Accessibility Tools

রাজকন্যের সন্ধানে – অভীক দত্ত

রাজকন্যের সন্ধানে – ১০

১০

গিলগিটে পাকিস্তান আর্মি বেসক্যাম্পে পার্টি হচ্ছে। আসন্ন শাহী বিয়ের পার্টি।

ইয়াসির হুসেনকে ঘিরে ধরে আছে সেনাবাহিনীর অফিসার মহল।

হুইস্কির গ্লাস হাতে কর্নেল শাহরিয়ার খান বলল, “ইয়ে শাম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াসির হুসেইন কে নাম। ইয়াসির আমার জুনিয়র, আমরা একসঙ্গে কাশ্মীর বর্ডারে ডিউটি করেছি। এখন পাকিস্তানকে গোটা ওয়ার্ল্ড ওয়াহ ওয়াহ করবে ইয়াসিরের জন্য। দিস ইজ দ্য ম্যারেইজ অফ দিস ডিকেড। অবশ্য আমার বিয়ে না হয়ে গেলে আমিই বিয়েটা করতাম”।

বলেই হো হো করে হেসে উঠল শাহরিয়র খান।

একজন মেজর কর্নেল শাহরিয়রকে বলল, “জনাব, আমি শুনেছি দুজন হিন্দুস্তানী স্পাইকে আপনি আর হুসেন স্যার ধরেছিলেন। সেই কাহিনীটা একবার শোনাবেন প্লিজ?”

শাহরিয়র তার গোঁফে তা দিয়ে বলল, “মনে আছে ইয়াসির? আহা, আমার তো প্রতিটা মিনিট মনে আছে”।

ইয়াসির বলল, “মনে আমারও আছে জনাব। তবে আপনিই বলুন। আপনার মুখ দিয়ে শুনতে ভাল লাগে। বিশেষ করে শেষটা”।

যে মেজর শাহরিয়রকে প্রশ্ন করেছিল, সে জিজ্ঞেস করল, “শেষটা মানে?”

শাহরিয়র হেসে বলল, “দাঁড়াও। ধৈর্য ধর। পুরোটা বলি। আমি আর ইয়াসির জিপ নিয়ে বেরিয়েছি। সঙ্গে দুজন সুবেদার। রহমান ছিল না ইয়াসির তখন?”

ইয়াসির হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

শাহরিয়র বলল, “তখন উপত্যকার বরফ গলছে। মে মাস। পাকিস্তান আর ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার নাকি শান্তি চুক্তি করবে। এদিকে প্রায়দিনই বর্ডারে গুলি চলছে। এসব তো চলতেই থাকে। আমরা খুব ভাল করে জানি। লাইন অফ কন্ট্রোলে যারা ডিউটি করে, তাদের জানতেই হয়।

বরফ ঢাকা পাহাড় সবুজ হতে শুরু করেছে। পাইন গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে। ওয়াসির গ্রাম এল ও সির কাছেই পড়ে। টহল চলাকালীন ওই গ্রামে আমরা পানি খেতে যেতাম। তার পরের দিন আমার লাহোর ফেরার কথা। খোশ মেজাজেই ছিলাম। গ্রামে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। গ্রামের এক বাড়ির সামনে আমরা দাঁড়িয়ে পানির বোতল নিয়েছি, এমন সময় হঠাৎ মনে হল একটা বাড়ির জানলা দিয়ে কে উঁকি মারছে। ইয়াসিরকে বললাম। যে বাড়ির সামনে পানি খাচ্ছিলাম, সে বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, বুড়ো বলল ওই বাড়ি ফাঁকা। কেউ নেই, ওরা অনেক দিন আগেই পালিয়েছে”।

শাহরিয়র গোঁফে তা দিয়ে বলল, “কেউ মিথ্যে কথা বলে পার পাবে, তাও আবার আমারই কাছে, তা কি সম্ভব? বুড়োর তোতলামো দেখেই আমি বুঝেছি ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। বুড়োকে বললাম চল দেখি। তুমি চল, গিয়ে দেখাও ও বাড়িতে কেউ নেই। বুড়োর তখন কলজে হাতে চলে এসেছে। হাত জোড় করে সে কী কান্না! আমি আর ইয়াসির সরাসরি ওই বাড়িটায় হানা দিলাম। দরজা খোলাই ছিল। দেখি দুটো কাশ্মীরি মেঝেতে বসে থরথর করে কাঁপছে। আমরা দুজনেই রিভলভার তাক করলাম ওদের দেখে। ওরা আমাদের পা ধরে কাঁদতে শুরু করল। বলল এল ও সির ওপার থেকে ভুল করে চলে এসেছে। ভাবো জাস্ট, ওরা নাকি ভুল করে চলে এসেছে। ইয়াসির জিজ্ঞেস করল কী করছিলি তোরা? একজন বলল, ভেড়া চড়াতে বেরিয়েছিল নাকি”।

মেজর বলল, “সত্যিও তো বলতে পারে জনাব?”

শাহরিয়রের বেশ নেশা হয়েছিল। মেজরের দিকে তাকিয়ে বলল, “দুশমন টেরিটরিতে ভুল করে চলে এসেছে। সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? ইন্ডিয়ান সোলজাররা করে? বিশ্বাস করে?” চিৎকার দিয়ে উঠল শাহরিয়র। চেয়ার থেকে উঠে বসে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে শুরু করল সে।

মেজর চুপ করে গিয়ে মাথা নিচু করল।

শাহরিয়র গ্লাসে আরো হুইস্কি নিয়ে বলল, “দুটোকে ওই বাড়ি থেকে বের করা হল। জেনানা, বাচ্চা মিলিয়ে খান সত্তর জন ছিল। সব কটাকে মাঠে নিয়ে যাওয়া হল। ওই দুটো স্পাইকে মাঠের মাঝখানে বসিয়ে সবাইকে দিয়ে ইট মারা হল। ইটের ঘা খেয়ে খেয়ে যখন নেতিয়ে পড়ল, তখন…”

শাহরিয়র চুপ করল।

ইয়াসির জোরে হেসে উঠে বলল, “জিপে কুরবানী দেওয়ার অস্ত্র ছিল। একটার গলা আমি, আরেকটার গলা জনাব শাহরিয়র গোটা গ্রামের সামনে কাটলেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এদের আশ্রয় দেওয়ারও সাহস না দেখাতে পারে। পরের দিন সকালবেলা ইন্ডিয়ান আর্মি টহল দিতে বেরিয়ে সেই দুটো স্পাইয়ের মুণ্ডু পেয়েছিল, সুন্দর করে পার্সেল করে ওপাশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম”।

১১

“আমরা যে কোথায় যেতে চাই, আর কোথায় গিয়ে পৌঁছোই, তা আমরা কেউ জানি না। আমাদের রাস্তা কখন শুরু হয়েছিল, আর কখন শেষ হবে, আমরা কেউ জানি না। তাই তো? আপনি কোয়েটায় উঠেছেন, আমি দেখেছি। তখন একবারে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। মেয়ের কাছে গেছিলাম পেশোয়ারে। মেয়ে বড় আদর করে। কিন্তু কতদিন থাকব বলুন? সেই ফিরতেই হল?”

জাফর এক্সপ্রেস রাওয়ালপিন্ডি স্টেশন ঢুকবে খানিকক্ষণ পরে। তার পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ সারা রাস্তা চুপ করে থেকে হঠাৎ যেন নড়ে চড়ে উঠলেন। কোয়েটা থেকে মারাত্মক ভিড় ছিল। কোনমতে প্যাসেঞ্জার কামরায় বসার জায়গা ম্যানেজ করতে পেরেছিল। পাঠানদের চেহারা ভারি লম্বা চওড়া। একটা সময় কারো একটা কোলেও বসতে হয়েছে। সৈকত অত ভাবে না। পথে বেশি ভাবলে চলে না। তাছাড়া পাকিস্তানে সাধারণ মানুষ এভাবেই যাতায়াত করে। প্রথম যেবার সে পাকিস্তানে এসেছিল, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বেশ অসুবিধা হত। পরে সয়ে যায়। সাধারণ মানুষ সব দেশেই এক রকম। একইভাবে খেটে খুটে জীবিকা নির্বাহ কখনো হয়, কখনো হয় না। এর মধ্যেই আনন্দ আসে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে গেলে। মানুষ উত্তেজিত হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে একটুও দুঃখিত হয় না, বরং আনন্দে থাকে, এই বারে বোধ হয় প্রতিবেশী দেশকে শায়েস্তা করা যাবে। একঘেয়ে, হতাশাগ্রস্থ জীবনকে যুদ্ধ ছাড়া আর কোন কিছু আনন্দ দিতে পারে না। ক্রিকেট ম্যাচে জয়ও না।

সৈকত বলল, “আমি ইসলামাবাদ যাচ্ছি। কোয়েটায় ব্যবসার কাজ ছিল”।

বৃদ্ধ বললেন, “বাহ, বাহ, ব্যবসা? খুব ভাল। বিয়ে করেছেন?”

সৈকত বলল, “নাহ”।

বৃদ্ধ বললেন, “বাবা মা কী করেন?”

সৈকত বলল, “বাবা আর্মিতে ছিলেন। বর্ডারে শহীদ হন”।

বৃদ্ধ বললেন, “আহা। তাহলে তো খুব ভাল ফ্যামিলির ছেলে তুমি। আমার ছোট মেয়েকে বিয়ে করবে? মাশাল্লাহ খুব সুন্দরী। এই দেখো ছবি”।

সৈকতকে নড়ার অবকাশ না দিয়ে আপনি থেকে তুমিতে নেমে গিয়ে ছবি বের করল বুড়ো পকেট থেকে। মেয়েটার বয়েস আঠেরোও হয় নি। সৈকত বলল, “এ তো বাচ্চা মেয়ে! তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবেন?”

বৃদ্ধ বললেন, “তুমি কি আমেরিকায় থাকো হে ছোকরা? এ দেশে কি বুড়ি হলে মেয়ে বিয়ে দেব? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? বিয়ে করবে কী না বল?”

সৈকত উত্তর না দিয়ে হেসে ফেলল। বৃদ্ধ রেগে গিয়ে গজগজ করতে লাগলেন। দেশের নওজোয়ানরা ফাজিল হয়ে যাচ্ছে, বয়স্কদের সম্মান করা ভুলে গেছে, এদের সবাইকে বর্ডারে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য, তাতে যদি দেশের কিছু ভাল হয়, ইত্যাদি বলতে শুরু করলেন।

ট্রেন রাওয়ালপিন্ডি স্টেশন ঢুকছে দেখে সৈকত আর দাঁড়াল না। দরজার কাছে চলে গেল।

স্টেশনে থামতেই সে নেমে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে দৌড় লাগাল। ইসলামাবাদ সেক্টর সেভেন যেতে দু ঘন্টা লাগার কথা। শেয়ার ট্যাক্সি পেল। চারজন উঠল একটা সেডানে। সে ড্রাইভারের পাশে বসার জায়গা পেল। গাড়ির পিছনে তিনজন যুবক হৈ হৈ করতে করতে উঠল। তিনজনেই লন্ডন যাচ্ছে পড়তে। দেশে ফেরার ইচ্ছে নেই কারো।

ড্রাইভার বলল, “আমারও আর এদেশে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমাকেও নিয়ে যাও তোমরা”।

ছেলেগুলো খুব হাসছে।

সৈকত দেখেছে, এই পাকিস্তানের ভেতরে আরেকটা পাকিস্তান আছে। সুশিক্ষিত, আদব কায়দা জানা, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষিত উচ্চ বর্ণের প্রতিনিধি এরা। দিন দিন দেশ ছাড়ার প্রতিযোগিতা বাড়ছে এদের মধ্যে। দেশের অর্থনীতি ঝুঁকে পড়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক স্তরে জেদ বজায় রাখতে জোর করে কাশ্মীরি সমস্যা টিকিয়ে রাখা, অন্যদিকে বালোচ কিংবা গিলগিটে নিজেদের মধ্যে রেষারেষিতে রত এক দেশ। সামরিক বাহিনীর উপর প্রবল পরিমাণে নির্ভরশীল এরা। দেশের সরকার যে কোন সময় টলিয়ে দিতে পারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। একদিকে ভারতের সঙ্গে ঝামেলা, অন্যদিকে তালিবান এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর ভার বহন করার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা, বিশ্বব্যাঙ্কের ধারের টাকায় তৈরী ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট দেখলে কে বলবে দেশটার এত খারাপ অবস্থা?

সেক্টর সেভেন পৌঁছতে রাত হয়ে গেল।

একটা দোতলা বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল জাভিদ। নেমপ্লেটে ইলিয়াস খান লেখা।

কলিং বেল টিপল।

ছোটখাটো চেহারার একজন মানুষ তাকে দেখে বলল, “খুব কষ্ট হল, তাই না? জার্নি আর জার্নি?”

সৈকত হাসল, “তা হল”।

লোকটা বলল, “ঘরে এসো”।

সৈকত বাড়িটায় ঢুকল। সুসজ্জিত এক উচ্চবিত্তের ড্রইং রুম। সৈকত বলল, “আপনিই ইলিয়াস খান?”

লোকটা ঘাড় নাড়ল। বলল, “খেয়ে দেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে রাতটা কাটাও। যে রাস্তায় এসেছো, সে রাস্তায় কাল সকালে ফিরে যাও। চিফ জানিয়েছেন মিশন ক্যান্সেল। যে মেয়েকে উদ্ধার করতে এসেছো, সে বিষ খেয়ে সুইসাইড করেছে”।

সৈকত হাঁ করে ইলিয়াস খানের দিকে তাকিয়ে রইল।

১২

ইলিয়াস খানের বাড়ি বেশ বড়। আসবাবপত্রও দামী।

সৈকত হাঁ করে দেখতে লাগল।

ইলিয়াস বলল, “কী দেখছো?”

সৈকত বলল, “এগুলো সবই কি কাকলি ফার্নিচার?”

ইলিয়াস অবাক গলায় বলল, “মানে?”

সৈকত হেসে ফেলল, “ও জানেন না? এটা লেটেস্ট ট্রেন্ড। দামে কম, মানে ভাল”।

ইলিয়াস হাসল না। তাচ্ছিল্যের মুখে বলল, “কান্দাহার থেকে আনানো, এগুলো পাথরের টেবিল। একেকটার দাম কত জানো? তোমাদের ইন্ডিয়ার লোকেরা অ্যাফর্ড করতে পারবে না”।

সৈকত বলল, “যাব্বাবা, আমাদের ইন্ডিয়া মানে? আপনি ইন্ডিয়ার লোক না?”

ইলিয়াস বলল, “কোন দুঃখে আমি ইন্ডিয়ার লোক হতে যাব? আমার চোদ্দপুরুষ পাকিস্তানী। অবশ্য তারা গিলগিটের লোক”।

সৈকত বলল, “ওহ, আপনি শিয়া মুসলমান। তাই তো?”

ইলিয়াস বলল, “অত জেনে কাজ নেই তোমার। কাবাব বানিয়েছি তুমি আসবে বলে, খেয়ে উদ্ধার কর”।

সৈকত বলল, “আমি জানতাম এখান থেকে সিকিওর লাইনে কথা বলা যাবে”।

ইলিয়াস বলল, “যাবে তো। চল খেয়ে নিই”।

ইলিয়াস খেতে দিল। গাদা গাদা কাবাব। আর কিচ্ছু নেই।

সৈকত বলল, “শুধু কাবাব?”

ইলিয়াস বলল, “আজ ইচ্ছে হল না, তাই বানাইনি অন্য কিছু”।

কাবাব অবশ্য অত্যন্ত সুস্বাদু। মুখে দিতেই গলে যাচ্ছে। সৈকত তৃপ্তির মুখ করে বলল, “আহা, জীবনের সেরা কাবাব খেলাম আজ”।

ইলিয়াস বলল, “সেটাই আমার কাজ। ভাল তো হবেই। র্যাডিসনের শেফ আমি। তুমি থাকলে এক মাসে চেহারা ফিরিয়ে দিতাম। এই সিড়িঙ্গে রোগা চেহারা নিয়ে কী করে যে এত জার্নি কর, কে জানে”!

সৈকত বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছিল। আপনি বড় কোন জায়গার শেফ”।

টেবিলের ওপর রাখা ইলিয়াসের ফোন বাজতে শুরু করল। ইলিয়াস বলল, “ধর। তোমার ফোন”।

সৈকত ফোনটা রিসিভ করল, “হ্যালো”।

“পৌছেছো?” গলাটা চিনতে পারল না সে।

সৈকত বলল, “হ্যাঁ”।

“ঠিক আছে। লাহোরে খুব ভাল ফিরনি তৈরী হচ্ছে আজকাল। খেয়ে যেও”।

সৈকত বলল, “ঠিক আছে”।

ফোন কেটে গেল।

খাওয়া হয়ে গেলে মুখ ধুল সৈকত। ইলিয়াস নিজেই বাসন ধুতে শুরু করল। বলল, “টিভি দেখলে দেখতে পারো”।

সৈকত টিভি চালাল। অন্যমনস্ক হয়ে চ্যানেল পাল্টাতে শুরু করল।

ইলিয়াস বাসন ধুয়ে এসে আর পাশে বসে বলল, “তুমি একবারও জিজ্ঞেস করলে না গিলগিটে কী হয়েছে, কেন মেয়েটা সুইসাইড করেছে?”

সৈকত চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বলল, “আমার কৌতূহল কম”।

ইলিয়াস বলল, “আমি আজকাল গিলগিটে যেতে হলে নিজের গাড়িতেই যাই। আহা, কী জায়গা!”

সৈকত বলল, “আমি গিলগিটে গেছি তো। খুব সুন্দর জায়গা”।

ইলিয়াস বিদ্রুপের সুরে বলল, “ওহ, গেছো?”

সৈকত বলল, “হু”।

টিভিতে গিলগিটে পাক আর্মির লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইলিয়াস হুসেনের বিয়ে নিয়ে স্পেশাল খবর দেখাচ্ছে। কারা কারা আসছে, এর ফলে পাকিস্তানের কী কী লাভ হতে পারে, সব কিছু দেখাচ্ছে।

সৈকত বলল, “পাকিস্তানী মিডিয়া কতটা পিছিয়ে আছি ভাবছি। কনে মারা গেছে, অথচ বিয়ে নিয়ে খবর দেখানোর বিরাম নেই”।

ইলিয়াস রিমোটটা সৈকতের হাত থেকে নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিয়ে বলল, “অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়”।

সৈকত বলল, “ঘর দেখান”।

ইলিয়াস বলল, “যেখানে খাট পাবে, ঘুমিয়ে পড়”।

সৈকত উঠল। ইলিয়াস আবার টিভি চালিয়ে খেলার চ্যানেল দিল।

সৈকত একটা ঘরে ঢুকল।

সুসজ্জিত খাট। সে পথশ্রমে ক্লান্ত ছিল।

ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। সে যে ঘরে ঘুমাচ্ছিল, সে ঘরের মিউজিক সিস্টেম তীব্র শব্দে বাজতে শুরু করায় ঘুম ভেঙে উঠে বসল সৈকত।

সে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল ড্রইং রুমে ইলিয়াসের সঙ্গে তিন জন লোক বসে টিভি দেখছে। তিন জনের মধ্যে একজনকে দেখে ষাটোর্ধ মনে হল। বাকিরা যুবক।

ইলিয়াস তাকে দেখে বলল, “ঘুম হয়ে গেল? এসো”।

সৈকত ড্রইং রুমে ঢুকে সোফায় বসে বলল, “এভাবে ঘুম ভাঙানো কোন দেশী সভ্যতা?”

ইলিয়াস যে সোফায় বসে ছিল, সেটা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোফার গদি সরিয়ে একটা বাক্স বের করল। তাদের সামনে মেঝেতে বাক্সটা খুলে দিয়ে বলল, “আমি সিকিওর লাইনে চিফের সঙ্গে কানেক্ট করছি। সৈকত, ইন্সট্রাকশন শুনে নাও”।

সৈকত একটা হাই তুলে বলল, “জানতাম”।

১৩

ড্যানিয়েল বলল, “আমার এই চাকরিটা এত ভাল লাগে কেন জানো? শুধু এভাবে দেশ ঘুরতে পারি বলে। তুমি সুইজারল্যান্ড গেছো, ভিয়েনা গেছো, কিন্তু এই কারাকোরাম রেঞ্জ ভিউ ইজ দ্য বেস্ট ভিউ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ভয়ংকর সুন্দর বোধ হয় একেই বলে। হিমালয়, হিন্দুকুশ, কারাকোরাম-ওয়াও! আই মিন সিরিয়াসলি, ওয়ার্ল্ডের ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত গিলগিট বাল্টিস্তান”।

রাত এগারোটা। রাওয়ালপিন্ডি, হোটেল র্যাডিসন।

ড্যানিয়েল আর এনা বাজার ঘুরতে বেরিয়েছিল। ডিনার করতে অনেক রাত হয়ে গেল। গিলগিটে যাবে তারা। সি এন এন থেকে এসেছে। নিরাপত্তা রক্ষীরা সারাক্ষণ তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে।

এনা বলল, “সবই ঠিক আছে, তবে পাকিস্তান আমার অতোটা নিরাপদ মনে হয় না। ইন্ডিয়া ইজ গুড, যদিও সেখানেও কয়েকটা শহরে নিরাপত্তার সমস্যা আছে, নাম্বার অফ রেপ ইজ রাইজিং ফ্যাক্টর দেয়ার, তবু, ইসলামিক এক্সট্রিমিস্টরা পৃথিবীর শান্তির জন্য সব থেকে বড় থ্রেট”।

ড্যানিয়েল স্যুপ খেতে খেতে বলল, “আমাদের কিছুটা ইসলামোফোবিয়াও তার জন্য দায়ী”।

এনা বলল, “সেটা হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে আইসিস কিংবা এই টেরোরিস্ট অরগানাইজেশনগুলো যেভাবে বেড়েছে, তা ভয়ের”।

ড্যানিয়েল গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল।

পাঁচ তারা হোটেলের রেস্তোরাঁ এখন প্রায় ফাঁকা। দুজনে চুপ চাপ খাচ্ছিল। তাদের নিরাপত্তারক্ষীরা খানিকটা দূরে তাদের উপর নজর রাখছে।

ড্যানিয়েল বলল, “ভয়ের তো বটেই। তোমার ভয়টা আরেকটু বাড়িয়ে দি। বল তো হিন্দুকুশ শব্দকে এরা কী হিসেবে ব্যাখ্যা করে?”

এনা বলল, “কী হিসেবে?”

ড্যানিয়েল বলল, “কিলার অফ হিন্দুস, অর ইন্ডিয়ান্স। এখানের মাউন্টেনে যে কত রক্ত লেগে আছে, তার হিসেব রাখা সম্ভব না। যাই হোক, তুমি জানো তো, আমার নেক্সট মান্থেই সিরিয়ায় একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে”।

এনা চমকাল, “সেকী, তুমি আগে বল নি তো?”

ড্যানিয়েল বলল, “আমি জানতাম তুমি আগে থেকে জানো”।

এনা বলল, “না, জানি না”।

ড্যানিয়েলের খাওয়া হয়ে গেছিল। বলল, “তুমি সিরিয়া যেতে চাও না আশা করি”।

এনা মাথা নাড়ল, “একেবারেই না”।

ড্যানিয়েল হাসল, “গুড। কাল ভোরে ফ্লাইট। উঠে যেও”।

এনা ঘাড় নাড়ল, “অ্যালার্ম কাজ করলেই হল। এখন মনে হচ্ছে ইসলামাবাদে থাকলেই হত। সেই তো ভোরে অতটা যেতে হবে”।

ড্যানিয়েল বলল, “আমার ইসলামাবাদকে অনেক বেশি মেকানিকাল মনে হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে আলাদা লাইফ আছে। এক্সাইটমেন্ট আছে”।

এনা বলল, “তোমার পাল্লায় পড়লে আর দেখতে হবে না। এক্সাইটমেন্টেই পাগল হয়ে যাব”।

ড্যানিয়েল বলল, “একটা ওয়াক হয়ে যাক আফটার ডিনার? ভাল লাগবে”।

এনা বলল, “আবার?”

ড্যানিয়েল বলল, “ঘুম ভাল হবে”।

এনা বলল, “নাহ। আমি যাব না। তুমি যাও”।

ড্যানিয়েল বলল, “গুড নাইট দেন। কাল দেখা হচ্ছে”।

এনা বলল, “গুড নাইট”।

ড্যানিয়েল বেরোতে গেলে নিরাপত্তারক্ষীরা আটকাল। এনা দেখল ড্যানিয়েল তাদের কাঁধে হাত দিয়ে কীসব বোঝাল।

দুজন নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়ে ড্যানিয়েল বেরিয়ে গেল।

এনা খেয়ে লিফটে উঠল। এইসব দেশে এলে অস্বস্তি হয়। লোকেরা কেমন করে তাকায়। তার অস্বস্তি হয় এখানকার মেয়েদের দেখলে। কী করে হিজাব পরিহিত হয়ে সারাদিন কাটায়, ভাবা যায় না।

তার ঘর এগারো তলায়। ঘরে ঢুকে গোছগাছ শুরু করল সে। ক্যামেরাটা দেখে নিল ঠিক আছে কিনা। ব্যাগে কিছু গোছগাছ ছিল, করে নিল।

চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকতে তার কানে গোলাগুলির শব্দ এল। হার্টবিট মিস হল তার। বাথরুম থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল রাস্তায় ফায়ারিং চলছে। কোনমতে শার্ট ট্রাউজার পরে লিফটে করে নিচে নামতে তাকে সিকিউরিটিরা আটকে দিল। এনা থরথর করে কাঁপছিল, বলল, “কী হয়েছে”?

হোটেলের রিসেপশনিস্টরা তাকে লবিতে অপেক্ষা করতে বলল। এনার মাথা কাজ করছিল না। সে ফোন বের করে ড্যানিয়েলকে ফোন করল। ফোন বেজে গেল। ড্যানিয়েল ধরল না।

কিছুক্ষণ পর একজন রিসেপশনিস্ট এসে জানাল ড্যানিয়েলকে কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। ড্যানিয়েলের সঙ্গে যে নিরাপত্তারক্ষীরা ছিল, তাদের লাশ রাস্তায় পড়ে আছে।

১৪

সকাল সাতটা । ইসলামাবাদ পেরিয়ে কারাকোরাম হাইওয়ে ধরে একটা এস ইউ ভি রওনা দিয়েছে গিলগিটের উদ্দেশ্যে। গাড়ি চালাচ্ছে খালেদ রিজভি। খালেদের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে ইখতিয়ার গিলানী তার বয়স ষাট পেরিয়েছে। চুলে পাক ধরলেও চলা ফেরা দেখে বোঝা যায় শারীরিকভাবে কতটা সক্ষম সে। পিছনের সিটে সৈকত আর হামিদ।

সৈকত বাদে বাকি তিনজনই গিলগিটের বাসিন্দা, বর্তমানে ইসলামাবাদে থাকে। চিফ শুধু বলেছেন তাদের একটা টিম হিসেবে কাজ করতে হবে। ইলিয়াস তার বাড়িতেই থেকে কো অরডিনেটরের কাজ করবে। সেখান থেকেই সে সমস্ত নির্দেশ তাদের পাঠাবে।

কারাকোরাম হাইওয়ে ছাড়াও নারানের রাস্তা দিয়ে গিলগিটে যাওয়া সম্ভব। সমস্যা হল সে রাস্তার বরফ পুরোপুরি গলে নি। কারাকোরাম হাইওয়ের রাস্তা চওড়া এবং মসৃণ। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে খালেদ।

মনোরম আবহাওয়া। মারগালা হিলসের অপরূপ সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে তারা যাচ্ছে। সৈকত হাই তুলে বলল, “এত সুন্দর জায়গা দেখে কে বলবে মিয়াঁ কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে? দেখলে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর কোথাও কোন সমস্যা নেই, সবাই খুব আনন্দে আছে”।

হামিদ বলল, “আনন্দেই আছে বটে। লস্কর, হিজবুলের লোকেরা আমাদের বাড়ির ছোট ছোট ছেলেদের টেনে নিয়ে গিয়ে জিহাদের ক্লাস নেয়, সুইসাইড বোম্বার বানিয়ে মেরে ফেলে, শিয়াদের ওপর সমস্ত রকম দমন পীড়ন করে, আনন্দ তো বটেই। খুব আনন্দ”।

সৈকত বলল, “এই জন্য আমি নাস্তিক, আমাকে এই সব ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বোঝাতে পারবে না”।

হামিদ বলল, “নাস্তিকতাও একটা ধর্ম তো। সবাইকে তুচ্ছ করার ধর্ম। সেটা ধুয়ে কী লাভ?”

সৈকত মাথা নাড়ল, “ভুল বলছো। তুচ্ছ করছে না। বরং প্রশ্ন করছে। অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্ন করার সাহস দিচ্ছে। যে অন্ধবিশ্বাস মায়ের কোল থেকে শিশুকে টেনে নিয়ে গিয়ে তার শরীরে বোম বেঁধে ব্যবহার করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে, তাকে প্রশ্ন করছে”।

হামিদ তেড়েফুঁড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, ইফতিকার ঘাড় ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “নিজেদের মধ্যে কোন রকম তর্ক না করাই ভাল। এই সংক্রান্ত কোন বিষয়ে আমরা আর আলোচনা করব না হামিদ”।

হামিদ বলল, “জি জনাব”।

ইফতিকার বলল, “তার থেকে আপনি অন্য কথা শুনুন। হুনজা ভ্যালিতে চীনা ট্যুরিস্টের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে। যে চীন এই নাস্তিকতাকে এত প্রোমোট করে এসেছে এতদিন ধরে, তারা জানে পাকিস্তান কীভাবে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে, তার পরেও পাকিস্তানকে সব রকমভাবে সাহায্য করে চলেছে। আবার আমেরিকা ক্রিয়েটেড টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশনগুলোর নামও আশা করি খুব ভাল ভাবেই জানেন। শিক্ষিত দেশ, উন্নত দেশদের মদত ছাড়া এই অর্গানাইজেশনগুলো মাথা তুলতে পারতো কোন দিন?”

সৈকত বলল, “আপনারা গিলগিট বাল্টিস্তানের সমস্যা কোন দিন আমেরিকাকে বলেছেন?”

ইফতিকার বলল, “কীভাবে বলব? কে শুনবে আমাদের কথা? আমাদের কথা কেউ শুনবে না”।

সৈকত চুপ করে গেল।

ইফতিকার বলল, “আমাদের মিশনের ব্যাপারে আই এস আইএর কাছে কোন খবর নেই ইনশাল্লাহ। তবু কোন রকম ঝুঁকি নেওয়া যাবে না”।

কথা বলতে বলতে খালেদের ফোন বেজে উঠল। সে কিছুক্ষণ উত্তেজিত ভঙ্গীতে কথা বলে ফোন রাখল।

ইখতিকার বলল, “কী হয়েছে?”

খালেদ বলল, “রাওয়ালপিন্ডিতে কাল রাতে এক আমেরিকান জার্নালিস্টকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ঠিক সময়ে ইসলামাবাদ ছেড়েছি আমরা। ভোর থেকে ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির এক্সিট আটকে দিয়ে নাকা চেকিং চলছে”।

ইফতিকার বলল, “লস্করই করে থাকবে। আর কাজ কী ওদের?”

খালেদ বলল, “শাদি কভার করতে এসেছিল জার্নালিস্টরা। সব রকম ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াকে ডেকে পাঠিয়েছে পাকিস্তান বিদেশ মন্ত্রক”।

ইফতিকার বলল, “সে তো জানা কথা। এর মানে আমাদের কাজটা আরো কঠিন হয়ে গেল”।

সৈকত বলল, “সোজা ছিল বুঝি কাজটা? জানতাম না তো?”

হামিদ বলল, “হাই অ্যালার্টে চলে গেল আর্মি। লস্করের উপরেও চাপ আসবে। আমেরিকান মাথা খারাপ করে দেবে এখন পাকিস্তান সরকারের”।

খালেদ মোটরওয়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, “নাস্তা করে নিন। বেশি ভেবে লাভ নেই এখন”।

বড় একটা রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। সৈকত বলল, “আমি আর নামব না। একটা চা পাঠিয়ে দেওয়া যাবে”?

হামিদ বলল, “যাবে। বসে থাকুন। আপনার না নামাই ভাল এখন। কোন দরকার ছিল না আপনাকে এই মিশনে পাঠানোর। আমরাই করতে পারতাম। জানি না কেন আপনি এসেছেন”।

সৈকত হাসল, “আমিও জানি না”।

হামিদ কটমট করে সৈকতের দিকে তাকাল।