লুব্ধক – ৬
৬
… একটা কুকুর যখন বাস চাপা পড়ার পরে রাস্তায়,
চাঁদের আলোয় রক্তে ভিজে শুয়ে থাকে আর
তার শেষ চিত্কার টেপরেকর্ড করে
ইস্কুলের বাচ্চাদের শোনানো হয়…
‘আমরা মোটের ওপরে বুড়ো কুকুরগুলোর ওপর নজর রেখে এবং মোটের ওপর ওদের লক্ষ্যবসত্তর একটা আন্দাজ করে অনুমান করছি যে ওরা বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের দিকেই তাকিয়ে আছে৷ এর কারণ আমরা জানি না৷ সন্ধানী-আলোয় দেখা গেছে যে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়টা ওদের মুখটা একটু হাঁ করে থাকছে এবং জিভগুলো থরথর করে কাঁপছে৷ ওরা কি কোনো প্রার্থনা জানাচ্ছে? কুকুররা কি প্রার্থনা জানাতে পারে? বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের কী আছে যে ওরা কিছু চাইতে পারে? এখন ওই বুড়ো কুকুরগুলো যদি মরে যায় তাহলে আমরা এই অনুমানভিত্তিক পরীক্ষা আর চালাতে পারব না৷ তাই আমরা অনুরোধ করছি পিঁজরাপোল-১-এ অন্তত কিছু খাবারদাবার ও জল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক৷ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারবেন যে বুড়ো কুকুরদের প্রতি মমত্ববোধ থেকে এই প্রস্তাব আমরা করছি না৷ আমরা যা কিছু বলছি সবই অমিত শক্তিধর বিজ্ঞানের স্বার্থে৷’
ঘেউ! ঘেউ!
লুব্ধক ওরফে কুকুর তারা ওরফে সিরিয়াস ওরফে আলফা ক্যানিস মেজরিস হল একটি যুগ্ম তারা৷ জার্মান জ্যোতির্বিদ ফ্রিডরিশ ভিলহেলম বেসেল ১৮৪৪ সালে এই তারকাটির কথা প্রথম বলেন এবং যুগ্ম তারকাটিকে চাক্ষুষ দেখা যায় ১৮৬২-তে৷ দেখেছিলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ অ্যালভান ক্লার্ক৷ প্রাচীন মিশরীয়রা লুব্ধককে বলত ‘সোথিস’৷ রোমে, সবচেয়ে গরমের সময় এই তারা দেখা দিত৷ ইংরেজি ‘ডগ ডেজ’ কথাটির মধ্যে সেই রোমক অভিজ্ঞাতার রেশ রয়ে গেছে৷ লুব্ধকের যুগ্ম তারা হল সিরিয়াস-বি৷ তারাদের দুনিয়ায় এ হল একটি সাদা বামন অর্থাৎ এর পরমাণুরা ঘন সনিনবিষ্ট হতে হতে আশ্চর্য ঘনত্ব অর্জন করেছে৷ আফ্রিকার ডোগন উপজাতির লোকেরা লুব্ধক ও সিরিয়াস-বি সম্বন্ধে খুঁটিনাটি অনেক খবর জানে৷ কীভাবে ‘জংলিরা এসব জানল (যেমন সিরিয়াস-বি হল সবচেয়ে ছোটো আর ভারি তারা) তা হদিশ করা যায়নি৷ নীলচে-সাদা লুব্ধক সৌর পরিবার থেকে ৮০৬ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে৷ লুব্ধক সূর্যের চেয়ে বড়ো এবং ২৩ গুণ বেশি উজ্জ্বল৷ সাদা বামন সিরিয়াস-বি-র ভরও প্রায় সূর্যের সমান কিন্তু ঘনত্ব অনেক বেশি৷ ঘেউ! ঘেউ!
কান-গজানো, জিপসি, বেড়াল এরা সবাই যে ট্রান্সফরমার ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল সেখানকার নেতার নাম বাহান্ন৷ হলদেটে মাদি কুকুর বাহান্ন-র এরকম নাম হওয়ার কারণ, মোটের ওপরে তখন অবধি সে বাহান্নজনকে কামড়িয়েছে৷ অবশ্য এর জন্যে ওকে দোষ দেওয়ার কোনো মানে হয় না৷ প্রতি বছরই বাচ্চা হওয়ার সময়টাতে লোকেরা ও কম বয়সের মানুষেরা কারণে-অকারণে মা ও বাচ্চাদের বিরক্ত করে বলে মায়েরা কামড়াতে বাধ্য হয়৷ সেখানে একটা কুকুর ছিল যার নাম তিনপেয়ে৷ ছোটোবেলাতেই মোটর সাইকেল একটা পা উড়িয়ে দিয়েছিল৷ কলকাতায় এরকম অসংখ্য জায়গার মধ্যে কুকুরেরা লুকিয়ে ছিল৷
প্রত্যেকটা ট্রামডিপো ও পাম্পিং স্টেশনে, দুধের বুথের পেছনে ও ভাঙাচোরা গ্যারেজে, থানার মধ্যে যেখানে অ্যক্সিডেন্টে চুরমার গাড়িদের রাখা হয় সেখানে, কবরখানা, বাসগুমটি, রোলের দোকানের তলায়, বেড়ার পেছনে, খোলা ম্যানহোলের মধ্যে, আধ-বানানো বাড়ির সিঁড়ির তলায়, বিরাট জায়গা জুড়ে দোতলা বাসের ভাগাড়ে, সুলভ শৌচালয়ের পেছনে, পার্কের মধ্যে, গাড়ি ঢুকতে পারবে না এরকম অপ্রশস্ত গলিতে, দুর্গাপুজোর জন্য বানানো পাকা বেদির পেছনে, শ্মশানে, আদিগঙ্গার ধারে বুনোকচুর জঙ্গলে, সেতুর তলায় নানা ফাঁকফোকরে – কুকুররা লুকোয়নি এমন কোনো জায়গা ছিল না৷ সকলেই জানে যে বড়ো বড়ো পাইপ-এর ভেতরে মানুষ ঘরসংসার করে৷ কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় এমন মাপের পাইপ পড়ে থাকে যার মধ্যে মানুষের পক্ষে ঢোকা সম্ভব নয়৷ কলকাতার কুকুরেরা সেগুলোকেও কাজে লাগিয়েছিল৷ যেমন কাজে লাগিয়েছিল রাতের বাসের তলা, ইটের পাঁজা, স্টেডিয়ামের আশপাশের পরিত্যক্ত এলাকা ও বাতিল মালগাড়ির ওয়াগন৷ এইসব জায়গায় কুকুর-ধরা গাড়ি কখনও পৌঁছতে পারবে না৷ কোনো সাহসী কুকুর-ধরা যদি একা একা সাঁড়াশি হাতে যায় তাহলে তাকে বিপদের মুখে পড়তে হবে৷ বাঁধা মাইনের চাকরিতে অত ঝুঁকি নেওয়া চলে না৷ সবাই তো আর মিলিটারি নয়৷
কুকুর-উপকথার মধ্যে গল্পের সঙ্গে সঙ্গে সত্যি বা চিরন্তন ঘটনার মিশেল থেকেই যাচ্ছে৷ শুধু সিমেন্ট দিয়ে কোনো কাঠামো বানানো যায় না৷ বালি, জল, লোহার রড – অনেক কিছু লাগে৷
প্রচণ্ড গরমের মধ্যে (৯৫, ১১৩, ও ১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কুকুরদের ট্রেডমিল ব্যায়াম করিয়ে অনেক পরীক্ষা করা হয়েছে৷ আরও যে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা কুকুরদের ওপরে চালানো হয়েছে তা বিভিন্ন ফাইলের শিরোনাম দেখলেই বোঝা যাবে-
Accleration, Aggression, Asphyxiation, Blinding, Burning, Centrifuge, Compression, Concussion, Crowding, Crushing, Decompression, Drug Tests, Experimental Neurosis, Freezing, Heating, Hemorrhage, Hindleg Beating, Immobilization, Isolation, Multiple Injuries, Prey Killing, Protein Deprivation, Punishment, Radiation, Starvation, Shock, Spinal Chord Injuries, Stress, Thirst… – এই তালিকার কোনো শেষ নেই৷ আর আছে – চিমটে দিয়ে শরীরের কোনো অংশ ছিঁড়ে নেওয়া, থ্যাঁত্লানো, হাতুড়ির বাড়ি মারা, ঘুরন্ত ড্রামের মধ্যে গড়ানো, গুলি করা, ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করা ইত্যদি৷ সবই বিজ্ঞানকে সর্বশক্তিমান করার জন্যে৷
পাঁচমিনিট পরে কাঁপুনি দমকে দমকে শুরু হল৷ ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম মিনিটের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের সংখ্যা বেড়ে গেল৷ ১১শ থেকে ১৩শ মিনিটের মধ্যে শ্বাসের সংখ্যা কমে মিনিটে তিনটিতে নেমে এল এবং এই পর্বটির শেষেই শ্বাসক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল৷ এর আধঘন্টা পরে ব্যবচ্ছেদ শুরু হল’ – এই পরীক্ষা কিন্তু কুকুরের ওপর হয়নি৷ হয়েছিল কোনো ইহুদি, রুশ বা পোল যুদ্ধবন্দির ওপরে৷ বাতাসের চাপ কমাতে থাকলে মানুষের কী হয় তা জানার জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি করেছিল নাত্সি ডাক্তারেরা৷ অতএব মানুষ যে শুধু কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীদের ওপরেই পরীক্ষা চালিয়েছে এমন নয়৷ বিজ্ঞানের জয় হোক৷ ঘেউ! ঘেউ!
দেওয়ালের ওপরের দিকে একটা গর্ত ছিল৷ কিন্তু সেটা মানুষের ঢোকার৷ ওই গর্তটা করেছিল পাতাখোর চোরেরা৷ ওরা ওখান দিয়ে লোহালক্কড়, তার, টুকটাক যন্ত্রপাতি – এসব টুকরো মাল ঝাড়বে ভেবেছিল৷ খুব একটা লাভ হয়নি৷ সে-সব যা টানার মতো ছিল সে তো কবে উধাও হয়ে গিয়েছিল৷ জগু আর ভজুয়া গিয়ে দেখল গর্তটা নীচের দিকে বাড়াতে না পারলে দুবলা বা বুড়ো, বাচ্চা বা কমজোরী মায়েরা ঢুকতে পারবে না৷ পুরো একটা রাত্তির ওদের লেগেছিল গর্তটা বাড়াতে৷ মেট্রোরেলের সীমানাটা টালিগঞ্জের দিকে শেষ হয়েছে সেখানে রেললাইন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও অনেক, অনেক জায়গা রয়েছে৷ সেখানে কেউ যায় না৷ অনেক বছর ধরে গাছ ও আগাছা, ইট, রেলের স্লিপার, জমাট বেঁধে যাওয়া সিমেন্টের বস্তা – এইসব মিলেমিশে সেখানে একটা দুর্ভেদ্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ তেলাকুচো ও অন্যান্য লতানো গাছ জায়গাটাকে এমনভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে ঢেকেছে যে কোথাও কোথাও রোদ্দুর বা আলো, কিছুই ঢোকে না৷ বরং সবুজ অন্ধকার থাকে যার সঙ্গে পচা পাতা, গাছের কষ ও ভিজে মাটির গন্ধ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ হাওয়া ঢোকে কম৷ এই আদ্রর ছায়ায় অসংখ্য পাতালকোঁড় হয় এবং গোল গোল গেঁড়ি অবাধে ঘুরে বেড়ায়৷ পরের রাতে ওই গর্ত দিয়ে প্রায় দেড়শো কুকুর মেট্রোরেলের এলাকায় ঢুকে আশ্রয় নেয়৷ এদেরই মধ্যে ছিল পাটকিলে আর তার চারটে বাচ্চা৷ কলকাতার কুকুরদের বাঁধা এলাকা থাকে৷ জায়গার দখলদারি রাখতে ঝগড়া থেকে সংঘর্ষ, গর্গর করে রাগ দেখানো থেকে শুরু করে রক্তক্ষয়ী কামড়াকামড়ি সবই হয়৷ কিন্তু কুকুর ধরার অভিযানের সময় এসব আর মাথায় রাখা সম্ভব হয়নি৷ তাড়া খেয়ে কুকুরদের দঙ্গল বেঁধে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পালাতে হয়েছে৷ সবাই পালাতে পারেনি৷ কোনো কোনো অন্ধ বা চোখে কম দেখতে পাওয়া কুকুর ফ্লাইওভার বানাবার জন্যে খোঁড়া, গভীর জলজমা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে৷ হয় জলে ডুবে মারা গেছে বা কাদার ঢালের ওপর দিয়ে বারবার ওঠার চেষ্টা করে পিছলে নেমে গেছে৷ সারা রাত ধরে কলকাতার বাজারে যে লরির কনভয় আসে তার হেডলাইটের রাক্ষুসে আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে অনেক কুকুর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ছে৷ লরির পর লরি, চাকার পরে চাকা তাকে পিষে পিষে, গুঁড়িয়ে, রাস্তার পিচের সঙ্গে লেই-এর মতো মিশিয়ে দিয়েছে৷ ঠাঁইনাড়া বা হটাবাহার হলে সকলেই কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ কলকাতার কুকুরদের বেলাতেও এর অন্যথা ঘটেনি৷
ট্রান্সফরমারের ঘরে সব কুকুরই, এমনকি বাচ্চাগুলোও চুপচাপ বসেছিল৷ শুধু একটা পাঁজরভাঙা রোগা কুকুর ঘুমের ঘোরেই গোঙাচ্ছিল৷ জিপসি আর কান-গজানো ফিসফিস করে গল্প করছিল আর তাদের দুজনের মধ্যে, দুজনেরই গায়ের গরম থেকে আরাম পেয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছিল বেড়াল৷ দরজার দিকটায় শুয়ে শুয়ে বাহান্ন বাইরের দিকটায় নজর রাখছিল আর বাতাস শুঁকে শুঁকে বা কান পেতে প্রায় অস্ফুট সব কম্পন থেকে কোনো খবর বা অন্যকিছুর জন্য সজাগ সন্ধান চালাচ্ছিল৷ কান-গজানো জিপসিকে বলল,
-তোকে তো ভদ্দরলোকেরা অনেকদিন পুষেছিল৷
-পুষেছিলই তো৷
-তাহলে নির্ঘাৎ টিভি-ও অনেক দেখে থাকবি৷
-দেখব না কেন?
-তাহলে একটা বেশ ভালো গল্প বল্ না৷ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ব৷
-টিভির গল্পগুলো একেবারেই ফালতু৷ একটা ভালো গল্প শুনবি তো বলতে পারি৷
-বল৷
বাইরে কারা যেন টহলদারি করছে৷ তাদের বুটের শব্দ কাছে আসে৷ ট্রান্সফরমারের ঘরে টর্চের আলো পড়ে৷ টহলদাররা চলে যায়৷ পাঁজর-ভাঙা কুকুরের গোঙানির আওয়াজটা ওদের কানে যায়নি৷ ওদের বুটের আওয়াজটা দূরে মিলিয়ে যাওয়ার পরে বাহান্ন বলল-
-জিপসি!
-কী?
-তুই বরং গল্পটা জোরেই বল৷ যারা জেগে আছে তারা সকলেই শুনবে৷ আমারও শুনতে ইচ্ছে করছে৷
-দাঁড়া৷ তাহলে উঠে বসে বলি৷ আমাদের এই গল্পটার নাম হচ্ছে ‘ক্ষুধার্ত কুকুর’৷ এক মস্ত বড়ো রাজা ছিল৷
-উফ্, ফের সেই রাজা-গজা৷
-শোনোই না, কী হয় তারপর৷ সেই রাজা ছিল অসম্ভব অত্যাচারী৷ বিনা কারণে অত্যাচার করাতেই সে আনন্দ পেত৷ তা একবার হল কী, বুদ্ধদেব সেই অত্যাচারী রাজার রাজ্যে এলেন৷ সেই রাজা তখন বুদ্ধকে বলল, হে তথাগত, তুমি কি আমাকে এমন শিক্ষা দিতে পারো যাতে করে আমার মনটা অন্যভাবে ভাবতে পারে? বুদ্ধদেব তখন বললেন, আমি তোমাকে ‘ক্ষুধার্ত কুকুরের’ গল্পটা বলছি৷ মন দিয়ে শোনো-
এক ছিল অত্যাচারী সম্রাট৷ তাকে শিক্ষা দেবার জন্য ইন্দ্র শিকারি সেজে তার রাজ্যে এলেন৷ সঙ্গে ছিল ভীষণ এক বিশাল কুকুরের রূপে মাতালি রাক্ষস৷ শিকারি আর কুকুর সম্রাটের প্রাসাদে ঢুকল৷ কুকুরটা এমন জোরে ডাকতে লাগল যে গোটা প্রাসাদটা ভিত্ অবধি থরথর করে কেঁপে উঠল৷ সম্রাট তখন সেই শিকারিকে ডেকে ওই ভয়াবহ ডাকের কী কারণ তা জানতে চাইল৷ শিকারি বলল, ওর খিদে পেয়েছে তাই ডাকছে৷ ভীত সম্রাট তখন কুকুরকে খেতে দিতে বলল৷ পুরো রাজবাড়ির সব খাবার শেষ হয়ে গেল৷ কুকুরের ডাক থামে না৷ সম্রাটের খাদ্য-ভাণ্ডার শেষ হয়ে গেল৷ কিন্তু কোথায় কী? সম্রাট তখন বলল, এই ভয়াবহ জানোয়ারটার খিদে কি কিছুতেই মেটানো সম্ভব নয়? শিকারি বলল, না যতক্ষণ না ও ওর শত্রুদের মাংস, হাড়, সব চিবিয়ে না খাবে ওর খিদে মিটবে না৷ সম্রাট তখন বলল, কারা ওই বিশাল কুকুরের শত্রু? শিকারি বলল, এই রাজ্যে যতদিন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে ততদিন ওর ডাক বন্ধ হবে না এবং গরিবদের ওপরে যারা অত্যাচার করে, অন্যায় করে তারাই হল ওর শত্রু৷ ভীত সম্রাট তখন নিজের কুকর্ম সম্বন্ধে সচেতন হল এবং প্রজাদের ওপরে জুলুম করা বন্ধ করল৷
গল্পটা শেষ করে বুদ্ধদেব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া সেই রাজাকে বললেন, যখনই শুনবে যে ওই কুকুরাটা ডাকছে তখনই বুদ্ধের শিক্ষার কথা মনে কোরো৷ এতে করে তোমার ভালো বই মন্দ হবে না৷
গল্পটা শেষ হওয়ার পরে সকলেই চুপ করে ছিল৷ বাহান্ন বলে উঠল, -গল্পটা খুবই ভালো৷ কিন্তু আমার কথা একটাই৷ আমাদের ওপরে যে নিষ্ঠুর অত্যাচার চলছে তা বন্ধ করার কি কোনো উপায়ই নেই? বুদ্ধদেব, ইন্দ্র, মাতালি অথবা অন্য কেউ কি আমাদের হয়ে একটাও কথা বলবে না?
কান-গজানো হঠাৎ চিত্কার করে ডেকে উঠল৷ সবাই চমকে গেছে৷
-আমি শুনতে পাচ্ছি৷
-কী!
-অনেক কিছু হচ্ছে, একই সঙ্গে৷
-কী? কী হবে?
-বলো!
-চুপ করে থাকিস্ না৷
-ম্যাঁও৷
-বলছি৷ ছায়া-কুকুরেরা এবার দৃশ্যমান হবে৷ ওরা যাকে পাঠিয়েছিল সে বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে৷
বাইরে বিদ্যুৎ চমকাল৷ আকাশ চিরে বাজ পড়ার শব্দ হল৷ বৃষ্টি নামল৷ ঘেউ! ঘেউ!
-কে বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে?
কান-গজানোর ওপরে কিছু একটা ভর করেছে৷ তা না করলে সে এসব কথা জানবে কী করে? কিন্তু সর্বশক্তিমান বিজ্ঞান কি ভর মানে? না৷ বিজ্ঞান ভর না মানলেও আবেশ মানে৷ না মানলেই বা কী এসে গেল?
-বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে অনুবিস৷
-অনুবিস?
-হ্যাঁ, অনুবিস৷ পোড়ামাটির র- তার গায়৷ তার প্রতীক হল পাথরের শবাধার বা কাঠের কফিন৷ অনুবিস হল সেই মিশরীয় হাউন্ড যে এ-পৃথিবী থেকে পরবর্তী বিশ্বে যাতায়াত করতে পারে৷ অবশ করে দেওয়ার জাদু সে জানে৷ সে হারানো জিনিস খুঁজে দিতে পারে৷ আত্মা বা ‘বা’- কে সে রক্ষা করে৷ রহস্য উন্মোচনকারী নপথিস বা বিচারক ওসাইরিসের কাছে সে প্রার্থীকে নিয়ে যায়৷ অনুবিস বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে৷ বাইরে যে ঝড় উঠছে দেখছ তা হল বার্তা পেয়ে ছায়া কুকুরদের উল্লাস৷
-কিন্তু কী আছে সেই বার্তায়?
-জানি না৷ তবে আমাদের জন্যে নির্দেশ আসছে৷
-কে আনছে?
-বাদামী৷ আমি তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ বাদামী আসছে৷
ছায়া-কুকুররা দৌড়চ্ছে৷ বিদ্যুৎ চমকালে তাদের ছায়া গোটা শহরের ওপরে চমকে উঠছে৷ ওই তো সবার আগে দৌড়চ্ছে লাইকা৷ তার পেছনে ভেলু৷ পাশে দৌড়চ্ছে কারা? ওরা হল শ্মশানের কুকুর৷ কালু, ভুলু, জামভোলা, বড়োশ্বেতফুল, মড়িমা, সাবলিদিদি, বুড়োবাবা, বুড়িমা, ছোটোশ্বেতফুল, দুর্গা, পদি, হরির মা, থরথরি, ফুলটুসি, হরহরি, বাঘা, রাঙ্গুবাবু – সবাই দৌড়োচ্ছে৷
কান-গজানো ভুল বলেনি৷ সারা গা চুপচুপে ভিজে৷ সমস্ত লোম লেপটে রয়েছে সারা গায়৷ বাদামী এল৷
-সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?
-সবাই আছি৷ ঠিকই আছি৷
-আজ মাঝরাতে, সবাই মন দিয়ে শোনো, হঠাৎ তোমরা দেখতে পাবে যে কুকুরদের একটা বিশাল দল কাছে আসছে৷ তোমরা শয়ে শয়ে পায়ের শব্দ পাবে৷ পেলেই তোমরা বেরিয়ে আসবে৷ -কোথায়?
-রাস্তায়৷ তারপর সেই দল যেদিকে যাবে তোমরাও চলতে থাকবে৷ মোদ্দা কথা আমাদের কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে যেতে হবে৷
-কোথায় যাব আমরা?
-দূরে৷ অনেক দূরে৷ আর শোনো, সবাইকে ছুটতে হবে৷ দরকার হলে পালা করে বাচ্চাদের মুখে নিয়ে ছুটতে হবে৷ যারা দুর্বল, অসুস্থ বা চোট পেয়েছে তাদেরও সঙ্গে কাঁধ লাগাতে হবে৷
-অনুবিস কী বার্তা এনেছে তুমি জানো?
-তুমি অনুবিসের কথা জানলে কী করে?
-কী করে তো বলতে পারি না৷ কেমন একটা ভরের মতো হয়েছিল৷
-কী বার্তা সেটা আমিও জানি না৷ আমাকে যতটা জানাতে বলা হয়েছে ততটাই আমি বললাম৷
-এখন তুমি কোথায় যাবে?
-আমি? আমাকে এখন অনেকগুলো জায়গায় খবর দিতে হবে৷ আমি বরং আর সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যাই৷
বাদামী তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল৷
বাহান্ন একবার ফাঁকায় বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকাল৷ অন্ধকার ফুঁড়ে লক্ষ লক্ষ তির হয়ে বৃষ্টি নামছে৷ বাহান্ন ঘরে ফিরে এল৷ জিপসি বলল,
-আমরা সবাই যাব কিন্তু পাঁজর-ভাঙা আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না?
-কেন?
-গোঙাচ্ছিল৷ কোনঞ্জ ফাঁকে মরে গেছে আমরা বুঝতে পারিনি৷