Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ
বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ
0/51
বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ

দেশ, জাত ও ধর্ম

মানুষের জীবনের প্রয়োজনেই ধর্মমতের সৃষ্টি। ধর্মের যূপকাষ্ঠে আত্মবলিদানের জন্যে জীবন নয়। কাজেই জীবনই মুখ্য। আর সব গৌণ। জীবন গড়ে ওঠে দেশে ও কালে। মানুষের জীবন স্বাতন্ত্রে উপভোগ সম্ভব নয়, তাই পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সংস্থা ও দেশকাল ভিত্তিক জাতীয়তা তার প্রয়োজন। মানুষের পক্ষে এ এমনি স্বাভাবিক যে এ নিয়ে বিচার-বিতর্কের অবকাশই নেই।

মুসলমানেরা যে-ধর্ম মানে তা আরবোদ্ভূত। সেখানকার লোক ইসলাম মানে, কিন্তু দেশের অমুসলিম ও মুসলিম কোনো ঐতিহ্যকেই অবহেলা করে না। ইরানেও ধর্মমত দৈশিক ঐতিহ্যবোধের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়নি। তুরস্ক-ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রেও দেখি লোকের ধর্মমতে ও ঐতিহ্যবোধে কোনো বিরোধ নেই। আমাদের দেশেই কেবল শাসন-শোষণের প্রয়োজনে কৃত্রিমতত্ত্বের অবতারণা করে দেশ, জাত ও ধর্মের দ্বান্দ্বিক ধারণা দানের অপচেষ্টা হচ্ছে।

আমরা একাধারে বাঙালি ও মুসলমান। আমাদের ধর্মীয় জীবন যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ব্যবহারিক জীবন। আমরা নামাজ পড়ব, মসজিদ গড়ব, আল্লাহকে ডাকব, যথাবিধি ধর্মীয় আচরণে নিষ্ঠ থাকব। আবার আমাদের ব্যবহারিক প্রয়োজনে আমরা বিদেশী পণ্য নেব, বিজাতির জ্ঞান নেব, যা-কিছু ভালো লাগে তা-ই বরণ করব, পরের বলে বর্জন করব না। জীবনকে উপভোগের ও কল্যাণের অনুগত করব। সুন্দরের ও কল্যাণের প্রসাদকে বিদেশী ও বিজাতির বলে এড়িয়ে চলব না–বঞ্চিত করব না নিজেদের।

মানুষের জীবন রূপ পায় মুখ্যত দেশ ও কালের প্রভাবে। ধর্মের প্রভাব খানিকটা কৃত্রিম। রাষ্ট্রিক জাতীয়তাবোধ তো কৃত্রিম বটেই। কেননা ওটি সচেতন অনুশীলন ও অনুধ্যানের অপেক্ষা রাখে। এজন্যে জাতীয়তার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। জাতীয়তা অভিন্ন স্বরূপে গড়েও ওঠেনি কোথাও। কারো জাতীয়তা রাষ্ট্রসীমাভিত্তিক, যেমন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে; কারো জাতীয়তা ধর্মভিত্তিক, যেমন ইসরাইলে; কারো জাতীয়তা গোত্রনির্ভর, যেমন আফগানিস্তানে; কারো জাতীয়তা রাজনৈতিক আদর্শকেন্দ্রী, যেমন সোভিয়েট ইউনিয়নে। আজকের দুনিয়ায় সাধারণভাবে রাষ্ট্রিক-সীমাভিত্তিক জাতি-চেতনাই প্রবল। এ ধরনের জাতীয়তাবোধে রাজনৈতিক চেতনা ও স্বার্থবুদ্ধিই বন্ধনসূত্র, ধর্মমতের অভিন্নতা, সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ ও অভিন্ন-ঐতিহ্য-চেতনা তাতে অনুপস্থিত।

এজন্যে রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ও জাতি-পরিচয় নেহাত কৃত্রিম। রাষ্ট্রসীমার সংকোচন ও প্রসারণের সাথে কিংবা রাষ্ট্র ভাঙা-গড়ার সঙ্গে এমনি জাতীয়তার ও জাতির জন্ম-মৃত্যু ঘটে। রোমক জাতির অস্তিত্ব এমনি করেই লোপ পায়।

অতএব, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে যে-জাতি-চেতনা জাগে, রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক অভিন্ন স্বার্থবোধই তার জনক। এইস্বার্থ সূত্রে আবদ্ধ জাতির জীবন টেকসই নয়। স্বার্থগত বিরোধে সে সূত্র ছিঁড়ে যায়, জাতীয়তাও যায় উবে, যেমন মিশর-সিরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রে।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের বাঞ্ছায় এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের উপায় হিসেবে ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানেরা মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ইসলাম ও মুসলিম-সংস্কৃতি-চেতনা এর গৌণফল, মুখ্য লক্ষ্য নয়। অতএব, পাকিস্তান মুসলমানের রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক স্বার্থচেতনা প্রসূত, ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি প্রীতিজাত নয়।

আত্মবিকাশের ও আত্মবিস্তারের সুযোগ মেলে বলেই স্বাধীনতা মানুষের কাম্য। যে নামসার স্বাধীনতা প্রবলপক্ষের কাছে আত্মবিক্রয়ে দুর্বলপক্ষকে বাধ্য করে, সে-স্বাধীনতা তো বর নয়– অভিশাপ।

আমরা জাতে বাঙালি। আত্মবিকাশের সুযোগ পাব বলেই আমরা পাকিস্তান গড়েছি– আত্মবিলোপের জন্যে নয়। আমরা বাঙালি থেকেই, বাঙালিত্ব রেখেই পাকিস্তানী। কেননা, বাঙালি হিসেবে বাঙলার আবহাওয়ায় বাঙালি জীবনের প্রসার লক্ষ্যেই পাকিস্তান চেয়েছি–ইসলামের সেবার মহৎ উদ্দেশ্যেও নয়, ইসলামী সংস্কৃতির হাওয়াই সৌধ নির্মাণের স্বপ্নেও নয়। আমাদের সত্তা নিয়ে, স্বাতন্ত্র নিয়ে, বৈশিষ্ট্য নিয়ে এবং বিকাশের পথ উন্মুক্ত ও প্রশস্ত রেখেই আমরা পাকিস্তানের নাগরিক। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হবে সমান ও অভিন্ন। আমাদের নাগরিকত্ব হবে সমঅধিকারের ভিত্তিতে সমপর্যায়ের ও সমমর্যাদার। যেখানে মিল নেই, সেখানে মিলন অসম্ভব। অসমানে একত্রিত হতে পারে, কিন্তু মিলতে পারে না। এখানে অভিভাবকত্ব অচল। আমরা স্বধর্মী নিয়েই সমাজ করি, আত্মীয় নিয়ে করি ঘর, তাই বলে স্বার্থ ছাড়িনে। স্বার্থ বজায় রেখেও সৌজন্য দেখানো সম্ভব কিংবা সদ্ভাব রেখেও স্বার্থসচেতন থাকা অসম্ভব নয়। স্বার্থে ও সৌজন্যে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলাই সুনাগরিকতা ও সংস্কৃতিপরায়ণতা।

আমাদের এবাদতে থাকবে ইসলামী বিধি, আমাদের মসজিদে থাকবে ইসলামী রীতি, আমাদের বোধে থাকবে ইসলামী নীতি, আমাদের রাজনীতিতে থাকবে পাকিস্তানী আদর্শ, আমাদের নাগরিক দায়িত্ব, জ্ঞান ও কর্তব্যবুদ্ধি চালিত হবে রাষ্ট্রের স্বার্থে–এ সব হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রিক ও বাহ্যিক জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্যবুদ্ধিপ্রসূত চর্যা। আর আমাদের অনুভবের যে জীবন–যেখানে আমরা স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও খেয়ালি তার রসদ যোগাবে আমার দৈশিক পরিবেশ, আমার দৈশিক ও জাতিক ঐতিহ্য এবং গ্রহণে-সৃজনে পাওয়া নতুন উপকরণ–ভাব, চিন্তা ও বস্তু।

কেউ তার স্বদেশের ঐতিহ্যকে অবহেলা করে না। কেননা ঐতিহ্যকে ভিত্তি করেই আত্মবিকাশ সহজে সম্ভব। তাই আমরাও স্বদেশের ঐতিহ্যকে পরিহার করব না। আমরা বাঙালি-চেতনা নিয়ে বিদেশী গুপ্ত-শাসনে গ্লানিবোধ করব, পাল-গৌরবে গর্বিত হব, স্বাধীন সুলতানী আমলের ঐশ্বর্য গর্বে উল্লসিত হব, মুঘল শাসনে হতবার বেদনাবোধ করব, ব্রিটিশ শাসনে অপমানের জ্বালা অনুভব করব।

আমরা বৌদ্ধযুগের মূর্তিশিল্পে পিতৃপুরুষের নৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করব, সেন আমলের সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদের নিন্দা করব, মসলিন শিল্পের গৌরব করব, মসজিদ শিল্পের প্রসারে উল্লাসবোধ করব, বাঙলা ঘরের আকর্ষণে আকুল হব। ধনপতি-চাঁদ সওদাগরে বাঙালির উদ্যম দেখে খুশি হব, সত্যপীর-বড়গাজীতে বাঙালির কল্যাণবুদ্ধির বিকাশ দেখে আশ্বস্ত হব। বাউল-দর্শনের গৌরব করব। আমরা রাষ্ট্রের সেবায় রত থাকব। পাকিস্তানের আপদে বিপদে জান-মাল কোরবান করব। আমরা কোরান-হাদিস জানব, ইসলামের ইতিহাস স্মরণ করব। সে-সঙ্গে চর্যাগীতির রহস্য উদঘাটন করব, বেহুলা-লখিন্দরের গল্প পড়ব, বৈষ্ণব পদাবলী আস্বাদন করব, বিদেশী তুর্কী-মুঘল শাসক বিদ্বেষী বঙ্কিম-সাহিত্যের রস-গ্রহণ করব, রবীন্দ্রসাহিত্য-সমুদ্রে অবগাহন করব। কেননা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তার চেয়ে দেশ, গোত্র ও ভাষাগত ঐক্যের বন্ধন যে অনেক দৃঢ় তার সাক্ষ্য রয়েছে ইতিহাসের সর্বত্র। সে-সত্য অবহেলা করা জীবনকে তথা কল্যাণকে অস্বীকার করারই নামান্তর। এ তত্ত্ব জানে বলেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা ময়েনজোদাড়ো-হরপ্পা ঐতিহ্যের সংরক্ষণ করে এবং হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী গান্ধার-এ নিজেদের খুঁজে পায়। আমরাও আমাদের পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকার ছাড়ব না। ভুলব না আমাদের রিকথ।

সাংস্কৃতিক শুচিতার কথামাত্রই অবান্তর। কেননা সংস্কৃতি বদ্ধকূপের জিয়েল মাছ নয়। সংস্কৃতি বহতা নদীর স্রোত। প্রতিদিনের সূর্যের সঙ্গে তাল ঠুকে চলার নামই সংস্কৃতিপরায়ণতা। তাই সংস্কৃতি কখনো অবিমিশ্র হতে পারে না, গ্রহণে-সৃজনেই তার স্থিতি ও বহমানতা। বিকাশমানতাই সংস্কৃতি। সুন্দর ও কল্যাণকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা, উদ্ভাবন করা, আবিষ্কার করা, জীবনে গ্রহণ করা ও ফুটিয়ে তোলাই সংস্কৃতি। যে সৃজন করতে পারে না, গ্রহণ করেই তাকে সংস্কৃতি চালু রাখতে হয়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে শুচিবাই সংস্কৃতিবিমুখতার অন্য নাম। সৌন্দর্যচেতনা, কল্যাণবুদ্ধি, সৃজনশীলতা অন্তত গ্রহণশীলতা সংস্কৃতিপরায়ণতার লক্ষণ। To know all is to pardon all- তত্ত্বে উত্তরণই সংস্কৃতিপরায়ণ লোকের চরম লক্ষ্য।

সুস্থ ও স্বস্থ জীবন ও মননের বৈশিষ্ট্যই এই। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিবিম্ব ধারণেই ঘট-জীবনের তুচ্ছতা এড়ানোর একমাত্র উপায়। নিজের সত্তার স্বাতন্ত্র রক্ষা করেও বসুধৈব কুটুম্বকম তত্ত্বের উপলব্ধি করাই মনুষ্যজীবনের লক্ষ্যহীনমন্যের আত্মসংকোচনে নয়। এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে। ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে। স্বাতন্ত্রের মধ্যে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যবোধ এভাবেই আসে। আত্মবিলোপে বিশ্ববোধ জন্মায় না, আত্মোপলব্ধিতেই চিত্তশুদ্ধি সম্ভব। কেননা আমি আছি বলে বিশ্ব আছে, অতএব নিজের সত্তার সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনই জীবনের লক্ষ্য। নইলে জীববোধে আসে বিকৃতি। জীবনের প্রসাদ থাকে অজ্ঞাত। তখন এক পাশব প্রাণের ভার বয়ে জীবন হয় অনর্থক অবসিত। যদি আমরা বুঝতাম যে–এ দেহ-প্রাণ এক মহৎ শিল্পের ইজেল, তা হলে।