সোনার কৌটো – ৬
৬
বিকেলে ননী মাঝখানে পাতা ওই বেঞ্চিতে একটু বসতে পায়, মাঝে মাঝে বিড়ি টানতে টানতে কোন পরিচিত খদ্দেরের সঙ্গে সুখ—দুঃখের কথাও কইতে পায়।
অনেকেই বলে ননীকে, ‘তোমার এই দোকানে যদি সকালের দিকে অন্তত আলুর চপ আর পেঁয়াজি রাখো ননী, পড়তে পাবে না। দেখবে ওই তেলেভাজার দৌলতেই তোমার টালিঘরখানি কোঠাঘর হয়ে যাবে—’
ননী এসব সুপরামর্শ কানে নেয় না।
বলে, ‘না দাদা, যা আছে তাই ভালো। চা চিনি আর গুঁড়ো দুধ, এসব তো মজুতই থাকে, বিস্কুটও মজুত রাখি টিন বোঝাই করে, আর ওই বিড়ি। ব্যস হয়ে গেল! ওই সব গরম মাল যোগান দিতে গেলেই ভেস্তে যাবো! হাতছাড়া আম হয়ে সুখ নেই।’
তারপর হয়তো তেমন পরিচিত জন কেউ হলেই উদাস উদাস গলায় বলে, ‘আর অধিকে দরকারই বা কী দাদা? কার জন্যে কী!’
বছর কয়েক হল ননীর বৌটা মারা গেছে রেল হাসপাতালে, মেটার্নিটি ওয়ার্ডে। জ্বলজ্যান্ত বৌটা গেল আর মরে গেল। তদবধি ননীর কণ্ঠে এই বৈরাগ্যের সুর।
তবু হিতৈষীরা বলে, ‘কেন ননী, তোমার যখন পুষ্যি রয়েছে ঘরে, নিজের দুটো মা—মরা গুঁড়োও রয়েছে, তখন সবই প্রয়োজন।
ননী সংক্ষেপে বলে, ‘সব শালা বেইমানের ঝাড়। কারুর জন্যে করার মন নেই দাদা! খেতে পরতে দেওয়াটা ডিউটি, সেটা দিয়ে যাচ্ছি ব্যস।’
অবিশ্যি ননীর ‘পুষ্যি’দের মধ্যে যার মুখটা বেশী সে এমন কথা শুনলে বলে, ‘ওই গরবেই গেল মামা। দিচ্ছে অবিশ্যি যোগান, তবে কেমন ভাত কেমন কাপড় সেটাই হচ্ছে কথা।’
ওই মুখটাকে ননী একটু ভয় করে, আর কিছু না। তবে কেউ যদি ননীকে সহযোগিতা না করে, ননীই বা কার? কারো নয়।
ননী ওই চা—বিস্কুট সাপ্লাই করেই যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট, আর সন্তুষ্ট তার বন্ধু—বান্ধবদের সুব্যবহারে। সুখেন, রাজেন, জগাই এরা তার কে? কেউ না। বাংলা মুলুক ছেড়ে যখন, কে জানে কার জুতোর ঠোক্কর খেতে খেতে, ছিটকে এসে বেহারের এই রেল স্টেশনের ধারে এসে পড়েছিল, তখন না জানত হিন্দী, না চিনত একটা লোককে।
ঢের লোকই হিন্দী জানে না, তবু হিঁয়াসে হুঁয়াসে করে চালিয়ে নিতে পারে, ননী পারত না। সেই দুরবস্থার সময় কোথা না কোথা থেকে এই তিনটে স্বজাতির সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। তারা হিন্দীতে চৌকস, আবার বাংলা কথা বলে প্রাণ কান জুড়িয়ে দেয়।
ননী তাদের আঁকড়ে ধরেছিল।
সেই বন্ধন এখনো অটুট আছে।
ননী ছাড়েনি, ওরাও বেইমানি করেনি। যেটা করেছিল ননীর নিজের সহোদর ভাই ফণী।
নিজে একটু দাঁড়িয়ে পড়ে গ্রামে গিয়ে অগাবগা ভাইটাকে নিয়ে এসেছিল ননী, তার সঙ্গে ভাত রাঁধতে বিধবা দিদি পদ্মকে।
পদ্মকে আনার অন্য উদ্দেশ্যও ছিল।
ঘরে একটা মেয়েছেলে না থাকলে, বিয়ের কথা কে তুলবে? নিজে নিজে দুম করে একটা বিয়ে করে বসলে, তাতে কখনো বিয়ে বিয়ে স্বাদ আসে? আর সত্যি বলতে, ভাল ঘর থেকে তেমন সম্বন্ধও আসে না। শুধু একটা চায়ের দোকানদার? সন্দেহের চোখে তাকায়।
এ বাবা বিধবা দিদি আছে সংসারে, ছোট ভাই আছে যাকে বলে একটা গেরস্থ! লোকে মেয়ে দিতে এগিয়ে আসবে।
তা অবিশ্যি ক্যালকুলেশনে ভুল হয়নি ননীর, ভাল ঘরের মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল তার। আর তারা ওই দিদি পদ্মকে দেখেই আশ্বস্ত হয়ে বিয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে। কনক ওই দিদিরই দূর সম্পর্কের ভাসুরঝি না দেওরঝি।
গুণের তুলনা ছিল না কনকের।
ননীর ভাগ্যে সইল না। বাচ্ছা দুটো ছেলেমেয়ে রেখে হুট করে মরে গেল। দিদি অনেক বলেছিল, ‘এই বয়সে কে আবার বৌয়ের জন্যে সন্নিসী হয়? আর একটা বে কর।’
ননী দুই হাত তুলে দুটো কান মলেছে।
না, আর নয়।
বড় দাগা বেজেছে প্রাণে।
ননী দিদিকে জ্ঞানের কথাও শুনিয়েছে—’কপালে সুখ থাকলে ওই বৌই টিঁকে থাকত! যাবেই বা কেন? সুখ কপালে নেই বলেই—
আবার বিয়ে করলে সে বৌও যে মরবে না তার গ্যারাণ্টি আছে? তাছাড়া সে তোমায় কাকী বলে মানতো, দ্বিতীয় পক্ষ এসে যদি ধিঙ্গী অবতার হয়, যদি তোমায় না মানে?’
পদ্ম বলেছে, ‘সেটা তোমার হাতে। তুমি পুরুষ ছেলে যদি পরিবারকে ঢীট করতে না পারো, তাহলে তোমাকেই ধিক।’
ননী উদাস গলায় বলেছে, ‘একটা অপর বাড়ির মেয়েকে ডেকেডুকে নিয়ে এসে তাকে ঢীট করতে বসবার আমার দরকার কি? ইচ্ছেও নেই, শক্তিও নেই।’
দিদি শেষ চেষ্টা হিসেবে বলেছে, ‘আমি কি চিরকাল তোমার মা—মরা ছেলে—মেয়ের কন্না করব?’
ননী আরো উদাসভাবে বলেছে, ‘করতে বেজার ধরলে কোর না। অনাথ আশ্রমে চালান করে দেব দুটোকে।’
‘বাপ থাকতে ওদের অনাথ বলবি?’
‘বলতে কী? তোমরাই তো বল মা মরলে বাপ তালুই। তা সেই সম্পর্কই বলব।’
দিদি বলেছে, ‘তোকে বিয়ের কথা বলতে আসা আমার ঝকমারি।’
‘আর ততোধিক ঝকমারি বৌ মরলে আবার বৌ আনা।’ ননী বলেছে, ‘বেদে পুরাণে শুনেছ কখনো সৎমা এসে কন্না করেছে?’
‘শুনব না কেন, ঢের শুনেছি—’
তর্কের খাতিরে জোর দিয়েছে পদ্ম।
ননী বলেছে, ‘তোমার কপাল ভাল। তাই তেমন দেবীদর্শন হয়েছে। আমার সঙ্গে তো পরিচয় ধ্রুবর বাপ রাজা উত্তানপাদের দ্বিতীয় পক্ষ সুরুচি রাণীর, পরিচয় মহারাণী কৈকেয়ীর, আর রূপকথার সুয়োরাণীদের। ওনাদের তো দূরে থেকে নমস্কার! হ্যাঁ তোমার কষ্ট, তা তোমার আয়েসের কপাল হলে ফণী রাস্কেলটা এমনটা করত না। আজ তার বিয়ে দিয়েই তো ঘরে বৌ এনে আয়েস করতে পারতে।’
তা ফণীকে রাস্কেল বলা যায়।
সবে যখন ননীর দোকানটি জাঁকিয়ে উঠেছে, এবং ফণীও জোয়ান হয়ে উঠেছে, ননী স্বপ্ন দেখছে ফণী তার ডানহাত হয়ে উঠবে এইবার, হঠাৎ একদিন ফণী হাওয়া। আর তার সঙ্গে হাওয়া ননীর বাক্সের টাকা, আর নতুন বৌয়ের গহনা ক’টা।
বেশী না হোক, তবু ছিল কিছু।
হারটা, বালাটা, কানফুলটা।
পদ্ম তার জ্ঞাতি দেওরকে মোচড় দিয়ে বাগিয়েছিল। তার এক কুচিও রেখে যায়নি।
ননী বাঘের মত গর্জন করে বলেছিল, ‘ওই হতভাগাকে আমি জেলে দিয়ে ছাড়ব। যাচ্ছি থানায় ডায়েরী করতে—’
নতুন বৌ হাত ধরে মিনতি করে বলেছিল, ‘দোহাই তোমার, ঘরের কেলেঙ্কারি প্রকাশ করে লোকের কাছে মুখ হাসিও না।’
এবার ননী কেঁদে ফেলেছিল, ‘তোমার সর্বস্ব নিয়ে গেল, আমার কী ক্ষ্যামতা আছে যে আবার গড়িয়ে দেব?’
‘থাক আমার গয়নার দরকার নেই!’ বৌ নরম চোখ দুটি তুলে বলেছিল, ‘মেয়েমানুষের স্বামীই সর্বস্ব, গয়না কাপড় নয়। তুমি আমায় শহরের দোকান থেকে কেমিকাল সোনার গয়না কিনে দিও।’
‘সোনা হারিয়ে কেমিকেল পরবে কনক?’
কনক অম্লানবদনে বলে, ‘তাতে কি? ও বরং চোরে নেবে না, অথচ পরতে বাহার! আমাদের বর্ধমানে কত কত বড়মানুষের বৌরাও পরে। দু’খানা সোনার সঙ্গে পাঁচখানা কেমিকেল সোনা।’ কেউ কিছু বলতে যায়?’
ননী মৃদু হেসেছিল, ‘বড়লোকের বৌকে কেউ কিছু বলতে যাবে না। কিন্তু ননী দাসের বৌকে বলবে।’
‘বলুক, গায়ে ফোসকা পড়বে না।’
বাইরের চোরে নিলে শুধু লোকসান, লজ্জা অপমান নেই, ঘরের চোরে নেওয়ায় লোকসানের সঙ্গে সেটাও থাকে। সেই জ্বালায় জ্বলে ননী প্রতিজ্ঞা করল, ‘ও ফিরে আসুক, আমি যদি আবার ওকে বাড়ি ঢুকতে দিই তোমরা আমার নামে কুকুর পুষো।’
তা ননীর নামে কুকুর পোষা আর হল না কারুর ভাগ্যে। ফণী আর এল না। ননী আরও একটা প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেটা মনে মনে। সেটা হচ্ছে, ‘বৌকে আবার ওই সব গয়না আমি গড়িয়ে দেবই দেব। যতদিনে পারি।’ কিন্তু সে প্রতিজ্ঞাও পালন হল না। যতদিনে পেরে উঠতে পারত ননী, ততগুলো দিন তো দিল না বৌ।
তবে আর ননী কোন উৎসাহে চায়ের দোকানে আলুরচপ আমদানী করে লাল হয়ে ওঠার প্রেরণা পাবে?
তার থেকে সারাদিনের ঝামেলা মিটিয়ে রাত্তিরবেলা এই ভাঙা চৌকির উপর ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে বসে ময়লা তাসের জোড়া ভেজে ভেজে টেয়েনটিনাইন খেলা ঢের ভাল।
ইস্টিশনের ওদিকে চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি, কিন্তু ননীর দোকানে সেই আদি ও অকৃত্রিম হ্যারিকেন লণ্ঠন। চালার বাতায় একটা বাঁকানো শিক গুঁজে রেখেছে ননী, তাতে ওই লণ্ঠনটা ঝুলিয়ে দেয়, আর বলে, ‘কেন’ বিজলীবাতির থেকে আলোটা কী কম হচ্ছে বল? চিমনীর কাঁচটা কেমন সাফ রাখি!’
তা হয়তো রাখে সাফ, তবু দোদুল্যমান আলোর নীচে বসে যারা খেলে, তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই পারে, নতুন কেউ এলে পারত না।
তুলসী তো এলেই বলে, ‘ইলেকট্রিক না আনতে পার, একটা হ্যাজাক কিনতে পার না ননীদা? দোকানটা এমন ভুতুড়ে দেখায় না।’
একমাত্র ননীকেই তুলসী ‘দাদা’ বলে আর সবাইকে স্রেফ নাম ধরে ডাকে।
ননী বলে, ‘এক তুইই ভূতুড়ে বলিস, আর তো কেউ বলে না?’
‘বলে না, তারা সবাই ভূতুড়ে বলে।’
তুলসী যে কোন অধিকারে যাকে যা ইচ্ছে বলে ভগবানই জানে, অথচ বলে দিব্যি পার পায়। অথচ তুলসীর বদনামের শেষ নেই। তুলসী পিছন ফিরলেই সমালোচনা শুরু হয়ে যায়, আর আসছে দেখলেই লোকে গলা নামিয়ে বলে, ‘ওই যে আসছেন। ঢলানি, বাচাল!’ আরো যা বলে, সেটা অনুচ্চারিত থাকে, তবু বুঝতে অসুবিধে হয় না কারুর!
তবু ওই রেলওয়ে কলোনির মধ্যে যতগুলো বাঙালী বাড়ি আছে সব বাড়িতেই তুলসীর গতিবিধি আছে, এবং মজা এই সমাদরও আছে। গেলেই মহিলারা তাকে ‘বোস বোস’ করে চা খাওয়ান, পান জর্দা খাওয়ান এবং এ বাড়ি ও বাড়ির গল্প ফাঁদেন।
তুলসীর কাছে অনেক খবর।
তুলসীর আদি ইতিহাস কি তা কেউ জানে না, ওকে প্রথম যখন এই করণপুরে দেখা যায় তখন ওর বছর দশেক বয়েস।
পরনে একটা বোতামবিহীন সস্তা ছিটের খাটো ফ্রক, মাথায় একমাখা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, ধুলি ধূসরিত হাত—পা।
তবু স্বাস্থ্যটি একেবারে টাইট।
কচিডাবের মতো চাঁচাছোলা মুখ, থোড়ের মত হাত—পা, রং না ফর্সা না ময়লা। যত্নে থাকলে হয়তো ফরসার দিকেই পাল্লা ঝুঁকত? তবু স্বাস্থ্যটি আছে। জিগ্যেস করলে কিছু বলতে চাইত না তুলসী, তবু যাদের খোঁচানো অভ্যেস, তাদের খোঁচানির ফলে এইটুকু জানা গেছে, কোন বাবুরা ফাই—ফরমাশ খাটাবার জন্যে তাকে গ্রামের বাড়ি থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, এবং খরচ—পত্তর করে নিয়ে এসেছিল বলেই সেটা উসুল করবার চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তার সঙ্গে বকুনিটা ছিল ফাউ।
নিরুপায় মেয়েটা খেটেছে, বকুনি খেয়েছে, গ্রামের কথা ভেবে ভেবে কেঁদেছে, গ্রামের সেই কাকা—কাকী যারা তুলসীকে এদের হাতে তুলে দিয়েছিল, মনে মনে তাদের শাপশাপান্ত করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত এদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে তাদের যত পেরেছে জ্বালাতন করতে ধরেছে।
বোঝা গিয়েছে নিরুপায় হলেও অসহায় নয় তুলসী নামের মেয়েটা। সহায় তার ওই বুদ্ধিটি।…একদিন ইচ্ছে করে হাত থেকে ফেলে গিন্নীর সদ্য—কেনা একটা দামী টী—সেট ভেঙে যখন তুলসী ঘাড় বাঁকিয়ে বলেছিল, ‘মারছেন কেন? অসাবধানে হাত থেকে পড়ে যায় না মানুষের? আপনারও যেতে পারত?’—তখনই সেইখানেই মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছিল।
‘বেরো, বেরো আমার বাড়ি থেকে’ বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল গিন্নী। বলেছিল ‘পয়লা নম্বরের বিচ্ছু তুমি, ইচ্ছে করে ভেঙেছ।’
তবু ভাবেনি হয়তো মেয়েটা সত্যিই সেই অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যাবে।
বিদেশ বিভুঁইয়ে যাবে কোথায়?
কিন্তু হারিয়ে যাবার ইচ্ছে থাকলে কি হারিয়ে যাবার জায়গার অভাব হয়? লাইনের এপারে আর ওপারে দু’দিকে কলোনি ইস্ট—ওয়েস্ট। সেখানে এঞ্জিনের ধোঁয়ায় মলিন বিবর্ণ ইঁটের পরে ইঁট গাঁথা জুতোর দোকানের জুতোর বাক্সর মত যে কোয়ার্টারের সারি, তার মধ্যে কোন একটা খোঁজে কোন একটা মানুষকীট যদি গুঁজে গিয়ে ঢুকে থাকে, কে তাকে খুঁজে বার করবে?
তাছাড়া খোঁজায় তো অসুবিধাও আছে।
যতই মেয়েটার পাজীমো বদমাইসি বিচ্ছুমির কাহিনী ফলাও করে বল, মেয়েটার বয়েস শুনলেই লোকের সহানুভূতির ঢল তার দিকেই নামে।
মুখের ওপরই বলে, ‘গাঁ—ঘরের মেয়ে আপনার জন ছেড়ে এসেছে, মন টেঁকেনি আর কী। হয়তো দেশে ফিরে যাবার চেষ্টাতেই পালিয়েছে।’
মুখের রেখায় যেটা বলে, সেটা হচ্ছে, নিষ্ঠুরের মতন অত্যাচার করেছ, তা নইলে ওইটুকু মেয়ে সাহস করে পালায়? মরীয়া হয়েই পালিয়েছে।…লোকে ভাংচি দিয়ে ভাঙিয়ে নিয়েছে তাই বা কি করে বলা যায়? তোমাদের সঙ্গে ছাড়া একা তো যেতে দিতে না কোথাও।’
এসব কথা লোকে একদিনে জানেনি, দিনে দিনে কথায় কথায় জেনেছে। কেউ যখন জিগ্যেস করেছে, ‘পালাবার জন্যে জ্বালাতন করেছিস? তুই তো খুব সাংঘাতিক মেয়ে!’ তুলসী হেসে হেসে বলেছে, ‘হ্যাঁ দেশে কাকী বলত ‘ধানিলঙ্কা।’
সেই ধানিলঙ্কা তুলসী দশবছর বয়েস থেকেই পুরো স্বাধীন। নিজেই নিজের মালিক। লোকের বাড়ি চাকরী করেছে নিজে মাইনে ঠিক করে, কাজ ঠিক করে। একটুকরো কাজ বেশী করবে না। বরং অন্যের বাড়িতে গিয়ে অমনি কাজ করে দিয়ে আসবে, তবু নিজের মনিব—বাড়ি এতটুকু বেশী নয়।
অতএব এই ঘর—জ্বালানে পর—ভোলানের এক জায়গায় বেশী দিন আশ্রয় জোটেনি। কিন্তু তুলসী হেসে হেসে বলেছে, ‘ভালই তো! বেশ নিত্যি নিত্যি নতুন নতুন গিন্নী—কর্তা দেখছি, নতুন নতুন দাদাবাবু—দিদিমণি দেখছি।’
সে সব অবিশ্যি তামাদি কালের কথা। সেই দশবছরের মেয়েটা এখন কোন না আটাশ—তিরিশের হয়ে উঠেছে। গড়ন আরো টাইট, মুখ তেমনি ডাবের মত চাঁচাছোলা, শুধু চুল তেল—জবজবে, হাত—পা মাখন—বুলানো।
তুলসী আর লোকের বাড়ি কাজ করে বেড়ায় না, রেল হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে আয়ার কাজ করে। নিজের চেষ্টায় শিখেছে তুলসী; নিজের চেষ্টায় কাজ জুটিয়েছে।
তুলসীর কাজের গুণে, একটা বেলাও বসে থাকতে পায় না তুলসী। যাদের আয়া রাখবার ক্ষমতা নেই, তারাও লোভে পড়ে পাঁচটা ছ’টা দিন তুলসীর হাতের সেবা খেয়ে নেয়।
এখন তুলসীর এই করণপুরে রীতিমত প্রতিষ্ঠা।
‘তুলসীর বিয়ে হল না’, ‘ঘর সংসার হল না’, একথা কেউ কোনদিন ভাবেনি। তুলসী যেন ধাপে ধাপে সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে গেছে, সেটার জন্যেই তুলসী মহিমান্বিতা।
কেউ বলতে পারবে না কেউ কোনদিন তুলসীর সাহায্যের জন্যে একটি আঙুল নেড়েছে। চাকরী থেকে বরখাস্ত করে দেবার ইতিহাসই ঘরে ঘরে।
তবে রেল কোয়ার্টাসের বাসিন্দারা চিরস্থায়ী নয়। কেউ বদলি হয়ে যায়, কেউ রিটায়ার হয়ে যায়, নতুন যারা আসে তারা তুলসীকে এই মূর্তিতেই দেখে। ওর আদি ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামায় না।
অতটুকু বয়েস থেকে নিজে নিজের জীবনের মালিক হওয়ার মধ্যে দুঃখ যদিও বা কিছু থাকে, সুখটা অনেক বেশী। তুলসী সেই সুখের স্বাদ পেয়ে গেছে বলেই হয়তো আর মাথার ওপর ছাতার অভাব অনুভব করেনি।
ছাতা মানেই তো শাসনকর্তা।
ছাতা মানেই মাথা। মালিক।
দরকারটা কি? আহার আছে, আশ্রয় আছে, প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি আছে, আর কি চাই?
বিয়ে করলে, সংসার হলে, এমন সচ্ছন্দ বিচরণের সুখ পেতো তুলসী?
একটা শাসনের মুঠো থেকে পিছলে বেরিয়ে এসে যে জীবনটাকে সে নিজে গড়ে নিয়েছে, সেটাকে এমন তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করবার সুখটা পেতো? লোকে তার চলন—বলন ধরন—ধারন ঠাঁট—ঠমকের সমালোচনা করে, আর কিছু বলুক দিকি গলা তুলে? তা বলতে হয় না। ওটুকু লোক—নিন্দে তুলসী গায়ে মাখে না, পায়ের তলায় মাড়ায়।
লোক—নিন্দের ভয় থাকলে আর তুলসী রাত দশটায় এই চায়ের দোকানের তাসের আড্ডায় এসে হাজির হত না।
অনেক ভোল পাল্টাতে পাল্টাতে তুলসী এখন বাবুদের বাড়ির বৌ—ঝিদের ভোল ধরেছে। তুলসীর গায়ে কাট—ছাঁটের রঙিন ব্লাউজ, তার সঙ্গে শৌখিন ধাঁচে পরা হালকা ছাপা ছিটের শাড়ি, পায়ে চটি। হাতে চুড়ি ফুড়ির পাট নেই, একগাছা করে সরু বালা। আগে হাত—ভর্তি কাঁচের চুড়ি পরত, আয়ার কাজের অসুবিধে হয় বলেও সব ছেড়েছে। তুলসীর মাথার চুল টান করে খোঁপা বাঁধা, তেল—চকচকে, তবু কপালের ওপরকার চুলগুলো ঠিক ঝুরো হয়ে উড়ছে। যেমন সেই ছোটবেলায় রুক্ষুমাথায় উড়ত। যা দেখে লোকের তার ওপর কেমন যেন একটা মায়া এসে যেত, দুষ্টু জেনেও।
রাস্তার ওপর কোথা থেকে যেন কিছু আলো এসে পড়েছে, তুলসীকে দূর থেকেই দেখা গেল। যারা তাসে নিমগ্ন, তাদের হয়তো দেখতে পাবার কথা নয়, কিন্তু ঠিক সেই সময়েই সুখেন অন্যের তাস দেবার অবসরে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলছিল, ‘রাত কত হল? বেশী দেরী হলে বাড়িতে গ্যাজগ্যাজানি শুনতে হবে।’
বাড়ি বলতে সুখেনের অকালবুড়ো বাপ আর হাড়—জ্বালানো পিসি। কিন্তু সুখেনই বেশী ব্যস্ত হয়।
কথাটা বলেই সুখেন গলা নামিয়ে বলে, ‘ঢঙিনী আসছেন!’
সবাই চকিত হয়ে তাকাল।
রাজেন নীচু গলায় বলল, ‘আজ আর নাইট ডিউটি নেই বুঝি?’
‘নেই বোধহয়।’
‘খেলাটা মাটি করতে এলো’, বলল জগু, এবং ননীও একটা বিরক্তি—সূচক আঃ করল। অথচ আশ্চর্য, সকলেরই মনের মধ্যে যেন একটা ভাল লাগা ভাল লাগা ভাব খেলে গেল।
মন জিনিসটা এমনি অদ্ভুতই বটে!
ভাল লাগা আর ভাল না লাগাটা একাধারে এসে বসে!
তবু ওরা না দেখার ভান করল।
নিজের তালে তাস কুড়োতে লাগল।
তুলসী সামনে পাতা বেঞ্চি দুটোর পাশ কাটিয়ে দোকানে উঠে এসে মাজা ঘষা গলায় বলে উঠল, ‘সেই টোয়েনটিনাইনই চালাচ্ছিস তো? না, তোরা আর সাবালক হলি না কোন কালে।’
সুখেনের সঙ্গেই লাগে বেশী। সুখেন বলে, ‘তা তোর কী নির্দেশ? জুয়ো খেলতে হবে?’
‘ও ছাড়া আবার কেউ খেলে নাকি?’
‘ওসব বাবু ভদ্দরলোকদের খেলা—’ রাজেন বলে, ‘আমাদের জুয়োর বাজি ধরবার পয়সা কোথায়?
‘ও থেকেই পয়সা আসে, তুলসী চৌকিটার একধারে বসে পড়ে বলে, ‘চা সব ফুরিয়ে ফেলেছিস? কি গো ননীদা?’
‘তা, তুই আসছিস আমি জানতাম?’
‘জানা উচিত ছিল।’
‘হাত গুণতে তো জানি না।’
‘তাও জানতে হয়।’
তুলসী হাত বাড়িয়ে বলে, ‘কার পকেটে সিগ্রেট আছে একটা ছাড় দিকিন!’ প্যাণ্ট—শার্টই এখন জাতীয় পোশাক, অতএব সুখেন, রাজেন, জগাই তিনজনেই প্যাণ্টের পকেটে হাত পুরে একটা করে বিড়ি বার করে এগিয়ে ধরল। ননীর পরনে ধুতি গেঞ্জি, ওর পকেট নেই।
‘বিড়ি?’
নাক কোঁচকালো তুলসী, ‘মানুষের মতন হবার যদি কোন বাসনা থাকে তোদের! যা শিখেছিস তাই।’
তুলসী নিজের হাতে ঝুলানো ব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে তা থেকে তিনটে সিগারেট বার করে তিন জনের দিকে এগিয়ে ধরে বলে, ‘নে খা! ভাল জিনিস কাকে বলে দেখ।’
সাগ্রহে লুফে নিয়েও ওরা ঠোকা দেওয়া গলায় বলে উঠল, ‘তুই এখন পয়সাওলা মানুষ। ভাল জিনিস কাকে বলে দেখাবি বৈকি।’
তুলসী ততক্ষণে নিজে একটা ধরিয়ে টান দিয়ে প্যাকেটটা ননীর দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘ননীদা চলবে?’
ননী নেয় না, গম্ভীর গলায় বলে, ‘ভাল জিনিস গরীবের পেটে সয় না। যার খাবার সে খাক। মেয়েছেলের ধোঁয়া খাওয়া আমার দু চক্ষের বিষ।’
তুলসী স্বচ্ছন্দে সেই বিষাক্ত দৃশ্যটা ননীর সামনে দৃশ্যমান করে আরামের ধোঁয়া ছড়িয়ে বলে, ‘তুমি তাহলে এখনো আমায় মেয়েছেলে বলে মনে রেখেছ ননীদা? আমি নিজে ভুলে গেছি।’
‘সেটা খুব বাহাদুরী নয়।’
বলে ননী নিজে একটা বিড়ি ধরায় তাক থেকে পেড়ে এনে!
‘বিড়ির গন্ধে আমার মাথা ধরে।’ তুলসী বলে।
সুখেন বলে, ‘এখন তা ধরবে বৈকি। এখন যে দামী মাথা। একদা আধখানা পোড়া বিড়ির জন্য ঘুর ঘুর করেছিস। সে সব দিন তোর মনে না থাকলেও আমরা ভুলিনি রে তুলসী!’
কথাটা মিথ্যা নয়।
তুলসীর বাল্য—কৈশোরের প্রধান সঙ্গীই ছিল এই ছেলে তিনটে। আরও একজন ছিল—ফণী। একদিন তুলসী ফণীর হাত কামড়ে রক্ত বার করে দিয়ে ফণীর সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল।
সুখেন রাজেন জগাই ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, ‘বল তো কী করতে এসেছিল, শালাকে খতম করে দিই।’
তুলসী গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘আমার ব্যাপার নিয়ে কারুর মাথা ঘামাতে হবে না। যা করতে এসেছিল তা তোরাও যে—কোন টাইমে করে বসতে পারিস। তোদের জাতকে বিশ্বাস আছে?’
নিতান্ত কৈশোরকালের দুর্মতিতে ওই মুখ্যু লক্ষ্মীছাড়া, বলতে গেলে ‘রাস্তার ছেলে’ তিনটে মাথার ওপর দায়হীন পাড়াবেড়ানী মেয়েটার সঙ্গে একটু অধিক ঘনিষ্ঠতার আশায় যে ঘুর ঘুর করেনি তা নয়, তবে সুবিধে হয় নি। তুলসীকে ভয়ও করে এসেছে বরাবর।
তুলসীকে ধোঁয়ার নেশা ধরিয়েছে ওরাই। সুখেনটাই বেশী সাহসী ছিল, সে—ই ওকে ডেকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘খেয়ে দ্যাখ না, দেখবি কী মজা!’
কিন্তু তার বদলে সুখেন যদি নিজে কিছু মজার প্রত্যাশা করেছে, ঠাস করে তার গালে এক চড় বসিয়ে পোড়া বিড়িটা তার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছে তুলসী।
অতঃপর আবার সুখেনের খোসামোদের পালা, মা—কালীর দিব্যি গালা।
তুলসী চড়া গলায় বলেছে, ‘মনে থাকে যেন। যতক্ষণ বন্ধু আছিস ঠিক আছি, ‘শত্রু’ হতে আসিস তো খুন করে ফেলব।’
ননী অবিশ্যি ওভাবে ওদের দলে ঘুরে বেড়ায়নি কখনো, বয়েসে ক’বছরের বড় বলেও বটে, আর সংসারের ধান্দাতেও বটে। দোকান দিয়েছে তো আজ নয়, কোন ছোটবেলাতে।
তখন তুলসী তার দোকানে কাজ করে দিয়েছে ঢের।
ঘর—জ্বালানী পর—ভোলানী তুলসী সেই বোতাম—খোলা পিঠ—হাঁ হাঁ—করা ফ্রক পরেই এসে এসে উদয় হয়েছে। উনানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, চায়ের গেলাস ধুয়ে দিয়েছে।
ফণীও তার সঙ্গে সঙ্গে লেগে কাজ করেছে তখন। …ক্রমে ক্রমে কখন বড় হয়ে শাড়ি ধরেছে, কেউ লক্ষ্য করেনি তুলসী বড় হয়েছে।
একদিন ননীই বারণ করল।
বলল, ‘কাল থেকে তুই আর আসিস না তুলসী!’
তুলসী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে, সংক্ষেপে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘রাগ দুঃখু করিস না।’
এটা যদি না বলত ননী, তুলসী হয়তো নিঃশব্দেই বিদায় নিত, কিন্তু এই পিঠে—হাত—বুলানো কথায় ক্ষেপে গেল। তবে চেঁচাল না কড়া গলায় বলল, ‘সে ভয় করতে হবে না ননীদা, চাকরী থেকে বরখাস্ত হওয়া আমার এই নতুন নয়।’
‘চাকরী! আমার এখানে তুই চাকরী করতিস? আমি তোকে কোন দিন মাইনে দিয়েছি?’
‘বিনি মাইনেতেই তো দূর হ বের হ, মাইনে দিলে আরও কী করতে কে জানে।’
‘তোর ভালর জন্যেই বলেছি—’
‘তা জানি।’
বলে তুলসী চলে গেছে।
তারপর আবার ননী নিজে গিয়ে যেচে ডেকে এনেছে ওর বিয়ের সময়।
‘দিদি একা, বিয়ের কাজ কে তোলে?’
ননী বলেছিল, ‘তুই আমার ছোট বোনের মতন, দিদিতে তোতে কাজ ঠেলতে হবে।’
অনুরোধ রেখেছিল তুলসী।
গতরও তো অসীম।
সেই সময় বোধহয় ওই ফণী—ঘটিত ঘটনাটা ঘটেছিল। কিছুদিন পরে ফণী পালাল।
তারপর তো গঙ্গায় কত জল গড়াল।
তুলসী লোকের বাড়ির ছেলে—ধরুনীর চাকরী ছেড়ে হাসপাতালে আয়ার কাজে ট্রেনিং নিতে গেল। তাতে পাশ করে চাকরী ধরল, নিজে আলাদা বাসা করল, দামীলোক হয়ে গেল তুলসী।
এদিকে ননীর ভাই পালালো, বৌ মলো, এবং দোকানের জন্যে কোন মাথা না খাটিয়েও আয় বাড়তে লাগল।
বাড়বেই!
যে যেখানে যে ব্যবসাই খুলে বসুক, তার আয়বৃদ্ধি হবেই। কারণটা জনসংখ্যা বৃদ্ধি। প্রত্যেকটি জায়গাতেই চাহিদার ভীড়, এই ভীড়ের চাপেই ফাটা—চটা কাঁচের গ্লাসের চা আর তার লেড়ো বিস্কুটের অনুপানও পড়তে পায় না!
শুধু আয়—বৃদ্ধির প্রশ্ন নেই চাকুরে লোকদের। তাদের মাসে বছরে হিসেব করে অঙ্ক কষে মাইনে বাড়ে। সুখেন রাজেন জগাই তিনজনেই এই রেল ইষ্টিশানের ধারে কাছে এটা ওটা একটা কাজ যোগাড় করে নিয়েছে, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে যৎসামান্য মজুরী।
যার মার্জিত নাম মাইনে।
ওদের পক্ষে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখাও পাগলামি। অথচ একদা ওরা প্রত্যেকেই সে স্বপ্ন দেখেছে। আর হাসির কথা এই, লজ্জার কথাও, প্রত্যেকেই সে স্বপ্ন দেখেছে একটি মূর্তিকে কেন্দ্র করে।
যে মূর্তিটা এক অদ্ভুত রহস্যময়ীর।
যার চোখে প্রশ্রয়, বাহুতে প্রতিরোধ, ভঙ্গীতে আমন্ত্রণ, কণ্ঠে বিষবাণ।
হয়তো এমন রহস্যময়ী বলেই এমন আকর্ষণীয়া। আর প্রত্যেকেরই কেমন মনের মধ্যে একটা আশ্বাস ছিল, তার কাছে বুঝি দুর্লভ নয়।
তাই তাকে ঘিরে ঘিরে স্বপ্নের জাল রচনা।
এটা একদার।
এখন আর সে স্বপ্নের মোহ নেই।
এখন ওরা জেনে গেছে মূর্তিটা তাদের নাগালের বাইরের বস্তু।
‘তখন যদি এই সামান্য চাকরীটুকুও জুটত,—আলাদা আলাদা করে ভেবেছে সুখেন, রাজেন, জগাই, হয়তো ও হাতছাড়া হয়ে যেত না। এখন সে দূর আকাশের তারা।
তবে আর কী করা?
যে যেমন পারে বিয়ে—থা করে ঘর—সংসার করা, এই তো? তা এমনি কপাল ওদের, যেমন—তেমনও পাচ্ছে না। রাস্তায় রাস্তায় আড্ডা দিয়ে বেড়ানো এই বখাটে ছেলে ক’টাকে যে সবাই চেনে এখানকার! দেখে জামাই করবার ইচ্ছে কারো জাগে নি।
ওদের মতই হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে দু’একটা হ্যাংলার মত ওদের পিছু নিয়েছিল, পাত্তা না পেয়ে খসে পড়েছে। পুরুষ নিজে হ্যাংলামী করতে পারে, কিন্তু হ্যাংলা মেয়ে তাদের অসহ্য।
অথচ বিয়ের বাসনাটা একেবারে বিসর্জনও দেয়নি কেউ, মনের মধ্যে আশা, ভবিষ্যতে কিছু একটা হবে। যেন সেই অদৃশ্য ভবিষ্যৎ তাদের জন্যে কী একটা উপহার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ দিয়ে দেবে একদিন। আবাল্য একসঙ্গে একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই ছেলে তিনটের মানসিকতাও যেন একই। ননী ওদের সঙ্গে তাস খেলে, ননী ওদের হিতৈষী বন্ধু, কিন্তু মনের সঙ্গী নয়।