লুব্ধক – ৮
৮
উজ্জ্বল সূর্য গিয়েছিল নিভে, আর তারারা
অনন্ত মহাশুন্যে অন্ধ হাতড়ে বেড়ায়,
রশ্মিহীন ও পথবিহীন এবং বরফ পৃথিবী
দৃষ্টিহীন, কৃষ্ণতর, চন্দ্রবিহীন আকাশে;
সকাল আসে ও যায়, ফের আসে,
কিন্তু আনে না কোনো দিন…
-জর্জ গর্ডন বায়রন
সাত ঘন্টা, মাত্র সাতটা ঘন্টা আর বাকি আছে৷ সাত ঘন্টা মানে চারশো কুড়িটা মিনিট৷ খুব একটা অভাবনীয় মাপের কিছু নয়৷ মাত্র পঁচিশ হাজার দুশোটা সেকেন্ড৷ সময়-এর এই খণ্ড দৌড়ে পেরিয়ে যেতে একটা ঘুমই যথেষ্ট৷ তবে পুরোটাকে ঘুম বলা যাবে না৷ খুব সামান্য সময়ের জন্যে হলেও দু-একটা স্বপ্ন দেখতে হবেই৷ মোটের ওপর সাত ঘন্টার অপেক্ষা৷ আর ঘুমোতে যে হবেই বা ঘুম যে আসবেই এমন কোনো কথা নেই৷ ঘেউ! ঘেউ!
আগেই জানানো হয়েছে যে তিনটি পিঁজরাপোলই খুলে দেওয়া হয়েছিল৷ এর মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর পিঁজরাপোলে বলতে গেলে সব কুকুরই মরে গিয়েছিল৷ পিঁজরাপোল-১-এ যে প্রার্থনার ও বুড়ো কুকুরেরা ছিল তারা কিন্তু সশব্দে দরজা খুলে দেওয়ার দিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি৷ চড়া আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে ও বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করে তাদের সচকিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ শেষ সময়টাতে কী ঘটেছিল তা জানা যাবে না কিন্তু আন্দাজ করা যায় যে অন্তিম সাত ঘন্টা তারা তাদের জায়গা ছেড়ে নড়েনি৷ শেষ মুহূর্তে তারা একসঙ্গে হেসে উঠেছিল কি না হদিশ করার আর কোনো উপায় নেই৷
কুকুরেরা কলকাতা থেকে সরে যাচ্ছে৷ কারণ সেরকমই নির্দেশ এসেছে তাদের ওপর৷ কলকাতা বাঁচবে না৷ কলকাতা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ ডোগোনরা জানে যে কুকুর-তারা লুব্ধক তার অমোঘ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু অসভ্য ডোগোনদের সঙ্গে সভ্য কলকাতার কোনো যোগাযোগ নেই৷ সেই নির্মম সিদ্ধান্ত সম্মতি পেয়েছে তার যুগ্ম অংশ সাদা বামন সিরিয়াস-বি-র৷ লুব্ধকের ব্যাস ৪৮ লক্ষ কিলোমিটার৷ সূর্যের ব্যাস ১৪ লক্ষ কিলোমিটার৷ লুব্ধকের র- নীলচে সাদা৷ তার প্রভা সবার চেয়ে বেশি -১.৪৫৷ ছোটো কুকুরমণ্ডল বা ক্যানিস মাইনর৷ এই তারামণ্ডলে রয়েছে প্রশ্বন৷ পৃথিবী থেকে প্রশ্বনের দূরত্ব ১১.৩ আলোকবর্ষ৷ সে-ও জানিয়ে দিয়েছে যে লুব্ধকের সিদ্ধান্ত সঠিক৷ বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের সবকটি তারাকে নিয়ে যে-কুকুর সে হল কালপুরুষের সঙ্গী৷ কালপুরুষও সম্মত হয়েছে৷ এবং লুব্ধক হিংস্র কুকুরকে লেলিয়ে দেবার সেই শব্দটিই উচ্চারণ করেছে – লুঃ
এবং সেই শব্দে উত্তেজিত হয়েছে একটি গ্রহাণু, নেমে আসছে কলকাতার ওপর৷ কোনো ওজর, কোনো প্রার্থনা, কোনো আপিল তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না৷ ঘেউ! ঘেউ!৷
৬৫ মিলিয়ন বছর আগে ১০ কিলোমিটার মাপের একটি গ্রহাণু বা অ্যাস্টেরয়েড পৃথিবীর ওপরে আছড়ে পড়েছিল এবং সেই মহাবিস্ফোরণে ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ গোটা পৃথিবী থেকে৷ আগেই বলা হয়েছে এরকম মহাধ্বংস, মহাসংহার ৪৫০, ৩৫০, ২২৫, ১৯০ মিলিয়ন বছর আগেও হয়েছিল৷ ১৯৮৯ সালে পৃথিবীর কক্ষপথে ১০০০ মিটারের একটি গ্রহাণু এসেছিল৷ মাত্র ৬ ঘন্টা আগে পৃথিবী সেখানে ছিল৷ ১৯৯৬-এর মে মাসে ওই একই মাপের একটি গ্রহাণু মাত্র ৪ ঘন্টার জন্য পৃথিবীকে আঘাত হানতে পারেনি৷
কলকাতার ওপরে যে হিংস্র কুকুরটিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে সে ঘন্টায় ১ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসছে৷ তার মাপ ও ওজন এখনই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না৷ উন্মত্ত কুকুরটি কলকাতার ওপরে আছড়ে পড়ে ভস্ম হয়ে উবে যাবে, কিন্তু যে মহা-গহ্বরটির সৃষ্টি হবে তা কুকুরটির ব্যাসের দশগুণ এবং গভীরতা দুগুণ৷ কুকুরটির যা ওজন তার থেকে একশো গুণেরও বেশি পাথর সে আকাশে উড়িয়ে দেবে৷ প্রথম আঘাত ও বিস্ফোরণের পর কয়েক লহমা কোনো বাতাস থাকবে না৷ চাপা আগুন হয়ে ধক্ ধক্ করে জ্বলবে কলকাতা৷ তার পরই আসবে লক্ষ ঝড়ের শেষ নিশ্বাস৷ দাউ দাউ করে জ্বলে, গলে, পুড়ে, ছাই হয়ে খাক্ হয়ে যাবে কলকাতা৷ এর পরে ধুলোর মেঘ বর্মের মতো সূর্যকে আড়াল করবে৷ কতদিন সেই হিমরাত্রি থাকবে তা বলা যাবে না৷ ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস ২০০ সেন্টিগ্রেডে নেমে যাবে৷ এবং অনেক মাস ধরে হিমাঙ্কের নিচেই থাকবে৷ প্রলয়ান্ধকারে কলকাতাকে ঢেকে রাখবে প্রলয়মেঘ৷ এই নির্মম ভবিষ্যদঞ্জবাণী মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে করতে কুকুর-উপকথা ‘লুব্ধক’ তার অন্তিম পর্বে পৌঁছিয়েছে৷ কলকাতা এখন এক অসাড়, অপেক্ষমান পিঁজরাপোল৷ তার শাস্তি মৃত্যু৷
তবে হাতে তো এখনও সাত ঘন্টা সময় রয়েছে৷ ঘেউ! ঘেউ!
***