Accessibility Tools

বিষের বাঁশি – কাজী নজরুল ইসলাম

কৈফিয়ত (বিষের বাঁশি)

কৈফিয়ত (বিষের বাঁশি)

‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম দিয়ে তাতে যেসব কবিতা ও গান দেব বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেইসব কবিতা ও গান দিয়ে এই ‘বিষের বাঁশি’ প্রকাশ করলাম। নানা কারণে ‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম বদলে ‘বিষের বাঁশি’ নামকরণ করলাম। বিশেষ কারণে কয়েকটি কবিতা ও গান বাদ দিতে বাধ্য হলাম। কারণ ‘আইন’-রূপ ‘আয়ান ঘোষ’ যতক্ষণ তার বাঁশ উঁচিয়ে আছে, ততক্ষণ বাঁশিতে তথাকথিত ‘বিদ্রোহ’-রাধার নাম না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই ঘোষের পো-র বাঁশ বাঁশির চেয়ে অনেক শক্ত। বাঁশে ও বাঁশিতে বাঁশাবাঁশি লাগলে বাঁশিরই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা, বাঁশি হচ্ছে সুরের, আর বাঁশ হচ্ছে অসুরের।

এই বাঁশি তৈরির জন্য আমার অনেক বন্ধু নিঃস্বার্থভাবে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁরা সাহায্য না করলে এ বাঁশির গান আমার মনের বেণুবনেই গুমরে মরত। এঁরা সকলেই নিঃস্বার্থ নিষ্কলুষ প্রাণ-সুন্দর আনন্দ-পুরুষ। আমার নিখরচা কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ পাওয়ার লোভে এঁরা সাহায্য করেননি। এঁরা সকলেই জানেন, ওসব বিষয়ে আমি একেবারে অমানুষ বা পাষাণ। এঁরা যা করেছেন তা স্রেফ আনন্দের প্রেরণায় ও আমায় ভালোবেসে। সুতরাং আমি ভিক্ষাপ্রাপ্ত ভিক্ষুকের মতো তাঁদের কাছে চিরচলিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁদের আনন্দকে খর্ব ও ভালোবাসাকে অস্বীকার করব না। এঁরা যদি সাহায্য হিসাবে আমায় সাহায্য করতে আসতেন তাহলে আমি এঁদের কারুর সাহায্য নিতাম না। যাঁরা সাহায্য করে মনে মনে প্রতিদানের দাবি পোষণ করে আমায় দায়ী করে রাখেন, তাঁদের সাহায্য নিয়ে আমি নিজেকে অবমানিত করতে নারাজ। এতটুকু শ্রদ্ধা আমার নিজের উপর আছে। স্রেফ তাঁদের নাম ও কে কোন মালমশলা জুগিয়েছেন তাই জানাচ্ছি – নিজেকে হালকা করার আত্মপ্রসাদের লোভে।

এ ‘বিষের বাঁশি’র বিষ জুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশমাতা, আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।

বাঁশ জুগিয়েছেন সুলেখক ঔপন্যাসিক বন্ধু সনৎকুমার সেন। এ-বাঁশকে বাঁশি করে তুলেছেন – ‘বাণী’ যন্ত্র দিয়ে ওই যন্ত্রাধিকারী বিখ্যাত স্বদেশ-সেবক আমার অগ্রজ-প্রতিম পরম শ্রদ্ধাস্পদ ললিতদা ও পাঁচুদা। তাঁদের যন্ত্রের সাহায্য না পেলে এ-বাঁশি শুধু বাঁশই রয়ে যেত। এই বাঁশি গায়ের অদ্ভুত বিচিত্র নকশাটি কেটে দিয়েছেন প্রথিত-যশা কবি-শিল্পী – আমার ঝড়ের রাতের বন্ধু – ‘কল্লোল’-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। এই সবের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছিলেন দেশের-কাজে-উৎসর্গ-প্রাণ আমার পরম শ্রদ্ধার বন্ধু মৌলবি মঈনউদ্দিন হোসেন সাহেব বি. এ. (নূর লাইব্রেরি)। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ডি. এম. লাইব্রেরির গোপালদা এই গান শোনাবার জন্য ঢোল শোহরৎ দেওয়ার ভার নিয়েছেন।

এত বন্ধুর এত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক দোষত্রুটি রয়ে গেল আমার অবকাশ-হীনতা ও অভিমন্যুর মতো সপ্তরথী-পরিবেষ্টিত ক্ষতবিক্ষত অবস্থার জন্য। যাঁরা আমায় জানেন, তাঁরা জানেন, আমার বিনা কাজের হট্টমন্দিরে অবকাশের কীরকম অভাব এবং জীবনের কতখানি শক্তি ব্যয় করতে হয় দশ দিকের দশ আক্রমণ ব্যর্থ করবার জন্য। যদি অবকাশ ও শান্তি পাই, তাহলে দ্বিতীয় সংস্করণে এর দোষত্রুটি নিরাকরণের চেষ্টা করব। ইতি –

নজরুল ইসলাম
হুগলি
১৬ শ্রাবণ, ১৩৩১