লুব্ধক – ৩
৩
‘বারবার থেমে, খুবই জঘন্য একটি গেরিলা পরিক্রমার পর, কাকভোরে আমরা একটা জঙ্গল পেলাম যার ধারেকাছেই কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিলো৷’
চে গুয়েভারা’র দিনলিপি, ৫ অক্টোবর, ১৯৬৭
কুকর খতম করার একাধিক পরিকল্পনা করার মধ্যে মধ্যে ছুটির দিন বা রবিবারের ফাঁক ছিল, যার মানে গাড়িঘোড়া কম৷ সে সময় কয়েকটি কুকুরকে খুবই ব্যস্তভাবে শহরের বিভিন্ন দিকে ধাবমান হতে দেখা যায়, যদিও সে গতি ঠিক স্বল্পপাল্লার দৌড়ের মতো ক্ষিপ্র ও ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং দূরপাল্লার দৌড়বীরদের পদ্ধতিতে, কখনও কমিয়ে, আবার বাড়িয়ে … এবং সে সময় সেই কুকুরদের মুখমণ্ডলের কোনো উত্ফুল্লতা, চড়া মেজাজ বা বিষাদের লেশমাত্র দেখা যায়নি৷ তারা মোটের ওপর রাজপথ, থানা, স্কুল, রাজনৈতিক দলের দপ্তর, ক্লাব ইত্যাদি এড়িয়ে গলিপথ, ফাঁকা উঠোন, বস্তির মধ্যের অপ্রশস্ত রাস্তা, গাড়ির তৈলাক্ত স্বেদে ভেজা কালো মাটির চত্বর, জবাই করা মুরগির পালক ও পেঁয়াজের খোসা ছড়ানো ছেটানো বাজারখোলা, হাসপাতালের পেছন দিকের নোংরা রাস্তা যেখানে কাটা প্লাস্টার, রক্তমাখা তুলো ও বিবর্ণ ব্যান্ডেজের মধ্যে শিশুদের খেলার শব্দ ও বৃদ্ধবৃদ্ধাদের অপেক্ষা মিশে থাকে-এইসব এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল৷ এই প্রত্যেকটা জায়গাতেই সেখানকার কুকুরেরা নিজস্ব অধিকার কায়েম করে বাস করে৷ তাদের সঙ্গে এই গতিয়ান কুকুর-দূতদের চোখাচোখি বা কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা বিনিময় হয় অথচ কোনো কলহ হয়নি৷ কুকুরদের ক্ষেত্রে এ রকম সচরাচর হয় না৷ কোনো কুকুর-দলই তাদের এলাকা বা অঘোষিত সীমানার মধ্যে চেনা বা অচেনা কুকুরদের আগমন মেনে নেয় না৷ কুকুরেরা জেনে গিয়েছিল যে কলকাতা আর তাদের চায় না৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -১
কালক্ষেপ করা ঠিক হবে না৷ কুকুরদের গুলি করে মেরে ফেলা হোক৷
বিরুদ্ধে মত
সম্ভব নয়৷ বুলেটের দাম আছে৷ দ্বিতীয়ত, বন্দুকের শব্দ পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর৷ তৃতীয়ত, এ ধরনের অভিযান রাতেই চালানো সম্ভব, কিন্তু বন্দুকধারীরা তখন মদ্যপ অবস্থায় থাকে, ফলে গুলি অন্য কোথাও লাগতে পারে৷ চতুর্থত, আমাদের কুসংস্কারময় দেশে এ কাজ করতে অনেক বন্দুকধারী রাজি নাও হতে পারে৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -২
রাতের প্রথম প্রহরে বিষ মেশানো মাংস ছড়িয়ে দেওয়া হোক৷ পরে, ভোররাতে মনুষ্যেতর প্রাণীদের মৃতদেহ বহনকারী গাড়ি পাঠিয়ে, লোকজন জেগে ওঠার আগেই, লাশগুলো তুলে নিয়ে গেলেই হবে৷ বিষ যারা বানায়, তারা বিনা দামেই বিষ সরবরাহ করে পরিকল্পনাটির পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে এবং একইভাবে বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও কসাইখানা থেকে বাসি টোকো মাংস যোগাড় করা যায়৷ পচা মাছ হলেও চলবে৷
বিরুব্ধে মত
প্রস্তাবটি ভালো কিন্তু এর প্রধান বিপদ হল, ওই বিষাক্ত মাংস যে শুধু কুকুররাই খাবে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না৷ উলটোপালটা কিছু ঘটে গেলে বিশ্বের সামনে কলকাতাকে হেয় হতে হবে এবং নিন্দুকেরা অনেক কিছু মুখোমুখি বা সোজাসাপটা বা কথায় কথায় বলার সুযোগ পেয়ে যাবে৷ আর একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ বিনা পয়সায় পাওয়া বিষ যদি ভেজাল হয়, তাহলে উদ্দেশ্য তো চরিতার্থ হবেই না, উপরন্তু কুকুরেরা বাড়তি শক্তি পেয়ে যাবে৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -৩
কুকুর মারার ব্যাপারে আমরা যদি কোনো দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করি তাহলে আমাদের সম্মানহানির প্রশ্ন বোধহয় ওঠে না৷ যে দেশটাকে সবাই বিশ্ব-ফুটবলের একনম্বর দেশ বলে জানে সেই ব্রেজিলের অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি পর্ব ব্রেজিলিয়ান মির্যাকল্’ (১৯৬৭-১৯৭৩) বলে পরিচিত৷ ওই সময় ব্রেজিলের বড়ো বড়ো গয়নার দোকানের মালিকেরা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোকদের দিয়ে একটি দল বানিয়েছিল, যাদের কাজ ছিল রাতের রাস্তায় ঘুমন্ত ভিখারি শিশু ও বালক-বালিকাদের গুলি করে মারা৷ এর পেছনে একটা গভীর ও সারবান যুক্তি ছিল৷ আজকে যারা ছোটো লুম্পেন তারাই কিন্তু কাল দামড়া হয়ে ডাকাবুকো গুন্ডায় পরিণত হবে এবং গয়নার দোকানে ডাকাতি করবে৷ ‘ব্রেজিলিয়ান মির্যাকল্’-এর বহু আগে, রাশিয়াতে বিপ্লবের পরেই, উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন যে, দুনিয়াভর বলশেভিক মুরগির বাচ্চাগুলোকে তাড়া করে বেড়ানোর চেয়ে বলশেভিক ডিমগুলোকে থেঁতলে দেওয়াই ভালো৷ মহাজন-প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে আমরাও ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারি৷ কুকুরের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলতে গুলি বা বিষ, কোনো কিছুরই দরকার নেই৷ ঘাড় মুচড়ে বা আছড়ে বা পিটিয়ে বা জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলা খুবই সহজ৷ আরও সহজ হল বড়ো সাইজের পলিব্যাগের মধ্যে দলা পাকিয়ে অনেকগুলোকে ঢুকিয়ে মুখটা জবরদস্ত করে বেঁধে দেওয়া৷ ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা ও চিলি থেকে এ বিষয়ে প্রেরণা পাওয়া যায়৷ বড়োগুলোকে মারলে লাশগুলোর হিল্লে করা ঝামেলা৷ কিন্তু কিছুদিন পরপর বাচ্চাগুলোকে মারলে এরা আর সংখ্যায় বাড়বে না৷ আমরা এক্ষেত্রে বড়োগুলোকে প্রাপ্তবয়স্ক মশা ও বাচ্চাগুলোকে লার্ভার সঙ্গে তুলনা করতে পারি৷ সুচারুরূপে প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত করলে জানাজানি বা কেচ্ছার সুযোগও কম৷
বিরুদ্ধে মত
প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে ভাবনার খোরাক যোগায়৷ শুধু তাই নয়, বিংশ শতকের ইতিহাস থেকে যেভাবে এখানে সদর্থক শিক্ষা নেওয়া হয়েছে, তা চমকে দেওয়ার মতোই৷ এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমরা শুধু দিতেই জানি না, নিতেও জানি৷
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল বাচ্চাদের ওইভাবে মারার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হবে তারা দয়াপরবশ হয়ে কিছু বাচ্চাকে মারবে না৷ এর প্রমাণ আমাদের বিগত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের ইতিহাসের মধ্যেই রয়েছে৷ বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই৷ তা ছাড়া বেড়ালের মতো গুপ্তচরসুলভ মেজাজের না হলেও কুকুররাও বাচ্চাদের লুকোতে জানে৷ আর একটা কথা সম্ভবত ভাবাই হয়নি৷ বাচ্চাদের চোখের সামনে যে ভাবেই হোক মারতে দেখলে তাদের মা-বাবারা চুপচাপ শুধু দেখে যাবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই৷ ওরা বিকট চিত্কার করতে পারে, অন্য কুকুরদের ডেকে জড়ো করতে পারে এবং এমনকী মরিয়া হয়ে আক্রমণও করতে পারে৷ এর ফলে শহরে শব্দ ও অন্যবিধ দূষণ বাড়বে এবং কুকুররা মারমুখী হয়ে উঠবে৷ সেই অবস্থা আমরা কীভাবে সামাল দেব? কুকুরের সঙ্গে লড়াই চালাতে শেষে কি প্যারামিলিটারি ফোর্স নামাতে হবে? ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের দরকার সুখী গৃহকোণ, অসুখী গৃহযুদ্ধ নয়৷ তাই গোড়াতে সাধুবাদ জানালেও শেষ-বিশ্লেষণে প্রস্তাবটি আমরা নাকচই করলাম৷ নাকচ করার আর একটি কারণ হল শিশু-কুকুর হত্যার ওপরে জোর দেওয়া৷ ব্যাপারটা কেমন লাগেই৷ কেমন কি না?
‘নৈষ্কর্মা সিদ্ধি’-তে আচার্য শ্রীসুরেশ্বর বলেছিলেন,
‘বুদ্ধাদ্বৈতসতত্ত্বস্য যথেষ্টাচরণং যদি৷
শুনাং তত্ত্বদৃশাং চৈব কো ভেদোহশুচিভক্ষণে৷’
(নৈঃ সিঃ, ৪/৬২)
-অদ্বৈততত্ত্ব সাক্ষাত্কারী পুরুষেরও যদি যথেষ্টাচরণ হয়, তবে অপবিত্র পদার্থভক্ষন বিষয়ে তত্ত্বজ্ঞানী ও কুকুরে কী প্রভেদ?
পরিকল্পনা প্রস্তাব – ৪
আমরা ঠিক ভোজসভা বা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা অথবা সুন্দরীদের ফ্যাশন প্যারেডের আয়োজন নিয়ে বোধহয় আলোচনা করছি না৷ এখানে স্পষ্ট দুটি পক্ষ আছে৷ একটিতে রয়েছি আমরা৷ অন্যটিতে কলকাতার রাস্তার কুকুর বা নেড়িকুত্তা যাদের বলা হয়৷ এখানে ধানাই-পানাই, দীর্ঘসূত্রতা বা দয়া প্রদর্শনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ সহজ কথাটা হল কুকুর ধরতে হবে৷ এবং ধরে আদরে রাখা নয়, মেরে ফেলতে হবে৷ এতেই কিন্তু হাত ধুয়ে ফেলা যাবে না৷ যেভাবে আমরা হাজারে হাজারে কুকুর মারার পরিকল্পনা করেছি তাতে মৃতদেহ একটি পাহাড়ে পরিণত হবে এবং সেই পাহাড় পচতে থাকবে৷ ভূমিকম্প হলে আমরা দেখেছি ইঁদুরদের গায়ে যে মাছি থাকে তারা ইদুর মরার ফলে মানুষকে কামড়াতে শুরু করে, যার পরিণতি হল প্লেগ৷ পচা কুকুর থেকে কী অসুখ ছড়াবে আমরা জানি না৷ এখনও মানুষ জানে না এমন কোনো মহামারীও শুরু হয়ে যেতে পারে৷ এইসব নানাদিক চিন্তাভাবনা করে আমাদের প্রস্তাব হল –
ক) যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নামতে হবে৷ কে কী বলল, কার চোখে কী লাগল, দুনিয়া কী ভাববে এসব ছেঁদো ব্যাপার নিয়ে, ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না৷ দয়ামায়া দেখাবার অনেক জায়গা আছে – অনাথআশ্রম আছে, প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয় আছে, যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সমস্যা আছে – সেখানে গিয়ে ওসব দেখান৷ কুকুরদের ক্ষেত্রে ওসব ছিঁচকাঁদুনে মনোভাব দেখানোর কোনো অর্থই হয় না৷
খ) আমরা দেখেছি যে সাঁড়াশি দিয়ে কুকুর ধরার একটা চলনসই ব্যবস্থা চালু রয়েছে৷ নির্দিষ্ট এক একটি এলাকা অতর্কিতে ঘেরাও করে চিরুনি অভিযান চালাতে হবে৷
গ) কুকুরগুলোকে ধরে আনা ও মেরে ফেলার মধ্যে ব্যবধান বেশি হলে চলবে না৷ এর জন্যে আমরা গ্যাস-ভ্যান ব্যবহার করতে পারি, যেখানে সরাসরি ইঞ্জিন থেকে কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাস ওই ভ্যানে দেওয়া যায়৷ কিন্তু আমরা জানি যে কার্বন-মনোক্সাইডে মানুষ হলে মরতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগে৷ অথচ গত শতাব্দীর ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে খুবই উদঞ্জবায়ী হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাস এই সময়টাকে পনেরো মিনিটে নামিয়ে আনতে পারে৷ এটাও অবশ্য মানুষেরই হিসেবে৷
ঘ) এবার আমাদের শেষ কাজ৷ মৃতদেহের গতি৷ এর জন্য আমরা জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি বিদ্যুৎ-চুল্লি তৈরি করতে পারি যেগুলো পরে অন্য কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷ দেখা যাচ্ছে যে তৃতীয় ধাপটি শেষ হওয়ার পরে সেবারের মতো আমাদেরও কাজ শেষ৷ এবং শেষ কুকুরদের দলটি এই তিন ধাপ পদ্ধতি অতিক্রম করলেই আমাদের কাজ একেবারেই সমাপ্ত ও সম্পূর্ণ হবে৷
বিরুদ্ধে মত
এটা আমরা করতে পারি না৷ কারণ পুরো মডেলটাই হচ্ছে নাত্সি মৃত্যু-শিবিরের যা আমাদের দুর্নাম ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না৷ পরিকল্পনাটি ভেবেচিন্তেই করা এবং কার্যকর নয় এমনও বলা যায় না৷ বোঝাই যায় যে নাত্সি-পর্বে মৃত্যু-শিবিরের খুঁটিনাটি ভালোভাবেই বিচার করা হয়েছে এবং ত্রেবলিনকা, সবিবর, বেলজেক, অসউইত্জ-১ বা সেন্ট্রাল এবং অসউইত্জ-২ অর্থাৎ বিরকেনাউ-এর ঢঙে কুকুর মারা ও পুড়িয়ে ফেলার ছকটি করা হয়েছে৷ প্রস্তাবটি লোভনীয় হলেও গ্রহণযোগ্য নয় এবং এই প্রসঙ্গে প্রস্তাবকারীদের আমরা জানাচ্ছি যে নাত্সিদের মতো পরিকল্পনা-মনস্করাও কিন্তু আগেভাগে সবটা বুঝতে পারেনি৷ একটি উদাহরণই যথেষ্ট৷ অসউইত্জ (বিরকেনাউ)-এ চারটে মড়া পোড়াবার চুল্লি ছিল যেগুলো বানিয়েছিল এরফুর্তের জে.এ.টফ্ অ্যান্ড সন্স্৷ এর মধ্যে বড়ো দুটি চুল্লি প্রতি ২৪ ঘন্টায় ৬৫০০ মড়া পোড়াতে পারত৷ ওই দুটি চুল্লি ১৮ মাস একনাগাড়ে চলেছিল অর্থাৎ ১৮,০০,০০০ মড়া পুড়েছিল৷ এটা পুরো হিসেব নয়৷ পুরো হিসেব হল ৪ মিলিয়ান বা ৪০,০০,০০০৷ যাইহোক এত বড়ো ব্যবস্থার মধ্যেও অ্যাডলফ্ আইসম্যান যখন ৪,০০,০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিকে হত্যা করে তখন চুল্লিগুলো সামাল দিতে পারেনি৷ চুল্লির ইটে ফাটল ধরতে শুরু করে৷ তখন বিশেষ দহনখাদ খোঁড়া হয় যেখানে কংক্রিটের নর্দমা দিয়ে মানুষের চর্বি বয়ে যেত এবং সেই চর্বি জ্বলন্ত মৃতদেহের ওপরে বেলচা দিয়ে তুলে ঢেলে দেওয়া হত৷ এ কাজ করত বন্দিরাই৷ অতএব দেখা যাচ্ছে যে, সব পরিকল্পনার মধ্যেই অভাবনীয় নানা গলদ থেকে যায়৷ প্রস্তাবটি আমরা খারিজ করলেও এটি সংরক্ষণযোগ্য৷
বিরুদ্ধে মত (সংযোজনের জন্য)
প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে তরুণদের চিন্তা ভাবনা আমাদের ফেলনা মনে করা উচিত হবে না৷ উপরোক্ত প্রস্তাব-বিরোধী বক্তব্যের সঙ্গে মোটের ওপর একমত হয়েও জানাচ্ছি যে, মাত্র ২৯ বছর বয়সি এস. এস. অফিসার অটো মল অশউইত্জ-এ দহন খাদের নকশা করেছিল৷ নর্দমা দিয়ে যখন মানুষের ফুটন্ত চর্বি বয়ে যেত তখন অটো মল তার মধ্যে বাচ্চাদের ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলত৷ প্রস্তাবটি অবশ্যই সংরক্ষণযোগ্য এবং গোপন রাখলেই ভালো হয়৷
পরিকল্পনা প্রস্তাব -৫
অনেকগুলো প্রস্তাব এসেছে৷ কোথাও বিজ্ঞানেরও কৃৎকৌশলের জয়জয়কার৷ কোথাও একপেশে সামরিক মনোভাব৷ কোথাও ভ্রষ্ট শতাব্দীর ইতিহাসের যান্ত্রিক প্রভাব৷ আমাদের বক্তব্য হল নিজেদের ক্ষমতা বিচার করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ উদ্ভট খরচ যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে৷ সাপও (অর্থাৎ কুকুরও) মরে, লাঠিও না ভাঙে সেটা দেখতে হবে৷
ক) সাঁড়াশি দিয়েই কুকুর ধরা হোক৷ কারণ এর কিছু ব্যবস্থা ও অভিজ্ঞ কর্মী অন্তত আমাদের হাতে আছে৷
খ) কুকুর মারার জন্যে এক নয়া পয়সাও খরচ হবে না৷ ব্রিটিশ শাসকরা যে পিঁজরাপোলগুলো বানিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে কুকুরদের ছেড়ে দিলেই চলবে৷ খাবার বা জল কিছু দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ শুকিয়ে কয়েকদিনেই মরে যাবে৷ এবং এভাবে মরলে মৃতদেহে স্নেহপদার্থ ও জলের ভাগ যথেষ্ট হ্রাস পাবে৷ পচে গেলেও ভয়ানক কিছু হবে না৷ শকুন, চিল, কাক এরা আছে৷ অতএব কঙ্কালে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না৷ এর চেয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থার কথা বর্তমানে আমরা কী ভাবতে পারি?
প্রস্তাবের পক্ষে মত
এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থার কথা এই মুহূর্তে আমরা ভাবতে পারি না৷ পয়সা গাছে ফলে না৷ দেশের হালও বেহাল৷ এখন যদি কলকাতা অলিম্পিক বা বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করতে চায়, সেটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই সম্ভব নয় কুকুর মারার জন্যে এমন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যা আমাদের সাধ্যাতীত৷ তাই সবকিছু বিচার করে আমরা ‘পরিকল্পনা প্রস্তাব-৫’ সুপারিশ করছি৷ এরপর প্রয়োজনীয় অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি ওপর-মহলে পাঠানো হবে৷ ওপর-মহলে আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা চূড়ান্ত সম্মতির জন্য পাঠাবেন…
আগেই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পাড়ি দেওয়া কুকুরদের কথা বলা হয়েছে৷ রাস্তার শানের ওপরে, বাঁধানো জায়গার ওপরে তাদের চারটে থাবা যখন ছন্দ মিলিয়ে পড়ে তখন নখের সামান্য শব্দ হয়৷ মধ্যে থেমে থেমে একটু জিরিয়ে নিতে হয়৷ জল খেতে হয়৷ ফের ছুটতে হয় খবর নিয়ে৷ নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে৷ মাঝপথে যে কুকুররা খবর পায় তারাও সবাই চুপ করে বসে থাকে না৷
কুকুর কীভাবে তার অভীষ্ট খুঁজে বের করে তা নিয়ে অনেক সত্যি ঘটনা আছে যার মধ্যে জাদুর ছোঁয়া রয়েছে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে গ্রেট ব্রিটেনের ফার্স্ট নর্থ স্ট্যাফোর্ডশায়ার রেজিমেন্টের সৈন্য জেমস ব্রাউন যুদ্ধ করতে ফ্রান্সে গিয়েছিল৷ ১৯১৪ সালের আগস্টে৷ ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রাউনের স্ত্রী তাঁকে চিঠিতে এই দুঃসংবাদ দেয় যে, তার প্রিয় আইরিশ টেরিয়ার ‘প্রিন্স’-কে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ব্রাউন তাঁর স্ত্রীকে জবাবে লেখে, ‘দুঃখের ব্যাপার যে তুমি প্রিন্স-কে খুঁজে পাওনি৷ পাওয়ার কথাও নয়৷ কারণ সে আমার কাছেই রয়েছে৷’ এর মানে প্রিন্স ইংল্যান্ডের দক্ষিণেই ২০০ মাইল পথ পেরোয়৷ ইংলিশ চ্যানেল কোনোভাবে অতিক্রম করে৷ এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রান্সের ৬০ মাইল পেরিয়ে আর্মেন্তেয়ের-এ একটি ট্রেঞ্চে তার প্রভুকে খুঁজে বের করে৷