Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

লুব্ধক – ৪

অলৌকিক ভিক্ষাপাত্রের মতো চাঁদ

দাঁতে কামড়ে ছুটে যাচ্ছে রাতের কুকুর

কান গজিয়ে ওঠার পরে কান-গজানো পুরনো থাকার জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় নোংরা ফেলার বড়ো ভ্যাট-এর আশপাশটা বেছে নিয়েছিল৷ কয়েকদিনের নোংরা জমে ওঠার পরে এখানে বড়ো বড়ো লরি আসে৷ তাতে করে নোংরা ধাপায় চলে যায়৷ জায়গাটা নোংরা বলে বেড়াল, কুকুর ও কাক বাদে খুব একটা কেউ আসে না৷ তবে ডানদিকে হাত বিশেক দূরে একটা ভাঙাচোরা বাতিল পেচ্ছাপখানা আছে যাকে ঘিরে এমন লতা আর কাঁটাগাছের জঙ্গল যে কেউ যেতে পারে না৷ ওই ভাঙা পেচ্ছাপখানার ছাতে অনেকদিন আগে একটা পাগল সাইকেল রিক্সার পর্দার ছেঁড়া পলিথিনে জড়ানো বালিশ রেখে গিয়েছিল৷ কিন্তু আর নিতে আসেনি৷ কোনো কিছুই ফেলা যায় না, কোনো না কোনো কাজে লেগে যায়৷ বাতাসে পলিথিনটা উড়ে গেছে৷ বালিশটা বৃষ্টিতে ভেজে, আবার রোদে শুকিয়েও যায়৷ শুকনো থাকলে ওই বালিশের ওপরে নিরীহ একটা বেড়াল ঘুমোয়৷ কান-গজানোর সঙ্গে তার বিশেষ সদ্ভাব না থাকলেও ঝগড়া অন্তত নেই৷ এক ধরনের মায়াবী শেষ দুপুর আছে যখন নিরীহ বেড়ালেরা ঘুমোয়৷ ঘুম থেকে উঠে বেড়ালটা দুই থাবা ঝুলিয়ে নীচে কী হচ্ছে তা নির্লিপ্তভাবে দেখে৷ সে দেখতে পায় কান-গজানো হয় নোংরা ঘাঁটছে বা কিছু একটা তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে৷ এখানে অন্য কুকুররাও আসে, তবে সবই ধারে-কাছের৷ তারা আসে, আবার চলেও যায়৷ শুধু কান-গজানো এখানে থেকে যায়, কারণ সে অ্যাসিডে কান গলে যাওয়ার ব্যাপারটা ভোলেনি৷ বরং কোথাও আয়নার মতো জল-টল জমলে বা ঝকমকে গাড়ির গায়ে সে পরে-গজানো কানটা মাঝে মাঝে দেখে নেয়৷ একদিন বিকেলে কাছাকাছি টহলদারি করে ফিরে কান-গজানো দেখতে পেল যে ফেলে যাওয়া একটা থার্মোকলের বাক্সের ওপরে তারই মতো কালো কিন্তু থাবায় নয়, বুকের ওপরে সাদা নদী, একটা কান-ঝোলা বিলিতি কুকুর বসে আছে৷ ওকে দেখেই কান-গজানো দাঁত অল্প খিঁচিয়েছিল, কিন্তু ও বিশেষ পাত্তা দিল না৷ এই কুকুরটা একে তো নেড়ি নয়, তার ওপরে আশপাশের কোনো বাড়িরও নয়৷ হলে কান-গজানো ঠিক জানতে পারত৷ কান-গজানো তাকে বলল,

– তুই কে?

– যেই হই তোর মতো নেড়ি নই৷ আর কথা নেই বার্তা নেই, শুরুতেই তুই তোকারি৷ জংলি কি আর এমনি বলে!

– ঠিক আছে, ঠিক আছে, এটা আমার জায়গা৷ এখানে আস্তানা গাড়া আমি বরদাস্ত করব না৷

– কী করবি? কামড়াবি? ভয় দেখাবি?

– না৷

– তাহলে কী করবি?

– আমাকে কিছুই করতে হবে না৷ তুই যাদের পোষা তারা ঠিক তোকে ধরে নিয়ে যাবে৷ ঘেঁটি ধরে৷

– তারাই বড়ো গাড়ি করে ঘুরে ঘুরে আমাকে দিক ভুলিয়ে ছেড়ে দিয়ে গেল, খুঁজে নিয়ে যেতে তাদের ভারি বয়েই গেছে৷

-মানে?

– মানেটা বোঝার বুদ্ধি তোর আছে? বুড়ো হয়ে গেছি৷ আগের মতো টরটরে নেই৷ কারণে-অকারণে ঘুম পায়৷ তাই আর রাখবে না৷ ইচ্ছে হলে আমি নিজেই তো ফিরে যেতে পারতাম৷

– বুঝলাম, কিন্তু এত বড়ো কলকাতাটা থাকতে তুই মরতে আমার এই জায়গাটায় এলি কেন?

– কেন এলাম সেটা তুই তো বুঝবি৷ এ তল্লাটটা এখনও একটু ফাঁকা ফাঁকা৷ এখনই ওদের নজর এদিকে পড়বে না৷ অবশ্য বলা যায় না –

-কাদের?

-কলকাতায় কুকুর ধরা চলছে৷ জানিস না?

ভাঙা পেচ্ছাপখানার ছাদ থেকে বেড়ালটা বলল, – বেড়ালদেরও ধরছে নাকি?

-এখনও ধরছে না৷ তবে কুকুরদের পরে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ালদের দিকে নজর পড়বে৷ কথাতেই বলে কুকুর-বেড়াল৷

-আমার নাম কান-গজানো৷

-কান-গজানো? ঠিক আছে৷

-তোর নাম?

-আমার নাম জিপসি৷

-কী করছে ওরা কুকুরদের ধরে?

-পিঁজরাপোলে নিয়ে যাচ্ছে৷

-তারপর?

-তারপর আবার কী? না-খাইয়ে শুকিয়ে মারছে৷ উত্তরের দিকে অনেক কুকুর ধরা পড়েছে৷ আমি তো সেখান থেকেই আসছি৷ তবে কাকেরা যে উড়ো খবর ছড়াচ্ছে তা মোটেই ভালো নয়৷

-যেমন?

-বলছে পুরনো, জং-ধরা কুকুর-ধরবার গাড়িগুলোকে আবার নাকি রংচং করে, ঝালাই মেরে ফের রেডি করছে৷ গণ্ডায় গণ্ডায় কুকুর ধরার সাঁড়াশি অকেজো অবস্থায় ডাঁই করে রাখা ছিল৷ সেগুলোকে ঝেড়েমুছে ফের তেল-টেল দিয়ে নতুনের মতো করে ফেলা হচ্ছে৷

-কিন্তু উত্তর থেকে তুমি পালিয়ে কোথায় গেলে?

-আড়াআড়ি এলে চৌরঙ্গি পড়বে৷ আমি শেয়ালদা দিয়ে রেললাইন ধরে ফেলি৷ রেললাইনের পাথরে পা কেটে গেছে৷ একটু পর পর বড়ো বড়ো রেলগাড়ি যাচ্ছে৷ কিন্তু থামিনি৷ আর এই আমায় দেখছিস তো৷ এরপর দেখবি আরও আসছে৷

-এটাও কি কাকরা জানিয়েছে?

-না৷ এটা নিজের চোখে দেখা৷ কানে শোনা৷ এখান থেকে মিনিট কুড়ি দৌড়লে একটা বাজার আছে না?

-হ্যাঁ৷ ওখানে মাছের কাঁটা আছে৷

-তা থাকতে পারে৷ ওখানে বাজারের বাইরে তিন-চারটে বড়ো বড়ো চা-বিস্কুটের দোকান আছে?

-আছে৷

-ওখানে তিনটে কুকুর বলাবলি করছিল যে, এবারে এদিকটায় সরে আসবে৷ তবে দল বেঁধে নয়৷ একজন একজন করে৷ তাহলে নজরে পড়বে না৷

-এরকম কি আগে কখনও হয়েছে?

-হয়েছে কিন্তু এই মাপে নয়৷ গরমকালে কুকুররা একটু তিরিক্ষে হয়ে থাকে৷ খ্যাঁকখ্যাঁকে৷ তখন দু-চারটেকে ধরত৷ এবার কোনো বাছাবাছির বালাই নেই৷ কুকুর হলেই হল৷ পেলেই ক্যাঁক্৷

-উঃ, সাঁড়াশি? ঘাড় আর গলাটা কেমন শিরশির করে উঠল৷

-শুধু কি তাই? সাঁড়াশি দিয়ে ধরে হিঁচড়ে হিঁচড়ে খাঁচার গাড়ির কাছে নিয়ে যাবে৷ তারপর ছুঁড়ে গাড়ির ভেতরে৷ এরকম করে করে গাড়িতে যখন আর কুকুর তোলা যাবে না তখন পিঁজরাপোল৷

ওদের এই কথাবার্তার মধ্যে একটা দমকা হাওয়া এল যাকে আর-একটু রাগিয়ে দিলে ছোটোখাটো একটা ঝড় বলা যেতে পারে৷ ওরা ওপরদিকে তাকাল৷

বেড়ালটা বলল,

-কী হচ্ছে৷ কিছু বুঝলে?

-ঝোড়ো বাতাস বইছে৷

-ঘেঁচু বইছে৷ বিশতলা, তিরিশতলা ওপর দিয়ে ছায়া-কুকুরেরা দৌড়চ্ছে৷ কেন দৌড়চ্ছে বলতে পারব না৷ তবে জন্ম থেকে শুনে আসছি এরকম হওয়া ভালো নয়৷

-আমরা তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না৷

-পাবে৷ চেষ্টা করো, পাবে৷ দেখতে ভুলে গেছ তাই৷ ফের মনে পড়ে যাবে৷

ছায়া-কুকুরেরা কবে মরে গেছে কেউ বলতে পারে না৷ কালান্তক সময় এলে তারা মেঘের আড়াল ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ সরাইল হাউন্ডের মতো ক্ষিপ্রতায় লাফ দিয়ে ছুটতে থাকে৷ তাদের থাবার আঘাতে থরথর করে কাঁপে ছায়া-শহর, ছায়া-অট্টালিকা ও ছায়া-রাজপথ৷ সামনের দুটো পা একসঙ্গে ছোঁ মেরে নেমে আসে মারাত্মক ঢেউ-এর মতো, জ্বলন্ত ফেনায় বুদবুদ ও তরল আগুন ঝলকে ওঠে, তখন পেছনের দুটি পা ছায়া-মরুতে ধাক্কা দিয়ে বালি ওড়ায়৷ তাদের ডাক বড়োই গম্ভীর৷ ক্কচিত্‍কখনও যুদ্ধবিমানের চালকেরা দেখেছে যে তাদের ম্যাক-২ বা অধিকতর শক্তিধর বিমানকে হেলায় পেছনে ফেলে আকাশ বেড় দিয়ে ছুটে চলেছে ছায়া-কুকুরের দল৷ কেউ কেউ বলে মারণ-জ্যোত্‍স্নায় ছায়া-কুকুরেরা চান্দ্র শশক শিকার করতে বেরোয়৷ তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে৷ যদিও কেউই ছায়া-কুকুরদের অন্তরীক্ষ অতিক্রমণকে তুচ্ছ বলে মনে করেন না৷ ছায়া-কুকুরদের দলপতি হল একটি শুভ্র পবিত্র কুকুর৷ তার নাম হল লাইকা৷ কুকুর-উপকথা ‘লুব্ধক’ চারপায়ে নতজানু হয়ে লাইকাকে প্রণাম জানাচ্ছে৷

হাওয়ার ঝাপটাটা কেটে যেতে কান-গজানো বলল,

-তাহলে একটা কিছু হবেই, বলছ?

-সে তো বটেই৷ হবে না, হচ্ছে৷

-রাতে কি ধরতে আসতে পারে?

-এখনও অতটা বুদ্ধি ওদের হয়নি৷ তার ওপরে ভয়ও আছে৷ সব কুকুর তো আর সাঁড়াশির হাঁ-তে গলা এগিয়ে দেবে না৷ লড়ে যাবে৷

-তা তো বটেই৷ যাইহোক, তুমি এলে বলে খোঁজখবর সব পাওয়া গেল৷ একটেরে হয়ে থাকি৷ কারও সঙ্গে মিশি না৷ ওই বেড়ালটাই যা দু-একটা খবর-টবর এনে দেয়৷ দিন পাঁচেক আগে এসে বলল ও নাকি একটা মরা বাদুড় দেখেছে৷

-তো?

-বাদুড়ের মুখটা নাকি অনেকটা কুকুরের মতো৷ এ বিষয়ে তোমার কোনো ধারণা আছে৷

-না৷ আমি বাদুড়দের উড়তে দেখেছি৷ বাদুড়বাগান বলে একটা জায়গা আছে, জানো?

-সেখানে কি শুধু বাদুড়রাই থাকে?

-দূর! আদ্যিকালে হয়তো থাকত৷ এখন চামচিকেও থাকে কিনা সন্দেহ৷ ঘুম পেয়ে যাচ্ছে৷

-ঘুমোবে৷ কিন্তু তার আগে একটা কথা বলতে পারো?

-কী?

-দিনের বেলায় যদি আমাদের ধরতে আসে তাহলে আমরা কী করব?

জিপসি কিছু বলার আগেই বেড়ালটা বলল,

-আমি বলব?

-বলো৷

-এই ভাঙা পেচ্ছাপখানাটার দেওয়ালের পেছনে একটা ফাঁক আছে৷ বেশ বড়ো৷ ঝোপঝাড় হয়ে গেছে বলে বোঝা যায় না৷ ওখানে ঢুকতে পারো৷ কেউ খুঁজে পাবে না৷

কান-গজানো বলল,

-সে হয়তো যাওয়া যায়৷ কিন্তু ওখানে বোলতার চাক আছে৷

-আছে না, ছিল৷ বোলতারা কবে চলে গেছে৷ এখন শুধু চাকটাই আছে৷

-তাহলে তো চুকেই গেল হ্যাপা৷

এই বলে কান-গজানো জিপসির দিকে তাকিয়ে দেখল জিপসি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আর শুধু তাই নয়, স্বপ্নও দেখছে৷ কারণ শরীরটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে৷ সামনের থাবাদুটোও কখনও কখনও নড়ছে৷ জিপসির ঘুমোনো দেখে কান-গজানো ভাবল একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হয় না৷

নাহি মার কুক্কুরেরে, শুন দ্বিজবর৷

শুনিয়া বিপ্রের ক্রোধ বাড়িল বিস্তর৷৷

হাতে দণ্ড ধরি বলে নৃপতির প্রতি৷

মোর হাতে কুক্কুরের নাহি অব্যাহতি৷৷

পুণ্যহীন কুক্কুরের নাহি পরিত্রাণ৷

পুণ্য-বিনা স্বর্গে বাস নহে মতিমান্৷৷

৩ নম্বর পিঁজরাপোলে তখন একটা তাণ্ডব চলছিল৷ কুকুরদের কাঁই কাঁই বা ঘ্যাঁকাও করে চিত্‍কার, প্রতিবাদী শুকনো ঘেউ, চাপা রাগে গর্ গর্ করা-সব মিলেমিশে এক মহা-ঐকতান৷ এরই মধ্যে কামড়া কামড়ি, জায়গা নিয়ে দখলে রাখার চেষ্টা, দেহ শুকিয়ে আসায় প্রাণপণ তেষ্টা ও পায়ের তলায় বালি মেশানো কাঁকর-মাটি যা তখনও ঠান্ডা হয়নি এবং এখানে ওখানে মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে পাঁজর, করোটি, শুকনো ক্ষুর বা শিং৷ গতকাল যাদের আনা হয়েছিল তারা সারাদিন রোদে তেতে নিভে এসেছে, কেউ তলিয়ে গেছে আচ্ছন্নতায় যা অবধারিত প্রক্রিয়াতে অন্তিম প্রচ্ছায়ায় প্রবেশ করবে বা কেউ নির্বাক, শান্ত, কানও নড়ছে না যার অর্থ হল সে অসহায়তার শিক্ষা নিতে পেরেছে৷ মুখে-নাকে বালি ঢুকে গেছে কারও৷ এদের মধ্যে একটি কুকুর ট্যাক্সি চাপা পড়ে বহুদিন ধরে পঙ্গু৷ পেছনের পা দুটো অকেজো৷ সামনের দুই থাবায় ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলে৷ রয়েছে বৃদ্ধ কুকুরেরা যারা বহু যুদ্ধ ও সন্ধির সাক্ষী৷ সারা গায়ে প্রাচীন ক্ষতচিহ্ন৷ যেভাবে থেবড়ে মাটিতে পড়ে আছে তারা, দেখলে মনে হবে মৃতপ্রায় কুমির বা নিথর ডাইনোসর যুগের মথ৷ সারাদিন ধরে কুঁই কুঁই করে ধুঁকতে ধুঁকতে শিশুরা মরেছে৷ মা তাদের শুষ্ক জিভ দিয়ে চেটে চেটে আর্দ্রতা দিতে চেষ্টা করেছে৷ অসহায়তায় এলোমেলো ছোটাছুটি করেছে৷ মৃত্যুর পরেও মৃত শিশুরা দেয়ালা করছে ভেবে মায়াতাড়িত হয়েছে৷ কিন্তু এই মায়াই হল মৃত্যুর প্রথম সোপান৷ ওই তো নিঃশ্বাস নিচ্ছে৷ ওই তো ওঠানামা করছে ছোট্ট বুক৷ এই তো শোনা যাচ্ছে সেই হৃদস্পন্দন যা জরায়ুর মধ্যে প্রথম ক্ষীণ কম্পন হয়ে দেখা দিয়েছিল৷

এই মৃত, মৃতপ্রায় ও অর্ধমৃতদের চেয়ে আজ যারা এসেছে তারা স্বাভাবিক কারণেই অধিকতর সজীব ও সরব৷ কিন্তু মৃতের সঙ্গে থাকলে মৃত্যুর চৌম্বকক্ষেত্রের চোরা ঠান্ডা টান না চাইলেও অনুভব করতে হয় ও স্নায়ুতে স্নায়ুতে ধীর লয়ে অবশ সঙ্গীতের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে আত্মসমর্পণ৷

ছায়া-কুকুরদের দৌড়ের সময় এখানেও বালি ও কাঁকুরে-মাটির ওপরে এক ধুলোর আঁধি উঠেছিল, কিস্তু তা থিতিয়ে গেছে মৃত কুকুর-শিশুদের নরম লোমে ঢাকা শরীরের ওপর৷ এই ধুলোর চাদর হল ঢাকা পড়ে যাওয়ার, গভীরে চলে যাওয়ার এক আয়োজন৷ ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে এভাবেই ডাইনোসরদের ওপরে ধুলো জমতে শুরু করেছিল যার মধ্যে ছিল ইরিডিয়াম৷ এই ইরিডিয়াম এসেছিল মহাকাশ থেকে প্রেরিত উল্কাপিণ্ডের শরীরে মিশে৷ কে পাঠিয়েছিল এই মহাসংহারের অস্ত্র? এর আগেও বারবার পৃথিবী থেকে প্রাণ মুছে গেছে প্রলয়ের স্পর্শে৷ ৪৫০, ৩৫০, ২২৫, ও ১৯০ মিলিয়ন বছর আগেও এই অভিশাপ এসেছিল৷ কেন? কী হেতু এই মরণোত্‍সবের? সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রশ্নচিহ্নে সমাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সার্কাসের এরিনার মতো গোল পিঁজরাপোলের জমিতে দাঁড়িয়ে দেখা কলকাতার আকাশ৷

মস্ত বড়ো টাটা সুমোটা এসে দাঁড়াতে প্রায় একই সঙ্গে কান-গজানো আর জিপসির ঘুম ভেঙে গেল৷ গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার পেচ্ছাপ করতে নামল৷ গাড়ির মধ্যে এফ-এম রেডিয়োতে খবর হচ্ছে-

‘আজ চারশো আটচল্লিশটা কুকুর ধরা পড়েছে৷ এই নিয়ে মোট প্রায় সাড়ে সাতশো কুকুর ধরা সম্ভব হয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র জানান যে আকড়া ফটকের কাছে কিছু দুষ্কৃতি কুকুর ধরার কাজে বাধা দেয় ও যথেচ্ছ ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে৷ অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য এলাকায় পুলিশ নামানো হয় ও বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতি কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তিনি আরও জানান যে, আগামীকাল থেকে সশস্ত্র পুলিশ ও র্যাফ কুকুর ধরার সময়ে হাজির থেকে শান্তি রক্ষা করবে৷ আরও স্থির করা হয়েছে যে, শিশুরা যে-সময়টা স্কুলে থাকে সেই সময়ে কুকুর ধরার অভিযান জোরদার করা হবে৷ এ ব্যাপারে শিশু-মনস্তত্ত্ববিদদের বক্তব্য সরকার মেনে নিয়েছেন যে, চোখের সামনে সাঁড়াশি দিয়ে কুকুর ধরা দেখলে শিশুদের কোমল মনে বিরূপ প্রতিক্রয়ার সৃষ্টি হতে পারে৷ আপনারা কলকাতা বেতারকেন্দ্রের এফ এম চ্যানেলে সংবাদ শুনছেন৷’

‘প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে একটি অজানা বিদেশি বিমান আজ ভারতের সীমানা লঙ্ঘন করলে ভারতীয় জঙ্গিবিমান ওই বিদেশি বিমানটিকে ধাওয়া করে…’

টাটা সুমোটা চলে যাওয়ার পরে কান-গজানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-আমাদের কি কিছুই করার নেই? এইভাবে মরতে হবে?

-ভাগ্যে থাকলে মরতে হবে৷ কী করা যাবে৷ সাড়ে সাতশোর দলটা তো আরও বাড়বে৷ অনেক বাড়বে৷ ভাগ্যে যদি পিঁজারাপোলে গিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরাই লেখা থাকে তো তাই হবে৷ আমরা পারব ঠেকাতে? নিয়তি কেউ ঠেকাতে পারে না৷ কুকুর না, মানুষ না, কেউ না৷

-তুমি ভাগ্য মানো?

-না মেনে উপায়? ছোটোবেলায় তিন সপ্তাহ বয়সে কালো-ভাই আর আমি বিক্রি হয়েছিলাম হাতিবাগানে৷ সেখান থেকে ট্যাক্সি করে বউবাজারে এলাম৷ আমার জন্যে ডাক্তার আসত৷ একবার পড়ে গিয়েছিলাম৷ নড়তে পারতাম না৷ তখন বেলগাছিয়ার জন্তুদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল৷ রোজ দুধ খেতাম, মাংসের ছাঁট খেতাম৷ চকোলেট, আইসক্রিম – কী না খেয়েছি? আর আজ! নোংরার গাদায় বসে বেড়ালের লেকচার শুনতে হচ্ছে৷ এর পরেও বলতে হবে ভাগ্য মানি না?

বলাই বাহুল্য, বেড়ালটা রেগে গিয়েছিল৷ অন্ধকারে চোখ চকমকি পাথরের মতো জ্বেলে সে বলল,

-ভালো ভেবে লুকোবার জায়গাটা বলে দিলাম৷ শুনি কুকুররা কৃতজ্ঞতা জানে আর বেড়ালরা অকৃতজ্ঞের হদ্দ৷ এখন বোঝাই যাচ্ছে কোনঞ্জটা কী৷

-আরে বাবা, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে৷ নিছকই কথার কথা৷ আমি অন্য বেড়ালদের কথা বলছিলাম৷ তুমিই কি একলা বেড়াল নাকি? কত বলে বেড়াল রয়েছে৷

-সে থাকুগগে৷ এখানে বেড়াল বলতে আমিই৷ কাজেই বেড়ালের নামে কিছু বললে আমার গায়েই লাগার কথা৷

-আরে বাবা, মাফ চাইছি৷ হয়েছে? চালচুলো কিছু নেই৷ কী বলতে কী বলে ফেলি৷ অত ধরলে চলে?

এই মৃদু ঝগড়াটা দুম্ করে থেমে গেল, কারণ প্রচণ্ড জোরে কিছুটা দূরে একটা বোমা ফাটল আর ঝলকে অন্ধকারটা এক লহমার জন্যে চমকে উঠল, যেন কারও ফোটো তোলা হল৷ বোমার আওয়াজটা মিলিয়ে যেতে না যেতে কয়েকটা হালকা শব্দ৷ গুলির৷ বেড়ালটা বলল,

-লেগে গেল৷

-কার সঙ্গে কার?

-অত জানলে আর বেড়াল হয়ে জন্মাতে হত না৷

কান-গজানো হঠাৎ বলে উঠল,

-না৷ একটা খবর আসবে৷

-কী খবর?

-একটা খবর৷ আমাদের খবর৷ কুকুরদের খবর৷ আমার মন বলছে একটা খবর আসবেই৷

-ভালো না খারাপ?

-সেটা বলতে পারব না৷ কিন্তু একটা খবর আসছে৷ আসতে তাকে হবেই!