থেকে দেখবেন বলে কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তোর আর আমার বন্ধুত্ব দেখে একদিন হঠাৎই আমার সাথে রাস্তায় পরিচয় করেন। সবটা বলেছেন আমাকে।

নীল, যেকোনো কারণেই হোক, আন্টির সাথে ওনার অ্যাডজাস্টমেন্ট হয়নি, তাই বলে তুই মানুষটাকে ঘৃণা করবি? তুই তো ওনারও ছেলে বল? তাছাড়া তুই জানিস, ওনার তুইই একমাত্র সন্তান, ওনার আর কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। উনি আর রিতা আন্টির কোনো সন্তান নেই। জানিনা এটা ইচ্ছেকৃত কিনা।

নীল বলল, বাবা কোথায়?

শ্রীজা হাত দুটো ওপরে তুলে বলল, ওটাই তো ডিল হয়েছিল শ্বশুরজির সাথে।

তোকে দিয়ে আমার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করাবেন উনি যে কোনো ভাবে, আর আমি ওনার সাথে তোর কথা বলিয়ে দেব।

নীল বলল, তারমানে তোর এই ফালতু নাটকে বাবাও সামিল হয়েছে, তাই তো?

শ্রীজা বলল, দেখ, ভদ্রলোকের এক কথা, তুই আমায় ভালোবাসিস, আর বিয়ে করবি এটা বলে দিয়েছিস, ওই নার্সদিদি সাক্ষী আছে। শ্রীজার মুখে হাসি। নীল বিরক্ত মুখে বলল, সবেতে তোর নাটক! উফ!

ডাঃ নীলাভ ব্যানার্জীর অর্ধেক চুল পাকা। মুখে বয়েসের ছাপ পড়ছে। ধীরে ধীরে রুমে ঢুকে বললেন, নীল, মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে তোকে। আর যাকেই অবহেলা করিস, ভালোবাসাকে অবহেলা করিস না। সুমিত্রা কেমন আছে?

নীল ধীর গলায় বলল, তুমি কেমন আছো বাবা?

বাবা শব্দটা উচ্চারণের সময় ভারী হয়ে এল নীলের মতো কঠিন ছেলের গলাটা, আর স্বনামধন্য ডাক্তারের চোখে জল দেখল শ্রীজা। শ্রীজা বলল, আঙ্কেল আমার তো বাবা নেই, তাই আমাদের বিয়েতে কিন্তু আপনাকেই কন্যা সম্প্রদান করতে হবে। নীলাভ ব্যানার্জী শ্রীজার মাথায় হাত রেখে বললেন, কতদিন পরে শুনলাম বাবা ডাকটা।

সমাপ্ত