Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ
বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ
0/51
বিচিত চিন্তা – আহমদ শরীফ

শাহাদাৎ-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য

সবদেশেই পাঠ্যপুস্তক অবলম্বন করেই বিদ্যার্জন শুরু হয়। কিন্তু কোনো কোনো দেশে এর বাইরের বিদ্যাও আয়ত্ত করবার সহজ সুযোগ ঘটে। বাঙলাদেশে আমরা যে-পরিবেশে লেখাপড়া করেছি বা এখনও পল্লী অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে যে-আবহাওয়া বিদ্যমান, তা পাঠ্যবইএর বাইরের বিদ্যার্জনের পক্ষে খুব অনুকূল নয়। কাজেই পাঠ্যবই-এ যাঁদের রচনা থাকে না, তাঁরা যতবড় প্রতিভাই হোন না কেন, নেহাত সাহিত্যানুরাগী ব্যতীত আর কারো কাছে তাদের লেখা দূরে থাক, নামও পৌঁছে না। এজন্যেই শক্তিমান কবি হওয়া সত্ত্বেও মোহিতলাল মজুমদার ও শাহাদাৎ হোসেন শিক্ষিত-সাধারণের কাছে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না।

স্কুলপাঠ্যবইএর উপযোগী কবিতার অভাবহেতু শাহাদাৎ হোসেন বা মোহিতলাল জনপ্রিয় বা প্রখ্যাত কবি হয়ে উঠতে পারেননি। অথচ রবীন্দ্র-যুগে যে-কয়জন বিশিষ্ট কবি বাঙলা কাব্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছেন, এঁরা তাঁদেরই সমস্থানীয়।

যখন স্কুলে পড়ি, তখন পাঠ্যপুস্তকে যাদের রচনা থাকত, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। তাদের এক-একজন মনশ্চক্ষে বিস্ময়কর ব্যক্তিরূপে প্রতিভাত হতেন। এখন বয়োধর্মে শ্রদ্ধাবিগলিত চিত্তের সে-উচ্ছ্বাস হ্রাস পেয়েছে অবশ্য, কিন্তু শ্রদ্ধা জাগরূকই রয়েছে। বাল্যে ও কৈশোরে যে কয়জন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের নাম ও লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, কবি শাহাদাৎ হোসেন তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ মৃদঙ্গ এবং উপন্যাস রিক্তার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। মৃদঙ্গের ভাষা বা বক্তব্য বুঝবার বিদ্যা বা বয়স আমার ছিল না। তবু কবির কাব্য! শ্রদ্ধা জাগাবার পক্ষে তা-ই যথেষ্ট ছিল। রিক্তা গদ্য-বই, উপন্যাস, সুতরাং ভালো তো বটেই!

নানা ব্যাপারে শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলালের মধ্যে মিল আছে, সেজন্যেই শাহাদাৎ হোসেন প্রসঙ্গে মোহিতলালের কথাও মনে জাগে। শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলাল ক্লাসিকধর্মী কবি। তবু তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং য়ুরোপীয় ভাবাদর্শের প্রভাব কম নয়। এতৎসত্ত্বেও তাদের কাব্যে যে-বস্তুটা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হচ্ছে কাব্যের আঙ্গিক বা কবিতার diction। শব্দ চয়নে আশ্চর্য নৈপুণ্য, ছন্দে গাম্ভীর্য ও লালিত্য, ভাবাদর্শের আভিজাত্য, প্রকাশভঙ্গির সৌষ্ঠব ও সংযম তাঁদের কাব্যকে শ্রীমণ্ডিত করেছে। তারা উভয়েই আদর্শবাদী ও শিল্পী। ব্যবহারিক জীবনের রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু-ব্যথা, অথবা নিজের বা মনুষ্য-সাধারণের প্রাত্যহিক জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভাব-অনটন, অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনী মোহিতলালের কাব্যে স্থান পায়নি। শাহাদাৎ হোসেনেও খুবই কম। তার কারণ, তাঁরা ছিলেন রোমান্টিক কবি বাস্তব বিমুখ, কল্পলোকবিহারী! তাঁদের কাব্য প্রেরণার উৎস এ জগৎ ও জীবন নয়! প্রত্যক্ষ বাস্তবজীবনের হাজারো দুঃখ-বেদনা-লাঞ্ছনা-হতাশা-গ্লানি ভুলে থাকবার তাগিদে তাঁরা মনোময় কল্পলোক রচনা করে তাতে নির্দ্বন্দ্বে ও নির্বিঘ্নে সানন্দে জীবন উপভোগ করেন–জীবনে; যে কল্পসাধ মিটানো যায়নি, সে সাধ মিটেছে গানে, জীবনে যা অসম্ভব, কল্পনায় ও স্বপ্নে তা-ই সম্ভব ও সার্থক হয়ে উঠেছে। সুতরাং কবি হিসেবে শাহাদাৎ হোসেন মুখ্যত বাস্তবমুখী নন–কল্পাশ্রয়ী। তাঁর সমধর্মী কবি মোহিতলাল বলেন :

জীবন যাহার অতি দুর্বহ, দীন দুর্বল সবি
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সেইজন বটে কবি।

কারণ—এতে

ঘুচে যাবে খেদ, যত ভেদ ভয়,
কায়া আর ছায়াবৃথা সংশয়।
স্বর্গ হইবে ধরা।

শাহাদাৎ হোসেনের হৃদয়েও অমৃতের তৃষ্ণা, তিনিও মর্ত্যের সৌন্দর্যে, ধরিত্রীর যৌবন-লাবণ্যে বিমুগ্ধ হয়ে নেমে আসেন দেবতাদের মতো মর্তবিহারে। ধরণীর আবিলতা ও গ্লানি তাঁকে স্পর্শ করবার পূর্বেই তিনি চলে যান কল্পলোকবাসে। ধুলার ধরায় তিনি অতিথি। ধরণীর বনকুঞ্জে তাঁর আনন্দ প্রবাস চলেছিল মাত্র। কারণ, শ্যামায়িত সৌন্দর্যের ফুল্ল শতদল কবির রূপ-সৌন্দর্য-পিপাসু হৃদয়কে যে আকুল করে তুলেছিল!

মানসের কল্পদলে চিত্রিত মায়ায়
অনন্ত বসন্ত জাগে সান্দ্র নিরালায়।

তাই প্রকৃতির শ্যামল মায়ার বশে কবি কল্পতুলিকায় রূপচ্ছবি আঁকছিলেন। এছাড়া বিমুগ্ধ কবির উপায় ছিল না। কারণ–

যত দেখি, বাড়ে সাধ কী অপূর্ব প্রাণরসে
হয়ে থাকি ভোর,
 অনুভূতি জেগে উঠে, শুষ্ক আঁখি ভিজে যায়,
গলে যায় হিয়া খানি মোর।

এজন্যেই বোধহয় প্রকৃতি (ঋতুপর্যায়) বিষয়ক কবিতায় শাহাদাৎ হোসেনের কবিপ্রাণ উচ্ছল হয়ে উঠেছে। আজকের দিনে পাঠকের স্ব-স্ব মত-পথ-আদর্শ ও রুচি অনুসারে এ-কাব্যাদর্শের বিচার হবে। আজ সে বিতর্কের সময় নয়। তবে এ-কথা স্বীকার্য যে, জীবনবোধ মানুষ অবিশেষে কোনোকালেই একরূপ ছিল না এবং হয়তো মানুষ কোনোকালেই একমত হবে না।

মধুসূদন-প্রবর্তিত উনিশ শতকের ক্লাসিক-ধারার অনুসারী ছিলেন শাহাদাৎ হোসেন ও মোহিতলাল। অর্থাৎ এরা মূলত রোমান্টিক কবি হয়েও বাহ্যত ক্লাসিকরীতির ধারক ছিলেন। তাঁদের উচ্ছ্বসিত কল্পনা, অনুভূতির তীব্র-গভীর আবেগ সংযমের আবরণে আত্মপ্রকাশ করেছে। ভাস্করের মূর্তির ন্যায় তাঁদের কবিতার বহিঃরূপই অধিকতর ভাস্বর হয়ে উঠেছে। এজন্যে তাদের কাব্যকলাকে ভাস্কর্য ও তাঁদের ভাস্কর বলা চলে। এক কথায়, তাঁদের কবিতা Romantic in spirit এবং Classical in form. Romantic ভাবকল্পনাকে সুসংযত কথার ছাদে ও সুনির্বাচিত শব্দের নিগড়ে বেঁধে ভাবগর্ভ ও বর্ণাঢ্য করে তোলার মধ্যে আশ্চর্য শক্তির পরিচয় রয়েছে।

বিশ শতকে মোহিতলাল ও শাহাদাৎ হোসেন এবং আরো দুচারজন কবি কাব্যক্ষেত্রে এ দুস্তর সাধনা ও কলাকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। ভাষার ওজস্বিতায় ও লালিত্যে, উপমার ঘটায়, অলঙ্কারের ছটায়, ছন্দের ঝঙ্কারে, শব্দের সুনিপুণ চয়নে এঁদের কবিতাগুলো রসজ্ঞ রসবেত্তার আদরণীয় হয়ে থাকবে।

কবি শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে আমার যখন চাক্ষুষ পরিচয় হয়, তখন লক্ষ্য করেছি তাঁর চলনে-বলনে-পোশাকে একটা আভিজাত্যবোধের ছাপ ছিল। আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রবল; স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল সজাগ। তাঁর মন-মননেও এ আভিজাত্য ও স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল স্পষ্ট। এক কথায় তাঁর জীবনে ও মননে Love for grandeur ছিল। নাটক ও অভিনয়ের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণের মূলেও ছিল এই grandeur প্রবণতা।

আশ্চর্য, কৈশোরে কবিতার ডালি নিয়েই তাঁর সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ, যৌবনে যাত্রা-থিয়েটারের আকর্ষণই ছিল বেশি, তবু তিনি কবিতা ও নাটক লিখেছেন কম, অথচ উপন্যাস লিখেছেন বহু এবং উপন্যাসে তিনি আদর্শে ও রূপায়ণে বঙ্কিমচন্দ্রকেই অনুসরণ করেছেন; যেমন নাটকে করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে আর কাব্যের ভাষার ক্ষেত্রে করেছেন ভুজঙ্গর রায় চৌধুরীকে।

আনন্দকামী শাহাদাৎ হোসেন ও দেহাত্মবাদী মোহিত মজুমদার রস-সর্বস্ব (Art for arts sake) আদর্শের কবি। এরূপ কল্পনাশ্রয়ীদের জীবন সংঘাতমুখী নয়–একেবারে নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন। কিন্তু তবু তাদের অনুভূতির সে-জগৎ প্রশস্ত নয়। তাই তাঁদের কাব্যজগতে জীবনলীলার বৈচিত্র্য বিরল। নানাভাবে, বহুবিচিত্র ধারায় জীবনকে উপলব্ধি করবার প্রয়াস সেখানে নেই। তাদের প্রাণও তেমন উচ্ছল নয়–এ জন্যে তাদের ভাবাবেগেও উদ্দামতা নেই। স্বল্প পরিসরে অবশ্য অনুভূতি তীক্ষ্ণ ও গভীর। এ-কারণেই তাদের কবিতার ভাব গুপ্ত ও মন্দ-প্রবাহিণী।

শাহাদাৎ হোসেনের কবিতায় কল্পনার প্রসার ও ভাবের আশানুরূপ গভীরতা না থাক, কিন্তু তিনি ভাষার জাদুকর, ছন্দযোজনায়ও নৈপুণ্য আছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বহিঃরূপ ও গঠনসৌন্দর্যই তাজমহলকে মনোহারী ও বিশ্ববিখ্যাত করেছে–এর প্রসার বা বিস্তার নয়। তাই এসবের আলোচনা অবান্তর। শাহাদাৎ হোসেনের কবিতাও ছন্দ এবং শব্দের মহিমায় মনোহারী, পড়বার সময় ভাব-সৌন্দর্য বিচার করবার অবকাশ হয় না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা যে-কারণে সুন্দর ও সুখপাঠ্য; শাহাদাৎ হোসেনের কবিতাও সে-কারণে প্রশংসনীয়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যদি ছান্দসিক কবি বলে কীর্তিত হন, তবে শাহাদাৎ হোসেনও রূপকার বা ভাস্কর কবি বলে মর্যাদা পাবেন। কবিও হয়তো এ-বিষয়ে সচেতন ছিলেন, তাই তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন রূপচ্ছন্দা।

কবি শাহাদাৎ হোসেন মুখ্যত রসলোক-বিহারী হলেও বাস্তব জীবনকে একেবারে উপেক্ষা করেননি। দেশ, জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অনুরাগও বহু কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। ইতিহাস-সচেতনতাও তাঁর তীক্ষ্ণ ছিল। আজাদী-প্রীতি এবং স্বদেশ-বাৎসল্যও তাঁর কম তীব্র ছিল না। তিনি যে বিশ্ব-মুসলিম জাতীয়তাবাদী (Pan-Islamist) ছিলেন, তা-ও তাঁর কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে।

মোহিতলাল ও শাহাদাৎ হোসেন উভয়েরই আত্মবিশ্বাস ছিল অকৃত্রিম ও দৃঢ় এবং এঁদের কেউ আত্মপ্রচারে বা আত্মপ্রসারে আগ্রহশীল ছিলেন না। তাই তারা জনপ্রিয় হননি সত্যি, কিন্তু তারা যাদের কাছে যতটুকু সমাদর বা কদর পেয়েছেন, তাতে খাদ নেই, তা একান্তই খাঁটি। তাদের শক্তি ও প্রতিভার যে-স্বীকৃতি পাওয়া গেছে–তাপ্রচারে আদায় করা নয়; তা রসগ্রাহী চিত্তের। স্বেচ্ছানিবেদিত অভিব্যক্তিমাত্র। তাই Tennyson-এর কথায় উভয়েই বলতে পারেন–We shall dine late, but the dining room will be well-lighted, the guests few and select.