Accessibility Tools

বইয়ের নাম - লেখক
লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

লুব্ধক – ৫

প্রথম বিমানহানা করে গেছে শীত
বসন্তের কথা বা ভাবনা এখন দূর
রাস্তায় মানচিত্র হয়ে ঘুমায়
কয়েকটি ক্লান্ত কুকুর

কান-গজানো ভুল বলেনি৷ আগে আমরা শহরের এ-মাথা ও-মাথা ছুটে যাওয়া ব্যস্ত কুকুরদের কথা বর্ণনা করেছি৷ প্রথম (আসলে দ্বিতীয়) হাওড়া ব্রিজের এপার থেকে সে এসেছিল৷ তার নাম বাদামী৷ কান-গজানো আর জিপসি দেখেছিল দূর পেরিয়ে একটা হন্যে কুকুর আসছে৷ তার লোমে ডিজেলের ধোঁয়ার গন্ধ৷ চোখ একটু ভিজে৷ ওটা কান্না নয়৷ ধোঁয়ার আক্রমণ ঠেকাবার ব্যবস্থা৷ নামের সঙ্গে রঙের মিল থাকলেও চোখ দুটো একটু লালচে বলে অনেকেই ভেবে নিতে পারে যে, বাদামী বেশ রাগী ধাঁচের, কিন্তু এর চেয়ে ভুল আর কিছুই হতে পারে না৷ বাদামী এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

– আমার আগে আর কেউ এসেছিল?

– না তো৷

– আসার কথা ছিল৷ তাহলে হয়তো মাঝরাস্তায় ধরা পড়ে গেছে৷ অবশ্য চাপাটাপাও পড়তে পারে৷ একটু জল খাওয়া দরকার৷

– উলটোদিকে যে বাড়িটা দেখছ ওর বাগানে গাছে জল দেওয়ার পাইপটা খোলা আছে৷ জলটা গেট দিয়ে বেরোচ্ছে৷ খেয়ে এসো৷

বাদামী রাস্তার ডানদিক-বাঁদিক দেখে রাস্তা পেরিয়ে জল খেতে গেল৷

– আচ্ছা, হঠাৎ ওরা আমাদের নিয়ে পড়ল কেন বলতে পারো? আমরা কি খুব ঝামেলা করছিলাম?

– বুঝতে পারছি না৷ আমার তো এক-একসময় মনে হয় যে অজান্তেই কোনো ভুল বোধহয় আমরা করে ফেলেছি৷ যে কারণে ওরা এত ক্ষমাহীন হয়ে উঠেছে৷

– আসলে কলকাতাকে যেভাবে ওরা সাজাতে চাইছে সেই ছবিটার মধ্যে আমরা খুবই বেমানান৷

– সে না হয় হল, কিন্তু আগেই প্রশ্ন উঠবে যে কলকাতাটা কী কেবল ওদের? হঠাৎ ওরা বাদে অন্যরা ফেলনা হয়ে গেল?

– আবার অন্য একটা কথাও থেকে থেকে ভাবছি৷ মানে, বলা যায় যে কথাটা আমাকে ভাবাচ্ছে৷

– কী সেটা শুনি?

– আসলে হয়তো ব্যাপারটা তত কিছু নয়৷ এমনও হতে পারে যে আমরা যাতে নিজেদের মতো করে আরও গুছিয়ে আরও ভালোভাবে থাকতে পারি তারই জন্যে ওরা করছে৷ হয়তো … হয়তো… আমাদের নিয়েই একটা চিড়িয়াখানা বানাতে চায় ওরা৷ যেখানে আমাদের ভালো খেতে দেবে৷ অসুখ হলে ডাক্তার দেখাবে৷ কত কীই তো হতে পারে…

বাদামী জল খেয়ে ফিরে এসেছে৷ তার গোঁফে ও কালো নাকের ওপরে বিন্দু বিন্দু জল লেগে আছে৷

– তোমাদের এই কথাবার্তা শুনে আমার গল্পটা মনে পড়ে গেল৷ ছাগলছানা হাততালি দিচ্ছে আর নাচছে – কী মজা, সামনে সরস্বতী পুজো, কী মজা৷ তার মা তখন তাকে বকুনি দিয়ে বলছে যে আগে কালীপুজোটা যেতে দে, তারপর সরস্বতী পুজোর কথা ভাববি৷ তোমাদের হাল ওই ছাগলছানার মতো৷ কী কারণে কী হচ্ছে আমরা ভেবেচিন্তে কুলোতে পারব না৷ কাজেই সাত-পাঁচ ভেবে সময় নষ্ট কোরো না৷ যা বলছি শোনো৷ আমাকে এখনও অনেক জায়গায় যেতে হবে৷

– বলো৷

– একটা ব্যাপার মাথায় রাখবে৷ ওরা ওদের মতো করে ফন্দি আঁটছে৷ সে-ক্ষমতা আমাদের নেই৷ তাই আমাদের নিজেদেরই ব্যবস্থা করতে হবে৷ হাতে সময় বেশি নেই৷

– বলো না৷ পিঁজরাপোলে শুখা-ভুখা হয়ে মরার চেয়ে সবকিছু করতে রাজি আছি৷

– তুই কে?

– আমি জিপসি৷

– আর আমি কান-গজানো৷

– এখন আমাদের একমাত্র কাজ হল যেখানে ওরা হুট করে হানা দেবে না সেই সব জায়গায় দল বেঁধে লুকোনো৷ তারপর হল রওনা৷

– কোথায়?

– অত কথা বলা যাবে না৷ তোমাদের এই রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা বাস-গুমটি আছে৷ চিনিস?

– চিনব না কেন? তবে ওখান থেকে আর বাস ছাড়ে না৷ আগে ছাড়ত৷

– ঠিক৷ ওই গুমটিটার উলটোদিকে একটা দরজা আধখোলা সিইএসসি-র ট্রান্সফরমারের ঘর আছে৷

– হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার আগুন লেগেছিল৷ দুটো দমকল এসেছিল৷

– বিকেলে আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর ভেতরে ঢুকে যাবি৷ মেসিন-টেশিন ছুঁবি না৷ পেছনটায় চলে যাবি৷ দেখবি অন্তত চল্লিশটা কুকুর ওখানে লুকোতে আসবে৷ আপাতত এই৷ পরের কথা পরে৷ একটাই কাজ, পারলে খাবার-দাবার কিছু নিয়ে যাস৷ কেউ কোনো শব্দ করবি না৷ বাচ্চাগুলোকেই নিয়ে ঝামেলা৷ যতটা পারা যায় ওদের চুপ করিয়ে রাখতে হবে৷

– সে না হয় হল, কিন্তু তারপর?

– বললাম না পরের কথা পরে৷ এইটুকু শুধু জেনে রাখ যে রওনার আগে নির্দেশ আসবে৷ আর এখানে ন্যাড়া রাস্তার ধারে কচ্ছপের মতো বসে থাকিস না৷ গাড়ি থেকে দেখলেই নেমে তেড়ে আসবে৷

– এখন তুমি কোথায় যাবে?

– নানা জায়গায় হাল্লাক হয়ে খবর দিয়ে দিয়ে বেড়াব৷ আজ রাতের মধ্যেই বেশিরভাগ কুকুরের লুকোনোর ব্যবস্থা করতে হবে৷

– যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাবে?

– কী?

– ছায়া-কুকুররা কি সত্যি?

– তোদের কী মনে হয়?

– আমরা ব্যাপারটা বুঝিনি৷ ওই বেড়ালটা বলল… তাই… ওরা বাদামীকে বেড়ালটাকে দেখাবে ভেবেছিল, কিন্তু বেড়ালটা ওখানে তখন ছিল না৷

– সত্যি তো বটেই৷ এরপর নিজেদের চোখেই সব দেখতে পাবি৷ পরের মুখে আর ঝাল খেতে হবে না৷

যা খবর দেওয়ার ছিল দিয়ে বাদামী চলে গেল৷ জিপসি আর কান-গজানো দেখল বাদামী দূরে ছোটো হয়ে যাচ্ছে৷ আর তার কানদুটো না-হাঁটা না-দৌড়ের তালে তালে লাফাচ্ছে৷

কুকুর ধরার অভিযান যে এভাবে ঝিমিয়ে পড়তে পারে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি৷ এমন নয় যে সাঁড়াশি-বাহিনীর সঙ্গে শহরের ঝড়তি পড়তি মানুষদের সংঘর্ষ বাড়তে বাড়তে আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং তার ফলে বৃহত্তর বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছিল৷ এমনও নয় যে সাঁড়াশী-বাহিনীর কর্মীরা বিশেষ কোনো দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে কাজে ঢিলে দিচ্ছিল বা অন্য কিছু৷ তবে আগের কথাটার খেই ধরে এটা বলাই যায় যে কুকুর-ধরাদের মজুরি নিয়ে দীর্ঘদিনই কোনো চিন্তাভাবনা হয়নি৷ কারণ কুকুর ধরাই হত না৷ পিঁজরাপোলগুলোর অবস্থাও ছিল তথৈবচ৷ আসল ব্যাপারটা হল যখন, যেদিকে বেশি নজর দেওয়া হয়, তখন অন্যদিক থেকে নজর সরে যায়৷ পোলিও নির্মূল করার অভিযান চলছে৷ ওদিকে সঙ্গত কারণেই প্লেগ-এর দপ্তর খোলে কিনা সন্দেহ৷ কিন্তু একজন বিকৃতমস্তিষ্ক লোক যদি কার্জন পার্কের ইঁদুরদের বিষ খাওয়ায় তাহলে ওদের গায়ে যে মাছিরা থাকে তারা বাধ্য হয়ে বেরিয়ে মানুষকে কামড়াবে৷ প্লেগ দেখা দেবে৷ তখন আবার দেখা যাবে পোলিও নিয়ে কেউ ভাবছে না৷ এসব আকাশ-পাতাল না ভেবে আমরা যখন কুকুর নিয়ে পড়েছি তখন সেই আসল কথাতেই ফিরে যাওয়া যাক৷

কুকুরদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না৷ উপরন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা গেল৷ বিভিন্ন পাড়ায়, গুরুত্বপূর্ণ সব মোড় ও দরকারি রাস্তার মাঝখানে ধরা দেবার জন্যে জ্ঞানবৃদ্ধ কিছু কুকুর হয় বসে বসে ঝিমোচ্ছে, গায়ে মাছি বসলেও তাড়াচ্ছে না বা সামনের দুই থাবার মধ্যে মাথাটা রেখে দু-চোখ মেলে নির্লিপ্তভাবে বিশ্ব-সংসারে কী ঘটে চলেছে দেখছে এবং অজানা কোনো শব্দতরঙ্গের সংকেত ধরার জন্যই যেন তাদের কানগুলো রাডারের মতো দিক পালটাচ্ছে৷ কুকুর ধরার একটা বিশাল অভিযান চলছে৷ সেটা সকলেরই জানা৷ তার মধ্যে এই প্রবীণ কুকুরদের আগ বাড়িয়ে ধরা দিতে আসা কারও কারও চোখে তাজ্জব ঠেকলেও ঠেকতে পারে৷ এবং সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের সেটা হল কুকুর-ধরা গাড়ি এসে দাঁড়াতেই এরা গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল৷

-‘এটা খুবই স্বাভাবিক৷ এরা কুকুরদের কোনো বৃদ্ধাশ্রম থাকলে সেখানে চলে যেত৷ অথচ দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এদের শিখিয়েছে যে প্রতিবাদ বা কামড়াকামড়ি করে কোনো লাভ নেই৷ এমনিতেও মরবে অমনিতেও মরবে৷ এই বয়সে আর হুজ্জুতি পাকাতে চায় না৷ এই আত্মসমর্পণের মধ্যে অন্য কিছু খোঁজার চেষ্টা বাতুলতা৷’

-‘কোনোমতেই এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ মানুষের বেলায় দেখা গেছে যে, সে যত অভিজ্ঞ ও প্রবীণ হয়ে ওঠে, ততই ধীর স্থির হয়ে ওঠা মনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তার বিচারধারাও তদনুরূপ হয়ে যায়৷ কাজেই টালাপার্ক থেকে টালিগঞ্জ, বেলেঘাটা থেকে বাঘাযতীন – নানা জায়গায় আমরা যখন প্রবীণ কুকুরদের একইরকমের রহস্যময় ব্যবহার দেখছি তখন পুরো ঘটনাটাকে স্রেফ কাকতালীয় বা অপারগ হয়ে আত্মসমর্পণ বলে না ভাবলেই বোধহয় ভালো৷ সব ঘটনার অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যা হয় না৷ যদিও মানুষের প্রবণতাই হল তাই৷’

-‘আমাদের মনে হয় বিষয়টি নিয়ে অযথা বিতর্ক চলতে দেওয়া ঠিক হবে না৷ এতে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে এবং কলকাতাকে কুকুর-শূন্য করার আমাদের যে সাধু-পরিকল্পনা তার বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে৷ মাথা যদি ঘামাতেই হয় তাহলে অনেক ব্যাপার রয়েছে৷ কতগুলো বুড়ো কুকুরের হাবভাব নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা বা বিতর্ককে আর যেন আমল না দেওয়া হয়৷’

-‘আমরা সম্পূর্ণ অন্য প্রস্তাব দিচ্ছি এবং কোনো বিতর্কের অবতারণা ঘটানো আমাদের লক্ষ্য নয়৷ পিঁজরাপোল-৩ মৃত ও অর্ধমৃত কুকুরে ভর্তি৷ বস্তুতই সেখানে আর কুকুর ছাড়া যায় না৷ পিঁজরাপোল-১-এ মেরামতি চলছে৷ পিঁজরাপোল-২-তেও যথেষ্ট সংখ্যক কুকুর রয়েছে৷ আমাদের বক্তব্য হল এই আত্মসমর্পণকারী বৃদ্ধ কুকুরদের পিঁজরাপোল-১-এ রেখেও মেরামতির কাজ চলতে পারে৷ বিজ্ঞানের স্বার্থে কয়েকটা দিন ওদের ওপরে নজর রাখা প্রয়োজনীয় বলে আমরা মনে করছি৷’

সন্ধের মুখে ফিরে এসে বেড়ালটা দেখল জিপসিও নেই, কান-গজানোও নেই৷ সারাটা দিনই আজকে ওকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে৷ এদিকটায় কী ঘটেছে কিছুই জানা নেই৷ তবে কি কান-গজানো আর জিপসিকে ধরে নিয়ে গেল কুকুর-ধরা গাড়ি?

অসম্ভব মনখারাপ করে ভাঙা পেচ্ছাপখানার ছাদে শুয়ে শুয়ে বেড়ালটা আকাশ দেখতে লাগল৷ কান-গজানো বা জিপসি – কোনোটারই লড়াই করার মুরোদ নেই৷ দুটোই ক্যাবলা, ভালোমানুষ৷ ওদের কি সত্যিই ধরে নিয়ে গেল? রাত বাড়ল৷ আকাশের উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধকের নীলচে আলোর রকমফের দেখতে দেখতে বেড়ালটা একসময় ঘুমিয়ে পড়ল৷ ঘুমিয়ে পড়লে সকলেই ছোটোবেলায় ফিরে যেতে পারে৷ বেড়াল দেখল সে তখন বেড়ালছানা৷ বেশি লাফালাফি করার সেই সুন্দর ছোটোবেলা৷ তখন সে প্রজাপতিদেরও লাফ দিয়ে দিয়ে ধরার চেষ্ট করত৷ একদিন হয়েছিল কী, হঠাৎ অ্যালামোন্ডা ফুলের ওপরে কালো ডানায় সাদা, হলদে ও নীল ছিট ছিট একটা মস্ত প্রজাপতি বসে ছিল সকালবেলায়৷ আলতো শীতের পশ্চিমি বাতাসে হলদে ফুলটা একটু একটু দুলছে আর প্রজাপতিটার ডানা দুটো লুকোনো একটা আমেজের ছন্দে একবার করে পুরো মেলে যাচ্ছে আবার বন্ধ হচ্ছে৷ রোদ ঝলমলে শীতের সকাল৷ এর মধ্যে আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি৷ স্বপ্নে যা ইচ্ছে তাই হয়, যা ইচ্ছে হয় না তাও৷ ঘুম ভেঙে বেড়ালটা দেখল সত্যিই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে৷ আকাশের সব তারা লালচে একটা গুমোট মেঘ আড়াল করেছে৷ রাস্তাটা ডানদিকে বাঁদিকে জলে ভিজে চকচকে হতে শুরু করেছে৷ এবারে নেমে একটা আড়াল খুঁজতে হবে৷ কিন্তু নামার জন্যে টানটান হয়েও সে লাফ দিল না৷ তলায় কিছুটা বুক সাদা জ্যান্ত অন্ধকার বসে৷

– কে?

– আমি জিপসি৷

– বলবি তো৷ আমি ভাবলাম কী রে বাবা৷ ভূত-টুত নাকি?

-শোন, আমি আর কান-গজানো একটা জায়গায় চলে গেছি৷ বাদামী বলে একটা কুকুর এসে আমাদের ওখানে যেতে বলছে তাই৷ তা ভাবলাম তুই নির্ঘাৎ ভাববি যে আমাদের ধরে নিয়ে গেছে৷

-ভাববো কী, আমি তো তাই ধরেই নিয়েছিলাম৷

-আমরা ওখানে প্রায় একচল্লিশটা কুকুর আছি৷ দুটো বেড়ালও এসেছে৷

-সে কী?

-ওদের পাড়ার কুকুররা এসেছে, সঙ্গে ওরাও চলে এসেছে৷ তোকে বলতে এলাম যে তুইও আমাদের সঙ্গে চল৷

-তারপর?

-দিনদুয়েকের মধ্যে আমাদের শহর ছাড়তে হবে৷ মারাত্মক একটা কিছু হবে৷ কী তা জানি না৷ আমরা নির্দেশ পেলেই দল বেঁধে শহর ছেড়ে পালাব৷ তুই এখন চলে আয়৷ কান-গজানোও খুব করে বলেছে৷

-তাহলে বলছিস যে গেলেই ভালো৷

-এখন অবধি যা শুনেছি তাতে আমারও তো তাই মনে হচ্ছে৷ নেমে আয়৷ চল্৷

-সে না হয় যাচ্ছি কিন্তু মারাত্মক ঘটনাটা কী?

-সবই কানাঘুঁষো৷ কেউ বলছে যুদ্ধ লেগে যাবে৷ কেউ বলছে ভূমিকম্প হবে৷ কুকুরদের বাঁচাবার জন্যে পাতাল থেকে নাকি কিছু উঠে আসতেও পারে৷ ঠিক করে কিছু বলা যায় না৷ চল্, যেতে যেতে বাকিটা বলছি৷

টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে জিপসি আর বেড়াল চলে গেল৷ নোংরার গাদার মধ্যে একটা গলায় দড়ি বাঁধা পুতুলও পড়েছিল৷ বিদ্যুৎ চমকালে এক লহমায়- মনে হতে পারে যে পুতুলটা এই ভিজে নোংরার মধ্যে বেশ আরাম করে বসে আছে৷ হাসছে কি?

পিঁজরাপোল-১-এ প্রবীণ কুকুরদের ঢুকিয়ে দিতে দেখা গেল তারা কোনো শব্দ না করে চক্রাকার জায়গাটার মধ্যে গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে একবার নাক শোঁকাশুঁকি করে নিল৷ তারপর নিজের নিজের জায়গাতেই আধশোয়া হয়ে বসে থাকল৷ ওদের যখন ওখানে ছাড়া হয় তখন বেশ একরোখা রোদ্দুর৷ পিঁজরাপোলের বধ্যভূমির একাংশে একটি বাজে-পোড়া মরা গাছ তার কয়লার ডালপালা মেলে কিছুটা ছায়ার সৃষ্টি করেছে৷ বৃদ্ধ কুকুরেরা যদি ওই ছায়ার জায়গাটায় সরে যেত তাহলে প্রখর উত্তাপ থেকে কিছুটা অন্তত রেহাই পেতে পারত৷ কিন্তু সেরকম কোনো চেষ্টাই ওরা করেনি৷ রোদ্দুরের মধ্যে অন্ধ সূর্য-উপাসক বা জেদি পাথরের মতো বসেছিল ওরা৷ চড়া রোদ্দুরে সব কুকুরই জিভ বার করে হ্যা-হ্যা করে৷ সেরকমও তারা করেনি৷ রোদ, গরম, জলাভাব, ক্লান্তি, খিদে, অবধারিত অমোঘ মৃত্যু, কঙ্কালসার হতে হতে ঢলে পড়া, অবলুপ্তি- কোনোকিছুকেই তারা তিলমাত্র আমল দেয়নি৷ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এদের ওপরে নজর রাখা হয়েছিল৷ সন্ধেবেলা যখন টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ল তখন সন্ধানী-আলো ফেলে দেখা গেল যে তারা একইভাবে বসে আছে এবং একফোঁটা বৃষ্টির জলও তাদের শুকনো জিভ দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে না৷

এরপরে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে আকাশ যখন একটু পরিষ্কার হল তখন দেখা গেল যে সেই একই জায়গাতে উঠে বসে সেই প্রবীণ কুকুরেরা তাদের ঘোলাটে ছানিপড়া চোখগুলো অন্তরীক্ষের দিকে মেলে তাকিয়ে রয়েছে৷ একযোগে৷ বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের আলো ওই৷ ওই তার মধ্যে লুব্ধক৷ ঘেউ! ঘেউ!